ক.
মন পবনের নাও বাদাম উড়াইয়া ভাটির গাঙে ভাসে....
জলে তখন ঘুঙুর বাজে...
নাওটা সামান্য ঠেলে দিলে অনায়াসেই তা জলে ভাসলো। হামদুমাঝি পা দুটো একপাশে ঝুলিয়ে দিয়ে ঝপ করে বৈঠা নামালো। ঠিক তখুনি মোস্তফার কানে বাজলো যুগপৎ ছলাৎ এবং টিক...টিক...টিক...
নদীতে অফুরান ভিজে বাতাস। ঢেউয়েরা হেলেদুলে ভাটির দেশে ছুটে চলেছে। সব ছাপিয়ে ফের শব্দ হলো টিক... টিক...
এই শব্দের প্রতি মোস্তফার মারাত্মক দুর্বলতা জন্মেছিল। সারিগানের সুলেমান গায়েন বন্দনায় কতোভাবেই না এই টিকটিকের মাহাত্ম বর্ণনা করেছে। অন্তরায় টান দিয়েই বলেছে
‘টিকটিকি হইলো গুপ্তজ্ঞান সরপন্ন পরানি। কেমনে পাইলো সে এই গুপ্তজ্ঞান? আ...আ...আ...
সেই কাহিনী এখন বর্ণনা করিব...
পণ্ডিত বরাহ খনার প্রজ্ঞায় ঈর্ষান্বিত হয়া পুত্রকে তার নিজ বধূর জিহ্বা কাইটে ফেলতে বললো। কী আর করা। মিহির পিতৃআজ্ঞা পালন করেছিল। বুঝলেন ভায়ারা? আর বিদুষী খনার সেই কর্তিত জিহ্বা ভক্ষণ করা টিকটিকি পাইল গুপ্তজ্ঞান। তাই যাত্রার প্রাক্কালে টিকটিকি ডাকলে ভাইয়ারা জানবেন তা অতি শুভ...
মোস্তফা সারিগানের আসর ছেড়ে উৎসুক হয়ে নাওয়ের ভেতর টিকটিকের উৎস হাতড়ে বেড়ায় এবং সত্যি সে বিফল হয় না। চোখ কুচকে অনুসন্ধানী হতেই নাওয়ের পাটাতনের ফাঁক গলে টিকটিকিটা সুরুৎ করে উপরে উঠে আসে। তারপর ত্যাড়াবাঁকা দৌড়ে গলুইয়ের তলায় পৌঁছে যায়। ইতোমধ্যে তা হামদু মাঝির নজরেও পড়েছে। হামদু মাঝি ঝটতি পা দুইখানা জল থেকে তুলে আড়াআড়ি পেতে দেয়। এতে টিকটিকিটা হঠাৎ বাঁধাগ্রস্থ হয়ে কেমন যেন ভড়কে যায়। হয়তো বা বেগতিক হয়ে সে ফের পাটাতনের তলায় ঢুকে পড়ে।
শীতকাল এলেই নদীরা কেমন যেন বিষণ্ন হতে শুরু করে। জলরাশির অতল বিষণœতার ভেতর কুয়াশা নিপাট পড়ে থাকে। গাঙচিলেরা ডানায় জলজ ঘ্রাণ নিয়ে উড়ে বেড়ায়। আর হঠাৎ হাঠাৎ ডানা ছুঁইয়ে জলের বিষণœতা নাড়িয়ে দেয়। ফলে চিত্রবিচিত্র রেখায় জল ভেঙ্গে ভেঙ্গে পড়ে। টিকটিকিটা পাটাতনের তলায় অদৃশ্য হওয়ার পর মোস্তফার যেন আর কিছু করার থাকে না। অনেকটা অপারগ হয়েই সে জলের চিত্রকর্ম দ্যাখে। কিন্তু আলোর গতি তীর্যক হতে শুরু করলে কুয়াশার পর্দা দ্রুত সরে যেতে থাকে। এতে করে চৌদিক স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এতক্ষণ নদী ঘিরে কুয়াশার জাল ঝুলছিল বলে কাছের চিলগুলো ছাড়া আর সবই ছিল অস্পষ্ট। কিন্তু কুয়াশা হালকা হতে শুরু করলে নদীবক্ষে বিস্তর নৌযান আর উড়ন্ত গাঙচিল দেখা যায়! হঠৎ করে দৃশ্যপট পাল্টে যাওয়াতে মোস্তফার মনে হয় কোনো অপরূপ দৃশ্য ক্রমে চলমান হয়ে উঠেছে। আর এই অপরূপতার ভেতর কমলারঙের বাড়াবাড়ি কিছুতেই নজর এড়ায় না। আসলে মোস্তফা বিগত শীতকালগুলো ঘেটেঘুটে এ বিষয়ে একবারে নিশ্চিত শীতকালের রোদমানেই কমলা রঙের আলো। ম্যাদামারা সূর্য কছুতেই যেন তার উজ্জ্বল সাদারঙের রথটাকে টেনে আসতে পারে না। মোস্তফা অবশ্য সঠিক জাসেসা সে কমলা বেশি বালোবাসে নাকি সাদা!
