নুশেরা তাজরীন
আমাদের ছেলেবেলায় যেবার
বর্ষায়
উথালপাথাল বৃষ্টি নামল, পুকুরডোবা উপচে শোল-টাকি-কইয়ের ঝাঁক সরসরিয়ে ধানক্ষেতে
নেমে এল,
ফুল-আসা ডাগরডোগর কচুরিপানার ভাসন্ত
ঝোপঝাড়ের তলায়
মাছেদের ডুবসাঁতারের স্রোতে বাঁশকাঠির
ফাঁদ পাতার আয়োজনে কাদাপানিতে দিনভর ভিজছিলাম আমরা; সে রকম একটা দিনে, অবিরাম বর্ষণের সতেরতম দিনে, দুপুরের একটু আগে খবর এসেছিল- আমাদের
বড়দাদা,
দাদাদের পাঁচ ভাইয়ের মধ্যে সবচেয়ে বড়জন, মারা গেছেন।
একশ সাত বছর বয়সী রোগশয্যাগত
বৃদ্ধের মৃত্যুসংবাদে জ্ঞাতিভাইদের কারোরই বিশেষ দুঃখিত হবার কারণ ছিল
না;
তবু আন্তা-চুপড়ি কাদায় গেঁথে, ঘেরাটোপবন্দী জিওল মাছদের আয়ু আরও একদিন বাড়িয়ে, খুদিপানার সরপড়া পানির ওপর
থেকে নেপিয়ার ঘাসের ঝাড় আর ইতস্তত সাঁতরে বেড়ানো টোপাপানা দুহাতে সরাতে
সরাতে ক্ষেত থেকে উঠে এসেছিলাম আমরা। মৌসুমী সংগ্রহের লম্বাডাঁটি শালুকগোছা
নেতিয়ে পড়লেও কালচে-সবুজ মোস্তগের ফকফকে শাদা ঝিরঝিরে ফুলগুলো তখনও
হাসছিল;
তবু সেগুলো সঙ্গে আনার কথা ভাবতে পারি নি
আমরা কেউ।
প্রয়াণ-বিষয়ক খবরের বিস্ময়কর এক
নিজস্ব শক্তিবলয় আছে;
সদ্যমৃতের আশপাশের
পৃথিবী- মানুষজন-কাজকর্ম ছোটবড় সবার, সবকিছুর যাবতীয় লঘুগুরু আয়োজনকে
স্বতঃসিদ্ধ ক্ষমতায় এক নিমেষে নিরর্থক ও অপ্রয়োজনীয় করে তুলতে মৃত্যুসংবাদের
জুড়ি এখনও নেই,
তখনও ছিল না।
আট-দশ-বারোর শিশুকিশোরের বোধে
মৃত্যু ব্যাপারটির সঙ্গে বেদনার চেয়ে রহস্যময়তার যোগ বেশি; তাছাড়া রহস্য মানেই তো নিষেধের কঠিন বেড়াজাল, গা-হিমহিম ভয়, আর দুর্দমনীয় কৌতূহলের হাতছানির মিশেল! সে-বয়সে আমরা জেনেছিলাম
মানুষ মরে গেলে আকাশে একটা তারা বেশি হয়; যদিও মানুষটা তখন আর মানুষ থাকে না; খাটিয়ায় চড়ে কবরে ঢুকে হয়ে যায় মুর্দা, অথবা শ্মশানে গিয়ে মড়া। তখন গোরস্তানের
পাশের রাস্তায় হাঁটতে গিয়ে আঙুল তুলে কবর দেখালে ভেতরে শায়িত মুর্দা
বিরক্ত হয়ে উঠে বসতো;
যদিও বাইরে থেকে তাকে দেখা
যেত না,
তবুও কাফনমোড়া মৃতদেহের কল্পিত
উপবেশনভঙ্গিটি দীর্ঘস্থায়ী আতঙ্কের যোগান দিত। তার
অসময়োচিত নিদ্রাভঙ্গের প্রায়শ্চিত্ত হিসেবে দুহাতের
দশটি আঙুল এক কামড়ে মুখে পুরতে হতো; অপারগতায় পরবর্তী শুক্রবার অবধি
ঘুরপথে স্কুলে যাওয়ার নিয়ম ছিল। শ্মশানের বাঁশঝাড়ে অধিষ্ঠিত ভূতের পছন্দ
ছিল ভাতের গন্ধ;
আমিশাপাড়ার শ্যামলদের বাড়ির পথে ভরপেটে
চলতে গিয়ে
