অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়
ভেটিচরণ খুবই বেকুব— কী যে করে। কেউ তার কথা কানে
নেয় না। কিছু বললেই এক কথা, ভেটু তুমি কি ওদের সঙ্গে
পারবে! ওরা যদি গাছটার নীচে পেচ্ছাপ করে আটকাবে কী করে! পরের জায়গায় দোকান করেছ।
খাস জায়গা, এত বড় সড়ক, বাস যায়
গাড়ি যায়, ট্রাক, গরুর গাড়ি আর
সারা দিন প্যাঁক প্যাঁক, রিকশায় সওয়ারিও কম থাকে না— তোমার চায়ের দোকানটি বলতে
গেলে জমজমাট। কী ঠিক বলছি তো!
আজ্ঞে দাদা ঠিক।
সরকার কলেজটা করল—
ভেটু বাধা দিয়ে বলেছিল, আজ্ঞে দাদা ওটা বেসরকারি
কলেজ। বাস এখানে থামত না, এখন সব বাসই থামে।
ক’ দিন বাদে এটাও একটা গঞ্জ হয়ে যাবে। তুমি তো অনেক
ভেবেচিন্তে খাস জমিতে চায়ের দোকানটা করেছিলে— এত বড় সুখার মাঠে— লোহা লক্কর, ইটের সারি, সারি সারি ট্রাক, সিমেন্টের গুদাম, মানুষজনের চা তেষ্টা পাবে,
এ সব ভেবেই তো দোকানটা করেছ।
আজ্ঞে দাদা।
দোকানের পিছনে নিমগাছটাও বিশাল।
গরমের দিনে ছায়া পাবে। বসন্তকালে নিমের কচিপাতা, সেই নিমগাছটারও বেওয়ারিশ দখল নিয়ে নিয়েছ।
কচিপাতার দাম তো কম না। যেই উঠতে যায় গাছে, ক্যারে,
তোর বাপের গাছ, গাছটারও দখল নিয়ে নিলে।
তোমার অনুমতি না নিয়ে কেউ গাছে উঠতে পারে না। ওই করেও তোমার রোজ পাঁচ-সাত টাকা হয়।
ভেটুচরণ সামান্য গাঁইগুঁই শুরু করে
দিল। নিমগাছের কচিপাতা যারা নেয়, এসেই এক কথা, ভেটু দাদা, দুটো কচিপাতা দিবেন? তারপর তার চটে আট আনা
পয়সা ফেলে রাখে। কেউ এক টাকা। সরকার থেকে ইজারা নেওয়া গাছ, এমন একটা ভেল্কি চাউর হয়ে আছে। ভেটুচরণের সায় না থাকলে কচি নিমপাতা
পারতে কেউ গাছে উঠতে পারে না। পয়সা না দিয়ে উঠলেই এক ধমক, এই শালা এটা তোর বাপের গাছ? চুরি করে গাছের
ডাল পাতা ভাঙছিস। ইজারা নেওয়া গাছ। ইজারা নিয়েছি, পয়সা
দিয়ে গাছে উঠবি। পয়সা না দিলে, ঠ্যাং ভেঙে দেব।
কেউ দেয়, কেউ দেয় না। সে চায়ের দোকানে
ব্যস্ত থাকে, খদ্দের সামলায়, দোকানের
পিছনে গাছটা, চুরি চামারি করে কেউ ডালপাতা ভেঙে নিলে টেরও
পায় না। গোন্দাদা তো বলেই খালাস। গরমকালে রোজ সকালে পাঁচ-সাত টাকা হয়। গুজব যে কে
ছড়ায়! লোকটা পঞ্চায়েতের মেম্বার। আগে ছিল মিলের তাঁতি।— মিল তো কবেই বন্ধ হয়ে গেছে,
তবু মাস মাইনে ঘরে বসে পায়— আর ইট সিমেন্ট বালির সাপ্লাই
