আনোয়ার শাহাদাত
ভাদ্রমাসের অমাবস্যার রাত। এ রাতের অন্ধকার অন্ধ। ‘দোজখের আন্ধারের’ সঙ্গে তুলনীয়। কথিত আছে খাটাশও অন্ধকার-ভীত হয়ে হাঁস-মোরগের খোপে হানা দিতে নামে না। সন্ধ্যায় কুপির তেল শেষ হয়ে গেলে পরে পুনর্বার কেরোসিন ভরাও অশুভ। কোনো স্বপ্নের কথা অন্য কাউকে বলা বা মুর্দায়ের নাম নেয়া অমঙ্গল। গর্ভবতী নারীর থাকতে হবে এ ‘হারইন’ রাতে উপাস, নাহলে ভাগ্যদেবী অসন্তোষে ভয় দেখাবে, পিলে-চমকানো ভয়ে পেটের সন্তান নেমে আসবে হেঁটে। পুরনো ‘'দখল'ই তেঁতুলগাছের নিচে চার-মাথার পেতনিরা খ্যামটা নৃত্যের জলসা করে। আরও কত কী ভয়াবহ সব বর্ণনার বিভীষিকাময় রাত এটি এ এলাকায়।
তার পরও এ রাতে কতকিছু হয়! শেয়াল ও চোর তাড়ানোর বা ‘শীতলা’ আসার ভবিষ্যদ্বক্তার মতো যোগ্য কুকুর বানাতে এ রাতে দু’মাসের নিচে বয়স কুকুরছানার কান ফুটে দিতে হবে। ‘অজাত’ বেলগাছের কাঁটায় কান ফুটে পতিত কামরাঙা-মরিচ গাছের মরিচ দিয়ে ভাত মেখে ফলহীন তাল-বেগুনের পাতায় সে কুকুরছানাকে খেতে দিতে হবে।
শত্রুর আধ্যাত্মিক ক্ষতি করতে চাইলে এ রাতেই ‘বাণমারা’ ফকিরের নির্দেশমতো সংগ্রহ করতে হবে ফিকির-ই উপাত্ত। যেমন কালো কবুতর জোড়ায় তা-দেয়া ডিম, বাজা তালগাছের মাথির কচি-তম পাতা, রাঢ়ী মহিলার ধলা কাপড়ের খোঁট, ডুব দিয়ে থাকা ভাটা-মাছের চোখ ইত্যাদি।
সূর্য ডোবার সঙ্গে সঙ্গে ঘরের ঝাঁপ বন্ধ করে দিয়ে সবাই শুয়ে পড়ে। কর্ম-ক্লান্ত দেহ নিয়ে ঘুমের জগতেও সবাই চলে যায় ভৌতিক ভয়ডর ঠেলে ফেলে দিয়ে। তার পরও থেমে না থাকা রাতে যার যা করণীয় তা করে। আলতাফ মানুষের পাতা কইয়া-জাল হাতড়ায়। ওয়াজেদ পাশের বাড়ির সুপারির ঝাড়ের পাকা-কাঁচা সব সুপারি ছাপা করে ফেলে। ঝোর-খালে প্রতিপক্ষের দেয়া বাঁধ কাটা হলে সকালে তাতে জোয়ারের পানি গড়ায়। এর সব কাজই হয় অতি নিরাপদে। কেননা ভৌতিক এই রাতে কোনো প্রতিবন্ধকতারই সম্ভাবনা থাকে না। ঘরে ঘাপটি মেরে কাটায় সবাই রাত।
