মিল্টন বিশ্বাস
সাব অল্টার্ন ইতিহাসবিদদের মতে, অক্সফোর্ড ও ক্যামব্রিজ
ইতিহাসধারায় ভারতবর্ষের উচ্চবর্গীয় ইতিহাস প্রকল্পে নিম্নবর্গ তাদের স্বাতন্ত্র্য
নিয়ে উপস্থাপিত হয়নি। এ জন্য তাঁরা উচ্চবর্গের ইতিহাস পরিকল্পের (ঢ়ধৎধফরমস) বাইরে
ক্ষমতা ও প্রতিপত্তির মাপকাঠিতে নিম্নবর্গকে মূল্যায়ন করেছেন। শারীরিক শ্রমে
নিযুক্ত, সামাজিক মর্যাদায় অনগ্রসর, ক্ষমতাহীন, অবহেলিত, বঞ্চিত,
শোষিত এবং আর্থিক বিচারে নিম্নস্তরের কৃষক শ্রমিক ও অন্ত্যজ
প্রান্তিকই নিম্নবর্গ।
আন্তোনিও গ্রামশির সাব অল্টার্ন সম্পর্কিত মতামত অনুসরণ করে ইতিহাসবিদরা নিম্নবর্গের জীবনযাত্রা, আচার আচরণ, ভাবাদর্শ অনুসন্ধান করে তাদের ধর্মবিশ্বাস ও সংস্কৃতির স্বরূপ তুলে ধরতে সচেষ্ট হয়েছেন। নিম্নবর্গ মানুষের আর্থসামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বাস্তবতার সম্যক ধারণা বাংলা উপন্যাসে পাওয়া যায়।
আন্তোনিও গ্রামশির সাব অল্টার্ন সম্পর্কিত মতামত অনুসরণ করে ইতিহাসবিদরা নিম্নবর্গের জীবনযাত্রা, আচার আচরণ, ভাবাদর্শ অনুসন্ধান করে তাদের ধর্মবিশ্বাস ও সংস্কৃতির স্বরূপ তুলে ধরতে সচেষ্ট হয়েছেন। নিম্নবর্গ মানুষের আর্থসামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বাস্তবতার সম্যক ধারণা বাংলা উপন্যাসে পাওয়া যায়।
মূলত বাংলাভাষী ভূখণ্ডের আর্থসামাজিক
সংস্থান, উৎপাদন
কাঠামো, শ্রেণীবিন্যাস ও সমাজ বিবর্তনের ক্রমধারায়
উপন্যাসে বিষয়বৈচিত্র্য ও চরিত্রচিত্রণে নিম্নবর্গের প্রাধান্য সুস্পষ্ট।
নিম্নবর্গের বহুমাত্রিক আচরণ, জীবন বাস্তবতা, কৌমসংস্কৃতির সারবত্তা উপস্থাপিত হয়েছে ঔপন্যাসিকদের অনেক আখ্যানে।
উপন্যাসের যাত্রালগ্নে সাধারণ মানব মানবীর জীবন অবলোকন সূত্রে কোনো কোনো ক্ষেত্রে
নিম্নবর্গের মানুষের জীবন উন্মোচিত হয়েছে। এ ক্ষেত্রে ‘আলালের ঘরের দুলাল’ এর ঠকচাচা, ‘কপালকুণ্ডলা’র নির্মম ধর্মসাধনায় নিয়োজিত কাপালিক, ‘ইন্দিরা’, ‘রজনী’, ‘বিষবৃক্ষ’ ও ‘কৃষ্ণকান্তের উইল’ উপন্যাসের নারী চরিত্রগুলো
নিম্নবর্গের অন্যতম নিদর্শন। বিষবৃক্ষের হীরা দাসীর চরিত্রটি নারীর নিম্নবর্গত্বের
ব্যতিক্রমী রূপায়ণ হিসেবে স্বীকৃত। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘চোখের বালি’র বিনোদিনী নিরাশ্রয় নারীর নিম্নবর্গত্বকে
