সন্দীপন মজুমদার
নভেম্বর, ১৯৯৮
একটা সাধারণ কথার ভিতর এতটা নখ-দাঁত
বের করা নিষ্ঠুরতা থাকে? ‘অনুপ, তোমার টেলিফোন এসেছে’, এই সরল বাক্যটি তার ধাতব
কাঠিন্য-সহ গত এক বছরের মধ্যে এই দ্বিতীয় বার উচ্চারিত হল। বাবলুদের বাড়ির সিঁড়ি
দিয়ে ফোনটা ধরার জন্য উঠতে উঠতে অনুপের মনে পড়ল গতবারও ফোন আসার খবরটা দোতলার
বারান্দা থেকে মুখ বাড়িয়ে মাসিমা মানে বাবলুর মা-ই দিয়েছিলেন।
সিঁড়ির ল্যাণ্ডিং থেকে দোতলার ডাইনিং-এর কোনায় রাখা টেলিফোনটা পর্যন্ত পৌঁছতে পৌঁছতে মেঝের খোপকাটা মোজাইকের চৌখুপির নিরর্থকতার ভিতর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতেই অনুপ বাবার মৃত্যুসংবাদটা পেয়ে গেছিল। বিশেষত, মাসিমার সদারুষ্ট মুখমণ্ডলেও একটা ‘আহা বেচারি’ গোছের কৃপাবর্ষণ অনুপের জন্য যখন সঞ্চিত হচ্ছিল।
সিঁড়ির ল্যাণ্ডিং থেকে দোতলার ডাইনিং-এর কোনায় রাখা টেলিফোনটা পর্যন্ত পৌঁছতে পৌঁছতে মেঝের খোপকাটা মোজাইকের চৌখুপির নিরর্থকতার ভিতর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতেই অনুপ বাবার মৃত্যুসংবাদটা পেয়ে গেছিল। বিশেষত, মাসিমার সদারুষ্ট মুখমণ্ডলেও একটা ‘আহা বেচারি’ গোছের কৃপাবর্ষণ অনুপের জন্য যখন সঞ্চিত হচ্ছিল।
গত বারের ফোনটা এসেছিল বাবার
কর্মক্ষেত্রে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ার সংবাদ নিয়ে। তার পর হাসপাতাল, স্যালাইন, ইঞ্জেকশন ইত্যাদি। ছুটি দেবার সময় ডাক্তারবাবু মুচকি হেসে বলেছিলেন,
‘লাকি চ্যাপ। একেবারে
যমের দুয়োর থেকে ফিরে এলেন।’ তার পর বাবার সেই বইয়ের দোকানের চাকরি থেকে এক মাসের বেতনহীন ছুটি। গত
আট-দশ মাসের ভিতরই অনুপ টের পেয়ে যায়, বাবার ওই ন্যুব্জতা
দেখেই হয়তো যা ছিল সামগ্রিক, যে আবার ফোন আসবে। ‘ঘাট খরচ ইত্যাদি যা হয় আমরাই দিয়ে
দেব’, মালিক নাকি
মালিকের ছেলে, ফোনের ইথারীয় দূরত্বের মধ্য দিয়ে যতটা
সহৃদয়তা প্রকাশ করা যায় সে ভাবেই বলেছিল। ফোনটা রাখার পরই মাসিমা বলেছিলেন,
‘বন্ধুদের খবর দেবে তো।
ফোন করতে হলে কর না’। ‘না মানে পাড়াতেই তো সব...’ উত্তর শেষ না হতে হতেই মাসিমা
আশ্চর্য দ্রবীভূত গলায় বললেন, ‘হ্যাঁরে, দুপুরের খাওয়া-দাওয়া হয়ে গেছে তো? এ কথায় অনুপ
হঠাৎ ছাতিমফুলের গন্ধ পেল।
সেই মুহূর্তে অনুপের মনে পড়ল, এই মাসিমাই তাকে তোর্ষার
সঙ্গে কথা বলতে বারণ করে দিয়েছেন মাত্র কিছু দিন আগে। অনুপের বন্ধু, যদি বন্ধুই বলা যায় বাবলুকে, সেই বাবলুর
