শাহনাজ মুন্নী
তখন আসর ও মাগরেবের মধ্যবর্তী এক অতীব স্বল্পকালীন আশ্চর্য সময় প্রবহমান, হাসান হোসেনের শহীদি রক্তের লালিমায় পশ্চিমাকাশ
প্লাবিতপ্রায়, হাতে সময় অত্যন্ত সংকীর্ণ। এরই
মধ্যে মসজিদের গলির সামনে আবদুর রব স্বপ্রণোদিতভাবে তার দাওয়াতের কাজকে নিজের
জিম্মাদারী ভেবে তা পালন করার নিয়তে উন্মুখ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আবদুর রবের বয়স অল্প
হলেও তার মধ্যে একটা নিবেদিত প্রাণ ভাব রয়েছে। সে নিজের মধ্যে দ্বীনের সৌন্দর্য
বিকশিত করতে এবং গাফেল মুসলমানের মধ্যে ঈমানি চেতনা জাগিয়ে তুলতে তৎপর কেননা সে, আবদুর রব জেনেছে পবিত্র বাক্য সমূহ ...‘‘আর তোমাদের মধ্যে এমন একটি দল থাকা উচিত যারা আহ্বান জানাবে সৎ কর্মের প্রতি, মঙ্গলের প্রতি, বারণ করবে অন্যায় ও নিষিদ্ধ কাজের, আর তারাই হবে সফলকাম। আজ দুনিয়ার মানুষ এই দাওয়াতের কাজকে নিজের জিম্মাদারী বা
হুকুম বলে মনে করে না .. তার মধ্যে দ্বীনের সৌন্দর্যও বিকশিত হয় না। আজ দ্বীনের
মূল্য নাই, কারণ আজ দ্বীনের দাওয়াত নাই।’
আমি চমকে উঠি। আজকাল যে কোন
কিছুতেই চমকে উঠা আমার স্বভাব হয়ে গেছে। আমি ভ্রু কুঁচকে অল্পবয়সী ছেলেটির দিকে
তাকাই। প্রায় সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। চারিদিকে আবছা অন্ধকার। আমার সন্দেহ হয়। আমি ওকে
এড়াতে চাই। আসলে এই ক্ষণে যখন আমি পলায়নের পথে পা রেখেছি তখন সকলকেই তো এড়াতে চাই
আমি কেননা এটিই লুকিয়ে থাকার সবচে উত্তম পন্থা। আমি তাকে না শোনার ভান করে সামনে
যাওয়ার জন্য পা বাড়ালে ছেলেটি সম্ভবত আমার বিরক্তিকে অনুধাবন করতে না পেরে নিজের
দীর্ঘ দেহের সারল্য নিয়ে প্রায় পথ আগলে দাঁড়ায়,
‘মাগরেবের আজান হয়ে গেছে, ফরজটা আদায় করে যান ভাইসাহেব’ সে বলে।
আমি এইবার সামনে দাঁড়ানো তরুণকে
চিনতে পারি, এদের অনেকের সঙ্গেই আগে বহুবার
বহুস্থানে দেখা হয়েছে আমার। আমি তাদের ধর্মপ্রচারের বিপুল উদ্দীপনায় অবলীলায়
ঠান্ডা পানি বা জল ঢেলে দিয়ে বলেছি, ‘আমি তো ভাই হিন্দু ..’
