আমার সাহিত্য এত ব্যক্তিগত এত ভ্রাম্যমান : আব্দুল মান্নান সৈয়দ

শিবু কুমার শীল-এর সাথে আবদুল মান্নান সৈয়দের আলাপচারিতা

২০০৮ খ্রিস্টাব্দের মে মাসের এক অপরাহ্নে আমরা হাজির হই কবি, লেখক, গবেষক- আবদুল মান্নান সৈয়দের বাসায়। উদ্দেশ্য ছিল আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ছোটগল্প খোঁয়ারি সম্পর্কে তার একটা ভিডিও সাক্ষাৎকার ধারণ করা। কিন্তু আলোচনা আর খোঁয়ারিতে সীমাবদ্ধ থাকেনি সেটা ছড়িয়ে পড়েছে ষাটের দশক থেকে পরবর্তী সাহিত্য আলোচনায়। তাঁর কথোপকথনে আমরা জানতে পারি একজন লেখক কীভাবে ব্যক্তিগত হয়ে ওঠে, ভ্রাম্যমান হয়ে ওঠে এবং হয়ে ওঠে একজন জীবন অধ্যয়নকারী। 


শিবু কুমার শীল : আখতারুজ্জামান ইলিয়াস সম্পর্কে কিছু বলেন
আবদুল মান্নান সৈয়দ : যখন ইলিয়াসের সঙ্গে আমি বিচ্ছিন্ন তখনও কিন্তু ইলিয়াসের প্রশংসা আমি করেছি। লেখায়। মুখের প্রশংসার কোন মূল্য আছে বলে আমি মনে করি না। আমার একটা উপন্যাসে আমি উল্লেখ করেছি যে আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের পুরান ঢাকার উপর- জাদুকরের মতো তার কাজ।জাদুকরের মতো তার চোখ। এটা ইলিয়াসের চোখে পড়েছিল এবং এটা সে উল্লেখ করেছিল। ও নিজেই দেখেছে। এটা ও দেখবে এটা ভাবিনি। তাৎক্ষণিকভাবে লেখা। এটা একটা বলব, আরেকটা হচ্ছে ইলিয়াসের বিয়ের পরে একবারই ওকে আমি খেতে ডেকেছিলাম। এসেছিল বউ নিয়ে; তখনও বাচ্চাকাচ্চা হয়নি। তখন এসেছিল এবং আমাদের সঙ্গে সময় কাটিয়েছিল। আমি নিজে তখন বিবাহিত নই।
শিবু কুমার শীল : আপনাদের শুরুটা। সম্পর্কের শুরুটা।
আবদুল মান্নান সৈয়দ : সত্যি কথা বলতে কি, ইলিয়াসের সঙ্গে আমার যে বিচ্ছেদ ঘটেছিল সেটা তার জীবৎকালেই। ওইভাবে আর সম্পর্ক ছিল না। কিন্তু ওর যে সাফল্য যেটা ও দেখে যেতে পারেনি। এতে আমি খুশি (ইলিয়াসের সাফল্যে) এবং আমার লেখা কী হয়েছে জানি না কিন্তু ইলিয়াস যে একটা সাফল্যে পৌঁছেছে এটা আমি অনত্মর থেকে বলব। এবং ইলিয়াসের কাছ থেকে একই সঙ্গে আজকের দিনের তরুণ প্রজন্মের যে পাঠ গ্রহণ করা দরকার সেটা হলো জীবন অধ্যয়ন।
শিবু কুমার শীল : আপনাদের ছাত্র জীবন, লেখালেখির শুরু
