আনোয়ার শাহাদাত
‘দক্ষিণা’ বলে অপবাদ কি গালি খাওয়া গাঁও-গেরাম অঞ্চলের লোক, আষাঢ়-শ্রাবণ মাসের কাদা-পানি প্যাঁকে খাওয়া পা দু’খানার ঘায়ের দুর্গন্ধের সাথে ভাদ্র মাসের ভ্যাপসা গরমের কষালো ঘামের যোগ বমি উদ্গীরণতুল্য দুর্গন্ধ সৃষ্টিকারী লোকটি যে কিনা এখন বাংলা সাহিত্যের জনপ্রিয় লেখক আবসার হাসানের সামনে এবং যার কাহিনী কোনো না কোনোভাবে শুরু হয় আমেরিকা থেকে।
কাজেম আলী নামের লোকটি বরগুনা-ঢাকা লাইনের দোতালা লঞ্চে এসে সকাল বেলা সদরঘাটে নেমে সঙ্গের ঠিকানা অনুযায়ী ধানমণ্ডি লেকের পাড়ে সদ্যনির্মিত বিশাল কথিত অট্টালিকা সমান এপার্টমেন্ট বিল্ডিংয়ের সামনে এসে দাঁড়ায়। তার দাঁড়ানোর ভঙ্গিটির কোন পরিবর্তন হয় না যেমন ক্ষেতের আগাছা বাছতে কি লাঙ্গল জোয়াল টেনে ক্লান্ত গরুর বিরতির জন্যে জোয়ালখানা খুলে গরুর খুঁড়ার উপরে ও নিজের ঊরুতে কামড়ে জড়িয়ে থাকা জোঁক ফেলে সূর্য ঢাকতে কপালের উপরে হাতটা রেখে বাড়ির কান্দির দিকে চোখ কুঁচকিয়ে কোমরটা মচকে যাওয়ার মতো দাঁড়িয়ে দেখা বাড়ি থেকে খাবার নিয়ে কেউ এলো কিনা, চাষা কাজেম আলী ইচ্ছায় কি অনিচ্ছায় ওই রকমই দাঁড়ায়, যাকে ঢাকার শহর অনুপোযোগী বলে একটি লোক বিবেচনা করা গেলেও যেতে পারে, সেই লোকটিকেই ওই মুহূর্তে এই বিলাসবহুল এপার্টমেন্টের দারোয়ানদের পক্ষ থেকে নিশ্চিত করা হয় যে এই ঠিকানাই তার সঙ্গে থাকা কাগজে লেখা রয়েছে, যে-কাগজখানা সঙ্গে নিয়ে আসা দুটো পুরোনো লুঙ্গি দিয়ে বানানো পোঁটলা দুটোর দ্বিতীয়টা থেকে মোড়ানোর পর মোড়ানো বিধ্বস্ত কাগজের ভেতর থেকে বের করা হয়। কাজেম আলীর কাছে থাকা ঠিকানার বর্ণনা অনুযায়ী ধানমণ্ডি এলাকার অভিজাত তালিকায় উল্লেখযোগ্য এই এ্যাপার্টমেন্টের কথা থাকলেও ভবনের সার্বক্ষণিক কর্তব্যরত দারোয়ান বাহিনী এই মর্মে সন্তুষ্ট হতে পারে না যে, এমন একটা চাষা চেহারার লোক এ এ্যাপার্টমেন্টের কোনো সদস্যের বাড়িতেই যাওয়ার উপযোগী হতে পারে, তাও কিনা এমন এক লোকের নাম ও এ্যাপার্টমেন্টের কথা উল্লেখ করা আছে যার বাসায় এই সব দারোয়ানরা ভাবতেই পারে না এমন একটা চাষা এসে ঢুকবে বা ঢুকতে পারে, কথা হচ্ছে আবসার হাসানের বাসা নিয়ে। আবসার হাসানের প্রতিটি উপন্যাসের পেছনে ছবিসহ লেখা থাকে তিনি সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেছেন জাতীয় তথ্য, দারোয়ানরা সে-সব বই দেখেছে, কখনো তা পড়েছে, ও পড়ে বিনোদিত হয়েছে, একে অপরকে তৃপ্তির সঙ্গে বলেছে, লিক্ছে এক্খান জব্বর। তাদের ভাষায় ‘জব্বর’ এই লেখক বাংলা সাহিত্যের এ সময়ের সবচেয়ে জনপ্রিয়দের একজন, সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্ম, আল্লা-বিল্লা সামাজিক দায়িত্বসহ যাবতীয় ম্যাসেজে ভরপুর ঔপন্যাসিক, গত বছরও যার ডজনখানা উপন্যাস প্রকাশিত হয়েছে, তার আগের বারও প্রায় সমসংখ্যক ক’খানা বেরিয়েছিল, তারও আগের বার নিজের লেখা বইয়ের সংখ্যা অবশ্য জোড়সংখ্যার, তা প্রায় কমছে কম ১৪খানা কি তারও কিছু বেশি সেই তুলনায় গত বারের ক’খানা সংখ্যা নিচে নামার কারণে আগামীতে ১৬খানা প্রকাশের পরিকল্পনা করেছেন লেখক, সে-অনুযায়ী কাজও করে যাচ্ছেন তিনি অর্থাৎ লিখছেন। তাঁর স্ত্রী আতিয়া সিদ্দিকা হাসান নিজের গলার স্বর্ণালংকারে সহসা পাঁচ আঙ্গুল বোঝাই ভারী সব আংটি সহযোগের হাত সঞ্চালন করে অন্যদের সাথে যে-ধরনের কথাবার্তা বলেন বা বলতে পছন্দ করেন স্বামী প্রসঙ্গে, আল্লার ইচ্ছায় ‘সুলেখক’, মাল-ছামানা, ধন সম্পত্তি যাবতীয় যা তা লেখকের পক্ষে সম্ভব হওয়ার কথা না, কিন্তু আমাদের ওনার উপর তেনার নেকনজর আছে, ‘তেনা’ বলে লেখক-স্ত্রী ‘সৃষ্টিকর্তা’ তেনার কথা বলেন বোঝা যায়। ‘সুলেখক’ স্ত্রী হয়তো আরো বলতে থাকেন, তা ছাড়া উনি সব ধরনের মানুষের সঙ্গে ওঠ-বস করেন, লেখক মানুষ তাই বড়-ছোট, ছোট-বড় যত্তলোক সক্কলের সঙ্গে ওঠ-বস, ‘সুলেখক’ স্ত্রী এর পর আবারও তাঁর স্বামীকে ইঙ্গিত করে বলে যেতে থাকেন, ল্যাখক মানুষ অত বাছবাছাই করলে কি চলে, আর তাছাড়া ছোট লোকেদের সঙ্গে মিশলেই তো আর বড় লোকের ফোসকা পড়ে না বা ইজ্জত কি ধুইয়া নেমে যাওয়ার জিনিস যে ল্যাখক হিসাবে দুই চারটা নিম্নশ্রেণীর মানুষের সঙ্গে ওঠ-বস করলেই তা ধুয়ে নেমে যাবে।
পুরোনো দারোয়ানরা এসব জানে, অতএব তারা ভাবতে পারে না আজকের জনপ্রিয় লেখকের বাসায় এমন একটা চাষা প্রকৃতির লোকের আগমন ঘটতে পারে। পাছে ধমক খাবার ভয় থাকে আবসার হাসানের কাছ থেকে, তাই দারোয়ানরা এই গেঁয়ো লোকটির আগমনের খবর দিতে ইতস্তত, দারোয়ান দলের একজন অবশ্য একবার বলে দিয়েছিল, ঠিকানা ঠিক থাকলে কি অবে, যার নাম লেহা তাও ঠিক কিন্তু আপনার মতো লোক যাইতে চাইলেই তো আর আমরা পাটাইতে পারি না। কাজেম আলীর প্রকাশে ঢাকার নাগরিক দারোয়ানের বিনয় থাকে না যখন কিনা দারোয়ানদের ওইসব কথার উত্তরে বলে, আরে সাইব এইডা কোনও কতা অইল নাহি, এইডা কি কওনের কতা কিনা যে ঠিকানা ঠিক আছে, মানুও ঠিক আছে কিন্তুক যাইতে দেবেন না, আরে ভাই আমি কি চোর, নাহি ডাহাইত, না যোচ্চর নাহি বদ্মাইস নাকি কী যার জইন্যে যাইতে দেবেন না ? দারোয়ানরা একটু দ্বিধায় পড়ে, লোকটি গেঁয়ো হলেও কথার মধ্যে কোথায় যেন একটি শক্তি আছে।
অচলাবস্থা কাটাতে ইন্টারকমের দায়িত্বে নিয়োজিত দারোয়ান সাহস করে লেখক আবসার হাসানকে ফোন করে। লেখকের নিয়ম অনুযায়ী বিশেষ করে ব্যস্ত ও জনপ্রিয় লেখকের নিয়মানুযায়ী তিনি সকালের সেশনের লেখা লিখছিলেন, যে উপন্যাসটি তিনি এ বছরের সবচেয়ে কাটতি হবে বলে ধারণা করছেন, সেটাই সেই মুহূর্তে লিখছিলেন, লিখছিলেন বললে ঠিক হবে না, লেখা থামিয়ে কলমটা অর্ধেক পাতা লেখা কাগজের উপরে ছেড়ে দিয়ে ওই হাত দিয়ে বোডাম ফ্রেঞ্চ প্রেস-এর বিখ্যাত কফি পট থেকে কলাম্বিয়ান কফিতে একটু চুমুক দিলেন এবং কাগজের উপর কলম ছেড়ে দিয়ে লেখার বিরতি নিলেন। লেখার বিরতি নিলেন কারণ তিনি তাঁর উপন্যাসের নায়ক-নায়িকাকে দিয়ে একটি গভীর ঘন চুমুর দৃশ্যের কথা লিখছিলেন। লিখতে চাইলেন কিন্তু তার মধ্যে একটা সোশ্যাল কমিটমেন্ট বাধা সৃষ্টি করল। ভাবলেন তাঁর নায়ক-নায়িকা এক রুমে ঢুকে একটা চুমু খাবে তা ‘নতুন প্রজন্মের’ মূল্যবোধকে অবক্ষয়ে সহযোগিতা করবে কিনা। এমন বোধের তাড়নায় তাঁকে ক্ষাণিকক্ষণ বিরতি নিতে কি ‘কলম’ থামাতে হয়, সে লেখকের ‘ঔচিত্য-অনোচিত্য’ কি কর্তব্য বোধের ফলাফল। তাঁর উপন্যাসের নায়ক-নায়িকাকে দিয়ে যে চুমুটি তিনি খাওয়াতে চাইলেন তার পেছনে ছ্রোট্ট কাহিনী আছে এবং ওই চুমুর দৃশ্যে তিনি জীবনে সবচেয়ে বেশি প্যাশন বোধ করেছিলেন, তা তাঁর শেষবার আমেরিকা ভ্রমণের সময়। ঢাকায় থাকাকালে বহু বছর আগে চেনা একটি ছেলের সঙ্গে জ্যাকসন হাইটসের দোকানে তাঁর স্ত্রীর জন্য শাড়ি ও বাইশ ক্যারেটের খাঁটি সোনার গহনা কেনার সময় দেখা, বড় লেখক যেচে কারো সঙ্গে কথা বলেন না, তাও আবার নিউইয়র্কে যেখানের ভক্তদের সঙ্গে দেশের দূর মফস্বলের ভক্তদের খুব মিল, কিন্তু কী কারণে যেন নিজেই ছেলেটির সঙ্গে কথা বলেন। ছেলেটি হাই হ্যালো ধরনের উষ্ণতা দেখিয়ে, ক’সেকেণ্ডের মধ্যে বলে বাইদ্যা ওয়ে আপনি যদি আমাকে সময় দেন তাহলে একটি লেসবিয়ান বারে নিয়ে যাবো, এক লিটারের ম্যাক্সিকান কফি টেস্টের কাহ্লুয়া মদ খাওয়াবো, অ্যাঞ্জেলিকা থিয়েটারে যে কোনো একটি ছবি দেখাবো, একটি বিকাল, একটি সন্ধ্যা আমোদের উৎসব, বললে সে উৎসবকে ফস্টি-নস্টিও বলা যেতে পারে, ছেলেটি এই বলে হাসে এবং বলে এর সবই হবে যদি রাজী থাকেন। ‘তিনি লেখক মানুষ অসম্ভবের প্রতি অদমনীয় কৌতূহল অতএব রাজি হলেন’।
অন্ধকারাচ্ছন্ন শেক্সপিয়ারিয়ান আমলের জাহাজ ধরনের ডেকোরেটেড একটি বারে মদ খাওয়ার সময় সঙ্গী ছেলেটি ওই কাহ্লুয়া মদের ইতিহাস বর্ণনা করতে থাকে যেমন কেউ কেউ পেটে অ্যালকোহল গেলে অযৌক্তিক বাচালে পরিণত হয়, দ্বিতিয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এই মদের জন্ম, বাষট্টিতে এর আমেরিকা আগমন ইত্যাদি সব বগর-বগর চলতে থাকে। যদিও লেখকের লেসবিয়ান বারে যাওয়ার অভিজ্ঞতা আশানুরূপ নয় যেমনটি তিনি ভেবেছিলেন ও আশা করেছিলেন, তারপর ছবি দেখার পালা শুরু হলে লেখক ওই চুমুটিতে নিমগ্ন হলেন, তখনই ভাবলেন কোনো একটি উপন্যাসের নায়ক-নায়িকাকে দিয়ে তিনি তাঁর দেখা চুমুটি খাইয়ে দেবেন, যদিও চুমুটির পরের অভিজ্ঞতা তার জন্য ছিল আশ্চর্য হওয়ার। কেননা গভীর উত্তেজনপূর্ণ ওই চুমুর দৃশ্যের শেষে গিয়ে তিনি আবিষ্কার করলেন নারী ও পুরুষ নয় দুটো পুরুষের মধ্যে ওই চুম্বন চলল যা অবশ্য তাঁকে বমির অনুভূতি দিয়েছিল সে সময়ের জন্যে। ছবিটি স্পেনের এক পরিচালকের যিনি নিজেও নাকি সমকামী, তিনি কখনোই ওই পরিচালকের নাম মনে করতে চান না যদিও ছেলেটি বলেছিল অনেক কথা তাঁর সম্পর্কে । সেই চুমুটিই তিনি যখন তাঁর নায়িকাকে দিয়ে করাচ্ছেন বলে কলম তুলে নিয়েছেন, যদিও ওই মুহূর্তে কল্পনায় আসা তাঁর নায়িকাকে পুরুষের মতোই মনে হয়, ঠিক সেই সময় নিচের গেট থেকে ইন্টারকমে লেখককে কাজেম আলীর আগমনের সংবাদটা জানানো হয়। লেখক আবসার হাসান ‘মিষ্ট লেপ্টিত’ মানুষ, নিজের বিচিত্র সব অভিজ্ঞতা ছাড়া আবার এটা-সেটা পড়েও অভিজ্ঞতা রয়েছে অতএব তাঁর কৌতূহল কাজেম আলী নামক লোকটির আগমনকে ছোট করে দ্যাখে না। যদিও তিনি গেটের দারোয়ানদেরকে একটু চেক করে পাঠাতে বলেন মৌলবাদীদের পক্ষ থেকে লেখকদের উপর আক্রমণের বিষয়টির কথা মাথায় রেখে।
কাজেম আলীকে নিয়ে একজন দারোয়ানের সে ধরনের কাজ করতে হলো যে ধরনের কাজ তারা খুব ভিআইপি ধরনের অতিথিদের ব্যাপারে করে থাকে। অর্থাৎ বাড়ির গেট থেকে এ্যাপার্টমেন্টের দরজা পর্যন্ত এগিয়ে নিয়ে আসা, সেটা অতিথিকে বিশেষ মর্যাদা ও সম্মান দেখানো। কিন্তু কাজেম আলীকে একইভাবে একজন দারোয়ানকে সঙ্গে করে লেখক আবসার হাসানের দরজার সামনে আসতে হয় তার কারণ কাজেম আলীর পক্ষে লিফটে ওঠা বা আবসার হাসানের বাসার দরজা পর্যন্ত আসা সম্ভব নয়। দারোয়ান দেখলো লেখক সাদা পাজামার উপর একটি ফতুয়া পরে দরজা খুলে বাইরে এসে হলওয়েতে অপেক্ষা করছেন। দারোয়ান আবারও ‘কথিত’ শ্রদ্ধাবনত হলো মনে মনে লেখকের প্রতি, তা কাজেম আলীকে লেখকের এমন সম্মান প্রদর্শনের কারণে। লেখক দারোয়ানের সঙ্গের লোকটিকেই কাজেম মিয়া সম্বোধন করে তার এ্যাপার্টমেন্টের দরজার ভেতরে যেতে উদ্যত হলেন, দারোয়ানও ফিরে গেল।
কাজেম আলীকে লেখক আবসার হাসান তাঁর লিভিং রুমে ঢোকার পর যথারীতি বিনয়ের সঙ্গে বললেন ‘দয়া করে বসুন’। কাজেম আলীকে বসতে বলার পর লেখকের নিজের কাছেই খটকা লাগল, তিনি লোকটিকে বসতে বলবার সঙ্গে ‘দয়া করে’ কথাটা বললেন কেন ? তিনি জানেন ‘দয়া করে’ কথাটা বললেন কেননা একজন চাষাভুষা শ্রেণীর মানুষকে বিনয় দেখাতে আর কোনো ভাষা তিনি খুঁজে পাননি। এরপর অবশ্য তিনি আরো ভেবে পান না এমন বিশেষ বিনয় কেন দেখাতে হবে, তার ভেতরে কি কোনো অপরাধবোধ কাজ করে ? কি অপরাধবোধ, তা নিজের ভেতরে কোথাও হয়তো, এ সময় বুকের কোনো এক এলাকায় ব্যথা করে ওঠে। তিনি জানেন না সে কী ধরনের ব্যথা তবে নিজেই বোঝেন ‘সস্তা উপন্যাসের ‘সস্তা ব্যথা সঞ্চালন’-এর এখানে কোনো মূল্য নেই। অতএব তিনি কাজেম আলীর জগতে ফিরে আসেন।
কাজেম আলীর কোন পরিবর্তন নেই লেখকের এই বিশাল ড্রইং রুমে ঢুকে, চারদিকে তাকায় না পর্যন্ত, অথচ আবসার হাসানের ড্রইং রুমটা তাবৎ দুনিয়ার জিনিস পত্রে ঠাসা, ‘একটা আধুনিক সাজানো যাদুঘরের মতো’। কাজেম আলীর তাতে কেন, কোনো কিছুতেই কিছু যায় আসে না, এই ভাবনাটা লেখকের। কাজেম আলীর ভাবনার বিষয়টা এ মুহূর্তে জানা যায় না, সে শোনে না যে লেখক তাকে বসতে বলেছেন এবং তাও ‘দয়া’ জাতীয় শব্দ ব্যবহার করে। কাজেম আলী নিজের মতো উদ্যোগ নেয়, তার সঙ্গে দুটো পোঁটলা, দুটোই লুঙ্গির কাপড় থেকে বানানো, স্ত্রী শ্যামেলা দ্বিতীয় পোঁটলা বানিয়েছিল একটি পুরোনো শাড়ি কাপড় দিয়ে, পোঁটলার পেছনে কোনো মূল্যবোধ থাকতে পারে তা কাজেম আলীর স্ত্রী শ্যামেলার জানা থাকবার কথা ছিল না, স্বামী কাজেম আলীরও জানবার কথা নয়। কিন্তু সে যে জানে তা বোঝা যায় যখন তার স্ত্রী শ্যামেলাকে বলে, হোনো মস্ত বর ল্যাখকের সঙ্গে সায়ক্ষাৎ, মেয়ে-ছেলেদের হাড়ি-কাফুড়ে বানানো পোটলা দেইখ্যা যদি ল্যাখক দেলে কষ্ট পায়, দ্যাহো আর একখান লুঙ্গি কাফুড় পাও কিনা। সামনের আশ্বিনে কাঁথা সেলাইর জন্য রাখা লুঙ্গি নামিয়ে শ্যামেলা দ্বিতীয় পোঁটলা বানায়। কাজেম আলী তার সেই লুঙ্গির বানানো প্রথম পোঁটলা বাম বগলে চেপে দ্বিতীয় পোঁটলা থেকে লাল প্রধান সবুজ চেকের একখানি গামছা বের করে, কোনো রকম লেখকের কোনো মতামত গ্রাহ্য না করে কাজেম আলী লাল রংয়ের গামছাখানি লেখক আবসার হাসানের দামি কার্পেটের উপর বিছাতে থাকে। প্রায় তিনবার গামছাখানি কাজেম আলী বাতাসে ঢেউয়ের মতো করে দুলিয়ে পরে বিছায়। লেখক আবসার হাসান খেয়াল করেন গামছা বিছানোর সময় গ্রামের এই লোকটির হাত দু’খানি এমনভাবে দুলে ওঠে যেন শ্রাবণের আউশ ধানের উপর বাতাসের ঢেউ, যে ঢেউ লেখক নিজে স্বচক্ষে কোনো দিন দেখতে পারেননি, দেখেছেন টেলিভিশনে। গামছা বিছানো দেখে লেখক বুঝতে পারে যে কাজেম আলী ফ্লোরে কার্পেটের উপরে বিছানো গামছায় বসবে। গামছা বিছিয়ে কাজেম আলী লেখকের দিকে না তাকিয়েই নৈর্ব্যক্তিক বলতে থাকে, সাইবদের বাড়ি-ঘর, মোগোর মত লোক-জোনের গা-গতরে থাহে রাজ্যের কাদা-মাডি। লেখকের যে কাজেম আলীকে বলতে ইচ্ছে করে না তা নয় যে, তার স্প্রিং বিশিষ্ট সোফায় কাজেম আলী বসলে কোনো অসুবিধা নাই, কিন্তু তিনিই আবার বোঝেন কোনো কাজ হবে না, কারণ লোকটা ইতোমধ্যে প্রমাণ করে ফেলেছে যা সে ভাববে বা ভেবে আছে বা করতে চাইবে তা সে করবে। আবসার হাসান ‘লেখক’ অতএব তার ক্ষমতাসম্পন্ন ভাবনায় এও ভাবেন নিজের ব্যাপারে যে কাজেম আলী তার নিজস্ব হালকা প্রায় অদৃশ্য সবুজ চেকের লাল রংয়ের গামছা কোনো অভিমত ছাড়া বিছিয়ে বসতে না চাইলে তিনি ওই লোকটিকে সোফায় বসতে বলতেন কিনা। বরং তিনি ভেবে পান কাজেম আলী নিজের দিক থেকে সোফায় বসতে চাইলে হয়তো আবসার হাসানই বলতেন, না না ওখানে বসবেন না, ভেতর থেকে কাপড় আনাবার ব্যবস্থা করছি, আপনি মাটিতে বসেন; তিনি আসলে জানেন না কী হলে কী হতো, কিন্তু এসব ভাবেন। কাজেম আলী তার গামছায় বসতে বসতে পরিতৃপ্তির সঙ্গে যে সংবাদটি লেখককে দেয় তা হলো ‘ঝালহাডির গামছা’, আমগো দক্ষিণাঞ্চলে ঝালহাডির গামছাই অইল যাইয়া আহমনার সেরা গামছা। লেখক ভেবে উঠতে পারেন না এ ধরনের সংবাদ কাজেম আলী নামক লোকটি তাকে দেয়া বোধ করছে কেন, হয়তো কী দিয়ে কথা শুরু করবে তেমন বোধ থেকে সে এ সব কথা বলছে। কাজেম আলী বসে পড়বার পর আবসার হাসান কোথায় বসবেন দ্বিধায় পড়েন, ক’মুহূর্তে তার দ্বিধা কেটে যায় সোফায় নিজের আসনে ফিরে যাওয়ার মধ্য দিয়ে, কেননা তিনি বুঝে ফেলেছেন তাঁর সৌজন্যতার কোনো প্রভাব এখানে পড়ছে না।
আবসার হাসানের আগ্রহ ভেতরেই থাকে, কাজেম আলীর কাছে তা প্রকাশ করেন না, ধরেই নিয়েছেন একটা কিছু তো আছে, না হলে গ্রামের এই লোকটি এত আস্থার সঙ্গে তাঁর বসার ঘর পর্যন্ত আসতো না। ‘লেখক’ বলে বিচিত্র অভিজ্ঞতা তাঁর রয়েছে। সে-সব অভিজ্ঞতা কেবল ঘটনাক্রমে বা দুর্ঘটনাক্রমে হয়েছে এমন নয়, নিজে সোৎসাহে অভিজ্ঞতা সংগ্রহে উদ্যোগীই হয়েছে। আর এখন প্রতিষ্ঠিত লেখক হিসেবে তাঁর অভিজ্ঞতার অধিকাংশই আনুষ্ঠানিক বা সাজানো তা আবসার হাসান জানেন, কিন্তু তাতে তাঁর খুব তেমন অসুবিধা হয় না, নিজের মতো করে অভিজ্ঞতার বিশ্লেষণ ও যাচাই করে তার উপন্যাসে ব্যবহার করেন। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তাঁর উপন্যাসের উপকরণ আসে প্রধানত অন্যের বলা অভিজ্ঞতার কাহিনী থেকে। আবসার হাসানের সর্বশেষ হিট উপন্যাসগুলোর উপকরণ সবই মানুষের বলা অভিজ্ঞতা-গল্প বা কাহিনী থেকে নেয়া, অতএব কাজেম আলী যে সে রকমই একটা ব্যাপার তেমনটি আবসার হাসান মনে মনে ধরে নেয়। তারপরও তাঁর কৌতূহল প্রকাশ হয়ে পড়ে না, বরং অধীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করতে থাকে, ‘দেখা যাক কি হয় ধরনের’ সে-আগ্রহ। নিজের বিছানো গামছায় কাজেম আলীর ‘আসন’ ভঙ্গীতে বসার মধ্যেও কোনো এক ধরনের অস্বস্তি কাজ করছে সেটা বোঝা যায়। সম্ভবত সেই অস্বস্তি থেকে কাজেম দু’হাত এমনভাবে হাঁটুর দু’পাশে ভর দিয়ে নিচের মাটিতে রাখে তাতে স্পষ্ট হয়ে ওঠে অস্বস্তি ও তার হাতের ভর দেয়ার ধরনের মধ্যে একটা সম্পর্ক রয়েছে। আবসার হাসান উপলদ্ধি করেন কাজেম আলীর ওই অজ্ঞাত অস্বস্তি, বলেন-- ভাই সাহেব আরাম করে বসেন, বসতে অসুবিধা হচ্ছে না তো ? কিছু মনে না করলে বলি, আপনি আরাম করে সোফায় বসুন, আমি কিছু মনে করবো না, বরং খুশি হবো।