এমন কথায় এই নাছোড়বান্দাদের খুব
সহজেই কাবু করা সম্ভব এবং তখন তারা জিহ্বা কেটে একজন বিধর্মী মূর্তিপূজকের সামনে
থেকে দ্রুত নিজেদের প্রত্যাহার করে নেন। এর হাত থেকে মুক্তি পেতে, এক্ষেত্রেও যখন আমি চকিতে সেই কৌশল অবলম্বন করার কথা ভাবছিলাম তখনই হঠাৎ গলির শেষ মাথায় আবছা ভাবে দেখতে পাই আমার শত্রু
শ্রেণীর একজনকে, এখন এই মুহুর্তে যার মুখোমুখি
হলেই সমূহ বিপদ। অতএব এতক্ষণের উটকো ছেলেটাকে আমার কেমন ত্রাণকর্তা মনে হয় এবং আমি
তাৎক্ষণিক কোন ‘উত্তর না দিয়ে নিজেকে সহসাই
শত্রুপক্ষের আড়াল করার জন্য দ্রুত তার সঙ্গে মসজিদের মসৃণতায় ঢুকে পড়ি। মসজিদের
মোজাইক করা দীর্ঘ মেঝে অতিশয় সাদা, শীতল এবং পিচ্ছিল মনে হয়। লম্বা লাইনে
দাঁড়িয়ে মুসল্লীদের সাথে এক সুরে ‘আল্লাহু আকবর’ বলে ইহরাম বেঁধে আমার মনে পড়ে না শেষ কবে জামাতে নামাজ পড়েছিলাম। আব্বার সাথে? না, নানার সাথে? নাকি আমাকে বড় চাচা নিয়ে গেছিল? কবে সেটা? .. সবার সঙ্গে
রুকুতে যাই, সেজদায় যাই, মোনাজাত ধরি .. দেখি সূরাগুলি মনে আছে, সময়মতো ঠিকই ঠোট নড়েছে, অবাক লাগে, সেই কবে শিখেছিলাম তারপর ভুলেও
গিয়েছিলাম, কিন্তু আসলে তো ভুলি নাই, মনের মধ্যে কোথায় যেন সবই লুকিয়ে ছিল। আসলে কি মনে ছিল, না-কি মাথায় ছিল, মাথায় না মগজে .. বয়ান শুরু হয় .. ‘‘দুনিয়ায় বর্তমানে যা কিছু পাপ, যা কিছু অন্যায়, অরাজকতা তা
হইতেছে শুধুই আমাদের গোনাহগারির কারণে
.. আমাদের পথভ্রষ্টতার কারণে, এই অবস্থার অবসান চাইলে আমাদের মেহ্নতের সাথে দোয়া করতে হবে, আল্লাহ পাক বলেছেন, যে কেহ মেহনত করবে, সে নিজের
মেহনতের ফল নিজে পাবে। একদিন আমাদের মেহ্নত ও দোয়ার বরকতে পুরা পৃথিবীতে হেদায়েতের
হাওয়া ছড়াইয়া যাবে ইনশাল্লাহ্্ ..’’
আমি উস্্খুশ্্ করি, আমার অস্থির লাগে, এইখানে মসজিদে বসে নিরামিষ বয়ান শোনার সময় আমার আছে নাকি? বাঁচতে হলে আমাকে এক্ষুণী পালাতে হবে এই শহর ছেড়ে যত দ্রুত
সম্ভব চলে যেতে হবে আত্মগোপনে, সকলের চোখের
আড়ালে। আমি বয়ানের একঘেয়ে সুর উপেক্ষা করে সন্তর্পণে উঠে বাইরে চলে আসি। নিজেকে
বেশ মুক্ত আর নির্ভার লাগে। গা ঝাড়া দিয়ে সামনে খানিকটা এগিয়েই টের পাই পেছনে
পেছনে তরুণ ছেলেটিও আসছে। বিরক্ত লাগে, ব্যাটা, পিছু ছাড়ে না কেন? টিকটিকি নাকি?
‘ভাইজান, চলে আসলেন যে !’
বহু কষ্টে মেজাজ নিয়ন্ত্রণ করে
নিচু গলায় বলি,
‘না, আমার একটু কাজ আছে তো, ঢাকার বাইরে
যাবো।’
‘আমরাও আজকে রাত্রে যাচ্ছি ভাইজান, রাজশাহীতে, তাবলীগ জামাতে..’
যেখানে খুশি যা, গিয়ে মর। আমার বেরুতে হবে নিরুদ্দেশের পথে। আমি ওকে পেছনে
ফেলে সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসি। মনে মনে ঠিক করে নেই বিস্তারিত পলায়ন পরিকল্পনা। মোবাইল সেট
খুলে সিমটা ফেলে দেই প্রথমে। এবার বাস বা রেল ষ্টেশনে .. কিন্তু না, আমাকে আবার ফিরে আসতে হয়, কি জানি, আমার নিয়তিই হয়তো আমাকে ফিরিয়ে
আনে। দেখতে পাই ওরা কয়েকজন মসজিদের গলির সামনে দাঁড়িয়ে আছে। ওরা কি আমার জন্য
অপেক্ষা করছে? টের পেয়ে গেছে আমি এখানে এই
মসজিদে ঢুকেছি ? কিন্তু তা কি করে হয় ? যদ্দুর জানি আমাকে কেউ দেখেনি। তবে এতো নিশ্চিতই বা হই
কিভাবে?
