শাহনাজ মুন্নী
শোভার স্বামী শওকত যে নিয়মিত নয়
তবে মাঝে মাঝে অনিয়মিত ভাবে মদ্য পান করে তা বিয়ের আগে তাদের প্রেম থাকাকালীন
সময়েই শোভা হালকা ভাবে কিছুটা জানতো। বাঙ্গালী মুসলমানের কন্যা হিসেবে মদ্য পান
নিয়ে শোভার মনে এক ধরনের সংস্কার যে ছিল না তা নয়, বাংলা সিনেমা আর
নভেল নাটকগুলো ছোটবেলা থেকেই শোভাকে এমন ধারণা দিয়েছিল যে, খারাপ মানুষরাই সাধারণত মদে আসক্ত হয় এবং মাতাল হয়ে তারা
যাচ্ছেতাই কান্ড-কারখানা করে।
শরৎচন্দ্রের দেবদাস এতো বড়
প্রেমিক হয়েও অপরিমিত মদ্য পান করে তিলে তিলে নিজেকে ধ্বংস করে ফেলায় তার প্রতি
কিশোরী বয়স থেকেই খুব রাগ আছে শোভার মনে। প্রেমে ব্যর্থ হলেই মদ খেতে হবে নাকি? অথবা জমিদার নন্দন হলেই হাতে তুলতে হবে মদের গ্লাস? ..
তাই প্রথম প্রথম শওকতের মদ্য
পানের বিবরণ শুনে শোভাও আঁতকে উঠতো, মন খারাপ করতো, রাগ করে কয়েকদিন
ওর সাথে কথা-বার্তাও বন্ধ রেখেছে, ঝগড়া-ঝাটিও কম
করে’নি, কিন্তু পরে
দেখেছে,
শওকত মানুষটা আসলে সিনেমায় দেখা ভিলেনদের মতো অতটা খারাপ না, মদ খেয়ে সে কখনো মাতাল হয় না, অসংলগ্ন আচরণও করে না। মদে তার যে খুব বেশি আসক্তি আছে তাও নয়। শওকত বলে, অনেকটা শখের বশে, বন্ধু-বান্ধবদের আড্ডায় মদের গ্লাস ঠোটে ছোঁয়াতে মজা পায় সে। মদ নাকি তাকে
কাবু করতে পারে না কখনো, বরং পাঁচ/ ছয়
পেগ খেয়েও তার ধারণা সে দিব্যি স্বাভাবিক থাকতে পারে। শোভা দেখেছে, শওকতের অন্য সব
বন্ধু যারা মাঝে মাঝে মদ খায় তারাও
চরিত্রহীন, লম্পট বা বদমাশ নয়। শোভা অবশ্য স্বামীর স্বাস্থ্য নিয়েও চিন্তা করতো, সে শুনেছে, মদ টদ খেলে নাকি
লিভার সিরোসিস হয়, কলিজা পচে মানুষ
মরে যায়।
শোভার আশংকাকে হেসে উড়িয়ে দিয়ে
শওকত বলেছে,
‘কি যে বলো না, আমরা কি আর কম পয়সার বাংলা মদ খাই? আমরা খাই বিদেশী মদ। অল্প মাত্রায় বিদেশী মদ খেলে শরীর
খারাপ হয় না, বরং শরীর চাঙ্গা হয়, বুঝছো?’