জ্যাঠতুতো বোন তোর্ষা। তোর্ষার বাবা কলেজে পড়ান কলকাতায়। তোর্ষা লা মার্টস-এ পড়ে,
প্রতিবার গরমের ছুটিতে এখানে আসে। অনুপ জানে তোর্ষা একজন অন্য
গ্রহের প্রাণী। ওর সঙ্গে অনুপ কখনও দেড়খানা বাক্যর বেশি কথা একসঙ্গে বলেছে কিনা
সন্দেহ। তাও তখন বাবলু মানে তীর্থঙ্কর এখানে ছিল, পরে তো
চলে গেল যাদবপুরে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে। এক বারই শুধু ব্যতিক্রম হয়েছিল, যখন অনুপ ভাল আঁকে শুনে তোর্ষা ওর আঁকা দেখতে চেয়েছিল আর অনুপ গোটা
কুড়ি ছবি নিয়ে হাজির হয়েছিল বাবলুদের বাড়িতে। সে দিন অনুপ কথা বলতে বলতে মনের ভিতর
অনেক জমে থাকা নুড়ি পাথরের স্থানচ্যুত হওয়া টের পেয়েছিল। তোর্ষা যে হাসতে হাসতে
বার বার স্থানচ্যুত ওড়না ঠিক করে নিচ্ছিল এবং ঘরে আর কেউ ছিল না— অনুপ এতে পুরুষের একাকীত্বের
বেদনার স্বীকৃতিকে দেখেছিল। মাসিমা সে দিন বাড়ি ছিলেন না। কে ওঁকে নালিশ করল কে
জানে, অনুপকে তো এত বছর ধরে উনি দেখছেন, যখন ক্ষোভের সঙ্গে উনি বললেন, ‘সারা দুপুর ধরে, তুমি একটা কলেজে পড়া ছেলে, একটা সতেরো বছরের মেয়ের সঙ্গে একা একা গল্প করলে!’ অনুপের মনে হচ্ছিল তার
আত্মরতিময় গোপন বেদনার উৎসটাকে কেউ চড়া রোদ্দুরে ফেলে পরীক্ষা করছে।
বাবাকে শ্মশানে দাহ করার সময় থেকে
পারলৌকিক কাজ শেষ হওয়া পর্যন্ত সময়টাতে যত জনের সঙ্গে মোলাকাত হল তার নব্বই শতাংশ
লোকই বলে গেল, ‘তোমার কাঁধে এখন গোটা সংসারের বিরাট
দায়িত্ব। বাবা যে চৌকিটাতে শুত সেখানেই পরের রাত থেকে শুতে আরম্ভ করল অনুপ। বাবার
ফেলে যাওয়া শূন্যতাকে শরীরে অনুভব করল সে। অনুপ জানে যে, নিজে যদি বি-কম পাসও করে
কোনও রকমে, কোনও লাভ নেই। বরং ভাইটাকে যদি ভাল ভাবে পড়ানো
যায়। অঙ্কের মাথাটা খারাপ নয়, সামনের বছরই মাধ্যমিক দেবে
অরূপ। এ সব ভাবনার ভিতরই অনুপ মাঝরাতে বিছানায় উঠে বসে দেখে, ঠাণ্ডা বাতাসের একটা দমক ঘরের মধ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে, এক ঘর থেকে আর এক ঘরে, এমনকী বাথরুমে গিয়েও সে
টের পায় সেটা। বোঝে শীত এসে গেল। বড্ড তাড়াতাড়ি।
অক্টোবর, ২০০২
রাস্তাঘাটে কেমন পুজো পুজো গন্ধ, উচ্ছল মানুষের চলাফেরায়
মালিন্যমুক্তির আভাস। এই সময়টায় প্রতি বছরই অনুপের মনে হয় জীবন হয়তো পাল্টে যেতে
পারে। দু’চারটে
লটারির টিকিট কাটে সে। মনে হয় পুঁজিটুজি পেয়ে গেলে, জবরদখল করা খাস জমিতে সন্ত্রস্ত দোকানদারি ওরফে