আবসার হাসান যেন জানতেন তাঁর বসতে বলবার অনুরোধ কাজে আসবে না, তারপরও বলেছেন নিজের মনের শান্তির জন্যে, অজ্ঞাত অপরাধবোধ দূরীকরণ উদ্যোগে। উত্তরে কাজেম আলী তেমনটি অপরিবর্তিত আসন ও হাতে ভর দিয়ে বিনীত ও আস্থাবান কণ্ঠে বলে, ছার হাইল্যা-জাইল্যা মানু আমাগো আসন দিয়া বওনের অইভ্যাস নাই, আসন মাইর্যা বইলে পরে মেইদারা, পাছা, আডু, পায়ের নলা, খুঁড়া সবই আহ্মনার ব্যাতা হরে, জনাবের অনুমতি পাইলে পরে আত পা কয়হান ইটটু খুইল্যা বইতে পারি। আবসার হাসান নিজের আসনে একটু নড়ে ঝুঁকে হাত সামনের দিকে দিয়ে বলেন, দয়া করে আপনি হাত-পা খুলে আপনার সুবিধামতো বসুন, আমি কিছুই মনে করবো না। এমনকি আপনি আমার পাশেও বসতে পারেন, তিনি তাঁর ডান হাত সোফার ডানদিকে ছোট চাপড় দিয়ে দেখান যেন ওইখানে ইচ্ছা করলে কাজেম আলী বসতে পারে। কাজেম আলী নিজের গামছার উপরে থেকে দু’পায়ের পাতার উপরে বসে তার আনা দুটো পোঁটলার উপরেই হাত রাখে, যে-পোঁটলায় তার বসবার গামছা ছিল সেই পোটলার গিট খুলে হাতায় এবং আর একখানি গামছা বের করে, এবারের গামছাখানিও লাল তবে লালে লালে তফাৎ আছে, আগেরটি শিমূল-লাল সবুজ চেকের মধ্যে আর এবারেরটি হালকা হলুদ চেকের মধ্যে শক্ত পাকা খেজুরের রং ও আয়তনে বসবার গামছা-খানির তিন ভাগের একভাগ। কাজেম আলী পা খুলে বসে, যেমন পায়ের বুড়ো আঙ্গুল প্যাঁচ দিয়ে গরুর গলায় বা খুঁড়ায় বাঁধার জন্যে পাটের দড়ি পাকানো ভঙ্গিতে। কাজেম আলী ছোট গামছাখানি পায়ের পাতার উপরে ফ্যালে, আসলে দু’পায়ের পাতা ছোট ওই হলুদাভ লাল গামছা দিয়ে ঢেকে দেয়।
তার আগে গামছাখানি কাজেম আলী পায়ে বিছানোর সময়ে যেন একবার গন্ধ নেয়, লেখক আবসার হাসান তেমনটিই মনে করেন। তাঁর মনে করাকে নিশ্চিত করে দিয়ে কাজেম আলী লেখককে জানায় শিশুসন্তানের মতো আরকি, মায়ের কাপড় নাকের পাশে রেখে ঘুম পাড়িয়ে দেয়া, শিশু মায়ের কাপড় থেকে গন্ধ পেয়ে, মা মনে করে স্বস্তিতে নিরাপদ ভেবে ঘুমায়। কাজেম আলী এভাবে ভাঙ্গিয়ে না বললেও লেখক ইন্দ্রিয়শক্তিতে তা বুঝে নেয়। আবসার হাসান মনে করে কাজেম আলী হয়তো ভাবছে খোলা পায়ে লেখকের সামনে বসা বেয়াদবি হবে ভেবে হয়তো কাজেম আলী তার পা ঢেকে দেয়। কাজেম আলী লেখকের এ ভাবনা দূর করে দেয় এ কথা বলে, ছার মোরা অইলাম যাইয়া আইল্যা-জাইল্যা মানু, কাদা প্যাকে থাকতে থাকতে পাও দুইহান ঘা হইয়া যায়, দুর্গন্ধ ছড়ায়, আহ্মনের সঙ্গে দেহা হরতে আমু বুইল্যা তিন হপ্তা আগ থেইকা কাদা পানি ভাঙ্গা বন্ধ হইর্যা দিছি, পিরতিদিন তুইত মাইখ্যা রাখছি ঘা পঁচা যা আছে হেও য্যানো হুগাইয়া যায়। সেই কাদা পাঁক না ভাঙ্গা ও তুত মাখিয়ে পা শুকিয়েছে ও দুর্গন্ধমুক্ত হয়েছে সে-কথা কাজেম আলী লেখককে জানায়। আরো জানায়, তারপরও সাইব বইল্যা কতা, ওই লক্ষীছাড়া দুমড়াইন্যা-মছড়াইন্যা পাও দুইহান আহ্মনে দেখপেন ক্যা ?
আবসার হাসানের প্রত্যাশার বাইরে কাজেম আলী আরো খবর দেয় যে এই গামছাখানি আয়তনে ছোট কেন ? ছোট, কারণ এই গামছাখানি তার ‘পরিবার’ শ্যামেলা বিবি চুল ঝাড়ার কাজে ব্যবহার করে থাকে। কাজেম আলী তাই দূরে কোথাও গেলে স্ত্রীর গামছা সঙ্গে নিয়ে যায়, গামছায় চুলের গন্ধ স্ত্রীর উপস্থিতি কাজেম আলীকে সঙ্গ দেয়।
এ পর্যায়ে আবসার হাসান অনানুষ্ঠানিকভাবে তার লেখার রসদ যোগাড় শুরু করেন। তিনি তাঁর উপন্যাস লেখার জ্ঞান সমৃদ্ধ করতে থাকেন কেমন করে স্ত্রী এই গ্রামীণ মানুষটির কাছে ‘পরিবার’। কেমন করে স্ত্রীর ব্যবহৃত গামছা যা গোসল-এর চুল ঝাড়তে ব্যবহার করা হয়, যার গন্ধ নিয়ে কাজেম আলী স্ত্রীর সংস্পর্শ বা উপস্থিতি অনুভব করে। আবসার হাসান ইতোমধ্যে কাজেম আলীর প্রতি কৃতজ্ঞতার অনুভূতিতে পূর্ণ হতে শুরু করেন, কেননা স্ত্রীর চুল ঝাড়া ও গামছা বৃত্তান্ত তথ্যটি দিয়ে তাঁর পরবর্তী কোনো উপন্যাসে পাঠকদের চমকে দেবেন বলে ভেবেছেন। লেখক নিজের দিক থেকে আর কিছু জানতে চান না কাজেম আলীর কাছে তাতে আশঙ্কা থাকে স্বতঃস্ফূর্ততা ও সরলতা হারাবার যা সৎ উপাত্ত সংগ্রহের পরিপন্থী।
ধনী লেখকের বাড়ির নিয়মানুযায়ী কাজের লোক চা ও বিস্কুট নিয়ে আসে, কফি-টেবিলের উপর কাজের ছেলে দু’জনার চা ও বিস্কুট নামায়। আবসার হাসান নিজের বাসার এই রেওয়াজে অবাক হন না যে, কোনো অতিথি এলে আদেশ-নির্দেশের আগেই চা-কফি আসবে। কিন্তু অবাক হন অন্য কারণে, তিনি জানতেন না, যে কাপে কাজেম আলীর চা এসেছে সে রকম নিম্নমানের কাপ ও পিরিচ তাঁর বাসায় রয়েছে। একথা তাঁর কাছে অনবগত নয় যে, তিনি হাব-ভাব কি বেশভূষায় যাই হোন না কেন ভেতরে ‘শ্রেণীভিত্তিক’ লেখক, যদিও মূল পরিচিতি ওই ‘বাম ঘরানার বুদ্ধিজীবী গোত্রীয়’ হিসেবে, তাই বলে তার চর্চা যে এই পর্যায়ে তাঁরই পরিবারের ভেতরে হয়ে থাকে তা তিনি জানতেন না। তিনি আরো দেখলেন কাজের ছেলেটি কাপ-পিরিচ নামিয়ে ট্রে নিয়ে ফিরে যাওয়ার সময় হাতের কাপড় দিয়ে একটি জায়গা মুছে দিল যার পরিষ্কার অর্থ দাঁড়ালো কাজেম আলীর আগমনে কার্পেট বা এই বাসার ফ্লোর নোংরা হয়েছে যা এই বাসায় মানোপযোগী নয় বলে ধারণা দেয়া। আবসার হাসান এর সবই বোঝেন কিন্তু ঠিক এই মুহূর্তে কাজেম আলীর সামনে তিনি তার এ বিষয়ে যা যা বুঝতে পারছেন তা নিয়ে কথা বলবেননা, সেটা কাজেম আলীকে সম্মান দেখানোই কেবল। তিনি কাজের ছেলেটিকে বললেন এই মুহূর্তে এখান থেকে চলে যাও, আমি না ডাকলে আর তুমি আসছ না।
আবসার হাসানের খারাপ লাগছে কাজেম আলীকে খেতে বলতে, কারণ আপ্যায়নের উপস্থাপনের ভঙ্গীতে এরই মধ্যে কাজেম আলীর সামনে অস্বস্তি বোধ করছেন। অবশ্য একটি সান্ত্বনা রয়েছে, কাপপিরিচের যে বৈষম্য কাজেম আলীকে আপ্যায়নের ক্ষেত্রে উপস্থাপিত হয়েছে তা কাজেম আলী বুঝতে পারছে না লেখকের এই ধারণা, কারণ কাজেম আলী সেদিকে তাকায়নি পর্যন্ত, অতএব অন্য বৈষম্যের ব্যাপারে লেখক আবসার হাসান ভাবতেও পারেন না, যে-বিস্কুট বাসার কেউ খায় না এমনকি কাজের লোকেরাও যা ছোঁয় না তা আনা হয়েছে কাজেম আলীর জন্যে। আবসার হাসানের জন্যে ভাল সংবাদ হচ্ছে এর কোনো কিছুর প্রতি কাজেমের আগ্রহ আছে বলে তার মনে হয় না, সে কেবল লেখক আবসার হাসানের সঙ্গে কথা বলতে এসেছে, লেখকের সঙ্গে কথা বলতে আসার সঙ্গে পৃথিবীর অন্য কিছুর সম্পর্ক থাকতে পারে এমন ধারণা হয়তো তার নাই। কাজের ছেলেটি চা-বিস্কুট দিয়ে চলে যাওয়ার পর কাজেম আলী লেখককে বলে, ছার আহ্মনের সঙ্গে দ্যাহা হরনের বুদ্ধি করি মোরা গত সালে চৈত্তর মাসের শেষে, খুব গরম আছিল হেইদিন, টানা মেলা দিন গরমের পর সাদ্যের ঠাডা পইর্যা ঝড় বইন্যা অইল, দুনিয়াডা ইটটু ঠাণ্ডা, ঝরা আমের নুন কাচা মরিচে ভর্তা বানাইয়া খাইতে খাইতে স্কুলঘরের মইদ্যে এই কতা অয়, কতা উডায় পেরাইমারি বিদ্যালয়ের আইএসসি মাস্টোর আবুয়াল হোসেন। কাজেম আলীর এই লম্বা করে কথাটার মধ্যে দিয়ে লেখক আবসার হাসান জানতে পারে তার আগমন কেবল একক ব্যাপার নয়, এর মধ্যে রয়েছে আমরা, যা কোনো এক চৈত্রের পড়ন্ত দুপুরে কাল-বোশেখী সেই ঝড়ের পর কতিপয় মিলে এই সিদ্ধান্ত নেয় যে লেখকের সঙ্গে এই কাজেম আলী দেখা করতে আসবে। আবসার হাসান বুঝতে পারেন তার গল্প শুরু হয়ে গেছে যা তিনি শুনে যাবেন প্রায় কোনো প্রশ্ন ছাড়া; খুব জরুরি কোথাও কোনো প্রশ্ন করতেই হবে এমন মনে না করলে। আবসার হাসানকে জানানো হয় ঢাকা কীভাবে যাওয়া হবে, কীভাবে আসা হবে যাতায়াত ভাড়া বাবদ খরচাদি, লেখকের ঠিকানা যোগাড় ইত্যাদি সব বিষয়ে। পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজেম আলী লেখকের সঙ্গে দেখা করতে গেলে যথাসম্ভব পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন পোশাক-আশাক, আচার-আচরণসহ এমন জিনিস বাদ থাকে না যা হতে পারে বলে কাজেম আলীরা ভাবেনি। ‘পেরাইমারি’ স্কুলশিক্ষক আবুয়াল হোসেনের দূরে সম্পর্কের ‘বেয়াই লাগে’ এমন আত্মীয়ের ছেলে ঢাকার শহরে থাকে, তারই কাছে একটা বই পেয়ে সেই বইয়ে লেখকের ভূমিকা থেকে আবুয়াল হোসেন জানতে পারে কীভাবে লেখক ওই উপন্যাসের উপকরণ পেয়েছিল কোনো একজন অচেনা লোকের কাছ থেকে। অতএব আবুয়াল হোসেন ধারণা করে কাজেম আলীর কাছে যে একটি কাহিনী রয়েছে সেই কাহিনীর বয়ান আবসার হাসানের মতো কোনো লেখককে বলতে পারলে একখানা পুঁথি রচিত হতে পারে, যে-পুঁথিখানার মাধ্যমে কাজেম আলী, আবুয়াল হোসেনসহ অন্যান্যরা সন্তুষ্ট হতে পারে এই মর্মে যে, আর যা হোক তাদের মতে উল্লেখযোগ্য অথচ ঘটনার বাস্তবতায় আজ যা ছোট সেই সব ঘটনা অন্তত একখানা পুঁথির ভেতরে থাকবে। এসব এখন আবসার হাসানের জানা হয় এবং বোঝেন কিন্তু সিদ্ধান্ত নেন যে, নিজে আগ বাড়িয়ে কিছু জানতে চাইবেন না। তিনি মনে করেন, যে-উপন্যাসটির ভেতর থেকে তাকে এখন হাটতে হবে সেই মুখে-বর্ণিত উপন্যাসের লেখক এই কাজেম আলী, তা সে যে ভাবেই বলুক।
ঘটনা নাকি অনেক বছর আগের যার নির্ধারিত সন-তারিখ কাজেম আলীর পক্ষে বলা সম্ভব হয় না, স্মৃতিই নির্ধারিত সময় মনে না থাকবার প্রধান কারণ যদিও সঙ্গে, কাজেম আলী আবসার হাসানকে জানায়, মোরা অইলাম যাইয়া আলেহা পড়া আইল্যা-জাইল্যা, শোন-তারিকে মোরা চলি না, ওয়া বুজিও না। জোয়ার ভাডা, জোবা, চান্দের ক্ষয়, আর পূর্ণিমায় বুঝি দিন যায় আয়, এই রহম সব। তবে কাজেম আলী লেখক আবসার হাসানকে একেবারে সময় সম্পর্কে অন্ধকারে রাখে না, একটি ধারণা অন্তত দেয় তা হলো, বড় বইন্যার আগের কি পরের বচ্ছর। লেখক চোখের পাতায় লম্বা পলক ফেলে শান্তভাবে ঘাড়টা একটু দুলিয়ে কাজেম আলীকে যেন বলে সন-তারিখে কোনো অসুবিধা নাই, সে যা বলতে চায় তা বলে যেতে পারে।
কাজেম আলীদের গ্রামের নাম বউলাপুর, পাশের গ্রাম নোলকঝোর, নোলকঝোরের সুবিমল মিস্ত্রি ভারত চলে যাওয়ার পর তার কাজ ধরে নোভা শফি, কাজেম আলী ভাঙ্গিয়ে বলে নোভা শফির অর্থ কী, শফি লোভা প্রকৃতির লোক, খাবার দেখলে হিতাহিত জ্ঞান থাকে না, ছোট বাচ্চারা লোভা বলতে পারত না তারা বলত নোভা, সেইভাবে সে হয় নোভা শফি। কিন্তু সেইসব সময় বলতে কোন সময় তার কেনো ধারণা কাজেম আলী লেখককে দিতে পারে না, কেবল বহুত আগিলা কাল, বহুত পুরানা দিনসব, এমন ভাবে বলে। তয় হেই নোভা শফি সুবিমল মিসতিরির কাম ধরলে তহন থেইকা হেয়ার নাম নোভা শফি গোনে শফি মিসতিরি অয়। হেই শফি মিসতিরির যে পোয়া অইল হেই পোয়ার নাম অইল যাইয়া রহম, রহম আলী। রহম আলী বাপের মিসতিরিগিরি না হইর্যা হে হইল যাইয়া আহ্মনার ভাসার আডের ছাতি হারানি মিসতিরি। কাজেম আলী ব্যাখ্যা করে, মিসতিরিগিরিডা ঠিক থাকলে, খালি কামের ধরন বদল অইল, ঘর মিসতিরিগিরি থুইয়া ছাতির মিসতিরি ধরলে। আবসার হাসান তখন কাজেম আলীর মাধমে জানেন যে রহম মিস্ত্রি তার বাবা শফি মিস্ত্রিকে বলে যে, ঘরের কামের কোনো ঠিক থাহে না, বচ্ছরে একটা কি দুইডা, হেরও কোনো সোময় ঠিক নাই, হের চাইতে ছাতির কামে আডে আডে কিছু অন্তত আইবে, এই ভাবে এবং এই কারণে রহম মিস্ত্রি ছাতির মিস্ত্রিতে পরিণত হয়। এরপরে লেখক আবসার হাসান কাজেম আলীর মাধ্যমে জানতে পারেন রহম মিস্ত্রির বাবা নোভা শফি কি শফি মিস্ত্রি গল্পে একেবারে প্রেয়াজনহীন কেননা হঠাৎ করে কাজেম আলী এবারে ওই রহম মিস্ত্রির ছেলের প্রসঙ্গ আনে যার নাম বলা হয় খবির মেয়া। কাজেম আলী খবির মিয়ার নাম তার কাহিনীতে যোগ দিয়েই সেইভাবে বইন্যার আগের বছর পরের বছর প্রসঙ্গটি আর একবার তোলে যাতে আবসার হাসানের মনে হয় তার কাহিনীতে শফি মিস্ত্রির উপস্থিতি অত জরুরি নয় যত না এখন সময় উল্লেখের কারণে রহম আলী মিস্ত্রি কিংবা খবির মিয়ার উপস্থিতি সঙ্গত।
তাদের কতাবার্তা চলাকালে কাজের ছেলে ঢুকে পড়ে আবসার হাসানকে জানায় ক্যানাডা থেকে ফোন এসেছে। আবসার হাসান কাজের ছেলেটিকে বলেন আমি একটি কাজে আছি, জরুরি কাজ এবং এমন কাজের সময় আমার বাসায়ই থাকবার কথা নয়, কাজটি বাসার বাইরে ঘটবার কথা, অর্থাৎ লেখক কাজের ছেলেটিকে বলে দিলেন অন্য আর কোনো ফোন এলে যেন তাকে জানানো না হয়। তিনি এই ধরনের কাজের সময় তাত্ত্বিকভাবে বাইরে তা ফোন করা ব্যক্তি সে কবি বা গল্পকার কি ঊপন্যাসিক হোক না, সে ক্যানাডা হোক কি আমেরিকা প্রবাসী হোক কি চন্দ্রপ্রবাসী, আবসার হাসান কারো ফোন ধরবেন না, তিনি কেবল কাজেম আলীর সঙ্গে কথা বলবেন, নোভা শফি থেকে রহম মিস্ত্রি হয়ে খবির মিয়ার অনির্ণীত সময়ে বিচরণ করবেন। কাজের ছেলেটি লিভিং রুম থেকে চলে যাওয়ার আগেই কাজেম আলী লেখক আবসার হাসানকে বলে, ছার জল-পিপাসা পাইছে, পানি এটটু। কাজেম আলীর মতো লোকের মুখে জল-পিপাসা পেয়েছে শুনে আবসার হাসান সম্ভবত ভেতরে খাণিকটা হোঁচট খান, শুধু ভেতরে কেন হয়তো বাইরেও, তা না হলে কাজেম আলী নিজের দিক থেকে শোধরাবেন কেন- ওই পাশের গেরাম নোলকঝোর, হেইহানে কয়ঘর ইন্দু পরিবার আল্হে, ছোট্ট সোময় হ্যাগোর সব বাড়তে গেলে মোরা ওইরম হইর্যা কইতাম, এটটু ‘জল-পানি’, হেরাও ওইরম কইত মোগর সব বাড়তে। আবসার হাসান কাজেম আলীর এই ব্যাখ্যায় কিছুই বলেন না অথবা বলেন, ঠিক আছে ঠিক আছে ও কিছু নয়, অথবা কিছু, এর কিছু নিশ্চিত হওয়া যায় না। তবে তাঁর অগোচরে একটি দীর্ঘশ্বাস পড়ে, যদিও সেই দীর্ঘশ্বাস নাসারন্ধ্র থেকে নিঃসরিত হওয়ার পর তাঁর কাঁচাপাকা ‘পুরুষালি’ প্রতীকের গোঁফের উপর দিয়ে গড়িয়ে পঞ্জের মত কোঁচকানো কি অমসৃণ তেলতেলে বিশেষ গোত্রীয় জোঁকের দেহের মতো ঠোঁট গড়িয়ে চিবুকে মিইয়ে যায়, সেখান থেকে গড়িয়ে বুকের উপরে শার্টে পড়বার আগেই। তিনি মনে করতে পারেন না কাজেম আলী যে-কথাটি অর্থাৎ জল-পানি যে বলল সেই রকম একটা কথা তিনি কবে বলেছেন বা আদৌ বলেছেন কিনা কোনদিন, নাকি লেখকের কমিটমেন্ট ‘উদারতা’ও কমিটেড হয়ে পড়ে। কত কিছু করা উচিত-অনুচিতের কর্তব্যের কারণে বলা হয়নি কখনো, কোথাও, কাউকে কোনো সময়ে, না সজ্ঞানে, না ভুলে। আবসার হাসান কাজের ছেলেটিকে পানি দিয়ে যেতে বলেন, তিনি জানেন কাজের ছেলেটি কাজেম আলী উপযোগী করে পানি নিয়ে আসবে যা তাঁর দেখতে ভাল লাগছে না। তাই নিজের জন্যেই পানি দরকার এমন করে কাজের ছেলেটিকে পানি আনতে বললেন। কাজের ছেলেটি পানি আনতে গেলে কাজেম আলী প্রথম পোঁটলার ভেতরে কী জানি খুঁজতে থাকে, আবসার হাসান কোনো আগ্রহ দেখান না বাড়তি। তিনি শুধু দেখে যেতে থাকেন যে কাজেম আলী অপর আর একটি পোঁটলা থেকে একটি গ্লাস বের করে, ছোট পেতলের গ্লাস, পরিষ্কার ঝকঝক করছে। লেখক বুঝে ফেলেন তাঁর বাড়ির গ্লাসে কাজেম আলী জল বা পানি খাবে না। নিজের হাতের গ্লাসের দিকে তাকিয়ে আবসার হাসানের উদ্দেশে কাজেম আলী বলে, ছার দানা ছাই দিয়া পরিবার মাইজ্যা পরিষ্কার হইর্যা দেচে, কতা অইল বড় লোহের বাড়ির গেলাস-পাতি আমাগোর মতো মাইনষের বেবহার কইর্যা নষ্ট হরা উচিৎ কিনা, হেইর লইগ্যা পরিবার ও অইন্যাইন্যরা গেলাসের কতা কইল, গেলাসটার আবার ইতিহাস আছে, ওই নোলকঝোড়ে সুবিমল মিস্ত্রি যাওয়ার আগে মোর বাফরে দিয়া গ্যাছে। আবসার হাসানকেই পানি তার পেতলের গ্লাসে ঢেলে দিতে বলেন, আবসার হাসান তাই করেন, কেনোনা তিনি বোঝেন কাজেম আলীর ভাষায় বড় লোকের বাড়ির জিনিসপত্র ধরে তার হাতের কারণে যেন নোংরা হয়ে না যায়। পানি পানে এত তৃপ্তি মানুষ পেতে পারে এমন ধারণা যেন আবসার হাসানের প্রথম হলো। কাজেম আলী আবার শুরু করে সেই বড় বন্যার আগের বছর নাকি পরের বছর যার ঠিক কিছু নাই এবং রহম মিস্ত্রির ছেলে খবির মেয়া। হাটে ছাতি সারানোর রহম মিস্ত্রির ছেলে খবির মিয়ার নাম বলার পর অনেক কথাই হয়তো তার বলবার থাকে, কিন্তু শব্দসীমিতের কারণে কি বর্ণনার দুর্বলতার কারণে সেভাবে না হলেও কাজেম আলী বলে, সেই মোগোর সব গেরামের খবির মেয়া, সোনার চান্দ, চাইন্দের টুকরা, গোবরের পইদ্দ এই কতা লোকে কইত কিন্তুক মুই গোবর চিনি পইদ্দ চিনি না, হেইর লইগ্যা নিশ্চিন্ত কইতে পারমু না গোবরে পইদ্দ কি জিনিস। আবসার হাসান কাজেম আলীর কথা শুনে আরো বোঝেন যে অমন ছেলে দুই চার দশ বিশ গ্রামে কি থানায় কি জেলাতেও হয় না। কিন্তু তাদের পাশের নোলকঝোর গ্রামে সেই রকম সন্তান হয়। আবসার হাসান কাজেম আলীর গল্পের আর কোনো ধারণা পান না, কেবল খবির মেয়া নামক লোকটি মেধাবী বলে তার কাছে মনে হয়। তবে আবসার হাসানের এ ধারণা হয় যে, খবির মিয়া নামক লোকটি নিশ্চয়ই মারা গেছে তা না হলে এটি কেন গল্পের উপকরণ হবে বলে কাজেম আলী কি আবুয়াল হোসেনরা ধারণা করতো না ?