ওয়াজেদ বা আলতাফের মতো কোনো উদ্দেশ্যে নয়, ফুরফুরা বুড়িরও ঝাঁপ লাগিয়ে ঘাপটি মেরে ঘুমানোর কোনো উপায় থাকে না এ রাতে। মানবহীন ‘ছাড়া’ বাড়িতে ফুরফুরা নির্ঘুম রাত কাটায় খাটালে হোগল-পাতার হোগলায় দাদার আমলের মোটা কাঁথা বিছিয়ে। এ রাতে তার তন্দ্রা পড়ারও উপায় নেই। বছর ছয়-সাতেক আগে একবার তন্দ্রায় পড়েছিলো আর তক্ষুনি ডংকাবাজ ঝাঁপিয়ে পড়েছে তার দেহের উপর।
এরপর ভাদ্রমাসের অমাবস্যার রাত আর ফুরফুরায় থাকে না। সারারাত সজাগ থেকে হায় খাডাস যা, হায় শয়তান যা, খাডাস যা, যা খাডাস বলে জানান দিতে থাকে সে সজাগ।
ফুরফুরার এ রাত হারানোর পেছনে সিকু ফকিরের যন্তর-মন্তর ও কলকাঠি যে কাজ করে তা ফুরফুরা জানে। অতিষ্ঠ, নির্যাতিত ফুরফুরা একদিন লজ্জা ভেঙে হাওলাদার বাড়ির বড় মেম্বরকে নালিশও করে। মেম্বর তক্ষুনি মোটা বেতের লাঠি নিয়ে সিকু ফকিরের বাড়ি যায়।
- ‘হারামজাদা তোর পেট বেশি বাড়ছে, এককালে জনমের খাওন খাওয়াইয়া দিমু, আর যদি হুনছি ফুরির কিছু অইছে হেলে তোর ঠ্যাং ভাইঙ্গা দিমু মোর বাফের কিরা।’ সিকুর ঘুইট্টা-চালি আবারও শুরু হয় বড় মেম্বার গত হলে। বড় মেম্বরের ছেলেরা তার মতো হয়নি। কেউ মান্য করে না, সিকুও না। এরপর ফুরফুরি এ ঘটনা থেকে নিজেকে রক্ষার চেষ্টা নিজের মতো করে। এইসব তার কপালের ‘তামার পাতায়’ লিখন বলে বিশ্বাস।
ফুরফুরার উপর এ যাবৎ বেশুমার বার নির্যাতন হলো। একবার ঘটনার পরদিন ফুরফুরা খাল ভেঙে সিকু ফকিরের বাড়ি যায়। কোমল কণ্ঠে সিকুর বউকে উঠোন থেকে ডাকে- ‘ও ছোডো বউ, ঘরে আছোনি হু-মোইল দেও।’ সিকুর বউ সবুর-জান এলি-পাতার হোগলা বুনতে বুনতে সাড়া দেয়- ‘কেডা ওপারের ফুরি বাছায় নাহি, ওডো, ঘরে ওডো, আইলা কেম্মে এই ডাওরে, কার নায়ে খাল পাড় হইলা?’ সিকুর ঘরের সামনে বৃষ্টি থেকে ধরা লোটা-ভরা পানিতে পা ধুয়ে ফুরফুরি ঘরে ওঠে। সে সিকুদের ছেলের খোঁজ নিলে সবুর-জান জানায় ‘পোয়ায় গেছে বাফের লগে তাল টোহাইতে’। এ সময় চির-রোগা সিকু বাম কোলের কাঁখে হাড্ডিসার ছেলেকে নিয়ে ডান হাতে তালসহ ঘরে ঢোকে। ফুরফুরিকে দেখে ভেতরে চমকে উঠলেও ঠাণ্ডা গলায় বলে,- ‘ও, বাছা নাহি, তুমি আইলা কোন সোময়, কী সোংবাদ?’