তো আছেই। তার উপর পঞ্চায়েত মেম্বার, পয়সা হড়কা বানে উপচে
পড়ছে। দোতলা বাড়ি, ভটভটি, ফুলের
বাগান, সুন্দরী পারুলবালা— রূপসী কন্যে একখানা যারে কয়।
কচি নিমপাতার মতো সবে কচিঘাসে মনোরম হয়েছে।
ছিল তাঁতি, হয়ে গেল মহাজন। কন্যে
মহামান্যা সুন্দরী রূপসী।
ইউনিয়ানবাজিতেও তুখোর, পার্টি লাইনে নাম লিখিয়ে
গোন্দা কর্মকার এখন এলাকার নেতা। চারপাশটা দেখছে। রাস্তার ধারে শালগাছগুলির বড় বড়
পাতা হাতির কানের মতো দুলছে। ফাল্গুনের মোলায়েম ঠাণ্ডা হাওয়া দিচ্ছে। কর্মকার
এদিকটায় ফাঁক পেলেই পাক দিয়ে যায়। ভেটুর দোকানের মিনি মাগনা চা-ও পায়, আসলে কলেজের এক ছোকরা তার বাড়ি যায়, সেই
ছোকরাকেই খুঁজতে, ঠিক খুঁজতে না, অথবা যদি কোনও বড় অপকর্মে লিপ্ত হয়ে যায়, দেশ
কান্দি, পাস টাস করলে চাকরি বাঁধা। চাকরি না পেলেও
কন্ট্রাকটরি লাইনে ভিড়িয়ে দেওয়া যাবে— সতর্ক নজর রাখা। ছোকরার বাপই বলে গেছে, আপনি চেনাজানা মানুষ কর্মকারবাবু। আপনার হেপাজতেই রেখে গেলাম।
হোস্টেলের একঘেয়ে খাওয়া, কতদিন সহ্য হবে কে জানে। আর
গোলমালে হরিবোল হয়ে না যায়, লক্ষ রাখবেন।
আপনি ভাববেন না। লোকজন আমার চারপাশে, পুত্রটি আপনার বিপথগামী হয়
সাধ্য কি!
ভেটুচরণ চা বাড়িয়ে কাপ ধরেই আছে।
গাড়ি যায়। গরুর গাড়ি। ট্রাক যায়, ইটের ট্রাক, সর্বত্র গোন্দার নজর, কার ইট, কে নেয়, তার ইট বালি চুন সুরকির সাপ্লাই থাকতে,
ট্রাকওয়ালা কার ইট বয়!
দাদা চা।
অঃ।
চায়ের কাপে চুমুক দিতেই কেমন একটা
চ্যাংটা গন্ধ।
আরে ভেটুচরণ চায়ে পেচ্ছাপের গন্ধ। কী
চা দিস!
কী করি বলেন, চায়ের চ্যাংটা গন্ধ
নিমগাছটার নীচে। চায়ের গন্ধ ছাপিয়ে, পলকা হাওয়ায় চ্যাংটা
গন্ধ ভেসে বেড়ায়। হোস্টেলের ছোকরাগুলি নিমগাছটার গোড়ায় মুতে সাফ হয়ে নেয়। তারপর
শহরের বাস ধরে। কী যে করি! মিনতি করেছি কত। শোনে না। চায়ের খদ্দের তারা। মিনতি
করলে যদি শোনে। তা পাত্তাই দেয় না। এক দু’ কাপ হলে কথা ছিল। হোস্টেল ক্যামপাসে জায়গার অভাব,
দল বেঁধে বের হয়, তারপর আমার নিমগাছটার
কী যে অপরাধ বুঝি না! বললে কী কয় জানেন, চা খেলাম,
আবার খালাস করেও গেলাম।
তার মানে?
মানে ওই এক কথা, তোমার চা, তোমার নিমগাছ, বলে গাছের গোড়ায় মুতে দেবার সময়
হা হা করে হাসে। একটা বিহিত করেন দাদা।
কমলাক্ষ কি ওদের দলে থাকে!