দেশী আর বিদেশী মদের পার্থক্য
বুঝেই হোক আর না বুঝেই হোক, শেষ পর্যন্ত
শওকতের মাঝে মাঝে মদ খাওয়ার ব্যাপারটা শোভা একরকম মেনেই নিয়েছে।
তবে শওকতের সব বন্ধুর বউরা তো আর
শোভার মতো না, কেউ কেউ আছে যারা স্বামীর মুখে
মদের গন্ধ পেলে তাকে তৎক্ষণাৎ বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিতেও দ্বিধা করে না। শওকতই গল্প করেছে, ওদের এক বন্ধু আছে, খায়রুল, যে কিনা, বউ যাতে টের না পায় সেজন্য মদ্য পানের পর এক খিলি মিষ্টি
পান মুখে দিয়ে বাড়িতে যায়, খায়রুলের ধারণা, পান-জর্দার সুগন্ধে মদের গন্ধ কেটে যায়।
শওকতের কয়েকজন বন্ধু আছে যারা বেশ
ভাল মদারু। তারা সময় সুযোগ পেলেই মানে যেদিন খুব বেশী বৃষ্টি হয় সেদিন আর যেদিন
বৃষ্টি হয় না সেদিন নিজেরা কারো না কারো বাসা বা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে পানাহারের
আয়োজন করে। শওকত অবশ্য সবসময় তাদের আড্ডায় যোগ দেয় না, মাঝে মাঝে তার অবসর মতো যায়। এই বন্ধুদের কয়েকজনের নাকি
আবার মদ্য পানের লাইসেন্সও আছে। লাইসেন্স অবশ্য তেমন কিছু না, স্রেফ একজন বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন, যেখানে লেখা থাকে, সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিটির সুস্থ থাকার জন্য মদ্য পান আবশ্যক। এই লাইসেন্স নিয়ে
তাদের অনেকে নাকি আবার বেশ অহংকারও প্রকাশ করে। শওকতের মদ্যপায়ী বন্ধুরা এক সঙ্গে
হলে প্রায়ই গুলাম আলীর গজল থেকে বাক্য ধার করে বলাবলি করে, ‘আরে ভাই, মদ্য পানের কথা শুনলেই এতো
হাঙ্গামা কেনো করো, চুরি ডাকাতি তো
করি না,
জোচ্চরি বাটপারিও করি না, সামান্য সুরা পান করি, তাতে এতো পেরেশান
হওয়ার কি আছে ?’
এই সৌখিন মদ্যপ বন্ধুদের প্রায়
সবাইকেই শোভা চেনে, সবাই নিতান্তই
ভদ্র লোক,
ভাল চাকরি বাকরি করে, কেউ স্বচ্ছল ব্যবসায়ি, কেউ কেউ আবার
উঠতি কবি সাহিত্যিক, এই কবি
সাহিত্যিকরা কখনো মদ বলে না, কাব্য করে বলে, শরাব বা সুরা।
মদ্য পানের প্রসঙ্গ এলে তারা
বলাবলি করে,
‘আরে বাবা, পাশ্চাত্যে এটা তো ভদ্রতা, এটা সংস্কৃতি, ওসব দেশে বাড়িতে
মেহমান এলে তাকে প্রথমেই নানা রকম পানীয় দিয়ে আপ্যায়ন করা হয়.. ’
‘আবার আমাদের আদিবাসী সংস্কৃতিতে
দেখো,
ওখানেও কিন্তু মদ্য পানের ক্ষেত্রে কোন সংস্কার নেই ..’
‘ইসলাম ধর্মেও কিন্তু মাতলামী করতে
বারণ আছে,
তবে মদ্য পানে? .. উহু.. মনে হয় না, বলা হয়েছে মদ্য
পানে উপকার কম হয় ..’
এধরনের কথা শুনে প্রথম প্রথম তর্ক
করার চেষ্টা করেছে শোভা। গলা চড়িয়ে বলেছে, ‘পাশ্চাত্যের সংস্কৃতির সঙ্গে আমাদেরটা মিলালে চলবে কেন? তাছাড়া ওটা শীতের দেশ, ওখানে না হয় শরীর গরম রাখার জন্য লোকে মদ খায়, আমরা কেন খাবো?’