সাদা নাকি কমলা! কিন্তু সে একটা বিষয় স্পষ্ট জাসে যে তার জল দেখলেই তীব্র ভয় জাগে। জলের কাছাকাছি হলেই তার মনে হয়, হয়তো বিকট এক চুলপ্যাঁচানি মাইলকে মাইল দূর্ঘ চুল দিয়ে তাকে শক্ত করে পেঁচিয়ে নিক্ষেপ করবে অতল জলে। অতঃপর গহনা অন্ধকার! পাতালগুলীর অজানা কাহিনীতে ঢুকে পড়া।
মোস্তফার এই জলজীতি এক্কেবারে অমূলক নয়। মাস তিনেক আগে তার সত্যতা সে বেশ করে উপলব্ধি করেছে। কারণ মোস্তফার দুই ছাওয়ালের বড়টা নদীতে নাইতে নেমে আর উঠে আসেনি। অথচ এক দঙ্গল ন্যাংটো ছাওয়াল পাওয়ালতো হররোজই নাইতে নামে!
নদীর পাড়ে কয়েকটা আম, বট অথবা গুল্ম জাতীয় গাছ আগোছালো দাঁড়িয়ে। তা থেকে দঙ্গলেরা জলে ঝাপুরঝুপুর লাফিয়ে পড়ে। তাদের উচ্ছাসময় ঝাঁপিয়ে ঝাঁপিয়ে মোস্তফা কতদিন নিশ্চুপ উপভোগ করেছে। দঙ্গলদের ঝাঁপাঝাঁপি খেলা থেকে কিছু শব্দও সে উদ্দার করেছে। নদীতে সাঁতার কেটে ছাওয়াল পাওয়ালরা চিৎকার করেছে
কুম্ভির তোর গাঙ্গে নাইমাছি...
কুম্ভির তোর গাঙ্গে নাইমাছি...
সেই অদৃশ্য কুম্ভির না চুলপ্যাচানি না জল-দেও কোটা যে মোস্তফার ঝাওয়ালটারে টাইসে নিল। আতিপাতি করে খোঁজার পরও তা আর সন্ধান মিললো না! জেলেরা জাল ফেলে জল ঘোলা করে ফেললো। কিন্তু মোস্তফার বড় ছাওয়ালের হদিশ আর কিছুই মিললো না! সেই অর্ন্তদাহ বুকে চেপেই মোস্তফা এই দীর্ঘ যাত্রায় পা রেখেছে। শোক কাটিয়ে ওঠার জন্যও তো মানুষের কিছু দরকার!
ছাওয়ালটা নদীতে হারিয়ে যাওয়ার পর মোস্তফা একেবারে ভেঙেচুরে গ্যাছে। বুকের ভেতর ছাই চেপে রাখা অগ্নিকুণ্ড এবার দাউ দাউ করে জ্বলে উঠেছে। কত বছর ধরে মোস্তফা এই অগ্নিকুণ্ড বুকে বয়ে চলেছে! কমলারোদের ভেতর ডুবতে ডুবতে মোস্তফা যেন আপন মনেই হিসেব কষে ‘তা প্রায় ২৫ বছর...
এমনিতর এক শীত সমুয়। আসমান আন্ধার কর্যা মেঘ করলো। আর বাতাস ক্ষেপ্যা এক্কেবারে পগোল হয়্যা গেল। পূবের আঙিনার গরগরা সেয়ানা চারখান নারকোল গাছ পড়লো! হেরপর জলদেও নাকি চুলপ্যাঁচানি মেঘনা নদীর বেবাক জল সেচ্যা ডাঙায় মারলো আছাড়। সেই জমিতে জমিন চুরচুর কর্যা ফাটা গেল। আর নিমিষেই সব পানির তলায় চলা গেল। চাইর দিকে খালি পানি আর পানি। পিনির মইদ্যে চুল প্যাঁচানির রাক্ষুস্যা ঘূর্ণি। বাজনে থই পায় না! হেরপরে আর মায়েরে দেখি নাই!