প্রাণপণে ঠোঁট টিপে মুখে হাতচাপা দিতাম
সবাই।
বড়দাদার মৃত্যুসংবাদের প্রতিক্রিয়ায়
তড়িঘড়ি বাড়ি ফিরেছিলাম আমরা; শরীর
থেকে ডুবোক্ষেতের পানাশ্যাওলার গাদ টিনঘেরা গোসলখানার চাপকলে ধুয়ে কাদাছানা
উঠানে জোড়ায়-জোড়ায় পাতা ইটে চপ্পলপরা পা ফেলে কাছারিঘরে উঠতে উঠতে
দেখেছিলাম,
বাবাচাচা- জেঠাকাকারা সবাই সেখানে জড়ো
হয়ে দাঁড়িয়ে।
আমাদের শরিকিবাড়ির বড় উঠানে ততোক্ষণে
দুচারজন করে লোক জমতে শুরু করেছিল- পাড়ার লোক, গ্রামের লোক, বৃহস্পতিবার দুপুরের জোহরের আজান শুনে বা না-শুনে মসজিদের
দিকে রওনা হওয়া নানান বয়সী পুরুষ; এগার ঘাটলার বিশাল মুন্সিপুকুরের ঘাটে-ঘাটে
প্রাকস্নানপর্বের কাপড় কাচতে বসা মা-চাচী-মাসী। মহিলাদের
কেউ অবশ্য কাছারিঘরের দিকে যায় নি, বরাবরের মতো কলপাড় হয়ে ঢেঁকিঘরের
পিছন দিয়ে আড়ালের হাঁটাপথে ভেতরবাড়িতে ঢুকেছিল তারা।
মুর্দাবাড়ির পুরুষদের
গাম্ভীর্য ধরে রাখতে হয়;
সদা-আমুদে মানুষটিও যেভাবেই
হোক মুখমণ্ডলের পেশি ও চোখের শুষ্কতার ওপর পারিপার্শ্বিক শোকাবহতার আপ্রাণ
নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায় সক্ষম হয়েছিলেন। কেউ দাঁড়িয়ে কেউ বসে, কাছারিঘরের কাঠের জানালার লোহার শিকে, টিনের চালের নীচে বাঁশকাঠের দরমায়, অথবা প্যাচপ্যাচে উঠানের কাদায় উদাসীন দৃষ্টির সচেতন
আপতনে।
গ্রামের বর্ধিষ্ণু যৌথ-পরিবারগুলো
তখনও পুরোপুরি ভাঙে নি অথবা শহরমুখী হয়ে ওঠে নি, মানবিক সম্পর্কের সুতোগুলো এবংবিধ জটিলতায় পাক খায় নি, গ্রাম পতনের শব্দ দু-এক পাড়ায় বিচ্ছিন্নভাবে বোল তুলতে
শুরু করলেও সমবেত
উচ্চনিনাদে ফেটে পড়ে নি। সে-কারণেই
বোধহয়,
ঠিক কতদিন ধরে তিনি শয্যাশায়ী, কবে থেকে পরিপূর্ণ বাকরোধ ঘটেছে; অথবা শ্বাসটানটা কখন উঠেছিল, কিংবা শেষ পানিটুকু কার হাত থেকে খেয়েছিলেন- ইত্যাকার
তথ্যউপাত্ত সমবেত
জনতার কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল।
মরহুম বড়দাদার মৃত্যু বিষয়ক যাবতীয় তথ্যের পৌনঃপুনিক
পরিবেশনার গুরুদায়িত্ব পরিজনদের অনুচ্চারিত সমঝোতায়
নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন বড়জেঠা, বড়দাদার জ্যেষ্ঠ সন্তান।
×××