--বোঝেন সাইব হেই খবির মিয়ার স্ত্রীর সোন্তান হইবে, এইডা কি খেলা কতা ? আবসার হাসান এ পর্যায়ে বুঝে ফেলেন যে কাজেম আলীর বলা গল্পে হয়তো তেমন জোর নাই, যেমন প্রতিটি মানুষই মনে করে তার কাছে সবার সেরা গল্পটি রয়েছে, কেবল দরকার একজন লেখকের যিনি গুছিয়েগাছিয়ে এমন ভাবে লিখবেন যে রাজ্যের লোকজন সেই কাহিনী লয়ে হাসবেন ও কাঁদবেন, কাঁদবেন ও হাসবেন। আবসার হাসানের আগ্রহে টান পড়লেও তিনি কাজেম আলীকে তা বুঝতে দেন না। কাজেম আলী বলে যেতে থাকে, খবির মেয়া ঢাহায় থাহে, মোস্ত বড় চারহি হরে। কিন্তু স্ত্রী ‘সোন্তান সোম্বাবা’ বলে রহম মিস্ত্রি ও তার স্ত্রী ঢাকায় আসতে চায়, কিন্তু খবির মেয়া চাকরি রেখে যেতে পারে না, কিন্তু বাবা মাকে খবর পাঠায় বৈশাখে তার স্ত্রীর সন্তান হবে, তারা যেন ঢাকায় চলে আসে। এখন তারা ঢাকায় কীভাবে আসবে এর আগে তো কোনোদিন ঢাকা আসেনি। বন্যার বছর পৌষ মাসের ধানের মৌসুম শেষে কোনো কাজ করা যায় কিনা এই মনোভাব নিয়ে কাজেম আলী একবার ঢাকায় এসেছিল। দেশী দু’একজনের মাধ্যমে তার কাজ জোটে খিলগাঁও বাজারে তরিতরকারি বিক্রেতাদের ফুটফরমায়েশ খাটা, তখন তার বয়স কম, অনেক পুরানা কথা। কিন্তু বেশি দিন কাজেমের ওই কাজ ভাল লাগে না, সে আবার গ্রামের দেশে চলে যায়। হয়তো তারই কিছুদিন পর খবির মেয়ার স্ত্রীর সন্তান সম্ভাবনার কথা থাকলেও খবির মিয়ার বাবা-মার ঢাকায় আসার দরকার পড়লে পাশের গ্রামের খবির মিয়ার খোঁজ পড়ে, যদি সে খবির মিয়ার বাবা-মা রহম মিস্ত্রি ও তার স্ত্রীকে ঢাকা নিয়ে আসতে পারে কারণ তখনকার দিনে কাজেম আলীদের সব গ্রাম থেকে কোনো মানুষজন ঢাকার শহরে আসে না বা ঢাকার শহর চেনে না কেবল কাজেম আলী বাদে, কাজেম আলী রাজি হয় কেননা খরচপাতি যাওয়া-আসা খাওয়া দাওয়া বাবদ সব খরচাদি ওই রহম মিস্ত্রির।
বন্যার আগের কি পরের বছর তাতে অবশ্য কিছু যায় আসে বলে মনে হয় না লেখক আবসার হাসানের। কেননা কাজেম আলী এমন কিছুই বলছেন না যাতে সন তারিখের আদৌ কোনো দরকার আছে। তারপরও কেন যেন কাজেম আলী সন-তারিখের সঙ্গে এক যোগ স্থাপনের চেষ্টা করে যায়। আবসার হাসান কাজেম আলীর কোনো কিছুতেই আপত্তি করে না। তিনি লেখক, অন্যের গল্প শুনতে তাঁর কোনো আপত্তি নাই, অতএব তাঁকে কাজেম আলীর বর্ণনা শুনতে হয় কীভাবে এবং কেন মনে করে সেটা অর্থাৎ যে সময়ের কথা বলতে চায় তা বছরের কোন সময়। চৈত্র মাস হবে, ভীষণ গরমের রাত, পরের দিন ঢাকা যাবে বলে তেমন ঘুম হয় নি। সকালে উঠে পাতি গাব খাওয়ার লোভ সামলাতে পারে না। সে যখন লুঙ্গি কাছা দিয়ে গাব গাছে উঠছিল তখনও গাব গাছে বসে থাকা কোকিল শেষ ডাকটি দিয়ে উড়ে গিয়েছিল, এর সব কিছুই তার মনে থাকত না বলে কাজেম আলী লেখককে জানায়, যদি-না তাড়াহুড়ায় সে একাধিক গাবের বিচি গিলে ফেলতো। গাবের বিচি গিলে ফেলা যে কোনো ঘটনা নয় বা ঘটনা হতো না যদি-না ওই গাবের বিচি তার পেট শক্ত করে ফেলত এবং ঢাকায় খিলগাঁওয়ে দেখা করতে যাওয়া মেসের পায়খানায় ওই গাবের বিচি হেগে না দিত। কাজেম আলী তাই লেখককে যুক্তি দিয়ে বোঝাবার চেষ্টা করে যে সেটাই ভাগ্য যে সেদিন সে ঢাকা যাওয়ার আগে খুব সকালে তাড়াহুড়া করে অতগুলো গাবের বিচি না খেলে ঢাকায় গিয়ে পেট শক্তও হতো না কষ্টও হতো না এবং খবির মিয়ার ঘটনার সময়টাও ধরিয়ে দিতে পারত না। লেখক আবসার হাসান কাজেম আলীর কথায় এমন ভাব করেন যেন সে খুবই ঠিক কথা বলেছে। বন্যা এবং কোকিল ও পাতি গাব পাকানোর সময় চিহ্নিত হলেও এই গল্পের কোনো ভাবগতিক ঠাওর করতে পারে না লেখক আবসার হাসান।
বরগুনার লাইনের লঞ্চে করে সারাদিন লাগে তাদের বরিশাল আসতে। বরিশাল থেকে আর একটা বড় লঞ্চে তারা ঢাকায় রওনা দেয়, দু’দিনের খাবারদাবার সঙ্গে নিয়ে আসে গ্রাম থেকে অর্থাৎ যতক্ষণ-না পর্যন্ত তারা ঢাকায় রহম মিস্ত্রির ছেলের বাসায় আসবে, তার আগে তাদের খাবারদাবারের ব্যবস্থা আছে। এই দীর্ঘ ভ্রমণের সময়ে নাকি রহম মিস্ত্রি ও তার স্ত্রী রাজ্যের সব কথা বলে কাজেম আলীর সঙ্গে। হেয়া কত্তা দরনের কতা সাইব, আর কমু কি, আবসার হাসান বোঝেন অর্থাৎ রহম মিস্ত্রি যত ধরনের কথা সে সময়ে কাজেম আলীকে বলেছে তার কিছু অংশ হলেও আবসার হাসানকে এখন শুনতে হবে।
এই পোলা তো আমার ঘরে জন্মানোর কতা না, ভাগ্যের কারবার, এমনভাবে বলেছে রহম মিস্ত্রি সেই লঞ্চভ্রমণের সময় কাজেম আলীকে। ছেলেসন্তান হলে ছাতি মিস্ত্রির যতসব কল্পনা থাকবার কথা তা তার ছিল কিন্তু সব উল্টাপাল্টা হয়ে যায় যখন আবিষ্কার করে তাদের ছেলে খবির মেয়া পড়াশুনায় ভাল, তুখ্খার ছাত্তর। রহম মিস্ত্রির স্ত্রী কদম বিবি সে সময় কাঁদে আনন্দ ও দুঃখে যে, ছেলে তার লেখাপড়া করে বড় হয়েছে, আবার ছেলেকে মা হিসেবে কোনোদিনই কাছে পায় নাই, ওই তার লেখা-পড়া করবার জন্যে। রহম মিস্ত্রি সুখ-দুঃখের অনেক কথার মধ্যে এ কথাও বলে যে সকলের মতো তারও আশা ছিল ছেলেকে দেখেশুনে বিয়া করাবে, কিন্তু তাদের সব গাঁওগেরামে ওই ছেলের উপযুক্ত কইন্যা কোথায়। ছেলে তার পছন্দ মতো বিয়ে করে, বউ অইলো যাইয়া সোনার নাহান টুকরা। কিন্তু তাতে কি তারা তো আর কাছে পায় না। খবির মিয়ার চাকরি হওয়ার পরে বাবাকে বলেছে ছাতি সারানোর কাজে যত টাকা আসে তার চেয়ে বেশি টাকা সে বাবাকে দেবে, তাতে যদি বাবা তার ছাতি সারানোর কাজ ছেড়ে দেয়। রহম মিস্ত্রি কথা বলবার সময় সেদিনের তরুণ কাজেম মিস্ত্রির ডানায় হালকা চাপ দেয়, মুচকি হাসে, বলে, এইডা হের ইজ্জতের ব্যাপার, অমুকের বাবা হাট-বন্দরে ছাতি মিস্ত্রির কাম করে। তবে ছেলে বলেছে চাইলে সে ছাতি সারানোর কাজ করতে পারে যদি একান্তই তার মন চায়। অতএব ছাতি মিস্ত্রি ছাতি সারানোর কাজ বন্ধ করে দেয়, কিন্তু ছাপড়া দেয়া জায়গাটা হাট কমিটির কাছ থেকে বায়না করে রাখে যদি সত্যই তার মনে হয় যে ছাতি সারানোর কাজ আবার তার করতে হবে, এই ধরনের কত সব কথা হয় তার শেষ নাই, এমনভাবে কাজেম আলী লেখক আবসার হাসানকে জানায়। কাজেম আলী অভ্যাসবশত তার হাত দিয়ে কপালের ঘাম মোছবার চেষ্টা করে যদিও তার ঘামায় না, তার কাছে এটা তাজ্জব ব্যাপার মনে হয় এবং একবার ঘামহীন কপালে হাত দিয়ে মুছে লেখককে বলে, ছার সাইবদের বাসা বাড়ির কারবারই অইল যাইয়া অন্য রহম, ভাদ্দর আশ্বিনের গরমেও কেমন ঠাণ্ডা, যেন পুহুইর পারের ঘন ক্যালার ঝাড়ের নিচে, হেও এত ঠাণ্ডা না। লেখক আবসার হাসান তাকে বলেন না যে তাঁর বাড়িতে ঠাণ্ডার কারণ কী, বলেন না কারণ তাঁর মনে হয় তাতে হয়তো গল্পের স্রোত পরিবর্তন হয়ে যাবে। অতএব এ প্রসঙ্গে আবসার হাসানের কোনো কিছু না বলায় কাজেম আলীর সেই অভিমতই থেকে যায় যে সাহেবদের বাড়িঘরে অন্যরকম ব্যাপার, গরমের মধ্যেও ঠাণ্ডা। আবসার হাসান এ সময় বোধ করেন দুপুর হয়ে গেছে, কিছু খাওয়া দরকার। তাই এক ফাঁকে কাজেম আলীকে বলেন, ভাই সাহেব আমাদের তো কিছু খাওয়া দরকার, দুপুর হয়ে গেছে। এর উত্তরে কাজেম আলী বলে, ও মেলাক্ষণ কতা কইলাম, টেরই পাই নাই। তাছাড়া হুরুজ দেহন যায় না এহান দিয়া বুঝমু কেম্মে এহন কী বেলা। এ পর্যায়ে অবশ্য আবসার হাসানের নূতন সমস্যার কথা ভাবতে হয়। এ কথা সত্য গ্রামীণ এই কাজেম আলীকে নিয়ে তাঁর ক’লাখ টাকা দামের ডাইনিং টেবিলে বসে খেতে আপত্তি নাই, কিন্তু তাঁর পরিবার, তারা কি প্রস্তুত এর জন্যে এমনকি দেখতে এই দৃশ্য, কাজের লোকগুলোও তো আপত্তি করবে, মুখে না হোক অন্তরে। যে মানুষটির বর্ণিত কাহিনীর উপর তিনি হয়তো যে সফল উপন্যাসটি রচনা করবেন, যে-উপন্যাসটি আবার তাঁকে দিতে পারে কত লাখ টাকা এবং অগণিত আরো, তা অনাগত সময়ের জন্যে অথচ সেই মানুষটিকেই সঙ্গে করে এক বেলা খাবার খাওয়া যাবে না। এক বেলা মাত্র, অথচ কী অদ্ভুত ‘লেখক স্বাধীনতায়’ কখনো তার কাগজ কি কলম, কোনো কিছুতে বাধ সাধে না। আবসার হাসান কাজেম আলীকে বলেন, একটু ভেতর থেকে আসি তিনি ভেতরে যান। স্ত্রী ফোনে কথা বলছিলেন, সিঙ্গাপুর, হোটেল, শপিং মল এ সব শব্দ তিনি শোনেন, ফোন হাতে রেখে স্ত্রী জানতে চান লোকটি কে ? তুমি তো সকাল থেকে কিছু খাওনি, এক সঙ্গে দুপুরের খাবারটিই খেয়ে নাও। স্ত্রীর সামনে লেখক এমনভাবে দাঁড়িয়ে থাকেন যেন গ্লাডিয়েটর যুগের দাস, কিছু বলতে চান বলতে পারেন না। স্ত্রী জিজ্ঞেস করেন বিশেষ কিছু বলবে ? লেখক এক পা আগান দু’হাত জড়ো করেন তাঁর নাভি সমান্তরাল, জড়ো হাত উপরে উঠে আসে বুকের কাছে, বুকের নিচে, বলেন, লোকটি বরিশালেরও একশ মাইল দক্ষিণ থেকে এসেছে। স্ত্রী বলেন তাঁর হাতের ফোন একবার কানের কাছে নিয়ে আবার ফিরিয়ে এনে, ‘তো’। লেখক তো ধ্বনির বিশ্লেষণাত্মক মর্মার্থ বোঝেন না তা নয়, তারপরও জড়ো হাত আবার নিচে নাভি সমান্তরাল এনে বলেন, দুপুরের খাবার। লেখক স্ত্রী ফোন আবার কানের কাছে নিয়ে বলেন, শোন্ পরে ফোন করবো। তিনি ফোন থেকে ফ্রি হলেন, কারণ কোনো রকমে ঝামেলামুক্ত এবারে স্বামী লেখকের সঙ্গে কথা বলবেন। লেখক জানেন আগ্রাসী মনোভাবাপন্ন প্রতিবেশীর সঙ্গে বসবাসের কৌশল, তিনি দু’বার বলেন, ঠিক আছে, ঠিক আছে। যদিও এই ‘ঠিক আছে’র ভেতর অঘোষিত যুদ্ধের শুরুতেই পরাজয় মেনে নেয়া। কিন্তু লেখক যখন বললেন, মনে হলো অতি স্বাচ্ছন্দে তিনি পরাজয়ের কথা বললেন। স্ত্রী কিছু বলবার আগে তিনি ‘ঠিক আছে’ বলে বেডরুমের বাথরুমে যেতে থাকলেন। নিয়ম ভাঙ্গলেন, বাথরুমের দরজা লাগালেন না, আধা খোলাই থাকল। কমোডে বসে তিনি পেশাব করেন কিন্তু সিদ্ধান্ত নিলেন পুরো পাজামা খুলে তিনি কমোডে বসে পেশাব করবেন না বরং যিপার খুলে দাঁড়িয়ে পেশাব করবেন, তিনি তাই করতে গেলেন কিন্তু টের পেলেন অনেক্ষণ পেশাব করেননি, অধিক চাপে পেশাব আসতে সময় নিল। তখনই তার মনে হলো যে একইভাবে কাজেম আলীর পেশাব পাওয়ার কথা অথচ কাজেম আলী সে কথা বলেনি এখনো পর্যন্ত, খারাপ লাগে ভেবে সমাধান খুঁজতে যে কাজেম আলীর মতো লোকের পেশাব বা পায়খানা করবার সেই ব্যবস্থা এ বাড়িতে আছে কিনা, পেশাবের অধিক চাপে লেখকের চোখে পানি এলো।
বাংলা সাহিত্যের জনপ্রিয় লেখক পাজামা কোমর থেকে নামিয়ে অঙ্গ কমোডের দিকে শ্যুটার নিয়মে টার্গেট করে ঝড়ঝড় শব্দে সীমিত জলে ফ্যানা তুলে হলুদাভ জলোচ্ছ্বাস তৈরি করলেন, তাতে যোগ হতে চাইল আরো ক’ফোঁটা জল, চোখ থেকে যার উৎস, অধিক পেশাবের চাপ ও অতঃপর একটি অজ্ঞাত কান্নার অনুভূতি। ভাবলেন বা মনে পড়লো লস এঞ্জেলেসের হলিউড ইউনিভার্সাল স্টুডিওতে যেমন করে ছোট পুকুরখানিতে কেমন কৃত্রিম ঢেউ তুলে টাইটানিকের মতো জাহাজ ডুবিয়ে ফেলা হয়। তখনই তার মনে হলো তিনি তার কোন এক উপন্যাসের নাম রাখবেন ‘কমোডে ঝড়’।
এই ঝড় থেমে যায় যখন কিনা স্ত্রী ছোট চিৎকার করে বলেন, তোমার কি মাথা খারাপ হয়েছে দাঁড়িয়ে পেশাব করছ ? লেখক আবার বেরিয়ে তার লিভিং রুমে চলে যান, কাজেম আলীকে বলেন কিছু মনে নেবেন না দেরি হয়ে গেল একটু পেশাবের বেগ পেয়েছিল, আপনার পেশাব পেলে বলেন। তখনো একহাত পোটলার ভেতরে কাজেম আলীর, পোঁটলা থেকে কী যেন বের করতে করতে বলল, না ছার আমাগোর মতন লোকের সাইবদের বাড়িতে গু-মোতনের মতন কাম হরন ভাল না, হুরুজ উদয় অস্তাব্দি একদিন না হরলে কিচু অইবে নানে। ঢাকায় আওনের আগে এই ব্যাপারে এটটু টেরনিং দিছি যাতে ওই কতা ‘সাইবদের বাড়ি’। লেখক অবাক হন লোকটির জ্ঞান দেখে। কাপড়ের পোঁটলার ভেতর থেকে নতুন ছোট পোঁটলা সে বের করে। আবসার হাসান দেখতে থাকেন এ পোঁটলা থেকে কী বের হচ্ছে, কাগজে মোড়ানো দুটো পোঁটলা একটা আয়তনে অপরটির চেয়ে ছোট। কাজেম আলী প্রথমে বড় পোঁটলা খোলে, আবসার হাসান দেখতে থাকেন তার ভেতর থেকে চারটে আটার রুটি বের হয়। তখন অবশ্য লেখকের বুঝতে বাকি থাকে না যে অপর পোঁটলায় এমন কিছু যা দিয়ে সে তার ওই রুটি খাবে।
আবসার হাসান তাঁর আসনে ফিরে আগের মতো বসেন। ছার পরিবার আডার রুটি বানাইয়া দেছে সব ব্যালার জইন্যে, আলেদা আলেদা পোটলা বানাইয়া, লগে মিডা দিয়া দেছে, খাজুরের মিডা, রওয়া পড়া চিনির লাহান দানা, ঝোলা মিডা না, নিজের গাছের, নিজেই গাছ কাটছি নিজেই রশ লইছি, শ্যামেলা বিবি জাল দিয়া হেইয়ার মিডা বানাইছে। আবসার হাসান জানেন এ প্রসঙ্গে কাজেম আলী কী বলবে, যে সাইবদের বাড়িতে তার মতো হাইল্যা-জাইল্যার খাওয়া উচিত নয়, তাই স্ত্রী তার জন্যে রুটি বানিয়ে দিয়েছে। এবারে লেখক আবসার হাসানের সত্যি কেঁদে ফেলতে ইচ্ছে করছে একটি মানুষের এমন সব অদ্ভুত ব্যক্তিত্ব ও বুদ্ধিমত্তা দেখে। ঠিক সেই মুহূর্তে কাজেম আলী বলে, ছার কইতে অয় তাই কই, খায়েন আমার লগে ঝোলা মিডা আর রুডি, কিন্তু আহ্মনেদের মতো বড় লোকরার এই সব জিনিস না খাওয়াই ভাল। এ সময় আর একটি অবাক কাণ্ড ঘটে তা হলো লেখক-স্ত্রী নিজে একটি ট্রেতে কিছু খাবার নিয়ে আসেন কাজেম আলীর জন্যে। তাঁর উদ্দেশ্য খাবার খেয়ে হয়তো লোকটি চলে যাবে। কিন্তু তিনি যখন দেখলেন কাজেম আলী নামক লোকটি আটার রুটি ও গুড় খাচ্ছে আর তার স্বামী তাকিয়ে থেকে তা দেখছে, তখন স্ত্রী অবাক হলেন, স্বামীকে বললেন, সেকি আমি তো ওনার জন্যে খাবার নিয়ে এসেছি। লেখক স্বামী তখন বললেন, তোমার খাবারের অপেক্ষায় সারা পৃথিবী থেমে থাকে না তা এভাবে চোখের সামনে না দেখলে বোঝার উপায় থাকবে না। শুধু রাগ ও আশ্চর্য হওয়ার দৃষ্টি নিয়ে স্ত্রী স্বামীর দিকে তাকায়। হয়তো সে তাকানোয় প্রশ্ন ছিল কেননা লেখক তখন বলেন, জানিনা তবে মনে হয় উনি বলবেন যে, ওদের মতো হাইল্যা-জাইল্যা লোকদের সাহেবদের বাড়িতে খেতে নেই। স্ত্রী কিছু বলেন না, কারণ তাঁর ধারণা হয় স্বামী নিজেও অজানা রাগের শিকার, তবুও স্বামীর পাশে বসেন। স্বামী টেবিলের উপরে রাখা কাজেম আলীর জন্য আনা খাবার থেকে খেতে শুরু করেন, তিনি জেনেই এ কাজ শুরু করেন, ফলে স্ত্রী অধীর প্রশ্নবোধক ও অর্থবহ চোখে স্বামীর চোখের দিকে তাকালে স্বামী তার উত্তরে স্ত্রীকে এমন ভাব দিলেন যে, তিনি জানেন এ খাবারগুলো পুরোনো, পতিত যা কাজেম আলীর জন্যে আনা হয়েছে এবং যা কোনো ক্রমেই স্বামী আবসার হাসানের খাওয়া উচিত নয়। অতএব স্ত্রীও জেনে যান তাঁর স্বামী ইচ্ছে করে ওই খাবার খাচ্ছেন। এ রকম সময় স্ত্রীও অভিজ্ঞ হন যে কীভাবে কাজেম আলী নামক লোকটি ট্রেতে রাখা পানির গেলাস থেকে তার পেতলের গ্লাসে ঢেলে তার পরে পানি খাচ্ছে। স্বামী জানেন স্ত্রী এ দৃশ্য দেখে অবাক হচ্ছে, তাই তাঁর উদ্দেশ্যে স্বামী বলে, সাহেবদের গ্লাস নষ্ট হতে পারে বলে তার নিজস্ব গ্লাসে খাচ্ছে, যদিও এই গ্লাস নষ্ট হওয়ার কিছু নাই। শেষের অংশটা স্ত্রীকে লেখকের বলার কারণ তিনি জানেন যে, কাজেম আলীর জন্যে যে-গ্লাস আনা হয়েছে তাও পতিত ও নিম্নবর্গীয় মানুষের জন্যে। স্ত্রী বোধহয় আর সহ্য করতে পারেন না, তিনি উঠে চলে যান। কাজেম আলীর আটার রুটি খাওয়া শেষ হয়, শেষ হয় লেখকেরও যা তিনি খাচ্ছিলেন সেই ট্রে থেকে। এরপর কাজেম আলী আবার শুরু করে, কত যে জিনিসপত্র রহম মিস্ত্রি ও তার স্ত্রী কদমবিবি সঙ্গে নিয়ে নেয় ঢাকায় ছেলের জন্যে। রস, রসের পিঠা, গুড়, নারকেল, তেল, আমের আচার, চিকন চাল, হেন কিছু নাই যা লওয়া হয় নাই। এমনকি নাতিনরে মাথায় রাইখ্যা তাবিজ তুমার মাদলি ও ত্যানা খাতা, হের কোনো হিসাব নাই, বেহিসাব। লেখক আবসার হাসান এ কথা বুঝবার চেষ্টা করে যে, কত আবেগ সেই সব জিনিসপত্রের মধ্যে যা রহম মিস্ত্রি তার ছেলে, ছেলে-বউ ও সম্ভাব্য নাতি বা নাতনির জন্যে ঢাকা নিয়ে আসছেন।