- ‘আমারে বাছা কও কোন মুহে সিকু শরমও করে না!’ সিকু, ফুরফুরির এ’কথার কোনো উত্তর করে না। সিকুর বউ অনুমান করতে পেরে অসহায় কণ্ঠে বিলাপ করে- ‘ওরে পোড়া কপাইল্লা।’ সে সহানুভূতিতে ফুরফুরির হাত ধরে- ‘এর চাইতে আল্লায় লইয়া যায় না কেয়া দুইন্নাই-দিয়া মোগোরে।’ দু’পক্ষের এ ধরনের মুখোমুখি হওয়ার সময় সংঘাত-মুখী যে মনোভাব ও পরিবেশ থাকার কথা তা এখানে নেই এবং মনে হয় দু’পক্ষই যেনো একে অপরের প্রতি সহানুভূতিশীল। সেইরকম উত্তাপ-হীন কণ্ঠে আবার ফুরফুরি কথা বলে,- ‘মুই তোর মায়ের সোমান বেডি, ওরহম একটা কাম হরনের আগে তোর কইলজাডায় এটটু পাড় পরে না রে সিকু!’ নিরুত্তর সিকু তাল ছিলে তা একটি মাটির পাত্র আউত্তায় কচলাতে শুরু করে ছেলেকে ডাকে- ‘আয় বাজান তালের ছোলা-ডি চাইট্টা খা।’ সিকুর বউ ভেজানো কাঁচা খেজুরের বিচি দিয়ে শুকনো একটুকরো পান রাখে ফুরফুরির সামনে। সে পান গুটি করে মুখে পুরে দেয়ার আগে আবার ফুরফুরি সিকুর দিকে তাকায়, ‘মুই তোর কী ক্ষ্যাতি হরছিরে সিকু?’ সিকু সেকথার কোনো উত্তর না দিয়ে ফুরফুরিকে অন্য কথা বলে,- ‘বাছায় বুঝি পান মুহে দেয়, এহন কইতরের ঝোল দিয়া চাইরডা ভাত খাবা মোগো লগে।’
ফুরফুরির খুব মনে পড়ে জীবনে সে মেলাবার মাংস খেয়েছে। অন্তত নয়-দশবার গরুর মাংস, কমছে কম এক কুড়ি বার মোরগের মাংস, দুইবার বরকি-ছাগলের মাংস, একবার ডাহুকের মাংস, তিনবার চড়ইর মাংস, দুইবার কবুতরের মাংস। দিনগুলিও তার প্রায় ঠিক ঠিক মনে আছে। দাদুর মৌয়তের বছর, নিজের প্রথম বিয়ার বছর, ক’টা কোরবানির বছর, এক বছর একটা পথ-হারানো কবুতর, আর এক বছর একটা খাটাশে কামড়ানো কবুতর। কখন সে কবুতরকে খাটাশে কামড়ে দিয়েছে তা কেউ জানে না। পড়ে-থাকা কবুতরের গলায় খাটাশের কামড়ের জায়গায় তাজা শুকিয়ে যাওয়া রক্ত ছিলে। সে জানতো মরা হাঁস-মুরগি খাওয়া যায় না কিন্তু তা যদি শিকারি প্রাণীর কামড়ানোর ফলে মরা হয় তবে তা খাওয়া যায়। আলু দিয়ে ‘শিকারি’ কবুতরের ঝোলের স্বাদ কখনোই ভুলে যাবে না। অনেকদিন সে কোনো কিছুর মাংসই খায় না। দোষ যদি করে থাকে তা সিকু, কবুতরের কোনো দোষ ফুরফুরি খুঁজে পায় না। তা হলে কবুতরের মাংস দিয়ে ভাত খেতে দোষ কী? আর এ তো আর যেচে খাওয়া নয়, সিকুই সেধে আস্তিক করে খাওয়াচ্ছে।
সিকু নিজ হাতের আঙ্গুল চেটে নারকেলের মালাই দিয়ে ফুরফুরির থালার পাতে কবুতরের ঝোল দেয়। বেশি ঝাল হওয়ায় সিকু নিঃশব্দে নাক ঝেড়ে জীর্ণ লুঙ্গিতে মোছে। সিকুর ছেলে মোহাম্মদ হামিদ শুধুই ‘গোত্ত’ চায়। সবুর-জান ছেলের পাতে কৃপণ হাতে বারবার ঝোল দিয়ে অনাগত কোনো একদিন আবারও ‘গোত্ত’ হবে বলে প্রতিশ্রুতি দিতে থাকে। ফুরফুরির আর কোনো ক্ষোভ আছে কি না বা থাকলে তা কী ধরনের তা এখন আর বোঝার সাধ্য নেই। তবুই সিকু ফকির ফুরফুরির কাছে আত্মপক্ষ সমর্থন করে সান্ত্বনা নিতে চায়--‘বাছা পোয়াডার মুহে আইজতক গোস্ত দিতে পারছি কই? কার দারে হুনছে গোস্ত মজা, এহন গোস্ত খাইবে, পামু কই, চুরি হরমু, আছে কার, যাগো আছে হ্যাগোডা ধরলে জানে হেরা মোরে রাখপে! ক্যা, তোমার মনে নাই হিকদারগো একটা ক্যাজা মুরহা চুরি হরছিলাম একবার, হেরা মোরে পিডাইয়া কোমরডা ভাইঙ্গা দেলো হেই বছর। এহন পোয়ায় মোর গোশত খাইবে।’ সিকু আবার আঙুল চেটে রান্না-করা মাটির পাতিলে আর ক’টা শুকনা ভাত নিয়ে পাতিলের তলায় লেগে থাকা ঝোলের সঙ্গে সে ভাত মাখে- ‘হেই সোময় বুদ্ধিটা অইলে, সোহরাবের পোলা ছোমেদ দল-ঘরার আনসাইররার মাইয়া পিয়ারারে বিয়া করতে চায়। হুনছি পিয়ারা রাজি না। যাইয়া ছোমেদরে কইলাম- আতালের পাডাডা, পিয়ারারে পাইতে অইলে আগে দরকার তার মোন। যদি রাজি থাহ এমন একখান ফিহির দিয়া দিমু যে মাইয়া আইট্টা তোর দারে আইয়া লুঙ্গির খোট ধইররা থাকপে। কইলাম চেরাগ দেতে অইবে একটা কইতর, দুইডা হলইদ, পোনে একসের পুরান চাউল, দুইডা রোসন। সঙ্গে লাগবে জোড়া তাল-গাছের মইদ্যের হিকড়, বন্দ ডোবার টেপ্পনা যা জোয়ারে ভাইসসা আইছে। আর কইলাম সাত জাগা দিয়া ছাইরা দেছে হেইরম বেডিগো গোপন অঙ্গের কেশ। এ রহম উল্ডা-পাল্ডা না কইলে হালার পুতেরা বিশ্বাস করতে চায় না। হেই কইতর বাছা, হেই কইতর। মোর গালে দুইডা চোফার দিয়া দেও, মুড়া-পিছা দিয়া দুইডা পিডান দিয়া দেও।’
সুতরাং প্রেম-পাগল গ্রাম্য তরুণের কাঙ্ক্ষিত মেয়ের মন জয় করার যে আধ্যাত্মিক ফিকির এর জন্যে অপরিহার্য কিছু উপকরণ দরকার। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য একটি হচ্ছে সাত পুরুষের ঘর-করা নারীর দেহের গোপন অঙ্গের কেশ। সিকু ফকির এই কেশ সংগ্রহের জন্যই কার্তিক মাসের পাগলা কুকুরের মতো লেলিয়ে দেয় যুবক ছোমেদকে সো-লে-লে-লে। এলাকায় কথিত আছে ফুরফুরি সেই মহিলা যে কিনা সাত পুরুষের ঘর করেছে। সে হিসেবেই প্রেমিকার মন জয় করার জন্য যে কোনো প্রেমিকার কাছে ফুরফুরি অতি গুরুত্বপূর্ণ জিনিস। তাতে ফুরফুরির দেহ থেকে কেশ সংগ্রহের হিংস্র পদ্ধতিতে সে-নারী-দেহের বা মানুষের কী কষ্ট পেতে হয় তা কোনো পক্ষের বিবেচনায় আসে না। না পরামর্শদাতা ফকির-পক্ষের, না সংগ্রহকারী প্রেমিক পক্ষের। যদিও সিকু ফকির ওদিন ফুরফুরিকে কবুতরের মাংসের ঝোল দিয়ে ভাত খাইয়ে তার পক্ষ থেকে ফুরফুরিকে অন্যান্য যে-সব উপকার করা হয় তাও শুনিয়ে দিয়েছে। সেগুলো এরকম- সিকু যদি একটি নির্দিষ্ট রাত ভাদ্রমাসের অমাবস্যার কথা না বলে দিত তা হলে সারা বছরই যে ফুরফুরি বাছার খারাপ যেতো। মন দেয়া-নেয়ার এতো ঘটনা যে ফুরফুরির উপর প্রতি রাতেই চড়াও হতো ‘মনাধিকারী’রা। এটার কথাই ধরা যাক। আরও আছে, ‘মুই কইয়াদি বোলে বেডা একগাছা কেশই যথেষ্ট, আনতে গেছো হেইডু আইলেই অয়, বাহিডা তো মুই আছি। হে কতা না কইয়া দেলে হালার পোয়রা খুনাখুনি কইররা আইতো। এইডিও তোমার একটা উহুগার মনে রাইখখো। এইগুলি ইসাব কইরাই কই বাছা, বেজন্মা না, এমন কাম হইররা মুহে ভাত দেতে শরম লাগে, হেও তো খাইয়া জানে বাঁচি, নাইলে দেহি না খাইয়া মৌয়াত অইতো।’ একথা বলে সিকু ফকির বাসন-খোরায় সামান্য কবুতরের ঝোল-থাকা পাতিলে ভাত নিয়ে ওলটপালট করে যেনো একহারা জমিতে আমন ধানের বীজ বোনার আগে শেষ চাষটা চলছে। সে খাচ্ছে না। মাটির বাসনে হাঁড়ির ঝোল-জলে ভাত-মৃত্তিকায় আবাদ হচ্ছে মানুষের বিবেক, নৈতিকতা, জীবন ও জীবিকার।
ঘটনা আর রটনা এক থাকে না। সাত পুরুষ দূরে থাক, যদি এক পুরুষও তার জীবনে ঠিক করে আসতো!
নিয়তির লিখনের মতো বাল্যবিবাহ ফুরফুরিরও। প্রাণের মানুষ ফাল্গুনের ফকফকে জোনাক-রাতে পালা করে বেড়ায়। দ্ইু বছরের মাতায় তিন প্রহরের ঝোলা কলেরায় সে বাঁশ-তলায় কবর-খানায় শোয়। যুবতী ‘মাইয়া যুহুত’ আ-বিয়াত থাকে না স্বাভাবিক অন্যসব কিছুর মতো। পরের জামাই আজরাইল জাতসাপের ছোবলে ক্ষেতের আলে সেই ছর্ধ হয়ে পড়ে যায় আর ওঠে না। ওঝা বদ্যি আর কলার ভেলায় ভাসানো হয় ঠিক, কিন্তু জোয়ানের জান আর ভাসে না। কপাল-পোড়া এ নারী বিয়ে করে আর যাহোক প্রাণে মরে যেতে কে রাজি, হয় কলেরায় না হয় শাপের ছোবল। দলিল-পর্চাবিহীন ঘরজামাই বাপজানের ভিটাই পড়ে থাকে ফুরফুরির জন্য। তার পরও মজিদ মাঝি নাছোড়বান্দা ফুরফুরির পা চেপে ধরে আড়ালে ‘মোর মরণ-ফরনের ডর নাই’ কিন্তু মজিদ মাঝির তাগড়া ছেলে এসে গলায় গামছা বেঁধে ফিরিয়ে নিয়ে যায় বাবাকে। এতে ফুরফুরার সাত পুরুষের ঘরের হিসেব মেলে না। তাতে কী লোক তা-ই জানে। সাত পুরুষের মাথা-খাওয়া ছিনাল গালটা তাকে প্রাণভরে সবাই দিতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। সাত কেনো তিন সাতে একুশ পুরুষের ঘর-করা বজ্জাত মাগি বলে তাকে গাল দিলেও তার কিছু যায়-আসে না। বরং দুইন্নাই ছাড়া কথা বলার অপরাধে বক্তারই পাপ হবে সে মনোভাবই সবসময় ফুরফুরির। তা ছাড়া মানুষের ওইসব ফায়েসা খারাপ কথায় তো আর ফুরফুরির চামড়ায় ফোসকা পড়ে না। এইসব যুক্তিতে ফুরফুরি প্রতিবাদ-হীন স্থবির-প্রায়।
কিন্তু প্রেম-ফিকির-ই বানে তার শরীরের ‘অঙ্গ’ দরকার ‘সাত পুরুষের ঘর-করা’ নারী হিসেবে। ফলে বর্বরোচিত পাশবিক নির্যাতন থেকে তার আর নিস্তার থাকে না। মিথ্যা এ অপবাদে ও তার পরিপ্রেক্ষিতে অত্যাচার থেকে মুক্তির জন্য বেঁচে থাকতে বড় মেম্বারকে ধরেছিলো। বলেছিলো সিকু ফকিরকে সহ আরও দু’চারজনকে। কে কার কথা শোনে! ভাদ্রের অমাবস্যার রাত এলে দানবের হাতে ছেড়ে দিয়ে প্রাণ শঙ্কায় কাটে ক্ষণ। বুঝি বা দানব এখুনি পড়ে ঝাঁপিয়ে হালের খোপের উপর খাটাশের মতো। সে কি ওষধি ফল, না স্বর্ণলতা, না সোয়ানার তাবিজ? তাকে কেনো লাগাবে কোনো যুবকের প্রত্যাশিত মেয়ের মন জয় করতে?