বাজানরে দেখি নাই। চক্ষু খুল্যা দেখি ফকফকা চান্দের আলো। আলো আর আলো। সেই আলোর মদ্যে মাইনসের কালা কালা মাথা। মাথাগুলান আমার উপর উপর ঝুঁক্যা খালি ফিসফাস করে... আর ফিসফাস করে... হামদু মাঝি একই ছন্দে নাও বাইছিল। আর জল ভেঙে ভেঙে সামনের দিকে এগুচ্ছিল। মোস্তফার মুখে এ গল্প বহুবার শুনেছে। আজও নিরবে শুনে গেল। মোস্তফা যখন এ গল্প বলে তখন কেমন যেন একটা ঘোরের ভেতর তলিয়ে থাকে। আজও তেমন রইলো।
হামদু মাঝি কমলাদের ভেতর পথ কেটে তাদের গন্তব্যের কাছে চলে এসেছে। তাদের এই দীর্ঘ নৌযাত্রা শেষ হলে মোস্তফাকে আরো অনেকটা যেতে হবে। ধুলো মাখা পথ ধরে মোস্তফাকে হাঁটতে হবে ঘণ্টাখানেক। সে পথের শেষ সড়কপথ। সেখান থেকে বাস ধরে মোস্তফা যাবে পশ্চিমে।
হামদুমাঝি মোস্তফাকে ভারি পছন্দ করে। তাই সে মনে স্থির করেছে, মোস্তফাকে বাসে তুলে দেবার পর সোনাদিয়া ফিরে যাবে সে।
বহু পুরাতন গল্পটা শেষ হলে মোস্তফাও যেন কথা খুঁজে পায় না। চুপচাপ হামদুমাঝির বৈঠা ধরা হাতদুটো লক্ষ্য করে। জাড়কাঁটায় পরিপূর্ণ সবল হাত
দুটোতে কোনো ক্লান্তি নেই। ভাটি বা উজানে নাও বাইতে হামদুমাঝির যে কোনো পরিশ্রমই হয় না। জলের উপর সাবলীল ভঙ্গিতে সে বৈঠা চেনে চলেছে। দুপাশের গ্রামগুলোকে দ্রুত অদৃশ্য করে দিচ্ছে...
খ.
মরমর কেঁদে ওঠে ঝরাপাতাভরা ভোর রাতের পবন। আর মনোবেদনার নদী- যার কুল নাই... কিনার নাই...
সূর্য বেশ ধীরে সুস্থে মেঘনার জলে ডুব দেয়। জলের ভেতর সূর্য ঢুকে পড়লে সমস্ত আকাশ কেমন যেন সিঁদুর রাঙা হয়ে পড়ে। নদী আর আকাশ যেখানে মিশে থাকে, সেই রেখাটুকুও লালের ঘোরে ক্রমশ নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। খয়েরমাঝি তখন নদী পাড়র কাদাপ্যাকলা বাঁচিয়ে বেশ তফাতে বসে থাকে। বসে বসে নদী আর আকাশ রেখার নিশ্চহ্ন হয়ে যাওয়া দ্যাখে। বালুখেকো ঘায়ে তার পা দুটো দগদগে হয়ে আছে। এক জোড়া পাম্প সু কিনেছিল বছর পাঁচেক আগে। সেই পাম্প সু এখন ছিঁড়েছুড়ে একাকার। পাম্প সুর ছেঁড়াফোড়া দিয়ে তার পায়ের গোল গোল ক্ষতের চিহ্ন স্পষ্ট দেখা যায়। বছরের বারো মাস খয়েরমাঝির পায়ের এমন সঙ্গীন দশা। শীতের কনকনে হাওয়ার ঘা শুকিয়ে কাঠ। ফলে পায়ের চামড়া টান ধরে দুরাবস্থা চরমে ওঠে। খয়ের মাঝি তখন অসহ্য হয়ে নদীর ট্যালকা জলে পা দুটো ভিজিয়ে নেয়। এতে অল্প সময় খটখটে ভাবটা আর থাকেনা। কিন্তু বাতাস অনার্দ্র বলে পায়ের জল ঝটাঝট শুকিয়ে ফের আগের অবস্থা। খয়ের মাঝি কি প্রতিদিন আকাশের রঙ দেখতেই নদীর পারে এসে বসে! রাত নিঝুম হলে সে ঘরমুখো হয়। আর ঘরে ফিরেই বা কী করবে? পাষান পুরীর শূন্যতা নিয়ে তার ঘরবাড়ি খা খা করে।
