প্রেম একটি লাল গোলাপ
মারুফ রায়হান
রশীদ করীম চলে গেছেন দেখতে দেখতে একটি বছর হয়ে গেল।
জীবদ্দশায় তাঁকে আমরা যথাযথ সম্মান দেখাতে পারিনি। প্রয়াণের পর তাঁকে স্মরণ করায়ও
আমাদের কার্পণ্য থাকবে-- এমন
আশঙ্কা সত্যে পরিণত হয়েছে। অথচ তিনি ছিলেন বাংলাদেশের কথাসাহিত্যের এক উত্তম পুরুষ।
কোনো শক্তিমান লেখকই অন্য আরেকজন লেখকের মতো হন না। রশীদ করীমও স্বতন্ত্র ও
অননুকরণীয় লেখক। তাঁর লেখামাত্রই শনাক্ত করা যায় তাঁর বিশেষ ভঙ্গি ও সপ্রতিভতা, সুরুচি ও রসবোধের কল্যাণে। এমন একজন গুণী ও মৌলিক ধরনের
কথাশিল্পীর শেষ জীবনটা ছিল ট্রাজেডিপূর্ণ। শারীরিক সীমাবদ্ধতার কারণে প্রায় দুটি
দশক তিনি লেখেননি। যদি লিখতে পারতেন, তবে তাঁর পূর্বেকার সাহিত্যকর্মের বিবেচনায় আমরা সন্দেহাতীতভাবে বলতে পারি, বাংলাদেশের কথাসাহিত্য সমৃদ্ধতর হতো।
রশীদ করীম শুরু করেছিলেন ছোটগল্প দিয়েই, সেই ত্রিশের দশকের একেবারে শেষদিকে। ১৯৪২ থেকে ১৯৪৫-- এই কালপর্বে লেখেন বেশ কিছু গল্প। সর্বকনিষ্ঠ গল্পকার
হিসেবে তাঁর গল্প ছাপা হয়েছে সওগাত, মাসিক মোহাম্মদী, নবযুগ, ইত্তেহাদ, মিল্লাত, পূর্বাশাসহ
বিভিন্ন পত্রিকায়। সর্বকনিষ্ঠ গল্পকার, এবং প্রথম মুসলমান হিসেবে গল্প পড়ছেন অল ইন্ডিয়া রেডিওর কলকাতাকেন্দ্রীক
রবিবাসরীয় সাহিত্য আসরে। যুদ্ধকালে ফ্যাসিবাদ-বিরোধী অনেকগুলো গল্প পড়েছেন রেডিওয়।
তারপর সাহিত্য থেকে নির্বাসিত। অর্থাৎ যৌবনের প্রখর সূর্যের নিচে কিংবা
চন্দ্রালোকিত অধ্যায়ে লেখালেখি থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন রেখেছিলেন। এ পর্যায়ে কলকাতা
থেকে ঢাকায় চলে আসেন স্থায়ীভাবে এবং তেল কোম্পানিতে চাকরি নেন।
বাংলা কথাসাহিত্যে তাঁর পুনঃপ্রবেশ ষাটের দশকে। ১৯৬১
সালে তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘উত্তম
পুরুষ’ প্রকাশকালে তাঁর বয়স ছত্রিশ। পরে
এক-আধটা গল্প যা-ও লিখেছেন সেসব নিজেই খারিজ করে দিয়েছেন ‘বর্ষণের অনেক পর গাছের পাতা থেকে দুই ফোঁটা বৃষ্টি পড়ার
মতো’ ব’লে। তাঁর গল্পগ্রন্থের সংখ্যা মাত্র একটি-- প্রথম প্রেম। হ্যাঁ, কৈশোরে
প্রথম প্রেমে পড়েই একে একে গল্প লিখেছেন, আর তাঁর প্রথম প্রেম জেগেছিল গল্পের প্রতিও। সেই প্রেম তিনি নিজেই ছিন্ন
করেছেন, যদিও তাঁর গল্পগ্রন্থ পাঠ করে পাঠকদের
হাহাকারই জেগে ওঠে-- কেন
তিনি আর গল্প লিখলেন না।
