যুদ্ধলগন

কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীর

বিষমবাহু ছায়াটির সাথে পরিচয় বাড়তে গিয়েই আম গাছটির সাথেও পরিচয় হয় কায়েছালীর। কবরটির একেবারে শিথানে দাঁড়িয়ে আছে গাছটি। বনাজি ঘাস, দূর্বা, ঝোপঝাড় এমনকি শ্যাওলা-পাড়া-কবরটা সাফসুফ করার পরও সে খেয়াল করে যে, শিপুইন্যের চেহারা-সুরত মাথার একেবারে ভিতরের দিকে জমাট বেঁধে আছে। তা না হয় হলো, কিন্তু তার ঝামেলা বেড়ে যায় শিপনের বয়সটা নিয়ে। হারামজাদার যুদ্ধকালের বয়সটা যে বাড়ছেই না। লাশটির ভ্রাম্যমান বয়স সে বারে-বারে আন্দাজ করে আর আন্ধাচক্করে পড়ে। অত পুরানা লাশের বয়সটা না-বাড়ার মর্ম কী! এতদিন তবে কেন সে এদিকে আসেনি? এই সব ভাবতে ভাবতেই জলখেলির শুকনা খটখটে গাঙের দিকে তাকায় সে। দেখে দেখে হয়ত ক্লান্তও হয়। তবে শিপুইন্যে হারামজাদার মৃত্যুকালীন বয়সটা থাকেই। ধান-গম-ভুট্টা থেকে শুরু করে শাক-সবজির ভিতরও তার বয়স না-বাড়ার তীক্ষ্ণ গন্ধটা বহমান হয়! জ্যান্ত রক্ত-মাংশ পেরিয়ে বারুদ কিম্বা রক্তের গন্ধ টের পায়। কী এক গোঙানি ওঠে আসে নীরবতা ভেদ করে। তাই হয়ত ক্রমান্বয়ে বর্ধনশীল হয়ে যুদ্ধের বছরের গন্ধের বছরের গন্ধের মতন নেশার কবলে পড়ে।

সোহসপুরের যুদ্ধের বছরের সকালটা সেদিন বাড়তে থাকলে মানুষ-পঁচা-গন্ধটি আরও পরিপক্ব হয়। লাশের প্রাবল্যে নোনতা জল তখন আরও ফুলে- ফেঁপে ওঠে যে গাঙের, তার নাম জলখেলি। গাঙের কিনারায় অন্য গ্রামগুলোর মতো এখানকার বাচ্চাদের সকালবেলার কাজই হচ্ছে গুণে গুণে লাশের সংখ্যা জানা আর চিৎকার দিয়ে অন্যদের জানানো। তবে সোহনপুরের জলস্রোত-আশ্রিত লাশের গন্ধ কখনো দূর হয় না। বলতে গেলে গ্রামটি গন্ধের কবলেই জব্দ হয়ে গেছে। আরও এক লাশ নিয়ে আসে জলখেলি। প্রতিদিনের মতন পচারক্তের ভিতর দিয়ে চলা হেলে-পড়া-হিজলের ডালের সাথে কোনো একসময় আটকে পড়ে এটি। দু’পাড়ের অনেকেই দেখে সেই লাশ। নিজেদের আত্মীয়-স্বজনের কিনা তাও প্রতিঝলক দেখে নেয়। গত সাড়ে চারমাসের সকাল এভাবেই আসে সোহনপুরে। মাত্র দেড়মাইল দূরের সরারচর হাইস্কুলের মিলিটারিদের ক্য্ম্প থেকেই লাশ আসে। একটাও দিন থাকে না লাশের গন্ধ ছাড়া। লাশের অনুসন্ধান নিয়ে বাড়তি কোনো চিহ্নও নেই এখন। কী যে এক দায়ভার নিয়ে নিল জলখেলি। গ্রামটির অনেকেই নিজেদের ভিতর কোনো অসীম পাপের ইশারা খোঁজে। বুক-ধড়পড় করা ছটপটানির ভিতর তার সময় পার হয়।

এ লাশটিই যদি ডানে অথবা বাঁয়ে কাত হয়ে ভেসে আসত, তা হলে মইদুল মেম্বারের মেয়ে আধাচালু ব্রেইনের সুর্মা আক্তার একে গরু-মহিষের লাশ বলেই ধরতে পারত; কিন্তু এটি যে শুধু মানুষের ষোলআনা আকৃতি নিয়ে চিৎ হয়ে ভেসে এসেছে তাই নয়। একটি চিৎকার তৈরি হয়। ওই চিক্কুর উত্তরপাড়ার জয়নাব বিবি বা রহীমার মা-ই দারুণ উৎকণ্ঠার সাথে লক্ষই শুধু করে না, এটি এক ক্ষয়চিহ্ন হয়ে যেন সারা গাঁয়ের বুকজুড়ে ধুকপুক করতে থাকে। লাশটি ভোবে ফুলে- ফেঁপে উঠেছে তাতে শুধু সুর্মা আক্তার নয়, তা তার মা’র কাছেও এক আচানক কিসিমের ব্যাপার। তবু তার বিস্ময়টা ভয়ের কাছাকাছি পৌঁছে না। কারণ অত গন্ডগোলের ভিতর, টাসটুস গোলাগুলির ভিতর, কায়েছালি রাত-দিন দিগদারির ভিতর; কেআর আধাচালু ব্রেইনের সুর্মা আক্তারের চিক্কুর মনে রাখে। কিন্তু সোহনপুরের আন্ধাচক্করের ভিতর ঢুকে যায় এ চিক্কুর, সুর্মা আক্তারকে মিলিটারিরা ধরে নেয়ার পর অনেকটা ফাইনাল আলাপ হয়ে থাকে যে, সেদিন সুর্মা আক্তারের ক্ষয়-জাগানিয়া চিক্কুরই তার পরবর্তী সময়ের দুঃখের জন্য দায়ী।