মৃত্যুর সময় বড়দাদা তার বহুদিনের অভ্যস্ত বিছানা সুপারিকাঠের মাচার বদলে কাছারিঘরের চৌকিতে শুয়েছিলেন। বস্তুত সেবারের উথালিপাথালি বর্ষা জেঁকে বসার পর থেকে ঘরেই রাখা হয়েছিল তাঁকে; তার আগে, আষাঢ়ের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত, ঢেঁকিঘর আর পুকুরঘাটের মাঝামাঝি জায়গাতে জাম-কাঁঠাল আর চালতা গাছের ছায়ায় বাঁধা সুপারিতক্তার মাচাটিই ছিল তাঁর সার্বক্ষণিক ঠিকানা। অসাড় ডানপাশ নিয়ে নিজে থেকে উঠতে-বসতে বা চলতে-ফিরতে পারছিলেন না অনেক দিন ধরে; শেষের পাঁচটা বছর বলতে গেলে সেই মাচায় পাতা মাদুরে শুয়ে থাকতে বাধ্য ছিলেন বড়দাদা। স্নান-প্রক্ষালনের মতো অত্যাবশ্যকীয় নিত্যকর্ম পালিত হতো মাচার ওপরেই- বাড়ির বৌঝিদের হাতে, শরীরের তলা থেকে মাদুর সরিয়ে, ওপর থেকে পানিভরা কলসি উল্টে ধরে। বাদবাকী সময় মাথার নীচে নিত্যচাপে আকৃতিহারা তেল-চিটচিটে ভগ্নস্বাস্থ্য বালিশ; চাহিদার প্রকাশ সাপেক্ষে কখনও বা শীর্ণ শরীরের ওপর কাঁথা কিংবা চাদর ফেলে দিয়ে যেত চাচিজেঠিদের কেউ।
মৃত্যুর সময় বড়দাদা তার বহুদিনের অভ্যস্ত বিছানা সুপারিকাঠের মাচার বদলে কাছারিঘরের চৌকিতে শুয়েছিলেন। বস্তুত সেবারের উথালিপাথালি বর্ষা জেঁকে বসার পর থেকে ঘরেই রাখা হয়েছিল তাঁকে; তার আগে, আষাঢ়ের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত, ঢেঁকিঘর আর পুকুরঘাটের মাঝামাঝি জায়গাতে জাম-কাঁঠাল আর চালতা গাছের ছায়ায় বাঁধা সুপারিতক্তার মাচাটিই ছিল তাঁর সার্বক্ষণিক ঠিকানা। অসাড় ডানপাশ নিয়ে নিজে থেকে উঠতে-বসতে বা চলতে-ফিরতে পারছিলেন না অনেক দিন ধরে; শেষের পাঁচটা বছর বলতে গেলে সেই মাচায় পাতা মাদুরে শুয়ে থাকতে বাধ্য ছিলেন বড়দাদা। স্নান-প্রক্ষালনের মতো অত্যাবশ্যকীয় নিত্যকর্ম পালিত হতো মাচার ওপরেই- বাড়ির বৌঝিদের হাতে, শরীরের তলা থেকে মাদুর সরিয়ে, ওপর থেকে পানিভরা কলসি উল্টে ধরে। বাদবাকী সময় মাথার নীচে নিত্যচাপে আকৃতিহারা তেল-চিটচিটে ভগ্নস্বাস্থ্য বালিশ; চাহিদার প্রকাশ সাপেক্ষে কখনও বা শীর্ণ শরীরের ওপর কাঁথা কিংবা চাদর ফেলে দিয়ে যেত চাচিজেঠিদের কেউ।
বড়দাদার মাচার ধারেপাশে
পারতপক্ষে ঘেঁষতে চাইতাম না আমরা; আহারের সময়টি
ধরাবাঁধা হলেও নিদ্রার মতো বৃদ্ধের প্রাতঃক্রিয়াদিও কোন নির্দিষ্ট সময়ের
অনুবর্তী ছিল না,
ফলত মাচার নীচে প্রবহমান তরল-বর্জ্যের
বিবমিষাকর
দৃশ্যগন্ধযুক্ত পরিবেশটিকে সচেতনভাবেই
এড়িয়ে চলত বাড়ির ছেলেপুলেরা। মাঝেমধ্যে বেমক্কা শটের
খেসারত হিসেবে বাঁশঝাড়ে নিখোঁজ তিন-নম্বরী ফুটবলের খোঁজে
ঢুঁ দিতে গেলে শ্লেষ্মামাখা ঘড়ঘড়ে স্বর শোনা যেত:
কে রে?
কে যায়!
এরে ও মনা!
মিলন নি রে?
কতা কস না কা?
মিলইন্যা!
মিলু রে!
এরে ও মিলা...
কে রে?