হকারি করা নয়, বটতলার মোড়ের মার্কেট কমপ্লেক্সটায় একটা ঘর
কিনে ঝাঁ চকচকে একটা দোকান খুলে ফেলবে ও। মনে হয় কোনও জাদুমন্ত্রবলে ওর অবিবাহিত
দিদির বিয়ে না হোক, একটা প্রাইমারি স্কুলে চাকরি হয়ে
যাবে। অরূপটা বিল্ডিং মেটেরিয়ালস সাপ্লাইয়ের ব্যবসাটায় এমন লাভ করবে যে, নিজেই প্রোমোটারি শুরু করে দেবে। করছি, করব
বলে যেটা হচ্ছে না, মায়ের সেই ইউট্রাসের টিউমারটাও
অপারেশন করানো যাবে কোনও নার্সিংহোমে। যদি কিছু নাও হয়, ওর
দোকানের স্টেশনারি মালের বিক্রিবাটা প্রতিদিনের দু-আড়াইশো টাকা থেকে বেড়ে যদি
পাঁচ-ছ’শো
টাকাতেও পৌঁছয়।
আগে প্রতি শুক্রবার দোকান বন্ধের দিন
অরূপ ক্লাবঘরে তাস পিটত, অথবা টিভি দেখত। গত এক মাস ধরে রুটিনটা পাল্টে গেছে। এখন প্রতি
শুক্রবার ও নিয়ম করে যাচ্ছে ‘হকার উচ্ছেদ বিরোধী কমিটি’র সভায়। প্রথম লিফলেটটার খসড়া ও-ই লিখেছিল। পড়ার
পর বিরোধী দলের পুর কমিশনার মনোজদা ঘাড় নেড়ে বলেছিলেন, ‘ঠিকই আছে। শুধু ওই বিশ্বায়ন এবং কেন্দ্রীয় সরকার অনুসৃত জনবিরোধী
নীতির কথা একটু জায়গামত ঢোকাতে হবে’। কমিটির ব্যানারে হকার শব্দটা থাকায় অনুপের একটু লজ্জা লাগছিল ওটার
পিছনে মিছিলে হাঁটতে। মিছিলটা ওর পুরনো পাড়া দিয়েও যাবে কিনা। অবশ্য তোর্ষা কী করেই
বা দেখবে, ও তো
কম্পিউটার সায়েন্স পড়ছে বাঙ্গালোরে।
গত বছর এক বার এখানে এসে একেবারে
অনুপের দোকানে হাজির হয়েছিল। ‘অনুপদা, তোমার দোকান দেখতে এলাম।
অনুপ দেখছিল আরও স্রোতবতী হয়েছে তোর্ষা, আরও সজল, সঘন মেঘ এসে ছায়া ফেলেছে সেই স্রোতে। বাবলুর কাছেই শুনেছে অনুপ,
তোর্ষা এক হিন্দু পঞ্জাবি সহপাঠীর প্রেমে পড়েছে। পাস করার পর দু’জনে কিছু দিন চাকরি করার পর বিয়ে
করবে। তোর্ষা মা, দিদি ও ভাইয়ের কুশল জিজ্ঞেস করতে করতেই একটা পারফিউমের শিশি তুলে
নাড়াচাড়া করতে থাকে। অনুপ বলে ফেলে ‘ওটা তুমি রেখে দাও। আমি প্রেজেন্ট করলাম’। ‘না না,
মানে সে কী, এ রকম জানলে আমি আসতামই না’, ইত্যাকার কথা বলতে বলতে
তোর্ষা যখন শেষে বলে, ‘ঠিক
আছে। প্রেজেন্ট করতে হলে একটা জিনিসই দিতে পার, তোমার আঁকা ছবি। আমি নিয়ে আসব তোমাদের বাড়ি থেকে’। তখন অনুপ চুপ করে যায়। তোর্ষা তো
জানে না, কত দিন
রং তুলি নিয়ে বসেনি অনুপ। অনুপ নিজেও কি জানে, কবে ছাড়ল
সে আঁকা? এই ছয় বাই চার ফুট কাঠের দোকানটি আট হাজার টাকা
এবং কিছু প্রভাবের বিনিময়ে পেয়ে চালু করার পর থেকে? নাকি
অরূপকে যে বার পুলিশ তুলে নিয়ে গেল, তার পর থেকে?