সেদিন লাশরূপী শিপনের আলাদা বিচরণ অনেকের কাছে সদাজাগ্রত এক অস্তিত্ব হয়ে থাকে। এর সারাটা পেট, বুক, গাল, গলা এমনকি শিশ্নও ফুলে ওঠে। ুসুর্মা আক্তার এমন একটা লাশ দেখে অত জোরে চিক্কুর দেয় কী করে। দ্বিতীয়বার তার এই হাহাকার পেঁচানো চিক্কুরটি সোহনপুরের সকালকে আর কাঁপাতে পারে না; কারণ তার আগেই সুর্মা আক্তারের মা এক ধমে মেয়েকে পাকঘরের ভিতর ঢুকিয়ে দরজা বন্ধ করে দেয়। তবে শিপনের পরনের লুঙ্গিটা যে সুর্মা আক্তারের বড়োভাইয়ের তা অনেক পরে জানাজানি হয়। এবং একটা লুঙ্গির সাথে একটা মেয়েমানুষের জীবন আটকে যাওয়ায় তা অন্য কায়দায় দীর্ঘজীবী হয়। সেই লাশটা ভেসে আসার দিন সুর্মা আক্তার প্রথমেই চিল্লানিটা দেয় এভাবে -- দেহো- গো আম্মা, এইডা মনে অই শিপুইন্যে ভাইজানের লাশই। আল্লা গো, পেটটাদি ঢূলডার লাহান ফুইল্লা গেছিগে।

গলায় পড়েছে কম করে হলেও পাঁচটা পোঁচ। ২০/২৫টা ছোট মাছ সেই পোঁচের পচাগলা মাংশের গর্তে ঢুকে আছে। চামড়ার নিচের মাংস কখন নিচে থেকে ঝুরঝুরে হয়ে আছে। একটু টানেই সবটুকু হাড়-মাংশ-রগ যেন খুলে-খুলে পড়বে। সারাটা বাতাস কী বুকের ভীতরে টেনে নিল নাকি! তা না হলে লাশটি অত ফুলে-ফেঁপে ওঠে কী করে? পুরাটা লাশ একটা কাঁথায় আটকে রাখতে পারে না। দুইটা কাঁথা দিলে লাশটা তবেই এতে ডুব দিতে পারে। সোহনপুরের মানুষজনের মিলিত ভয় আর দীর্ঘশ্বাস বাড়ে। দীর্ঘক্লান্তিতে পড়ে এবং এতে শিপনের মায়ের ফোঁপানিযুক্ত কান্নাঢাকা পড়ে যায়। এমন এক তরতাজার ছেলে যদি রেকমান মৌলানার লোক বা কায়েছালী নিজে দেখে ফেলে?

কেন্দে-কেটে পথ পাবে তখন? একশ বার বাপ ডাকলেওতো তখন রক্ষা পাবে না কেউ, তা হলে উপায়টা কী! শুধু জননীর কান্নাকাটির দিকে নজর দিলে সংসারধর্ম চলে না। তবে সেদিন সোহনপুরের মানুষজন ব্যাকুল হয়ে লাশটি দেখতে থাকে। খুবই অল্পসময়ে একে শিপনের লাশ বলে চিনতে পারে অনেকেই। ওরা আসলে মাত্র দুদিন আগে থেকেই এমনটি ভাবতে থাকে। সোহনপুর থেকে শিপনসহ তিনজনকে মিলিটারিরা ধরে নেয়ার পরই এ অপেক্ষা তাদের ছিল। তারা যেন জানতোই, এমনটি না-ঘটে উপায়ই নাই। পরের ঘটনা তো মইদুল মেম্বারের মেয়েটাই ঘটাল। উত্তরপাড়া দক্ষিণপাড়া কিম্বা স্কুলপাড়ার অনেকেই সুর্মা আক্তারের ক্রমে ক্রমে বাড়তে থাকা নিরালা কান্নাকে ব্যতিক্রম ধরে নেয়। তা এমনই বেতালে বাড়ে যাতে সুর্মা আক্তারের মা’র হুমকি-ধামকিতে কাজ না-হলে এক পর্যায়ে তাকে ঝাড়– দিয়ে পিটাতে থাকে। তারও পর সে এ কান্নায় জলখেলির শ্যাওলা-প্যাঁচানো-পচাগান্ধা মিহিস্রোতের মতো সারাপ্রহর নিমজ্জিত থাকে। তার এ কান্নার জল এতই নোনতা আর ঘন যে, তা চোখের তীক্ষ্ণরক্তনালী শুষে বেয়ে- বেয়ে ক্রমাগত ঝরতে থাকে। রাত দুপুর হলে সেই নিচুলয়ের গোপন-কান্না স্বাধীন স্তরে পেঁছে এবং দুই দিনও এই অবস্থায় থাকা অসম্ভব হয় কারণ সোহনপুরে রাত-পাহারায় নিযুক্ত বয়স্ক লোকেরা সহসাই টের পায় সুর্মা আক্তারের কান্না দীর্ঘজীবী হয়ে গেছে। এবং এমনই কান্নার ঝামেলায় পড়ে তার মা আল্লা-রসুলকে তছবি টিপার মতো জপেও কূলকিনারা পায় না। মেয়েটার এই গার্হস্থ্য কান্না যে এমন দুর্দিনেও লোকমুখে মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে না, গাঁয়ে দশকথার এককথা হবে না; তা কে বলবে? সুর্মা খাতুনের বাবা মইদুল মেম্বার চারদিকে বিপদ ছাড়া কিচ্ছু দেখে না। ছিনাল মেয়েটার কান্ডকীর্তি সহ্য করার কোনো পথই যে তার নাই। বেজায় গোলাগুলি আর মান-ইজ্জত দিয়ে টানাটানি এই গন্ডগোল কি রোজ- কেয়ামত পর্যন্ত চলবে? খন্নাসের গোষ্ঠীর বিচার কি আল্লায় করবে না? এই সব ভেবে- ভেবে মইদুল মেম্বারের সময় যায়। ভেজাইল্যে-যাতনা তো আরও আছে, জলখেলিতে ভাসতে থাকা সেই লাশটিই যে শিপনের, তার জন্য এভাবে অপেক্ষা করা যথার্থ নয়; দাফন-কাফন তো করতেই হবে। তা না করলে কোনদিক দিয়ে জলখেলিতে পড়ে একসময় দেখা যাবে ঘোড়াউত্রা দিয়ে মেঘনা, সুর্মা, যমুনায় গিয়ে পড়তো তা কে বলতে পারে? পাঁচটা মাস ধরে এই জলখেলি তো লাশর জামিনদারীই নিয়ে নিয়েছে।

