সুলতানা রহমান
২৪.০৪.২০১৩ বাংলাদেশের সাভারে রানা প্লাজা নামের ভবনটি ভেঙ্গে পড়ে। এখানে ছিল একটা পোষাক কারখানা। চাপা পড়ে মারা যায় অসংখ্য পোষাক শ্রমিক। এ ঘটনা নিয়ে নিচের লেখাটি সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছিল।
----------------------------------
২৪.০৪.২০১৩ বাংলাদেশের সাভারে রানা প্লাজা নামের ভবনটি ভেঙ্গে পড়ে। এখানে ছিল একটা পোষাক কারখানা। চাপা পড়ে মারা যায় অসংখ্য পোষাক শ্রমিক। এ ঘটনা নিয়ে নিচের লেখাটি সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছিল।
----------------------------------
’হ্যালো বাবা, হ্যালো মা, হ্যালো হ্যালো... কেউ আছেন? ভেতরে কেউ আছেন?’ সরু অন্ধকার সুরঙ্গের ভেতরে এভাবেই জীবিতদের খুজেছেন লিজা। ধ্বংস স্তপের ভেতর নিজেই আবার হারিয়ে না যান, সেই জন্য কোমড়ে দড়ি বেধে পৌছে গেছেন দুর্গম অনেক কক্ষে। তার মাথায় কখনও খসে পড়ছে পলেস্তারা, কখনও আহতদের ফোটা ফোটা রক্ত। কখনও ধ্বংস স্তুপের খাজে খাজে ঝুলে থাকা গলিত লাশ ঠেলে ভেতরে গেছেন, কখনও শাবল হাতে ভেঙ্গেছেন কংক্রিটের দেয়াল, সন্ধান করেছেন জীবিতদের। উদ্ধার করেছেন অন্তত অর্ধশত নারী পুরুষ।
‘দুর্ঘটনার পরের দিন নয় তলা’র সরু সুড়ঙ্গ পথে হামাগুড়ি দিয়ে পাঁচ তলা পর্যন্ত পৌছতে পেরেছিলাম। মানুষের উপস্থিতি বুঝতে পেরে একটা রুম থেকে দেয়ালের ক্ষীন কন্ঠে এক নারী চিঁতকার করে বলতে থাকে, বাচান, আমারে একটু বাচান। আমি বকুল। বাড়ি বগুড়া। বাচান’। শাবল দিয়ে সেই রুমে একটু ছোট গর্ত করি। টর্চ মারতেই দেয়ালে ঝুলে থাকতে দেখি মুখের ভেতর রড ঢুকে থাকা এক নারীর লাশ। পাশে তাও দুটো মৃতদেহ। সেই ফুটো দিয়ে একজন নারী আমার হাত চেপে ধরে। তাকে বের না করলে সে কিছুতেই আমাকে ছাড়বেনা। কিন্তু তখন আমার আশপাশে আর কেউ ছিলোনা। আর দেয়ালটিও আমার একার পক্ষে ভাঙ্গা সম্ভব ছিলোনা। টানাটানি করায় হাতের টর্চটি পড়ে যায়। ভয় পেয়ে জোরে হাত টান দিলে, বকুলের হাতের চুড়িটি খুলে আসে আমার হাতে।” বলছিলেন লিজা। সেই সুড়ঙ্গ বেয়ে উপরে আসতে আসতে অজ্ঞান হয়ে গেলে তাকে হাসপাতালে নেয়া হয়।
’বকুলের আর্তনাদ আমার কানে সারাক্ষন বাজছে। কিছুতেই ভুলতে পারছিনা, অজ্ঞান না হয়ে গেলে আমিই তাকে বের করতাম। পরে শুনছি সেখান থেকে বেশ কয়েকজনকে উদ্ধার করা হয়েছে, কিন্তু তাদের মধ্যে বকুল আছে কিনা তা আমি জানিনা,” বলতে বলতে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে লিজা”।
”আরেকটি দৃশ্য মনে করলে হাউ মাউ করে কান্না আসে। একটি গর্ভবতী নারীর পেটের ওপর পিলার পরেছে, পেট ফেটে অনাগত শিশুটির মাথা বের হয়ে আছে।’ লিজা সত্যিই হেইমাউ করে কেদে ওঠে।
থিয়েটার কর্মী আসমা আখতার লিজা ২৫ এপ্রিল থেকে লিজা নিজ তাগিদে নেমেছিলেন উদ্ধার অভিযানে। ধ্বংস স্তপের যেসব দুর্গম কক্ষে পুরুষ উদ্ধারকর্মীরাও যেতে সাহস পায়নি, লিজা সেখানে পৌছে গেছেন অসীম সাহস নিয়ে। স্বীকৃতি হিসেবে পেয়েছেন সহযাত্রীদের প্রশংসা-’লিজা আপার সাহস আর শক্তি দশ জনের সমান। এমন সাহসী মেয়ে কখনও দেখি নাই,” বলছিলেন একজন সেনা সদস্য। তার কথায় সায় দেন আরও কয়েকজন সাধারন উদ্ধারকর্মি। অচেনা-অজানা এই উদ্ধারকর্মিদের কাছে লিজা এক অসিম সাহসের নাম।
’উদ্ধার করতে গিয়ে কখনও ভয় লাগেনি। মাঝে মাঝে বড় বেশি আবেগ তাড়িত হয়ে পড়েছি, সেই জন্যই আসলে নিজের নিরাপত্তার কথা ভুলে কাজ করতে পেরেছি। বাচার আকুতি কত মানুষ ধ্বংস স্তপের ভেতর অপেক্ষা করছে, তাদের বাচানোর চেষ্টা সাধ্য মতো করাই তো মানুষের কাজ। আমরা কেবল সেই টুকুই করার চেষ্টা করেছি, তবু অনেক মানুষকে বাঁচাতে পারিনি-কষ্ট হয়,’ বলছিলেন লিজা।
0 মন্তব্যসমূহ