আবদুল মান্নান সৈয়দ : পুরোনো শহরে ও ঘুরে বেড়াত। পুরোনো শহরে আমিও চাকরি করেছি, আমরা একই কলেজে। কিন্তু ওঁর সঙ্গে আমার দিবারাত্রির পার্থক্য ছিল। মানে ও ছিল দিনে আর আমি ছিলাম রাতে। এমনিতে জীবনেও পার্থক্য ঘটে গেল। আমরা একই কলেজে কিন্তু ও ছিল আপনার দিনের বেলা আর আমি ছিলাম রাতে। জগন্নাথ কলেজে আমি দশ বছর ছিলাম। যখন ইলিয়াসও ওরকম সময়ই ছিল। আমার বেশিরভাগ সময় কিন্তু জগন্নাথ কলেজেই কেটেছে। এবং পরে ও দুএকবার আমাদের কলেজে এসেছে যখন ও ঢাকা কলেজে। তখন জগন্নাথ কলেজে এসছে। তো সেই সময় হাসি-মশকরা ইত্যাদি। আমার মনে আছে। আমার পঞ্চাশের পরে। আমার পঞ্চাশ বছরপূর্তির পরে একটা অনুষ্ঠান হয়েছিল তার পরে। তো স্বাভাবিকভাবে জীবনে একটা জিনিস, একটা বাস্তবতাকে অস্বীকার করলে মিথ্যে বলা হবে সেটা হচ্ছে আমাদের মধ্যে একটু যে ঈর্ষা ছিল না এটা বললে মিথ্যাচার হবে। কিন্তু আবার ভেতর থেকে কোনো অশ্রদ্ধা ছিল না। যে শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা না থাকলে আজকে আমি ইন্টারভিউ দিতে রাজি হতাম না। সেই শ্রদ্ধা ইলিয়াসেরও ছিল তার প্রমাণ হচ্ছে আমার পঞ্চাশ বছরপূর্তি উপলক্ষে একটা পুস্তিকা বেরিয়েছিল প্রায় শতাধিক পৃষ্ঠা, সেটা দেখে ইলিয়াসের মন্তব্য হচ্ছে যে, মান্নান কি-রাতেও ঘুমায় না নাকি? মানে আমি জীবনভর এত কাজ করেছি এটার প্রতি এটা এক ধরনের শ্রদ্ধার্ঘ। আবার আমি যে কাগজে- কাজ করেছি ও সেই কাগজে লেখা দেবে- না। এই সব আমাদের ছিল। ও আমাদের এখানে এসছে আমাদের ওখানে কাগজ বিক্রি করল সংস্কৃতি; ও বোধ হয় সম্পাদক ছিল। দু কপি বিক্রি করল আমাদের ইয়েতে। পত্রিকাতো চলত না। আমার সেখানে কেনার বা বেচার কোনো ইয়ে ছিল না। আসলে কোথাও একটা আমাদের বিচ্ছেদও ঘটেছিল আবার কোথাও একটা পরস্পরের প্রতি প্রেম তো ছিলই। তা না হলে আমি আপনার যখন তার সাথে কোনো সম্পর্ক নেই পুরোনো শহরে তার যাদুকরের মতো চলাফেরার কথা লিখছি-ইলিয়াসের সেটা চোখে পড়ছে এবং সেটা উদ্ধৃতও করেছে। আমার পঞ্চাশ বছর পূর্তিতে যে পুস্তিকা বেরিয়েছে সেটা দেখার পর ইলিয়াস আমাকে বলে আমার পঞ্চাশ বছরটা তো আমি ঠিক খেয়াল করিনি, ওরও ঠিক একই সঙ্গে পঞ্চাশ বছর সেটা আবার একটু কূটৈষা প্রকাশ পেল। এটা থাকেই। বাস্তব কথা হচ্ছে যেহেতু আমাদের বন্ধুতা প্রবল ছিল, যদি বন্ধুতা প্রবল না থাকে- তাহলে এটা থাকবে না। আমি মনে করি