এ নিয়ম ফুরফুরা দেখেছে, কেউ আসে না কাউকে রক্ষা করতে। আত্মরক্ষার চিন্তা নিজেরই করতে হয়। রামদা বা ধারালো ছ্যানা সিথানে রেখে ঘুমানো যায়, তাতে লাভ কী? দানব এলে দাও-ছ্যানার ব্যবহার ফুরফুরাকে দিয়ে সম্ভব নয়। তা সে ভাবতেও পারে না। লাল-মেয়া দোকানদারের কাছে সে আহাজারি কণ্ঠে সহযোগিতা চায়- ‘যাদু, মোরে একটা কেরেস তেলের খালি টিন দেবা, তোমারে পেরতেক হপ্তায় আসের আণ্ডা দিয়া পরিশুদ কইররা দিমু। ভাঙ্গা-চুরা, ফুডা-ফাডা অইলেও কোনো অসুবিদা নাই।’ হালি-হালি ডিমের বিনিময়েই লাল-মেয়া দোকানদার ফুরফুরিকে ভাঙা কেরোসিন তেলের টিন সরবরাহ করে জানতে চায়- ‘তোমার দেহি ক্ষেতও নাই জামরুল গাছও নাই, টিন দিয়া ঘুন্টি লাগাবা কি তোমার তেতুল-টোঙ্গা গাছে, পেতনি লড়াবা?’ ফুরফুরা তখন ডান হাত কপালে ছোঁয়ায়, কপাল ঘষে উত্তর করে- ‘মোর কফালের উপর বালা-মসিবত বইছে, দেহি লড়ান যায় নাহি।’ লালমেয়া দোকানদারের দেয়া টিন ফুরফুরি তার হাঁস-মোরগের খোপের উপর শক্ত কাইল্লা লতা দিয়ে ঝুলায়। অশ্বত্থের প্রমাণ মাপের মোটা ডাল টিনের মধ্যে স্থাপন করে। সেই ডালের মাথায় পাটের দড়ি বেঁধে দড়ির একমাথা ঘুমানোর আগে ডান-পায়ের বুড়া আঙুলে বেঁধে রাখে। অভ্যাসবশত বা এমনিতে পা নড়লে খোপের উপরের টিন ঢং ঢং করে ঘণ্টার আওয়াজ করে। ভাদ্রের এই অমাবস্যার রাতে সহসা সে ঘুমিয়ে পড়লেও ঢং ঢং শব্দে দানবেরা বুঝবে ফুরফুরি সজাগ আছে, ফিকির-ই উপাত্ত সংগ্রহ সম্ভব নয়। আর সজাগ থাকলে অসহায় ক্লান্ত ছন্দে বলবে- ‘যা শয়তান, যা খাডাস, যা আজরাইল...।’
অন্যান্য নিঃস্ব অভাবী মানুষের মতো তারও জীবন চলে। কচু-লতা, শাক সিদ্ধ, একদিন রান্না-করা ভাতের ফেন দু’দিন, আর ভাত তিনদিন, বীচিকলা খেয়ে দিনাতিপাত, এক-হালি ডিম বেচে এক ছটাক তিলের তেল, কলাগাছের মুড়া কুচি কেটে কাপর ধোয়া, যে কোনো ধরনের অসুখ হলে তেঁতুল-পাতা সিদ্ধ করে পথ্য আহার। এরকম জীবনের নির্ধারিত চক্রেরও ছন্দপতন হয় কখনো। এ বছর ধানক্ষেতে পামরির পঙ্গপাল পড়েছিলো। পরে এসেছিলো পানি বন্যা। সবাই বলাবলি করেছে এ পানি