কিন্তু এসব তর্কে শুধু কথা বাড়া ছাড়া আর কোন ফল
না হওয়ায় আস্তে আস্তে সবকিছু গা সইয়ে নিয়েছে সে। শোভার খুব বোঝা হয়ে গেছে, মদের জাহাজ সবসময় আকাশেই উড়বে, হাজার চেষ্টা করলেও মাটিতে বা পানিতে একে নামানো যাবে না।
তারচে বাবা, ওম্ শান্তি। এক আধ গ্লাস মদ্য পান
সহ্য করলে যদি গৃহ-শান্তি বজায় থাকে, তবে থাকুক না।
বিয়ের পর শওকত মাঝে মাঝে দুয়েক
বোতল মদ বাসায়ও নিয়ে এসেছে। শোভাকে বলেছে, চলো এক সাথে খাই। স্বামীর উৎসাহে শোভা যে দুয়েকবার মদের গ্লাসে ঠোট লাগায়নি তা
নয়। কিন্তু কোনও বারই এর স্বাদ তেমন একটা
ভাল লাগেনি ওর কাছে। সে মুখ বিকৃত করে বলেছে, ‘তোমরা কেন যে এই তিতকুটে বস্তুটি এতো আগ্রহ করে খাও বুঝি না
.. ’
শওকত বলেছে, ‘আমিও বুঝি না কেন খাই, আসলে আমার তো না খেলেও চলে ...তবু ধরো এই খাওয়া উপলক্ষে জীবনে একটা বৈচিত্র .. কিংবা ধরো একটা অন্য রকম আমেজ তো আসে ...’
শওকতের বদান্যতায় ব্ল্যাক লেভেল, জ্যাক ড্যানিয়েল, হানড্রেড পাইপারস, টিচারস, সিগনেচার, পাসপোর্ট স্কচ,ভদকা, ব্রান্ডি, জিন, ওয়াইন এমন
অসংখ্য ব্রান্ডের স্বাদ না জানলেও নাম-পরিচয় ভালই জানা হয়ে গেছে শোভার, এমনকি টাকিলা নামের মেক্সিকান পানীয়টি যে লেবু আর লবণের
সাথে মিলিয়ে বিশেষ কায়দায় খেতে হয় তাও শোভা জানে।
অফিসের ক্যান্টিনে আড্ডা দিতে
গিয়ে একদিন কথায় কথায় জানা গেল শোভার কলিগ নাইমার স্বামীরও নাকি মদ্য পানের ভাল
রকম অভ্যাস রয়েছে, গল্প করার ছলে
নাইমা বেশ স্বাভাবিক ভাবেই বললো, ‘আমার ফ্রিজে তো ভাই সবসময়ই স্কচ হুইস্কি, জিন,
ওয়াইন নয়তো ভদকার বোতল থাকে’
‘কি বলছো ? তুমি বাসায় এসব এলাউ করো?’
মর্জিনা আপা, শোভাদের অফিসের একাউন্টস সেকশনের একমাত্র হিজাব পরা বয়স্ক
কলিগ একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেন।
‘না করে কি করবো, আপা? বাইরে গিয়ে
যেখানে সেখানে খাওয়ার চে ঘরে বসে খাক, সেটা ভাল না ? অন্তত চোখের
সামনে থাকবে ..’
‘নাইমা আপা, আপনি এক কাজ করেন, একদিন একটা ককটেল পার্টি দেন, আমরা আপনার
বাসায় গিয়ে একটু পানাহার করি , কি বলেন, শোভা আপা, ভাল হবে না ?’
পারচেজ বিভাগের সবচে ষ্টাইলিশ
মেয়ে অজন্তা আচমকা প্রস্তাব করে বসে। হৈ হৈ করে ওকে সমর্থন করে অল্পবয়সী মেয়েগুলো,
‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, অজন্তা আপা, আমরা রাজি, এখন শোভা আপা
অনুমোদন করলেই হয়।’
মর্জিনা আপা মুখ কালো করে আড্ডা
ছেড়ে চলে যান।
নাইমা আপা মাথা ঝাঁকিয়ে বলেন, ‘কোন অসুবিধা নাই, কবে আসবা বলো, শুধু ড্রিংকস না, সঙ্গে গরুর ভুনা মাংস আর ঝাল ঝাল বাদাম ভাজাও থাকবে’
‘দারুণ, মারহাবা, খুব মজা হবে’
অল্পবয়সী মেয়েগুলো চেঁচিয়ে উঠে।
‘শোভা আপা, আপনি তারিখটা ঠিক করেন .. অফিসের পর একদিন সন্ধ্যায় যাই
চলেন.. কোন একটা উইকেন্ডে ..’
