হাসান আজিজুল হক(জন্ম ১৯৩৯) আমাদের কথাসাহিত্যের শক্তিমান লেখকদের একজন।
দীর্ঘ পাঁচ দশক ধরে তিনি লিখে চলেছেন। লেখালেখির জন্য পেয়েছেন বাংলাদেশের প্রায় সকল উল্লেখযোগ্য পুরষ্কার এবং রাষ্ট্রীয় একুশে পদক। আসাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পেয়েছেন সম্মানসূচক ডি.লিট (২০১২)। তাঁর লেখা গল্প অনূদিত হয়েছে ইংরেজি, হিন্দি, উর্দু, রুশ ও চেক ভাষায়। সমুদ্রের স্বপ্ন, শীতের অরণ্য, আত্মজা ও একটি করবী গাছ, জীবন ঘষে আগুন, পাতালে হাসপাতালে, রাঢ় বঙ্গের গল্প, মা মেয়ের সংসার তাঁর উল্লেখযোগ্য গল্পগ্রন্থ।লিখেছেন বিভিন্ন বিষয়ে নানা প্রবন্ধ ও শিশুতোষ রচনা। প্রকাশিত হয়েছে আত্মজীবনীর দু’টি পর্ব। এমনকি অনুবাদ করেছেন একটি নাটক, যার বাংলা নামকরণ- চন্দর কোথায়।যদিও কথাসাহিত্যই তাঁর লেখালেখির মূল জায়গা, কিন্তু সেই কথাসাহিত্যেরই একটি বড় ক্ষেত্র বা মাধ্যম উপন্যাস, যেখান থেকে তিনি রয়েছিলেন দূরে।
কেন এই দূরে থাকা ? অবশেষে লেখালেখি শুরু করার প্রায় পঁয়তাল্লিশ বছর পরে ২০০৫ -এ তিনি জবাব দিলেন। লিখে ফেললেন ‘আগুনপাখি’। দেশভাগকে মূল উপজীব্য করে লেখা উপন্যাসটি প্রকাশের পরপরেই সচেতন পাঠক ও তীক্ষè সমালোচকদের নজর কাড়ে। প্রথম উপন্যাস প্রকাশিত হওয়ার আট বছর পরে সম্প্রতি (মার্চ, ২০১৩) প্রকাশিত হয়েছে তাঁর নতুন উপন্যাস ‘সাবিত্রী উপাখ্যান’। লেখালেখির সেই শুরুর দিক থেকেই তিনি সমান আলোচিত। লেখার পাশাপাশি, অতীতে তাঁর দেয়া বিভিন্ন সাক্ষাতকারকে কেন্দ্র করে উত্তপ্ত হয়ে ওঠেছে আমাদের সাহিত্য অঙ্গন। হাসান আজিজুল হকের লেখা যেমন আমাদেরকে টেনেছে ভিন্ন নতুন মুগ্ধতায়, তেমনি তাঁর দেয়া সাক্ষাতকারও হয়ে ওঠে সাবলীল, হাস্য-রসে ভড়পুর- যেন বা রক্ত-মাংসের জীবন্ত মানুষ ! সাহিত্যের নানা দিক নিয়ে তাঁর সাথে অন্তরঙ্গ আলোচনায় বেরিয়ে এসেছে এমনসব দিক, যা আমাদেরওউৎসাহিত করবে কথাসাহিত্যের দিগন্তে উঁকি দিতে !
প্রতিমুহূর্ত : আপনার কাছে প্রথমে জানতে চাইবো- আপনি লেখালেখি করছেন পাঁচ দশকেরও বেশি সময় ধরে। এই দীর্ঘ সময়ে আপনি লিখেছেন গল্প, প্রবন্ধ, আত্মজীবনী, শিশুতোষ গ্রন্থ এবং অনুবাদ করেছেন নাটক। এমনকি সম্পাদনা করেছেন জি.সি. দেব রচনাবলী। কিন্তু উপন্যাস লিখতে এতো সময় নিলেন কেন ?
