স্মরণ : শতবর্ষে জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী : পত্রিকা থেকে


শতবর্ষে জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী

তিনি শব্দের জাদুকর। বারো ঘর এক উঠোন’-এর স্রষ্টা। বাংলা সাহিত্যের উপেক্ষিতসাহিত্যিক জ্যোতিরিন্দ্র নন্দীর শততম জন্মদিন আজ, ২০ অগস্ট। রবীন্দ্রনাথের প্রয়াণ মাস এখনও শেষ হয়নি। এরই মধ্যে জ্যোতিরিন্দ্র নন্দীর জন্মদিন মনে রাখবে কে? ছোটগল্পে এক নতুন সাম্রাজ্যের নির্মাণ করেছিলেন জ্যোতিরিন্দ্র। তাঁর স্ত্রী এক সাক্ষাতকারে জানিয়েছিলেন, তিনি বিয়ে করতে গিয়েছিলেন ময়লা ধুতি-পাঞ্জাবি পড়ে। এমনই ছিলেন মলিন মানুষ’-এর রূপকার। বাংলাদেশের কুমিল্লার ব্রাহ্মণবেড়িয়ায় জন্মেছিলেন তিনি।
পড়াশোনা করেছেন স্থানীয় স্কুলে। কুমিল্লার ভিক্টোরিয়া কলেজ থেকে বিএ পাশ করে কলকাতায়। চাকরি জীবনের শুরু টাটা এয়ারক্র্যাফট থেকে। জে ওয়াল্টার টমসন, আজাদ হয়ে যুগান্তর পত্রিকায়। সেখান থেকে জনসেবক। জ্যোতিরিন্দ্র নন্দীর প্রথম গল্প খেলনা’, অনেকে বলেন তাঁর লেখায় রয়েছে প্রগতিশীলতা। কেউ বলেন তাঁর লেখা পিছিয়ে পড়া জীবনের মানে খোঁজে। কারও কাছে তিনি উত্তরণের দিশা। কেউবা তাঁর লেখায় আত্মমগ্নতা খুঁজে পান। তাঁর প্রথম উপন্যাস সূর্যমুখীআলোড়ণ ফেলেছিল বাংলা সাহিত্যে। জ্যোৎস্না রায় ছদ্মনামে লিখেছেন তিনি। তাঁর গল্পসংগ্রহ আজ কোথায় যাবেনসাহিত্যে নতুন মাত্রা যুগিয়েছিল। তবুও শতবর্ষে তাঁকে নিয়ে কোনও উদ্যোগ নেই। না আছে সরকারের, না কোনও বেসরকারি সংগঠনের। বাংলা সাহিত্যে তাঁর মতো প্রতিভা বিরল। হয়ত আজও অনেক উদযাপণ থাকবে। তবুও জ্যোতিরিন্দ্র নন্দীকে নিয়ে কেউ ভাবেননি। সুন্দরের জাদুকরজ্যোতিরিন্দ্র হয়ত ব্রাত্য থেকে যাবেন। তিনি লিখেছিলেন এই তার পুরস্কার’, এখন মনে হয় ভবিষ্যতদ্রষ্টা ছিলেন বাংলা সাহিত্যের এই কারিগর।
--এখন কলকাতা