শত্রুকে ছোট করে দেখতে নেই। অবশ্য রাত হয়ে গেছে, এখন সাহস করে একটা ঝুঁকি নেওয়া যায় বটে, সেটা হলো অন্ধকারের মধ্যে মুখ ঢেকে ওদের সামনে দিয়েই কোন
পরোয়া না করে গট্্গট্্ করে হেঁটে চলে যাওয়া। কিন্তু এই ঝুঁকি নেওয়াটা কি ঠিক হবে? যদি ধরা পড়ে যাই .. ওরা কি তখন আমায় বাঁচতে দেবে? রক্তের বদলা তো রক্ত দিয়েই নিতে হয়।
মগরেব ওয়াক্তে আকস্মিক দাওয়াত
কবুল করে মসজিদে নামাজ পড়তে আসা অচেনা লোকটাকে আবার ফিরে আসতে দেখে আবদুর রব ভারি
খুশী হয়। ‘জামাতে যেতে চান ভাইজান? আলহামদুলিল্লাহ্ .. চলেন.. বাড়িতে বলে আসছেন তো? বলার কেউ নাই? ঠিক আছে, কোন অসুবিধা নাই আমি থাকতে .. মাল
সামানা সঙ্গে কি নিবেন? কিছুই না ? মারহাবা, এই তো আসল
আল্লাহর পথের পথিক। ভাইজান আপনের নামটা বলেন’
আমি গত বছর র্যাবের হাতে ধরা
খাওয়া আমার এক শিষ্যের নাম বলে দেই। তারপর এশার নামাজ শেষে দীর্ঘ বয়ান শুনে আমি
যখন তাবলিগী দলটার সাথে জোট বেঁধে চিল্লায় বেরিয়ে যাচ্ছি, তখনো দেখলাম ওদের দলের একজন মসজিদের গলির সামনে দাঁড়িয়ে এক
মনে সিগারেট টানছে।
আমাদের তের সদস্যের দলটা
বৈচিত্র্যময়। এতে দুজন দাড়িঅলা ডাক্তার, একজন ক্লিন শেভড ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়র, আবদুর রবের মতো মাদ্রাসার দুই জন তরুণ ছাত্র, একজন পান বিড়ি দোকানদার, একজন রুগ্ন
রিকশাচালক, একজন বয়স্ক স্কুল মাস্টার, একজন জোয়ান রাজমিস্ত্রি এমনকি একটা প্রাইভেট টেলিভিশন
চ্যানেলের ভিডিও এডিটর পর্যন্ত আছে। দল বেঁধে বের হওয়ার আগে মসজিদেই সবার সাথে
সবার পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়েছে। দলে আমিসহ আরো দুজন এই মূহুর্তে বেকার বলে নিজেদের
পরিচয় দিয়েছি। আমার আসল পেশা কি সেটা তো আমি ঠিকই জানি, বাকি দুজনও আমার মতো নাম পরিচয় ভাড়িয়ে এসে দলে ঢুকেছে কী-না
কে জানে। হাঁটু পর্যন্ত লম্বা পাঞ্জাবি পরলে কি হবে ভাবসাব তো ছিঁচকে চোরের মত ।
আমরা ভোর নাগাদ এসে পৌছুলাম
রাজশাহীর একটা বড়-পুরনো মসজিদে, মসজিদের লাগোয়া
আবার বিরাট এক গোরস্থান। কাল সারা রাত ট্রেনের মধ্যে এক ফোটা ঘুম আসেনি, একঠায় জেগে বসে ছিলাম, সকালে মসজিদে ঢুকেই দেখি ঘুমে চোখ বন্ধ হয়ে আসছে। বোধহয় ক্লান্ত ছিলাম, খানিকটা নার্ভাসও হয়তো।
আবদুর রব বললো, ‘অসুবিধা
নাই ভাইজান, ঘুম ধরলে ঘুমায়া পড়েন। ঈমানদারের
ঘুমও এবাদত। জোহরের আগে আগে উঠে গোসল সেরে নিয়েন।’
আমি মসজিদের অন্ধকার কোণায় ঠান্ডা