সেই বারের ঘূর্ণিঝড় সবচেয়ে বৃদ্ধ অশ্বত্থ গাছটাও উপড়ে ফেলেছিল। সে গাছের নিচে চাপা পড়ে আম্বরির সোয়ামী মরেছিল। খয়েরমাঝি অনেকটা নিজের তাড়নায় আস্বরিকে নিকাহ করলো। কিন্তু আম্বরি মাঝির ঘরদোর কোলাহলে ভরে দিতে পারেনি! আকাশ যেদিন জোছনা ঢেলে দেয় মাঝি সারারাত আর বাড়ি ফেরে না। ঠায় বসে বসে বিস্তার ঢেউ গুণে চলে। গুণতে গুণতে ঢেউয়ের ফণার ওপর পানসি ফের তীব্রবেগে ছুটতে শুরু করে। আর দেখতে না দেখতেই মোস্তফার মায়ের মুখটা কোনো একটা বাঁকে আড়াল হয়ে যায়। তখন খয়েরমাঝিও কেমন যেন ধন্ধে পড়ে। তখন জোছনারাতের অলীক গল্প দু-পাঁচ কানে যে পৌঁছানি তা নয়। কিন্তু কেউ তা বিশ্বাস করে না। কারণ অমন পানসির চিহ্ন কেউ এতাদিনেও দ্যাখেনি। অবশ্য খয়ের মাঝি মানুষজনের বিশ্বাস অবিশ্বাসের তোয়াক্কা করে না। সে তার মত করেই বর্ণনা করে চলে।
‘বুঝলা-এক্করে আজহাঁস। পৈথানের ল্যাজটা খাঁড়া আর শিথানের দিকটা ব্যাঁকা, আজহাঁসের গলার মতোই। আছে-তা নলে তো জন্য আষ্টেক হবই। হেরা ঝাপঝুপ বৈঠা ফেল্যা পানি কাট্যা চলে। দেখতে না দেখতেই নাও চল্যা যায় কোনোদূর! মোস্তফার না হাত নাড়ায়া ডাক্যা মরে। কী বিপদ! আমি যে যাবো উপায় আছে নিহি! বাতাস উইড়া যায় ভাটির দ্যাশে। বাতাসের লগে লগে নাওখানও তর তরাইয়া চল্যা যায়...
খয়ের মাঝির বয়স হয়েছে। তার কথায় কেউ আজকাল কান পাতে না। তাছাড়া জোছনা রাতের পানসি ভাসান শুসে শুনে লোজনের বিরক্তি ধরে গ্যাছে। মাঝির জীবন তো একবারে সায়াহ্নে এসে দাঁড়িয়েছে। বুড়ো বয়সে মানুষের কত রকম বিভ্রমই না থাকে। সেসব নিয়ে খালি খালি মাথা ঘামালে কী অন্যদের চলে!
পঁচিশ বছর আগে ভয়াল এ রাত্রিরে ফুঁসে উঠেছিল মেঘনা গাঙ্গের ক্রোধ বড় ভয়ানক। কোনোক্রমে একবার ফুঁসে উঠলো তো একেবারে চণ্ডাল মূর্তি।
সে রাতেও তাই মেঘনার তাণ্ডব থেকে কেউ রেহাই পায়নি। নয় বছরের মোস্তফা আর মোস্তফার মা যে কোথায় ছিটকে পড়েলো! তারপর জল থই থই ঢেউ। ঢেউতো নয় যেন লক্ষ লক্ষ দাড়াশ সাপের গর্জন। খয়েরমাঝির যখন চেতনা ফিরেছে তখন ঝড় জল থেমে গ্যাছে। অগণন লাশ গোর দিতে দিতে মানুষজন ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। আর খয়ের মাঝি আথালপাতাল করে মোস্তফাকে খুঁজেছে। মোস্তফার মাকে খুঁজেছে। কিন্তু কিছুতেই তাদের সন্ধান মেলেনি। চারপাশে তখন বিভৎস দৃশ্য। কারো হয়তো দুটো পা কাটা পড়েছে। কারোবা হতো কব্জি। থেৎলানো, রক্তাক্ত মানুষ দেখে দেখে খয়ের মাঝি নিজেও কেমন যেন অপ্রকৃতিস্থ হয়ে পড়েছে। হড়হড়িয়ে বমি করেছে। এক সময় অসহ্য হয়ে দুহাতের পাতায় কেচা ঢেকে ডুকরে কেঁদেছে। কিন্তু কিছুতেই নিজেকে শান্ত করতে পারেনি...