শতবর্ষে জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী
বছর আগস্ট মাসের 20 তারিখে জন্মশতবর্ষে পা-রাখলেন প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক প্রয়াত জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী৷ জ্যোতিরিন্দ্রর জন্ম ইংরেজি 1912 সালের 20 আগস্ট ৷ বাংলা 1319 সনের 4 ভাদ্র৷ অবিভত্তু বঙ্গের কুমিল্লা জেলায়৷ তাঁর মাতামহ ছিলেন কুমিল্লা শহরের পোস্টমাস্টার৷ ওখানেই পোস্ট অফিস-সংলগ্ন মাতামহর কোয়ার্টারে তাঁর জন্ম৷ তবে পৈতৃক বাসভূমি ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়৷ বাবা সেখানে ওকালতি করতেন৷ বছর আটেক বয়সে প্রথাগত শিক্ষার জন্য তিনি ওখানেই এক মাইনর সুকলে ভরতি হন৷ কিন্তু শৈশব থেকেই তিনি ছিলেন আলাদা৷ আর পাঁচটা শিশুর মতো নয়৷ সবসময়ই কী ভাবেন৷ কী দেখেন৷ মুখে হাসি নেই৷ কথা নেই৷ চুপচাপ, শান্ত৷ খেলাধুলা করে না, ভুলেও কোনও শিশুর সঙ্গে মেশে না, এমনই  নিশ্চুপ শিশু এই ধনু৷ ধনু অর্থে জ্যোতিরিন্দ্র৷ জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী৷ ধনু তাঁর ডাক নাম৷

এই বয়সে বাচচারা হুটোপাটি করে৷ সারাক্ষণ তাঁদের ছুটোছুটি লেগেই আছে৷ এটার জন্য বায়না, ওটার জন্য কান্নাকাটি, খেলনা পেলে খাবার পেলে মহাখুশি৷ মেলায় যাওয়ার নাম শুনলে আহ্লাদে নাচতে থাকে৷ এ ছেলে তো তা নয়৷ চার বছরের ছেলের এত ভাবনা কোথা থেকে আসে৷ কী ভাবছিস, মা জিগ্যেস করে৷ তারপর  ঠাকুর্-ঠানদি জিগ্যেস করে৷ তারপর কাকারা পিসিরা৷ উঁহু, উত্তর দেবে কে? রা নেই ছেলের মুখে৷ ড্যাবড্যাব করে পুকুরঘাটের দিকে তাকিয়ে৷ খেজুর আর ডালপালা ছড়ানো একটা ঝুপসি গাছের পেছনে লাল দগদগে আকাশ ৷ সূর্য অস্ত যায়৷

নিজের শৈশব সর্ম্পকে এভাবেই লিখেছেন জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী৷ আসলে শৈশবের সে বয়সে শিশু-আকর্ষণকারী কোনও বিষয়েই তাঁর টান ছিল না৷ না হলে তিতাস নদীর বুকে প্রতিমা-ভাসান দেখা বা তিতাসের বুকেই পয়লা ভাদ্রের নৌকা-দৌড় প্রত্যক্ষ করার জন্য নদীর পাড়ে যে উপচে-পড়া আবালবৃদ্ধবনিতার ভিড়, সে-ভিড়ে আর পাঁচটা শিশুর মত ভালো জামা-প্যান্ট পরে পরিবারের সঙ্গে উপস্থিত হলেও সে দৃশ্য তাঁকে মুগ্ধ করতে পারেনি৷ আসলে কোন দৃশ্য বা কোন শব্দ, কীসের অভিজ্ঞতা বা কীসের গন্ধ যে তাঁকে আনন্দ দেওয়ার  জন্য অপেক্ষা করছিল তা তিনি নিজেও জানেন না৷ জানলেন একদিন, সকালে সূর্য ওঠার আগে বেরিয়ে যখন শহরের শেষসীমায় রেললাইন পার হয়ে ধানখেত পাটখেত দেখতে দেখতে একটা খালের প্রান্তে এসে পৌঁছলেন৷ আর পৌঁছতেই অদ্ভুত এক গন্ধ৷ ব্যস কী করে যে ভালো লেগে গেল! প্রথমে দৃশ্য পরে গন্ধ৷ এবং এরও পরে টুকরো টুকরো কত যে অভিজ্ঞতা! শৈশবের এই অভিজ্ঞতা ও ভালো লাগা সেই গন্ধই পরবর্তী জীবনে সাহিত্য রচনা করতে তাঁকে সাহায্য করল৷