ক্যান্টিনের হৈ হৈ এর মধ্যেই কিভাবে
যেন নাইমার বাসায় পার্টির দিন তারিখও ঠিক হয়ে যায়। শোভা ভেবেছিল অন্য কোন কাজের
অজুহাতে পার্টিতে যাওয়াটা এড়িয়ে যাবে। এইসব ছেলেমানুষির কোন মানে হয়? কিন্তু নাইমা আপা বেশ কয়েকবার ফোন করে অনুরোধ করায়
বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় অফিস শেষে নাইমা আপার ধানমন্ডির লেক ভিউ ফ্ল্যাটে যেতেই হয়
শোভাকে।
যে মেয়েগুলো পার্টি, পার্টি করে বেশি লাফালাফি করেছিল, তাদের অনেককেই দেখা গেল না। অজন্তা, রেহনুমা মিলিয়ে প্রায় জনা আটেককে পাওয়া গেল। এতে অবশ্য একটু
স্বস্তিই পেলো শোভা। শওকত সব সময় বলে, ‘মদ্য পানের সময় তুমি কাদের সাথে বসে খাচ্ছো, কারা তোমার সঙ্গী-সাথী তা বিচার বিবেচনা করে নেওয়াটা খুব
জরুরী। এক মানসিকতার লোক না হলে দেখবে, পুরো আড্ডাটাই মাটি, এমন সব কান্ড
কারখানা শুরু করবে...’
যারা এই ঘরোয়া পার্টিতে এসেছে
তাদের দিকে তাকিয়ে শোভার মনে হলো,নাহ্ সঙ্গী
সাথীরা খুব একটা মন্দ নয়, এক মানসিকতার না
হলেও সবারই একটা ষ্ট্যান্ডার্ড হয়তো আছে ..আপাতত এতেই চলবে ... নাইমা আপা আয়োজন
খারাপ করেননি। টেবিল ভর্তি নানা রকমের শক্ত পানীয়, সঙ্গে মোগলাই খাবার-দাবার ... ত্র“টি নেই কোন কিছুর।
অল্পবয়সী মেয়েগুলোর জোড়াজুড়িতে
শোভাও হাতে হুইস্কির গ্লাস তুলে নেয়। অল্প অল্প চুমুক দেয়। নানা বিষয়ে সরগরম আড্ডা
চলতে থাকে। গ্লাসের পানীয় ফুরিয়ে যেতেই কেউ না কেউ আবার তা ভরে দেয়। সন্ধ্যাটা
কাটতে থাকে অন্য রকম এক আবেশে। অফিসের রাশভারী গম্ভীর কেতাদুরস্ত পরিবেশের বাইরে
.. মুক্ত,
নির্ভার, উদার.. যেন
এখানে এই আসরে কেউই কারো বস্ না, কেউই কারো
অধঃস্থন না, সবাই সমান, সবাই শুধু মানুষ, শুধু নারী।
মেহেরিন চানাচুর খেতে খেতে তার এক
বান্ধবীর মদখোর স্বামীর গল্প শুরু করে, ভদ্রলোক নাকি এমনিতে বোমা মারলেও প্রেমের কথা বলেন না, কিন্তু মদ
খাওয়ার পর দারুণ রোমান্টিক হয়ে উঠেন, দুই পেগ পেটে পড়লেই হলো, এমন সব
ভাব-ভালবাসার কথা বলতে শুরু করেন যে, বান্ধবীটি বাধ্য হয়েই মাঝে মাঝে তার মদ খাওয়াটা অনুমোদন করে মিষ্টি মধুর কথা
শোনার জন্য। মেহেরিনের বলার ভঙ্গীতে হাসির হুল্লোড় উঠে। যেন সরল উল্লাসে ঘরের ভেতর
এক ঝর্ণা বয়ে যায়, ঝর্ণা ধুয়ে নিয়ে
যায় সব অবসাদ, মাপা হাসি, মাপা কথার অফিসিয়াল ম্যানার ..
‘এই লিমিট ক্রস করো না কেউ, বুঝে খেয়ো..’