ইলিয়াসের সঙ্গে আমার সেই প্রথম সেই কৈশোরক বন্ধুতা, সেটা আমাদের মধ্যে প্রেমিক-প্রেমিকার মতো সম্পর্ক ছিল বিশ্বাস করুন। এবং এবার সেটা আমি বিশ্বাস করি। আমার অন্য বন্ধু আছে অন্য ক্ষেত্রে কিন্তু গল্পকার এরকম বন্ধু আমি পাইনি, আমার বিশ্বাস ইলিয়াসও আর বন্ধু পায়নি। যেটা পেয়েছে সেটা মতাদর্শঘটিত জীবনে এরকম যেটা একধরনের আদর্শঘটিত বন্ধুতা। সেটার মধ্যেও আবার অন্য আরেক ইয়ে থাকেকিন্তু এই যে হৃদয়ের যে সম্পর্ক এই সম্পর্ক ইলিয়াসের সঙ্গে আমার ছিল। দীর্ঘ চিঠি- খুবই দুঃখের কথা সেই চিঠি দুটো কে নিয়ে গ্যাছে। চিঠিগুলোর কপি রেখে দিয়ে গ্যাছে। পাঁচ-ছ পৃষ্ঠার চিঠি। ইলিয়াসেরও পাঁচ-ছ পৃষ্ঠা চিঠি- আজকে যেটা আপনাদের কাছে অপরিসীম মূল্যবান। এটা আপনার কেউ একজন আমার কাছ থেকে নিয়ে আর ছাপেনি। ইলিয়াসের মৃত্যুর পরে যথারীতি নিয়ে গ্যাছে ছাপবোবলে আর ছাপেনি। তো এইসব কিছু কিছু ঘটনা আমাকে আপ্লুত করে। জীবনে ধরুন আমি যেটা বলব জীবনে এসে আমরা অনেক সুখ পেয়েছি, অনেক দুঃখ পেয়েছি। কিন্তু সব মিলিয়ে যে আমার একজন বন্ধু যার এই সাফল্য আমি দেখলাম এবং আমার যে বন্ধুতা, আপনার সেই বন্ধুতার জন্যই তো এসছেন। আজকে আমার বাল্যবন্ধু কৈশোরক বন্ধুকে নিয়ে তথ্যচিত্র- বানাচ্ছেন-আমিও এর একজন অংশীদার মনে করি। এটা আমার জন্য সৌভাগ্যজনক। এবং আমি তরুণ প্রজন্মকে বলব ইলিয়াসের কাছ থেকে শিক্ষা নেওয়ার কী করে জীবন অধ্যয়ন করতে হয়। প্রচারমুখী না হয়ে নিঃশব্দে নিজের কাজ করে যেতে হয়। এই আশ্চর্য নিষ্ঠা, এই বিস্ময়কর নিষ্ঠা এটার শিক্ষা নিতে হবে এবং একই সঙ্গে কথা সাহিত্যিক হলে জীবনকে কীভাবে অধ্যয়ন করতে হয় জীবনকে কীভাবে দেখতে হয়। গোর্কি- রাশিয়া দুবার পায়ে হেঁটে সফর করেছে সারা রাশিয়া। দরিদ্র মানুষও ছিলেন টাকা পয়সা ছিল না। তো এইগুলো হচ্ছেকথাসাহিত্যিকদের শিক্ষা কিন্তু মূলত এই জীবন অধ্যয়ন থেকে আসবে। আর আমি যে কথাসাহিত্য লিখি সেটা আমাদের দেশের আদর্শ বলে আমি মনে করি না। এটা আমার নিজের ঘরানা। আমি সারা দেশের, বাংলাদেশের সাহিত্যের কথা যদি বলেন তাহলে আমি বলব ইলিয়াসের কাছ থেকে তাদের শহীদুল জহিরের মতো লেখক থেকে এই পাঠ যেন আমরা গ্রহণ করি।
শিবু কুমার শীল : ইলিয়াসের সঙ্গে আপনার বন্ধুতার শুরুটা কীভাবে?
