কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীর
এ এক বিজ্ঞাপন বটে-- নিজেকে নিজের মনে দেখার এক কাজ কাজ তো! এ হচ্ছে নিজের সাথে একধরনের বোঝাপড়া কিংবা সমঝোতা করে নেয়া, বা তা নিজের আশপাশ দেখানো হোক অথবা একধরনের বাসনা লালন করা হোক, এতে একধরনের বিজ্ঞাপনত্ব থাকে বা আছে কিন্তু। সারাজীবন ধরে নিজেকে আড়ালে রাখার বাসনার ভিতর এ কেমন এক কঠিন পরীক্ষা শুরু হলো আমার! আমি যেন এখন সদা হতচকিত এক আয়না নিয়ে ঘুরঘুর করছি। এ এক মহাফ্যাসাদের কথাও বটে। আমার মনে হচ্ছে এটা একধরনের অনুসরণ, নিজেকে নির্মাণের বা দেখার এক প্রচেষ্টা। এই দেখার ভিতর শুধু নয়, বর্তমান তো নয়ই, আসলে আমরা নিজের ব্যাপার বলে-টলে ভবিষ্যৎকেও দেখাচ্ছি। তার মানে আল্টিমেটলি, নিজেকে নিয়ে আমি একধরনের ইতিহাস চর্চায় মগ্ন হচ্ছি। এখানে কি নিয়ন্ত্রণ থাকবে না? আমি না বলে দিলেও থাকবে, কারণ এ হচ্ছে আড়ালের ভিতর দিয়ে একধরনের সভ্যতা বানিয়ে তোলা। আর মানুষ তার মানুষতার ভিতর সারাজীবনই সভ্যতার নামে আড়াল নির্মাণ করে গেছে। যাই হোক, তবু আমাকে নিয়ে আমি কিছু কথা বলব এখন।
আমার জন্ম একেবারে বিশুদ্ধ গ্রামে, অনেকটা ভাটি আর অনেকটা উজানের ভিতর, মানে এমন এক জায়গায় আমার জন্ম-- গ্রামঘোঁষা শহর, একেবারেই গ্রাম। জন্ম আমার মামাবাড়িতে-- শুধু আমি নয়, আমরা নয় ভাইবোনের সবারই জন্ম সেখানে। এটা কেন হলো!? এ প্রশ্নে মা হাসেন, এখানেও আড়াল, মায়ের আড়াল। যৌথপরিবারের নানান বঞ্চনার আড়াল। মেয়েমানুষের সারাজীবনের আড়াল যেন। মেয়েরা স্বভাবতই নিজের জন্মভিটায় নিজেকে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন, ছেলের পক্ষও অনেক অনেক দায়িত্ব থেকে বাঁচেন। গোটা একটা মানুষের জন্ম, তার প্রাথমিক লালন-পালন, যাবতীয় পরিচর্চা কী আর কম কথাগো! এখানে শ্রেণীর বিষয়ও থাকতে পারে, থাকতে পারে আভিজাত্য। কারণ আমার বড়োচাচীর বাচ্চারা তো আমার বাড়িতেই জন্মালেন! যাই হোক, আমার জন্মটা ছিল শুক্রবারে, সন্ধ্যার দিকে। কাঁদতে খুব একটা দেরি নাকি করিনি আমি। তবে এই জীবনের নিরবতার প্রতি পক্ষপাত তখনও নাকি ছিল! মাকে এ নিয়ে প্রশ্ন করার পর জেনেছি, আমার জন্ম জ্যৈষ্ঠ মাসের দিকে, তখন পাটের মৌসুম। এমনই এক সময়ে আমার জন্ম। অথচ কাগজপত্রে তা নেই, তার সাথে তো তেমন মিলে না! আমার জন্মতারিখ কার্যত লেখাই ছিল না! আমার এ জন্মতারিখ বসিয়েছেন আমার বাবা আর প্রাইমারী স্কুলের হেড-টিচার মোতালেব স্যার। এই তারিখ তাহলে একধরনের সামাজিকতার ভিতর দিয়েই