ভেবেছিল আম্বরি হয়তো তার সমস্ত জ্বালা যন্ত্রণা জুড়িয়ে দেবে। ফের ছাওয়াল পাওয়ালে ভরে উঠবে সংসার। কিন্তু তাও তো হলো না! খয়েরমাঝি ক্রমাগত নিসঙ্গতায় সাঁতরে বেড়ালো। অতঃপর একদিন অজান্তেই পানসি নাওয়ের খোয়াবের ভেতর ঢুকে পড়লো। খোয়াবের ভেতর থেকে নিজের নাওখানা তাকে ঠিকই বাইতে হলো। নাও বাইতে বাইতে দুহাতে অজস্র কড়া পড়লো। আর নাওটা ছয় ঋতুর ঝড়-জল-তাপে জরাজীর্ণ হলো। এখন তো এমন অবস্থা যে, গাঙে ভাসালেই ভুকভুক করে জল ঢুকে পড়ে। অথচ খয়েরমাছির ওতেই যে দিব্যি চলে! আম্বরি খুব করে বলে বলে তাতে কবার আলকাতরার পোচ লাপিয়েছে। ফলে ভুকভুকিয়ে আর জল ওঠে না ঠিকই তবে চুঁইয়ে জল ওঠে। তাই কিছুক্ষণ পর পর জল সেঁচে ফেললে ডুব দেওয়ার আশঙ্কা থেকে যায়।
ধীরে ধীরে বৈঠা টানলে দু-চারজন সওয়ারী এখন সে পাশের গাঁয়ে অনায়াসে নামাতে পারে। অবশ্য সন্ধ্যার পর কোন সওয়ারী তার নাওয়ে পারাপারের ভরসা পায় না। তখন খয়েরমাছির একটানা অবকাশ। সে একলা বসে মোস্তফার মায়ের পানসি ভাসান দ্যাখে। চাঁদের কৃষ্ণপক্ষ শুরু হলে ভাসান ইতিহাসও কেন যেন বদলে যায়। কারণ মোস্তফার মায়ের পানসি তখন প্রায়ই ঘাটে এসে ভিড়ে। খয়ের মাঝির ভুলভাল যতই হোক মোস্তফার মায়ের মুখটা সে অবিকল চিনতে পারে। ঘোরঘুট্টি আমাবস্যায় মোস্তফার মা পানসি থেকে ডাঙ্গায় নেমে আসে। কিন্তু মাঝি সে বসে আছে তা যেন সে দেখেও দ্যাখে না! নদীর জল ছুঁয়ে ছুঁয়ে নির্বিকার হেঁটে যায়। খয়ের মাঝি লক্ষ করেছে, তার হাঁটার গতিতে কেমন যেন এক অদ্ভুত ছন্দ থাকে। তার পায়ের পাতা জল ছুঁয়ে নয়, যেন শূন্যে ভাসতে ভাসতে এগিয়ে চলে। খয়ের মাঝি তাকে সহস্্রবার ডেকে মরে। কিন্তু মোস্তফার মা তা যেন শুনতেই পায় না। মাঝি তখন সেই ছেলেবেলায় শোনা ঝড়া সামান্য বদলে গিয়ে জোরেসোরে আওড়ে চলে-
পানসি নাও পাননি নাও
পান খায়্যা যাও
মোস্তফার বাপের কাছে
এটু বস্যা যাও....
কিন্তু কে কার ডাক শোনে! মোস্তফার মা প্রায় উড়তে উড়তে আরও সামনে এগিয়ে চলে। অগত্যা খয়ের মাঝি তার বালু খেকো ঘা ভর্তি পা নিয়ে দৌড়াতে শুরু করে। এতে পায়ের চামড়া ফেটেফুটে ঘায়ের কষ বেরিয়ে পড়ে কিন্তু তবুও সে দৌড়ায়। দৌড়ায় আর কাকুতি-মিনতি করে মোস্তফার মায়ের চলমানতা রুদ্ধ করে দিতে চায়।
‘হ্যাগা, এট্টু জিড়ায় যাও। এট্টু বস্যা যাও। কত্তো কথা যে জইমে রইছে। আমি যে আর কউরে কতি পারনি না...
না দেখতেই পানিসির তলায় স্রোত ফণা তুলে দাঁড়ায়। পানসি যেন পলকে নদীর বাঁকে অদৃশ্য হয়ে যায়!
অন্ধকারে ডুবে থাকলে চাঁদের যেমন তীব্র যন্ত্রণা হয, তেমনি যন্ত্রণায় খয়ের মাঝি ক্রমাগত দগ্ধ হয়। তবুও নদীর পাড়ে ঠায় বসে বসে সে রাত ভোর করে দেয়...