মুক্তিযোদ্ধাদের দলটি আগরতলা থেকে ফিরে আসারও আগে সুর্মা আক্তার সংক্রান্ত আরও এক স্মৃতি গ্রামে জেগে ওঠে। সেই স্মৃতি শিপন বাড়ি ত্যাগের ১৫ দিনের পরের ঘটনা। এ-সবের সাথে যার নাম যোগ হবে তার না কায়েছালি। খাকি পোষাকে, নাগরা জুতা পায়ে দিয়ে, হাতে বেতের লাঠি নাড়াতে নাড়াতে কায়েছালী তার প্রতিবেশী শিপনের বাড়িরও আগে পৌঁছে সুর্মা আক্তারদের বাড়িতে এবং খয়ের জর্দা দিয়ে পান চিবাতে চিবাতে, বর্গা-মার্কা-সিগারেটে টান দিতে দিতে বলতে থাকে -- কিয়ো চাচী, জামাইরে যুদ্ধে পাডাইলানি? সুর্মা আক্তারের মা ঘোমটার আড়ালে নিজেকে সঁপে রেখেই বলতে থাকে --পুলিশ বেডা ইতা কি ক! নিজের বইনেরে বুঝি কলঙ্কিনি করতো চাও! কায়েছালী তখন নিজের ভিতর একধরনের ভাব-যাতনা টের পায় -- একে তো সর্মা আক্তারের মা তাকে পুলিশ বলে দিল, তার উপর তাকে সুর্মা আক্তারের বোন বানিয়ে ছাড়ল। সিগারেটে জোরে জোরে দুইটা টান দেয় এবং সে নিজেই বারান্দায় রাখা হাতলঅলা চেয়ারটায় বসে পড়ে। ফস্ করে সিগ্রেটে আগুন ধরাতে-ধরাতে বলতে থাকে -- সুর্মা আক্তার কই? হেরে পান বানাইতে কও। -- হে ত গরে নাই গো বাজান। --তাই নিহি! কই গেল? -- কেমনে কই? খালের পাড়োনি গেল? সুর্মা আক্তারের মায়ের শুকনা খটখটে কথার ভিতর কাযেছালীর পূর্বসিদ্ধান্ত পাকাপাকি হলে পর বলে -- হেরে জানাইয়া দিয়ো, মাঙ্গোর জয় বাংলার বেপর্দা চলাচলতি আমার বালা লাগে না। কায়েছালী সেদিন শুধু পানই খায় না, অর্ডার জারি করার মতনই বলে -- শিপুইন্যে নডির পুতে বাচতে চাইলে ক্যাপ্টিন ছারের অমহে হাজিরা দিতে কইবা। মার্ত দুইকান দিন টাইম দিলাম।

সিগ্রেটের পাছায় নরম করে টান মারে। আবারও বাড়িটা দেখে সে, সাথের তিনজনের সাথে গপসপ করার ফাঁকেই হাই তোলে। তারও পর কায়েছালী পুরুষহীন বাড়ির পশ্চিমঘরের বারান্দায় বসে তার কাঁধের চাইনিজ রাইফেলটা টিনের বেড়ায় রেখে পূব-ভিটার সামনের খালি জায়গায় অপেক্ষা করতে থাকা বাকি তিন সহযোগীকে হাতের ইশারায় আরও অপেক্ষা করতে বলে। তার হাতের একটা পানের বাটিতে কড়া খয়ের সহযোগে দুই খিলি পান দেয়। সুর্মা আক্তারের মায়েল পাকা কলার মতো চামড়ায় আবৃত হাতের দিকে নজর পড়ে কায়েছালীর। তার ভিতরে অস্থিরতা জাগ্রত হতে থাকে। সাবালকত্ব টের পায়। ক্যাপ্টেন স্যারের সাথে বহু জায়গায় নারী সংগ্রহের অভিযানে তাকে যেতে হয়েছে। এ মুহূর্তে ক্যাপ্টেন স্যারের অতিস্বাধীন তেষ্টা তার শরীরে ভর করে। প্যান্টের ভিতর পড়ে থাকা শিশ্নটিকে যথারীতি স্বাধীন করে দেয়। তখন হঠাৎই সুর্মা আক্তারদের ঘরে ঢুকে পড়ে কায়েছালী; সুর্মা আক্তারের মা আঁতকে উঠার টাইমও পায় না। তাকে ঝাপটে ধরে কায়েছালী। পা দিয়ে দরজার কপাট দুটি অল্প বন্ধ হওয়ার মতো হয়ে আবারও অনোকটায় খুলে থাকে। ঝাপটে-কামড়ে-লেপ্টে সুর্মা আক্তারের মাকে একাকার করতে থাকে। কায়েছালীর শক্ত শরীরের নিচে তার জমানো শক্তি ক্রমশ স্তিমিত হয়ে আসে।