অর্থাৎ কমলাক্ষ থাকলে কোনও সুরাহা
করা যাবে না। কমলাক্ষ যে কর্মকারেরও বাড়ি যায় ভেটুচরণ জানে— ভাবী জামাতার নামে দোষ দিলে
গোন্দা কর্মকারের শিরে রক্ত জমে যাবে। সে বলল, চায়ের এমন
ফ্লেবার আর কার দোকানে মিলবে বলেন। এখন চা খেতে খেতে যদি চ্যাংটা গন্ধ নাকে ঝাপটা
মারে, কে খাবে চা। দোকান যে বসে যাবে দাদা।
খুব ল্যাঠা দেখছি তোর। তা কী করবি, যারা কর্মটি করে, তারা আবার চাও খায় তোর। টুলে বসে গুলতানি মারে, সিগারেট ওড়ায়। ক্যামপাসে নজরে পড়ে গেলে দশ কান হতে কতক্ষণ! ওদেরও তো
গুলতানি মারার একটা জায়গা চাই। কী ছিল, আর পাঁচ-সাত বছরে
কী হয়ে গেল জায়গাটা!
দাদা!
বল।
একটা বিহিত করেন।
বিহিত! তা দেখি। কমলাক্ষ কি সিগারেট
খায়!
আজ্ঞে না।
বিপথগামী কথাবার্তা বলে?
আজ্ঞে না।
কিছুটা ভজানোর জন্য বলল, অমন ছেলে দাদা লাখে হয় না।
মাথা নিচু করে বসে থাকে। হাতে বই থাকে, চা খেতে খেতে পড়ে।
বই ছাড়া মাথায় কিছু নেই। আজেবাজে আড্ডা শুরু হলেই কমলাক্ষ উঠে যায়। বড়ই সুন্দর
স্বভাব।
সেই। বাপ তো হোস্টেলে রেখে খালাস।
কখন মাথা বিগড়ে যাবে, তুই তো জানিস, নীরদ দাদার মেয়েটার কী হাল করে
রেখে গেছে। প্রেমটেম করে, শহরে পালিয়ে সিনেমা দেখে শেষে
ছোবড়া করে রেখে গেল। কানপুর না কোথায় চাকরি করছে। ছেলের বাপের এক কথা, মাথাটা ভাগ্যিস বিগড়ায়নি। ব্যাটারা কলেজ তো খোলেনি, ভাবী জামাতাদের যেন আড়ত খুলেছে।
তা দাদা ঠিক বলেছেন। এখন যদি আপনার
সুমতি হয়।
সুমতি!
হ্যাঁ, আপনি নিষেধ করলে, কারও
বাপের সাহস হবে না গাছটার নীচে কর্মটি সারে।
সাহস হবে না বলছিস?
চা খাওয়া হয়ে গেছে। কাপটা হাতে দিয়ে
বলল, ভাবিস না,
পার্টি লাইনে না গেলে হবে না। আমার একার কথা শুনবে কেন! এটা তো
প্রাকৃতিক কাজ— মানবাধিকারের প্রশ্নও উঠে যেতে পারে। আমি দেখি সুপারকে বলব। তার চেয়ে
তুই বরং একটা কাজ কর— বাঁশ পুঁতে গাছটার চারপাশে বেড়া দিয়ে দে। তারপর কী ভেবে গোন্দা কর্মকার
ভটভটি থেকে নেমে চারপাশটা ঘুরে দেখতে থাকল। চায়ের দোকান করায় নিমগাছটা আড়ালে পড়ে
গেছে। কিছুটা ঝোপজঙ্গলও আছে। আড়াল বলেই, বাসে রিকশায়
কিংবা সাইকেলে ওঠার আগে সবাই এখানে প্রাকৃতিক কর্মটি সেরে যায়। ওদের দোষও দেওয়া
যায় না।
রেলপাড়ের রাস্তায় হোণ্ডা গাড়ির শো
রুম খুলেছে। জানিস ভেটু।
ভেটু বলল, আজ্ঞে শহর ছাড়িয়ে যত দূরেই
যান দাদা, নানা কিসিমের শো রুম, দোকান
পাট, ফ্ল্যাটবাড়ি, ইট বালির আড়ত,
এদিকটাও বাদ থাকছে না। সারের গুদাম হবে শুনছি।
যত লোকজন, তত তোর পয়সা। কী বলিস!