গ.
বাউল মানুষের নোঙর করে রোদেলা জমিনে! নদী জানে সকল পরান কথা...
হামদুমাঝি নাও ভাসানের প্রাক্কালে টিকটিকি ডেকেছিল! তা ছিল মোস্তফার কাছে নিশ্চিত অভয়ের মতো। প্রায় নির্বিঘেœ যখন সে দৌলতখান পৌঁছালো, ঘরে ঘরে তখন সাঁঝের পিদিম জ্বলছে। দৌলতখান থেকে দামুড্যা প্রায় ৭-৮ কিলো পথ। গ্রামের সাঁঝ মানেই তো গহন রাত। মোস্তফা কী করবে ভেবে পেল না। বিশাল বৃক্ষের নিচে অনুজ্জ্বল আলোর আভা দেখে, সে সেদিকেই অগ্রসর হলো। আর কতটা পথ! আরও কতটা পথ তাকে যেতে হবে? আসলে এবার পথে নামলে অদৃশ্য লাটাই থেকে কে যেন সুতো ছাড়তে থাকে। ফলে পথ যেন শেষ হতে চায় না! মোস্তফা ভেবে দেখলো আজ রাতে কিছুতেই আর দামুড্যা যাওয়া সম্ভব নয়। বকুল বৃক্ষের কান্ড ঘেসে তিন-চারটে মুদিদোকান। মুদিদোকান লণ্ঠনের আলোই মোস্তফাকে এখানে টেনে এনেছে।
দোকানগুলোপর আশপাশে দুই তিনটে বেঞ্চ পাতা। বেশ কিছুলোক মাফলার বা চাদরে গলা, কান, মাথা ভালোমতন ঢেকেঢুকে বসে আছে। বসে বসে খুব নিুস্বরে কথা বলছে আর চা খাচ্ছে। বকুলের ছায়া এতোটা ঘন যে লণ্ঠনের আলো ঠিকরে বেশিদূর যেতে পারে না। ফলে অনুজ্জ্বল আলোতে লোজনের চেহারা ঠিক ঠাকভাবে আন্দাজ করা মুস্কিল। শীতের প্রকোপ বাঁচাতে চাদর বা মাফলঅর এমনভাবে জড়িয়ে রেখেছে যে, তাদের অশরিরী বলাই ভালো। আলো অপ্রতুল বলে মনে হয় অশরিরীরা কায়া ধরে চুলপ্যাঁচানি টাইনে নিল! আর সে মাসেই কীনা গ্রামের হাসুর মায়ের অদ্ভুত এক ছাওয়াল জন্মেছিল! দুইটা চক্সুর বদলে তার কপালের মধ্যিখানে ছিল বড়সড় একটা চক্ষ! সে চক্ষুতে কোনো পল¬ব ছিল না। ফলে ছাওয়ালটা দিবারাত্তির ফটফট করে চেয়ে থাকতো। তার কোন ঠোঁটও ছিল না। ঠোঁটের বদলে নাকের তিন ইঞ্চি নিচে ছিল বেশ গভীর গর্ত। সেই গর্তের ভেতর হাসুর মা ঝিনুকে করে দুধ ঢেলে দিত। আর কী অদ্ভূত কাণ্ড! ছাওয়ালটা বেড়ালের মতো চুকচুক করে দুধটুকু খেয়ে নিত! দশ গাঁয়ে রাষ্ট্র হয়ে গিয়েছিল হাসুর মায়ের পেট থেকে রাক্ষুস জন্মেছে। সেই রাক্ষুস দেখতে মানুষের কী উৎসাহ। অবশ্য অবশ্য হাসুর মা এতে ভয়ানক বিব্রত হতো। তার রাক্ষুস ছেলেকে লুকিয়ে রাখতে চাই তো। কিন্তু মানুষজনেরা রাক্ষস দেখতে এতবেশি আগ্রহ ছিল যে তা সম্ভব হতো না। সেই রাক্ষুসটাকে হাসুর মা কীভাবে যে মাস দেড়েক পালন করেছিল? ভাবলে মোস্তফার কেমন যেন আশ্চর্য লাগে। লোকজন তাকে একনজর দেখে ভয়ে প্রায় পালিয়ে যেত। কিন্তু হাসুর মা অপত্য স্নেহে তাকে ঠিক আগলে রেখেছিল। সময় হেঁটে হেঁটে নদী তীরের কাশবনে দুধেল বন্যা বইয়ে দিল। আর শিউলি বোঁটায় বোঁটায় কড়া জাফরানি ছোপ। এমনি সময়ে হাসুর মায়ের রাক্ষস ছাওয়ালটা দুম করে মরে গেল! হাসুর মা আছাড়িবিছাড়ি করে কাঁদলে। আর মৃত রাক্ষুস ছাওয়াওটা চেয়ে চেয়ে মায়ের আহাজারি দেখলো। কারণ তার চোখে তো কোনো পল¬ব ছিল না। ফলে মরে যাবার পরও সে চোখ কিছুতেই বন্ধ করা যায়নি।