হাসান আজিজুল হক : আমি যখন থেকে লেখালেখি শুরু করেছি, তখনই ভেবেছি উপন্যাস লিখব। উপন্যাস আমাকে যতোটা টানতো, কবিতা ততোটা টানতো না। পড়তে পড়তে যখন ভেবেছি আমিও লিখবো, তখনই ঠিক করেছিলাম উপন্যাস লিখবো। বিশ্বের বিখ্যাত লেখকদের উপন্যাস পড়তে গিয়ে বারবার ভেবেছি আমিও উপন্যাস লিখবো। লেখা শুরুও করেছিলাম। ১৯৫৭ সালে একটি উপন্যাস লেখায় হাত দিয়েছিলাম। সেটি ছাপাও হয়েছিল পূর্বমেঘপত্রিকায় ‘শামুক’ নামে।তারপরে ১৯৬০-এ এসে লিখলাম ‘শকুন’। সবাই সেটাকে বললো গল্প ! আমিও গল্প বলেই মেনে নিলাম।তারপরে পূর্বমেঘ পত্রিকায় একটি গল্প ছাপা হলো। সেটিও দেখলাম সমালোচকদের প্রশংসা পেল। তখন আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ সাম্প্রতিক ধারার গল্প নামে একটি গল্প সংকলন বের করেন। সেখানে আমার ‘বৃত্তায়ন’ ছাপা হয়। ’৬৯-এর দিকে ‘শিউলি’ নামে আরেকটি লেখা প্রকাশ হয়। তারপরে গল্প লেখাই শুরু করি। হতে চেয়েছিলাম ঔপন্যাসিক, লোকজন বানিয়ে ছাড়লো গল্পকার (হা ...হা... হা)! এখন পরিচয় দাঁড়িয়েছে ছোটগল্পকার। অনেকেই বলতেন- শুধু গল্প লিখে সাহিত্যজগতে টিকতে পারবে তো ? পরে অবশ্য অনেক দীর্ঘ গল্প লিখেছি।আর্নেষ্ট হেমিংওয়ের 'ওল্ড ম্যান এন্ড দ্যা সি' যাকে উপন্যাস বলা হয়, আসলে তা কিন্তু দীর্ঘ গল্পই বটে। কিন্তু, হেমিংওয়ে লিখেছিলেন উপন্যাস হিসেবেই। তবে আমার ক্ষেত্রে যা হয়েছে তা হলো, আমি কখনোই উপন্যাস লেখার জন্য কোমর বেঁধে নামিনি। ‘আগুনপাখি’- যেটিকে সবাই আমার প্রথম উপন্যাস বলে আসছে সেটিও কিন্তু গল্প হিসেবেই প্রথমে লেখা হয়েছিল। গল্পটি প্রথম আলোতে ছাপা হওয়ার পরে, আমার এক বন্ধু বললেন, হাসান, তোমার ঐ গল্পটার ভিতরে এমন একটা কিছু আছে যা আরো বড় কিছু দাবি করে। তুমি এক কাজ করো, গল্পটার ভিতরে একটা ডিনামাইট ঢুকিয়ে সেটিকে ফাটিয়ে দাও ! তারপরে বন্ধুর কথায় হোক আর যে কারণেই হোক গল্পটি নিয়ে আবার বসার পরেযা হলো তা-ই ‘আগুনপাখি’ উপন্যাস।
প্রতিমুহূর্ত : ‘আগুনপাখি’তে আমরা দেখি ’৪৭ এর দেশভাগের প্রসঙ্গ। যেখানে একজন নারীর জবানীতে সেই নারীর জীবনের নানা টানাপোড়নের মধ্য দিয়ে এগিয়ে যায় উপন্যাসের গতিপথ। যেহেতু বিষয়টি দেশভাগ, তাই আমার মনে একটি প্রশ্ন জাগে এইযে, আপনার জন্মও যেহেতু ওপাড় বাংলায়, আপনি নিজেও দেশভাগের ফলে সৃষ্ট কোনো না কোনো সমস্যার মুখোমুখি হয়েছেন। আর তাই আপনার লেখক মন সচেতন বা অবচেতনভাবে আপনাকে দিয়ে লিখিয়ে নিয়েছে ‘আগুনপাখি’। এ বিষয়ে আপনার মন্তব্য-
.