আজ্ঞে যা বলেছেন। আপনি রা করলে, কেউ আর সাহস পাবে না। দোকানে
বসাও যায় না।
তুই বাধা দিলেই পারিস!
শোনে না। তেড়ে আসে। ভয় দেখায়, বলে— দোকান বয়কট করবে। পুড়িয়ে
দেবে।
ঠিক আছে বেড়াটা দে। তারপর দেখি।
কেউ বাধা দিলে—
আমার দোহাই দিবি।
যাক, কর্মকার একটা পথ বাতলে দিয়েছে। সকাল থেকে রাত
দশটা দোকান খুলে বসে থাকে। তবে সবারই এক কথা—
বসা যায় না। কী উৎকট গন্ধরে বাবা!
ভেটুচরণেরও এক কথা, দুটো দিন সবুর করুন, সব ঠিক হয়ে যাবে।
সে বাঁশ পুতে বেড়া দেয়।
বেড়া থাকে না।
দু’ দিনও যায় না, কারা খুঁটি
উপড়ে ফেলে। কলেজের ছোকরাদেরই উৎপাত। অধিকার থেকে এক চুল নড়তে রাজি না।
কিছু দিন থেকে এই এক উৎপাতে
ভেটুচরণের জীবন বেহাল। গাছের গুড়িতে মূত্রের নির্যাস। সে ক্রমে পরাস্ত হতে থাকে।
দোকানে আজকাল খদ্দেরও কম হয়। সবাই কিছুটা গোবিন্দতলায় চলে যায়। সেখানে তার
বিয়াইমশাই কাঙ্গালীচরণ হোটেল খুলেছে। হোটেলে চায়ের বন্দোবস্তও আছে।
ভেটুচরণ নিরুপায় হয়ে শুধু ভাবে।
কাটা ঝোপে নিমগাছের গুড়ি জড়িয়ে রাখে।
যা শালারা এলেই বেলকাঁটা ফুঁড়ে মরবি।
কাঁটাও থাকে না। সব কারা সাফ করে
দেয়।
ভেটুচরণ বুঝতে পারে এভাবে চললে, তার দোকান আর থাকবে না।
ছেলেমেয়ে নিয়ে রাস্তায় গিয়ে দাঁড়াতে হবে।
গোন্দা কর্মকার একদিন চা খেতে এসে না
বলে পারল না, এক
কাজ করতে পারিস ভেটু?
আজ্ঞে বলেন।
তোর খুব বিপদ দেখছি।
আজ্ঞে বিপদ বলতে—
তুই এক কাজ কর, বৃহস্পতির বারবেলায়, গাছের নীচে বিপদনাশিনীর ব্রত করে ফেল।
পাপ হবে না! তেনাকে এই নরকের মধ্যে
নিয়ে এলে যদি কুপিত হন!
ধুস, ঠাকুরের কি স্বর্গ নরক থাকে! তেনারই সৃষ্টি,
তেনারই লয়। পেটে গামছা বেঁধে লেগে পড়। ক্যাম্পাসের ছোকরাদের ডেকে
প্রসাদ দে। কাজ দেবে। পরীক্ষা লেগেই থাকে, প্রসাদ অবহেলা
করতে পারবে না।
ভেটুচরণ বোঝে, গোন্দা কর্মকার বড়ই
ধান্দাবাজ মানুষ। চতুর এবং নেমকহারাম। পার্টি লাইনে থাকলে নয়কে ছয় করার কৌশল সহজ।
দোকান রক্ষা করতে হলে বিপদনাশিনীর কুক্ষিগত হতেই হয়।
ভেটু জায়গা সাফ করে— গোবরে লেপে দেয়। তার পরিবার
আসে। হাতে পানসুপারি সিঁদুর। কমলিনী পারুলবালাও আসে। ব্রতকথা শুনলে সব মনোবাঞ্ছা
পূর্ণ হয়। কমলাক্ষর সঙ্গে সেই সুবাদে দেখাও হয়ে যেতে পারে। পারুলবালা যে কিশোরী!