অরূপ তখন সবে সাপ্লাইয়ের ব্যবসাটা
শুরু করেছে। দুপুরবেলা বাড়িতে খেতে আসার সময় অনুপ দেখেছিল, ক্লাবঘরের পিছনে ফাঁকা
জায়গাটায় অরূপ আর দুটো ছেলে মিলে একজন প্রোমোটারকে কী সব বলে শাসাচ্ছে। প্রোমোটার
মোবাইল বের করে কাকে ফোন করার চেষ্টা করতেই অরূপ ওকে মারতে শুরু করল। অনুপ ছুটে না
থামালে— অরূপ
তখনও হাঁফাচ্ছিল আর শাসাচ্ছিল। পর দিনই পুলিশ তুলে নিয়ে যায় অরূপকে। মনোজদা থানায়
ফোন করে দেওয়ায় বিশেষ মারধর করেনি পুলিশ। ওসি শুধু এফ আই আর-এর কপিটায় চোখ বোলাতে
বোলাতে বলেছিলেন, ‘কার
গায়ে হাত তুলেছে আপনার ভাই জানেন? কবে বেমালুম ফুটে যাবে, দেখবেন’। পোখরাজের আংটি পরা ওসি-র আঙুলগুলোর
দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে জীবনের অনন্ত সম্ভাবনা এবং একটি অন্ধকার তলহীন কুয়োর
অস্তিত্ব যুগপৎ অনুপের চেতনায় ঢুকে যাচ্ছিল।
জানুয়ারি, ২০০৫
এই সময়টার দিকে অনুপ কত দিন ধরে
তাকিয়ে ছিল। গত তিন বছর থেকেই অনুপ শুনে যাচ্ছিল, এই সময়ে তার ফণীমামা দেশে ফিরবেন আমেরিকা থেকে।
ফণীমামা তার নিজের মামা নন, মায়ের মাসতুতো ভাই। যার গল্প
অনুপ ছোটবেলা থেকেই শুনে আসছে। নিজের বোন না হলেও মাকে নাকি দারুণ ভালবাসতেন। সে
যুগের চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্ট। আমেরিকার উচ্চপদের চাকরি থেকে অবসর নিয়ে দেশে
ফিরলেন। এখানে এসেও একটা বহুজাতিক কোম্পানির সঙ্গে চুক্তিভিত্তিক আর্থিক উপদেষ্টার
কাজ শুরু করলেন। কোম্পানি তাঁকে কলকাতার দক্ষিণে একটা বিরাট ফ্ল্যাটও দিল। এ দিকে,
যা ভাবা গিয়েছিল তাই। বিরাট ফোর্ড গাড়িটায় চেপে এক দিন ফণীমামা
অনুপদের বাড়িতে এসে হাজির। সঙ্গে উপহার হিসাবে বিদেশি ক্যামেরা, পারফিউম, চকোলেট, আরো
কত কী। বোঝা গেল, সব খোঁজখবর নিয়েই এসেছিলেন ফণীমামা।
চা-টা খাবার পরই দু’লাখ
টাকার একটা চেক কেটে অনুপের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন, ‘এর
সঙ্গে কিছু ব্যাঙ্ক লোন নিয়ে একটা মোবাইল ফোনের ছোট দোকান করে ফ্যালো। ভাল লাভ
আছে। কিংবা কম্পিউটারাইজড ইসিজি সেন্টার যদি করতে পারো হাসপাতালের কাছে। লাভ-টাভ
হলে দু’বছর পর থেকে যখন
যেমন পারবে, টাকা
শোধ দিও’।
চেকটা হাতে পাওয়ার পর থেকে অনুপ
বুঝতে পারল বাইরের রোদ্দুরটা কত নরম,
আর সেই রোদ্দুর মাখা জারুল গাছটার গায়ে চেনা কাঠবিড়ালির চলনটা কত