প্রতিমুহূর্ত : ‘আগুনপাখি’তে আমরা দেখি ’৪৭ এর দেশভাগের প্রসঙ্গ। যেখানে একজন নারীর জবানীতে সেই নারীর জীবনের নানা টানাপোড়নের মধ্য দিয়ে এগিয়ে যায় উপন্যাসের গতিপথ। যেহেতু বিষয়টি দেশভাগ, তাই আমার মনে একটি প্রশ্ন জাগে এইযে, আপনার জন্মও যেহেতু ওপাড় বাংলায়, আপনি নিজেও দেশভাগের ফলে সৃষ্ট কোনো না কোনো সমস্যার মুখোমুখি হয়েছেন। আর তাই আপনার লেখক মন সচেতন বা অবচেতনভাবে আপনাকে দিয়ে লিখিয়ে নিয়েছে ‘আগুনপাখি’। এ বিষয়ে আপনার মন্তব্য-
.
হাসান আজিজুল হক : অবচেতন নয়। দেশভাগের ফলে আমার জীবনে ওরকম সরাসরি কোনো আঘাত আসেনি। আমি বাধ্য হয়ে বা নিয়তি তাড়িত হয়ে আসিনি। মুর্শিদাবাদে আমার বড় বোনের বিয়ে হয়েছিল। যশোরের কলেজে আমার বোন শিক্ষকতা করেছেন। আমার বড় ভাই এখানে চাকরী করতেন। তাই আসা-যাওয়াটা কিন্তু ছিল। আমাদের বিশাল পরিবারের বিস্তৃতি ছিল।কিন্তু তারপরেও সবার কাছেই সবার আসা-যাওয়াটা হতো। আমার মনে আছে, ’৪৭-এ আমি ক্লাশ ফোরে পড়ি। হয়তো ক্লাশ ফোরের ফাইনাল পরীক্ষা দিয়ে ফেলেছি অথবা ফোরেই আছি তখনও। ১৯৫৪ তে আমি স্কুল পাশ করি। আমি ভারতীয় পাসপোর্টে এখানে লেখাপড়া করেছি।’৪৭-এ যা ঘটেছে তা রাজনৈতিক কারণ। এটা খুবই ভয়ঙ্কর একটি মানবিক ট্র্যাজেডির বিষয়। রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের স্বার্থসংশ্লিষ্টতার ফলে তা ঘটেছিল। এর সাথে জনগনের কোনো সম্পর্ক নেই। জনগনের মতামতও জানতে চাওয়া হয়নি। এর ফলে বিশাল ক্ষতি হয়েছে আমাদের। সেটা কিন্তু মাত্র ২৩ বছরেই পরিষ্কার হয়ে আসে। এর আগে ১৯০৫-এ এমন ঘটনা ঘটেছিল। সেটাও কিন্তু মানবিক বিপর্যয়। তবে এ সংক্রান্ত যে বিষয়টি আমাকে ভাবায় তা হলো- নতুন জেনারেশন বিষয়টিকে কিভাবে দেখে ? আমার মনে হয় দেশভাগ নিয়ে বা এ সংক্রান্ত লেখালেখি কম হয়েছে। যা হয়েছে তা নিয়েও সন্দেহ থেকে যায়। অথবা বলা যেতে পারে তা নতুন জেনারেশনের কাছে পৌঁছেছে কিনা ? দেশভাগ এদেশের (তৎকালিন পূর্ব পাকিস্তানের) ৮৫ ভাগ মুসলমানের কোনো কাজে আসেনি। বরং ক্ষতি হয়েছে। ’৭১-এ পশ্চিমবাংলার মুসলমানেরা অনেকেই চান নি যে, পাকিস্তান ভেঙে আলাদা হয়ে যাক। তারা অনেকেই মনে করতেন, একটি মুসলিম রাষ্ট্র ভেঙে দেবার কি দরকার ? ‘উত্তর বসন্তে’ বলেএকটা গল্প আমি লিখেছিলাম। আজ ৫০ বছর পরে বাস্তবতার খাতিরে অনেকেই এইগল্পে আগ্রহী হন না।