নরম সিল্কের মতোই উদোম হয়ে থাকে বুনো ঘাসের জঙ্গল। পূত পবিত্র শরীরে নারীর এ যে কী
জ্বালা!
কিশোরী পারুলবালা ডাকে, ভেটুদাদা।
বল।
কমলাক্ষ আসে!
আসে!
কখন?
কথা বলবি!
পারুলবালা আর রা করে না।
ভেটুচরণ এক ফাঁকে কমলাক্ষকে খবর দেয়, কমলিনী পারুলবালা হাজির।
আপনাকে ডাকছে।
ব্রতকথা হয়। উলু দেওয়া হয়। ব্রতকথা
শুরু হলে সবাই গোল হয়ে বসে। কমলাক্ষ,
পারুলবালাও বাদ যায় না। মানুষজন প্রসাদ নেয়, আর প্রসাদ দিতে গিয়ে অবাক, কমলাক্ষ নেই। তার
দোকান ঘরের ভিতর কমলাক্ষ আর পারুলবালা— দোকানের বেড়ার পাশে আড়াল মতো জায়গায় চুমো খাচ্ছে।
তাকে দেখে ঘেচি বেড়ালের মতো লজ্জা—
সে যেন কিছুই দেখেনি। ভেটুচরণ প্রসাদ দেওয়ার সময় একেবারে
সাদাসিধে মানুষ— আরে সারাজীবন পড়ে আছে, প্রসাদটুকু আগে নে।
মাথায় ঠেকিয়ে খা। দেবীর কোপে কে পড়ে বল! সুবিধা-অসুবিধা বলবি, এ বয়সে এ সব হয়। লজ্জা পাবার কি আছে।
কিন্তু সব বিফলে। ব্রতকথায় মানাল না— কমলাক্ষ যে পারুলবালার
ঢ্যামনা, চাউর হয়ে গেছে ক্যাম্পাসে। তারা মানবে কেন।
এক-দু দিন যায়। তারপর ফের মূত্র ত্যাগ। এবং জায়গাটা আবার নোংরা হতে থাকে।
বিপদনাশিনী ব্রত তো রোজ করা যায় না।
ভেটুচরণ ভাবে আর ভাবে।
তার রাতে ঘুম হয় না। দোকানে রাত
কাটায়। এপাশ ওপাশ করে। গোবর জলে গুলে সকালেই নিমগাছের গোড়ায়
ছিটিয়ে দেয়। গোবর জলে তীব্র গন্ধটা কিছুটা স্তিমিত থাকে। তারপর সারা দিন নিমগাছের গোড়া ভেসে যায়। এত তেজ থাকে মূত্র ত্যাগে যে চারপাশের গাছপালা পর্যন্ত হেজে যায়। তারই মাঝে রাতে চুপিচুপি কমলাক্ষ আসে। কমলিনী পারুলবালাও ঝোপজঙ্গল অতিক্রম করে আসে। শরীর বলে কথা। শরীরে গরম ধরে গেছে, তাদেরও দোষ দেওয়া যায় না। কমলাক্ষ আর কমলিনী পারুলবালাকে কিছুটা সুযোগ সুবিধে দিয়ে হাত করার চেষ্টা। পারুলবালা যদি তার হয়ে বাপকে বলে— শত হলেও সোহাগী মেয়ে, কথা ফেলতে পারবে না।
ছিটিয়ে দেয়। গোবর জলে তীব্র গন্ধটা কিছুটা স্তিমিত থাকে। তারপর সারা দিন নিমগাছের গোড়া ভেসে যায়। এত তেজ থাকে মূত্র ত্যাগে যে চারপাশের গাছপালা পর্যন্ত হেজে যায়। তারই মাঝে রাতে চুপিচুপি কমলাক্ষ আসে। কমলিনী পারুলবালাও ঝোপজঙ্গল অতিক্রম করে আসে। শরীর বলে কথা। শরীরে গরম ধরে গেছে, তাদেরও দোষ দেওয়া যায় না। কমলাক্ষ আর কমলিনী পারুলবালাকে কিছুটা সুযোগ সুবিধে দিয়ে হাত করার চেষ্টা। পারুলবালা যদি তার হয়ে বাপকে বলে— শত হলেও সোহাগী মেয়ে, কথা ফেলতে পারবে না।
একদিন পারুলবালা খবর দিল, ভেটুদাদা, বাবা বলল, ভেটু কি স্বপ্ন-টপ্ন দেখে না!