মেঝের উপর শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ি, আবদুর রবের হাতে
এখন অনেক কাজ। আগামী দুই দিন সে দলের খিদমতগার। সবার জন্য রান্না-বান্না, খাওয়া-দাওয়া, বাজার-সদাইয়ের ব্যবস্থা করা তার দায়িত্ব। খিদমতগার হিসেবে দলে অবশ্য আরো চার
জন আছে। কিন্তু আবদুর রব তো সব বিষয়েই অতিরিক্ত সিরিয়াস, সে মনে করে ঈমানদারদের খেদমত করার মধ্যেও সোয়াব আছে। ফলে সে
কোমর বেঁধে কাজে নেমে যায়। তার লক্ষ্য একজন উচ্চমানের দীনদার ব্যক্তি হওয়া।
ঘুম ভাঙার পর আমি অনেকক্ষণ
পর্যন্ত বুঝতে পারি না ঠিক কোথায় শুয়ে আছি, পরে ধীরে ধীরে মনে পড়ে সব। এক অদ্ভুত, মিশ্র ও নীরব অনুভুতির মাঝে ডুবে থাকি কিছুক্ষণ। নাহ্্ আত্মগোপনের জন্য ভাল
জায়গাই পেয়েছি, পুলিশ বলো আর আমার শত্রুই বলো, কেউ আন্দাজই করতে পারবে না দুর্ধর্ষ অমুক সবার চোখের আড়ালে
এমন একটা জায়গায় .... হা, হা, হা ওদের
উদ্দেশ্যে মনে মনে এক চোট হেসে নেই। তারপর মসজিদের মেঝেতে কিছুক্ষণ আরামে গড়াগড়ি
করে কলপারে যেয়ে হাপুশ-হুপুশ গোসল করি। শরীরটা ঝরঝরে লাগে। তারপর রুটিন মত জোহরের
নামাজ। গোরস্থানে একটা লাশ এসেছে। মসজিদে সবার সাথে তার নামাজে জানাজায় শরীক
হই।
এরপর দুপুরের খাওয়া। খেতে গিয়েই
বিরক্তিটা চরমে উঠলো আমার। বড় একটা থালায় ভাত দিয়ে এর মাঝখানে লাউয়ের তরকারি ঢেলে
দেওয়া হয়েছে। এখন পাঁচ জন মিলে এই ভাত এক
থালা থেকে ভাগাভাগি করে খাও। কেন বাপু, পাঁচ জনকে এক থালায় খেতে হবে? না, এতে নাকি পারস্পরিক সৌহার্দ্য বাড়বে, ভ্রাতৃত্ব¡ বোধ জোরদার হবে।
আমার তো গা ঘিন ঘিন করতে থাকে। আবদুর রব আমাকে বোঝায়, ‘সবই অভ্যাসের ব্যাপার ভাইজান। আমরা সবাই এক আল্লাহর সৃষ্টি।
কাউকে ঘৃণা করা ঠিক না।’
শেষ পর্যন্ত আমি আবদুর রব আর একজন
ডাক্তার মিলে এক থালায় ভাত খাই। খিদা পেটে সবই অমৃত লাগে।
আবদুর রব এসে দুটো মোটা মোটা সবুজ
রঙের বই হাতে ধরিয়ে দেয় ‘ফাযায়েলে আমল’ আর ‘মুন্তাখাব হাদিস’। এলোমেলো পাতা উল্টাই ‘.. কেয়ামতের দিন আল্লাহপাক কোন কোন ব্যক্তিকে বলিবেন, তুমি অমুক গোনাহ করিয়াছ, তমুক গোনাহ করিয়াছ, এইভাবে যখন অনেক
গোনাহ উল্লেখ করিবেন আর ব্যক্তিটি মনে করিবে আমি তো ধ্বংস হইয়া গিয়াছি, তখন আল্লাহতায়ালা এরশাদ করিবেন, দুনিয়াতে আমি তোমার অপরাধ গোপন রাখিয়াছি, আজও গোপন রাখিব। যাও তোমাকে ক্ষমা করিয়া দিলাম।’
আমার হঠাৎ মনে হলো, এই কোন কোন ব্যক্তির মধ্যে কি আমি পড়বো? .. কি জানি .. শেষ বিচারের দিন আল্লাহ-তায়ালার কি ইচ্ছা হয়?