কাজেম আলী আর একবার পানি খায়, পেতলের গ্লাসের দিকে তাকিয়ে দ্যাখে যেন এর আগে আর কখনো এমন গ্লাস সে দেখেনি যা অথচ নিজেরই। তুত দেয়া বেগুনি রংয়ের পা থেকে ছোট গামছাখানা টেনে তুলে কপাল ও ঘাড়ের ঘাম মোছে। যদিও যে-ঘরটিতে সে বসে আছে এয়ার কন্ডিশনার চলছে বলে সেখানে কোনো গরম নাই । সে বিষয়টা কাজেম আলীর বোঝার কথা না, শুধু এক ফাঁকে বলে, বাইরের গরমডা আহমনাগো ঘরের মইদ্যে হানতে পারে নায়।
আবসার হাসান অপেক্ষা করতে থাকে কাজেম আলী কখন তার গল্পের অবস্থান লঞ্চ থেকে ঢাকায় নিয়ে আসবে। তার এই অপেক্ষার পর-পরই কাজেম আলী যে কথাটি বলে, তা হলো তারা দু’খানা রিকশা নিয়ে অনেক ‘মাল-সামানা’ সহ সদরঘাট থেকে খবির মিয়ার বাসায় আসে। খবির মিয়ার বাসা সম্পর্কে কোনো স্পষ্ট ধারণা দিতে কাজেম আলী ব্যর্থ হন কিন্তু আবসার হাসান নানাভাবে প্রশ্ন করে যা ধারণা করতে সমর্থ হয় তাহলো খবির মিয়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক ও ইকবাল হলের হাউস টিউটর ছিলেন। আর দিন-ক্ষণ ছিল উনিশ্ শ একাত্তর সালের পঁচিশে মার্চের দু’একদিন আগে। খবিরের বাবা-মাকে ঢাকায় দিতে এসে কাজেম আলী পাশের গ্রামের কোন একজনের খিলগাঁওয়ের মেসে যায়। ধারণা করা যায় ওই সময়ের রাজনৈতিক পরিস্থিতির উপর কাজেম আলীর পরিষ্কার কোনো বোধ ছিল না সেটা অবশ্য বোঝা যায় তার আগের একটি কথা থেকে। সেই কথাটা ছিল এই রকম যে, তারা গাঁও-গেরামের লোক ‘দ্যাশ-ট্যাশ’ কি ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ কি এই সব অত কিছু তারা বোঝে না, কেবল জয় বাংলা, নৌকা মার্কা ও শ্যাখ সাইব ছাড়া। কিন্তু যেই রাতে পাকিস্তানি মিলিটারিরা ঢাকায় ‘লায়খে-লায়খে’ লোক মেরে ফেলে ওই রাতগত দিনে বিকাল বেলায় সদর ঘাট থেকে তার লঞ্চ বরিশালের দিকে ছাড়বার কথা, সে গ্রামে ফিরে যাবে। কিন্তু অবস্থা যত খারাপই থাকুক খবির মেয়া, তার বাবা রহম মিস্ত্রি ও রহম মিস্ত্রির স্ত্রী কদমবিবিকে না বলে সে গ্রামের দেশে যায় কী করে।
আবসার হাসান তাঁর উপন্যাসের উপাদানসমূহের এ পর্যায়ে উপলদ্ধি করতে পারেন যে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র চালিত এই ঘরে শরীরে ঘামের ভাপ অনুভূত হচ্ছে, অসম্ভব গরমে গায়ের ফতুয়া খুলে ফেলেন, ফতুয়া খুলবার আগে একবার মনে হয়েছিল কাজেম আলীকে অন্তত একটু বলে নেবেন। পরে মনে হলো এর কোনো মানে দাঁড়াবে না, অতএব কোনো ভূমিকা ছাড়া আবসার হাসান তাঁর গায়ের ফতুয়া খুলে দু’পা উঠিয়ে শক্ত হয়ে সোফার উপরে বসেন। যদিও ঐ রকম কথিত ‘গ্রাম্য’ নিয়মে বাসায় বসার ঘরের সোফার উপর তাঁর বসবার অধিকার নেই। কিন্তু এই মুহূর্তে কাজেম আলীর গল্পের মাত্রা এ পর্যায়ে পৌঁছাবার পর আর আবসার হাসানের সেই ভয় থাকে না।

কাজেম আলীর কণ্ঠ একটু একটু কাঁপে যখন সে বলতে থাকে, পাও থোয়ার জাগা নাই, লাশেরে লাশ, রক্তের বইন্যা, পরের দিন বিয়ান বেলা, খবির মিয়ার দুয়ারের হোম্মে, সে থেমে আবার বলে, দুয়ারের হোম্মে অর্থাৎ দরজার সামনে বলবার পরে কাজেম আলীর থামবার কারণ আবসার হাসান বোঝেন, সে কান্নার আবেগ থামাতে চাওয়া। কিন্তু থামে কি, হাউ মাউ করে কাঁদে, ছার হে কতা কওনের না। মাথা নাড়ায়, আবসার হাসান সোফা থেকে উঠে কাছে গিয়ে কাজেম আলীর কাঁধে, পিঠের অংশের দিকে বাম হাত রাখে। সেই হাতে কাজেমের ঘামে ভেজা অমসৃণ চামড়া অনুভূত হয়। লোনা কাদা-মাখা ধরনের, তাতে কি, মানবিকতা পৃথিবী থেকে উঠে যায় নি, যাবেও না, আবসার হাসান বুঝে নেন, যেহেতু সে রাতে ইকবাল হলে কোনো প্রাণই রক্ষা পায়নি অতএব কাজেম আলী দেখতে পেয়েছিল রহম মিস্ত্রি, খবির মিয়া ও তাদের স্ত্রীদ্বয় কদম বিবি ও ফৌজিয়া আক্তারের গুলিবিদ্ধ মৃত লাশ। অতএব আবসার হাসান কাজেম আলীর পিঠে হাত দিয়ে চাপড় কাটেন আদর করে বলেন, ঠিক আছে আপনাকে আর বলতে হবে না, আমি বুঝে নেবো। আবসার হাসানের ওই কথা বলবার পরে কাজেম আলী স্ত্রীর চুল ঝাড়বার গামছাখানি মুখে চেপে ধরে মাথা নাড়াতে থাকে তা যেন আবসার হাসানের ওই কথার প্রেক্ষিতে অর্থাৎ লেখকের এই যে বুঝে নেবার প্রতিশ্র“তি সেই সীমানার পেছনেও যেন আরো কিছু থাকতে পারে, আরো কিছু আছে, যা হয়তো লেখক বুঝে নিতে পারবে না বলে কাজেম আলীর ধারণা।
--ছার আহমনে যা মোনে হরছেন হেইডা না খালি। আবসার হাসান আর অন্য কিছুই ভাবতে পারে না, ভাববার কথাও নয়, দরকারও পড়ে না কারণ কে না বোঝে যে সবাই নিহত। কাজেম আলী তার মুখমণ্ডল থেকে গামছা সরিয়ে নাক টেনে পরিষ্কার করে, তখনও লেখক আবসার হাসানের আদরের হাতখানা কাজেমের কাঁধ নিু পিঠের উপর। অবাক করে দিয়ে অতি ঠাণ্ডা কণ্ঠে কাজেম আলী বলে, ছার গুল্লি খাইয়া হেইয়ার ব্যাতায় মনে হয় খবির মেয়ার পরিবারের বাচ্চা অইয়া গ্যাছে। আবসার হাসানের অনিয়ন্ত্রণে কণ্ঠ থেকে শব্দ বেরিয়ে পড়লো ‘কী’ ? কাজেম আলীর পিঠ থেকে তাঁর হাত সরে এলো, চুলসহ শরীরের লোমের উপর দিয়ে একটি ঝড় বয়ে যায়, সেই ঝড়ে লোমেরা যদি বৃক্ষ কী মাঠের ফসল হয় তা উপড়ে যায় ঝড়ের তীব্র বাতাসে, অজ্ঞাতেই লেখক আবসার হাসান নিয়ন্ত্রণহীন শব্দের কণ্ঠে আবার প্রশ্ন করেন, কি বললেন ? কাজেম আলী আবার শ্বাসরুদ্ধকর হিক্কা তুলে বলল, ছার একটা সোন্তানের জন্ম হইয়া ছিল, কইন্যা সোন্তান। আবসার হাসানের চিৎকার শুনে ভেতর থেকে স্ত্রী ও কাজের লোকেরা দৌড়ে এলে তিনি তাদের দিকে না তাকিয়েই সবাইকে ইশারায় চুপ থাকতে বলেন, দাঁড়ানো অবস্থা থেকে লেখক সোফায় এমনভাবে ভেঙ্গেচুরে বসে পড়েন যেন সহসা লেখকের দেহ তরল হলে পরে তা গলে মাটিতে মিশে যেতে চায়। --ছার কইন্যা সোন্তান, আমাগো গেরামের মাইয়া সোন্তান, হের ইজ্জত রাখতে নিজের গামছাহান দিয়া ঢাইক্যা দেলাম, মাইয়া জুহুততো। আবসার হাসানের কাঁদতে ইচ্ছে করছে উপন্যাসের নাটকীয় চরিত্রের মতো।
কাজেম আলী তার পোঁটলা গোছাতে গোছাতে অঝোরে কাঁদতে থাকে, ফোঁসফোঁস শব্দে তা উপলব্ধি করা যায়, পোঁটলার ভেতরে সেই পেঁতলের গেলাসও ঢুকায় বাইদানীর যাদুর পোটলা গোছাবার মতো করে। --ছার আহ্মনে মনে হরছেন কেস্সাহান শ্যাষ ? সে লুঙ্গির পোঁটলায় চার কোনা মিলিয়ে গিট দিতে থাকে, --না ছার আমাগো গেরামের মাইয়া হ্যার লাশ আমি হালাইয়া যাইতে পারি না, গামছায় মোড়াইয়া হেই লাশ লইয়া সদর ঘাডের দিকে আডা দেই। লয়ক্ষে লয়ক্ষে মানু সদর ঘাডে, কয়জন কইলে, মেয়া তুমি পাগল তোমার বরিশাল যাইতে লাগবে হাতদিন, হের মইদ্যে লাশ পইচ্যা যাইবে, হের চাইতে বুড়িগঙ্গার নদীতে ভাসাইয়া দেও। মুই নিজে না, হেরাই ভাসাইয়া দেয়। ছার, ছার হে আমাগো কইন্যা সন্তান যার নাম রহম মিস্ত্রি রাখতে চাইল্হে সরোজিনী কদমবিবি। সরোজিনী অইল যাইয়া আবার ইন্দু দম্মের মাইয়া, হের ছোট সময় যেই মাইয়ারে ভাল লাগজেলে। কাজেম আলী লেখক আবসার হাসানের বাসা থেকে বেরিয়ে পড়ে। আবসার হাসান জানে, যে, সে যেতে পারবে না লিফটে, অতএব তিনি পেছনে পেছনে বেরিয়ে পড়েন কিন্তু তাঁর হাতে কাজেম আলীর প্লাস্টিকের জুতা জোড়া। তিনি বলেন আপনার জুতা ফেলে যাচ্ছেন। লিফটে উঠতে উঠতে কাজেম আলী বলে, ছার জোতা মুই হালাইয়া দিমু এহন, হেইদিন লাশ আর রক্তের মইদ্যে আটবার আগে জোতা হালাইয়া দেল্হাম। নিচের দারোয়ানদের মাথা খারাপ হওয়ার দশা এই দৃশ্য দেখে যে লেখক নিজে এই লোকটির পেছনে পেছনে তার জুতা হাতে গেটের কাছে চলে আসছে। গেটের কাছে দাঁড়িয়ে কাজেম আলী বলছে ছার মোরা গাও গেরামের মানু, মোগোর কান্দনডাও কুচ্ছিত। সে লেখকের হাত থেকে জুতাটা নিয়ে দেয়ালের পাশে ফেলে দেয়, তারপর ফুটপাতে বেরিয়ে পড়ে। লেখক অনুরোধ করতে থাকেন, আপনি কি সদরঘাটে যাবেন, আমার ড্রাইভার আপনাকে গাড়ি করে দিয়ে আসবে। কাজেম আলী কিছুই শোনে না আবসার হাসান কী বলছে। ফুটপাত ধরে লেখক ওই কাজেম আলীর পেছনে হাঁটেন, বাড়ির দারোয়ানরা তাজ্জব হয়ে তা দেখতে থাকে।
কাজেম আলী পেছনে না তাকিয়ে বলে ছার একটা কতা, সে ঘুরে দাঁড়ায়, বুড়িগঙ্গার গাং-এ সরোজিনী কদমবিবির লাশ ভাসাইয়া দেওনের পর দ্যাশে যাইয়া ওই গামছাহানার কয়বর দেই, আমাগোর নোলকঝোড় গেরামে ওই কইন্যার কয়বর আছে। এটুকু বলে আবার কাজেম আলী হাঁটে, আচ্ছা বলে লেখক কাজেম আলীর পেছনে হাঁটা অব্যাহত রাখেন, কেন যে লেখক তখন তার পেছনে হাঁটে তা তিনি জানে না যেমন অনেক কিছুই তিনি জানে না বলে তাঁর বিভিন্ন উপন্যাসে লিখেছেন। কাজেম আলী আবার বলে, ছার আছেন নাহি, আসল কতাডাই কওয়া অয় নায়। আবসার হাসান মুহূর্তে ভাবেন এর মধ্যে কী আবার আসল কথা বাদ থাকতে পারে ? কাজেম আলী তার হাঁটা না থামিয়ে পেছনে না ফিরে বলে, ছার ওই কইন্যা সন্তান কিন্তু জেবন্ত জোন্মাইছিল, হের আঙ্গুল মুখের ভেতরে আছেল যহন আমি হ্যারে পাই, কিন্তু মিরতো, মরা, পরান নাই। আবসার হাসান শোনেন কিন্তু যা শোনেন তা বিশ্বাস করতে পারেন কিনা বোঝা যায় না; আর কাজেম আলী কথাটা বলার পর থামে ও দাঁড়ায়, ঘুরে সোজা লেখকের দিকে তাকায়, লেখক উপলব্ধি করেন এই দীর্ঘ আলোচনায় কাজেম আলী কখনো তাঁর চোখের দিকে তাকায়নি, এই প্রথম, সেই চোখ এখন এক অদ্ভুত গভীরতায় পতিত চোখ, পলকহীন সেই চোখের গভীরতা নিয়ে কাজেম আলী আবার বলে, মরা, পরান নাই।
লেখক আর কাজেম আলীর পেছনে হাঁটতে পারেন না। দারোয়ানরা দ্যাখে, লেখক আবসার হাসান রাস্তায় আলগা পায়ের উপর, দু’হাঁটুতে কনুইয়ের পেছনে ভর রেখে কনুই ভাঙ্গা হাত দুটো মাথার দু’পাশ ধরে বসে পড়ে, লোকটি হেঁটে সামনে যায়, স্বভাবতই কিছুক্ষণের মধ্যে হেড দারোয়ান এসে বলে, ছার আপনার শরীর খারাপ ? বাসায় চলেন।
কাজেম আলীকে নিয়ে এরপরও লেখকের দিক থেকে অনেক কিছুই আছে। কিন্তু প্রধান কথা হচ্ছে আমেরিকাতে প্রবাসী বাঙালিদের ভেতরে এমন একটি মৌখিকগল্প লেখক বলেছিলেন নিউইয়র্কে আর এক মফস্বলীয় ‘কলাম ল্যাখকে’র দোতালা বাসভবনের উঁচু সোফায় বসে ইলিশ মাছ, মাগুর মাছ, কৈ, গরুর মাংস, খাসী, হালাল চিকেন, ঘন ডাল, গুঁড়া মাছ ইত্যাদি সব দিয়ে খেতে-খেতে। কথিত আছে খাবার শেষে কলাম ল্যাখক তিন ধরনের জুস-- আপেল, কমলা ও আঙ্গুর রস পরিবেশন করেছিল কেননা গর্বিত “বাঙ্গালি ধর্মপ্রাণ অসাম্প্রদায়িক মুসলমান” হিসেবে সেখানে অন্যকোনো ধরনের বেহেস্তী রস নিষিদ্ধ বা নাজায়েজ ছিল। আরো শোনা যায় কেউ একজন নাকি ‘লেখক’ আবসার হাসানের কাছে কাজেম আলীর পরিণতির কথা জিজ্ঞেসও করেছিল কিন্তু ‘লেখক’ মানুষ গল্পের পরে অন্য কিছুর প্রতি আগ্রহ থাকা লেখকপ্রথা বিরোধী এমন ইঙ্গিত করা হয় তাঁর পক্ষ থেকে, তাছাড়া যে মফস্বলীয় লেখক এই খানা-পিনার আয়োজন করেছে তার কলামেও নাকি লেখকের খাদ্যতালিকা ও অন্যান্য সব এমনকি ’কবিগুরু’র থেকে পঠিত ’আমাদের ছোটো নদী’ ’দ্যাশ মিস্ করার গান বাদ্য’ যাকে তারা ’দ্যাশপ্রেম’ বলে তাঁর সব কিছুই স্থান পেলেও ঢাকায় ছাপা হওয়া ওই কলাম ল্যাখক কাজেম আলীর গল্প বা নাম স্থান দেয়নি, ব্যাখ্যায় এই বিষয়েও কলাম ল্যাখক নাকি তার গোটা বন্ধুপারিষদদের বলেন, হেলে-চাষার কথা নিয়ে লেখালেখি করলে বাংলা সাহিত্যে এমন কোন লাভ নেই, তাতে বিউটিটা নষ্ট হয়ে যায়, ইত্যাদি এই জাতীয় কথাবার্তা তাঁদের মধ্যে চলতে থাকে যা সাধারণত প্রবাসী বিজ্ঞ ও বুদ্ধিজীবী সমাজে হয়ে থাকে।*
লেখক পরিচিতি
আনোয়ার শাহাদাত
জন্ম বরিশালে। কৃষক পরিবারে।
গল্পগ্রন্থ : ক্যানভেসার গল্পকার, পেলেকার লুঙ্গী।
উপন্যাস : সাঁজোয়া তলে মুরগা।
চলচ্চিত্র : কারিগর।
শর্ট ফিল্ম : ন্যানী।
দীর্ঘদিন নিউ ইয়র্কে থাকেন।
কাজেম আলী নামের লোকটি বরগুনা-ঢাকা লাইনের দোতালা লঞ্চে এসে সকাল বেলা সদরঘাটে নেমে সঙ্গের ঠিকানা অনুযায়ী ধানমণ্ডি লেকের পাড়ে সদ্যনির্মিত বিশাল কথিত অট্টালিকা সমান এপার্টমেন্ট বিল্ডিংয়ের সামনে এসে দাঁড়ায়। তার দাঁড়ানোর ভঙ্গিটির কোন পরিবর্তন হয় না যেমন ক্ষেতের আগাছা বাছতে কি লাঙ্গল জোয়াল টেনে ক্লান্ত গরুর বিরতির জন্যে জোয়ালখানা খুলে গরুর খুঁড়ার উপরে ও নিজের ঊরুতে কামড়ে জড়িয়ে থাকা জোঁক ফেলে সূর্য ঢাকতে কপালের উপরে হাতটা রেখে বাড়ির কান্দির দিকে চোখ কুঁচকিয়ে কোমরটা মচকে যাওয়ার মতো দাঁড়িয়ে দেখা বাড়ি থেকে খাবার নিয়ে কেউ এলো কিনা, চাষা কাজেম আলী ইচ্ছায় কি অনিচ্ছায় ওই রকমই দাঁড়ায়, যাকে ঢাকার শহর অনুপোযোগী বলে একটি লোক বিবেচনা করা গেলেও যেতে পারে, সেই লোকটিকেই ওই মুহূর্তে এই বিলাসবহুল এপার্টমেন্টের দারোয়ানদের পক্ষ থেকে নিশ্চিত করা হয় যে এই ঠিকানাই তার সঙ্গে থাকা কাগজে লেখা রয়েছে, যে-কাগজখানা সঙ্গে নিয়ে আসা দুটো পুরোনো লুঙ্গি দিয়ে বানানো পোঁটলা দুটোর দ্বিতীয়টা থেকে মোড়ানোর পর মোড়ানো বিধ্বস্ত কাগজের ভেতর থেকে বের করা হয়। কাজেম আলীর কাছে থাকা ঠিকানার বর্ণনা অনুযায়ী ধানমণ্ডি এলাকার অভিজাত তালিকায় উল্লেখযোগ্য এই এ্যাপার্টমেন্টের কথা থাকলেও ভবনের সার্বক্ষণিক কর্তব্যরত দারোয়ান বাহিনী এই মর্মে সন্তুষ্ট হতে পারে না যে, এমন একটা চাষা চেহারার লোক এ এ্যাপার্টমেন্টের কোনো সদস্যের বাড়িতেই যাওয়ার উপযোগী হতে পারে, তাও কিনা এমন এক লোকের নাম ও এ্যাপার্টমেন্টের কথা উল্লেখ করা আছে যার বাসায় এই সব দারোয়ানরা ভাবতেই পারে না এমন একটা চাষা এসে ঢুকবে বা ঢুকতে পারে, কথা হচ্ছে আবসার হাসানের বাসা নিয়ে। আবসার হাসানের প্রতিটি উপন্যাসের পেছনে ছবিসহ লেখা থাকে তিনি সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেছেন জাতীয় তথ্য, দারোয়ানরা সে-সব বই দেখেছে, কখনো তা পড়েছে, ও পড়ে বিনোদিত হয়েছে, একে অপরকে তৃপ্তির সঙ্গে বলেছে, লিক্ছে এক্খান জব্বর। তাদের ভাষায় ‘জব্বর’ এই লেখক বাংলা সাহিত্যের এ সময়ের সবচেয়ে জনপ্রিয়দের একজন, সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্ম, আল্লা-বিল্লা সামাজিক দায়িত্বসহ যাবতীয় ম্যাসেজে ভরপুর ঔপন্যাসিক, গত বছরও যার ডজনখানা উপন্যাস প্রকাশিত হয়েছে, তার আগের বারও প্রায় সমসংখ্যক ক’খানা বেরিয়েছিল, তারও আগের বার নিজের লেখা বইয়ের সংখ্যা অবশ্য জোড়সংখ্যার, তা প্রায় কমছে কম ১৪খানা কি তারও কিছু বেশি সেই তুলনায় গত বারের ক’খানা সংখ্যা নিচে নামার কারণে আগামীতে ১৬খানা প্রকাশের পরিকল্পনা করেছেন লেখক, সে-অনুযায়ী কাজও করে যাচ্ছেন তিনি অর্থাৎ লিখছেন। তাঁর স্ত্রী আতিয়া সিদ্দিকা হাসান নিজের গলার স্বর্ণালংকারে সহসা পাঁচ আঙ্গুল বোঝাই ভারী সব আংটি সহযোগের হাত সঞ্চালন করে অন্যদের সাথে যে-ধরনের কথাবার্তা বলেন বা বলতে পছন্দ করেন স্বামী প্রসঙ্গে, আল্লার ইচ্ছায় ‘সুলেখক’, মাল-ছামানা, ধন সম্পত্তি যাবতীয় যা তা লেখকের পক্ষে সম্ভব হওয়ার কথা না, কিন্তু আমাদের ওনার উপর তেনার নেকনজর আছে, ‘তেনা’ বলে লেখক-স্ত্রী ‘সৃষ্টিকর্তা’ তেনার কথা বলেন বোঝা যায়। ‘সুলেখক’ স্ত্রী হয়তো আরো বলতে থাকেন, তা ছাড়া উনি সব ধরনের মানুষের সঙ্গে ওঠ-বস করেন, লেখক মানুষ তাই বড়-ছোট, ছোট-বড় যত্তলোক সক্কলের সঙ্গে ওঠ-বস, ‘সুলেখক’ স্ত্রী এর পর আবারও তাঁর স্বামীকে ইঙ্গিত করে বলে যেতে থাকেন, ল্যাখক মানুষ অত বাছবাছাই করলে কি চলে, আর তাছাড়া ছোট লোকেদের সঙ্গে মিশলেই তো আর বড় লোকের ফোসকা পড়ে না বা ইজ্জত কি ধুইয়া নেমে যাওয়ার জিনিস যে ল্যাখক হিসাবে দুই চারটা নিম্নশ্রেণীর মানুষের সঙ্গে ওঠ-বস করলেই তা ধুয়ে নেমে যাবে।