কে যায়!
এরে ও মনা!
মিলন নি রে?
কতা কস না কা?
মিলইন্যা!
মিলু রে!
এরে ও মিলা...
মাচার ওপর থেকে ভেসে আসা
জিজ্ঞাসা অথবা আহ্বানের জবাব দিত না কেউ; সেখানে শয্যাগত মানুষটির কথার বিন্দুমাত্র কর্ণপাতযোগ্যতা
ছিল না।
কালেভদ্রে অবশ্য বড়দাদা জবাব পেতেন, প্রশ্নোত্তরের আলপথ ধরে গন্তব্যহীন আলাপচারিতা
অগ্রসর হতো:
- কে রে, সাব্বির?
- জ্বে না
- ও সাব্বির!
- বাড়িত নাই
- সাব্বির রে!
- বাজারে গেছি!
- তোর বড়মামা ঘরে আছে নি? হেতারে খবর দে...
- ঘরে কেও নাই, খালি বাতায়ন আর সমীরণ আছে
- এরে হারমজাদা সাব্বিরিয়া!
- বাঁচি নাই গো, মরি গেছিইইইইই!
- কে রে, সাব্বির?
- জ্বে না
- ও সাব্বির!
- বাড়িত নাই
- সাব্বির রে!
- বাজারে গেছি!
- তোর বড়মামা ঘরে আছে নি? হেতারে খবর দে...
- ঘরে কেও নাই, খালি বাতায়ন আর সমীরণ আছে
- এরে হারমজাদা সাব্বিরিয়া!
- বাঁচি নাই গো, মরি গেছিইইইইই!
×××
ছানিপড়া চোখে দেখতে পেতেন না বড়দাদা, তবু কবেকার চশমার পুরু কাঁচ আড়াল করে থাকত ছাইরঙা ঘোলাটে মার্বেলজোড়া। কানে তিনি ঠিকই শুনতেন, অদ্ভুত ক্ষমতার অধিকারী ছিল তাঁর শ্রবণ, উৎপত্তির আগেই কীভাবে যেন বুঝে নিত শব্দের উৎস। মেঘমুক্ত খটখটে রোদের দুপুরে অভাবিত অত্যাসন্ন বৃষ্টিপাত অথবা আকস্মিক টর্নেডোর অবিশ্বাস্য অথচ নিখুঁত পূর্বাভাস দিতেন সেই অতিপ্রাকৃত ইন্দ্রিয়শক্তিতে ভর করে। মাচার ওপরের অভিজ্ঞ শ্রবণযন্ত্রে ধরা পড়ত ঢেঁকিঘরের নিরাপদ আড়ালে বাড়ির লজিং মাষ্টারের সাথে মেজচাচার কিশোরী কন্যা শিলুআপার মাঝরাত্রিকালীন অভিসারে উৎপন্ন যাবতীয় স্ফুট ও অস্ফুট শব্দবাক্য, গুঞ্জরণশিৎকার।
ছানিপড়া চোখে দেখতে পেতেন না বড়দাদা, তবু কবেকার চশমার পুরু কাঁচ আড়াল করে থাকত ছাইরঙা ঘোলাটে মার্বেলজোড়া। কানে তিনি ঠিকই শুনতেন, অদ্ভুত ক্ষমতার অধিকারী ছিল তাঁর শ্রবণ, উৎপত্তির আগেই কীভাবে যেন বুঝে নিত শব্দের উৎস। মেঘমুক্ত খটখটে রোদের দুপুরে অভাবিত অত্যাসন্ন বৃষ্টিপাত অথবা আকস্মিক টর্নেডোর অবিশ্বাস্য অথচ নিখুঁত পূর্বাভাস দিতেন সেই অতিপ্রাকৃত ইন্দ্রিয়শক্তিতে ভর করে। মাচার ওপরের অভিজ্ঞ শ্রবণযন্ত্রে ধরা পড়ত ঢেঁকিঘরের নিরাপদ আড়ালে বাড়ির লজিং মাষ্টারের সাথে মেজচাচার কিশোরী কন্যা শিলুআপার মাঝরাত্রিকালীন অভিসারে উৎপন্ন যাবতীয় স্ফুট ও অস্ফুট শব্দবাক্য, গুঞ্জরণশিৎকার।
অকেজো-অচল বড়দাদার কথায় কান
দিত না কেউ,
বাড়ির পুরুষদের সময় হতো না তাঁর
কথা শোনার,