আবদুল মান্নান সৈয়দ : ইলিয়াস ছিল আমার কৈশোরকালের বন্ধু। মানে আমার কৈশোরকাল বোধহয় একটু দীর্ঘায়িত। ঢাকা কলেজেই আমরা পড়তাম। ঢাকা কলেজ ইউনিভার্সিটি এবং ইউনিভার্সিটি থেকে বেরিয়ে কয়েকবছর এই। মানে মোটামুটি ষাটের দশক। ১৯৬০ থেকে ৭০ পর্যন্ত বলা যায় এই সময়টা বিশেষ করে কলেজ এবং ইউনিভার্সিটি জীবনে আমরা ছিলাম অভিন্নহৃদয় বন্ধু। আমাদের ধ্যানজ্ঞান ছিল দিবারাত্রির স্বপ্ন ছিল নতুন ছোটগল্প কী করে রচনা করব আমরা। এইটা আমাদের চেষ্টা ছিল ধ্যানজ্ঞান ছিল। এবং আমাদের ঈষৎ অগ্রজ ছিলেন জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত। হুমায়ুন চৌধুরী। এঁরা। ওঁরাও ছিলেন গল্পকার। ওরা আমাদের আবিষ্কার করেন বলতে গেলে। ওরাই খুঁজে নেন আমাদের-। ওরা বাংলার ছাত্র ছিলেন। ঢাকা কলেজে। আমার কাছ থেকে অধ্যয়ন নেয়ার দরকার নেই। আমার সাহিত্য এত ব্যক্তিগত এত ভ্রাম্যমান যে ওটার সঙ্গে দরকার নেই। কিন্তু আমাদের দেশের জন্য উপযুক্ত হচ্ছে ইলিয়াসের মতো কথাসাহিত্যিকের কাছ থেকে পাঠ গ্রহণ করা। আদিবাসীদের নিয়ে ওর একটা আগ্রহ ছিল।
এই বাংলাদেশ কিন্তু বিশাল! বাংলাদেশ ছোট জায়গা না। বিশাল! নোয়াখালির একটা ভাষা সন্দ্বীপের একটা চরিত্র ঢাকার একটা চরিত্র। এই চরিত্রগুলো আবিস্কারই যথেষ্ট। এই ঢাকা শহরই আমাদের চোখের সামনে যে বদলে গেল এটা একটা মহাকায়-উপন্যাসের বিষয় হতে পারে। এগুলো নিয়ে আমাদের চিন্তা নেই। আমাদের চিন্তা আছে কত দ্রুত আমরা বইমেলায় বই বের করব এবং টেলিভিশনে সেটা প্রচার হবে-বইমেলার সময় বিভিন্ন কাগজেই হবেএই সস্তা প্রচার সম্মোহন আমাদের জাতিকে-কথাসাহিত্যের ক্ষেত্রে বিশেষ করে পেয়ে বসেছে।
ইউনিভার্সিটিতে আমরা বাংলার ছাত্র ছিলাম। আমরা একসঙ্গে পাস করি একসঙ্গে ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হই। এবং ঢাকা কলেজ থেকেই আমাদের একটা বন্ধুম-লী ছিল। ইলিয়াস, আমি, সিকান্দার দারাশিকোহ, কমরেড মুজফ্‌ফর আহমেদের একমাত্র দৌহিত্র, কবি আবদুল কাদিরের একমাত্র জীবিত সন্তান। তারপর আর একজন ছিল আমিনুল ইসলাম বেদু, সাংবাদিক। আরেক বন্ধু ছিল মফিজুল আলম। আমরা এই পাঁচজন মিলে আমাদের এক বন্ধু সার্কেল ছিল।
শিবু কুমার শীল : গল্প লেখার শুরুটা কীভাবে?
আবদুল মান্নান সৈয়দ :ঢাকা কলেজে তখন অনেক রকম বলয় ছিল। যেমন একটা রাজনৈতিক বলয় ছিল, একটা এরকম সাহিত্যক বলয় ছিল। একটা খুব মেধাবী ছাত্র বলয় ছিল, বড়লোকদের ছেলেদের একটা বলয় ছিল। এরকম বিভিন্ন রকমের বলয় ছিল বৃত্ত ছিল। আমাদের ছিল পাঁচজনের একটা বন্ধুম-লী যাদের নাম বললাম এবং আমরা কলেজে থেকেই একটা পত্রিকা বের করার পরিকল্পনা করলাম, পত্রিকার নামও