চারজনের দলটি অতঃপর শিস দিতে দিতে সোহনপুরকে নাড়িয়ে-সরিয়ে সরারচর মিলিটারি ক্যাম্পের দিকে হাঁটা দেয়।

যেদিন লাশটি জলখেলিতে ভেসে আসে তারও সাতাদন আগে শিপনকে কমান্ডার মেনে আগরতলা থেকে রওয়ানা হয়েছিল দলটি। তবে সোহনপুরের কেউ কেউ তাদের কারও কারও পরনে চার-পকেটের ময়লা শার্ট দেখে কিঞ্চিৎ অবাক হয়। লুঙ্গি-গামছা আর হাঁটুর উপর কাদা-বালি লেগে থাকা দেখে তাদের অবাক হওয়ার কোনো বিষয় না। তাদের বিবেচনায়ও পড়ে না এ-সব। কিন্তু ওদের চুল-দাড়ি- মোচ যেভাবে লম্বা করে রেখেছে তা তো আবাক হওয়ার বিষয় শুধু নয়, দেখারও বিষয়। এরা মনে হয় ৮/৯ দিন ধরে গোসলটা পর্যন্ত করেনি। নোখের গোড়ায় গোড়ায় যেন গু লেপ্টে আছে! গোপন ক্যাম্পটি তারা করেছে হাদী প্রধানের পূবভিটার খালি ঘরটাতেই। ম্যালা ভাবনাচিন্তার পর এমনই সিদ্ধান্তে আসা যায় যে, শিপনের টু-আই-সি আব্দুল হাইদের এ বাড়িটাই ক্যাম্পের জন্য ষোলআনা ফিট। কুদরত চাচাও তা-ই রায় দেন।

সেদিন এমনই প্রতিজ্ঞা করে যে সোহনপুর থেকে তারা একচুলও নড়বে না। আরো ২/৪টা দিন যাক না, বাজিতপুর থেকে সরারচর পর্যন্ত সি.এন্ড.বি. রোডটাই শুধু কন্ট্রোল করবে না এরা; সারা নিকলি, অষ্টগ্রাম, মিঠামাইন ছাড়িয়ে সুনামগঞ্জের সাইডের নদী-নালার যত পথ আছে সবই একসময় ক্যাপচারে নিয়ে আসবে। আখাউড়া দিয়ে ঢোকার সময় এক শিখ মেজরের সঙ্গে এমন শলাপরামর্শ শিপন নিজে করে এসেছে। সোহনপুরের অনেকেই সেদিন ধরে নেয় এমন অস্ত্রপাতির মধ্যে যে একটা ভাবচক্কর এদের দেখা যায়; শালার পাঞ্জাইব্যে শূয়োরদের জানে-গতরে কবর দিতে খুব বেশি টাইম লাগার কথা নয়। আর কয়দিনের মধ্যেই যে বাইষ্যে মাসটা শুরু হবে, তাতে মিলিটারি শালারা পানির দেশের সুখ-সুবিধার বালটাও বুঝবে না। রুটি-খাওয়া-জাত পানির মর্ম বোঝে কী করে! দিনের বেলায় এরা মুর্দারের মতন চুপচাপ পড়ে থাকে আর রাথের বেলা চালায় অপারেশন। এরই মাঝে দুই-দুইটা রেলের ব্রিজে অ্যাটাক করেছে এরা। জয়নাল গাজীর বাড়ির পাশের ছোট ক্যাম্প থেকে রাজাকারদের দৌঁড়িয়ে-ভাগিয়ে দুইটা চাইনিজ রাইফেল আর বন্দুক একটা; ৪টা কিরিচ আনতে পেরেছে। ময়নাকান্দির ব্রিজের সেন্ট্রিবক্সে অ্যাটাক করে কিছুই পায়নি। শিপনের মাথায় তখনই অনেক কিছু ঘুরতে থাকে। এই সেন্ট্রিবক্সে রাতের বেলা যেখানে খাকি ড্রেস পরা কমসে-কম তিনটা রাজাকার থাকার কথা সে-ই ব্রিজটা এক্কেবারে শূন্য থাকে কী করে!

সন্দেহটা গাঢ় হয়ে তাদের বুকে বসে যাওয়ার আগেই ঘটে ওই ঘটনা। সোহনপুরের প্রতি কণা মাটি গুলির আওয়াজে আঁতকে ওঠে সেদিন। আক্রমণটা আসে বলতে গেলে চারপাশ থেকেই। স্পিড-বোড আসে দুইটা। একটা বাজিতপুরের দিক থেকে অন্যট নিকলিরও উজান থেকে। এই ক্যাম্পের খবরটা জাওরা পাঞ্জাবিদের কাছে কে জানাল! এ-টুকু ভাবনায় থাকার তেমন সময়ও সোহনপুরের লোকজন পায় না, তার আগেই হাদী প্রধানের বাড়ির ক্যাম্পটা একনিমেষেই পাঞ্জাবিদের দখলে চলে যায়। নয় জনের এ দলটার পাঁচ জন জায়গাতেই শেষ। নিবারণ আর রহমতালী নামের দুই জন জান নিয়ে কোনোরকমে পালাতে পেরেছে। দুই জন গুলি-গালা খেয়ে ধরা পড়ে মিলিটারিদের হাতে।