অথবা শুনতে চাইতেন না বলেই সময় দিতেন না; অন্যদিকে চাচিজেঠিদের মতে সবকিছুতেই
বৃদ্ধের বাড়াবাড়ি,
ফলে যে কোন অনাকাঙ্ক্ষিত অতিসক্রিয়
আতিশয্যের মতো বড়দাদার শ্রবণনির্ভর বক্তব্যকেও তারা সর্বাংশে ও সচেতনভাবে
উপেক্ষা করতেন। উঠানে শুকাতে দেয়া চালের গুঁড়ি আচম্বিত ঝড়বাদলায়
কাই হয়ে কাদায় মিশে গেলে,
এমনকি রমাদাসী দাইয়ের হাতে মেজচাচি শিলুআপার
গর্ভপাতের ভার দিতে বাধ্য হলেও, কেউ
কখনও একবিন্দু আক্ষেপ করে নি বড়দাদার কথার সময়োচিত
মূল্যায়ন হয় নি বলে।
×××
মাচাবন্দী জীবনে সময়-সময় কতবার একে-তাকে ডাকাডাকি করেছেন বড়দাদা- কেউ মুখ খুলে সাড়া দেয় নি। ব্যতিক্রমের মধ্যে অকালে পিতৃহারা ফুফাতো ভাই কৌতুকপ্রবণ সাব্বির, বাঁধাধরা জবাব ছিল- ‘মরি গেছি!’ শেষবার সে-কথা শুনে দাদা বলেছিলেন, ‘তুই মইরবিরে মরবি, হাল (লাফ) দি মইরবি...!’
মাচাবন্দী জীবনে সময়-সময় কতবার একে-তাকে ডাকাডাকি করেছেন বড়দাদা- কেউ মুখ খুলে সাড়া দেয় নি। ব্যতিক্রমের মধ্যে অকালে পিতৃহারা ফুফাতো ভাই কৌতুকপ্রবণ সাব্বির, বাঁধাধরা জবাব ছিল- ‘মরি গেছি!’ শেষবার সে-কথা শুনে দাদা বলেছিলেন, ‘তুই মইরবিরে মরবি, হাল (লাফ) দি মইরবি...!’
বড়দাদা আঁশবিহীন মাছ খেতেন
না,
দ্বিপদী প্রাণীর মাংসে প্রবল অরুচি, সূর্য ডোবার পর খাদ্যপানীয় স্পর্শ করতেন না। শুধু
সকালবেলাকার রুটির প্রতি
ছিল দুর্মর লোভ; ডানহাতের অসাড়ত্বহেতু মাচার ওপর থেকে শতরেখাকুঞ্চিত অস্থিসার
বামহাত পেতে আরেকটা,
আর মাত্র একটা বেশি রুটি, নিয়মিত চাইতেন নির্লজ্জ ভিক্ষুকের মতো!
অচল অকেজো বৃদ্ধের উপর্যুপরি
ঘ্যানঘ্যানে অনুরোধে কর্ণপাত করত না কেউ, যেহেতু বাড়তি খাদ্য মানেই পরিপাকীয় বর্জ্যত্যাগের পরিমাণ
অথবা ঘটনসংখ্যার
বৃদ্ধি যেখানে অবশানড় দেহের শৌচকার্য
এবং অধোবাসের পরিষ্কৃতি সংক্রান্ত ঝঞ্ঝাট জড়িত। একদিন, শুধু একদিনই, জ্যেষ্ঠ সন্তানের প্রতি বুভুক্ষু পিতার হাহাকার
সশব্দে উচ্চারিত হয়েছিল- ‘দিতো ন রে, তোরেও
দিতো ন...!’
×××
সাব্বির মরেছে, অমরত্বের কোনো কারণ ছিল না তার; তবু বলতেই হয় মরেছে অকালে, এবং অপঘাতে, রেলগাড়ির টিকিট-চেকারের তাড়া খেয়ে লোকাল রুটের চলতি ট্রেন থেকে লাফ দিয়ে; হাতে-ধরা কফসিরাপের শিশির ভাঙা কোণাটুকু সোজা বিঁধে গিয়েছিল বুকে! বড়দাদার আক্ষেপ অথবা অভিশাপ প্রথমবারের মতো প্রমাণিত ভবিষ্যদ্বাণীর খ্যাতি লাভে ধন্য হয়েছিল; অশ্রুত আবহসঙ্গীতের মতো আমাদের কানে বাজছিল, ‘তুই মইরবিরে মরবি, হাল দি মইরবি...!’
