ডা.সুরাইয়া
হেলেন
ঢাকার মাঝে যে এমন একটা জায়গা আছে আমার ধারনাতেই ছিলো
না! মীরপুর ডি.ও.এইচ.এস-এর ৬তলা অ্যাপার্টমেন্টের ৪ তলার ২৪০০বর্গফুটের বাড়িটায় যখন
উঠে এলাম,একটা ভালো লাগা কাজ করতে লাগলো! বাসার
সামনে প্রশস্ত রাস্তা,চারদিক খোলামেলা,সুনসান
নীরবতা!তবে চারদিকে ৬-৭তলা নতুন নতুন অ্যাপর্টমেন্ট উঠছে। সারাদিন ইট,পাথর,কাঠ,লোহা-লক্কড়ের বিচিত্র শব্দ সেই নিঃস্তব্ধতাকে ভেঙে
দিচ্ছে! হাঁটতে বের হলে কাছেই পুকুর,পুকুর পারে কদম গাছ! শীতল বাতাস উড়িয়ে নিতে চায়! সন্ধ্যা নামে পশ্চিম আকাশে
আবীর ছড়িয়ে!
এরপর পুরো এলাকাটা নিঝুমপুরী !শুধু নিচে আ্যাপার্টমেন্টের দারোয়ান,কেয়ারটেকার আর আশপাশের অর্ধ-সমাপ্ত বাড়ির দারোয়ানদের নিম্ন স্বরের কথাবার্তা,ফিসফিসানি শোনা যায়!বেশ লাগে আমার।লেখালেখির জন্য একেবারে উত্তম পরিবেশ!
এরপর পুরো এলাকাটা নিঝুমপুরী !শুধু নিচে আ্যাপার্টমেন্টের দারোয়ান,কেয়ারটেকার আর আশপাশের অর্ধ-সমাপ্ত বাড়ির দারোয়ানদের নিম্ন স্বরের কথাবার্তা,ফিসফিসানি শোনা যায়!বেশ লাগে আমার।লেখালেখির জন্য একেবারে উত্তম পরিবেশ!
এক
সন্ধ্যায় আমরা চায়ের টেবিলে।সে সময় একটা বেশ গোলমাল,হৈচৈ শোনা গেলো!আমার ১৮বছর বয়সী ছেলে কৌতুহল নিয়ে ঝট করে উঠে,ব্যালকনিতে গিয়ে ঘটনা দেখা-জানার চেষ্টা করছে!আমি ঘরের
ভেতর থেকেই উৎকর্ণ হয়ে শুনতে পেলাম,একটা করুণ কণ্ঠ কান্না মেশানো গলায় কাকুতি মিনতি করছে,
‘আমারে আর মাইরেন না!আমি চুরি করি
নাই!ওরে বাবারে,মা’রে,আামারে ছাইড়া দ্যান!’
সাথে কিল-ঘুসি-চড়-থাপ্পড়ের শব্দও বোঝা যাচ্ছে!সম্মিলিত
কণ্ঠের হট্টগোল থেকে কিছু টুকরো টুকরো কথাও উদ্ধার করা গেলো!
‘বারবার ঘুঘু তুমি খাইয়া যাও ধান!আইজকা ধরছি!মার বেটারে,মাইরা ফেলাট কইরা ফালা শালারে!চুরের বেটা চুর !দেখছস,পাক্কা চুর,মাইর খাইয়াও স্বীকার যায় না!ঐ ব্যাটা ক,কয়দিন আর এইহানে চুরি করছস?আইজকা তরে মাইরাই ফালামু।বাইর কর,বাইর কর,কি কি নিছস?’
বুঝলাম চোর ধরা পড়েছে।কিন্তু সে কিছুতেই স্বীকার করছে না।ডা.সাহেব(আমার
স্বামী)কে বললাম,
‘আরে,যাওনা তুমি?ওদের
থামাও!মেরে ফেলেবে নাকি ছেলেটাকে?’