শিপনের লাশটা জলখেলিতে আটকে যাওয়ার দিন অনেকের চিন্তাচেতনায় এটাও ছিল, কবরটা তাকে কোথায় দেয়? তাদের পারিবারিক গোরস্থানেই ওর ষোলআনা হক আছে। একে তো ঐ জায়গাতেই গোর দেওয়াটা উত্তম, শিপনের মায়ের এমন প্রস্তাবে পড়ে তাদের ভয়টা জমাট বেঁধে থিরথিরে করে কাঁপে। এক হিসাবে একে তো ন্যায্য বিবেচনাই ধরতে হয়। কিন্তু এখন কী শিপনের মায়ের প্যাতপ্যাতানি নিয়ে ভাবনাচিন্তায় থাকলে চলে? খাটিয়াই উঠাতে গিয়ে শিপনের আকৃতিটা সোহনপুরবাসীকে আবারও ঝামেলায় ফেলে। তার মায়ের কেঁপে কেঁপে ওঠা পিঠ-মাথা-ছেঁড়া শাড়ির আঁচল; সোহনপুরের লোকদের দম-আটকে-আসা ভয়ে ফেলে। সন্ধ্যার পরপরই সেই হাদী মেম্বারের বাড়ির বিছানার চাদর দিয়েই তার পিছ-বাড়ির হাগা-মুতার জঙ্গলে আন্ধার ভেঘঁষে-- ঘেঁষে ৫/৬ মিলে কবর দেয় তাকে। সেই কাজটি করে তাড়াহুড়ার ভিতরই। তবে তখনো তাদের স্মৃতি থেকে কায়েছালীর হুঁশিয়ারি পিছ ছাড়ে না। সোহনপুরের সেই রাতটা আরও দীর্ঘ, আর ছিন্নভিন্ন হতে থাকে। খানি-আন্ধার বিলায় সবখানে। সোহনপুরে ভয়ের রাজত্ব বাড়ে। বেতিরচরের জলে ভেজা মাঠ, ছালিয়াকান্দির গোরস্থান, নালিতার বিল পেরিয়ে সেই ভয় ঘোড়াউত্রার উদাম শরীরের দিকে বেগবান হয়। তবে এর পিছনে অনেকদূরে আরও এক মিহিকান্না কান্না জাগ্রত থাকে। এবং সেটি কোনোদিন কেউ হয়ত তখন জানেনি যে তা আসলে ছিল সুর্মা আক্তারের।

শিপন কী যে ছেলে ছিলো গো! মিছিল-উছিল ছাড়া কোনোদিন কলেজ কামাই করত! বাজিতপুর কলেঝে কত মিছিল চোখের সামনে দিয়ে চক্কর দিয়ে বেড়াত। মিছিলের নেতা কে ছিল? গন্ডগোল পুরাদমে লাগার সময় শেষদিন বাজিতপুরে মিছিল নিয়ে গেল। হাদী মেম্বারের মামাত ভাইটা, যে নাকি গচিহাটা থেকে তাদের বাড়িতে থেকে কলেচে পড়াশোনা করত, সে সাজল টিক্কা খান, কলিমুদ্দীন সাজল ইয়াহিয়া খান, আর শিপন সাজল আচকান আর টুপি পড়ে জিন্না। সেদিন বাজিতপুরে যাওয়ার আগে শিপনই কায়েছলীকে মিছিল থেকেই চিল্লিয়ে বলে -- কীরে কাইছালী, যাইবে নি? -- কই যাইবি? তর মারে ফিরেকবার বিয়া দিবি, পুঙ্গা বাজাইছেনি? এর জবাবটা তখনই শিপন দিতে পারত। তার তখন ইচ্ছা করছিল দুই গালে দুই-দুই চারটা থাপ্পড় লাগিয়ে দিতে। কিন্তু মিছিলে যেভাবে মৌচাকের মতো লোক আসা শুরু করছে তাতে হারিকেন বা দাঁড়িপাল্লায় ভোট দেয়া দুচারটা লোকের ব্যাঁকাতেরা কথায় পাত্তা না দিলেও চলবে। কথা শুধু এ-টুকুই বলে গেল -- তরার বাবারর দিন শেষরে বান্দির বাচ্চা। মুখটা আর খরাপ করাইছ না।

তার ১৫ দিন পর তো দেশটায় য্দ্ধুই লেগে গেল। তারও মাসদেড়েক পরে শিপন ১২ জনের একটা দলের সাথে আখউড়া বোর্ডার ক্রস করে আগরতলা চলে যায়। অত দূরদেশে পৌঁছলেও দেশ- গেরাম বা বিধবা মা-টা’র চিন্তা খুব বেশি করতে হয়নি। কোন্ খবরটা আগরতলার ক্যাম্পে পায়নি? সোহনপুর থেকে বাজিতপুরের খবর নিতে যে-টুকু পরিশ্রম করতে হয় আগরতলা বসে তো তারও আগে বেবাক খবর পেয়ে তে। তাদের বাড়িটা যে কায়েছালী হারামজাদা মিলিটারি দিয়ে পুড়িয়ে-লুটপাট করে একেবারে মিসমার করে দিয়েছে এবং তার মা যে মামার বাড়িতে সে- দিন বিকেলেইি চলে যায়; সেই খবরটা চার দিন গ্যাপ দিয়েই পেয়েছিল। সুর্মা আক্তারের মায়ের গজবের খবরটা পায় তিন দিন পর।

কায়েছালী এই বলে সোহনপুরের যবক সমাজকে রাজাকারের খাতায় নাম লেখাতে বোঝায় যে -- যুদ্ধ লইয়া এই কিসিমের উল্ডাসিধা মাতামাতির মাজেজাডা কী? ওই মিঞারা, কইলানা মাজেজাডা কী? যুদ্ধ তামাম দুইন্যেত এক-রহমই। কাফের-মালাউনের লগে মমিন-মুসলমানের ইমানী যুদ্ধ। কী বুঝলা? বুঝ্যো আমার চেটটা। খালি মালাউনের চেডের তলে মাথা নেওনের কুবুদ্ধি। ইসরে, নাওয়ের পুটকিত সিল মারে! অহন কী শুরু অইলো, যুদ্ধ নি? ওই মিঞারা, কি শুরু অইলো কওনা কেরে? এরে নি যুদ্ধ কয়! বন্দুকদে দুই-চারটা ছিডা গুলি মারলে আর আল্লাঅলা মুমিন-মুসলমানের জান কবজ করলেই যুদ্ধ অয়? হালার বুদাইর গুষ্ঠি।