অনায়াস। একটা মোবাইল ফোনের নম্বর দিয়ে ফণীমামা বললেন, সেই
নম্বরে কুড়ি তারিখের পর ফোন করতে। অন্তত, হাজার চারেক
টাকার চাকরি অরূপের জন্য, কোনও প্রাইভেট কোম্পানিতে,
অবশ্যই হয়ে যাবে ফণীমামার সৌজন্যে। সঙ্গে যদি কাজ চালানোর মতো
কম্পিউটার শিখে নিতে পারে অরূপ, তা হলে বছর খানেকের মধ্যে
ওর আয় দ্বিগুণ হবে। দিদির ব্যাপারেও ফণীমামা ভেবেছেন দেখা গেল। যদি বিপত্নীকে
আপত্তি না থাকে বয়স চল্লিশের বেশি নয় অথচ মাসে চল্লিশ হাজার রোজগার এ রকম এক জন
ইনকাম ট্যাক্সের উকিলকে উনি পাপিয়ার ব্যাপারে বলে রেখেছেন। লোকটি নিজে বিশেষ
সুদর্শন নয়, কিন্তু স্বভাবটি ভাল। একটু চেষ্টা করলেই
পাপিয়ার বিয়েটা সেরে ফেলা যাবে। রেজিষ্ট্রি ম্যারেজ হবে। তাই খরচাপাতিরও বিশেষ
দরকার হবে না। ওঠার আগে ফণীমামা বললেন, ‘তোর হেল্থের এত প্রবলেম, একবার টোটাল চেকআপ করিয়ে নে
মিনু। কলকাতাতেই করানো যেত। কিন্তু তুই সাউথে চলে যা। একটু বেড়ানোও হবে, কোনও দিন তো কোথাও গেলি না। আমি দুটো রিটার্ন টিকিট কেটে রাখব এসি টু’টিয়ারের। ওখানে আমার ক্লায়েন্ট
কোম্পানির গেস্ট হাউসে থাকবি রাজার হালে। অনুপ বা অরূপকে নিয়ে ঘুরে আয়’। গাড়িতে উঠে ফণীমামা বললেন, ‘এই শহরটা আমার খারাপ লাগে না। একটা জমিটমি দেখিস তো। একটা বাড়ি করে
রাখব এখানে। তোরাই থাকবি এখন। তার পর বছর পাঁচেকের মধ্যে তোদের নিজেদের একটা বাড়ি
হয়ে গেলে আমিও চলে আসব। বুড়ো বয়সে বড্ড একা একা লাগে। তোদের মামিমা অসময়ে চলে
গেলেন। ছেলেটাও ও দেশে থেকে গেল। এখানে থাকলে বোন আর ভাগ্নেকে তো অন্তত কাছে পাব’।
ফণীমামা চলে যাবার পর অনুপ বুঝতে
পারল সে ঈশ্বরকে দেখেছে। ঈশ্বরকে দেখার পর মানুষের জীবনের আর কী মানে থাকতে পারে? সে নিজেই তখন ঈশ্বরের
প্রতিরূপ। সে মনে মনে বর দেয়, ‘তোর্ষাকে ওই পঞ্জাবি ছেলেটা যেন বিট্রে না করে। ওর বাচ্চা হতে গিয়ে
যেন মিসক্যারেজ না হয়। অন্ধকার আর একাকীত্ব যেন তোর্ষাকে না ছোঁয়। ওর শরীরের ভেতর ঘুমিয়ে
থাকা নরম চারাগাছগুলো যেন আদরে আর ভালবাসায় জেগে ওঠে ঠিকঠাক’। অনুপ নিজের মনে বিড়বিড় করে ওঠে, ‘আমিই সে’।
জানুয়ারি, ২০০৫
মেন্টাল হসপিটালের আউটডোরের ডাক্তার
অনুপকে দেখার পর নিজের মনেই বলছিলেন,
‘ডিপ্রেসনটা হয়তো
ম্যানেজেবল হবে, কিন্তু
ওই হ্যালুসিনেশনটা, মানে ডিলিউশনাল ডিস-অর্ডারগুলো...’। পার্কের ধারের দোকানগুলো ভেঙে