পুরোনো দারোয়ানরা এসব জানে, অতএব তারা ভাবতে পারে না আজকের জনপ্রিয় লেখকের বাসায় এমন একটা চাষা প্রকৃতির লোকের আগমন ঘটতে পারে। পাছে ধমক খাবার ভয় থাকে আবসার হাসানের কাছ থেকে, তাই দারোয়ানরা এই গেঁয়ো লোকটির আগমনের খবর দিতে ইতস্তত, দারোয়ান দলের একজন অবশ্য একবার বলে দিয়েছিল, ঠিকানা ঠিক থাকলে কি অবে, যার নাম লেহা তাও ঠিক কিন্তু আপনার মতো লোক যাইতে চাইলেই তো আর আমরা পাটাইতে পারি না। কাজেম আলীর প্রকাশে ঢাকার নাগরিক দারোয়ানের বিনয় থাকে না যখন কিনা দারোয়ানদের ওইসব কথার উত্তরে বলে, আরে সাইব এইডা কোনও কতা অইল নাহি, এইডা কি কওনের কতা কিনা যে ঠিকানা ঠিক আছে, মানুও ঠিক আছে কিন্তুক যাইতে দেবেন না, আরে ভাই আমি কি চোর, নাহি ডাহাইত, না যোচ্চর নাহি বদ্মাইস নাকি কী যার জইন্যে যাইতে দেবেন না ? দারোয়ানরা একটু দ্বিধায় পড়ে, লোকটি গেঁয়ো হলেও কথার মধ্যে কোথায় যেন একটি শক্তি আছে।
অচলাবস্থা কাটাতে ইন্টারকমের দায়িত্বে নিয়োজিত দারোয়ান সাহস করে লেখক আবসার হাসানকে ফোন করে। লেখকের নিয়ম অনুযায়ী বিশেষ করে ব্যস্ত ও জনপ্রিয় লেখকের নিয়মানুযায়ী তিনি সকালের সেশনের লেখা লিখছিলেন, যে উপন্যাসটি তিনি এ বছরের সবচেয়ে কাটতি হবে বলে ধারণা করছেন, সেটাই সেই মুহূর্তে লিখছিলেন, লিখছিলেন বললে ঠিক হবে না, লেখা থামিয়ে কলমটা অর্ধেক পাতা লেখা কাগজের উপরে ছেড়ে দিয়ে ওই হাত দিয়ে বোডাম ফ্রেঞ্চ প্রেস-এর বিখ্যাত কফি পট থেকে কলাম্বিয়ান কফিতে একটু চুমুক দিলেন এবং কাগজের উপর কলম ছেড়ে দিয়ে লেখার বিরতি নিলেন। লেখার বিরতি নিলেন কারণ তিনি তাঁর উপন্যাসের নায়ক-নায়িকাকে দিয়ে একটি গভীর ঘন চুমুর দৃশ্যের কথা লিখছিলেন। লিখতে চাইলেন কিন্তু তার মধ্যে একটা সোশ্যাল কমিটমেন্ট বাধা সৃষ্টি করল। ভাবলেন তাঁর নায়ক-নায়িকা এক রুমে ঢুকে একটা চুমু খাবে তা ‘নতুন প্রজন্মের’ মূল্যবোধকে অবক্ষয়ে সহযোগিতা করবে কিনা। এমন বোধের তাড়নায় তাঁকে ক্ষাণিকক্ষণ বিরতি নিতে কি ‘কলম’ থামাতে হয়, সে লেখকের ‘ঔচিত্য-অনোচিত্য’ কি কর্তব্য বোধের ফলাফল। তাঁর উপন্যাসের নায়ক-নায়িকাকে দিয়ে যে চুমুটি তিনি খাওয়াতে চাইলেন তার পেছনে ছ্রোট্ট কাহিনী আছে এবং ওই চুমুর দৃশ্যে তিনি জীবনে সবচেয়ে বেশি প্যাশন বোধ করেছিলেন, তা তাঁর শেষবার আমেরিকা ভ্রমণের সময়। ঢাকায় থাকাকালে বহু বছর আগে চেনা একটি ছেলের সঙ্গে জ্যাকসন হাইটসের দোকানে তাঁর স্ত্রীর জন্য শাড়ি ও বাইশ ক্যারেটের খাঁটি সোনার গহনা কেনার সময় দেখা, বড় লেখক যেচে কারো সঙ্গে কথা বলেন না, তাও আবার নিউইয়র্কে যেখানের ভক্তদের সঙ্গে দেশের দূর মফস্বলের ভক্তদের খুব মিল, কিন্তু কী কারণে যেন নিজেই ছেলেটির সঙ্গে কথা বলেন। ছেলেটি হাই হ্যালো ধরনের উষ্ণতা দেখিয়ে, ক’সেকেণ্ডের মধ্যে বলে বাইদ্যা ওয়ে আপনি যদি আমাকে সময় দেন তাহলে একটি লেসবিয়ান বারে নিয়ে যাবো, এক লিটারের ম্যাক্সিকান কফি টেস্টের কাহ্লুয়া মদ খাওয়াবো, অ্যাঞ্জেলিকা থিয়েটারে যে কোনো একটি ছবি দেখাবো, একটি বিকাল, একটি সন্ধ্যা আমোদের উৎসব, বললে সে উৎসবকে ফস্টি-নস্টিও বলা যেতে পারে, ছেলেটি এই বলে হাসে এবং বলে এর সবই হবে যদি রাজী থাকেন। ‘তিনি লেখক মানুষ অসম্ভবের প্রতি অদমনীয় কৌতূহল অতএব রাজি হলেন’।
অন্ধকারাচ্ছন্ন শেক্সপিয়ারিয়ান আমলের জাহাজ ধরনের ডেকোরেটেড একটি বারে মদ খাওয়ার সময় সঙ্গী ছেলেটি ওই কাহ্লুয়া মদের ইতিহাস বর্ণনা করতে থাকে যেমন কেউ কেউ পেটে অ্যালকোহল গেলে অযৌক্তিক বাচালে পরিণত হয়, দ্বিতিয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এই মদের জন্ম, বাষট্টিতে এর আমেরিকা আগমন ইত্যাদি সব বগর-বগর চলতে থাকে। যদিও লেখকের লেসবিয়ান বারে যাওয়ার অভিজ্ঞতা আশানুরূপ নয় যেমনটি তিনি ভেবেছিলেন ও আশা করেছিলেন, তারপর ছবি দেখার পালা শুরু হলে লেখক ওই চুমুটিতে নিমগ্ন হলেন, তখনই ভাবলেন কোনো একটি উপন্যাসের নায়ক-নায়িকাকে দিয়ে তিনি তাঁর দেখা চুমুটি খাইয়ে দেবেন, যদিও চুমুটির পরের অভিজ্ঞতা তার জন্য ছিল আশ্চর্য হওয়ার। কেননা গভীর উত্তেজনপূর্ণ ওই চুমুর দৃশ্যের শেষে গিয়ে তিনি আবিষ্কার করলেন নারী ও পুরুষ নয় দুটো পুরুষের মধ্যে ওই চুম্বন চলল যা অবশ্য তাঁকে বমির অনুভূতি দিয়েছিল সে সময়ের জন্যে। ছবিটি স্পেনের এক পরিচালকের যিনি নিজেও নাকি সমকামী, তিনি কখনোই ওই পরিচালকের নাম মনে করতে চান না যদিও ছেলেটি বলেছিল অনেক কথা তাঁর সম্পর্কে । সেই চুমুটিই তিনি যখন তাঁর নায়িকাকে দিয়ে করাচ্ছেন বলে কলম তুলে নিয়েছেন, যদিও ওই মুহূর্তে কল্পনায় আসা তাঁর নায়িকাকে পুরুষের মতোই মনে হয়, ঠিক সেই সময় নিচের গেট থেকে ইন্টারকমে লেখককে কাজেম আলীর আগমনের সংবাদটা জানানো হয়। লেখক আবসার হাসান ‘মিষ্ট লেপ্টিত’ মানুষ, নিজের বিচিত্র সব অভিজ্ঞতা ছাড়া আবার এটা-সেটা পড়েও অভিজ্ঞতা রয়েছে অতএব তাঁর কৌতূহল কাজেম আলী নামক লোকটির আগমনকে ছোট করে দ্যাখে না। যদিও তিনি গেটের দারোয়ানদেরকে একটু চেক করে পাঠাতে বলেন মৌলবাদীদের পক্ষ থেকে লেখকদের উপর আক্রমণের বিষয়টির কথা মাথায় রেখে।
কাজেম আলীকে নিয়ে একজন দারোয়ানের সে ধরনের কাজ করতে হলো যে ধরনের কাজ তারা খুব ভিআইপি ধরনের অতিথিদের ব্যাপারে করে থাকে। অর্থাৎ বাড়ির গেট থেকে এ্যাপার্টমেন্টের দরজা পর্যন্ত এগিয়ে নিয়ে আসা, সেটা অতিথিকে বিশেষ মর্যাদা ও সম্মান দেখানো। কিন্তু কাজেম আলীকে একইভাবে একজন দারোয়ানকে সঙ্গে করে লেখক আবসার হাসানের দরজার সামনে আসতে হয় তার কারণ কাজেম আলীর পক্ষে লিফটে ওঠা বা আবসার হাসানের বাসার দরজা পর্যন্ত আসা সম্ভব নয়। দারোয়ান দেখলো লেখক সাদা পাজামার উপর একটি ফতুয়া পরে দরজা খুলে বাইরে এসে হলওয়েতে অপেক্ষা করছেন। দারোয়ান আবারও ‘কথিত’ শ্রদ্ধাবনত হলো মনে মনে লেখকের প্রতি, তা কাজেম আলীকে লেখকের এমন সম্মান প্রদর্শনের কারণে। লেখক দারোয়ানের সঙ্গের লোকটিকেই কাজেম মিয়া সম্বোধন করে তার এ্যাপার্টমেন্টের দরজার ভেতরে যেতে উদ্যত হলেন, দারোয়ানও ফিরে গেল।
কাজেম আলীকে লেখক আবসার হাসান তাঁর লিভিং রুমে ঢোকার পর যথারীতি বিনয়ের সঙ্গে বললেন ‘দয়া করে বসুন’। কাজেম আলীকে বসতে বলার পর লেখকের নিজের কাছেই খটকা লাগল, তিনি লোকটিকে বসতে বলবার সঙ্গে ‘দয়া করে’ কথাটা বললেন কেন ? তিনি জানেন ‘দয়া করে’ কথাটা বললেন কেননা একজন চাষাভুষা শ্রেণীর মানুষকে বিনয় দেখাতে আর কোনো ভাষা তিনি খুঁজে পাননি। এরপর অবশ্য তিনি আরো ভেবে পান না এমন বিশেষ বিনয় কেন দেখাতে হবে, তার ভেতরে কি কোনো অপরাধবোধ কাজ করে ? কি অপরাধবোধ, তা নিজের ভেতরে কোথাও হয়তো, এ সময় বুকের কোনো এক এলাকায় ব্যথা করে ওঠে। তিনি জানেন না সে কী ধরনের ব্যথা তবে নিজেই বোঝেন ‘সস্তা উপন্যাসের ‘সস্তা ব্যথা সঞ্চালন’-এর এখানে কোনো মূল্য নেই। অতএব তিনি কাজেম আলীর জগতে ফিরে আসেন।
কাজেম আলীর কোন পরিবর্তন নেই লেখকের এই বিশাল ড্রইং রুমে ঢুকে, চারদিকে তাকায় না পর্যন্ত, অথচ আবসার হাসানের ড্রইং রুমটা তাবৎ দুনিয়ার জিনিস পত্রে ঠাসা, ‘একটা আধুনিক সাজানো যাদুঘরের মতো’। কাজেম আলীর তাতে কেন, কোনো কিছুতেই কিছু যায় আসে না, এই ভাবনাটা লেখকের। কাজেম আলীর ভাবনার বিষয়টা এ মুহূর্তে জানা যায় না, সে শোনে না যে লেখক তাকে বসতে বলেছেন এবং তাও ‘দয়া’ জাতীয় শব্দ ব্যবহার করে। কাজেম আলী নিজের মতো উদ্যোগ নেয়, তার সঙ্গে দুটো পোঁটলা, দুটোই লুঙ্গির কাপড় থেকে বানানো, স্ত্রী শ্যামেলা দ্বিতীয় পোঁটলা বানিয়েছিল একটি পুরোনো শাড়ি কাপড় দিয়ে, পোঁটলার পেছনে কোনো মূল্যবোধ থাকতে পারে তা কাজেম আলীর স্ত্রী শ্যামেলার জানা থাকবার কথা ছিল না, স্বামী কাজেম আলীরও জানবার কথা নয়। কিন্তু সে যে জানে তা বোঝা যায় যখন তার স্ত্রী শ্যামেলাকে বলে, হোনো মস্ত বর ল্যাখকের সঙ্গে সায়ক্ষাৎ, মেয়ে-ছেলেদের হাড়ি-কাফুড়ে বানানো পোটলা দেইখ্যা যদি ল্যাখক দেলে কষ্ট পায়, দ্যাহো আর একখান লুঙ্গি কাফুড় পাও কিনা। সামনের আশ্বিনে কাঁথা সেলাইর জন্য রাখা লুঙ্গি নামিয়ে শ্যামেলা দ্বিতীয় পোঁটলা বানায়। কাজেম আলী তার সেই লুঙ্গির বানানো প্রথম পোঁটলা বাম বগলে চেপে দ্বিতীয় পোঁটলা থেকে লাল প্রধান সবুজ চেকের একখানি গামছা বের করে, কোনো রকম লেখকের কোনো মতামত গ্রাহ্য না করে কাজেম আলী লাল রংয়ের গামছাখানি লেখক আবসার হাসানের দামি কার্পেটের উপর বিছাতে থাকে। প্রায় তিনবার গামছাখানি কাজেম আলী বাতাসে ঢেউয়ের মতো করে দুলিয়ে পরে বিছায়। লেখক আবসার হাসান খেয়াল করেন গামছা বিছানোর সময় গ্রামের এই লোকটির হাত দু’খানি এমনভাবে দুলে ওঠে যেন শ্রাবণের আউশ ধানের উপর বাতাসের ঢেউ, যে ঢেউ লেখক নিজে স্বচক্ষে কোনো দিন দেখতে পারেননি, দেখেছেন টেলিভিশনে। গামছা বিছানো দেখে লেখক বুঝতে পারে যে কাজেম আলী ফ্লোরে কার্পেটের উপরে বিছানো গামছায় বসবে। গামছা বিছিয়ে কাজেম আলী লেখকের দিকে না তাকিয়েই নৈর্ব্যক্তিক বলতে থাকে, সাইবদের বাড়ি-ঘর, মোগোর মত লোক-জোনের গা-গতরে থাহে রাজ্যের কাদা-মাডি। লেখকের যে কাজেম আলীকে বলতে ইচ্ছে করে না তা নয় যে, তার স্প্রিং বিশিষ্ট সোফায় কাজেম আলী বসলে কোনো অসুবিধা নাই, কিন্তু তিনিই আবার বোঝেন কোনো কাজ হবে না, কারণ লোকটা ইতোমধ্যে প্রমাণ করে ফেলেছে যা সে ভাববে বা ভেবে আছে বা করতে চাইবে তা সে করবে। আবসার হাসান ‘লেখক’ অতএব তার ক্ষমতাসম্পন্ন ভাবনায় এও ভাবেন নিজের ব্যাপারে যে কাজেম আলী তার নিজস্ব হালকা প্রায় অদৃশ্য সবুজ চেকের লাল রংয়ের গামছা কোনো অভিমত ছাড়া বিছিয়ে বসতে না চাইলে তিনি ওই লোকটিকে সোফায় বসতে বলতেন কিনা। বরং তিনি ভেবে পান কাজেম আলী নিজের দিক থেকে সোফায় বসতে চাইলে হয়তো আবসার হাসানই বলতেন, না না ওখানে বসবেন না, ভেতর থেকে কাপড় আনাবার ব্যবস্থা করছি, আপনি মাটিতে বসেন; তিনি আসলে জানেন না কী হলে কী হতো, কিন্তু এসব ভাবেন। কাজেম আলী তার গামছায় বসতে বসতে পরিতৃপ্তির সঙ্গে যে সংবাদটি লেখককে দেয় তা হলো ‘ঝালহাডির গামছা’, আমগো দক্ষিণাঞ্চলে ঝালহাডির গামছাই অইল যাইয়া আহমনার সেরা গামছা। লেখক ভেবে উঠতে পারেন না এ ধরনের সংবাদ কাজেম আলী নামক লোকটি তাকে দেয়া বোধ করছে কেন, হয়তো কী দিয়ে কথা শুরু করবে তেমন বোধ থেকে সে এ সব কথা বলছে। কাজেম আলী বসে পড়বার পর আবসার হাসান কোথায় বসবেন দ্বিধায় পড়েন, ক’মুহূর্তে তার দ্বিধা কেটে যায় সোফায় নিজের আসনে ফিরে যাওয়ার মধ্য দিয়ে, কেননা তিনি বুঝে ফেলেছেন তাঁর সৌজন্যতার কোনো প্রভাব এখানে পড়ছে না।
আবসার হাসানের আগ্রহ ভেতরেই থাকে, কাজেম আলীর কাছে তা প্রকাশ করেন না, ধরেই নিয়েছেন একটা কিছু তো আছে, না হলে গ্রামের এই লোকটি এত আস্থার সঙ্গে তাঁর বসার ঘর পর্যন্ত আসতো না। ‘লেখক’ বলে বিচিত্র অভিজ্ঞতা তাঁর রয়েছে। সে-সব অভিজ্ঞতা কেবল ঘটনাক্রমে বা দুর্ঘটনাক্রমে হয়েছে এমন নয়, নিজে সোৎসাহে অভিজ্ঞতা সংগ্রহে উদ্যোগীই হয়েছে। আর এখন প্রতিষ্ঠিত লেখক হিসেবে তাঁর অভিজ্ঞতার অধিকাংশই আনুষ্ঠানিক বা সাজানো তা আবসার হাসান জানেন, কিন্তু তাতে তাঁর খুব তেমন অসুবিধা হয় না, নিজের মতো করে অভিজ্ঞতার বিশ্লেষণ ও যাচাই করে তার উপন্যাসে ব্যবহার করেন। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তাঁর উপন্যাসের উপকরণ আসে প্রধানত অন্যের বলা অভিজ্ঞতার কাহিনী থেকে। আবসার হাসানের সর্বশেষ হিট উপন্যাসগুলোর উপকরণ সবই মানুষের বলা অভিজ্ঞতা-গল্প বা কাহিনী থেকে নেয়া, অতএব কাজেম আলী যে সে রকমই একটা ব্যাপার তেমনটি আবসার হাসান মনে মনে ধরে নেয়। তারপরও তাঁর কৌতূহল প্রকাশ হয়ে পড়ে না, বরং অধীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করতে থাকে, ‘দেখা যাক কি হয় ধরনের’ সে-আগ্রহ। নিজের বিছানো গামছায় কাজেম আলীর ‘আসন’ ভঙ্গীতে বসার মধ্যেও কোনো এক ধরনের অস্বস্তি কাজ করছে সেটা বোঝা যায়। সম্ভবত সেই অস্বস্তি থেকে কাজেম দু’হাত এমনভাবে হাঁটুর দু’পাশে ভর দিয়ে নিচের মাটিতে রাখে তাতে স্পষ্ট হয়ে ওঠে অস্বস্তি ও তার হাতের ভর দেয়ার ধরনের মধ্যে একটা সম্পর্ক রয়েছে। আবসার হাসান উপলদ্ধি করেন কাজেম আলীর ওই অজ্ঞাত অস্বস্তি, বলেন-- ভাই সাহেব আরাম করে বসেন, বসতে অসুবিধা হচ্ছে না তো ? কিছু মনে না করলে বলি, আপনি আরাম করে সোফায় বসুন, আমি কিছু মনে করবো না, বরং খুশি হবো।
আবসার হাসান যেন জানতেন তাঁর বসতে বলবার অনুরোধ কাজে আসবে না, তারপরও বলেছেন নিজের মনের শান্তির জন্যে, অজ্ঞাত অপরাধবোধ দূরীকরণ উদ্যোগে। উত্তরে কাজেম আলী তেমনটি অপরিবর্তিত আসন ও হাতে ভর দিয়ে বিনীত ও আস্থাবান কণ্ঠে বলে, ছার হাইল্যা-জাইল্যা মানু আমাগো আসন দিয়া বওনের অইভ্যাস নাই, আসন মাইর্যা বইলে পরে মেইদারা, পাছা, আডু, পায়ের নলা, খুঁড়া সবই আহ্মনার ব্যাতা হরে, জনাবের অনুমতি পাইলে পরে আত পা কয়হান ইটটু খুইল্যা বইতে পারি। আবসার হাসান নিজের আসনে একটু নড়ে ঝুঁকে হাত সামনের দিকে দিয়ে বলেন, দয়া করে আপনি হাত-পা খুলে আপনার সুবিধামতো বসুন, আমি কিছুই মনে করবো না। এমনকি আপনি আমার পাশেও বসতে পারেন, তিনি তাঁর ডান হাত সোফার ডানদিকে ছোট চাপড় দিয়ে দেখান যেন ওইখানে ইচ্ছা করলে কাজেম আলী বসতে পারে। কাজেম আলী নিজের গামছার উপরে থেকে দু’পায়ের পাতার উপরে বসে তার আনা দুটো পোঁটলার উপরেই হাত রাখে, যে-পোঁটলায় তার বসবার গামছা ছিল সেই পোটলার গিট খুলে হাতায় এবং আর একখানি গামছা বের করে, এবারের গামছাখানিও লাল তবে লালে লালে তফাৎ আছে, আগেরটি শিমূল-লাল সবুজ চেকের মধ্যে আর এবারেরটি হালকা হলুদ চেকের মধ্যে শক্ত পাকা খেজুরের রং ও আয়তনে বসবার গামছা-খানির তিন ভাগের একভাগ। কাজেম আলী পা খুলে বসে, যেমন পায়ের বুড়ো আঙ্গুল প্যাঁচ দিয়ে গরুর গলায় বা খুঁড়ায় বাঁধার জন্যে পাটের দড়ি পাকানো ভঙ্গিতে। কাজেম আলী ছোট গামছাখানি পায়ের পাতার উপরে ফ্যালে, আসলে দু’পায়ের পাতা ছোট ওই হলুদাভ লাল গামছা দিয়ে ঢেকে দেয়।
তার আগে গামছাখানি কাজেম আলী পায়ে বিছানোর সময়ে যেন একবার গন্ধ নেয়, লেখক আবসার হাসান তেমনটিই মনে করেন। তাঁর মনে করাকে নিশ্চিত করে দিয়ে কাজেম আলী লেখককে জানায় শিশুসন্তানের মতো আরকি, মায়ের কাপড় নাকের পাশে রেখে ঘুম পাড়িয়ে দেয়া, শিশু মায়ের কাপড় থেকে গন্ধ পেয়ে, মা মনে করে স্বস্তিতে নিরাপদ ভেবে ঘুমায়। কাজেম আলী এভাবে ভাঙ্গিয়ে না বললেও লেখক ইন্দ্রিয়শক্তিতে তা বুঝে নেয়। আবসার হাসান মনে করে কাজেম আলী হয়তো ভাবছে খোলা পায়ে লেখকের সামনে বসা বেয়াদবি হবে ভেবে হয়তো কাজেম আলী তার পা ঢেকে দেয়। কাজেম আলী লেখকের এ ভাবনা দূর করে দেয় এ কথা বলে, ছার মোরা অইলাম যাইয়া আইল্যা-জাইল্যা মানু, কাদা প্যাকে থাকতে থাকতে পাও দুইহান ঘা হইয়া যায়, দুর্গন্ধ ছড়ায়, আহ্মনের সঙ্গে দেহা হরতে আমু বুইল্যা তিন হপ্তা আগ থেইকা কাদা পানি ভাঙ্গা বন্ধ হইর্যা দিছি, পিরতিদিন তুইত মাইখ্যা রাখছি ঘা পঁচা যা আছে হেও য্যানো হুগাইয়া যায়। সেই কাদা পাঁক না ভাঙ্গা ও তুত মাখিয়ে পা শুকিয়েছে ও দুর্গন্ধমুক্ত হয়েছে সে-কথা কাজেম আলী লেখককে জানায়। আরো জানায়, তারপরও সাইব বইল্যা কতা, ওই লক্ষীছাড়া দুমড়াইন্যা-মছড়াইন্যা পাও দুইহান আহ্মনে দেখপেন ক্যা ?
