আনোয়ার শাহাদাত
গাব-ডালের আড়াইহাতি পাঁচনির পেটান পিঠে পড়লে আর ঘাস-গোছা মুখে পোরা হয় না। লালা-মাখা লোভের জিহ্বা সংকুচিত করে নিতে হয় সাঁইটের আবালের। এ ফাঁকে মনে প্রশ্ন ওঠে- সরু আড়াই-হাতি পাঁচনি গোরু পেটানোর জন্যে মফেজ কোথা হতে পায়। নাকি সাত-সাঁজ কুপি জ্বেলে বাংলা দায়ে চেঁছে পাঁচনি চেকনাই করেছে ‘হালার পোয়’।
পিটানটা পড়ে লম্বালম্বি, মেরুদণ্ড বরাবর লেজের গোঁড়া থেকে কাঁধের চূড় অবধি। কী বাহারি চূড় কাঁধের! বাবার মহাজনের সঙ্গে শৈশবে চামটার হাট থেকে কেনা গোরু খেদিয়ে আনার শর্তে গেলে প্রথম দেখে- সাঁইটের আবাল কী? যেমন সুন্দরও হতে পারে সাঁইটের সেই আবালের চূড়। দেয়াই পড়লে তেলতেলে সেই চূড় দিয়ে ফোঁটা গড়াবে পেট-নাভির দিকে। তখন এই সাঁজের পশ্চিম আকাশের রঙের সাঁইটের আবালের রং সে পানি পেয়ে আরও গাঢ় হবে সে কথাও মনে হয়েছে, মনে পড়ে। ঠিক সেই রকমের চুড় তার যার গোঁড়া থেকে পিঠের উপর গাব-ডালের পাঁচনির পেটানোর শব্দ লাগোয়া গায়ের খেজুর ভিটায় ধাক্কা খেয়ে প্রতিধ্বনিত হয় ‘চড়াৎ’। কিন্তু কী আশ্চর্য, ব্যথা হয় না! বিরক্তিকর সুড়সুড়ি অনুভূত হয়, নরম জাম-ডাল নয়তো? সেই-বা কী করে হয়, এমনও নয় লেজের গোঁড়ায় কি মলদ্বারের আশেপাশে নরম পাঁচনির গুঁতানো যে সুড়সুড়িতে ঘাড়, পিঠ, পাছা একেবারে মুচড়ে উঠবে। আর মফেজের ব্যাটা সময়ও পায় না সাঁইটের আবালের পিঠে গাব-ডালের আড়াই হাতি পাঁচনি বসাবার যখন কিনা দো-হারা জমির উর্বরতায় বুনো ঘাসের গোছা উপড়ে পড়ে থাকে কাৎ হয়ে। এবং তারপর মই-টানা ছোপে বাঁক ঘুরবার মুখে মাথা নুইয়ে গলা বাঁকা করে জিব দিয়ে ঘাসের পাঁজাকে কোল করেছে, ছয়-দাতা যুবক তেজি আবালের মুখের দাঁতের নিচে বুনো ঘাস পিষ্ট হবে চিবুনিতে। ঠিক তখন মফেজের হাতের পাঁচনি ঠাস করে বসে পড়ে আবালের পিঠে। কী নিষ্ঠুরতা নিয়ে বুনো কালচে ঘাস পড়ে থাকবে এই বিরান ক্ষেতে, হালিয়া মফেজের দোষে। আবাল অতঃপর রাতের এক প্রহর পার করে ঘুম ভেঙে সেই দলা ঘাস চাবকাবে না। থেমে, টানা সময় নিয়ে লম্বা ঢেকুর তুলে জাবর কেটে ‘হারান’ ক্ষেতের ওই বুনো ঘাসের স্বাদ নেয়া যাবে না। চৈত্রের উঠানের খুঁটি-গোঁড়ায় দাশ-মশা এলে চামড়ায় ঝাড়া মেরে লেজ তুলে তাড়িয়েও দেয়া হবে না খালের ওপার। গোবরের পোকা কাঁধের জোয়াল ঘায়ে কিচকিচ করে কামড়ালে তালগাছের গোঁড়ায় আবাল এমন ঘষা দেবে পোকারা ঝুড়া-কাদা-মাটির মতো মিশে যাবে আবর্জনায়। সে ঘষায় যদি জোয়াল ঘা ফেটে রক্তের দরিয়াও বয়ে যায় তবুও আবাল পোকাদের ছেড়ে দেবে না চলে যেতে। ভালোই হতো তখন যদি চেকনাইছা দূর্বাঘাস ডলে ওই জোয়াল-ঘায়ে চেপে ধরে রক্ত বন্ধ করা সম্ভব হতো। কিন্তু কথা হচ্ছে সেই সময় ঘাস-গোছার দলা মুখে নিতে গেলে পরে পিঠের উপর মফেজের ব্যাটা পিটানটা ঝেড়ে দেয়।