তিয়াত্তরে লেখেন গল্প ‘প্রেম একটি লাল গোলাপ। একই নামে উপন্যাস প্রকাশিত হয় এর পাঁচ বছর পর।
তিরাশিতে লেখেন গল্প ‘প্রথম
প্রেম’। গল্পের বইটি বেরোয় ঠিক তার পরের বছর, চুরাশিতে। গল্প দিয়ে সাহিত্যজীবন শুরু হলেও প্রথম এবং
একমাত্র গল্পের বইটি বেরুনোর আগে তিনি লিখে ফেলেছেন জীবনের অধিকাংশ উপন্যাস-- মোট সাতখানা। রশীদ করীমের মোট উপন্যাস মাত্র বারোটি। তবে
কে না জানে সাহিত্যে পরিমাণ নয়, মানই
বিবেচ্য। প্রথম উপন্যাসেই তাঁর আসনটি নির্দিষ্ট হয়ে গিয়েছিল। আধুনিকতা, নান্দনিকতা এবং মানুষে মানুষে বন্ধুতা ও দ্বান্দ্বিক
সম্পর্কের ব্যতিক্রমী উপস্থাপনের জন্যে তিনি বোদ্ধা পাঠকমহলে আদৃত হন। প্রথম থেকেই
তাঁর লেখায় নারী এসেছে স্বতন্ত্র সত্তা রূপে। সমাজসংসারে নারীর সঙ্গে পুরুষের
সম্পর্ক এবং নারীর সমাজনিয়ন্ত্রিত ও পরিবার-নির্ধারিত ভূমিকা সত্ত্বেও প্রতিটি উপন্যাসেই
প্রত্যেক প্রধান প্রধান নারী একেটি মানবসত্তা রূপেই উজ্জ্বল ভাবে অধিষ্ঠীত। উত্তম
পুরুষের সেলিনা ও নিহার ভাবী, প্রসন্ন
পাষাণের তিশনা, প্রেম একটি লাল গোলাপের রানু, পদতলে রক্ত-র রেখা...প্রত্যেকেই আশ্চর্য মানবী!
প্রেম একটি লাল গোলাপ উপন্যাসটিকে বলতে পারি তাঁর
প্রতিনিধিত্বমূলক উপন্যাস। আজকের পাঠক যদি রশীদ করীমের আর কোনো উপন্যাস না পড়ে
কেবল এই রচনাটিই পাঠ করেন তাহলেও রশীদ করীমের রচনাশৈলী ও কাহিনী বুননের এবং
চরিত্রসমূহের জটিল মনোজগতের রসাস্বাদন করতে পারবেন। নারী-পুরুষের পরস্পরের প্রতি
সহজাত আকর্ষণ এবং স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের ভেতর সন্দেহ ও অবিশ্বাস নিয়ে হাজারো
উপাখ্যান রচিত হয়েছে। কিন্তু প্রেম একটি লাল গোলাপ তার ভেতর জীবন্ত টকটকে লাল
গোলাপের মতোই সুঘ্রাণময় এবং শিল্পসৌন্দর্যশোভিত। ভালোবাসা কোনো বায়ুভুক বিষয় নয়, এর সঙ্গে রক্তমাংসের শরীরী অস্তিত্ব সম্পর্কিত। এসত্যটি
গোপন না করে শিল্পসম্মত উপস্থাপন উপন্যাসে জরুরি। একাজটি দক্ষতার সঙ্গে করেছেন
রশীদ করীম। তাই বিদেশি উচ্চমানের চলচ্চিত্রের মতো তাঁর উপন্যাসে বেডসিনের আভাস আছে, উচ্চকিত প্রকাশ নেই, আছে পূর্বরাগ। উপন্যাসের লেখক-নায়কের জবানিতে বলা হয়েছে-- ‘মানুষের জটিল ও অবাধ্য আচরণ নিয়ে সব মানুষই বিব্রত।’ স্বামী-স্ত্রীর আবেগের সম্পর্ক এবং সম্পর্কের টানাপোড়েন