প্রকাশ করে। তাঁর ‘গোরা’র একদিকে ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রব্যবস্থায়
শাসকগোষ্ঠী, অন্যদিকে
গোরার আত্মানুসন্ধান প্রকৃতপক্ষে উচ্চবর্গ নিম্নবর্গের সমান্তরাল বিন্যাস।
উপন্যাসটিতে জনতা আছে, আছে মুসলমান ও ব্রাত্যজীবনের কথাও।
শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তাঁর উপন্যাসগুলোতে কখনো প্রেমবর্জিত আবার কখনো বা
দাম্পত্য প্রেম ও তার বিরোধকাহিনী অথবা নিষিদ্ধ সমাজবিরোধী প্রেমের চিত্র অঙ্কন
করেছেন। এর মধ্যে ‘শ্রীকান্ত’, ‘চরিত্রহীন’, ‘গৃহদাহ’ প্রভৃতি উপন্যাসে নারীর
নিরাশ্রয়তা, নিঃসঙ্গতা ও উন্মূলিত বাস্তবতা প্রকাশিত
হয়েছে। নিম্নবর্গের তাত্তি্বকদের কাছে এসব নারীর স্বতন্ত্র মূল্য রয়েছে।
নতুন আর্থসামাজিক রাজনৈতিক
প্রেক্ষাপটে কথাসাহিত্যিকরা ‘কল্লোল’ (১৯২৩) পত্রিকাকেন্দ্রিক
উপন্যাসচর্চায় নিম্নবর্গের জীবন উপন্যান্তে সচেতন হন। নরেশচন্দ্র সেনগুপ্ত,
শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়, অচিন্ত্যকুমার
সেনগুপ্ত, প্রেমেন্দ্র মিত্র প্রমুখের রচনায় নিম্নবর্গের
মানুষের জীবন রূপায়ণে অভিজ্ঞতাপ্রসূত ধারার সূত্রপাত ঘটে। কুৎসিত, বীভৎস ও দারিদ্র্যক্লিষ্ট নিম্নবর্গীয় জীবন রয়েছে অচিন্ত্যকুমার
সেনগুপ্তের ‘বেদে’ উপন্যাসে। গণিকাজীবন নিয়ে
লিখেছেন ‘আকস্মিক’। এ ধারার পরবর্তী রচনা জগদীশ গুপ্তর
‘লঘু গুরু’। রিজিয়া রহমানের ‘রক্তের অক্ষর’ এবং এ বছর প্রকাশিত হরিশংকর
জলদাসের ‘কসবি’ও পতিতাপল্লীর কাহিনী। শৈলজানন্দ
মুখোপাধ্যায় সাঁওতাল জীবনসহ কয়লা কুঠির কুলি মজুরের জীবনযাত্রা, রীতিনীতি, উৎসব অনুষ্ঠান ও প্রণয়লীলা অঙ্কন করেছেন তাঁর উপন্যাসে।
বাংলা কথাসাহিত্যে নিম্নবর্গের
জীবনবৈচিত্র্য রূপায়ণে মানিক, তারাশঙ্কর, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের
দক্ষতা অপরিসীম। বিংশ শতাব্দীর পরিবর্তনশীল আর্থসামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিস্থিতির
পরিপ্রেক্ষিতে তাঁদের সাহিত্যকর্ম হয়ে উঠেছে নবতর সমাজ ভাবনার শিল্পমণ্ডিত রূপ।
সাব অল্টার্ন ইতিহাসবিদরা যাদের নিম্নবর্গ হিসেবে অভিহিত করেছেন, তাদের তাঁরা চিত্রিত করেছেন বস্তু অভিজ্ঞতা ও ভাবের সমগ্রতায়।