পড়া-শোনার অভ্যাস সেই কবে ছেড়েছি
! এখন কি আর পড়তে ভাল লাগে ? এর মধ্যে আবার
রাজমিস্ত্রি, দোকানদার আর রিকসাচালক নিরক্ষর, তাই দলের মধ্যে পালাক্রমে একজন জোরে জোরে মাছায়ালার বই পড়ে
শোনায়। আমি মুন্তাখাবে হাদিস থেকে জোরে
জোরে পড়িÑ
‘মুমিন তাহারাই যে, যখন আল্লাহতায়ালার নাম লওয়া হয় তখন তাহাদের অন্তর কম্পিত হয়
এবং আয়াতসমূহ যখন তাহাদেরকে পড়িয়া শোনানো হয় তখন ঐ আয়াতসমূহ তাহাদের ঈমানকে দৃঢ়তর
করিয়া দেয় এবং তাহারা আপন রবের উপরই ভরসা করে।’
সকাল থেকে এরকমই বই পড়ো, নামাজ পড়ো, জিকির করো, বয়ান শোনো আর বিকেলে দল বেঁধে বের হও দ্বীনের দাওয়াত দিতে
.. এ আরেক অস্বস্তিকর কাজ। প্রথম কয়েকদিন শরীর খারাপ লাগার অজুহাত দেখিয়ে আমি
মসজিদ থেকে বের হলাম না। চতুর্থ দিন আবদুর রবের জোরাজুরিতে বের হলাম। এই ক’দিনেই গালে বেশ দাড়ি গজিয়েছে। ধরে নিলাম কেউ আমাকে চিনতে পারবে
না। আমি মাথা নিচু করে দলের পেছনে পেছনে থাকি, সামনে আবদুর রব ন¤্র বিনয়ী
ভঙ্গিতে শুনতে অনিচ্ছুক মানুষের কাছে বিপুল ধৈর্য্যে তার দ্বীনের দাওয়াত পৌছাতে
থাকে। এক মসজিদ থেকে অন্য মসজিদ, এক জেলা থেকে
অন্য জেলায় .. প্রথম দিকে অসহ্য লাগছিলো, প্রায়ই মনে হচ্ছিলো ছুটে বেরিয়ে যাই , চারপাশের কোন কিছুর কোন অর্থই খুঁজে পাচ্ছিলাম না, যাদের সঙ্গে বেরিয়েছি তারা কি সত্যিই পরিপূর্ণতার সন্ধানে
বেরিয়েছে?
তারা কি লালন করছে কোন উচ্চ আদর্শ? নাকি তারা অর্ধবোধসম্পন্ন অচেতন মানুষ? বুঝতে পারি না,
মাঝে মাঝে ভয়াবহ স্বপ্ন দেখতাম, স্বপ্ন না ঠিক স্বপ্নের মতো, হয়তো নিজের জীবনের বাস্তবতাই .. ফিনকি দেয়া রক্ত, ভয়ার্ত চিৎকার, রক্তাক্ত মৃতদেহ, গুলির শব্দ, বুক চাপড়ানো কান্না, হাহাকার, দৌড়ে পালানো .. কতকিছু .. এই দুঃস্বপ্নের ভেতর থেকে আমি কি
কোনদিন বেরিয়ে আসতে পারবো? দুঃস্বপ্ন কি
কখনো আমার পিছু ছাড়বে?