প্রতিমুহূর্ত : সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে আপনার ২য় উপন্যাস ‘সাবিত্রী উপাখ্যান’। এ উপন্যাসের বিষয় হিসেবে আপনি ধর্ষণের মতো একটি বিষয় নিয়ে এলেন। এ বিষয়ে কিছু বলুন।
হাসান আজিজুল হক : ‘সাবিত্রী উপাখ্যান’- এর কাহিনী একটি সত্য ঘটনাকে কেন্দ্র করে। সাবিত্রী নামের এক কিশোরীকে ধর্ষনের ঘটনাকে ঘিরে উপন্যাসটি রচনা করেছি। এক কিশোরী ধর্ষনের দায়ভার পুরো পুরুষজাতির। এ লজ্জা পুরুষ হিসেবে আমারও। আর আমি এ উপন্যাসটির উৎসর্গ পৃষ্ঠায় লিখে দিয়েছি- ‘সাবিত্রী দেবী, ক্ষমা করো।’

হাসান আজিজুল হক : এই যে তোমরা সমাসবদ্ধ কি সব ‘ডকু-ফিকশন’ টিকশন বলো না, এ সবে আমি বিশ্বাস করি না। আমি এটিকে উপন্যাস হিসেবেই লিখেছি। এখানে একটি কিশোরী মেয়ের নির্যাতনের বিষয়টিকে নিয়ে এবং এর ফলে পুরুষ সমাজের প্রভাব ও প্রতিক্রিয়া নিয়ে উপন্যাসটি লিখেছি। আর এখানে কাহিনী হচ্ছে কঙ্কালের মতো। আমি আমার মতো করে রক্ত-মাংসের যোগান দিয়েছি।ঐ যে একটা বাঘের গল্প আছে, জানো তো ...? এক গহীন জঙ্গলে বেড়াতে গিয়েছে চার যুবক। তাদের সকলেই মন্ত্র জানে। তো জঙ্গলে গিয়ে তারা দেখলো একটি বাঘের কঙ্কাল পড়ে আছে। তখন যুবকদের মধ্যে একজন মন্ত্র পড়ে কঙ্কালগুলোকে জোড়া লাগিয়ে ফেলল। অপরজন মন্ত্র বলে কঙ্কালে রক্ত-মাংস লাগিয়ে দিল। অন্য একজন চামড়া লাগিয়ে দিল। আর বাকি জন বাঘের দেহে প্রাণ সঞ্চার করে দিল। প্রাণ ফিরে পেয়েই বাঘ হালুম করেচার যুবককেই খেয়ে ফেলল। বুঝেছো এবার ? আমি কাহিনীর কঙ্কালকে শুধু প্রাণ দিতে চেষ্টা করেছি। এটি পুরোপুরিই 'বেসড অন ফ্যাক্টস' উপন্যাস। আমি আছি আমার পুকুরে। ইচ্ছে মতো সাঁতার কাটি। এটাই আমার অভিষ্ট। কঙ্কালকে কংক্রীট করে তুলতে চাই।
প্রতিমুহূর্ত : ‘আগুনপাখি’ এবং এখন পর্যন্তপ্রকাশিত সর্বশেষ উপন্যাস ‘সাবিত্রী উপাখ্যান’ এর বাইরে আপনার আর কোনো উপন্যাস আছে কিনা বা নতুন করে উপন্যাস লেখার কথা ভাবছেন কিনা ?