স্বপ্ন! স্বপ্ন দেখি, তবে কী দেখি সকালে উঠে মনে
থাকে না।
সকালে উঠে মনে থাকে না, সে আবার কি কথা! আমি তো জেগে
জেগেও স্বপ্ন দেখি। স্বপ্ন ছাড়া মানুষ বাঁচে বলো। একটা কথা বলব?
বল।
রাতে দোকানে পড়ে থাকো, বউদির কষ্ট হয় না!
হয়। হলেই কি করা! দিন রাত পাহারা
দিয়েই দোকান রক্ষা করতে পারছি না—
কেন কমলাক্ষ শোবে!
হঠাৎ ভেটুচরণ আলোর ঝিলিকে ভেসে গেল।
এই টাটে, পাটিতে, শক্ত বিছানায়, তেল চিটচিটে বালিশ, কমলাক্ষ রাজি হবে কেন!
আসলে ভেটুচরণের ফন্দি পারুলবালা ধরতে
পারছে না। মেয়েটার আর সহ্য হচ্ছে না। শরীরের কামড়ে অস্থির হয়ে পড়েছে। কমলাক্ষ রাতে
যদি শোয়, তবে
পারুলবালা গভীর রাতে ঝোপজঙ্গল টপকে সোজা বড় রাস্তায় উঠে আসতে পারে। ভেটুচরণ বলল,
কমলাক্ষ কি রাজি হবে?
আমি রাজি করাব।
কমলাক্ষ না হয় রাজি হল, ধরা পড়ে গেলে তোর বাপ আমাদের
সবাইকে পুড়িয়ে মারবে জানিস।
সোজা!
সোজা নয়, আবার কঠিনও নয়। দিনকাল কি পড়েছে
বুঝিস তো। তুই তো বুঝিস, গোটা এলাকা তোর বাপের তাঁবে। সে
হয়কে নয় সহজেই করে ফেলতে পারে। পার্টি তার মুরুব্বি। রাগ করিস না, এই যে তোর বাপ ভুরিভুরি চুরি করছে, কী এক
দারিদ্র সেবার ফাণ্ড করেছে, টাকা তুলছে— রসিদ দিচ্ছে না, কেউ মুখ ফুটে রসিদ চাইতে পর্যন্ত সাহস পায় না, চাইলেই লাশ পড়ে যাবে। তোর বাপের ভয়ে পুলিশ পালিয়ে বেড়াবে। নয় ছয়
রিপোর্ট দেবে। তুই তো সব জানিস। তোর এত সুবিধা করে দিচ্ছি, আমার কী থাকবে।
তুমি কী চাও, বলবে তো!
