ক্রুগো'র দোকান

রুবিনা খানম

ক্রুগো যখন দোকানের শেষ বাতি নিভাচ্ছে তখনো মেয়েটা রাস্তার ওপারে দাঁড়িয়ে। কী দেখে অমন মনোযোগ দিয়ে!ডিসপ্লেতে সাজানো বাহারি ব্যাগ? নাকি বুড়ির হাতের মতোই ফেটে যাওয়া মরাটে রুগ্ন ডালিমগুলো? গত পরশুও এসেছিল সে। সোনালু চামড়ার নীচ থেকে রক্ত সরে গেছে আরও। সন্ধ্যার বিষণ্ণতা পসরা সাজিয়েছে দুচোখে।


সাহায্যকারী ছেলেটি জানিয়ে গিয়েছিলো নতুন কাস্টমারের কথা। কিন্তু সাথে সাথেই ক্রুগোর উঠে আসার উপায় ছিলোনা। বুড়ো ভুহাই তখনো হাতটা ধরেছিলো ওর। বুড়োর টাকার অভাব ছিলোনা, অভাব ছিলো তা ভোগ করার মতো লোকের। তবুও কোনদিন কেউ দুপয়সার সাহায্য পায়নি, তাই কেউ কাছেও ঘেঁষেনি। শেষবেলাতেও বুড়োর কিপ্টেমি যায়নি, দাম নিয়ে মূলো ঝুলোঝুলি করেছে অনেকক্ষণ। শেষে ১৫০ রুক্তিতে দফা!

দরজা ঠেলে কাউন্টারের সামনে এসে দাঁড়ালে মেয়েটা ক্যাটালগ থেকে মুখ তুলে। তোমাদের এখানে প্রতিটি পদ্ধতির অনেক দাম লিখে রেখেছ! অথচ রুগুলকের দোকানে সবগুলির দাম কিন্তু প্রায় অর্ধেক!শব্দগুলি যেন বাতাসের গায়েও শিরশিরে কাঁপন ধরিয়ে দেয়। ক্রুগোর কানে তাই একটু দেরীতে পৌঁছায়। তাহলে সেই কসাইটার কাছেই যাচ্ছোনা কেন?’ বলতে গিয়েও গিলে ফেলে। কাস্টমারকে সব কথা বলতে নেই। রুগুলক যেন তেন করে কাজ সারে তা সবাই জানে। অথচ ক্রুগো সবচেয়ে কম যন্ত্রনা যেন হয় সেদিক দিয়ে সচেষ্ট থাকা থেকে শুরু করে, যথাস্থানে তা পৌঁছে দেয়ার ব্যবস্থা পর্যন্ত করে। এমনকি সে নিজের হাতে সবকিছু করে, কাস্টমার চাইলে শেষ সময় উপস্থিত থাকে। তবুও লোকের অভিযোগের কমতি নেই!

মেয়েটি আবার খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে ক্যাটালগ দেখে। অবশেষে নলখাগড়ার মতো তর্জনীটা সবচেয়ে দামী এবং সহজ পদ্ধতির উপর প্রতিস্থাপিত হয়।
আমি যদি এটা বেছে নেই, বলতে পারো কতক্ষণ লাগবে সবকিছু শেষ হতে?’
দুই মিনিট ষোল সেকেন্ড।
তুমি কি ঘড়ি হাতে নিয়ে বসে দেখেছিলে?’
মেয়েটা কি কৌতুক করছে? পেশাগত অভিজ্ঞতার কোন দাম নেই! ক্রুগো এইবার কিছুটা চিবিয়ে জবাব দেয়-
শেষ মূহুর্তে যদি তোমার দৃঢ় চিত্ত চির খায়, সেক্ষেত্রে কিছু সময় বেশি লাগবে।
এটা নিয়ে তোমার চিন্তার কিছু নেই। কিন্তু তুমি কি অন্তত কিছুটা দাম কমাতে পারো না?’
ক্রুগো এইবার বেশ বিরক্ত হয়। এরা সবাই ভাবেটা কী! এটা কি কোন দাতব্যলয় যেখানে বিনামুল্যে সেবা প্রদান করা হবে!
এতে যদি তোমার পোষায় তাহলে সবকিছু দ্রুত এবং সহজভাবে করার ব্যবস্থা করতে পারি। নইলে তুমি রুগুলকের দোকানে যেতে পারো। আশা করি তোমার বাজেট অনুযায়ী সেটাই উত্তম হবে।
তুমি একটু চিন্তা করে দেখ। আমি কাল আবার আসবো।
মেয়েটি ভারী আশ্চর্য! মাথাব্যথা কি আমার! ক্রুগো মুখ শক্ত করে মেয়েটির চলে যাওয়া দেখে। দেখো, এমনভাবে পা ফেলছে যেন মাটিতে ধূলোবালিগুলো ব্যাথায় আর্তনাদ করে উঠবে!

আসেনি মেয়েটি গতকাল। কোন কারনে ক্রুগো সারাদিন মেয়েটির অপেক্ষায় ছিল। অবশ্য শক্তচোয়াল আর ঘন ভ্রু এর নীচে সাদা বোতামের মতো চোখ দেখে কিছু বোঝার উপায় নেই।

দোকানে ঝাঁপিটা ফেলার পরও মেয়েটা একই জায়গায় দাঁড়িয়ে।ল্যাম্প পোস্টের ম্যারম্যারে হলুদ আলোয় মেয়েটাকে আরও ক্ষয়াটে মনে হয়। এবার ক্রুগোর দোকানের দিকেই মুখ করা। দোকানের সাইনবোর্ডটি লাল সবুজ আলোয় বার বার পড়েই যাচ্ছে-
ডেথ সপ। স্বল্পক্ষণে এবং সহজতম উপায়ে আপনার জীবনাবসান ঘটানোর একমাত্র বিশ্বস্তকর সাহায্যকারী প্রতিষ্ঠান

ক্রুগো অস্বস্তি নিয়ে ভাবে, একবার কি গিয়ে বলা যায় আচ্ছা, ৫ রুক্তি না হয় কম দিও’ ?*











লেখক পরিচিতি
রুবিনা খানম
ফেব্রুয়ারী ১১।
রেজিনা ইউনিভার্সিটি, কানাডা।
ব্লগার। গল্পকার। 


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