হাসান আজিজুল হক : তাস আমার হাতে আছে গো এহ্্সান! শেষ হয়ে যায় নি। ‘তরলা বালা এক বঙ্গ রমনীর গাথা’ নামে একটি উপন্যাস একসময় পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে বের হতে শুরু করেছিল, পরে সেটি আমি ছেড়ে দিয়েছি। ওর কাছে আর ফেরা হয়নি। এটি একটি সত্য ঘটনাকে কেন্দ্র করে লিখতে শুরু করেছিলাম।কুমিল্লার ওদিকে নিদারাবাদ বলে একটা জায়গা আছে। ১৯৮০ সালের দিকে ওখানে একটা ভয়াবহ হত্যাকান্ড হয়েছিল। একটি হিন্দু পরিবারের সকল সদস্যকে নৌকায় করে নিয়ে গিয়ে হত্যা করা হয়েছিল। হত্যার পরে লাশগুলোকে টুকরো টুকরো করে কেটে প্লাস্টিকের ড্রামে চুন ভর্তি করে পানিতে ফেলে দেয়া হয়েছিল। ঐ ঘটনায় তাজুল ইসলাম নামের একজনের ফাঁসিও হয়েছিল। এখন ভাবছি, ঐলেখাটাকে নিয়ে আবার বসবো। আর এছাড়া এটা হয়তো অনেকেই জানে না, ‘শামুক’ নামে আমার একটি উপন্যাস আছে। সেটি এখন পর্যন্ত কোথাও প্রকাশ করিনি।
প্রতিমুহূর্ত : তবে কি সেটি অপ্রকাশিত হাসান আজিজুল হক গ্রন্থভুক্তির জন্য অপেক্ষা করছে ?
হাসান আজিজুল হক : তা মন্দ বলোনি (হা...হা...হা)। কিন্তু এখন যেমনটা দেখছি, প্রকাশকদের দাবী রাখতে গিয়ে হয়তো সেটিও প্রকাশ হয়ে যেতে পারে।
প্রতিমুহূর্ত : এবার আপনার গল্প প্রসঙ্গে আসি। আর এ প্রসঙ্গে এসে প্রথমেই একটু বলে নিতে চাই লাতিন আমেরিকান লেখক মার্কেসের কথা। মার্কেস তাঁর গল্প লেখার কথা বলতে গিয়ে বলেছেন যে, ছোটবেলায় তাঁর দাদুর কাছে গল্প শুনে শুনে গল্প লেখার হাত পাঁকিয়েছেন। তাই তাঁর গল্প লেখা মানে আসর জমানো বা একজন কথক বলে যাবেন আর শ্রোতারা শুনবেন। আর আমাদের রবীন্দ্রনাথ তো রীতিমতো ছোটগল্প লেখার সংজ্ঞাই দিয়েগেছেন ! সেদিক বিবেচনায় আপনি গল্প লেখার সময় কোন কোন বিষয়গুলো আপনার মাথায় রাখেন ?
হাসান আজিজুল হক : আমি গল্প লেখার সময় মার্কেসের কথাও যেমন স্মরণ করি না, তেমনি রবীন্দ্রনাথকেও মাথায় রাখি না। আরো খোলাখুলি বললে, কাউকেই মনে রেখে গল্প লিখি না। বরং গল্প লেখার সময় আমি তাকাই আমার ভেতরের দিকে। সেখানটায় গভীরভাবে দেখার চেষ্টা করি। আমার ভিতরে আমি দেখি রয়েছে - মানুষ এবং সমাজ। রয়েছে ব্যাক্তি মানুষের স্বাধীনতা। কিন্তু সেই স্বাধীনতা মানে অবশ্যই স্বেচ্ছাচারিতা নয়। এক কথায় বলতে গেলে- আমি কোনো দীক্ষিত গল্পকার নই। আমি গল্প লেখা শুরু