এই যে শব্দ-স্পর্শ-গন্ধ এবং শৈশবের ধারণা--এই বিশ্বাসই পরবর্তীকালে জীবন সম্পর্কে জোতিরিন্দ্রর দৃষ্টিভঙ্গি নির্দিষ্ট করেছে৷ রুশ কথাসাহিত্যিক ফিওদর দস্তয়েফ৲স্কির কথায় , শৈশবে যে ধারণা ও বিশ্বাসগুলি মানুষের মনে অজ্ঞাতসারে দাগ রেখে যায় পরিণত বয়সে সেগুলিই জীবন সম্পর্কে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি নির্দিষ্ট করে৷ জ্যোতিরিন্দ্র নন্দীর এসব পাঠ ছিল৷ আর ছিল বলেই শৈশবের ওই শব্দ-স্পর্শ-গন্ধ, বিশ্বাস ও ধারণার নির্যাসকে তিনি ঘোলাজলে স্পর্শ করতে যাননি৷ থিতিয়ে এসে পলি পড়লেই তবে তাতে চোখ ফিরিয়েছেন৷ ফলে মীরার দুপুর, সূর্যমুখী থেকে বারো ঘর এক উঠোন,প্রেমের চেয়ে বড় বা এই তার পুরস্কার ইত্যাদি উপন্যাস বা গিরগিটি, ‘বনের রাজা, ‘তিন বুড়ি, ‘সমুদ্র, ‘ভাত, ‘অজগর, ‘নদী ও নারী, ‘মঙ্গল গ্রহ, কিংবা ছিদ্র, ‘ক্ষুধা, ‘হিমির সাইকেল শেখা, ‘বিকেলের খেলা, ‘পার্বতীপুরের বিকেল, ‘ বুনো ওল, ‘শয়তান, ‘আম কাঁঠালের ছুটি, ‘সোনালি দিন, ‘বনানীর প্রেম, ‘শালিক কি চড়ুই, ‘তারিণীর বাড়িবদল, ‘পালিশ, ‘সামনে চামেলি, ‘বুটকি ছুটকি, ‘খেলনা, ‘লেডিজ ঘড়ি, আজ কোথায় যাবেন-এর মতো অজস্র গল্পে সেই থিতিয়ে পড়া পলির ভেতরেই যেন জীবনের নির্যাসকে খোঁজার প্রচেষ্টা চালিয়েছেন৷ 

প্রথম জীবনে সুকলে পড়ার সময়ে কবিতা দিয়েই তাঁর লেখালিখির শুরু৷ কাঁচা হাতের সে-পদ্যই তখন তাঁর সাহিত্যের অভিমুখ৷ একটা খাতাও বানিয়ে ফেলেছিলেন শুধু কবিতা লিখবেন বলে৷ নাম দিয়েছিলে তার ঝরনা৷ কিন্তু অচিরেই সেই ভুল ভাঙল৷ সুকলে আবৃত্তির জন্য উপহার পাওয়া রবীন্দ্রনাথের গল্পগুচছ তাঁকে গদ্যের জগতেই ভাসিয়ে নিয়ে গেল৷ শুরু হল গদ্যচর্চা৷

1930-এ ব্রাহ্মণবাড়িয়া অন্নদা হাইসুকল থেকে তিনি ম্যাট্রিকুলেশনে উত্তীর্ণ হন৷ ভরতি হলেন আইএসসি-তে৷ কুমিল্লার ভিকটোরিয়া কলেজে৷ ওই সময়েই ঢাকার সাপ্তাহিক পত্রিকা বাংলার বাণী-তে তাঁর অনূদিত মোপাসাঁর একটি গল্প প্রকাশিত হয়৷ এটাই তাঁর প্রথম ছাপা গল্প৷ কিছুদিনের মধ্যে ওই সাপ্তাহিকেই তাঁর আর একটি গল্প বেরয়৷ কিন্তু এবারে আর অনুবাদ নয়৷ এবারে একটি মৌলিক গল্প৷ তাঁর নিজের লেখা৷