প্রাপ্ত। আমার মায়ের কোনো ভূমিকা নাই তাতে? নাকি কিছুই মনে করা হয়নি তাকে? আমি ঠিক জানি না। তবে তিনি যে খুব একটা পারিবারিক অবহেলায় ছিলেন তা কিন্তু নয়। আমার দাদার ধারণা, তার বড়োছেলের এ বিয়ের মাধ্যমে সমাজে তার মর্যাদাই বেড়েছে। আবার বাবা তো তখনকার ইন্টারমেডিয়েট পর্যন্ত পড়াশুনা করেছেন, আমার চাচাতো-দাদা রেলওয়েতে তখনকার দিনে ইন্সপেক্টর লেভেলে চাকরি করতেন, এলাকার তাকে অনেকেই চিনতেন, মান্যগণ্য করতেন। আমার নানাবাড়ির মোহ ছিল বাবার বড়ো-চাচার পারিবারিক এই সম্মানের প্রতি। পারিবারিক দ্বন্দ্ব আর অহঙ্কার তবে সর্বত্রই কাজে লাগে! আমি পড়াশুনা করেছি গ্রামের ইশকুলে, নাম তার সরিষাপুর ফ্রি প্রাইমারী স্কুল; হাইস্কুল হচ্ছে-- ক্লাস সিক্সে পড়েছি কিশোরগঞ্জের বাজিতপুরস্থ সরারচর শিবনাথ উচ্চ বিদ্যালয়ে; সেভেন থেকে এসএসসি পড়েছি বাজিতপুর বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ে। আমার কলেজ ছিল বাজিতপুর ডিগ্রি কলেজ, মেডিকেল হচ্ছে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ।
আমি বাজিতপুর বহুমুখী উচ্চবিদ্যালয় আর কলেজে সাধারণত সাইকেলেই যেতাম, কখনও কখনও হেঁটে গিয়েছি। আমি হিসাব করে দেখেছি স্কুল-কলেজ মিলিয়ে আমি সাড়ে সাত হাজার মাইল হেঁটে বা সাইকেলে চলাচল করেছি। এতে আামার পরিবারের বর্তমান লোকজন হাঁ হয়ে এ গল্প শোনেন! তবু এ জীবন মোটেই কষ্টের ছিল না। বার বার সেই সময়ের কথা মনে হয় আমার, আমার গ্রামের কথা মনে হয়, কী এ স্বর্গীয় আবাহনের এক ইশারা পাই যেন। আমার ব্যক্তিত্ব বিকাশের বিষয় বলে যদি আলাদা কিছু চিহ্নিত করতে হয়, তা তো নিশ্চয়ই গ্রাম থেকেই শুরু হয়েছে। রাজনীতির প্রাথমিক পাঠের শুরুই সেখান থেকে, মানুষ যে রাজনৈতিক জীব তা আমি শুরু করেছিলাম সেই বালকবেলায়। আমার এখনও মনে আছে, ক্লাস ক্লাস ফোর-এ পড়ার টাইমেই নৌকা মার্কার মিছিল নিয়ে পাশের থানা নিকলি চলে গেছিলাম, শেখ সাবের মিটিং বলে কথা। আমার হাঁটু পর্যন্ত লেগেছিল অজস্র ধুলাবালি। এখনও যেন সেই ধুলাবালির কড়ামিঠে গন্ধ পাই। কথাক্রমেই বলি, আমাদের সময় পায়ে জুতা, প্যান্ট ইত্যাদির প্রচলনও তেমন ছিল না। আহা মোর পদরেখা, সে তো ঢেকে দিতে থাকি, মানে রেগুলার জুতা-স্যান্ডেল পড়ি সেভেন-এইটে পাঠকালে। আমি তো প্যান্ট-বেল্ট ইত্যাদি ব্যবহার করি কলেজে যাওয়ার পর। আসলে গ্রামীণ জীবনই আমরা সহজভাবে উপভোগ করতে পারতাম। আমার তো মনে পড়ে না কোনোদিন কোচিং বা প্রাইভেট পড়েছি! তখন তো বিটিভিই ভরসা