করার পরে বিখ্যাতদের লেখা পড়তে শুরু করেছি। আমি গল্প লিখি নিজের ইঞ্জিনের ষ্টীমের জোড়ে ! অন্যের ষ্টীমে নয়। এটা আমি অহংকার করে বলছি না। কারণ, আমি গ্রামে থাকায় সেখানে বসে বিখ্যাতদের বই সংগ্রহ করতে পারতাম না। তাই লেখার ক্ষেত্রে সবসময় আমাকে নিজের জীবনের দিকেই তাকাতে হয়েছে। সেখানে আমি এক জীবনের ভিতর দিয়েই অনেক জীবন দেখেছি। আমি তো একা নই। যদিও বলা হয়, জীবনের কোনো অর্থ নেই। কিন্তু জন্ম থেকে মৃত্যু -এটা তো আছে। এটা তো এড়ানো যায় না। তবে জন্ম থেকে মৃত্যু -এই সময়টাকে আমি উপভোগ করবো না কেন ? আমি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখবো না কেন ? আমার লেখনিতে এইসব বিষয়কেই ধরতে চেষ্টা করেছি। তবে তথাকথিত সামাজিক দায়বদ্ধতার তকমা আমি কখনো লাগাতে চাইনি।
প্রতিমুহূর্ত : গল্পের আকার নির্ধারনের বিষয়টি আপনি কিভাবে দেখেন ? আমরা আপনার গল্পের দিকে তাকিয়েই যদি বলি, যেমন- আপনার কোনো কোনো গল্প বারো’শ থেকে পনের’শ শব্দের মধ্যে যেমন রয়েছে, আবার বারো থেকে চৌদ্দ হাজার শব্দের মধ্যেও আছে। এ ব্যাপারে আপনার মতামত-
হাসান আজিজুল হক : যখন গল্প লিখি তখন সেটি কতো শব্দ হলো, কতো পৃষ্ঠা হলো সেদিকে তাকাইনা। সেটি নিয়ে ভাবিও না। গল্পের প্রথম বাক্যটি লিখে ফেলার পরে, পরের বাক্যটি, এবং তারপরে তার পরেরটি একে একে চলে আসে। এমন অনেক হয়েছে, কেবল প্রথম বাক্যটিই আমার মাথায় এসেছে, আমি লিখতে বসেছি। দ্বিতীয় বাক্য কি লিখবো আমি জানি না। কিন্তু প্রথম বাক্যটি লেখার পরেই কলম দ্বিতীয় বাক্যটি লিখে ফেলেছে। এমনকি এমনও ঘটেছে পুরো গল্প পর্যন্ত ! আমার অভ্যেস হচ্ছে গল্পে কিছুতেই বেশি কথা না বলা। যেন মেদ না থাকে। লেখার পরে আমিবাক্যটিকে বারকয় সময় নিয়ে দেখি। বারবার দেখায় বাক্য কমে। আমি সব সময় আবেগকে চেপে রাখার চেষ্টা করি। আবেগ যেন যুক্তি-বিচারকে ছাড়িয়ে প্রধান হয়ে না ওঠে। যুক্তি এবং বিচারবোধ যেন প্রাধান্য পায়। গল্পের বিষয়ই ঠিক করে দেবে গল্প কতটুকু হবে। আর যেটি আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ তা হলো- যখন গল্পকার মনে করেন যথেষ্ট হয়েছে, আর নয়। তিনি সেখানেই ইতি টানতে পারেন। লেখকের তুষ্টি হলো আসল বিষয়।
প্রতিমুহূর্ত : আপনার কাছে গল্প এবং উপন্যাসের মধ্যে মৌলিক পার্থক্য কোনটিকে বলে মনে হয় ?