গত শতকের তিনের দশকেকুমিল্লা যুব সম্মেলন উপলক্ষে সেবারে কুমিল্লায় সুভাষচন্দ্র এসেছিলেন৷ সঙ্গে ছিলেন শরৎচন্দ্রের মতো কথাসাহিত্যিক৷ যুব সম্মেলন উপলক্ষে কবি ও গদ্যকার এবং পূর্বাশা-র সম্পাদক সঞ্জয় ভট্টাচার্য তাঁর সম্পাদিত একটি হাতে লেখা পত্রিকা প্রকাশ করেন৷ সেখানে জ্যোতিরিন্দ্রর একটি গল্প ছিল৷ নাম অন্তরালে৷ গল্পটি শরৎচন্দ্রের খুব ভাল লেগে যায়৷ পরে সেটি কলেজ ম্যাগাজিনে প্রকাশ করেন নারায়ণ চৌধুরী৷ ওই তখন থেকেই তিনি সকলের নজরে পড়ে যান৷ আত্মবিশ্বাস বেড়ে যায় জ্যোতিরিন্দ্র নন্দীর৷ এর পর থেকেই প্রায় নিয়মিত গল্প বেরতে লাগল বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায়৷ ঢাকার বাংলার বাণী ও সোনার বাংলা ছাড়াও কলকাতার নবশত্তিু, সপ্তাহিক সংবাদ ইত্যাদি নানা পত্রিকায়৷

1932-এ আইএসসি পাশ করে বিএ ক্লাসে ভর্তি হওয়ার আগেই সন্ত্রাসবাদী সন্দেহে পুলিস তাঁকে অ্যারেস্ট করে৷ কেন না, স্বদেশি চরমপন্হী আন্দোলনের সমর্থক হয়ে উঠেছিলেন জ্যোতিরিন্দ্র৷ ফলে চারমাস কারাবাসে থাকতে হয় তাঁকে৷ ওই সময়ে কত যে গল্প তাঁর মাথার ভেতরে! কিন্তু লিখবেন কী করে? এমনই রাজরোষে পড়েছিলেন যে,তাঁর লেখার ওপরও নিষেধাজ্ঞা জারি হয়েছিল৷ নির্দেশ এসেছিল যে পত্র-পত্রিকায় লেখা চলবে না৷ জেল থেকে বেরিয়ে কোথাও যাওয়া যাবে না৷ এদিকে মাথায় গিজগিজ করছে গল্প তখন৷ কী করবেন? থাকতে না পেরে বাড়িতে নজরবন্দি অবস্থায়ই জ্যোৎস্না রায় ছদ্মনামে লিখতে শুরু করলেন৷ এরপর নিষেধাজ্ঞা উঠলে 1935-এ তিনি প্রাইভেটে বিএ পাশ করেন৷   পরের বছর 1936- রাইচরণের বাবরি নামে একটি গল্প লেখেন৷ গল্পটি প্রকাশিত হয় কলকাতার দেশ পত্রিকার৷ কিছুদিন বাদেই তিনি কলকাতায় পাড়ি দেন একটা চাকরির জন্য৷ সময়টা 1937-38৷ চাকরি শুধু নয়়, মনে মনে বুঝি বাসনাও ছিল লেখক হওয়ার৷ লিখবেন তিনি৷ কলকাতায় না গেলে কি লেখক হওয়া যায়? অতএব কলকাতায় এসে প্রথমদিকে বেঙ্গল ইমিউনিটি, দৈনিক যুগান্তর, দৈনিক আজাদ ইত্যাদি সংবাদপত্র ইত্যাদি সংবাদপত্র হয়ে পরে টাটা এয়ারক্রাফট বা জে ওয়ালটার থমসন-এ চাকরি নিলেও তাঁর লেখক জীবনের সঙ্গে এই চাকরিকে মেলাতে পারেন নি৷ কিছুদিন পরই তাই ছেড়ে দিয়েছিলেন৷