আমাদের দলের ইঞ্জিনিয়র সাহেব
সুযোগ পেলেই বড় বড় দীর্ঘশ্বাস ফেলেন। দুনিয়াদারি যে কতো অনিত্য আর কতো বৃথা সেসব
শোনানোর চেষ্টা করেন। একদিন তার বন্ধু ডাক্তার সাহেব আমাকে জানালেন, সম্প্রতি দুর্নীতির দায়ে চাকরি থেকে সাময়িক অব্যাহতি পেয়েই
নাকি ইঞ্জিনিয়র সাহেবের এই নব-উপলব্ধি হয়েছে। রিকশাচালকের আছে হাঁপানির ব্যারাম।
আমরা সবাই মিলে চাঁদা তুলে তাকে ইনহেলার কিনে দেই। বেচারার খাওয়া-দাওয়ার খরচও
আমরাই দেই। স্কুল শিক্ষক ভদ্রলোক চুপ-চাপ নিজের মনেই থাকেন। শুনতে পাই স্ত্রী মারা
যাওয়ার পর থেকে সুযোগ পেলেই নাকি চিল্লায় বের হন তিনি। ভিডিও এডিটরের চাকরি আছে, সে সাত দিন পরেই দল ছেড়ে চলে যায়। রাজমিস্ত্রি সাহেব সময়
পেলেই দেখি মোবাইল ফোনে বউ-বাচ্চার খোঁজ খবর করেন। একদিন শুনি দোকানদার তাকে
নছিহত করছে, ‘দীন-দুনিয়ার এত
খোঁজ-খবরি রাখলে চিল্লায় আইসেন না, ভাই .. আমরা হইলাম জ্যান্ত মরা, আমাদের কি দুনিয়াদারি নিয়া এতো ভাবতে আছে? মনে করেন, কুদরতি ফেরেশতা আপনের পরিবারের
হেফাজত করতেছে ..’
রাজমিস্ত্রি দোকানদারকে উল্টো
শুনিয়ে দেয়, ‘কুদরতি ফেরেশতা
তো ভাই আপনের পরিবারকে আটকাইতে পারেন নাই তিনি আপনাকে ছেড়ে অন্য লোকের সাথে চলে
গেছেন। গেছেন না? আমার ভাই খোঁজখবর করতে হয়। আমার হিসাব আলাদা, আপনের হিসাব আলাদা।’
আমরা চলতে থাকি.. নীরস, আনন্দহীন,একঘেয়ে পথ চলা
.. সবার মধ্যে থেকেও নিজেকে মনে হয় ভীষণ একা, দলের মধ্যে সম্ভবত আবদুর রবই বিমল
আনন্দে বিভোর হয়ে অস্পষ্ট ঘোরের মধ্যে
ডুবে থাকে। আমাকে আল্লাহর পথে আনতে পেরেছে, এ নিয়েও তার মধ্যে একটা প্রচ্ছন্ন গর্ববোধ কাজ করে বুঝতে পারি। আমার এখন অবাক
লাগে কিভাবে কিভাবে এদের সাথে প্রায় ২৫/২৬ দিন কাটিয়ে দিলাম। আমার দাড়ি-গোঁফ
এতদিনে বেশ লম্বা হয়ে গেছে, আয়না নেই সাথে, নইলে হয়তো বুঝতে পারতাম চেহারায় কোনো নূরানীভাব এসেছে কি-না
। পত্রিকা পড়িনা, টিভি দেখিনা, কারো সাথে তেমন গল্প-গুজবও করি না, জীবন ও জগৎ-এর উপর ইচ্ছা করেই যেন একটা ভারি পর্দা টানিয়ে
দিয়েছি। যেন হাজার বছর ধরে আমি এভাবেই পথ চলছি। আমার কোন অতীত ছিল না, বর্তমান আর ভবিষ্যতও নেই।
একদিন আবদুর রবকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘ আচ্ছা, ধরেন, আপনাদের দলে কোন দাগী আসামী নাম পরিচয় গোপন করে ভিড়ে গেল, তাকে তো চেনার কোন উপায় নাই, তাই না ?’
‘হ্যাঁ’ আবদুর রব মাথা নাড়ে ‘এমন মানুষ চেনার উপায় নাই, তবে ভাইজান, কেউ যদি একবার আমাদের সাথে যাত্রা করে আর খাস দিলে সব কিছু
আমল করে,
তাইলে সে যত বড় পাপী-তাপী-দাগি আসামীই হোক তার মন পরিবর্তন
হয়ে যাবে।’
এই কদিনে আমার কি মন পরিবর্তন
হয়েছে?