ছিল-- ৮০ থেকে তা আমরা দেখি, সারা মেডিকেলের ভিতর মেইন হোস্টেলেই একটা টিভি ছিল। গ্রামের বাড়িতে গেলে একেবারে বাজিতপুর যেতে হতো তা দেখার জন্য। যাই হোক, যুদ্ধের গল্পে আসি। তখন স্থানীয় ছাত্রলীগ নেতা মিজুমামা ছিলেন আমাদের সার্বিক গাইড। সেই মামা মুক্তিযোদ্ধা হয়ে একেবারে ষড়যন্ত্রের স্বীকার পড়ে একাত্তরের একেবারে শেষ দিকে মারা যান। মুক্তিযুদ্ধের পর আমরা দেখলাম আরেক যুদ্ধ। মানুষ বিজয়ে চারপাশ কাঁপাচ্ছে, আমরা স্বজন হারানোর শোকে, বিচার-প্রার্থনায় সদাকাতর। আবারও দেখলাম, যুদ্ধ যে শেষ হবার নয়! এখন দরকার অর্থনৈতিক মুক্তি। সশস্ত্র আন্ডারগ্রাউন্ড রাজনীতির প্রতি নেশা জাগল। মানুষ সমানে এই রাজনীতির প্রতি ঝুঁকতে শুরু করেছে। আমার আপন বড়োভাই সাম্যবাদী দলের সাথে সংশি-ষ্টতায় জেলে যেতে বাধ্য হলেন। ফলত রক্ত, যুদ্ধ আর মৃতের রক্তাক্ত চিৎকার আমার কথাশিল্পে বার বার আসে। আমাদের গ্রাম ছিল নাটকপাগলা এক গ্রাম। সেই গ্রামেই সাংস্কৃতিক জীবনের হাতেখড়ি আমার। তাই সারাজীবন হয়ত নানাভাবে বহনও করছি। মেডিকেল লাইফও অনেকটা চমৎকারই ছিল। পড়াশুনা তো ছিলই, রাজনীতির একটা সজীব ধারা ছিল, সাহিত্য ছিল। এরশাদের পুলিশের প্যাদানি ছিল।
আমার সাহিত্যচর্চার প্রাথমিক ধারণাটা স্কুল-কলেজে খানিক ছিল, আমরা কলেজে ওয়াল ম্যাগাজিন বের করতাম। সেই ওয়াল ম্যাগাজিন মেডিকেল কলেজেও ছিল। এখন তা আছে কিনা জানি না। আমার এ সাহিত্যচর্চা ৮৬-৯৭ পর্যন্ত অনেকটাই কেবল পাঠের ভিতরই সীমাবদ্ধ ছিল। এরপর থেকে সাহিত্যচর্চা শুরু করি। কেন শুরু করি আমি ঠিক জানি না, মনে হয় আমার জীবনযাপন, রাজনীতি, যাবতীয় চলাচলের ভিতর বিশাল এক হাহাকারকে ভরাট করার জন্যই আমার লেখালেখির শুরু। আমার মনে পড়ছে হুমায়ূন মালিকের সাথে অনেক সময় আমি সাহিত্যকথনে পার করেছি। নানান আলোচনা, তর্ক, সমঝোতা ইত্যাদির ভিতর দিয়েই গেছি আমরা। রেলওয়েতে কর্মযজ্ঞের সুবাদে তমিজউদ্দীন লোদী আর মোহাম্মদ শামছুজ্জামানের সাথে অনেক মতবিনিময় করেছি। একটা পর্যায়ে হরিশঙ্কর জলদাসের সাথে আমার দারুণ সখ্যতা ছিল। সাহিত্যিক খালেদ হামিদীর কথাও স্মরণ করতে হয়। কথা বের করার সুবাদে অনেকের সাথেই নতুন করে সাহিত্যিক সম্পর্ক আরও প্রাণবন্ত হয়। আমার প্রথম গল্প বেরোয় মুক্তকণ্ঠ-এ, টোকন ঠাকুর তখন এর সাহিত্য দেখতেন। প্রথম প্রকাশিত গল্পের নাম জলে ভাসে দ্রৌপদী, ১৯৯৮ সালের দিকে লেখা। সেই আমার লেখালেখির শুরু।
৫.২.২০১৩