আসলে জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী ছিলেন আপাদমস্তক একজন লেখক৷ নিঃসঙ্গ এক জীবনশিল্পী৷ তাই তাঁর লেখার পরতে পরতে ফুটে উঠেছে শিল্পেরই সেই না-বলা কথা৷ শিল্পেরই সেই লুপ্ত এক সৌন্দর্য৷ অনন্যসাধারণ এক ব্যঞ্জনা৷ গল্প লিখতে গিয়ে গল্পের যে আখ্যান-কাঠামোটি গড়ে তুলতেন, তাতে রূপকল্প ও অবয়ব নির্মাণে তিনি এতটাই পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতেন যে, সেই পরীক্ষার ভেতরেই নিজের স্বাচছন্দ্য টের পেতেন৷ ফলে গল্পের এই মজায় থাকতে গিয়ে উপন্যাস লিখতে একটু দেরিই করে ফেলেছিলেন৷ কিন্তু তাতে কিছু ক্ষতি হয় নি তাঁর৷ বরং বাংলাসাহিত্য পেয়েছে কিছু অসাধারণ ছোটগল্প ও সেই সঙ্গে ব্যতিক্রমী কিছু উপন্যাস৷ সূর্যমুখী, ‘মীরার দুপুর, ‘বারো ঘর এক উঠোন, ‘প্রেমের চেয়ে বড় বা এই তার পুরস্কার-এর মতো উপন্যাস৷

মনে আছে সত্তর দশকে, গোটা কলকাতা জুড়েই যখন নৈরাজ্যের কালো ছায়া, কলকাতা যখন যুবহত্যার লীলাভূমি,আর সেসব নিয়ে খ্যাত-অখ্যাত সব লেখকই যখন রাতারাতি গল্প-উপন্যাস লিখতে ব্যস্ত, জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী ঠিক তখনই লিখলেন বিকেলের খেলা নামে একটি গল্প৷ যে-গল্পের শুরুতেই রয়েছে, কলকাতার একটি রাস্তা খঁুড়ে গর্তের ভেতরে নেমে টেলিফোনের কর্মীরা অসংখ্য সরু সরু তার আলাদা করে লাইনের কাজ করছে৷ কিন্তু এই দৃশ্যকে গোড়াতেই জ্যোতিরিন্দ্র দেখলেন এ-ভাবে–‘ওরা কলকাতার বুক চিরে নাড়ি-নক্ষত্র দেখার চেষ্টা করছে৷ এ তো শুরু৷ কিন্তু গল্প যখন শেষ হল তখন ওই গল্পের শরীরে ভয়ংকর এক দামামা৷

জ্যোতিরিন্দ্রর গল্পে এক ধরনের যৌনতা আছে৷ কিন্তু তা প্রচলিত যৌনতা নয়৷ এ যৌনতা এসেছে এক সৌন্দর্যচেতনা থেকে৷ ফলে জ্যোতিরিন্দ্রর সাহিত্যের যৌনতা সৌন্দর্যচেতনার সঙ্গে মিশে গিয়ে যেন এক ভিন্ন মাত্রা তৈরি করেছে৷ তখন যৌনতার আবরণ খসে গিয়ে পদ্মপাতায় একবিন্দু শিশিরের মতো কেবল সৌন্দর্যই টলমল করে৷
কেউ কেউ তাঁর সাহিত্যে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রভাবের কথা বলেন৷  কিন্তু বেঁচে থাকতে কথা বলে দেখেছি,জ্যোতিদা নিজে ব্যাপারটা স্বীকার করতেন না৷ তা স্বীকার করার মতো ব্যাপারও নয়৷ দু-জনে দু-রকম ধারার লেখক৷ এ ছাড়া, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা ওঁর খুব পছন্দেরও ছিল না৷ তবে একটা বিষয়ে দু-জনেরই মিল আছে৷ তা হলমানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো জ্যোতিরিন্দ্রও কোনও চরিত্র পেলে তার গভীরে ছঁুচের মতো ঢুকে থাকেন৷