হাসান আজিজুল হক : গল্পতে মনে হয় বিস্তারিত বুঝানোর জন্য বাক্য ব্যয়ের সুযোগ কম। কিছুটা ইঙ্গিতময়তা প্রয়োজন এখানে। সহজ একটি বাক্য, কিন্তু সহজ কথা না বলে ভিন্ন কথা বুঝানোর ব্যাপারটা থাকবে। আমি গল্পে আমার বাক্যটিকে একটি টর্চের মতো ব্যবহার করি। যেমন কোনো এক লোক আত্মহত্যা করার জন্য রেল লাইনের ওপর গিয়ে দাঁড়ালো। এখন তার মৃত্যু বুঝানোর ব্যাপারটিও বলতে হবে, আবার সরাসরি বলবোও না তিনি মারা গেছেন, বাক্যটি হতে পারে এরকম- তারপর ধপ ধপ শব্দ করে রেল যাওয়ার আওয়াজ শোনা গেল কেবল। আর উপন্যাসে বিস্তারিত আনা সম্ভব। এখানে একটি মানুষের মন খোঁজার মতো কাজও করা যায়। উপন্যাসে অনবরত অনুসন্ধান চালিয়ে যাওয়া সম্ভব।
প্রতিমুহূর্ত : আপনার অধিকাংশ রচনায় যেমন- শকুন, মা মেয়ের সংসার, আত্মজা ও একটি করবী গাছ, সুখের সন্ধানে, আগুনপাখি এবং সর্বশেষ সাবিত্রী উপাখ্যান সবকটিতেই নারী হচ্ছে প্রধান বিষয়। অন্যভাবে বলতে পারি, নারী চরিত্র আপনার প্রায় গোটা সৃষ্টি জুড়ে। এইযে বারবার নারী এসেছে, এটা কি সচেতনভাবেই করেছেন ? নাকি...
হাসান আজিজুল হক : সচেতনভাবে নয়। ছোটবেলা থেকে নারীর যে ভূমিকা দেখে এসেছি, সেখান থেকেই এসেছে বা নেয়া হয়েছে। জীবন-যাপনে নারীর যে রূপ আমার সামনে দেখেছি- আনন্দ যেমনি রয়েছে তেমনি দুঃখবোধও রয়েছে। রয়েছে নানা অভাববোধও। ‘সুখের সন্ধানে’ নামে গল্পটিতে একটি মানসিকভাবে নিঃস্ব মেয়ের কথা এসেছে। ‘উটপাখি’ নামের গল্পটিতেও এসেছে। তবে তা ভিন্নভাবে। আত্মজৈবনিক গল্প ‘একটি নিরাপদ নীল নির্জন’, এ গল্পটিতে বোধহয় আমি স্বভাবের বাইরে চলে গিয়েছি। নারীর প্রাধান্য কার রচনায় নেই ? বঙ্কিমের নারীদের মধ্যে- আয়েশা, রোহিনী, কপালকুন্ডলার কথা বলা যেতে পারে। রবীন্দ্রনাথের দুইবোন, আর শরৎ- এর নারীই তো তাঁর রচনার উল্লেখযোগ্য চরিত্র। আমার নারীরা শিড়দাড়া উঁচু করে বাঁচতে চায়। তাঁরা প্রয়োজনে ভেঙে যায়, কিন্তু মচকায় না।
প্রতিমুহূর্ত : এবার একটু ভিন্ন প্রসঙ্গে ঢুকবো আমরা। আমরা অনেক গল্পে দেখেছি যেখানে কোনো গল্প নেই। যেখানে রয়েছে অনিশ্চিত ঘটনার বয়ান। এই মূহুর্তে মনে পড়ছে শহীদুল জহিরের ‘কোথায় পাবো তারে’ গল্পটির কথা। গল্প না থেকেও এটি কিন্তু আমাদেরকে অনিশ্চয়তার ভিতর দিয়ে দিগন্তরেখায় নিয়ে যায়। আবার শরৎ চন্দ্রের ‘মহেশ’ কিন্তু নিটোল একটি গল্প। তাই আপনার কাছে জানতে চাইছি- গল্পে গল্প থাকাটা জরুরী কিনা ?