নিজের কাছেই নিজে প্রশ্ন করি। কোন উত্তর পাই না।
আমাদের চিল্লার চল্লিশ দিন প্রায়
শেষ হয়ে এসেছে। আবদুর রবের কাছে জিজ্ঞেস করেছিলাম, চিল্লার সময় চল্ল্শি দিন কেন?
তার তরিৎ জবাব, চল্লিশের অনেক ফজিলত ভাইজান। জানেন না, মাতৃগর্ভে আমরা রক্ত অবস্থায় চল্লিশ দিন থাকি, চল্লিশ দিন পর আমরা হই একখন্ড গোশত, তার চল্লিশ দিন পর আমাদের হাড্ডি হয়, তারও চল্লিশ দিন পর হয় চামড়া মানে মানুষের জন্মের মধ্যেই
আল্লাহপাক চল্লিশের বরকত দিয়া দিছে। ..’
মজার ব্যাপার হলো, আমার কাছে চল্লিশ দিন এখন কেন যেন কমই মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে
সব ছেড়ে-ছুড়ে সারা জীবন ধরে পথে পথে হাঁটি। সমতল, প্রশ্বস্ত, উজ্জ্বল, সবুজ কোন অচেনা পথ ধরে, সব কিছু পেছনে ফেলে হাঁটতেই থাকি। যদিও জানি আসলে কিছুই পেছনে ফেলা যায় না। না
আমল,
না কর্মফল। আবদুর রবের সাথে বিদায় আলিঙ্গন করে মসজিদ থেকে
বাইরে বেরিয়ে আসি।
একটা নতুন সিম কিনে আমার এক
শিষ্যকে ফোন করি, সে উত্তেজনায়
চিৎকার দেয়, ‘ওস্তাদ, কই আছিলেন ? মনে কয়, এক্কেরে হাওয়ায় মিলায়া গেছিলেন, কুনো খুঁজখবর নাই, এইদিকে তো আসলাম বাহিনী পুরা বিলা, কি করুম? ’
আমি দ্রুত কিছু নির্দেশ
দিয়ে অনির্দিষ্টকালের জন্য ফোনটা বন্ধ করে দেই। এখনই আবার আত্মগোপনে চলে না গেলে
পুলিশের হাতে ধরা খেতে হবে। *
লেখক পরিচিতি....................................।।
শাহনাজ মুন্নী
শাহনাজ মুন্নীর জন্ম ১৯৬৯-এর ৮ ফেব্রুয়ারি, ঢাকায়। সমাজবিজ্ঞানে মাস্টার্স করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। তিনি পেশায় টেলিভিশন সাংবাদিক। এটিএন বাংলার নিউজ এডিটর। সাংবাদিক হিসেবে বেশ জনপ্রিয়তা পেলেও তিনি মূলত লেখক। এ পর্যন্ত গল্প উপন্যাস গবেষণা মিলিয়ে তার বইয়ের সংখ্যা আঠারোটি। তার স্বভাবে আছে এক ধরণের নির্মোহতা। শিল্পেও তার প্রভাব দেখা যায়। তার গল্পে সবসময়ই একটা গল্প থাকে। চরিত্রগুলো বিকশিত হয় সহজিয়া প্রেরণায়। জবরদস্তি নয়, সহজাত নির্দেশনা ধরেই যেন তার কথাশিল্পের চরিত্রগুলো নিজস্ব পথে পদচারণা করেন। তার কথাশিল্পের ভাষা রসবোধসম্পন্ন, কাব্যসংলগ্ন ও স্বতস্ফূর্ত। মুন্নীর কবিতাও তার ব্যক্তি স্বভাবের মতোই অউচ্চকিত। মৃদুভঙ্গীতে তিনি মোক্ষম বোধটি ব্যক্ত করে ফেলেন। যার অনুরণন থেকে যায় ঢেউ মিলিয়ে যাবার পরও।
(লিখেছেন: সরকার আমিন)
0 মন্তব্যসমূহ