তখন আবালেরও ইচ্ছে জাগে না তেমন নয়। লেজ তুলে হল্লা করে দৌড়ানোর কথা মনে পড়ে দেড়-বছরি কৈশোর-কালের মতন। ছিটকা মেরে ফেলে দিতে হয় কাঁধের জোয়াল, যাতে টান সামলাতে না পেরে বাঁয়ের গজাল বলদ হুমড়ি খেয়ে থুবড়ে পড়ে মাঝ-ক্ষেতে। মফেজের হাতে লাঙল কুটি বেরিয়ে গিয়ে ফাল উপরে উঠে আবার জমিনে ঢুকে যাবে বিঘাত দেড়েক, তখন মফেজের কী যে হবে সেকথা সাঁইটের আবাল জানে না, জানে না মফেজও।
খাড়া সূর্য পশ্চিমে ঢলতে শুরু করলে মফেজ হাল ছেড়ে দেয়। আবাল জোড়া বিলের ঝোড়ের খালে ঝাঁপিয়ে পড়ে মুখ ডুবিয়ে পানি খায় দীর্ঘ সময় ধরে। সাঁইটের আবালের ডান পায়ের নিচে বাইন-মাছ মোচড় মেরে পিছলে চলে যায়। সহসা থুতনি ডুবিয়ে দেয় সাঁইটের আবাল। কাদায় সুচারু হাত বোলাতে গো-আবালের সামনের পায়ের শক্ত খুরকে হাঁটু ভেঙে ওঠানামা করেই ক্ষান্ত হয়ে যেতে হয়। পেছন থেকে মফেজ হ, বো-বো বলে আবালদের খালে থাকতে নির্দেশ দেয়, গায়ের কাদা ধুয়ে দেবে বলে। নির্দেশমতো গোরুদ্বয় দাঁড়িয়ে থাকে খালে কিছু একটা অবলোকনের ভঙ্গিতে। মাথার কাছে উড়তে থাকা গুটি পোকা তাড়ায় শপা-শপ কান ঝাঁকিয়ে। স্রোত শ্যাওলা গা ঘেঁষে চলে যেতে থকে নরম বিলি কেটে। উলঙ্গ কিশোর খোল-ওঠা একটা কলাগাছ ‘রমণী-আঁকড়ে’ ধরার চোয়েও গভীরতায় জড়িয়ে পাল-ছুট হাঁসের মতো যেভাবে স্রোতে ভাসে। এবং তখন মনে হতে থাকে অন্তহীন কাল কলাগাছ রমণী হয়ে ভেসে থাক যেথা। আগাছার লসমি মুঠো ভরে মফেজ আবালের লেজের গোঁড়া ডলে ধোয়া শুরু করে। বোতল বুইন্নার হাটের অলস বলদ ভুস করে মাথা ডুবিয়ে দেয় পানিতে পোকা নি®িকৃতির জন্যে। তখন মনে হয় ছেলেবেলায় গরমে মোষ কাদায় ভুস করে মুখ লুকালে মফেজ, আয়ুব, রহম আলি সমস্বরে জাগৈর দিয়ে ওঠে—ও মইষ তোর কানে খইল।
জোয়ারের জল ভেঙে কেমন ঝুপঝুপ শব্দে বলদ-জোড়া ক্ষেত ছেড়ে ভাঙার পাড় বেরিতে ওঠে। এরই ফাঁকে কালবৈশাখী থেকে শ্রাবণ হয়ে ভাদ্দরে ঠেকে। পৌষা আমনের ভুঁই রোপণ-শেষে চুই-চ্যাবা পিঠা দিয়ে মৌসুম বিদায় জানানো হয়ে যায়। কেবল পানি-কাদায় ভিজে হালিয়ার পা-দুখানার প্যাকে চোখে খেয়ে পচিয়ে দেয়ার পর্বটি গেঁথে থাকে মনে যা ফুলকে ফুলকে উঠে আসে স্মৃতিপটে বড় বেদনার পালা নিয়ে।