মোস্তফা মাথা থেকে দ্রুত হাসুর মায়ের রাক্ষস ছাওয়ালের স্মৃতি ঝেড়ে ফ্যালে। আজ রাতেই যে করেই হোক তাকে একটা আশ্রয় জোটাতে হবে। আর সকাল
হলেই সে দামুড্যার পথে রওনা দেবে। কারণ ঠিক ঠিক না পৌঁছাতে না পারলে এই দীর্ঘ যাত্রার সমস্ত শ্রম বিফলে যাবে।
দোকানগুলোর পাশে কেরোসিনের স্টোভ জ্বলছে। আর তাতেই যেন শীতের রাত কিছুটা উষ্ণতা পেয়েছে। সেই উষ্ণতায় মোস্তফা নড়েচড়ে বসে। অতঃপর দোকানির কাছে আশ্রয় সন্ধান করতেই সে একেবারে হইচই করে ওঠে।
‘আরে দামুড্যা যাইবেন! তা কার বাড়ি? আমি তো সেইখানেই বিবাহ করেছি। খয়ের মাঝি? ক্যান তারে তলাশ করেন ক্যান? শুনেছি তার তিনবুলে কেউ নাই। বুড়া থুত্থুরা হয়্যা গ্যাছে। কেমুন মতিছাড়া মতিছাড়া ভাব। কোন আমলের জলোজ্জ্বাসে নাকি সব ভাস্যা গ্যাছে। নিকা করছে কিন্তু কপাল মন্দা। বউডা বাজা। বুড়্যা আর কী করে-অহনো নাও বায়। নিরুদ্দেশ ইরিস্তি আর পোলার আশায় নদীর কাছাড়ে রাতভর বস্যা থাকে’।
দোকানির লম্বা ফিরিস্তি শুনে মোস্তফার গলা কেমন যেন অচেনা কান্নায় আটকে আসে। সে যেন কথা বলতেও ভুলে যায়! তার হাতে ধরা কাপের চা জুড়িয়ে জল হয়ে যায়। হঠাৎ মোস্তফার অমন অবস্থা দেখে দোকানিও একেবারে বিমূঢ় হয়ে পড়ে
‘আরে আপনের আবার কী হইলো! এমুন কর্যা তায়া রইছেন ক্যান?
দোকানির কথা মোস্তফা শুনতে পেল কীনা তাও বুঝা যায় না। সে তেমনি অচঞ্চল বসে থাকে। মোস্তফা মনে হয় লণ্ঠনের আলোগুলো হঠাৎ করে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। সে আলোতে বকুল বৃক্ষের ঘনছায়া কেমন যেন ফিকে দেখায়। শীতের হীম বাতাস নিঃশব্দে বয়ে যায়। মোস্তফা সেই বাতাসে কী এক অচেনা ফুলের গন্ধ পায়। বকুল! কাঁঠাল চাঁপা! নাকি লেবু ফুল! মোস্তফা তাও ঠিক চিনতে পারে না...
সুদীর্ঘকাল পর চৌত্রিশ-পঁয়ত্রিশ বছরের এক যুবক খয়েরমাঝির খোঁজ করছে! বিষয়টা দামুড্যাবাসীর কাছেও ভারি আশ্চর্য ঠেকে। কারণ খয়েরমাঝিকে এমন করে কেউ কখনো খুঁজেছে বলে তাদের মনে পড়ে না। খয়ের মাছির তো কোথাও যাওয়া আসা নেই। তার কাছেও কেউ যায় আসে না। মাঝির পানসি ভাসানের উদ্ভট কাহিনী শুনে শুনে অনেকে তাকে পাগলই মনে করে।
দোকানিকে সঙ্গে করে মোস্তফা যখন মাঝিবাড়ি পৌঁছালো কমলারোদ তখন রুপলি রঙ ধরতে শুরু করেছে। খয়ের মাঝি আজ গাঙে নাও নিয়ে যায়নি। কারণ শীতের তীব্রতায় তার পায়ের বালু খেকো ঘায়ে বড় যন্ত্রণা বেড়েছে। খয়ের মাঝি কিছুতেই আগন্তুককে চিনতে পারলো না। তবু তার মনে হয় মুখটা যেন কতকালেরই চেনা! এই যুবককে সে কোথায় যেন প্রায়ই দ্যাখে। খোয়াবে না বাস্তবে? বাস্তবে না খোয়াবে? খয়ের মাঝি হাতড়ে পাতড়েও তা মনে করতে পারে না!