হাসান আজিজুল হক : গল্পে গল্প থাকা উচিত কিনা- এই প্রশ্নটিই অবান্তর। এ জাতীয় প্রশ্ন আজকাল বেশ আলোচিত বলে শোনা যাচ্ছে। তবে এর সুনিশ্চিত জবাব দেয়ার মাধ্যমে গল্পকে একটি ধাঁচে ফেলা বা গল্পকারকে একটি ধাঁচে ফেলা উচিত নয়। লেখাটা শেষ পর্যন্ত হয়ে উঠলো কিনা সেটাই হলো আসল বিষয়।
প্রতিমুহূর্ত : আমাদের তিন বন্দ্যোপাধ্যায় (বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়) সম্পর্কে বলতে গিয়ে আপনি একবার বলেছিলেন, জনপ্রিয়তার বিচারেবিভূতিভূষণের পরে তারাশঙ্কর তারপরে মানিক। আপনার কাছে জানতে চাইবো- জনপ্রিয়তা আর মৌলিকতা এ বিষয়টিকে আপনি কিভাবে দেখেন ?
হাসান আজিজুল হক : জনপ্রিয়তা আর মৌলিকতার মধ্যে কোনো বিরোধ নেই। কোনো কোনো প্রতিভা স্বচ্ছ। কেমন স্বচ্ছ একটা উদাহরণ দিলে তুমি সহজে বুঝবে। মনে করো, কোনো এক দীঘির জলে একটি স্বর্ণের আংটি পড়ে আছে। দশ হাত জলের নিচে। সকালের সূর্যের একটি তীর্যক আলোক রশ্মি এসে পড়েছে দীঘির জলে। সেই আলোতে শান্ত দীঘির জলের নিচে পড়ে থাকা স্বর্ণের আংটিটি থেকে যেরকম আলো বিচ্ছুরিত হবে, প্রতিভা বা মৌলিকতা হচ্ছে সেরকম। জনপ্রিয়তা জিনিসটাকে সাহিত্যের মাপকাঠি করা ঠিক না।রামায়ণ, মহাভারত কি জনপ্রিয় নয় ? তবে জনপ্রিয়তার ধরণ আছে। গোর্কি বা চেখভ তাঁদের সময়ে অসম্ভব জনপ্রিয় ছিলেন। পাঠকের মানের সাথেও জনপ্রিয়তা ব্যাপারটা সম্পর্কযুক্ত। ফরাসী লেখক মার্সেল প্রুসত এর রিমেমবারেন্স অব পাষ্ট' বইটি প্রকাশক ছাপতে রাজি হন নি। প্রকাশক বলেছিলেন, আপনি মশাই বারান্দার একটি চেয়ার থেকে জানালা পর্যন্ত উঠে গিয়ে দাঁড়ানোর বর্ণনা দিতে খরচ করেছেন দশ পৃষ্ঠা ! এ লেখা আমি ছাপতে পারবো না। অথচ মার্সেল প্রুসত ফরাসী লেখকদের মধ্যে শক্তিমান একজন বলে বিবেচিত হয়ে আসছেন।একসময় শশধর দত্তের মোহন সিরিজ অসম্ভব জনপ্রিয় ছিল। এখন হয়তো অনেকে তাঁর নামই জানেন না। আবার শরৎচন্দ্র জনপ্রিয় ছিলেন। একই সাথে তাঁর মৌলিকতাও ছিল। তবে সেই মৌলিকতা হয়তো রবীন্দ্রনাথ বা বঙ্কিমের তুলনায় কিছুটা ম্লান। পরবর্তীতে জনপ্রিয়ধারার কথা বললে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বা হুমায়ূন আহমেদের কথা বলতে পারি। তবে সুনীল হয়তো হুমায়ূনের তুলনায় উজ্জ্বল। যাই হোক, সংক্ষেপে বলি- আমার কাছে মনে হয় কোনো কোনো লেখক কামারের মতো কাজ করেন। কেউ কেউ ছুতোরের মতো।
সাক্ষাতকার গ্রহণ : এহসান মাহমুদ, বিভাগীয় সম্পাদক, সাহিত্য
2 মন্তব্যসমূহ
এই মন্তব্যটি লেখক দ্বারা সরানো হয়েছে।
উত্তরমুছুনসাক্ষাতকার পড়ে মনে হয়েছে দিনটি অবশ্যই ভালো যাবে। আর লেখকের একটি গল্প এখনি পড়বার আকাঙ্খাবোধ করছি।
মুছুন