সামাজিকভাবে নিচু বা সাধারণ স্তরের মানুষ অথবা যারা উচ্চবর্গের কাছে অপ্রধান
জনগোষ্ঠী, তাদের জীবনের বাস্তবতা, আদিম জৈবপ্রবৃত্তি, নর নারী সম্পর্কে প্রচলিত
নীতিশাসন বহির্ভূত আচরণ, উচ্চবর্গ কর্তৃক শোষণ শাসন ও এর
প্রতিক্রিয়ায় তাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ প্রতিরোধ এবং জীবনাচার, সংস্কার ও জীবনযাপনের রীতি পদ্ধতি নিয়ে যে স্বাতন্ত্র্যের অধিকারী
নিম্নবর্গ তারই সম্যক উন্মোচন লক্ষ করা যায় বিভিন্ন উপন্যাসে। মানিক
বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পদ্মানদীর
মাঝি’ জেলে
সম্প্রদায়ের কাহিনী। অনুরূপভাবে সমরেশ বসুর ‘গঙ্গা’,
অদ্বৈত মল্লবর্মণের ‘তিতাস একটি নদীর নাম’, হরিশংকর জলদাসের ‘জলপুত্র’ নিম্নবর্গের চিত্রাঙ্কনে
অনন্য। উল্লেখ্য, সমরেশ বসুর অনেক উপন্যাসে নিম্নবর্গের
বাস্তব জীবনের পরিচয় ব্যক্ত হয়েছে। এ ছাড়া আলাউদ্দিন আল আজাদের ‘কর্ণফুলী’ এবং সেলিনা হোসেনের ‘পোকামাকড়ের ঘরবসতি’ কিংবা আবুবকর সিদ্দিকের ‘খরাদাহ’ ও ‘জলরাক্ষস’ নদী সমুদ্র ও খরায় যাপিত
নিম্নবর্গের জীবনচিত্রণ।
অদ্বৈত মল্লবর্মণ কিংবা হরিশংকর
জলদাস ব্যক্তিগত জীবনে নিম্নবর্গের ছিলেন। এ ছাড়া বেশির ভাগ ঔপন্যাসিকই শিক্ষিত
জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধি। এই হিসেবে উচ্চবর্গের মানুষ। কিন্তু কথাকারদের রচনায়
উচ্চবর্গের মানুষের জীবন চিত্রায়ণের সঙ্গে সঙ্গে ব্রাত্য, অন্ত্যজ ও শ্রমজীবী সাধারণ
মানুষের কোলাহল লক্ষণীয় স্থান দখল করে আছে। বরং বলা যায়, এ
ক্ষেত্রে অধিকতর শিল্পসার্থকতার পরিচয় দিয়েছেন কেউ কেউ। সমাজের উচ্চবর্গের
দৃষ্টিতে নিম্নবর্গ ছোটলোক, নিজস্বহীন, প্রবৃত্তিচালিত, লোলুপ হলেও এসব শব্দ তাদের
ওপর উচ্চবর্গ কর্তৃক আরোপিত প্রয়োগ। কিন্তু লেখকরা নিম্নবর্গের জীবনকে বাস্তবতার
আলোয় তুলে এনেছেন। নিম্নবর্গের দারিদ্র্য, অসহায়ত্ব,
প্রাকৃতিক ও সামাজিক দুর্যোগে বিপর্যস্ত জীবনকে তুলে ধরেছেন
অত্যন্ত দক্ষতায়। গোষ্ঠীগত জীবনের সঙ্গে বিচিত্র পেশার মানুষ ঔপন্যাসিকদের দৃষ্টি
আকর্ষণ করেছে। সরোজকুমার রায়চৌধুরীর ‘ময়ূরাক্ষী’, ‘গৃহকপোতী’ ও ‘সোমলতা’ এই তিন উপন্যাসে বৈষ্ণবজীবনের