দেওয়ার পর এখন জায়গাটা অনেক দৃষ্টিনন্দন হয়েছে। রাস্তায় ঘুরে ঘুরে লটারির টিকিট
বেচতে বেচতে অনেক সময় নিজের পুরনো দোকানটা যে জায়গায় ছিল সেখানে চলে আসে অনুপ।
এখানে ফাঁকা জায়গাটা ঘিরে বাগান আর ফোয়ারা হবে শিগ্গিরই। দমকা ঠাণ্ডা বাতাস গায়ে
লাগায় অনুপের শীত শীত করে ওঠে। মায়ের জন্য একটা চাদর কিনতে পারলে হত। ঠাণ্ডায় খুব
ভোগে মা। অরূপের মৃত্যুর পর থেকেই মা খুব দ্রুত বুড়িয়ে গেছে। পার্কের এক কোনায়
অন্ধকারে অরূপের থ্যাঁতলানো মৃতদেহটা পাওয়া গিয়েছিল। অরূপের বডি নিয়ে একটা
শোকমিছিল হয়েছিল। টিভিতে ‘খাঁটি
বাংলা’ নিউজ
প্রোগ্রামেও দেখিয়েছিল। পাপিয়া ইন্সিওরেন্সের এজেন্সি নিয়েছে। কেস-টেস বিশেষ পায়
না, হয়তো বাতিল হয়ে যাবে এজেন্সি। পার্কের বাঁ দিকের
রাস্তাটা ধরে নদীর ধারের দিকে হাঁটা লাগায় অনুপ। বাঁধানো ঘাটের নীচের সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে
ভাগীরথীর জলস্রোত দেখে সে। মনে পড়ে ছোটবেলায় ভূগোলে পড়েছিল, তোর্ষা নামে একটি পাহাড়ি নদী আছে। আচ্ছা, তোর্ষার
জলও কি এসে ভাগীরথীতে মিশছে? ঠিক জানে না অনুপ। নদীটা
কোথায় তাই ভুলে গেছে। শুধু নামটা মনে আছে। গঙ্গার ধারে বাঁধের পাশে নতুন কতগুলো
ঝুপড়ি হয়েছে। পুরনো জায়গায় তাড়া খাওয়া মানুষ নতুন বাসা বেঁধেছে। সেখান থেকে
রান্নায় দেওয়া ফোড়নের তীব্র গন্ধ ভেসে আসছে। অনুপ ফাঁকা ঘাটে দাঁড়িয়ে বেশ জোরে বলে
ওঠে, ‘তোর্ষা
নামে কোনও নদী নেই, ফণী নামে আমার কোনও মামা নেই’। বেশ কয়েকবার বলার পর মাথাটা বেশ হালকা লাগে
অনুপের। ঘাটের কাছে একটা বড় বোলডার পড়ে আছে। ছোটবেলায় অনুপের প্রায় পোষা পাড়ার
নেড়ি কুকুর চুনচুন পাগল হয়ে যাওয়ার পর পাড়ার লোকে দু’ঘণ্টা ধরে পিটিয়ে ওকে মেরে ফেলার পর ওর মৃতদেহটা
এ রকম অন্ধকার পিণ্ডের মতোই পড়ে ছিল। অনুপ পাথরটার দিকে আর না তাকিয়ে সিঁড়ি ভাঙতে
থাকে। ফোড়নের গন্ধটার মধ্যে এক ধরনের গৃহকাতরতার ঠিকানা লেখা ছিল, মানুষের জাগরণ আর কলকাকলির
আচ্ছাদনও ছিল বা। পিছনে সুতীব্র ‘ঘে...উ...উ’ আওয়াজটা এমন সময়েই শোনা যায়। ঘাড় না ঘুরিয়েও অনুপ
বুঝতে পারে পাথরটা নড়ে চড়ে উঠেছে। অনুপ ডাক দেয়, ‘আ,
তু, তু...’। পাথরটার গায়ে দ্বিধার মানচিত্র তখন
ফুটে উঠেছিল।
0 মন্তব্যসমূহ