আম-বতীর পূর্ণিমার জোবা থেকে বালাম আর রাজা-শাইল ধানের বীজ বপনের তাড়াহুড়োর শেষ ভাদ্দরের অবধি দিনগুলো পর্যন্ত পা-দুখানা বেড়াল-মরার পচন ধরে। কাঁঠালতলি হাটের সুশীলের মনোহরি দোকানের নীলাম্বরী তুঁতে গলিয়ে গরম পানিতে মিশিয়ে পায়ে মেখে যন্ত্রণার কান্না চেপে যেতে হয়। পায়ের কাছে তুষ-ভরা তাওয়া জ্বেলে প্রভাত-তারা ওঠা অবধি ছেঁকা হয় পা। নিরবচ্ছিন্ন যন্ত্রণা-কাতর তন্দ্রা-নির্ভর ঘুমিয়ে উঠে গোরু-ঘরে খুঁটার দড়ি খুলে কাঁধের লাঙল জোয়ালের ভারে পচা গোবরে পা দুখানা তলিয়ে যায় যথারীতি। রাতভর ছেঁড়া-ফাড়া পচা ঘাযুক্ত পদযুগল সুশীলের দোকানের তুঁতে মেখে তুষের তাওয়ায় যে টালিয়ে ভাজা হয় তা গোবরে পচা রসে ভিজলে কামড়াতে শুরু করে তলপেটের পেশাব-জনিত ঝামেলার চিনচিনে ব্যথা নিয়ে।
কোনো কারণ ছাড়া মনে পড়ে ভাদ্রের সারা চাষের আগে জোড় বলদ মরে গেলে বাবা মেছের হালিয়া কেমন করে গোরুর উপর পড়ে আহাজারি করে। দাদির মরণ তার সামনে কিছু নয়। সে নিয়ে ক’দিন বাদ আজগর খোঁটা দিতে ছেড়ে কথা বলে না-
‘মেছের তোর মায় না অইয়া আলের গোরু অইলে মন্দ অইতে না, যে রহম কাঁন্দলি মরা গোরুডার উফরে পইড়রা, তোর মায় মরলে পর দেহি গেলি খোন্তা কোদাল লইয়া কয়বর খোদতে’।
আজগরের এই অভিযোগের ব্যাখ্যা মেছেরের কাছে ছিল কি না কে জানে, তবে উত্তর সেও একটা করে তা এরকম-
-তোর আল-আলুডি, গোরু-ছাগল, হাঁস-মুরগা, নাও, ঘর-দুয়ার, কিছু নাই। হালের জোড়ের বলদ মরার কষ্ট তুই বুঝবি-ডা কী?
মেছেরের ছেলে রশিদ গোরু মরলে বাবার কন্নায় দোষের কী আছে আজগরের এ কথার কোনো অর্থ উদ্ধার করতে ব্যর্থ হয়, কি দাদি-বু মরলে বাবার না কান্নার কী এমন খোঁটা মারার বিষয় হতে পারে তাও সে বোঝে না যেমন আজগর কেনই-বা বুঝবে না হাল, বলদ, নৌকা না থাকলে তার দরদ। সেই রশিদের এসব না বোঝার দিন চলে গিয়ে বরং বোঝার দিনে হেঁটে যেতে থাকে। মেছেরও শ্রাবণের রাতে চারদিকে থৈথৈ প্লাবনের মধ্যে মরে গেলে রশিদ মফিজকে কবর-খোলার প্লাবন-আক্রান্ত নয় উঁচু কোণায় ত্বরিত কবর খুদে দাফনের কথাই বলে। না হলে মুদ্দার রাখার শুষ্ক ভূমি আর মিলবে না কোথাও। এরও পরে মরা মায়ের উপর না পড়ে জোড়ার বলদের উপর পড়ে কান্নার গূঢ় অর্থ পরিণতিতে রশিদের কাছে আর দুর্বোধ্য কিছু থাকে না।
শীতের মাঝরাতে গাই বাছুর প্রসব করলে মেছের আর মায়ের অস্থিরতায় সারারাত কুটায় আগুন লাগিয়ে নবজাতককে ছেঁক দেয়ার জায়গায় এখন রশিদ প্রতি-স্থাপিত। এও রশিদ বোঝে আজন্মকাল ধরে বাবা মেছের তার বাবা, পিতামহ, তারও বাবা-পিতামহরা পর্যায়ক্রমে লাভ করেছে এইসব অভিজ্ঞতা।