কমবয়সী মেয়েগুলোর উল্টা-পাল্টা
রকম-সকম দেখে ওদের সাবধান করে শোভা। কিন্তু কে কার কথা শোনে ? কয়েকটা মেয়েকে যেন পাগলে পেয়েছে .. হাসাহাসি করতে করতে, একে অন্যের
গ্লাসে গ্লাস ঠেকিয়ে চিয়ার্স করে ...
প্রায় প্রতিযোগিতা করে যেন মদ খায় একেকজন। তারপর শোভার সাবধান বাণী উপেক্ষা
করে গ্লাসের শেষ ফোটাটাও গলায় ঢেলে দিয়ে বেপরোয়া ভঙ্গীতে ‘ হেহ্, এইটুকু খেলে
কিছু হবে না আমার’
জড়ানো কন্ঠে বলেই, বেসিন পর্যন্ত যেতে পারে না, হড়হড় করে ঘর ভাসিয়ে বমি করে অজন্তা।
পাপিয়া হঠাৎ অপ্রকৃতস্থ মানুষের
মতো খিলখিল করে হাসতে শুরু করে আর হাসির ফাঁকে ফাঁকে বুড়ো আঙ্গুল শূন্যে নাচিয়ে
অদৃশ্য কারো উদ্দেশ্যে বলতে থাকে, ‘..একদিন টের পাবা বাছাধন, আমি কে? .. আমি কী? এখন তো বুঝো না,
হি হি হি ..টের পাবা ... হি হি হি
.. তারপর তুমি আমার কী করতে পারো দেখবো .. হি হি হি ...’
এইচ আর ডিপার্টমেন্টের দাপুটে
এক্সিকিউটিভ রেহনুমা হঠাৎ হাত-পা ছেড়ে সটান শুয়ে পড়ে কার্পেটের উপর। বাকীগুলোর
অবস্থাও তখন টাল-মাটাল। কোণার দিকে বসে থাকা একটা মেয়ে হঠাৎ জড়ানো গলায় চিৎকার করে
উঠে,‘ আমি আমার অসভ্য বাপটাকে ঘিন্না করি, আই হেট মাই ফাদার, সে প্রতিদিন আমার মাকে পিটাইতো . বোবা পশুরে যেভাবে পিটায় সেইভাবে পিটাইতো, সে একটা হারামজাদা আই হেট হিম ..’
পিঠে মাথায় হাত বুলিয়ে মেয়েটিকে
শান্ত করার চেষ্টা করে শোভা। নাইমা আপা মায়ের মমতায় নরম হাতে মেয়েগুলোর যত্নকরেন।
ভেজা তোয়ালে দিয়ে হাত মুখ মুছিয়ে দেন। বরফ ঠান্ডা পানিতে লেবুর রস চিপে
খাওয়ান।
যাদের সঙ্গে গাড়ি আছে তাদের
ধরাধরি করে গাড়িতে তুলে দেয় শোভা, আর যাদের নেই
তাদের কয়েকজনকে নাইমা আপার গাড়িতে আর কয়েকজনকে নিজের গাড়িতে করে কোন রকমে বাড়ি
পৌছে দিতে দিতে রাত প্রায় পৌনে বারোটা বাজে শোভার, ‘নারে বাবা, কান ধরছি, এই অল্পবয়সী মেয়েগুলোর পাল্লায় আর কিছুতেই পড়া যাবে না’ মনে মনে নিজের কাছেই প্রতিজ্ঞা করে শোভা।
শওকত এরই মধ্যে দুতিনবার ফোন করে
ফেলেছে,
‘কি ব্যাপার? কোন জরুরী মিটিং? কাজের চাপ? .. এখনো ফিরছো না যে, সব ঠিক আছে তো ..’
‘এই আসছি, আমার দুজন কলিগ একটু অসুস্থ ওদের বাড়ি পৌছে দিয়েই আসছি, ফিরে এসে সব বলবো তোমাকে ..’ এ কথা বলে ফোন
কেটেছে শোভা।
‘ব্যাপারটা কি? বলো তো ..
শওকতের গলায় উদ্বেগের সুর।
‘এত রাত হলো তোমার .. কে অসুস্থ ? কি হয়েছে? কি অসুখ? .. আমিতো টেনশনে .. ’
‘বলছি, বলছি । একটু অপেক্ষা করো ..’