এ এক বিজ্ঞাপন বটে-- নিজেকে নিজের মনে দেখার এক কাজ কাজ তো! এ হচ্ছে নিজের সাথে একধরনের বোঝাপড়া কিংবা সমঝোতা করে নেয়া, বা তা নিজের আশপাশ দেখানো হোক অথবা একধরনের বাসনা লালন করা হোক, এতে একধরনের বিজ্ঞাপনত্ব থাকে বা আছে কিন্তু। সারাজীবন ধরে নিজেকে আড়ালে রাখার বাসনার ভিতর এ কেমন এক কঠিন পরীক্ষা শুরু হলো আমার! আমি যেন এখন সদা হতচকিত এক আয়না নিয়ে ঘুরঘুর করছি। এ এক মহাফ্যাসাদের কথাও বটে। আমার মনে হচ্ছে এটা একধরনের অনুসরণ, নিজেকে নির্মাণের বা দেখার এক প্রচেষ্টা। এই দেখার ভিতর শুধু নয়, বর্তমান তো নয়ই, আসলে আমরা নিজের ব্যাপার বলে-টলে ভবিষ্যৎকেও দেখাচ্ছি। তার মানে আল্টিমেটলি, নিজেকে নিয়ে আমি একধরনের ইতিহাস চর্চায় মগ্ন হচ্ছি। এখানে কি নিয়ন্ত্রণ থাকবে না? আমি না বলে দিলেও থাকবে, কারণ এ হচ্ছে আড়ালের ভিতর দিয়ে একধরনের সভ্যতা বানিয়ে তোলা। আর মানুষ তার মানুষতার ভিতর সারাজীবনই সভ্যতার নামে আড়াল নির্মাণ করে গেছে। যাই হোক, তবু আমাকে নিয়ে আমি কিছু কথা বলব এখন।
আমার জন্ম একেবারে বিশুদ্ধ গ্রামে, অনেকটা ভাটি আর অনেকটা উজানের ভিতর, মানে এমন এক জায়গায় আমার জন্ম-- গ্রামঘোঁষা শহর, একেবারেই গ্রাম। জন্ম আমার মামাবাড়িতে-- শুধু আমি নয়, আমরা নয় ভাইবোনের সবারই জন্ম সেখানে। এটা কেন হলো!? এ প্রশ্নে মা হাসেন, এখানেও আড়াল, মায়ের আড়াল। যৌথপরিবারের নানান বঞ্চনার আড়াল। মেয়েমানুষের সারাজীবনের আড়াল যেন। মেয়েরা স্বভাবতই নিজের জন্মভিটায় নিজেকে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন, ছেলের পক্ষও অনেক অনেক দায়িত্ব থেকে বাঁচেন। গোটা একটা মানুষের জন্ম, তার প্রাথমিক লালন-পালন, যাবতীয় পরিচর্চা কী আর কম কথাগো! এখানে শ্রেণীর বিষয়ও থাকতে পারে, থাকতে পারে আভিজাত্য। কারণ আমার বড়োচাচীর বাচ্চারা তো আমার বাড়িতেই জন্মালেন! যাই হোক, আমার জন্মটা ছিল শুক্রবারে, সন্ধ্যার দিকে। কাঁদতে খুব একটা দেরি নাকি করিনি আমি। তবে এই জীবনের নিরবতার প্রতি পক্ষপাত তখনও নাকি ছিল! মাকে এ নিয়ে প্রশ্ন করার পর জেনেছি, আমার জন্ম জ্যৈষ্ঠ মাসের দিকে, তখন পাটের মৌসুম। এমনই এক সময়ে আমার জন্ম। অথচ কাগজপত্রে তা নেই, তার সাথে তো তেমন মিলে না! আমার জন্মতারিখ কার্যত লেখাই ছিল না! আমার এ জন্মতারিখ বসিয়েছেন আমার বাবা আর প্রাইমারী স্কুলের হেড-টিচার মোতালেব স্যার। এই তারিখ তাহলে একধরনের সামাজিকতার ভিতর দিয়েই প্রাপ্ত। আমার মায়ের কোনো ভূমিকা নাই তাতে? নাকি কিছুই মনে করা হয়নি তাকে? আমি ঠিক জানি না। তবে তিনি যে খুব একটা