সাগর-দেশের নয়, পাহাড়ের দেশ থেকে এসেছে। সেকথা শুনে ফুরফুরিও ঝোরের পানির দিকে চেয়ে দেখেছে- ঘোলা নয়, কী ফকফকে পানি, পাতালের কাদা দেখা গেছে! পাহাড়ি সেই পানিতে ধানক্ষেতের চেহারা মোটা শ্যাওলার মতো হলো প্রথমে, পরে সব পচে গেলো পচানো পাটের মতো। ফুরফুরির ধান থাকার কথা বাদ থাক ক্ষেতই যার নেই। তাতে কী- ‘দেশি বালা মসিবত ভাগে কুত্তারও সোমান।’ কি আগাছা শাক কি কচুও তার ভাগে পড়ছে না। একটা শসা বা ঝিংগা বিক্রি- তা কোথায় কার কাছে! যে কটা হাঁস-মুরগি ছিলো মড়কি ব্যারামে শেষ হয়ে গেলো। সেই খোপের উপর পড়ে ফুরফুরি তারপর গুনগুন শব্দে কেঁদেছে। কেঁদেছে সত্য, হাঁস-মুরগির প্রাণ আর তাতে ফেরে না।
হাঁস-মুরগি-হীন খোপের উপর ঝোলানো টিনকে ফুরফুরার খুব নিঃসঙ্গ মনে হয়। সেই ‘দানব-তাড়ুয়া’ টিনের উপর তার আবারও চোখ পড়তে দীর্ঘদিন না খেয়ে-থাকা পেট বোশেখি ঝড়ে মুচড়ে পড়া বৃক্ষের মতো মুচড়িয়ে কচলায়। যেনো খাবলা কয়েক ঝুড়া-মাটি ওই খোপ কি এ ঘুণ্টির টিন পেটে দিয়ে অন্তহীন ক্ষুধা মেটাতে পারলে হতো। যা আপাতত সম্ভব নয় তা হয়েও ওঠে না।
ফুরফুরি হেঁটে খাল-ধারে যায়। ওপারের সিকু ফকিরকে জরুরি কণ্ঠে ডাকে- ‘ও সিকু, ও সিকু বাড়তে আছোনি?’
সিকু অনুচ্চ চালের ঘর থেকে নুয়ে কিছুটা ত্বরিত গতিতে বের হয়ে আসে- ‘বাছা কী সোংবাদ, ভালো আছোনি।’ খালের এপারের ফুরফুরি সিকু ফকিরের দিকে তাকিয়েই ডান পায়ের বুড়ো আঙুলে ভাদ্রের হালকা কাদা খুঁচিয়ে বলে, ‘সিকুরে পেডে রাইজ্যের খিদা, চাইর-ডা ভাত খাইছি কবে হ্যা মনে হরতে পারি না। কাইল যে ভাদ্দরের আমবইস্যার রাইত, কইতরের হুররা দিয়া ভাত খাইতে মন চায়।’ সিকু উচ্ছ্বাসিত কণ্ঠে ফুরফুরিকে লক্ষ করে- ‘দেহি, দেহি কী হরন যায় বাছা?’ বলে খাল-পার ধরে টানা পায়ে হাঁটে। ফুরফুরার দিকে না তাকিয়ে আবারও সে বলে, ‘দোয়াই আলির বাছা, মোর মাথাডার কিরা, তোমার ঢন-ঢনিডা বাজাইও না আবার, ক্ষ্যামা দিও।’
একথা বলা যায়- ভাগ্যে থাকলে সিকু ও ফুরফুরা বিবাদহীন পরিবেশে অচিরেই কবুতরের মাংস দিয়ে ভাত খেতে পারবে।
0 মন্তব্যসমূহ