দেয়া হলো ময়ূখ কিন্তু সে পত্রিকা আর বেরোয়নি তখন। কিন্তু ইউনিভার্সিটিতে এসে মফিজ এবং বেদু বাংলাতে জয়েন করল, বাংলা বিভাগে যোগ দিল এবং তারপরে আমরা ৬৩ সালের দিকে বোধ হয় আমরা একটা পত্রিকা বের করলাম সাম্প্রতিক আমাদের নিজস্ব ঘরানার বলছি আমরা  ওইযে পাঁচ বন্ধুম-লী ছিলাম ঢাকা কলেজে ওদের উদ্যোগেই বেরুল। সেখানে ইলিয়াসের গল্প আমার গল্প ছাপা হলো একসঙ্গে। ইলিয়াসের গল্প সমুদ্র কি এরকম নাম ইলিয়াসের যে গল্পটা নিঃশ্বাসে যে প্রবাদবোধহয়। এটা ছাপা হলো। আমার গল্প অতিবারিষমাপাশাপাশি ছাপা হলো, না অতিবারিষমা আমার অন্য জায়গায় ছাপা হয়েছিল। যাই হোক, সাম্প্রতিক-এ আমরা একসঙ্গে ইয়ে করলাম। এটা ঢাকা কলেজের যে ধারাবাহিকতা সেটা বলছি। আর আমাদের সবার ছিল স্পেশাল বেঙ্গলি। আমাদের এই পাঁচজনেরই ছিল স্পেশাল বেঙ্গলি যেহেতু বাংলার এবং বাংলা সাহিত্যে আমাদের অসম্ভব উৎসাহ ছিল। ইলিয়াস তখন লিখত ছোটোদের গল্প। তখন আজাদছিল এখন ঠিক ওরকম কোনো কাগজ নেই, একমাত্র কাগজ যেটা সকলেই পড়ত। তো আজাদে ইলিয়াসের ছোটদের লেখাগুলি বেরিয়েছে একটা গল্পের কথা আমার এখনও মনে আছে চোর।
ইলিয়াস তখন লিখত ছোটদের গল্প এবং বড়দের গল্প লেখারও আমরা চেষ্টা করছি। আমি আবাল্য প্রাপ্তবয়স্কদের গল্প লিখি- ঢাকা কলেজ বার্ষিকীতে আমার গল্প এবং আমাদের এক সহপাঠী আবদুল্লাহ আল মামুন যাকে আপনারা চেনেন অভিনেতা নাট্যকার হিসেবে। মামুনের গল্প বেরিয়েছিল, মামুন তখন গল্প লিখত। আবদুল্লাহ আল মামুন, আমার গল্প একসঙ্গে বেরিয়েছিল। সকলেই তো তখন আমরা বন্ধু কিন্তু সাহিত্যের যে বলয়টা ছিল সেটা আমাদের পাঁচজনে কেন্দ্রিক ঢাকা কলেজের। পরে ইউনিভার্সিটিতে এসে বন্ধু বলয় আর একটু ছড়িয়ে যায়। এবং আমি। ছেলেবেলা থেকেই আমি নির্জন। আমি খুব নির্জন স্বভাব। সিকান্দার যে ছিল আমার বন্ধু সে আরো নির্জনতর, সে জীবনানন্দের চেয়েও নির্জন, এরকম একজন মানুষ। আমার এক স্কুলের বন্ধুও গল্প লিখত অবশ্য। ও আমাকে নায়ক করে একটা গল্প লিখেছিল। আমি ওকে নায়ক করে একটা গল্প লিখেছিলাম সেকালেই। কিন্তু ইলিয়াস আমি -আমরা নতুন ধারার গল্প লেখার চেষ্টা করতাম আমাদের অগ্রজদের যে ধারা, পঞ্চাশের দশকের লেখকদের যে ধারা। এবং আমরাই বোধ হয় প্রথম বোধহয় কেন, যেটা সত্যি কথা সেটাই বলতে হবে, আমরাই প্রথম যারা গল্পে আপনার তথাকথিত শালীনতাকে আঘাত করলাম। আমাদের লেখায় শালীনতা, সেক্স- ব্যাপারটা আমাদের দুজনের লেখাতেই এল। ইলিয়াসের প্রথম বিখ্যাত গল্প স্বগতমৃত্যুর পটভূমিসমকালে বেরুল। আমার প্রথম বিখ্যাত গল্প যেটা মাতৃহননের নান্দীপাঠ’, সেটা বেরোয় পরিচয়নামে একটা পত্রিকায়। সে পত্রিকা বের করেছিল জ্যোতি, হুমায়ুন চৌধুরী, সেবাব্রত চৌধুরী এরা বের করেছিল। উনি ভারতে চলে গ্যাছেন।