গোরুদ্বয় জানা নিয়মে চেনা পথে বাড়ির দিকেই আসতে থাকে যথারীতি, মফেজের খুব বেগ পেতে হয় না বিবিধ নির্দেশ দিতে। মাঘের শেষে সংরক্ষিত কুটার গড়া কুড়ের খৈল-মাখা ভেজানো কুটা কুমার-বাড়ির বিরাট চাড়িতে খেতে মন্দ লাগবে না এমনকিছু। তারপর গেল রাতের বর্ষার ছাঁটে ত্যানায় ভেজা ঘরের মেঝেতে ছড়ানো উষ্ণ ছাইয়ে গা এলাতে, পাতলা কাঁথার আমেজ মিলবে নিশ্চয়।
ভুঁই হতে বাড়ি ফিরতে ছাতন-তলায় মোহাম্মদ দফাদার সামনে পড়লে রশিদের ইচ্ছে হয় সাঁইটের আবালের মোষের মতন তিন-দিনের চাঁদ আকৃতির বাঁকা দুখানা সিং দিয়ে এক মস্ত-বড় গুঁতায় মাটিতে ঠেসে ধরতে। সারাজীবনের বদ খাসলতির একটা সুরাহা হয়ে যাক আজ এই-ক্ষণে। আবালেরও যে বিবেক আছে তা টের পায় না মফেজ বা মোহাম্মদ দফাদার। কিন্তু তারা দ্যাখে সাঁইটের আবাল পৌষ বীজধানের ভিটার কান্ধিতে সিং দুটো পুঁতে ফেলে গর্জন তোলে। মফেজ আবালকে এই বেলা সিং-এ কাদা লাগাতে বারণ করে- ফের, ফের আবাল!
ছয় মাসের জল-কাদা-পাঁক খাওয়া ঘা হয়ে যাওয়া পচা পায়ের দুর্গন্ধে সিথানের গামছায় মুখ চেপে যন্ত্রণার ঘুমের রাত আর আসবে না ভেবে রশিদের আনন্দ হয় সত্য। কেননা সাঁইটের আবালের পায়ের কালা শক্ত খুরার দাপটে পানি-কাদাই যেন ভীত থাকে দূরে চলে যেতে।
পাখিদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ভোরে ডান-বাম কাঁধে লাঙল-জোয়ালের সঙ্গে গামছাবাঁধা গামলার আধ-ভরা পান্তা, ছেটানো লবণের পাশে পোড়া মরিচ নিত্যদিনের আধপেটা সূচনার সম্ভাবনা আর থাকে না। আগাছা হোক, কি দল-ঘাস, রাস্তায়, খাল-কিনারে, ক্ষেতে কিছু-না-কিছু ঘাস-পাতা জোটেই নিয়মিত। হেলে-চাষার নিজের ভাগ্য যত অনিশ্চিত থাক আবালের গোরুর পেটের প্রতি সহানুভূতিশীল তা রশিদ নিজেই ভালো জানে।
মাঘের শেষে গোরুদের অন্যরকম জগতের প্রতি রশিদ আকর্ষণ উপেক্ষা করার কথা ভাবতে পারে না। খুব ফজরে উঠান-গোয়ালা ছেড়ে দড়ি-হীন বেরিয়ে পড়া যায় সদ্য ফসল ও বিস্তীর্ণ ক্ষেত-ভূমিতে। দফাদারের ধানের ছোপা, এর-তার শাক-পাতা বিশাল মাঠের ছাড়ানো-ছিটানো ঘাস পাতা-রাজির সামনে কিছু নয়। সাঁইটের পদ চারণা অনাকাঙ্ক্ষিত গণ্য করার কোথাও কিছু নেই বলে মনে হয়। খোঁয়াড়ে দিতে সিদ্ধহস্ত মোহাম্মদ দফাদারের বদ স্বভাব আগে জানা থাকলে আবালের দুঃসময়ের কী থাকে! ফাল্গুন সাঁঝে ঘরে ফিরতে বাড়ির হালট পথে একাধিক গোরুর পায়ের ঝাপটায় ধুলোর ঝড় উঠলে নতুন বউ আঁচলের কাপড় টেনে মুখে চেপে খুক খুক কাশি দিয়ে গোরুদের আস্তে হাঁটতে অনুরোধ করে গো-ধুলার ঝড় কমাতে।
একপর্যায় দুরকম ঘটনা ঘটে।