আমি তো বেশি কিছু চাই না। জায়গাটা
সাফ সুতরো রাখতে চাই। তোর বাপ সহায় হলে,
আমার সব হয়ে যাবে।
পারুলবালা বলল, বাবা তো তাই বলল, ভেটুটা একটা হাঁদা। আরে স্বপ্ন-টপ্ন দ্যাখ। দ্যাখে গাছের গুঁড়িতে দুটো
পাথর ফেলে রাখ। পাথরে সিঁদুরের ফোঁটা দে। ঠাকুর দেবতার অধিষ্ঠান হলে, আর কেউ এগোতে সাহস পাবে না। বাবার নাকি পরোক্ষ সমর্থন থাকবে।
স্বপ্ন দেখতে বলছে?
হ্যাঁ।
একা দেখলে হবে! বলবে না গাঁজাখুরি
কথা। কেউ বিশ্বাস করবে?
কেন বউদি দেখবে।
সে তো আমারই লোক।
আমি দেখব।
সেও তো তোর এখানে যাওয়া-আসা আছে বলে।
কমলাক্ষ দেখবে।
গোন্দাদা দেখলে ভাল হত না! মান্যগণ্য
মানুষ, লোকজন
তাঁকে সমীহ করে। তবে স্বপ্নটা গুরুত্ব পেত।
কিন্তু মুশকিল কি জানো। ঠাকুর দেবতার
নামে বাবার খুব একটা আগ্রহ নেই। তবে বাবাকে আমি রাজি করাব। দু’ দিন মুখ ব্যাজার করে, শুয়ে থাকলেই হবে। আমার মুখ ব্যাজার বাবা সহ্য করতে পারে না।
তুই ইচ্ছে করলে পারিস পারুল। তোর এত
সুযোগ-সুবিধা করে দিচ্ছি, তবে কেলেঙ্কারি যদি হয়, তখন কী হবে!
কেলেঙ্কারি হবে কেন! শর্বরীদির বিয়ে
হয়েছে না। আমার সঙ্গে স্কুলে পড়ত। শর্বরীদিকে চেনো না। রতনদার বোন। আজকাল তো সব
নাকি জলভাত। কেলেঙ্কারি হবে কেন। তুমি মনে করো আমি কিছু জানি না! হায়ার সেকেণ্ডারি
পাশ কি সোজা কথা। কত গুপ্ত কথা জানা হয়ে যায়।
সব তো হল রে পারুল। তোরা এলে না হয়
আমি ঝাঁপ ফেলে দেব, বাইরে বসে থাকব। সবই করুণাময়ের ইচ্ছে ভাবব। তুই কোথায় ছিলি, কমলাক্ষ কোথায় ছিল, ভেবে দ্যাখ— তাকে দেখে, তুই পাগল। তোকে দেখে কমলাক্ষ পাগল। আর এক পাগল আমি, দোকানটা রক্ষা না পেলে আমি পথে দাঁড়াব ভালই জানিস। পাগল না হয়ে আমার আর
উপায় বা কি আছে।
ঠিক আছে। তুমি ভেবো না। তুমি পাগল
হলে আমরা যাব কোথায়!
দু’ দিন বাদেই গোন্দা কর্মকার হাজির।
কী রে স্বপ্ন-টপ্ন দেখলি।
না দাদা। দুশ্চিন্তায় ঘুমই আসে না।
স্বপ্ন আসবে কোত্থেকে।
গোন্দা কর্মকার বলল, গাছের নীচে ত্রিনাথ ঠাকুরের
অধিষ্ঠান হলে মন্দ হয় না। গাঁজা ভাঙ উড়বে। তোর বউদি বড় অশান্তি করছে। চেলা
চামুণ্ডারা চরস গাঁজা খেতে ভালবাসে। তোর বউদি এখন সবাইকে লাঠি নিয়ে তাড়া করছে। তোর
এই নিরিবিলি জায়গাটা পছন্দ খুব তাদের। কিন্তু একটা কথা, বখরা
আধাআধি। কথার খেলাপ হলে, তুই তো আমাকে জানিস। তোর একটাই
কাজ, তোর পরিবারের একটাই কাজ, শুধু
স্বপ্ন দেখা। ত্রিনাথ ঠাকুর তোর দরজা থেকে ফিরে যাচ্ছে। গাছের গোড়া থেকে ফিরে
যাচ্ছে, তাঁর গাঁজা ভাঙ চরস খাবার জায়গা পছন্দ হচ্ছে না।
গাছের গোড়ায় অধিষ্ঠান হতে চাইছে।
ভেটু বলল, ঠাকুরের নামে মিছে কথা বলব!