আবসার হাসানের প্রত্যাশার বাইরে কাজেম আলী আরো খবর দেয় যে এই গামছাখানি আয়তনে ছোট কেন ? ছোট, কারণ এই গামছাখানি তার ‘পরিবার’ শ্যামেলা বিবি চুল ঝাড়ার কাজে ব্যবহার করে থাকে। কাজেম আলী তাই দূরে কোথাও গেলে স্ত্রীর গামছা সঙ্গে নিয়ে যায়, গামছায় চুলের গন্ধ স্ত্রীর উপস্থিতি কাজেম আলীকে সঙ্গ দেয়।
এ পর্যায়ে আবসার হাসান অনানুষ্ঠানিকভাবে তার লেখার রসদ যোগাড় শুরু করেন। তিনি তাঁর উপন্যাস লেখার জ্ঞান সমৃদ্ধ করতে থাকেন কেমন করে স্ত্রী এই গ্রামীণ মানুষটির কাছে ‘পরিবার’। কেমন করে স্ত্রীর ব্যবহৃত গামছা যা গোসল-এর চুল ঝাড়তে ব্যবহার করা হয়, যার গন্ধ নিয়ে কাজেম আলী স্ত্রীর সংস্পর্শ বা উপস্থিতি অনুভব করে। আবসার হাসান ইতোমধ্যে কাজেম আলীর প্রতি কৃতজ্ঞতার অনুভূতিতে পূর্ণ হতে শুরু করেন, কেননা স্ত্রীর চুল ঝাড়া ও গামছা বৃত্তান্ত তথ্যটি দিয়ে তাঁর পরবর্তী কোনো উপন্যাসে পাঠকদের চমকে দেবেন বলে ভেবেছেন। লেখক নিজের দিক থেকে আর কিছু জানতে চান না কাজেম আলীর কাছে তাতে আশঙ্কা থাকে স্বতঃস্ফূর্ততা ও সরলতা হারাবার যা সৎ উপাত্ত সংগ্রহের পরিপন্থী।
ধনী লেখকের বাড়ির নিয়মানুযায়ী কাজের লোক চা ও বিস্কুট নিয়ে আসে, কফি-টেবিলের উপর কাজের ছেলে দু’জনার চা ও বিস্কুট নামায়। আবসার হাসান নিজের বাসার এই রেওয়াজে অবাক হন না যে, কোনো অতিথি এলে আদেশ-নির্দেশের আগেই চা-কফি আসবে। কিন্তু অবাক হন অন্য কারণে, তিনি জানতেন না, যে কাপে কাজেম আলীর চা এসেছে সে রকম নিম্নমানের কাপ ও পিরিচ তাঁর বাসায় রয়েছে। একথা তাঁর কাছে অনবগত নয় যে, তিনি হাব-ভাব কি বেশভূষায় যাই হোন না কেন ভেতরে ‘শ্রেণীভিত্তিক’ লেখক, যদিও মূল পরিচিতি ওই ‘বাম ঘরানার বুদ্ধিজীবী গোত্রীয়’ হিসেবে, তাই বলে তার চর্চা যে এই পর্যায়ে তাঁরই পরিবারের ভেতরে হয়ে থাকে তা তিনি জানতেন না। তিনি আরো দেখলেন কাজের ছেলেটি কাপ-পিরিচ নামিয়ে ট্রে নিয়ে ফিরে যাওয়ার সময় হাতের কাপড় দিয়ে একটি জায়গা মুছে দিল যার পরিষ্কার অর্থ দাঁড়ালো কাজেম আলীর আগমনে কার্পেট বা এই বাসার ফ্লোর নোংরা হয়েছে যা এই বাসায় মানোপযোগী নয় বলে ধারণা দেয়া। আবসার হাসান এর সবই বোঝেন কিন্তু ঠিক এই মুহূর্তে কাজেম আলীর সামনে তিনি তার এ বিষয়ে যা যা বুঝতে পারছেন তা নিয়ে কথা বলবেননা, সেটা কাজেম আলীকে সম্মান দেখানোই কেবল। তিনি কাজের ছেলেটিকে বললেন এই মুহূর্তে এখান থেকে চলে যাও, আমি না ডাকলে আর তুমি আসছ না।
আবসার হাসানের খারাপ লাগছে কাজেম আলীকে খেতে বলতে, কারণ আপ্যায়নের উপস্থাপনের ভঙ্গীতে এরই মধ্যে কাজেম আলীর সামনে অস্বস্তি বোধ করছেন। অবশ্য একটি সান্ত্বনা রয়েছে, কাপপিরিচের যে বৈষম্য কাজেম আলীকে আপ্যায়নের ক্ষেত্রে উপস্থাপিত হয়েছে তা কাজেম আলী বুঝতে পারছে না লেখকের এই ধারণা, কারণ কাজেম আলী সেদিকে তাকায়নি পর্যন্ত, অতএব অন্য বৈষম্যের ব্যাপারে লেখক আবসার হাসান ভাবতেও পারেন না, যে-বিস্কুট বাসার কেউ খায় না এমনকি কাজের লোকেরাও যা ছোঁয় না তা আনা হয়েছে কাজেম আলীর জন্যে। আবসার হাসানের জন্যে ভাল সংবাদ হচ্ছে এর কোনো কিছুর প্রতি কাজেমের আগ্রহ আছে বলে তার মনে হয় না, সে কেবল লেখক আবসার হাসানের সঙ্গে কথা বলতে এসেছে, লেখকের সঙ্গে কথা বলতে আসার সঙ্গে পৃথিবীর অন্য কিছুর সম্পর্ক থাকতে পারে এমন ধারণা হয়তো তার নাই। কাজের ছেলেটি চা-বিস্কুট দিয়ে চলে যাওয়ার পর কাজেম আলী লেখককে বলে, ছার আহ্মনের সঙ্গে দ্যাহা হরনের বুদ্ধি করি মোরা গত সালে চৈত্তর মাসের শেষে, খুব গরম আছিল হেইদিন, টানা মেলা দিন গরমের পর সাদ্যের ঠাডা পইর্যা ঝড় বইন্যা অইল, দুনিয়াডা ইটটু ঠাণ্ডা, ঝরা আমের নুন কাচা মরিচে ভর্তা বানাইয়া খাইতে খাইতে স্কুলঘরের মইদ্যে এই কতা অয়, কতা উডায় পেরাইমারি বিদ্যালয়ের আইএসসি মাস্টোর আবুয়াল হোসেন। কাজেম আলীর এই লম্বা করে কথাটার মধ্যে দিয়ে লেখক আবসার হাসান জানতে পারে তার আগমন কেবল একক ব্যাপার নয়, এর মধ্যে রয়েছে আমরা, যা কোনো এক চৈত্রের পড়ন্ত দুপুরে কাল-বোশেখী সেই ঝড়ের পর কতিপয় মিলে এই সিদ্ধান্ত নেয় যে লেখকের সঙ্গে এই কাজেম আলী দেখা করতে আসবে। আবসার হাসান বুঝতে পারেন তার গল্প শুরু হয়ে গেছে যা তিনি শুনে যাবেন প্রায় কোনো প্রশ্ন ছাড়া; খুব জরুরি কোথাও কোনো প্রশ্ন করতেই হবে এমন মনে না করলে। আবসার হাসানকে জানানো হয় ঢাকা কীভাবে যাওয়া হবে, কীভাবে আসা হবে যাতায়াত ভাড়া বাবদ খরচাদি, লেখকের ঠিকানা যোগাড় ইত্যাদি সব বিষয়ে। পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজেম আলী লেখকের সঙ্গে দেখা করতে গেলে যথাসম্ভব পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন পোশাক-আশাক, আচার-আচরণসহ এমন জিনিস বাদ থাকে না যা হতে পারে বলে কাজেম আলীরা ভাবেনি। ‘পেরাইমারি’ স্কুলশিক্ষক আবুয়াল হোসেনের দূরে সম্পর্কের ‘বেয়াই লাগে’ এমন আত্মীয়ের ছেলে ঢাকার শহরে থাকে, তারই কাছে একটা বই পেয়ে সেই বইয়ে লেখকের ভূমিকা থেকে আবুয়াল হোসেন জানতে পারে কীভাবে লেখক ওই উপন্যাসের উপকরণ পেয়েছিল কোনো একজন অচেনা লোকের কাছ থেকে। অতএব আবুয়াল হোসেন ধারণা করে কাজেম আলীর কাছে যে একটি কাহিনী রয়েছে সেই কাহিনীর বয়ান আবসার হাসানের মতো কোনো লেখককে বলতে পারলে একখানা পুঁথি রচিত হতে পারে, যে-পুঁথিখানার মাধ্যমে কাজেম আলী, আবুয়াল হোসেনসহ অন্যান্যরা সন্তুষ্ট হতে পারে এই মর্মে যে, আর যা হোক তাদের মতে উল্লেখযোগ্য অথচ ঘটনার বাস্তবতায় আজ যা ছোট সেই সব ঘটনা অন্তত একখানা পুঁথির ভেতরে থাকবে। এসব এখন আবসার হাসানের জানা হয় এবং বোঝেন কিন্তু সিদ্ধান্ত নেন যে, নিজে আগ বাড়িয়ে কিছু জানতে চাইবেন না। তিনি মনে করেন, যে-উপন্যাসটির ভেতর থেকে তাকে এখন হাটতে হবে সেই মুখে-বর্ণিত উপন্যাসের লেখক এই কাজেম আলী, তা সে যে ভাবেই বলুক।
ঘটনা নাকি অনেক বছর আগের যার নির্ধারিত সন-তারিখ কাজেম আলীর পক্ষে বলা সম্ভব হয় না, স্মৃতিই নির্ধারিত সময় মনে না থাকবার প্রধান কারণ যদিও সঙ্গে, কাজেম আলী আবসার হাসানকে জানায়, মোরা অইলাম যাইয়া আলেহা পড়া আইল্যা-জাইল্যা, শোন-তারিকে মোরা চলি না, ওয়া বুজিও না। জোয়ার ভাডা, জোবা, চান্দের ক্ষয়, আর পূর্ণিমায় বুঝি দিন যায় আয়, এই রহম সব। তবে কাজেম আলী লেখক আবসার হাসানকে একেবারে সময় সম্পর্কে অন্ধকারে রাখে না, একটি ধারণা অন্তত দেয় তা হলো, বড় বইন্যার আগের কি পরের বচ্ছর। লেখক চোখের পাতায় লম্বা পলক ফেলে শান্তভাবে ঘাড়টা একটু দুলিয়ে কাজেম আলীকে যেন বলে সন-তারিখে কোনো অসুবিধা নাই, সে যা বলতে চায় তা বলে যেতে পারে।
কাজেম আলীদের গ্রামের নাম বউলাপুর, পাশের গ্রাম নোলকঝোর, নোলকঝোরের সুবিমল মিস্ত্রি ভারত চলে যাওয়ার পর তার কাজ ধরে নোভা শফি, কাজেম আলী ভাঙ্গিয়ে বলে নোভা শফির অর্থ কী, শফি লোভা প্রকৃতির লোক, খাবার দেখলে হিতাহিত জ্ঞান থাকে না, ছোট বাচ্চারা লোভা বলতে পারত না তারা বলত নোভা, সেইভাবে সে হয় নোভা শফি। কিন্তু সেইসব সময় বলতে কোন সময় তার কেনো ধারণা কাজেম আলী লেখককে দিতে পারে না, কেবল বহুত আগিলা কাল, বহুত পুরানা দিনসব, এমন ভাবে বলে। তয় হেই নোভা শফি সুবিমল মিসতিরির কাম ধরলে তহন থেইকা হেয়ার নাম নোভা শফি গোনে শফি মিসতিরি অয়। হেই শফি মিসতিরির যে পোয়া অইল হেই পোয়ার নাম অইল যাইয়া রহম, রহম আলী। রহম আলী বাপের মিসতিরিগিরি না হইর্যা হে হইল যাইয়া আহ্মনার ভাসার আডের ছাতি হারানি মিসতিরি। কাজেম আলী ব্যাখ্যা করে, মিসতিরিগিরিডা ঠিক থাকলে, খালি কামের ধরন বদল অইল, ঘর মিসতিরিগিরি থুইয়া ছাতির মিসতিরি ধরলে। আবসার হাসান তখন কাজেম আলীর মাধমে জানেন যে রহম মিস্ত্রি তার বাবা শফি মিস্ত্রিকে বলে যে, ঘরের কামের কোনো ঠিক থাহে না, বচ্ছরে একটা কি দুইডা, হেরও কোনো সোময় ঠিক নাই, হের চাইতে ছাতির কামে আডে আডে কিছু অন্তত আইবে, এই ভাবে এবং এই কারণে রহম মিস্ত্রি ছাতির মিস্ত্রিতে পরিণত হয়। এরপরে লেখক আবসার হাসান কাজেম আলীর মাধ্যমে জানতে পারেন রহম মিস্ত্রির বাবা নোভা শফি কি শফি মিস্ত্রি গল্পে একেবারে প্রেয়াজনহীন কেননা হঠাৎ করে কাজেম আলী এবারে ওই রহম মিস্ত্রির ছেলের প্রসঙ্গ আনে যার নাম বলা হয় খবির মেয়া। কাজেম আলী খবির মিয়ার নাম তার কাহিনীতে যোগ দিয়েই সেইভাবে বইন্যার আগের বছর পরের বছর প্রসঙ্গটি আর একবার তোলে যাতে আবসার হাসানের মনে হয় তার কাহিনীতে শফি মিস্ত্রির উপস্থিতি অত জরুরি নয় যত না এখন সময় উল্লেখের কারণে রহম আলী মিস্ত্রি কিংবা খবির মিয়ার উপস্থিতি সঙ্গত।
তাদের কতাবার্তা চলাকালে কাজের ছেলে ঢুকে পড়ে আবসার হাসানকে জানায় ক্যানাডা থেকে ফোন এসেছে। আবসার হাসান কাজের ছেলেটিকে বলেন আমি একটি কাজে আছি, জরুরি কাজ এবং এমন কাজের সময় আমার বাসায়ই থাকবার কথা নয়, কাজটি বাসার বাইরে ঘটবার কথা, অর্থাৎ লেখক কাজের ছেলেটিকে বলে দিলেন অন্য আর কোনো ফোন এলে যেন তাকে জানানো না হয়। তিনি এই ধরনের কাজের সময় তাত্ত্বিকভাবে বাইরে তা ফোন করা ব্যক্তি সে কবি বা গল্পকার কি ঊপন্যাসিক হোক না, সে ক্যানাডা হোক কি আমেরিকা প্রবাসী হোক কি চন্দ্রপ্রবাসী, আবসার হাসান কারো ফোন ধরবেন না, তিনি কেবল কাজেম আলীর সঙ্গে কথা বলবেন, নোভা শফি থেকে রহম মিস্ত্রি হয়ে খবির মিয়ার অনির্ণীত সময়ে বিচরণ করবেন। কাজের ছেলেটি লিভিং রুম থেকে চলে যাওয়ার আগেই কাজেম আলী লেখক আবসার হাসানকে বলে, ছার জল-পিপাসা পাইছে, পানি এটটু। কাজেম আলীর মতো লোকের মুখে জল-পিপাসা পেয়েছে শুনে আবসার হাসান সম্ভবত ভেতরে খাণিকটা হোঁচট খান, শুধু ভেতরে কেন হয়তো বাইরেও, তা না হলে কাজেম আলী নিজের দিক থেকে শোধরাবেন কেন- ওই পাশের গেরাম নোলকঝোর, হেইহানে কয়ঘর ইন্দু পরিবার আল্হে, ছোট্ট সোময় হ্যাগোর সব বাড়তে গেলে মোরা ওইরম হইর্যা কইতাম, এটটু ‘জল-পানি’, হেরাও ওইরম কইত মোগর সব বাড়তে। আবসার হাসান কাজেম আলীর এই ব্যাখ্যায় কিছুই বলেন না অথবা বলেন, ঠিক আছে ঠিক আছে ও কিছু নয়, অথবা কিছু, এর কিছু নিশ্চিত হওয়া যায় না। তবে তাঁর অগোচরে একটি দীর্ঘশ্বাস পড়ে, যদিও সেই দীর্ঘশ্বাস নাসারন্ধ্র থেকে নিঃসরিত হওয়ার পর তাঁর কাঁচাপাকা ‘পুরুষালি’ প্রতীকের গোঁফের উপর দিয়ে গড়িয়ে পঞ্জের মত কোঁচকানো কি অমসৃণ তেলতেলে বিশেষ গোত্রীয় জোঁকের দেহের মতো ঠোঁট গড়িয়ে চিবুকে মিইয়ে যায়, সেখান থেকে গড়িয়ে বুকের উপরে শার্টে পড়বার আগেই। তিনি মনে করতে পারেন না কাজেম আলী যে-কথাটি অর্থাৎ জল-পানি যে বলল সেই রকম একটা কথা তিনি কবে বলেছেন বা আদৌ বলেছেন কিনা কোনদিন, নাকি লেখকের কমিটমেন্ট ‘উদারতা’ও কমিটেড হয়ে পড়ে। কত কিছু করা উচিত-অনুচিতের কর্তব্যের কারণে বলা হয়নি কখনো, কোথাও, কাউকে কোনো সময়ে, না সজ্ঞানে, না ভুলে। আবসার হাসান কাজের ছেলেটিকে পানি দিয়ে যেতে বলেন, তিনি জানেন কাজের ছেলেটি কাজেম আলী উপযোগী করে পানি নিয়ে আসবে যা তাঁর দেখতে ভাল লাগছে না। তাই নিজের জন্যেই পানি দরকার এমন করে কাজের ছেলেটিকে পানি আনতে বললেন। কাজের ছেলেটি পানি আনতে গেলে কাজেম আলী প্রথম পোঁটলার ভেতরে কী জানি খুঁজতে থাকে, আবসার হাসান কোনো আগ্রহ দেখান না বাড়তি। তিনি শুধু দেখে যেতে থাকেন যে কাজেম আলী অপর আর একটি পোঁটলা থেকে একটি গ্লাস বের করে, ছোট পেতলের গ্লাস, পরিষ্কার ঝকঝক করছে। লেখক বুঝে ফেলেন তাঁর বাড়ির গ্লাসে কাজেম আলী জল বা পানি খাবে না। নিজের হাতের গ্লাসের দিকে তাকিয়ে আবসার হাসানের উদ্দেশে কাজেম আলী বলে, ছার দানা ছাই দিয়া পরিবার মাইজ্যা পরিষ্কার হইর্যা দেচে, কতা অইল বড় লোহের বাড়ির গেলাস-পাতি আমাগোর মতো মাইনষের বেবহার কইর্যা নষ্ট হরা উচিৎ কিনা, হেইর লইগ্যা পরিবার ও অইন্যাইন্যরা গেলাসের কতা কইল, গেলাসটার আবার ইতিহাস আছে, ওই নোলকঝোড়ে সুবিমল মিস্ত্রি যাওয়ার আগে মোর বাফরে দিয়া গ্যাছে। আবসার হাসানকেই পানি তার পেতলের গ্লাসে ঢেলে দিতে বলেন, আবসার হাসান তাই করেন, কেনোনা তিনি বোঝেন কাজেম আলীর ভাষায় বড় লোকের বাড়ির জিনিসপত্র ধরে তার হাতের কারণে যেন নোংরা হয়ে না যায়। পানি পানে এত তৃপ্তি মানুষ পেতে পারে এমন ধারণা যেন আবসার হাসানের প্রথম হলো। কাজেম আলী আবার শুরু করে সেই বড় বন্যার আগের বছর নাকি পরের বছর যার ঠিক কিছু নাই এবং রহম মিস্ত্রির ছেলে খবির মেয়া। হাটে ছাতি সারানোর রহম মিস্ত্রির ছেলে খবির মিয়ার নাম বলার পর অনেক কথাই হয়তো তার বলবার থাকে, কিন্তু শব্দসীমিতের কারণে কি বর্ণনার দুর্বলতার কারণে সেভাবে না হলেও কাজেম আলী বলে, সেই মোগোর সব গেরামের খবির মেয়া, সোনার চান্দ, চাইন্দের টুকরা, গোবরের পইদ্দ এই কতা লোকে কইত কিন্তুক মুই গোবর চিনি পইদ্দ চিনি না, হেইর লইগ্যা নিশ্চিন্ত কইতে পারমু না গোবরে পইদ্দ কি জিনিস। আবসার হাসান কাজেম আলীর কথা শুনে আরো বোঝেন যে অমন ছেলে দুই চার দশ বিশ গ্রামে কি থানায় কি জেলাতেও হয় না। কিন্তু তাদের পাশের নোলকঝোর গ্রামে সেই রকম সন্তান হয়। আবসার হাসান কাজেম আলীর গল্পের আর কোনো ধারণা পান না, কেবল খবির মেয়া নামক লোকটি মেধাবী বলে তার কাছে মনে হয়। তবে আবসার হাসানের এ ধারণা হয় যে, খবির মিয়া নামক লোকটি নিশ্চয়ই মারা গেছে তা না হলে এটি কেন গল্পের উপকরণ হবে বলে কাজেম আলী কি আবুয়াল হোসেনরা ধারণা করতো না ?