পারিবারিক অবহেলায় ছিলেন তা কিন্তু নয়। আমার দাদার ধারণা, তার বড়োছেলের এ বিয়ের মাধ্যমে সমাজে তার মর্যাদাই বেড়েছে। আবার বাবা তো তখনকার ইন্টারমেডিয়েট পর্যন্ত পড়াশুনা করেছেন, আমার চাচাতো-দাদা রেলওয়েতে তখনকার দিনে ইন্সপেক্টর লেভেলে চাকরি করতেন, এলাকার তাকে অনেকেই চিনতেন, মান্যগণ্য করতেন। আমার নানাবাড়ির মোহ ছিল বাবার বড়ো-চাচার পারিবারিক এই সম্মানের প্রতি। পারিবারিক দ্বন্দ্ব আর অহঙ্কার তবে সর্বত্রই কাজে লাগে! আমি পড়াশুনা করেছি গ্রামের ইশকুলে, নাম তার সরিষাপুর ফ্রি প্রাইমারী স্কুল; হাইস্কুল হচ্ছে-- ক্লাস সিক্সে পড়েছি কিশোরগঞ্জের বাজিতপুরস্থ সরারচর শিবনাথ উচ্চ বিদ্যালয়ে; সেভেন থেকে এসএসসি পড়েছি বাজিতপুর বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ে। আমার কলেজ ছিল বাজিতপুর ডিগ্রি কলেজ, মেডিকেল হচ্ছে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ।
আমি বাজিতপুর বহুমুখী উচ্চবিদ্যালয় আর কলেজে সাধারণত সাইকেলেই যেতাম, কখনও কখনও হেঁটে গিয়েছি। আমি হিসাব করে দেখেছি স্কুল-কলেজ মিলিয়ে আমি সাড়ে সাত হাজার মাইল হেঁটে বা সাইকেলে চলাচল করেছি। এতে আামার পরিবারের বর্তমান লোকজন হাঁ হয়ে এ গল্প শোনেন! তবু এ জীবন মোটেই কষ্টের ছিল না। বার বার সেই সময়ের কথা মনে হয় আমার, আমার গ্রামের কথা মনে হয়, কী এ স্বর্গীয় আবাহনের এক ইশারা পাই যেন। আমার ব্যক্তিত্ব বিকাশের বিষয় বলে যদি আলাদা কিছু চিহ্নিত করতে হয়, তা তো নিশ্চয়ই গ্রাম থেকেই শুরু হয়েছে। রাজনীতির প্রাথমিক পাঠের শুরুই সেখান থেকে, মানুষ যে রাজনৈতিক জীব তা আমি শুরু করেছিলাম সেই বালকবেলায়। আমার এখনও মনে আছে, ক্লাস ক্লাস ফোর-এ পড়ার টাইমেই নৌকা মার্কার মিছিল নিয়ে পাশের থানা নিকলি চলে গেছিলাম, শেখ সাবের মিটিং বলে কথা। আমার হাঁটু পর্যন্ত লেগেছিল অজস্র ধুলাবালি। এখনও যেন সেই ধুলাবালির কড়ামিঠে গন্ধ পাই। কথাক্রমেই বলি, আমাদের সময় পায়ে জুতা, প্যান্ট ইত্যাদির প্রচলনও তেমন ছিল না। আহা মোর পদরেখা, সে তো ঢেকে দিতে থাকি, মানে রেগুলার জুতা-স্যান্ডেল পড়ি সেভেন-এইটে পাঠকালে। আমি তো প্যান্ট-বেল্ট ইত্যাদি ব্যবহার করি কলেজে যাওয়ার পর। আসলে গ্রামীণ জীবনই আমরা সহজভাবে উপভোগ করতে পারতাম। আমার তো মনে পড়ে না কোনোদিন কোচিং বা প্রাইভেট পড়েছি! তখন তো বিটিভিই ভরসা ছিল-- ৮০ থেকে তা আমরা দেখি, সারা মেডিকেলের ভিতর মেইন হোস্টেলেই একটা টিভি ছিল। গ্রামের বাড়িতে গেলে একেবারে বাজিতপুর যেতে