‘লাল কাহু কই?’
আগন্তুকের এমন প্রশ্নে খয়ের মাঝির ভেতরটা টলে ওঠে। কে এই যুবক? সে কেন তার মৃত ভাইয়ের নাম ধরে সন্ধান করছে?
‘সে তো কবে মর্যা গ্যাছে!’
‘অ-’
একটি মাত্র ধ্বনিতে সবকটি মানুষ যেন অন্তহীন নীরবতায় ডুবে যায়! নয়া মানুষ দেখে আম্বরিও কখন যেন এসে দাঁড়িয়েছে। মোস্তফার মনে হয় এ মানুষটিও যেন তার খুব চেনা। আশ্চর্য তার নামও সে স্মরণ করতে পারে
‘আম্বরি চাচী না! কেমুন আছেন? তা আপনে...’
খয়ের মাঝি ক্রমাগত বিস্ময়ে যেন দিশেহারা হয়ে পড়ে। কে এই যুবক? মোস্তফা খয়ের মাঝির বিস্তর আঁকিবুঁকি পরিপূর্ণ মুখখানা ফের ভালো করে লক্ষ্য করে। অতঃপর সহস্র কান্না তাকে আক্রমণ করার আগেই বলে ওঠে-
‘বাপু গো-আমি তুমার মোস্তফা’
খয়ের মাঝি কী বজ্রাহত হলো? নাকি তার জিহ্বা আড়ষ্ঠ হয়ে গেল! সে কোনো কথা বলতে পারে না। কেবল ঘনঘন চোখের পলক ফ্যালে। মাঝি কিছুতেই ভেবে পায় না, পানসি ভাসিয়ে মোস্তফার মতো প্রতিরাতেই ভাটির গাঙে ছুটে যায়। কিন্তু তাজ্জব কাণ্ড! সেতো মোস্তফাকে এতোদিন একবারও দ্যাখেনি। মোস্তফা তাহলে কোথায় ছিল?
মোস্তফা কি বাপের মনোভঙ্গি আঁচ করতে পারে? বাবাকে আশ্বস্থ করতেই কী লুঙ্গিটা হাঁটু অব্দি তুলে দেখায়-
‘বাপুর দ্যাহো তুমি লগি কাটানোর সমুয় কুড়াল ছুট্টা মোর পা কাটছিল-’
মোস্তফার পায়ের কাটাদাগ দেখে মাঝি ঈষৎ কেঁপে ওঠে। আসলে মাঝি বড় অসহায় হয়ে পড়েছে। চোখের সামনে ঘটমান সবকিছু খোয়াব না সত্য এই দোটানা তাকে আরও অসহায় করে তোলে।
মোস্তফা ফের জামার আস্তিন গুটিয়ে বাঁ হাতের জড়–লটা দেখিয়ে বলে-
‘বাপু তুমি না এই জড়–ল দেখ্যা বলছেলা-পোলা আমার বাদশাহ হবো’
চামড়ায় অযুত নিযুত ভাঁজ ধরা হাত দুটো মাঝি এবার বাড়িয়ে দেয় এবং মোস্তফাকে খুব শক্ত করে ধরে। অসম্ভব ঠাণ্ডা অথচ অমসৃণ হাত দুটো মোস্তফা কিছুতেই ছাড়াতে পারে না। বুড়ো মানুষের হাতে এতোটা জোর দেখে মোস্তফাও কেমন যেন বিহ্বল হয়ে পড়ে। চেষ্টা করেও যখন সে ছাড়াতে পারে না, তখন নিজেকে সে হাতেই এলিয়ে দেয়। হয়ত দীর্ঘ পথের শ্রান্তি হঠাৎ তাকে অবসন্ন করে তোলে। মাস তিনেক আগে তার বড় ছাওয়ালটা নদীতে ডুবে মরেছে-সেই অসহ্য বেদনার কিছুটাও সে ভুলতে পারলো কীনা-মোস্তফাকে দেখে কিছুই অনুমান করা যায় না...
0 মন্তব্যসমূহ