চিত্র পাওয়া যায়। অজয় ভট্টাচার্যের ‘অরণ্যানী’তে আছে পার্বত্য বাসিন্দা ত্রিপুরাদের
গোষ্ঠীজীবনের পরিচয়। বিভূতিভূষণের ‘আরণ্যকে’ নিম্নবর্গের মিছিল গোষ্ঠী থেকে ব্যক্তি, ব্যক্তি
থেকে প্রাকৃত প্রজাসাধারণের রাজ্যে অনুপ্রবিষ্ট। তাঁর ‘পথের পাঁচালী’ ‘অপরাজিত’ গ্রামীণ নিম্নবর্গের অসামান্য দলিল। নরেন্দ্রনাথ মিত্রের ‘দ্বীপপুঞ্জ’ পল্লীজীবনের কাহিনী। এতেও
নিম্নবর্গের জয় ঘোষিত হয়েছে। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর ‘লালসালু’,
আবু ইসহাকের ‘সূর্য দীঘল বাড়ী’ নিম্নবর্গের গ্রামীণ জীবনের রূপায়ণ হিসেবে অনন্য। রমাপদ চৌধুরীর ‘বনপলাশির পদাবলী’ পল্লীজীবনেরই চিত্র। হরিপদ
দত্তের ‘ঈশানে
অগি্নদাহ’ ও ‘অন্ধকূপে জন্মোৎসব’ উপন্যাসে বাংলাদেশের গ্রামীণ
নিম্নবর্গের সমাজ কাঠামোর বিচিত্র পরিবর্তনের দৃশ্য অঙ্কিত হয়েছে। গ্রামীণ
নিম্নবর্গের ব্যাপক পরিচয় আছে ইমদাদুল হক মিলনের একাধিক উপন্যাসে।
অনেক উপন্যাসে নিপীড়িত নিম্নবর্গের
কৃষক শ্রমিকের সঙ্গে অপরাধী জনগোষ্ঠী বস্তুনিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। উচ্চবর্গের
ক্ষমতাকেন্দ্র থেকে দূরবর্তী নিম্নবর্গের জীবন জীবিকা ও পেশার বিস্তৃত বিবরণ এবং
নতুন পেশা অবলম্বনে জীবনের সমস্যার দিগন্ত উন্মোচিত হয়েছে। পেশার রূপ রূপান্তর
তাদের আর্থ উৎপাদনব্যবস্থার একটি অন্যতম দিক। বিভিন্নজনের উপন্যাসে ভিড় করেছে
বিচিত্র চরিত্র ও পেশার মানুষ। বৈষ্ণব বাউল সন্ন্যাসী, জাদুকর, বেদে, বাজিকর, রাজমিস্ত্রি,
ভিক্ষুক, কবিয়াল, নিম্ন শ্রেণীর ব্রাহ্মণ, কুমার, ডাইনি, চৌকিদার টহলদার, চোর ডাকাত, মাঝি, পিয়ন
প্রভৃতি। আবার নিপীড়িত অবলুপ্তপ্রায় মানুষের পরিচয় উপন্যাসের অনেক স্থানজুড়ে আছে।
রাঢ় ও মানভূমির মৃত্তিকায় যাদের বর্তমান অস্তিত্ব নেই, এমন
অনেক সম্প্রদায় বা জনগোষ্ঠীর বিবরণ বিভিন্ন উপন্যাসে পাওয়া যায়। সুবোধ ঘোষের ‘শতকিয়া’ উপন্যাসে মানভূমির আদিম
সংস্কার প্রধান জীবনের চিত্র রয়েছে। মনোজ বসুর ‘নিশিকুটুম্ব’ চৌর্যবৃত্তির বাস্তব রূপায়ণ। চোর আর ডাকাতের
চিত্র রয়েছে নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের তিন খণ্ডের ‘উপনিবেশ’
এ। একদিকে শাসকগোষ্ঠী তথা থানা পুলিশ ম্যাজিস্ট্রেট, অন্যদিকে নিম্নবর্গের জীবন বিস্তৃত পরিসরে এখানে উন্মোচিত হয়েছে।