সোহনপুরের নীরবতার ভিতর তার কথার স্পিড বাড়তেই থাকে -- ওহুদ-বদরের যুদ্ধের কিয়ের যুদ্ধ? কুন বেকুবের সল্লাত পইড়ে তুমরা খালি নাচো! ২/৪খান মালাউনের কথা দৌড় মারলেই দেশ স্বাদীন অইয়া গেলো? বেক্কলের বুইন্যেদ। মাসরেকি পাকিস্তানের লাইগ্যে যুদ্ধ অইলো গিয়া খাডি যুদ্ধ। কলবে ইমান ঠিক রাহো মিঞারা। এই সব কাফের-মালাউনের গুষ্ঠি নিব্বংশ অইয়া যাইবো। আল্লার লানত যে পড়বো হেই খবর রাহো! চিল্লাপাল্লার দিন খতম। রাজাকারের খাতায় নামখান লেহাইতে কই, খালি এরেস- মেরেস করো। হুনো।, ুমিক্ত-টুক্তির নাম-নিশানা পাইলে মেলেটারি স্যারেরারে নুটিশ করবা, না অইলে একটারঅ পুটকির চামড়া থাকতো না। সবগুলাইনরে গলাত গামছা লাগাইয়া সরারচর আর্মি-ক্যাম্পে হাজির করাইয়াম।

খাকি ড্রেসের লেফট-রাইট যখন-তখন সোহনপুরে বিচরণ করতে থাকে।

----------------

এ-সবেরও মাস ছয়েক পর, সময়ের সে-সব বুঝ-পরামর্শের ভিতর দিয়ে কায়েছালী সোহনপুরের কাঁচারাস্তায় হেঁটে হেঁটে রেন্ট্রি গাছ, ইউনিয়ন কাউন্সিল অফিস, বিআটিসি’র বীজ বিতরণ কেন্দ্র ও প্রাইমারী স্কুলটি পেরিয়ে মসজিদের দিকে আসতে থাকে, যখন কেউ একজন বিচ্ছিন্ন-বিহ্বলতার ভিতর জিজ্ঞেস করে -- কিরে রেজাকারের বাচ্চা হিহিহি, তুইও বাড়িত আইয়া পল্লে! তেমনই ঘটনাসমূহের কোনো এক জমায়েতে রেকমান মৌলবির কাছে-কিনারে ঘেঁষতে ঘেঁষতে মসি জদে ঢুকে কায়েছালী। গলা উঁচু করে সবার উদ্দেশ্যেই বলে -- আসসালামু আলাইকুম। রেকমান মৌলবি যেভাবে খইরাত শাহকে বিষয়টা কানে কানে বলতে থাকে তাতে খইরাত শাহই শুধু নয়; এই মাত্র খুতবা শ্রবণমুক্ত হওয়া অনেক মুসল্লিই পষ্ট বুঝতে পারে। রইমুদ্দী, শহর মিয়া, মব্বতালী, সুর্মা আক্তারের বড়োভাই ময়না মিয়া, সৌরভসহ অনেকেই বেসামাল ঝামেলার ভিতর পড়ে মাটি ফুঁড়ে উদয় হওয়া কায়েছালিকে দেখে। সে কথা শুরুর আগেই ময়না মিয়া করমালীর উঠানের ডানপাশ ঘেঁষে নিজের বাড়ির দিকে হাঁটতে থাকে। তার মাথা অতই সুানো যে, যেন আড়াই-মনী বস্তা তার মাথায় কে চাপিয়ে দিয়েছে। তবে তার পায়ের কদম এমনই জোরে জোরে চলে যেন বুকের ভিতর গজিয়ে উঠা কোনো নোনতা জলভেজা স্রোতকে অনবরত দূরে ঠেলে দিতে চাইছে।

রেকমান মৌলবি হরফের মতো থরে থরে ভাঁজ করা কথাগুলো পেশ করার জন্যই মুসল্লিদের সামনে দাঁড়ান। তিনি তাঁর কথাকে যেন ুদরত প্রধানের বাড়িটার উদ্দেশ্যেই জোরে জোরে বলেন -- মিঞারা নামাজের জামাত ত কমপ্লিটই। এখন বাড়ির দিকে না-যাইয়া আমাদের কুদরত সা’ বের মোকামের ফাইল পা বাড়াও। বিষয় কী! সোহনপুরের অনেকেই তখন এ বিষয়টা পরিস্কার করবার চায়। হঠাৎ এ আলামতের মানেটাই-বা কী! বিয়ে-শাদীর কোনো বিষয় না তো? কদিন ধরেই তো এরা শুনছে, কুদরত প্রধানের ছোটছেলের বিয়ের কথাবার্তা একরকম ফাইনালই, এখন কেবল সমাজ ডেকে দিন-তারিখের বিষয়টার একটা ফয়সালা করাটা কর্তব্য; তা আর এমনকি বিষয়। এ-সব কোনো বিবেচনার বিষয় হলো গো।

