কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীরের গল্প সম্পর্কে কিছু কথা


তিনি গল্পলিখনের প্রক্রিয়ায় থাকেন। এবং এরই মধ্যে তিনি ৫০টির মতো গল্প লিখেছেন। তার কাছে গল্প এক সাধনার বিষয়। তাঁর গল্পের প্রায় চরিত্র বা ঘটনা অনেক স্থানে ঘুরলেও মনে হবে তারা একই ঘুর্ণিপাকে ঘুরছে, একধরনের সমন্বিত চৈতন্য হয়ত তারা লালন করেন। কখনো তারা সমাজ ভাঙার মানুষ, কখনও প্রতিষ্ঠানকে নির্ণয় করতে করতে তাই ভাংতে চায়! একটা জনপদকে ঘিরে তারা কিছু ক্রিয়া করে যাচ্ছে। সময়, ইতিহাস, রাষ্ট্রনির্ধারিত কিছু কাজের বাইরে খুব বেশি কিছু করতে পারছে না ওরা। মূলত অনেকেই নিয়মনির্ধারিত কিছু শৃংখলের ভিতর সময় পার করছে। তিনি তার গল্পচর্চার শুরুতে যেখানে রিয়েলিস্টিক চর্চাকে গুরুত্ব দিতেন, তাই ক্রমশ যেন স্বপ্নবাস্তবতার দিকে মোড় নেয়। ভাষার বদল ঘটে। একধরনের প্রগতিশীল নৈরাজ্য তার আরাধনা হয়। প্যারালাল বাস্তবতা খোজেঁন তিনি। মুক্তচৈতন্যের বিকাশ চান। তিনি ক্রমশ স্বোপার্জিত ঈশ্বরত্ব লালনে যেন ব্রতী হোন। লৌকিক ধর্মের কাছে একধরনের প্রশ্রয় চান। রিয়েলিজমের সেই আবহ থেকেই ক্রমশ কোথায় যেন নিজের ঠিকানা নিতে চান। মুক্তিযুদ্ধ, তার পরবর্তী সশস্ত্র বাম-রাজনীতির প্রতি আছে তার প্রবল আগ্রহ। মৃতের কিংবা রক্তের জগতে আপনাকে স্বাগতম নামের গ্রন্থে তা তিনি প্রকাশ করতে চেয়েছেন। তার গল্পে মৃত আর রক্তজ অবস্থানের এক প্রতি-নিয়ম যেন চালু থাকেন। তিনি তার পাঠককে স্বস্তি দেন না; আরাম তাদের কপালে নেই। যেন তিনি ছায়াময় আড়াল থেকে তার পাঠককে কঠোর রোদ্দুরের ভিতর, রক্তাক্ত জোছনার ভিতর চুবিয়ে রাখতে চান। তিনি আলো খোজেঁন, স্বপ্ন দিয়ে তার বানাতে চান। তেমন এক গল্প এ তবে ছায়ার গল্প। ‘কোনো এক সকাল’ গল্পের কথাই ধরা যাক, যেখানে সামরিক নিয়ন্ত্রিত ও হিরোইজমে বাড়বাড়ন্ত এক রাষ্টনিয়ন্ত্রিত সকালের কথা উঠে আসে। মানুষের মৃত্যু, ধর্মের ওপর ভিত্তি করে রাষ্ট্রভাগের যন্ত্রণা, রাষ্ট্রশাসনের আওতায় কথিত সংখ্যালঘুর ওপর জান্তব পেষণ, রাজনীতির ওপর রাষ্ট্রের মায়াহীন দখল, স্বপ্নদেখা কর্নেলের হিংস্র ফাসি কার্যকর করা, নারীর ওপর সামাজিক-রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন, রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত চিকিৎসাসঙ্কট, যাত্রার মতো প্রাচীন ঐতিহ্যের প্রতি রাষ্ট্রের নিদারুণ অবহেলা, বুর্জোয়া রাজনীতির ফাঁকা আস্ফালন, দেশভাগের যন্ত্রণা, ক্ষত, রাষ্ট্রপালিত উর্দি কর্তৃক মাটিঘেঁষা মানবকে পেষণ তার গল্পের মূল উপজীব্য হয়ে আছে।

ইদানীং তিনি মানবপ্রেম, যৌনতা, মানুষের প্রকৃত স্বাধীনতা নিয়ে বেশ কিছু গল্প লিখেছেন। এ ধারার উল্লেখযোগ্য গল্প হচ্ছে, ভালোবাসাসনে আলাদা সত্য রচিত হয়, অক্ষরে যখন অক্ষরের বদল ঘটে, পাহাড় কিংবা কতিপয় জীবন প্রণালী, সে তার গল্পে যেভাবে বিরাজ করে, এ আত্মহত্যাহত্যামুখর প্রকল্প, কী কথা তার সনে... ইত্যাদি।





আবার প্রকৃতির ভিতর দিয়েও তিনি যেন আলাদা এক সত্য পেতে চান, জীবন যেন প্রকৃতির অংশ_ তেমন গল্প 'যখন ওরা এক ভ্রমণগল্প সৃজনে মত্ত হয়', C/O গিরিছায়া ইত্যদি প্রাসঙ্গিক গল্প।
অস্ত্রমুখর ভূগর্ভস্থ বামরাজনীতি শুধু নয়, কিছু চরিত্রও এখানে জলজ্যান্ত হয়ে আছে, যেমন কর্নেল তাহের (সেই এক কর্নেলের গল্প), সিরাজ শিকদার (তাকে আর খুঁজে পাওয়া যায় না), কমরেড মোফাখখর (যেভাবে তিনি খুন হতে থাকেন। এমনকি হুমায়ুন আজাদের রক্তাক্ত চিহ্ন তার গল্পে দেখা যায় (এখানে চিহ্ন সংগ্রহ করা হয়)।

এসবই তাঁর ভাষারও বদল ঘটায়, গল্পই ক্রমাগত তার ভাষা বদলায়, এক গল্পে বা ভিন্ন গল্পে প্যারায় কিংবা একই বাক্যে ভিন্নভিন্ন ধরন লক্ষ করা যায়। বলা যায়, একধরনের গল্পমেজাজ দ্বারা তিনি নিয়ন্ত্রিত_ এ তো জনপদের সাথে একধরনের রূপান্তরবাদী কর্ম, ভাষাজনিত একধরনের মোটিভেশন বলা যেতে পারে। মূল প্রসঙ্গ হচ্ছে, এর সবই স্বপ্ন ভেঙে যাওয়ার, স্বপ্ন গড়ার রক্তাক্ত চিৎকারের সমাহার যেন।



পদ্মাপাড়ের দেহজীবীদের নিয়ে লেখেন প্রাণস্পর্শী উপন্যাস পদ্মাপাড়ের দ্রৌপদী। তা-ছাড়া কথাসাহিত্য বিষয়ে তিনি নিরন্তর নানান প্রবন্ধ লিখে যাচ্ছেন। তিনি মূলত সাহিত্যনিমগ্ন মানুষ।
সেই ২০০৩ থেকে কথাসাহিত্যের কাগজ কথা বার করছেন। এবার এ জন্য লিটলম্যাগ প্রাঙ্গণ পুরস্কারও পান।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

1 মন্তব্যসমূহ