হাতে মুখে পানি ছিটিয়ে কাপড়-চোপড়
বদলে একটু সুস্থির হয়ে শওকতের সামনে এসে বসে শোভা । শওকত হঠাৎ নাক কুঁচকায়, কেমন অবিশ্বাসের সুরে বলে,
‘এলকোহলের গন্ধ ! ... ব্যাপার কি ? মদ খেয়ে এসেছো নাকি?’
‘আর বলো না..’ শোভা অপ্রস্তুত ভঙ্গীতে হাসে ‘ মানে .. হয়েছে কি ... নাইমা আপার বাসায় আমাদের অফিসের
কয়েকটা মেয়ে ..বললো কি ..’
শোভা সহজ ভাবে হেসে হেসে অন্য দিন
যেমন করে শওকতের সাথে অফিসের বা সংসারের আর দশটা গল্প বলে তেমনি করে নাইমা আপার
বাসার কাহিনী বর্ণনা করতে থাকলে শওকত তাকে কথার মাঝখানেই থামিয়ে দেয়,
‘বাহ্ বাহ্, বিদেশী কোম্পানীতে চাকরি করে ভালইতো উন্নতি হয়েছে তোমাদের
.. মদের পার্টি করো, রাত দুপুরে মুখে
এলকোহলের গন্ধ নিয়ে ঘরে ফেরো .. চমৎকার ! ব্রেভো .. ’
শওকতের বাক্য ও কন্ঠের আকস্মিক
শ্লেষ আর ঘৃণা শোভাকে হতবিহ্বল করে দেয়। সে হঠাৎ যেন কথা খুঁজে না পেয়ে তোতলাতে
থাকে। ঘরের বাতাসে তখন স্তব্ধতা নেমে আসে, শুধু এলকোহলের হাল্কা গন্ধ চলে যাবার
পথ খুঁজে না পেয়ে মধ্য রাতের বদ্ধ দেয়ালে অনবরত মাথা ঠুকতে থাকে। শোভার মনে হয় এখন
তার মাতলামী করার সময় এসেছে। মাতাল হয়ে সম্ভবত এমন সব কথা বলা যায়, যা স্বাভাবিক সময়ে বলা যায় না।
লেখক পরিচিতি....................................।।
শাহনাজ মুন্নী
লেখক পরিচিতি....................................।।
শাহনাজ মুন্নী
শাহনাজ মুন্নীর জন্ম ১৯৬৯-এর ৮ ফেব্রুয়ারি, ঢাকায়। সমাজবিজ্ঞানে মাস্টার্স করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে।
তিনি পেশায় টেলিভিশন সাংবাদিক। এটিএন বাংলার নিউজ এডিটর। সাংবাদিক হিসেবে বেশ
জনপ্রিয়তা পেলেও তিনি মূলত লেখক। এ পর্যন্ত গল্প উপন্যাস গবেষণা মিলিয়ে তার বইয়ের
সংখ্যা আঠারোটি। তার স্বভাবে আছে এক ধরণের নির্মোহতা। শিল্পেও তার প্রভাব দেখা
যায়। তার গল্পে সবসময়ই একটা গল্প থাকে। চরিত্রগুলো বিকশিত হয় সহজিয়া প্রেরণায়।
জবরদস্তি নয়, সহজাত নির্দেশনা ধরেই যেন তার কথাশিল্পের চরিত্রগুলো নিজস্ব
পথে পদচারণা করেন। তার কথাশিল্পের ভাষা রসবোধসম্পন্ন, কাব্যসংলগ্ন ও
স্বতস্ফূর্ত। মুন্নীর কবিতাও তার ব্যক্তি স্বভাবের মতোই অউচ্চকিত। মৃদুভঙ্গীতে
তিনি মোক্ষম বোধটি ব্যক্ত করে ফেলেন। যার অনুরণন থেকে যায় ঢেউ মিলিয়ে যাবার পরও।
(লিখেছেন: সরকার আমিন)
0 মন্তব্যসমূহ