এসময়
আবার শোনা গেলো,‘অহনও স্বীকার যাসনা?হাড্ডি-গুড্ডি আস্তা রাখুমনা কইলাম!অই আবুইল্যা,জুতা মারস ক্যান?জুতার বেইজ্জত করতাসস!আরে, হালার শইল অইলো স্টীল!হায় হায়,দিলি ত আমার স্যান্ডেলের বারোটা বাজাইয়া!হালার কিছু আইলো না,স্যান্ডেল ছিড়া গেলো!’
চোরের গলা
শোনা গেলো,‘হ,আমি চুরি করসি,স্বীকার
গেলাম,আর মাইরেন না আমারে!আইজ ২দিন কিছু খাই
নাই,আমারে এট্টু পানি দ্যান গো!’
ছেলে
ব্যালকনি থেকে দৌড়ে এলো।টেবিল থেকে কলা আর সমুচা তুলে নিয়ে বললো,‘মা, ও
কিছু খায়নি,ওরা পানিও দিচ্ছে না!আমি এগুলো আর
পানি দিয়ে আসি?’
আমার অতি
সাবধানী স্বামী ছেলেকে বাধা দিলেন,‘যেভাবে মারছে,মরে
গেলে থানা-পুলিশ হবে!বলবে,তোমার
এই কলা,সমুচা খেয়ে মারা গেছে!এসব ধকল সামলাতে
পারবো না,যেওনা তুমি!’
আমি আর
সহ্য করতে পারলাম না!ইন্টারকমে কেয়ারটেকারকে বললাম,‘মার থামাও!দোষ করলে পুলিশে দাও!’
কেয়ারটেকার বললো,‘ম্যাডাম,এরে পুলিশে দিলে কাম হইবো না,পুলিশ ছাইড়া দিবো!মাইরের ওপরে ওষুধ নাই!’
বললাম,‘ঠিক আছে,এখন মার থামাও,আমরা
দেখছি কী করা যায়!’
মার
থামলো। খবর নিয়ে জানলাম,ওকে
নীচে আন্ডারগ্রাউন্ড গ্যারেজে আটকে রাখা হয়েছে! কেয়ারটেকারকে জিজ্ঞেস করতেই ,সে রহস্যময় হাসি হেসে বললো,‘বান্ধাবান্ধির দরকার হয় নাই! ইমুন কাম করছি,কইলেও পলাইতে পারবো না!’
আ্যাপর্টমেন্টের কেউই এব্যাপারে মাথা ঘামালেন না!আমার স্বামীও না!যা করার
দারোয়ান,কেয়ারটেকাররাই করবে!
মনটা
খচখচ করতে লাগলো!রাতে প্লেটে ভাত-তরকারী আর পানির বোতল সহ,ছেলেকে নিয়ে আন্ডারগ্রাউন্ডে গেলাম! কোথাও কাউকে দেখা যাচ্ছেনা!একটা
অস্পষ্ট ফোঁপানীর আওয়াজ লক্ষ্য করে এগোলাম।
একটা গাড়ির পেছনে ১৮-২০বছরের একটা ছেলে,দুই হাঁটুর ভেতর মুখ রেখে উবু হয়ে কাঁদছে!শিউরে উঠে চোখ
ফিরিয়ে নিলাম! কেয়ারটেকারের হাসি আর কথার অর্থ এতোক্ষনে বুঝলাম! তার সব কাপড়-চোপড়
কেড়ে নেয়া হয়েছে! ছেলেটি পুরোপুরি বিবস্ত্র!খাবার রেখে ছুটে ঘরে চলে এলাম! একটা
লুঙ্গি আর সার্ট বের করে ছেলেকে পাঠালাম।
ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে দেখলাম,শীর্ণ-রুগ্ন ছেলেটি বাতাসের আগে
ছুটে পালাচ্ছে! পরনে আমার দেয়া লুঙ্গিটা এক হাতে ধরে আছে,আরেক হাতে দলা পাকানো সার্টটি!মনে হচ্ছে কেউ বোধহয় ওর পেছনে
ধাওয়া করছে ওগুলো ছিনিয়ে নেবে বলে!
ভাবলাম,দ্রৌপদীর বস্ত্র হরণের বীজ এখনও লুকিয়ে আছে আমাদেরই
মাঝে!
0 মন্তব্যসমূহ