বনফুলের উপন্যাসে, বিশেষত ‘স্থাবর’ ও ‘জঙ্গম’ এ মানবজীবনের ইতিহাস
নিম্নবর্গীয় বিন্যাসেই উপস্থাপিত। শামীম রেজার ‘ভারতবর্ষ’
উপন্যাসে ইতিহাসের পটে ধারণ করা হয়েছে বাংলার নিম্নবর্গীয় জীবনের
অনেক অজানা তথ্য উপাত্ত।
তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের একাধিক
উপন্যাসে নিম্নবর্গের জীবন ও চরিত্র উপস্থাপিত হয়েছে। রাঢ় বাংলার কৃষক, কুলি কামিন, মুটে মজদুর, বেদে, ডোম
জমাদার, বাগদি, কাহার, সাঁওতাল, মাঝি, চণ্ডাল,
বারবনিতা, ডাইনি, কুমার কামার, টহলদার চৌকিদার, চোর ডাকাত, বাজিকর বাউল বোষ্টম বিভিন্ন
শ্রেণীর অবহেলিত, পতিত নিম্নবর্গের মানুষ তাঁর উপন্যাসের
প্রধান উপজীব্য। তাঁর উপন্যাসে একদিকে বর্ণগত শ্রেণী বৈষম্যের চিত্র, অন্যদিকে অর্থনৈতিক পটভূমিতে নিচুতলার দরিদ্র ও অবহেলিত পতিত মানুষের
অস্তিত্ব সংকট, রাজনৈতিক বাস্তবতা, নর নারীর সম্পর্ক, সামাজিক আন্তক্রিয়া চিত্রিত
হয়েছে। তারাশঙ্করের উপন্যাসে গোষ্ঠীজীবনের চিত্র বারবার এসেছে। চেতনে বা অচেতনে
পল্লীসমাজ তাঁর প্রিয় বিষয়। গ্রামীণ পূজা, ব্রত, সংকীর্ণতা, কুসংস্কার বা গ্রামের পুরনো
রীতিনীতির ওপর আধুনিক যুগের প্রভাব অত্যন্ত তীব্রভাবেই প্রকাশিত হয়েছে তাঁর অনেক
উপন্যাসে। ‘গণদেবতা
পঞ্চগ্রাম’ উপন্যাসে
ডোম, মুচি, কামার চরিত্র আছে। ‘হাঁসুলী বাঁকের উপকথা’য় আছে কাহার বাগদি আর শ্রমিক। ‘কবি’ উপন্যাসে কবিয়াল নিতাই হাড়ির সঙ্গে আছে রেলের
পয়েন্টসম্যান রাজা মুচি। ‘রাইকমলে’ দেখা যায় বৈষ্ণব ও জাতবাউলের মতোই আখড়ার ঐতিহ্য বজায় রেখেও
পুরুষানুক্রমিক নানা বৃত্তির টানেই নিম্নবর্গের জীবন চলেছে। ‘ডাকহরকরা’ উপন্যাসে দীনু ডোম ডাকহরকরা।
ডোমদের সমাজ নির্ধারিত কাজ শবদাহ। কিন্তু সামাজিক অপরাধে জড়িত দেখা যায় শশী ডোমদের
জনগোষ্ঠীকে। তাদের পুরুষানুক্রমিক বৃত্তি চৌর্যবৃত্তি। কলিয়ারি ও মিল কারখানার
শ্রমিকও আছে তাঁর উপন্যাসে। শ্রমিকজীবনের আরো চিত্র পাওয়া যায় মানিকের একাধিক
উপন্যাসে এবং গৌরীশঙ্কর ভট্টাচার্যের ‘ইস্পাতের স্বাক্ষর’ ও শক্তিমান রাজগুরুর ‘কেউ ফেরে নাই’ আখ্যানে।
নিম্নবর্গের নর নারীর সম্পর্কে রয়েছে