--বোঝেন সাইব হেই খবির মিয়ার স্ত্রীর সোন্তান হইবে, এইডা কি খেলা কতা ? আবসার হাসান এ পর্যায়ে বুঝে ফেলেন যে কাজেম আলীর বলা গল্পে হয়তো তেমন জোর নাই, যেমন প্রতিটি মানুষই মনে করে তার কাছে সবার সেরা গল্পটি রয়েছে, কেবল দরকার একজন লেখকের যিনি গুছিয়েগাছিয়ে এমন ভাবে লিখবেন যে রাজ্যের লোকজন সেই কাহিনী লয়ে হাসবেন ও কাঁদবেন, কাঁদবেন ও হাসবেন। আবসার হাসানের আগ্রহে টান পড়লেও তিনি কাজেম আলীকে তা বুঝতে দেন না। কাজেম আলী বলে যেতে থাকে, খবির মেয়া ঢাহায় থাহে, মোস্ত বড় চারহি হরে। কিন্তু স্ত্রী ‘সোন্তান সোম্বাবা’ বলে রহম মিস্ত্রি ও তার স্ত্রী ঢাকায় আসতে চায়, কিন্তু খবির মেয়া চাকরি রেখে যেতে পারে না, কিন্তু বাবা মাকে খবর পাঠায় বৈশাখে তার স্ত্রীর সন্তান হবে, তারা যেন ঢাকায় চলে আসে। এখন তারা ঢাকায় কীভাবে আসবে এর আগে তো কোনোদিন ঢাকা আসেনি। বন্যার বছর পৌষ মাসের ধানের মৌসুম শেষে কোনো কাজ করা যায় কিনা এই মনোভাব নিয়ে কাজেম আলী একবার ঢাকায় এসেছিল। দেশী দু’একজনের মাধ্যমে তার কাজ জোটে খিলগাঁও বাজারে তরিতরকারি বিক্রেতাদের ফুটফরমায়েশ খাটা, তখন তার বয়স কম, অনেক পুরানা কথা। কিন্তু বেশি দিন কাজেমের ওই কাজ ভাল লাগে না, সে আবার গ্রামের দেশে চলে যায়। হয়তো তারই কিছুদিন পর খবির মেয়ার স্ত্রীর সন্তান সম্ভাবনার কথা থাকলেও খবির মিয়ার বাবা-মার ঢাকায় আসার দরকার পড়লে পাশের গ্রামের খবির মিয়ার খোঁজ পড়ে, যদি সে খবির মিয়ার বাবা-মা রহম মিস্ত্রি ও তার স্ত্রীকে ঢাকা নিয়ে আসতে পারে কারণ তখনকার দিনে কাজেম আলীদের সব গ্রাম থেকে কোনো মানুষজন ঢাকার শহরে আসে না বা ঢাকার শহর চেনে না কেবল কাজেম আলী বাদে, কাজেম আলী রাজি হয় কেননা খরচপাতি যাওয়া-আসা খাওয়া দাওয়া বাবদ সব খরচাদি ওই রহম মিস্ত্রির।
বন্যার আগের কি পরের বছর তাতে অবশ্য কিছু যায় আসে বলে মনে হয় না লেখক আবসার হাসানের। কেননা কাজেম আলী এমন কিছুই বলছেন না যাতে সন তারিখের আদৌ কোনো দরকার আছে। তারপরও কেন যেন কাজেম আলী সন-তারিখের সঙ্গে এক যোগ স্থাপনের চেষ্টা করে যায়। আবসার হাসান কাজেম আলীর কোনো কিছুতেই আপত্তি করে না। তিনি লেখক, অন্যের গল্প শুনতে তাঁর কোনো আপত্তি নাই, অতএব তাঁকে কাজেম আলীর বর্ণনা শুনতে হয় কীভাবে এবং কেন মনে করে সেটা অর্থাৎ যে সময়ের কথা বলতে চায় তা বছরের কোন সময়। চৈত্র মাস হবে, ভীষণ গরমের রাত, পরের দিন ঢাকা যাবে বলে তেমন ঘুম হয় নি। সকালে উঠে পাতি গাব খাওয়ার লোভ সামলাতে পারে না। সে যখন লুঙ্গি কাছা দিয়ে গাব গাছে উঠছিল তখনও গাব গাছে বসে থাকা কোকিল শেষ ডাকটি দিয়ে উড়ে গিয়েছিল, এর সব কিছুই তার মনে থাকত না বলে কাজেম আলী লেখককে জানায়, যদি-না তাড়াহুড়ায় সে একাধিক গাবের বিচি গিলে ফেলতো। গাবের বিচি গিলে ফেলা যে কোনো ঘটনা নয় বা ঘটনা হতো না যদি-না ওই গাবের বিচি তার পেট শক্ত করে ফেলত এবং ঢাকায় খিলগাঁওয়ে দেখা করতে যাওয়া মেসের পায়খানায় ওই গাবের বিচি হেগে না দিত। কাজেম আলী তাই লেখককে যুক্তি দিয়ে বোঝাবার চেষ্টা করে যে সেটাই ভাগ্য যে সেদিন সে ঢাকা যাওয়ার আগে খুব সকালে তাড়াহুড়া করে অতগুলো গাবের বিচি না খেলে ঢাকায় গিয়ে পেট শক্তও হতো না কষ্টও হতো না এবং খবির মিয়ার ঘটনার সময়টাও ধরিয়ে দিতে পারত না। লেখক আবসার হাসান কাজেম আলীর কথায় এমন ভাব করেন যেন সে খুবই ঠিক কথা বলেছে। বন্যা এবং কোকিল ও পাতি গাব পাকানোর সময় চিহ্নিত হলেও এই গল্পের কোনো ভাবগতিক ঠাওর করতে পারে না লেখক আবসার হাসান।
বরগুনার লাইনের লঞ্চে করে সারাদিন লাগে তাদের বরিশাল আসতে। বরিশাল থেকে আর একটা বড় লঞ্চে তারা ঢাকায় রওনা দেয়, দু’দিনের খাবারদাবার সঙ্গে নিয়ে আসে গ্রাম থেকে অর্থাৎ যতক্ষণ-না পর্যন্ত তারা ঢাকায় রহম মিস্ত্রির ছেলের বাসায় আসবে, তার আগে তাদের খাবারদাবারের ব্যবস্থা আছে। এই দীর্ঘ ভ্রমণের সময়ে নাকি রহম মিস্ত্রি ও তার স্ত্রী রাজ্যের সব কথা বলে কাজেম আলীর সঙ্গে। হেয়া কত্তা দরনের কতা সাইব, আর কমু কি, আবসার হাসান বোঝেন অর্থাৎ রহম মিস্ত্রি যত ধরনের কথা সে সময়ে কাজেম আলীকে বলেছে তার কিছু অংশ হলেও আবসার হাসানকে এখন শুনতে হবে।
এই পোলা তো আমার ঘরে জন্মানোর কতা না, ভাগ্যের কারবার, এমনভাবে বলেছে রহম মিস্ত্রি সেই লঞ্চভ্রমণের সময় কাজেম আলীকে। ছেলেসন্তান হলে ছাতি মিস্ত্রির যতসব কল্পনা থাকবার কথা তা তার ছিল কিন্তু সব উল্টাপাল্টা হয়ে যায় যখন আবিষ্কার করে তাদের ছেলে খবির মেয়া পড়াশুনায় ভাল, তুখ্খার ছাত্তর। রহম মিস্ত্রির স্ত্রী কদম বিবি সে সময় কাঁদে আনন্দ ও দুঃখে যে, ছেলে তার লেখাপড়া করে বড় হয়েছে, আবার ছেলেকে মা হিসেবে কোনোদিনই কাছে পায় নাই, ওই তার লেখা-পড়া করবার জন্যে। রহম মিস্ত্রি সুখ-দুঃখের অনেক কথার মধ্যে এ কথাও বলে যে সকলের মতো তারও আশা ছিল ছেলেকে দেখেশুনে বিয়া করাবে, কিন্তু তাদের সব গাঁওগেরামে ওই ছেলের উপযুক্ত কইন্যা কোথায়। ছেলে তার পছন্দ মতো বিয়ে করে, বউ অইলো যাইয়া সোনার নাহান টুকরা। কিন্তু তাতে কি তারা তো আর কাছে পায় না। খবির মিয়ার চাকরি হওয়ার পরে বাবাকে বলেছে ছাতি সারানোর কাজে যত টাকা আসে তার চেয়ে বেশি টাকা সে বাবাকে দেবে, তাতে যদি বাবা তার ছাতি সারানোর কাজ ছেড়ে দেয়। রহম মিস্ত্রি কথা বলবার সময় সেদিনের তরুণ কাজেম মিস্ত্রির ডানায় হালকা চাপ দেয়, মুচকি হাসে, বলে, এইডা হের ইজ্জতের ব্যাপার, অমুকের বাবা হাট-বন্দরে ছাতি মিস্ত্রির কাম করে। তবে ছেলে বলেছে চাইলে সে ছাতি সারানোর কাজ করতে পারে যদি একান্তই তার মন চায়। অতএব ছাতি মিস্ত্রি ছাতি সারানোর কাজ বন্ধ করে দেয়, কিন্তু ছাপড়া দেয়া জায়গাটা হাট কমিটির কাছ থেকে বায়না করে রাখে যদি সত্যই তার মনে হয় যে ছাতি সারানোর কাজ আবার তার করতে হবে, এই ধরনের কত সব কথা হয় তার শেষ নাই, এমনভাবে কাজেম আলী লেখক আবসার হাসানকে জানায়। কাজেম আলী অভ্যাসবশত তার হাত দিয়ে কপালের ঘাম মোছবার চেষ্টা করে যদিও তার ঘামায় না, তার কাছে এটা তাজ্জব ব্যাপার মনে হয় এবং একবার ঘামহীন কপালে হাত দিয়ে মুছে লেখককে বলে, ছার সাইবদের বাসা বাড়ির কারবারই অইল যাইয়া অন্য রহম, ভাদ্দর আশ্বিনের গরমেও কেমন ঠাণ্ডা, যেন পুহুইর পারের ঘন ক্যালার ঝাড়ের নিচে, হেও এত ঠাণ্ডা না। লেখক আবসার হাসান তাকে বলেন না যে তাঁর বাড়িতে ঠাণ্ডার কারণ কী, বলেন না কারণ তাঁর মনে হয় তাতে হয়তো গল্পের স্রোত পরিবর্তন হয়ে যাবে। অতএব এ প্রসঙ্গে আবসার হাসানের কোনো কিছু না বলায় কাজেম আলীর সেই অভিমতই থেকে যায় যে সাহেবদের বাড়িঘরে অন্যরকম ব্যাপার, গরমের মধ্যেও ঠাণ্ডা। আবসার হাসান এ সময় বোধ করেন দুপুর হয়ে গেছে, কিছু খাওয়া দরকার। তাই এক ফাঁকে কাজেম আলীকে বলেন, ভাই সাহেব আমাদের তো কিছু খাওয়া দরকার, দুপুর হয়ে গেছে। এর উত্তরে কাজেম আলী বলে, ও মেলাক্ষণ কতা কইলাম, টেরই পাই নাই। তাছাড়া হুরুজ দেহন যায় না এহান দিয়া বুঝমু কেম্মে এহন কী বেলা। এ পর্যায়ে অবশ্য আবসার হাসানের নূতন সমস্যার কথা ভাবতে হয়। এ কথা সত্য গ্রামীণ এই কাজেম আলীকে নিয়ে তাঁর ক’লাখ টাকা দামের ডাইনিং টেবিলে বসে খেতে আপত্তি নাই, কিন্তু তাঁর পরিবার, তারা কি প্রস্তুত এর জন্যে এমনকি দেখতে এই দৃশ্য, কাজের লোকগুলোও তো আপত্তি করবে, মুখে না হোক অন্তরে। যে মানুষটির বর্ণিত কাহিনীর উপর তিনি হয়তো যে সফল উপন্যাসটি রচনা করবেন, যে-উপন্যাসটি আবার তাঁকে দিতে পারে কত লাখ টাকা এবং অগণিত আরো, তা অনাগত সময়ের জন্যে অথচ সেই মানুষটিকেই সঙ্গে করে এক বেলা খাবার খাওয়া যাবে না। এক বেলা মাত্র, অথচ কী অদ্ভুত ‘লেখক স্বাধীনতায়’ কখনো তার কাগজ কি কলম, কোনো কিছুতে বাধ সাধে না। আবসার হাসান কাজেম আলীকে বলেন, একটু ভেতর থেকে আসি তিনি ভেতরে যান। স্ত্রী ফোনে কথা বলছিলেন, সিঙ্গাপুর, হোটেল, শপিং মল এ সব শব্দ তিনি শোনেন, ফোন হাতে রেখে স্ত্রী জানতে চান লোকটি কে ? তুমি তো সকাল থেকে কিছু খাওনি, এক সঙ্গে দুপুরের খাবারটিই খেয়ে নাও। স্ত্রীর সামনে লেখক এমনভাবে দাঁড়িয়ে থাকেন যেন গ্লাডিয়েটর যুগের দাস, কিছু বলতে চান বলতে পারেন না। স্ত্রী জিজ্ঞেস করেন বিশেষ কিছু বলবে ? লেখক এক পা আগান দু’হাত জড়ো করেন তাঁর নাভি সমান্তরাল, জড়ো হাত উপরে উঠে আসে বুকের কাছে, বুকের নিচে, বলেন, লোকটি বরিশালেরও একশ মাইল দক্ষিণ থেকে এসেছে। স্ত্রী বলেন তাঁর হাতের ফোন একবার কানের কাছে নিয়ে আবার ফিরিয়ে এনে, ‘তো’। লেখক তো ধ্বনির বিশ্লেষণাত্মক মর্মার্থ বোঝেন না তা নয়, তারপরও জড়ো হাত আবার নিচে নাভি সমান্তরাল এনে বলেন, দুপুরের খাবার। লেখক স্ত্রী ফোন আবার কানের কাছে নিয়ে বলেন, শোন্ পরে ফোন করবো। তিনি ফোন থেকে ফ্রি হলেন, কারণ কোনো রকমে ঝামেলামুক্ত এবারে স্বামী লেখকের সঙ্গে কথা বলবেন। লেখক জানেন আগ্রাসী মনোভাবাপন্ন প্রতিবেশীর সঙ্গে বসবাসের কৌশল, তিনি দু’বার বলেন, ঠিক আছে, ঠিক আছে। যদিও এই ‘ঠিক আছে’র ভেতর অঘোষিত যুদ্ধের শুরুতেই পরাজয় মেনে নেয়া। কিন্তু লেখক যখন বললেন, মনে হলো অতি স্বাচ্ছন্দে তিনি পরাজয়ের কথা বললেন। স্ত্রী কিছু বলবার আগে তিনি ‘ঠিক আছে’ বলে বেডরুমের বাথরুমে যেতে থাকলেন। নিয়ম ভাঙ্গলেন, বাথরুমের দরজা লাগালেন না, আধা খোলাই থাকল। কমোডে বসে তিনি পেশাব করেন কিন্তু সিদ্ধান্ত নিলেন পুরো পাজামা খুলে তিনি কমোডে বসে পেশাব করবেন না বরং যিপার খুলে দাঁড়িয়ে পেশাব করবেন, তিনি তাই করতে গেলেন কিন্তু টের পেলেন অনেক্ষণ পেশাব করেননি, অধিক চাপে পেশাব আসতে সময় নিল। তখনই তার মনে হলো যে একইভাবে কাজেম আলীর পেশাব পাওয়ার কথা অথচ কাজেম আলী সে কথা বলেনি এখনো পর্যন্ত, খারাপ লাগে ভেবে সমাধান খুঁজতে যে কাজেম আলীর মতো লোকের পেশাব বা পায়খানা করবার সেই ব্যবস্থা এ বাড়িতে আছে কিনা, পেশাবের অধিক চাপে লেখকের চোখে পানি এলো।
বাংলা সাহিত্যের জনপ্রিয় লেখক পাজামা কোমর থেকে নামিয়ে অঙ্গ কমোডের দিকে শ্যুটার নিয়মে টার্গেট করে ঝড়ঝড় শব্দে সীমিত জলে ফ্যানা তুলে হলুদাভ জলোচ্ছ্বাস তৈরি করলেন, তাতে যোগ হতে চাইল আরো ক’ফোঁটা জল, চোখ থেকে যার উৎস, অধিক পেশাবের চাপ ও অতঃপর একটি অজ্ঞাত কান্নার অনুভূতি। ভাবলেন বা মনে পড়লো লস এঞ্জেলেসের হলিউড ইউনিভার্সাল স্টুডিওতে যেমন করে ছোট পুকুরখানিতে কেমন কৃত্রিম ঢেউ তুলে টাইটানিকের মতো জাহাজ ডুবিয়ে ফেলা হয়। তখনই তার মনে হলো তিনি তার কোন এক উপন্যাসের নাম রাখবেন ‘কমোডে ঝড়’।
এই ঝড় থেমে যায় যখন কিনা স্ত্রী ছোট চিৎকার করে বলেন, তোমার কি মাথা খারাপ হয়েছে দাঁড়িয়ে পেশাব করছ ? লেখক আবার বেরিয়ে তার লিভিং রুমে চলে যান, কাজেম আলীকে বলেন কিছু মনে নেবেন না দেরি হয়ে গেল একটু পেশাবের বেগ পেয়েছিল, আপনার পেশাব পেলে বলেন। তখনো একহাত পোটলার ভেতরে কাজেম আলীর, পোঁটলা থেকে কী যেন বের করতে করতে বলল, না ছার আমাগোর মতন লোকের সাইবদের বাড়িতে গু-মোতনের মতন কাম হরন ভাল না, হুরুজ উদয় অস্তাব্দি একদিন না হরলে কিচু অইবে নানে। ঢাকায় আওনের আগে এই ব্যাপারে এটটু টেরনিং দিছি যাতে ওই কতা ‘সাইবদের বাড়ি’। লেখক অবাক হন লোকটির জ্ঞান দেখে। কাপড়ের পোঁটলার ভেতর থেকে নতুন ছোট পোঁটলা সে বের করে। আবসার হাসান দেখতে থাকেন এ পোঁটলা থেকে কী বের হচ্ছে, কাগজে মোড়ানো দুটো পোঁটলা একটা আয়তনে অপরটির চেয়ে ছোট। কাজেম আলী প্রথমে বড় পোঁটলা খোলে, আবসার হাসান দেখতে থাকেন তার ভেতর থেকে চারটে আটার রুটি বের হয়। তখন অবশ্য লেখকের বুঝতে বাকি থাকে না যে অপর পোঁটলায় এমন কিছু যা দিয়ে সে তার ওই রুটি খাবে।
আবসার হাসান তাঁর আসনে ফিরে আগের মতো বসেন। ছার পরিবার আডার রুটি বানাইয়া দেছে সব ব্যালার জইন্যে, আলেদা আলেদা পোটলা বানাইয়া, লগে মিডা দিয়া দেছে, খাজুরের মিডা, রওয়া পড়া চিনির লাহান দানা, ঝোলা মিডা না, নিজের গাছের, নিজেই গাছ কাটছি নিজেই রশ লইছি, শ্যামেলা বিবি জাল দিয়া হেইয়ার মিডা বানাইছে। আবসার হাসান জানেন এ প্রসঙ্গে কাজেম আলী কী বলবে, যে সাইবদের বাড়িতে তার মতো হাইল্যা-জাইল্যার খাওয়া উচিত নয়, তাই স্ত্রী তার জন্যে রুটি বানিয়ে দিয়েছে। এবারে লেখক আবসার হাসানের সত্যি কেঁদে ফেলতে ইচ্ছে করছে একটি মানুষের এমন সব অদ্ভুত ব্যক্তিত্ব ও বুদ্ধিমত্তা দেখে। ঠিক সেই মুহূর্তে কাজেম আলী বলে, ছার কইতে অয় তাই কই, খায়েন আমার লগে ঝোলা মিডা আর রুডি, কিন্তু আহ্মনেদের মতো বড় লোকরার এই সব জিনিস না খাওয়াই ভাল। এ সময় আর একটি অবাক কাণ্ড ঘটে তা হলো লেখক-স্ত্রী নিজে একটি ট্রেতে কিছু খাবার নিয়ে আসেন কাজেম আলীর জন্যে। তাঁর উদ্দেশ্য খাবার খেয়ে হয়তো লোকটি চলে যাবে। কিন্তু তিনি যখন দেখলেন কাজেম আলী নামক লোকটি আটার রুটি ও গুড় খাচ্ছে আর তার স্বামী তাকিয়ে থেকে তা দেখছে, তখন স্ত্রী অবাক হলেন, স্বামীকে বললেন, সেকি আমি তো ওনার জন্যে খাবার নিয়ে এসেছি। লেখক স্বামী তখন বললেন, তোমার খাবারের অপেক্ষায় সারা পৃথিবী থেমে থাকে না তা এভাবে চোখের সামনে না দেখলে বোঝার উপায় থাকবে না। শুধু রাগ ও আশ্চর্য হওয়ার দৃষ্টি নিয়ে স্ত্রী স্বামীর দিকে তাকায়। হয়তো সে তাকানোয় প্রশ্ন ছিল কেননা লেখক তখন বলেন, জানিনা তবে মনে হয় উনি বলবেন যে, ওদের মতো হাইল্যা-জাইল্যা লোকদের সাহেবদের বাড়িতে খেতে নেই। স্ত্রী কিছু বলেন না, কারণ তাঁর ধারণা হয় স্বামী নিজেও অজানা রাগের শিকার, তবুও স্বামীর পাশে বসেন। স্বামী টেবিলের উপরে রাখা কাজেম আলীর জন্য আনা খাবার থেকে খেতে শুরু করেন, তিনি জেনেই এ কাজ শুরু করেন, ফলে স্ত্রী অধীর প্রশ্নবোধক ও অর্থবহ চোখে স্বামীর চোখের দিকে তাকালে স্বামী তার উত্তরে স্ত্রীকে এমন ভাব দিলেন যে, তিনি জানেন এ খাবারগুলো পুরোনো, পতিত যা কাজেম আলীর জন্যে আনা হয়েছে এবং যা কোনো ক্রমেই স্বামী আবসার হাসানের খাওয়া উচিত নয়। অতএব স্ত্রীও জেনে যান তাঁর স্বামী ইচ্ছে করে ওই খাবার খাচ্ছেন। এ রকম সময় স্ত্রীও অভিজ্ঞ হন যে কীভাবে কাজেম আলী নামক লোকটি ট্রেতে রাখা পানির গেলাস থেকে তার পেতলের গ্লাসে ঢেলে তার পরে পানি খাচ্ছে। স্বামী জানেন স্ত্রী এ দৃশ্য দেখে অবাক হচ্ছে, তাই তাঁর উদ্দেশ্যে স্বামী বলে, সাহেবদের গ্লাস নষ্ট হতে পারে বলে তার নিজস্ব গ্লাসে খাচ্ছে, যদিও এই গ্লাস নষ্ট হওয়ার কিছু নাই। শেষের অংশটা স্ত্রীকে লেখকের বলার কারণ তিনি জানেন যে, কাজেম আলীর জন্যে যে-গ্লাস আনা হয়েছে তাও পতিত ও নিম্নবর্গীয় মানুষের জন্যে। স্ত্রী বোধহয় আর সহ্য করতে পারেন না, তিনি উঠে চলে যান। কাজেম আলীর আটার রুটি খাওয়া শেষ হয়, শেষ হয় লেখকেরও যা তিনি খাচ্ছিলেন সেই ট্রে থেকে। এরপর কাজেম আলী আবার শুরু করে, কত যে জিনিসপত্র রহম মিস্ত্রি ও তার স্ত্রী কদমবিবি সঙ্গে নিয়ে নেয় ঢাকায় ছেলের জন্যে। রস, রসের পিঠা, গুড়, নারকেল, তেল, আমের আচার, চিকন চাল, হেন কিছু নাই যা লওয়া হয় নাই। এমনকি নাতিনরে মাথায় রাইখ্যা তাবিজ তুমার মাদলি ও ত্যানা খাতা, হের কোনো হিসাব নাই, বেহিসাব। লেখক আবসার হাসান এ কথা বুঝবার চেষ্টা করে যে, কত আবেগ সেই সব জিনিসপত্রের মধ্যে যা রহম মিস্ত্রি তার ছেলে, ছেলে-বউ ও সম্ভাব্য নাতি বা নাতনির জন্যে ঢাকা নিয়ে আসছেন।