জ্যোতিরিন্দ্র নন্দীর জীবনে মায়ের চেয়ে বাবার প্রভাবই বেশি ছিল৷ এটা মৃতু্যর আগে আমাদের মতো অনেকের কাছেই তিনি বলেছেন৷ বাবা তাঁর লেখা পছন্দ করতেন৷ বাবা ছাড়াও আর একজন তাঁর লেখা পছন্দ করতেন৷ তিনি তাঁর স্ত্রী পারুল৷ পারুল নন্দী৷ 1946 সালে তাঁদের বিয়ে হয়৷ তিনিও শিল্পী ছিলেন৷ সেতার বাজাতেন৷ ফলে স্বামীকেও তিনি শিল্পী হিসাবেই গ্রহণ করেছিলেন৷ তাঁর সঙ্গ ও নিঃসঙ্গতায় তিনিও ছিলেন তাঁর যোগ্য সঙ্গী৷
প্রায় 70 বছর বেঁচেছিলেন জ্যোতিরিন্দ্র৷ শেষ সময়ে অন্ত্রের ক্যানসারে ভুগছিলেন৷ একটা অপারেশনও হয়েছিল৷ কিন্তু তাতে রোগের কোনও সুরাহা হয় নি৷ 1982 সালের 2 আগস্ট কলকাতার এক নার্সিংহোমে তিনি প্রয়াত হন৷

জ্যোতিরিন্দ্র নন্দীর প্রকাশিত গ্রন্হের সংখ্যা প্রায় 75৷ প্রথম প্রকাশিত গল্পগ্রন্হ খেলনা৷ কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, দু-একটা বই ছাড়া তাঁর কোনও গ্রন্হই এখন আর পাওয়া যায় না৷ মীরার দুপুর ও অন্যান্য দু-একটি গ্রন্হ ছাড়া আর কোন গ্রন্হ দ্বিতীয় সংস্করণের মুখও দেখেনি৷ হয়তো এই নিয়ে তাঁর ভেতরে একটা হতাশা কাজ করত৷ পাঠক পেতেন না বলে এক-একসময় যেন মুষড়েও পড়তেন৷ কিন্তু যেই না নতুন লেখা মাথায় এল, অমনি ভেতরে যেন বিস্ফোরণ ঘটত৷ তখন কে পাঠক আর কোথায় হতাশা! নিজের আনন্দেই সৃষ্টির কাজে ফের বিভোর হয়ে পড়তেন৷

বরাবরই তিনি ছিলেন নিঃসঙ্গ৷ তাঁর সমসাময়িক লেখক সন্তোষকুমার ঘোষ, গৌরকিশোর ঘোষ, নরেন্দ্রনাথ মিত্র,বিমল কর, সমরেশ বসু এঁদের সকলের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ছিল খুব কাছের৷ কিন্তু এ-সবের মধ্যেও তিনি ছিলেন একা৷ এমনই নিঃসঙ্গ যে, যখন চিন্তায় মগ্ন থাকতেন, তখন কারও উপস্থিতিই বুঝি পছন্দ হত না৷

জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী চলে গিয়েছেন আজ 30 বছর৷ দেখতে দেখতে তাঁর জন্মের শতবর্ষও চলে এল৷ এ-সময়ে তাঁকে নিয়ে অনেক আলোচনাই হচেছ৷ ইতিমধ্যে দু-একটি পত্রিকা তাঁর ওপরে বিশেষ সংখ্যাও প্রকাশ করেছে৷ হয়তো শতবর্ষ উপলক্ষে আরও কিছু আলোচনা যুত্তু হবে৷ কিন্তু যে-কথাটা বলা ভীষণ জরুরি, জ্যোতিরিন্দ্র নন্দীর বই কিন্তু ক্রমশই প্রকাশনা জগত থেকে লুপ্ত হয়ে যাচেছ৷ চাইলেও পাব না৷ কিন্তু কেন? শোনা যায় তাঁর বই নাকি সে-ভাবে বিক্রি হয় না৷ কিন্তু কীভাবে বিক্রি হলে এমন একজন লেখকের বই প্রকাশনার বাজারে থাকতে পারে? তা ছাড়া পাঠকের হাতে তুলে দেওয়ারও তো একটা দায়িত্ব থেকে যায়! সে-দায়িত্ব কার? বিক্রি হয় না বলে কি, ভাল বই হলেও, প্রকাশক সে-বই থেকে মুখ ঘুরিয়ে থাকতে পারেন? আর, ভাল বই কি মুড়ি-মুড়কির মতো বিক্রি হয়? সম্ভবত না৷ 


শততম জন্মদিন
আজ ২০ অগস্ট, আজ কোথায় যাবেন? সার্ধশতবার্ষিক রবীন্দ্রনাথের প্রয়াণমাস এখনও শেষ হয়নি। শত শত উদ্যাপনের দুএকটি থাকবে নিশ্চয় আজও। তবু, একটু অন্য পথে, মার্বেল বাঁধানো সিঁড়ি আর চকমিলানো উঠোনের একটু বাইরে যদি ভাবে এ কলকাতা মনে পড়বে হয়তো, ‘বারো ঘর এক উঠোন’-এর কথা। আর, মনে পড়বে, আজ, জ্যোতিরিন্দ্র নন্দীর শততম জন্মদিন। কেউ তাঁকে বলেন সুন্দরের কারিগর’, কেউ বলেন, ‘শব্দের জাদুকর। কারও ভাবনায় চমক দেয় তাঁর প্রগতিশীলতা, কেউ খুঁজে পান মর্বিডিটি। কারও কাছে তিনি আত্মমগ্ন, কারও কাছে উত্তরণের দিশা। বাংলা সাহিত্যের বহু বিতর্কিত কিন্তু উপেক্ষিত ছোটগল্পকার, ঔপন্যাসিক জ্যোতিরিন্দ্র নন্দীকে আজও কোনও সমগ্রতায় পাওয়া যায় না বইপাড়ায়। ছোটগল্পকার জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী প্রায় এক সাম্রাজ্যের অধীশ্বর। কিন্তু সাহিত্যের সেই ঔজ্জ্বল্য জীবনে ছিল না তাঁর। তিনি যেন এক মলিন মানুষ’, এমনকী, পত্নীর স্মৃতি জানাচ্ছে, তিনি বিয়ে করতেও গিয়েছিলেন ময়লা ধুতি আর পাঞ্জাবি পরে! অধুনা বাংলাদেশের কুমিল্লার ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় শৈশব-কৈশোর কেটেছে, পড়েওছেন ওখানকার স্কুলে। বি এ পাশ করেছেন কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ থেকে। কর্মজীবন পুরোপুরি কলকাতায়, টাটা এয়ারক্র্যাফট, জে ওয়াল্টার টমসন, আজাদ, যুগান্তর, জনসেবক। প্রথম গল্প খেলনা’, প্রথম উপন্যাস সূর্যমুখী। জ্যোৎস্না রায় ছদ্মনামেও লিখতেন। আজ কোথায় যাবেন’-এর মতো গল্পসংগ্রহ, ‘বারো ঘর এক উঠোন’-এর মতো উপন্যাস বাংলা সাহিত্যেই বিরল। তবু এই শতবর্ষেও তাঁকে নিয়ে তেমন উদ্যোগ নেই। কে জানে সেই বিস্ময় রয়ে গিয়েছিল তাঁর আর এক উপন্যাসের নামেই কি না এই তার পুরস্কার!
 
--আনন্দবাজার কড়চা

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