কায়েছালীর যদি কারও কাছে এ জীবনটাকে আধিয়া-বর্গা দিতেই হয় তা হলে তা তো ঐ সোহনপুরের মাথা কুদরত চাচার কাছেই দিবে। তা না হলে সোহনপুরের মানুষদের কী বিশ্বাসটা আছে? হারামজাদারা কী কথার কী অর্থ করে বসে তার কোনো ঠিকঠিকানা তো নাই! তবে রেকমান মৌলানার কথাও তার বিবেচনায় তাকে দিয়ে চাচার হাতে-পায়ে ধরিয়ে সবকিছু ঠিকঠাক করতে লাগলেন। তবে আজ যে সোহনপুরের বাড়িটাতে এদ্দিন পরে সে ফিরছে, তা কার জন্য? কুদরত চাচার জন্যই তো? তাইনের কলিজাটা মাশাল্লাহ উচা-লম্বায় পাক্কা ১৪ হাত। তাঁর বুকটার যত আন্ধাগুন্ধা ফাঁক আছে, তা সব মায়া-মহব্বতেই ঠাসা। কী করে যে তাকে কুদরত প্রধানের পায়ে ধরা অবস্থা থেকে তুললেন! যেন তিনি অধীর অপেক্ষায় ছিলেন কবে কায়েছালী সোহনপুরের মানুষকে সাক্ষী রেখে তার পায়ে লুটিয়ে পড়বে। সবকিছুর একটা নিয়ম-শৃঙ্খলা, আচার-বিচার আছে না! তিনি আঝছরের জামাত পড়ে আসা সামনের এই লোকগুলোকে কী চ,ৎকার নছিহত করলেন -- কী করবা মিঞারা তুমরাই কও, দশজনের উপরে ত কথা চলে না! দশ যেখানে আল্লাপাকও সেখানে। কায়েছ্যে বেকুবের পুতে দোষ একটা করছে। আর যেই দোষ করছে তা কী আল্লার দরবারে গেলেও মাফ করবো? তুমরাই ত এহন দেকলা, কী কান্দনডা কানতাছে! কও দেহি মিঞারা একন উপায় কী!


জটলাটির নীরবতার ভিতর আবারও কুদরত মিঞা তার বাকি কথাগুলো শুরু করেন এ-ভাবে--অহস কী আর অততা মনে রাহনের টাইম আছে? সোহনপুরটারে সক্কলে মিল্লামিশ্যা ফিরেকবার গইড়ে তুলনডা দরহার ত। নাহি কও? এক কাম কর, এই হারামীর পয়দা কায়েছ্যেরে অগলতে ধইরা-বাইন্ধা শিপুইন্যের মা’ডার পাঅ ধরা। হেই বেডিডার কইলজাডাত খুব দাগা দিছোররে তুই। যারে কুতুবুদ্দী, তর ভাইলারে লইয়া যা।

রহমালী যে এই ফাঁকে কথা বলে উঠবে তা কুদরত প্রধানের বিবেচনার ভিতর ছিল না, প্রথমেই তিনি রহমতালীর এই কথাগুলো শুনেন--ইতান কুনু বিবেচনার কথা অইলোগো পর্দাইন্যের পুত; এই সব কি মিলমিশের কুনু বিষয় অইলো? অতঃপর একটু ঝিম ধরে যান তিনি। এ কথাটায়যতই ভাঙাচুরা বেতাল মনে হোক, তার জবাবটা কুদরত প্রধানের জিবের সারা এলাকাব্যাপী সিরসির করে বাজতে থাকে এবং তিনি আশ্চর্য হওয়ার ভিতরই ফের নতুন তেজে তার কথা শুরু করেন -- যেই-সব তান বুঝোছ না, হেই-সব-তান লইয়া প্যাড়প্যাড়াছ কেরে? পর্দাইন্যের চেট কুনহানের! পরের যে কথাগুলোকে তিনি সোহনপুরের লোকজনের বুকে খোদাই করতে থাকেন তা হচ্ছে -- দ্যাশটার কইলচা-ফসকা কিচ্ছু রাখছেনি পাঞ্জইব্যেরা? তামা বানাইয়া ফালাইছে না! মানুষ ত ধরতে গেলে মানুষই; হেরার কেউ কি অন্যায্য কাম-কাজ করতে পারে না? লুম্বা বাছলে তো কম্বলই শেষ। না হি? আরে এই কায়েছ্যেরা ত আমরার ভাই-ভাতিজাঅই। ভুল একটা করছে, হেইডারে রুজ- কেয়ামত পর্যন্ত গিট্টাদে রাকলে ফর্তা পড়বো? কিয়ো মিঞারা কথা কওনাদি।

তাঁর কথার তাপে কায়েছালীর বুকের ওম নড়াচড়া করতে থাকে।

-------------------

শিপুন্যেই মা’র মতন পেটসর্বস্ব এক শহীদ পরিবার নিয়ে এখন কী করে কায়েছালী! কথার কথা এটা ধরলেও ধরা যায় যে, শিপুইন্যের তকরটা ৫ শতাংশ জায়গার ভিতরে পড়লেও এটাকে তো আর ইচ্ছে করে ফসলি-জমিতে বদলে ফেলছে না সে। আশপাশের জায়গাটাসহ শিল্প-কারখানা গড়ে নিতে পারলে বা আধুনিক চায়-বাস করলে খারাপ হবে কী? হাদী ম্বোর খাস-দিলে হাওয়ালা করে জায়ড়গাটা লিখে দিলেও শিপুইন্যের মা’র বদদোয়া থামে না। এতকাল পর এ-সব দেখলে চলে। বেকুবের দল জানে না যে রোজ কেয়ামতের আগে একটা কবরের উপর আরেকটা কবর পড়বে ৪০ বার। তা হলে এই জমিকে শিল্পকাজের অংশ বা ছাষাবাদ করলে ক্ষতিটা কী! কিন্তু এ জিনিসটাই শিপুইন্যের মা-টা বোঝে না। কুদরত চাচা নিজে এ-সব বয়ান করেন। তাদের আর কোনো কাজ-কাম নাই? চাষাবাদের কত বিচিত্র কায়দা-কানুন বাড়ছে সেই বেকুব মেয়েছেলেটার সে-দিকে একরতি বিবেচনা নাই। খালি খাবার-দাবারের মতো বাড়তি জিনিস নিয়ে যত আকথা-কুকথা। শিল্প আর সমাজসেবর ভিতর যে পরকালের আচানক নমুনা দেখা যাচ্ছে এখন, এদিকে এই মেয়েলোকটর কোনোই নজরদারি নাই। এভাবে আধামরা সংসারটার কোন্ কিসিমের আয়-উন্নতিটা হবে!