হতো তা দেখার জন্য। যাই হোক, যুদ্ধের গল্পে আসি। তখন স্থানীয় ছাত্রলীগ নেতা মিজুমামা ছিলেন আমাদের সার্বিক গাইড। সেই মামা মুক্তিযোদ্ধা হয়ে একেবারে ষড়যন্ত্রের স্বীকার পড়ে একাত্তরের একেবারে শেষ দিকে মারা যান। মুক্তিযুদ্ধের পর আমরা দেখলাম আরেক যুদ্ধ। মানুষ বিজয়ে চারপাশ কাঁপাচ্ছে, আমরা স্বজন হারানোর শোকে, বিচার-প্রার্থনায় সদাকাতর। আবারও দেখলাম, যুদ্ধ যে শেষ হবার নয়! এখন দরকার অর্থনৈতিক মুক্তি। সশস্ত্র আন্ডারগ্রাউন্ড রাজনীতির প্রতি নেশা জাগল। মানুষ সমানে এই রাজনীতির প্রতি ঝুঁকতে শুরু করেছে। আমার আপন বড়োভাই সাম্যবাদী দলের সাথে সংশি-ষ্টতায় জেলে যেতে বাধ্য হলেন। ফলত রক্ত, যুদ্ধ আর মৃতের রক্তাক্ত চিৎকার আমার কথাশিল্পে বার বার আসে। আমাদের গ্রাম ছিল নাটকপাগলা এক গ্রাম। সেই গ্রামেই সাংস্কৃতিক জীবনের হাতেখড়ি আমার। তাই সারাজীবন হয়ত নানাভাবে বহনও করছি। মেডিকেল লাইফও অনেকটা চমৎকারই ছিল। পড়াশুনা তো ছিলই, রাজনীতির একটা সজীব ধারা ছিল, সাহিত্য ছিল। এরশাদের পুলিশের প্যাদানি ছিল।
আমার সাহিত্যচর্চার প্রাথমিক ধারণাটা স্কুল-কলেজে খানিক ছিল, আমরা কলেজে ওয়াল ম্যাগাজিন বের করতাম। সেই ওয়াল ম্যাগাজিন মেডিকেল কলেজেও ছিল। এখন তা আছে কিনা জানি না। আমার এ সাহিত্যচর্চা ৮৬-৯৭ পর্যন্ত অনেকটাই কেবল পাঠের ভিতরই সীমাবদ্ধ ছিল। এরপর থেকে সাহিত্যচর্চা শুরু করি। কেন শুরু করি আমি ঠিক জানি না, মনে হয় আমার জীবনযাপন, রাজনীতি, যাবতীয় চলাচলের ভিতর বিশাল এক হাহাকারকে ভরাট করার জন্যই আমার লেখালেখির শুরু। আমার মনে পড়ছে হুমায়ূন মালিকের সাথে অনেক সময় আমি সাহিত্যকথনে পার করেছি। নানান আলোচনা, তর্ক, সমঝোতা ইত্যাদির ভিতর দিয়েই গেছি আমরা। রেলওয়েতে কর্মযজ্ঞের সুবাদে তমিজউদ্দীন লোদী আর মোহাম্মদ শামছুজ্জামানের সাথে অনেক মতবিনিময় করেছি। একটা পর্যায়ে হরিশঙ্কর জলদাসের সাথে আমার দারুণ সখ্যতা ছিল। সাহিত্যিক খালেদ হামিদীর কথাও স্মরণ করতে হয়। কথা বের করার সুবাদে অনেকের সাথেই নতুন করে সাহিত্যিক সম্পর্ক আরও প্রাণবন্ত হয়। আমার প্রথম গল্প বেরোয় মুক্তকণ্ঠ-এ, টোকন ঠাকুর তখন এর সাহিত্য দেখতেন। প্রথম প্রকাশিত গল্পের নাম জলে ভাসে দ্রৌপদী, ১৯৯৮ সালের দিকে লেখা। সেই আমার লেখালেখির শুরু।
৫.২.২০১৩
2 মন্তব্যসমূহ
খুব সহজ সরল ভাষায় নিজের জন্ম বেড়ে উঠা আর লেখা লেখির শুরুর কথা। আন্ডার গ্রাউন্ড রাজনীতি নেয়া আলাদা লেখা যাইনা? প্রত্যাশায়।
উত্তরমুছুনঅদ্ভুত সুন্দর -----
উত্তরমুছুন