সাব্বির মরেছে, অমরত্বের কোনো কারণ ছিল না তার; তবু বলতেই হয় মরেছে অকালে, এবং অপঘাতে, রেলগাড়ির টিকিট-চেকারের তাড়া খেয়ে লোকাল রুটের চলতি ট্রেন থেকে লাফ দিয়ে; হাতে-ধরা কফসিরাপের শিশির ভাঙা কোণাটুকু সোজা বিঁধে গিয়েছিল বুকে! বড়দাদার আক্ষেপ অথবা অভিশাপ প্রথমবারের মতো প্রমাণিত ভবিষ্যদ্বাণীর খ্যাতি লাভে ধন্য হয়েছিল; অশ্রুত আবহসঙ্গীতের মতো আমাদের কানে বাজছিল, ‘তুই মইরবিরে মরবি, হাল দি মইরবি...!’
উত্তর-পৌষের এক হিমমাখা সকালে
বড়দাদার পরিত্যক্ত মাচা নতুন করে বাঁধতে হয়েছে বড়জেঠার জন্য, ধান-ভাঙানো মেশিনের বেল্টে গায়ের চাদর পেঁচিয়ে গেলে
বামপাশের হাত-পা বিদায় জানিয়েছিল তাকে। গ্রামটা বিলাত অথবা ফরাসি দেশের
হলে লোকে হয়ত তার নাম দিয়ে দিত নেলসন; বাঁ-চোখটা যে আগেই গিয়েছিল বড়খোলার
হাট থেকে ফেরার পথে,
হাতের মুঠিতে ঝোলানো বকের গলা-বাড়ানো
ধারাল
ঠোকরে! অঙ্গহানির পর সুপারিকাঠের মাচায়
শুয়ে বরাদ্দকৃত খাদ্যের পরিমাণ বিষয়ে বড়জেঠার উষ্মায়
কেঁপে উঠেছিলাম আমরা;
তার হাহাকার বড়দাদাকে আরেকবার
অবধারিত আলোচনায় ফিরিয়ে এনেছিল।
তারপর পেরিয়ে গেছে কত কত দিন, কত গ্রীষ্মবর্ষা-শীতবসন্ত কত পূর্ণিমা-অমাবশ্যা-জোয়ারভাটার
পুনরাবৃত্তি দেখেছে এ জগৎ,
দেখতে-দেখতে বদলে যেতে-যেতে
হঠাৎ একদিন পুরোপুরি অচেনাও হয়ে গেছে চিরচেনা জীবনের কত কিছু! নয়নজুলিতে
হামলে পড়েছে বসত,
ভরা বর্ষার বিলঝিল থেকে অদৃশ্য হয়ে গেছে ডুবসাঁতারু
শাপলার গোছা,
শরতের মৃদু হাওয়া কাঁপন ধরাবে বলে খুঁজে
পায় না
মোস্তগের ঝাড়।
নির্দেশমান তর্জনী দেখে
গোরস্তানের মুর্দারা আর উঠে বসে না, শ্মশানের মড়াদের যেমন কিছুই এসে যায়
না ভাতের গন্ধে;
গা-ছমছমে রহস্যরা এখন বহুযুগের
ওপারে নির্বাসিত বিস্মৃতপ্রায় গল্প। তবু বড়দাদা অথবা সাব্বিরের কবরের
পাশে যেতে আমার বড় ভয় হয়! অহোরাত্রি শুনতে পাই জীবনজুড়ে শতসহস্র ছিদ্র
ফুঁড়ে তৈরি বাঁশির বাজনা;
সব সপ্তক চষে আর্তসুর বাজিয়ে চলেছে নিয়তির
অক্লান্ত আঙুল। এতকাল পেরিয়েও স্পষ্ট মনে পড়ে, মাচার ওপর থেকে ফুটো হয়ে যাওয়া টিনের
গ্লাসটা পালটে দিতে বলেছিলেন বড়দাদা। কী ভেবে, অথবা কিছুই না ভেবে, আমি দিই নি!
0 মন্তব্যসমূহ