নিয়ে একটি উপন্যাস রচিত হবে আর তাতে শারীরিক মিলনের প্রসঙ্গটি অনুপস্থিত থাকবে-- এটা তো অসম্ভব। এমন অনাধুনিকতার কথা তিনি নিশ্চয়ই
কল্পনাতেও আনতে পারতেন না।
প্রেম একটি লাল গোলাপের উপাখ্যানের শুরু স্বাধীনতার
অব্যবহিত পরের কালপর্বকে ঘিরে হলেও লেখক আসলে ফ্ল্যাশব্যাকে শুনিয়েছেন রানুর
কাহিনীটি। ফলে উপন্যাসের পটভূমি ষাটের দশকের শেষার্ধ। বাঙালি সমাজ, বিশেষ করে শিক্ষিত আধুনিক মধ্যবিত্ত পরিবারের চিত্র তাতে
মেল, সেইসঙ্গে পুঁজিসর্বস্ব উচ্চবিত্ত
অভিজাত সমাজের আভাসও বিদ্যমান। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের একজন চাকুরেকে কীভাবে তাঁর
ওপরঅলাকে সন্তুষ্ট রাখতে হয়, এই
প্রক্রিয়ায় কীভাবে নীতি ও আদর্শ মাঝসমুদ্রে সাম্পনের মতো দুলে ওঠে তার একটি চমৎকার
উদাহরণ এই উপন্যাস। চাকরিদাতার সঙ্গে চাকরিগ্রহীতার স্ত্রীর প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য
সম্পর্কের খুব ভেতরের শাঁস তুলে আনেন লেখক। দাম্পত্য ভালোবাসার অন্য ধরনের উদ্ভাসন
মেলে তাতে। ‘প্রেম’ একটি লাল গোলাপই বটে, তবে
তা সুতীক্ষ্ম কাঁটাবিহীন নয়। ভদ্রতা ও শিষ্টাচারের আড়ালে প্রাপ্তবয়স্ক
নারী-পুরুষের গোপন গহীন মনে থাকে গ্রাসী কামতৃষ্ণা। সে তৃষ্ণা কত বিচিত্রভাবেই না
তৃপ্ত/অতৃপ্ত থাকতে পারে। পরিমিতি ও শিল্পবোধ-- উচ্চাঙ্গের সাহিত্যসৃজনের বেলায় দুই অপরিহার্য অনুষঙ্গ। এ ক্ষেত্রে তাঁর
পরিচয় পেয়ে আমাদের বিস্ময় বাড়ে। প্রেমিক-স্বামীর ঈর্ষাদগ্ধ এবং অসহায়ত্বের একটি
দৃষ্টান্ত এখানে তুলে দিচ্ছি।
চওড়া কাঁধ রানুর। দর্জিদের ডামির মতো সরু হয়ে নেবে এসেছে
কোমরের ওপর। তার দুটি স্তন,-- কিন্তু
কি আর বলবে উমর নিজের স্ত্রীর স্তন সম্পর্কে। শুধু এটুকুই বলতে পারে, যে স্তন দুটিকে সবসময় এত আপন মনে হয়েছে, এই মুহূর্তে, কে জানে কেন, তা
আর মনে হচ্ছে না। খানিকটা হাতছাড়া হয়ে গেছে।
এদেশে ঈদসংখ্যা প্রকাশের সূচনা আগে হলেও স্বাধীনতার পর
তাতে বিশেষ গতি সঞ্চারিত হয়। সে সময়কার একটি বাস্তবচিত্র ধরা আছে এ উপন্যাসে।
মাত্র কুড়ি দিনের ভেতর একটি উপন্যাস রচনার জন্য সম্পাদক পীড়াপীড়ি করছেন লেখককে।
ঔপন্যাসিক-সম্পাদকের কথোপকথন বেশ কৌতূহল-উদ্দীপক। উপসংহারে একটি কথা না বললেই নয়, রশীদ করীম সাম্প্রতিককালে হয়তো ব্যাপকভাবে পঠিত হননি।
যদিও তাঁর শিল্পরসসিক্ত প্রতিটি উপন্যাসই সুখপাঠ্য।
0 মন্তব্যসমূহ