স্বতন্ত্র নীতিচেতনা। একদিকে যেমন আছে প্রেমানুভূতি বা ভালোবাসা, তেমনি আছে আদিম যৌন
প্রবৃত্তির তাড়না, দাম্পত্য জীবনে আছে মিলন বিরহ ও ক্রূর
বিচ্ছেদ। নর নারীর আদিম বৃত্তি দ্বন্দ্ব, বিবাদ, জিঘাংসা, প্রবল যৌনাকাঙ্ক্ষার বিচিত্র প্রকাশ
মনস্তাত্তি্বক সমস্যায় প্রকাশ পেয়েছে তারাশঙ্করের ‘হাঁসুলী বাঁকে’, মানিকের ‘পদ্মানদীর মাঝি’তে। সমাজরীতি বহির্ভূত প্রেম
রাধাকৃষ্ণের লীলারসের মতোই উচ্চকিত হয়েছে অনেক আখ্যানে। ‘নাগিনী কন্যা’য় আদিমতার প্রকাশ আরো স্পষ্ট ও উজ্জ্বল। এখানে
জৈব আসক্তির, আদিম
বৃত্তির লীলারথে রূপায়ণ ঘটেছে চরিত্রের। ‘কবি’র ডোম সমাজভুক্ত নিতাই হাড়ি বংশের মানুষ হয়েও কবিয়াল। স্টেশনে
কুলিগিরি করেও ঠাকুর ঝিয়ের প্রেমাস্পদ। নারী পুরুষের লৈঙ্গিক বৈষম্য একটি
গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। নারীরা কখনো কখনো পুরুষশাসিত সমাজের নীতিকে অন্তর্ঘাতের
মাধ্যমে আক্রমণ করেছে। মূলত সমাজবন্ধনহীন আবার সমাজস্থিত; অন্যদিকে শাস্ত্রাচারের
নৈতিক সীমাবহির্ভূত পারস্পরিক সম্পর্কের জটিলতায় এসব নিম্নবর্গের নারী পুরুষ এক
স্বতন্ত্র সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল তৈরি করেছে। কমলকুমার মজুমদারের ‘অন্তর্জলী যাত্রা’র ঘোর বাস্তবতায় এবং অমীয়ভূষণের অনেক
উপন্যাসে এর দৃষ্টান্ত রয়েছে। এ ছাড়া শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় ও জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী
নিম্নবর্গের নর নারীর জীবন রূপায়ণে আন্তরিকতার পরিচয় দিয়েছেন। ভিন্নতর চিত্র আছে
সৈয়দ শামসুল হকের ‘আয়না
বিবির পালা’য়। এখানে
নিজ স্ত্রীকে পতিতাপল্লীতে বিক্রি করে আরবদেশে যায় গ্রামের দরিদ্র মামুদ উজ্জ্যাল।
ইমদাদুল হক মিলনের ‘যাবজ্জীবন’, ‘কালাকাল’ উপন্যাসে বিক্রমপুর অঞ্চলের নিম্নবর্গের মানুষ সুনিপুনভাবে উপস্থাপিত
হয়েছে। বস্তি জীবন নিয়ে লিখেছেন সালমা বাণী তার ‘ভাংগারি’
উপন্যাসে, যা নির্মম সত্য তারই শৈলী এই
আখ্যান।
নিম্নবর্গের প্রতিবাদ প্রতিরোধ গুরুত্বসহ
উপস্থাপন করেছেন ঔপন্যাসিকরা। জীবন জীবিকার তাগিদে আমৃত্যু কর্মতৎপর এই
নিম্নবর্গের মানুষের মধ্যে একপ্রকার নিবিড় ঐক্য পরিদৃষ্ট হয় তাদের টিকে থাকার
আকাঙ্ক্ষায়, আত্মপ্রকাশের