কাজেম আলী আর একবার পানি খায়, পেতলের গ্লাসের দিকে তাকিয়ে দ্যাখে যেন এর আগে আর কখনো এমন গ্লাস সে দেখেনি যা অথচ নিজেরই। তুত দেয়া বেগুনি রংয়ের পা থেকে ছোট গামছাখানা টেনে তুলে কপাল ও ঘাড়ের ঘাম মোছে। যদিও যে-ঘরটিতে সে বসে আছে এয়ার কন্ডিশনার চলছে বলে সেখানে কোনো গরম নাই । সে বিষয়টা কাজেম আলীর বোঝার কথা না, শুধু এক ফাঁকে বলে, বাইরের গরমডা আহমনাগো ঘরের মইদ্যে হানতে পারে নায়।
আবসার হাসান অপেক্ষা করতে থাকে কাজেম আলী কখন তার গল্পের অবস্থান লঞ্চ থেকে ঢাকায় নিয়ে আসবে। তার এই অপেক্ষার পর-পরই কাজেম আলী যে কথাটি বলে, তা হলো তারা দু’খানা রিকশা নিয়ে অনেক ‘মাল-সামানা’ সহ সদরঘাট থেকে খবির মিয়ার বাসায় আসে। খবির মিয়ার বাসা সম্পর্কে কোনো স্পষ্ট ধারণা দিতে কাজেম আলী ব্যর্থ হন কিন্তু আবসার হাসান নানাভাবে প্রশ্ন করে যা ধারণা করতে সমর্থ হয় তাহলো খবির মিয়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক ও ইকবাল হলের হাউস টিউটর ছিলেন। আর দিন-ক্ষণ ছিল উনিশ্ শ একাত্তর সালের পঁচিশে মার্চের দু’একদিন আগে। খবিরের বাবা-মাকে ঢাকায় দিতে এসে কাজেম আলী পাশের গ্রামের কোন একজনের খিলগাঁওয়ের মেসে যায়। ধারণা করা যায় ওই সময়ের রাজনৈতিক পরিস্থিতির উপর কাজেম আলীর পরিষ্কার কোনো বোধ ছিল না সেটা অবশ্য বোঝা যায় তার আগের একটি কথা থেকে। সেই কথাটা ছিল এই রকম যে, তারা গাঁও-গেরামের লোক ‘দ্যাশ-ট্যাশ’ কি ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ কি এই সব অত কিছু তারা বোঝে না, কেবল জয় বাংলা, নৌকা মার্কা ও শ্যাখ সাইব ছাড়া। কিন্তু যেই রাতে পাকিস্তানি মিলিটারিরা ঢাকায় ‘লায়খে-লায়খে’ লোক মেরে ফেলে ওই রাতগত দিনে বিকাল বেলায় সদর ঘাট থেকে তার লঞ্চ বরিশালের দিকে ছাড়বার কথা, সে গ্রামে ফিরে যাবে। কিন্তু অবস্থা যত খারাপই থাকুক খবির মেয়া, তার বাবা রহম মিস্ত্রি ও রহম মিস্ত্রির স্ত্রী কদমবিবিকে না বলে সে গ্রামের দেশে যায় কী করে।
আবসার হাসান তাঁর উপন্যাসের উপাদানসমূহের এ পর্যায়ে উপলদ্ধি করতে পারেন যে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র চালিত এই ঘরে শরীরে ঘামের ভাপ অনুভূত হচ্ছে, অসম্ভব গরমে গায়ের ফতুয়া খুলে ফেলেন, ফতুয়া খুলবার আগে একবার মনে হয়েছিল কাজেম আলীকে অন্তত একটু বলে নেবেন। পরে মনে হলো এর কোনো মানে দাঁড়াবে না, অতএব কোনো ভূমিকা ছাড়া আবসার হাসান তাঁর গায়ের ফতুয়া খুলে দু’পা উঠিয়ে শক্ত হয়ে সোফার উপরে বসেন। যদিও ঐ রকম কথিত ‘গ্রাম্য’ নিয়মে বাসায় বসার ঘরের সোফার উপর তাঁর বসবার অধিকার নেই। কিন্তু এই মুহূর্তে কাজেম আলীর গল্পের মাত্রা এ পর্যায়ে পৌঁছাবার পর আর আবসার হাসানের সেই ভয় থাকে না।
কাজেম আলীর কণ্ঠ একটু একটু কাঁপে যখন সে বলতে থাকে, পাও থোয়ার জাগা নাই, লাশেরে লাশ, রক্তের বইন্যা, পরের দিন বিয়ান বেলা, খবির মিয়ার দুয়ারের হোম্মে, সে থেমে আবার বলে, দুয়ারের হোম্মে অর্থাৎ দরজার সামনে বলবার পরে কাজেম আলীর থামবার কারণ আবসার হাসান বোঝেন, সে কান্নার আবেগ থামাতে চাওয়া। কিন্তু থামে কি, হাউ মাউ করে কাঁদে, ছার হে কতা কওনের না। মাথা নাড়ায়, আবসার হাসান সোফা থেকে উঠে কাছে গিয়ে কাজেম আলীর কাঁধে, পিঠের অংশের দিকে বাম হাত রাখে। সেই হাতে কাজেমের ঘামে ভেজা অমসৃণ চামড়া অনুভূত হয়। লোনা কাদা-মাখা ধরনের, তাতে কি, মানবিকতা পৃথিবী থেকে উঠে যায় নি, যাবেও না, আবসার হাসান বুঝে নেন, যেহেতু সে রাতে ইকবাল হলে কোনো প্রাণই রক্ষা পায়নি অতএব কাজেম আলী দেখতে পেয়েছিল রহম মিস্ত্রি, খবির মিয়া ও তাদের স্ত্রীদ্বয় কদম বিবি ও ফৌজিয়া আক্তারের গুলিবিদ্ধ মৃত লাশ। অতএব আবসার হাসান কাজেম আলীর পিঠে হাত দিয়ে চাপড় কাটেন আদর করে বলেন, ঠিক আছে আপনাকে আর বলতে হবে না, আমি বুঝে নেবো। আবসার হাসানের ওই কথা বলবার পরে কাজেম আলী স্ত্রীর চুল ঝাড়বার গামছাখানি মুখে চেপে ধরে মাথা নাড়াতে থাকে তা যেন আবসার হাসানের ওই কথার প্রেক্ষিতে অর্থাৎ লেখকের এই যে বুঝে নেবার প্রতিশ্র“তি সেই সীমানার পেছনেও যেন আরো কিছু থাকতে পারে, আরো কিছু আছে, যা হয়তো লেখক বুঝে নিতে পারবে না বলে কাজেম আলীর ধারণা।
--ছার আহমনে যা মোনে হরছেন হেইডা না খালি। আবসার হাসান আর অন্য কিছুই ভাবতে পারে না, ভাববার কথাও নয়, দরকারও পড়ে না কারণ কে না বোঝে যে সবাই নিহত। কাজেম আলী তার মুখমণ্ডল থেকে গামছা সরিয়ে নাক টেনে পরিষ্কার করে, তখনও লেখক আবসার হাসানের আদরের হাতখানা কাজেমের কাঁধ নিু পিঠের উপর। অবাক করে দিয়ে অতি ঠাণ্ডা কণ্ঠে কাজেম আলী বলে, ছার গুল্লি খাইয়া হেইয়ার ব্যাতায় মনে হয় খবির মেয়ার পরিবারের বাচ্চা অইয়া গ্যাছে। আবসার হাসানের অনিয়ন্ত্রণে কণ্ঠ থেকে শব্দ বেরিয়ে পড়লো ‘কী’ ? কাজেম আলীর পিঠ থেকে তাঁর হাত সরে এলো, চুলসহ শরীরের লোমের উপর দিয়ে একটি ঝড় বয়ে যায়, সেই ঝড়ে লোমেরা যদি বৃক্ষ কী মাঠের ফসল হয় তা উপড়ে যায় ঝড়ের তীব্র বাতাসে, অজ্ঞাতেই লেখক আবসার হাসান নিয়ন্ত্রণহীন শব্দের কণ্ঠে আবার প্রশ্ন করেন, কি বললেন ? কাজেম আলী আবার শ্বাসরুদ্ধকর হিক্কা তুলে বলল, ছার একটা সোন্তানের জন্ম হইয়া ছিল, কইন্যা সোন্তান। আবসার হাসানের চিৎকার শুনে ভেতর থেকে স্ত্রী ও কাজের লোকেরা দৌড়ে এলে তিনি তাদের দিকে না তাকিয়েই সবাইকে ইশারায় চুপ থাকতে বলেন, দাঁড়ানো অবস্থা থেকে লেখক সোফায় এমনভাবে ভেঙ্গেচুরে বসে পড়েন যেন সহসা লেখকের দেহ তরল হলে পরে তা গলে মাটিতে মিশে যেতে চায়। --ছার কইন্যা সোন্তান, আমাগো গেরামের মাইয়া সোন্তান, হের ইজ্জত রাখতে নিজের গামছাহান দিয়া ঢাইক্যা দেলাম, মাইয়া জুহুততো। আবসার হাসানের কাঁদতে ইচ্ছে করছে উপন্যাসের নাটকীয় চরিত্রের মতো।
কাজেম আলী তার পোঁটলা গোছাতে গোছাতে অঝোরে কাঁদতে থাকে, ফোঁসফোঁস শব্দে তা উপলব্ধি করা যায়, পোঁটলার ভেতরে সেই পেঁতলের গেলাসও ঢুকায় বাইদানীর যাদুর পোটলা গোছাবার মতো করে। --ছার আহ্মনে মনে হরছেন কেস্সাহান শ্যাষ ? সে লুঙ্গির পোঁটলায় চার কোনা মিলিয়ে গিট দিতে থাকে, --না ছার আমাগো গেরামের মাইয়া হ্যার লাশ আমি হালাইয়া যাইতে পারি না, গামছায় মোড়াইয়া হেই লাশ লইয়া সদর ঘাডের দিকে আডা দেই। লয়ক্ষে লয়ক্ষে মানু সদর ঘাডে, কয়জন কইলে, মেয়া তুমি পাগল তোমার বরিশাল যাইতে লাগবে হাতদিন, হের মইদ্যে লাশ পইচ্যা যাইবে, হের চাইতে বুড়িগঙ্গার নদীতে ভাসাইয়া দেও। মুই নিজে না, হেরাই ভাসাইয়া দেয়। ছার, ছার হে আমাগো কইন্যা সন্তান যার নাম রহম মিস্ত্রি রাখতে চাইল্হে সরোজিনী কদমবিবি। সরোজিনী অইল যাইয়া আবার ইন্দু দম্মের মাইয়া, হের ছোট সময় যেই মাইয়ারে ভাল লাগজেলে। কাজেম আলী লেখক আবসার হাসানের বাসা থেকে বেরিয়ে পড়ে। আবসার হাসান জানে, যে, সে যেতে পারবে না লিফটে, অতএব তিনি পেছনে পেছনে বেরিয়ে পড়েন কিন্তু তাঁর হাতে কাজেম আলীর প্লাস্টিকের জুতা জোড়া। তিনি বলেন আপনার জুতা ফেলে যাচ্ছেন। লিফটে উঠতে উঠতে কাজেম আলী বলে, ছার জোতা মুই হালাইয়া দিমু এহন, হেইদিন লাশ আর রক্তের মইদ্যে আটবার আগে জোতা হালাইয়া দেল্হাম। নিচের দারোয়ানদের মাথা খারাপ হওয়ার দশা এই দৃশ্য দেখে যে লেখক নিজে এই লোকটির পেছনে পেছনে তার জুতা হাতে গেটের কাছে চলে আসছে। গেটের কাছে দাঁড়িয়ে কাজেম আলী বলছে ছার মোরা গাও গেরামের মানু, মোগোর কান্দনডাও কুচ্ছিত। সে লেখকের হাত থেকে জুতাটা নিয়ে দেয়ালের পাশে ফেলে দেয়, তারপর ফুটপাতে বেরিয়ে পড়ে। লেখক অনুরোধ করতে থাকেন, আপনি কি সদরঘাটে যাবেন, আমার ড্রাইভার আপনাকে গাড়ি করে দিয়ে আসবে। কাজেম আলী কিছুই শোনে না আবসার হাসান কী বলছে। ফুটপাত ধরে লেখক ওই কাজেম আলীর পেছনে হাঁটেন, বাড়ির দারোয়ানরা তাজ্জব হয়ে তা দেখতে থাকে।
কাজেম আলী পেছনে না তাকিয়ে বলে ছার একটা কতা, সে ঘুরে দাঁড়ায়, বুড়িগঙ্গার গাং-এ সরোজিনী কদমবিবির লাশ ভাসাইয়া দেওনের পর দ্যাশে যাইয়া ওই গামছাহানার কয়বর দেই, আমাগোর নোলকঝোড় গেরামে ওই কইন্যার কয়বর আছে। এটুকু বলে আবার কাজেম আলী হাঁটে, আচ্ছা বলে লেখক কাজেম আলীর পেছনে হাঁটা অব্যাহত রাখেন, কেন যে লেখক তখন তার পেছনে হাঁটে তা তিনি জানে না যেমন অনেক কিছুই তিনি জানে না বলে তাঁর বিভিন্ন উপন্যাসে লিখেছেন। কাজেম আলী আবার বলে, ছার আছেন নাহি, আসল কতাডাই কওয়া অয় নায়। আবসার হাসান মুহূর্তে ভাবেন এর মধ্যে কী আবার আসল কথা বাদ থাকতে পারে ? কাজেম আলী তার হাঁটা না থামিয়ে পেছনে না ফিরে বলে, ছার ওই কইন্যা সন্তান কিন্তু জেবন্ত জোন্মাইছিল, হের আঙ্গুল মুখের ভেতরে আছেল যহন আমি হ্যারে পাই, কিন্তু মিরতো, মরা, পরান নাই। আবসার হাসান শোনেন কিন্তু যা শোনেন তা বিশ্বাস করতে পারেন কিনা বোঝা যায় না; আর কাজেম আলী কথাটা বলার পর থামে ও দাঁড়ায়, ঘুরে সোজা লেখকের দিকে তাকায়, লেখক উপলব্ধি করেন এই দীর্ঘ আলোচনায় কাজেম আলী কখনো তাঁর চোখের দিকে তাকায়নি, এই প্রথম, সেই চোখ এখন এক অদ্ভুত গভীরতায় পতিত চোখ, পলকহীন সেই চোখের গভীরতা নিয়ে কাজেম আলী আবার বলে, মরা, পরান নাই।
লেখক আর কাজেম আলীর পেছনে হাঁটতে পারেন না। দারোয়ানরা দ্যাখে, লেখক আবসার হাসান রাস্তায় আলগা পায়ের উপর, দু’হাঁটুতে কনুইয়ের পেছনে ভর রেখে কনুই ভাঙ্গা হাত দুটো মাথার দু’পাশ ধরে বসে পড়ে, লোকটি হেঁটে সামনে যায়, স্বভাবতই কিছুক্ষণের মধ্যে হেড দারোয়ান এসে বলে, ছার আপনার শরীর খারাপ ? বাসায় চলেন।
কাজেম আলীকে নিয়ে এরপরও লেখকের দিক থেকে অনেক কিছুই আছে। কিন্তু প্রধান কথা হচ্ছে আমেরিকাতে প্রবাসী বাঙালিদের ভেতরে এমন একটি মৌখিকগল্প লেখক বলেছিলেন নিউইয়র্কে আর এক মফস্বলীয় ‘কলাম ল্যাখকে’র দোতালা বাসভবনের উঁচু সোফায় বসে ইলিশ মাছ, মাগুর মাছ, কৈ, গরুর মাংস, খাসী, হালাল চিকেন, ঘন ডাল, গুঁড়া মাছ ইত্যাদি সব দিয়ে খেতে-খেতে। কথিত আছে খাবার শেষে কলাম ল্যাখক তিন ধরনের জুস-- আপেল, কমলা ও আঙ্গুর রস পরিবেশন করেছিল কেননা গর্বিত “বাঙ্গালি ধর্মপ্রাণ অসাম্প্রদায়িক মুসলমান” হিসেবে সেখানে অন্যকোনো ধরনের বেহেস্তী রস নিষিদ্ধ বা নাজায়েজ ছিল। আরো শোনা যায় কেউ একজন নাকি ‘লেখক’ আবসার হাসানের কাছে কাজেম আলীর পরিণতির কথা জিজ্ঞেসও করেছিল কিন্তু ‘লেখক’ মানুষ গল্পের পরে অন্য কিছুর প্রতি আগ্রহ থাকা লেখকপ্রথা বিরোধী এমন ইঙ্গিত করা হয় তাঁর পক্ষ থেকে, তাছাড়া যে মফস্বলীয় লেখক এই খানা-পিনার আয়োজন করেছে তার কলামেও নাকি লেখকের খাদ্যতালিকা ও অন্যান্য সব এমনকি ’কবিগুরু’র থেকে পঠিত ’আমাদের ছোটো নদী’ ’দ্যাশ মিস্ করার গান বাদ্য’ যাকে তারা ’দ্যাশপ্রেম’ বলে তাঁর সব কিছুই স্থান পেলেও ঢাকায় ছাপা হওয়া ওই কলাম ল্যাখক কাজেম আলীর গল্প বা নাম স্থান দেয়নি, ব্যাখ্যায় এই বিষয়েও কলাম ল্যাখক নাকি তার গোটা বন্ধুপারিষদদের বলেন, হেলে-চাষার কথা নিয়ে লেখালেখি করলে বাংলা সাহিত্যে এমন কোন লাভ নেই, তাতে বিউটিটা নষ্ট হয়ে যায়, ইত্যাদি এই জাতীয় কথাবার্তা তাঁদের মধ্যে চলতে থাকে যা সাধারণত প্রবাসী বিজ্ঞ ও বুদ্ধিজীবী সমাজে হয়ে থাকে।*
আনোয়ার শাহাদাত
জন্ম বরিশালে। কৃষক পরিবারে।
গল্পগ্রন্থ : ক্যানভেসার গল্পকার, পেলেকার লুঙ্গী।
উপন্যাস : সাঁজোয়া তলে মুরগা।
চলচ্চিত্র : কারিগর।
শর্ট ফিল্ম : ন্যানী।
দীর্ঘদিন নিউ ইয়র্কে থাকেন।
4 মন্তব্যসমূহ
আমি বাকরুদ্ধ !
উত্তরমুছুনগল্পটি এক টানে পড়লাম, যদিও লেখাটি দীর্ঘ বাক্যে ভরপুর। খু উ ব ভালো লাগলো। কাজেম আলী বরগুনার এক লোক হিসেবে এক বড়লোকের ( লেখক পরিচয় গৌণ) বাড়িতে যে আচরণ করেছে তা আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে অসমতা দেখানোর সাথে উপেক্ষা করার ইঙ্গিতও শিখিয়ে দিয়েছে। এ এক কৌশলী বয়ান।সাথে মুক্তিযুদ্ধ যোগ হয়ে একে দিয়েছে ভিন্ন মাত্রা।
উত্তরমুছুনশুরুতে ভালো লাগছিল। অর্ধেকের একটু বেশি পড়তে পেরেছি। অকারণে বাক্যকে দীর্ঘ করা হয়েছে, যদিও মূলত কয়েকটা বাক্যের মধ্যে দাড়ির বদলে কমা দিয়ে বা না দিয়ে একটা বাক্যে পরিণত করা হয়েছে। এ ব্যাপারটা খুব বিরক্তি উৎপাদন করেছে।
উত্তরমুছুনবাক্যগঠন যাই হোক না কেন, উপস্থাপনা পুরোপুরি হুমায়ূন আহমেদীয়। তাঁর মিসির আলী চরিত্রটির মতো লেখক আবরার হাসান। আবার প্রকাশের স্টাইলটাও হুমায়ূন আহমেদীয়। হুমায়ূন চরিত্রদের দেখা যায় একটা কিছু ভাবছে, আর একটু পরই সামনে উপবিষ্ট চরিত্রদের সেই মতো কাজ করতে বা কথা বলতে দেখা যায়। এখানেও তাই ঘটে। আবরার হাসান, কাজেম আলীর ব্যাপারে যা মনে মনে ভাবেন, কাজেম আলী একটু পর তা-তা করে ফেলে বা বলে।
একতা সাদামাটা গল্প।
স্বাদু গল্প। ভালো লাগা।
উত্তরমুছুন