কায়েছালী বাড়ির বাইরে যেয়ে ফসলের মাঠ, প্রাইমারী স্কুল, মসজিদ পেরিয়ে শিপনের কবরটার শিথান ছাড়িয়ে পৈতানে দাঁড়ায়। ওর কবরটা নজরে আনতে গিয়ে কায়েছালীকে ভেজাইল্যে-ভাবনায় পড়ে যেতে হয় সেদিন। কারণ এটির ওপর যে এতবড়ো আমগাছটা হৃষ্টপুষ্ট হয়ে বেড়ে উঠেছে তা তো সে এতদিন খেয়ালই করেনি! এর পাতা আর ডালপালাা এত মাংসল! এ-সব দেখে- দেখেই কী শিপুইন্যের মা তার কথাগুলো খায়েশ মতো গুছিযে আনতে শুরু করেছে! নিশ্চয়ই গাছটি শিপুইন্রের রক্ত-মাংশ-হাড়গোড়-ত্বকের আবরণ, এমনকি গুলি-লাগা-জায়গাটাও চুষে নিয়েছে। গাছটার আচানক গন্ধ শুঁকতে গিয়ে তার সারা অঙ্গ রক্তবহুল চক্কর জাগে। যখনই শিপুইন্রের ঠান্ডা-মরা লাশটর কথা মনে হয়, তখনই মৃত্যুকালীন যুবা-বয়সের মানুষটা মিটমিটিযে হাসে। পাগলের মতন, জিদ্দাল মানুষের মতন, এ কেমন বেয়াদবি ছড়ায় শিপুইন্র্ ের্জিনতা ছিঁড়ে ছিঁড়ে এ কোন্ হাস্রময় ঘ্রাণ বাড়ে! ৩০-৩২ বছর পরও হালার ত্যাদরামি গে না? কায়েছালী গাছটির ডাল কাটাতে গিয়ে পড়ে বে-আন্দাজ ঝামেলায়। এ গন্ধ কে আবার তার রক্ত-মাংশে, জান-গতরে ছড়াতে শুরু করল! এমন তাপই-বা কোত্থেকে আসে; রক্তময বারুদের ঝাঁজ গলে গলে ঝরে যেন। তার ভাবচেতনার অনেকটাই ক্রমে ক্রমে এমন গন্ধের কববে জব্দ হয়ে যেতে থাকে। সে তাই রেকমান মৌলবি হয়ে কুদরত চাচার চাষাবাদ গবেষণার গভীরে নিজেকে নিয়োজিতদ করে ফেলতে চায়। শিপুইন্যের বাচ্চা শিপুইন্যে শুধু তার ভাবনার যাবতযি কোনাখামচিই দখল করেনি, জীবনের আয়-উন্নতিতেও হাত দিয়েছে। রাতটা পর্যন্ত সুখে-শান্তিতে কাটাতে দেয়া। বেতালে- বেঘেরে খোঁচায় কেবল। এর জন্র বেতেলকান্দার বড়োহুজুরের পানি-পড়া-খাওয়অও শেষ। কিচ্ছুতে কিচ্ছু হয় না। সময়ের পরলৌকিক আয়োজনে, জীবন গড়নে, এনকি শিল্প কিংবা ধান-চাষের সমুদয় নিযম বিস্তারের মর্ডান বিষযটা তো বিবেচনা করা লাগে -- নাকি? এ-সব ভেজাল থেকে দূরে থাকতেই কুদরত চাচার সঙ্গে ফের কথা বলে।


যখন কায়েছালীর হাতে মৌলবি রেকমানের চিঠিটা পৌঁছে, তখনই মনে হয়, এ সমাজে এমনকি সোহনপুরের মাটিতে যদি কিছু হয় তবে ওই কবরের উপরকার গাছ আর তার ছাযার ঘ্রাণ নিংগেই হবে। উচ্চ জননশীল ধান চাষ নিয়ে বসে না-থাকলে চলে? যে পারলৌকিক গন্ধটার কথা এ চিঠিতে বোঝা যায় : তাতে একটু কেন, শিপুইন্যের ষোলআনা কবর পড়লে কী করার আছে! তার সমগ্র ভাবনা এখন ধান-গম-ভুট্টা-শাক-সবজির বিচিত্র ঘ্রাণে ভরে যেতে থাকে। সবার মাঝে এটাই পষ্ট যে, সোহনপুরের যাবতীয় সৌন্দর্য এখন কৃষি, শিল্প বিষয়ক ঘ্রাণ আর পরলৌকিক সমাজসেবার নজরদারিতে ঠাসা। ভাবনা-চিন্তা করে, কষ্ট করে বাড়তি ভাবনায় থাকার দরকারটা কী? এখন তো সোহনপুরের তামাম বিষয়াদি এ ঘ্রাণ দিয়েই নির্মিত হতে পারে। শিপুইন্যের মা-টা কোন্ বুদ্ধিতে আজেবাজে নেশায় কিম্বা বুঝ-পরামর্শে মজে যায়!

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