ধুস ব্যাটা, ঠাকুর তোর আমার, ঠাকুর নিত্যদিন বিরাজ করে আমরা আছি বলে। আমরা না থাকলে ঠাকুর দেবতা
থাকে কোথায়! মিছে কথা বলে কিছু নেই, এত এত ঠাকুর দেবতার
বই পড়ে আমার হাড়ে দুব্বো গজিয়ে গেছে। মানুষকে আতঙ্কের মধ্যে ফেলে দাও ঠাকুর দেবতার
নামে। এই তো হয়ে আসছে।
ভেটু বলল, আমার কাজটা কী?
তোর কাজ স্বপ্ন দেখা। ত্রিনাথ
ঠাকুরের স্বপ্ন দেখা।
বেশ দেখলাম। তারপর—
আমার কাজ তিনটে সাদা, কালো, হলদে রঙের বড় পাথর খোঁজা। খুঁজলে বাড়িতেই পেয়ে যাব মনে হয়, নলহাটি থেকে পাথরের সাপ্লাই তো আছেই, ঠিক চলে
আসবে। শুধু মানুষের চোখের অন্তরালে পাথর তিনটেকে বসিয়ে দিবি। সিঁদুর মাখামাখি করে
রাখবি। আর সকাল হলে চেঁচামেচি করবি। ত্রিনাথ ঠাকুর কৃপা করেছেন। তিনি নরক উদ্ধার
করতে গাছের গোড়ায় হাজির। ঢাক ঢোলেরও ব্যবস্থা থাকবে। ত্রিনাথের মেলা বসে যাবে। দিন
যাবে, থান বাঁধিয়ে দেব।
সেই থেকে ভেটু শুধু স্বপ্নই দ্যাখে— তার দোকান লাটে উঠেছে। গলায়
তুলসীর মালা পরনে খোট— সিদ্ধবাবা ভেটুচরণ। শনি মঙ্গলবারে ত্রিনাথের মেলা বসে। লোকজনের ভিড় হয়।
হোস্টেলের ছাত্ররা পরীক্ষার আগে মানত দেয়— বড় নিষ্ঠার সঙ্গে পূজা হয়। এদিকটায় কেউ এলেই থানে
মাথা না ঠুকে যায় না। ছোট্ট একটি মন্দিরও হয়ে গেছে। ভিতরে শেকলে বাঁধা কাঠের
বাক্স। ভেটু মন্দিরেই থাকে, ফুল চন্দনে মাখামাখি
আশীর্বাদী দেয়, মনুষ্যজাতির বিশ্বাস জন্মে গেছে। বাবার
আশীর্বাদী ফুলে, অপুত্রকের পুত্র হয়। মরা মানুষ কথা বলে।
যথেষ্ট প্রণামির রেজকি পায়—
রাত হলে ভেটুর এখন একটাই কাজ। রেজকি গোনা। শত হলেও বখরা আধাআধি।
শরিক ঠকালে পাপ হয়। পারুল কমলাক্ষেরও বিয়ে হয়ে গেছে। জোড়ে প্রণাম করে গেছে। পেটে
এখন একটা বাচ্চা চাই।
1 মন্তব্যসমূহ
অনেকদিন আগে পড়া শিবরাম চক্রবর্তীর 'একটি দেবতার জন্ম' গল্পের মতোই ভালো লাগল। তবে এটা ওই গল্পের ছায়া নয় সেটা অবশ্যই স্বীকার করব।
উত্তরমুছুন