চৈত্রের দুপুরে পড়ন্ত বেলায় এলি-পাতার হোগলা বিছিয়ে তেঁতুল-গাছতলায় গরমের মধ্যে কাৎ হয়ে ঘুমিয়ে থাকা রশিদের পিঠে ও বুকে পেটে নোনা ঘামের ফোটা গড়াতে থাকে, ঘুমে স্বপ্নের জগতে সাঁইটের আবাল হয়ে যাওয়া রশিদের আবার মনে হতে থাকে, সে কী, আবালের পিঠে এত সাপ হাঁটবে কেন! সে তো কোনো পোয়াতি গাই নয় যে জাত-সাপ দুধের বানে চুমুক লাগাতে এসেছে! তখনই রশিদের ঘুম ভেঙে গেলে দেখে গায়ে ঘামের ফোঁটা গড়াচ্ছে নতুন পুকুর কাটলে যেমন গভীর তলা ঘামিয়ে প্রথম পানি জমতে শুরু করে।
আর ঘুম পাতলা হয় বাড়ির ‘দরজা’র খাল পাড়ে এপার-ওপাড় হাডুডু পার্টি খেলার সেট ওঠার শোরগোলে।
এমন কথা রশিদ শোনেনি কখনো তা নয়, ‘নইদের চাঁন’ কুমীর হলে আর মানুষ হতে পারে না রূপকথায় অন্যরা সবাই বেদনা বোধ করলেও বয়ান-শেষে রশিদ বয়াতিকে প্রশ্ন করেছে সরল মনে- ধরেন চাঁন কুম্ভীর অইলেই-বা এমন খারাপ কী বয়াতি মিয়া?
বয়াতি এ-ধরনের প্রশ্ন এই প্রথম শুনে শুধু হাঁ হয়ে থাকে উত্তরহীন।
সেও স্বপ্নে মনের মতো সাঁইটের আবাল হয়েছে এবং ভেবেচিন্তেই তার এই রূপান্তর ভালোভাবে মেনে নিয়ে। এই মেনে নেয়া তার কোনো অন্যায় হল কি না সে-ব্যাপারে বুঝে উঠতে পারে না। নাকি আকবর মুসল্লির কাছে জানতে চাইবে এই ‘সোয়ানা’র পরিণতি সম্পর্কে তার খোয়াবনামা কিতাবে কী লেখা আছে? রশিদ তাও জানে, আকবর মুসল্লি মেয়ে-ছেলে জড়িয়ে দুইখান ভণ্ড কথা শোনাবে তার খোয়াবনামা থেকে।
রূপান্তরিত যে-জীবন রশিদ হারালো তার হাহাকারে এক অস্থিরতায় ত্বরিত গামছা কাঁধে ফেলে দরজায় হাডুডু শোরগোলের দিকেই এগোয়। একজন তাকে দেখে সত্বর খবর দেয়-
দুই-পারই সেডা-সেট, কোডা-কোট, তুমি নামলে মোগো পার এই সেট পাইবে।
রশিদ ভ্রুক্ষেপ-হীন ডানদিকে হাডুডুর কোট ফেলে খালের পাড়ে চলে যেতে থাকে। কোট থেকে পেছনে মফেজ রশিদকে উদ্দেশ্য করেই হালচাষের ভাষায় ফাজলামো করে- হ. হ. বো. বো, ওম্মে যাইস না।
তার মনে হতে থাকে, না, স্বপ্নে সাঁইটের আবাল মফেজের সব নির্দেশই শুনেছে, এখন আর সে তা শুনতে রাজি না। তবে সে ঠিকই সাঁইটের আবাল, খালে নেমে সাঁতার কেটে ওপারে যায়, গায়ে ঝাড়া মেরে পানি সব মাটিতে ফেলে হেঁটে যাবে যেদিকে ইচ্ছে হয় সেদিকে। লেজ উপরে তুলে কিশোর বাছুরের মতো দৌড়ুবে। কিন্তু ছয়-দাঁতের-যুবক-আবালের তা সাজে না ভেবে সাঁইটের আচারণই শ্রেয় মনে করে।
পরিশেষে একটি তফাত দাঁড়ায়, স্বপ্নে সাঁইটের আবালে রূপান্তরিত হয় অনিয়ন্ত্রিতভাবে, আর এখন স্বেচ্ছায়।
পেছনে পড়ে থাক ওইসব হাডুডু, শোরগোল, মফেজেরা সব।
-------------------
নিউইয়র্ক, অক্টোবর ’৯৬।
0 মন্তব্যসমূহ