অভীপ্সায়। নিম্নবর্গ শোষিত, বঞ্চিত ও নিপীড়িত এই হিসেবে
তাদের মধ্যে ঐক্যের চেতনা জাগ্রত হয়। সম্মিলিত হয় তারা প্রতিবাদ প্রতিরোধে। তবে
বিভিন্ন উপন্যাসে ব্যক্তি পর্যায়ের প্রতিবাদ প্রতিরোধ বেশি পরিলক্ষিত হয়েছে।
প্রতিরোধস্পৃহা নিম্নবর্গের মজ্জাগত। তারাশঙ্করের ‘অরণ্যবহ্নি’তে সাঁওতাল বিদ্রোহ ঠাঁই পেয়েছে। ‘কালিন্দী’তে প্রজাবিদ্রোহ আছে। সতীনাথ ভাদুড়ির ‘ঢোড়াইচরিত মানস’, দেবেশ রায়ের ‘তিস্তাপারের বৃত্তান্ত’ ও ‘বরিশালের যোগেন মণ্ডল’ এবং আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ‘খোয়াবনামা’য় মহাকাব্যিক ঘটনাধারায় নিম্নবর্গের প্রতিবাদ
প্রতিরোধ উচ্চকিত হয়ে উঠেছে। শহীদুল্লা কায়সারের ‘সংশপ্তক’
এ সমাজতান্ত্রিক বাস্তবতায় নিম্নবর্গের প্রতিবাদ ভবিষ্যৎসঞ্চারী।
অন্যদিকে নিম্নবর্গের অস্তিত্ব সংকট ও প্রতিবাদকে একীভূত করেছেন মহাশ্বেতা দেবী
তাঁর একাধিক উপন্যাসে। তিনি নিম্নবর্গজীবনের সংগ্রামী কথাকার।
বাংলা উপন্যাসের বিশাল সম্ভারে
নিম্নবর্গের মানুষের জীবনাচারের প্রায় সব প্রান্ত উন্মোচিত হয়েছে। তাদের ধর্মাচার, জীবনাচার, পেশা নেশা, লোক রীতিনীতি প্রভৃতি সাংস্কৃতিক
জীবনের ব্যাপ্ত পরিচয় লক্ষ করা যায়। বিভিন্ন ধর্ম সম্প্রদায়ের সহাবস্থান বিচিত্র
মাত্রায় বিভিন্ন উপন্যাসে রূপায়িত। কৃষক শ্রমিক, বৈষ্ণব
বাউল, শাক্ত পটুয়া, পীর ফকির
প্রভৃতি সম্প্রদায়ের জীবনাচারের সত্য রূপও দেখা যায়। নগর সভ্যতার পাশে নিম্নবর্গের
সংস্কৃতির স্বতন্ত্র রূপ অভিনব। ধর্ম লালনে এরা হিন্দু মুসলিম দুই বিপরীত মেরুর
মিলনে বিশ্বাসী। ‘হাঁসুলী
বাঁক’ থেকে ‘খোয়াবনামা’ হয়ে তরুণ ঔপন্যাসিক তারেক
খানের ‘বান্ধাল’ ও স্বকৃত নোমানের বেদেদের
জীবন নিয়ে রচিত উপাখ্যানে আবিষ্কার করা যায় নিম্নবর্গের লোকসংস্কৃতির অমেয় সম্ভার।
ঢাকার বস্তিজীবনের সংস্কৃতির পরিচয় আছে সালাম সালেহ উদদীনের ‘জন্মদৌড়’ উপন্যাসে।
বস্তুত বাংলা উপন্যাসে নিম্নবর্গের
মানুষের বহুমাত্রিক জীবনের শিল্পসম্ভার উপস্থাপিত হয়েছে। বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর বাস্তব
অভিজ্ঞতা রূপায়ণে ঔপন্যাসিকরা অন্তর্ভেদী ও সৃষ্টিমনস্ক, যা পাঠকের সামনে উন্মোচন করে
দেয় অভিজ্ঞতার এক নতুন দিগন্ত।
0 মন্তব্যসমূহ