চৌষট্টির দাঙ্গার পরে- চৌষট্টি, পয়ষট্টি সালে। তো হায়াৎ মামুদ ছিল কাগজটার সঙ্গে। ওইখানে আমরা গল্প লিখতাম। যদি পাওয়া যায়। যদিও সেটা পাওয়া খুব দুষ্কর। ইলিয়াসের একটা গল্প ছাপা হয়েছিল, আপনারা শোষিত বকুলমনে হয় না সেটা পাওয়া যাবে। আমার গল্পও ছাপা হয়েছিল। নামটা মনে আছে আক্রোশের স্বর্গীয় ব্যবহারসেটাও পাশাপাশি ছাপা হয়েছে। জ্যোতিদা ছেপেছিলেন। জ্যোতি দেখাশোনা করতেন। আর রোকেয়া সুলতানা নামে এক মহিলা ওটার সম্পাদিকা ছিলেন। যে রকম তখনকার দিনে উল্টোরথ’, ‘সিনেমার জগৎকিন্তু এরকম কাগজ ছিল। ছদ্মবেশী সিনেমার পত্রিকা কিন্তু আসলে সাহিত্যের পত্রিকা। যে একটু বিনোদন দিয়ে যাতে লোক দেখে আর কি লোকে পড়ে। তো এইটা এভাবেই আমাদের সূচনা হয়।
শিবু কুমার শীল : আপনাদের সার্কেলের সবাই কি তখন গল্প লেখা শুরু করল?
আবদুল মান্নান সৈয়দ : এবং যতদিন যেতে থাকে কলেজে উঠে ইউনিভার্সিটিতে উঠে আমাদের বন্ধুতা নিবিড় হতে থাকে। এবং আমরা তখন বন্ধু হিসেবে ধরতাম, নতুন গল্প লেখার চেষ্টা যারা করতাম তাদের মধ্যে ধরতাম হুমায়ুন চৌধুরী, অসাধারণ গল্প লিখত হুমায়ুন। এখন বিস্মৃত। মাঝে ও টেলিভিশনে ছিলেন। তারপরে বিদেশটিদেশে ছিলেন। তারপরে আপনার পরে ঢাকায় এখন চলে আসছেন। তবে এখন আর গল্প লেখায় নিবিষ্ট না। অসম্ভব সুন্দর গল্প লিখত। ইলিয়াসের গল্প লেখায় কিন্তু হুমায়ুন চৌধুরীর ধারাবাহিকতা একটা আছে । এর গল্পের নাম ছিল, বিখ্যাত গল্প যেটা বই আকারে বের হওয়ার কথা ছিল নশ্বর-স্রোতহুমায়ুন চৌধুরী। পরে ওনার কোনো গল্পগ্রন্থই বেরোয়নি। আর জ্যোতিপ্রকাশ দত্তের গল্পগ্রন্থ রংবাজ ফেরে নার বিজ্ঞাপন বেরিয়েছিল।
কিনবই আকারে বেরিয়েছিল কিনা জানি না। তারপরে যখন কণ্ঠস্বর বেরুল ১৯৬৫ সালে, সেখানেও প্রথম সংখ্যায় ইলিয়াস এবং আমার লেখা গল্প একসঙ্গে বেরুল পাশাপাশি বেরুল। ইলিয়াসের গল্প আমার গল্প। এবং তখন একটা বিস্ময়কর ব্যাপার যে আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ উনি একটা বই সম্পাদনা করলেন তারও বয়স বেশি না আমাদের চেয়ে একটু বড়, বছর তিনেকের বড়। উনি বের করলেন সাম্প্রতিক ধারার গল্প সেখানে তরুণতম গল্পকার হিসেবে ইলিয়াস এবং আমার গল্প একসঙ্গে সে পাশাপাশি আবার মুদ্রিত হলো। আর আমাদের আর এক বন্ধু ছিল শহীদুর রহমান। ওর বিড়ালনামে গল্প বিখ্যাত ছিল। অনেকে ওকে ঠাট্টা করে বলত শহীদুর রহমান বিড়াল। তো এই যে আপনার, ইলিয়াসের নানারকম অভ্যেস ছিল। তো একটু নামকরণের অভ্যেস ছিল। প্রত্যেকের একটা নাম দিত। ও সবসময় ছেলেবেলা থেকেই ইলিয়াসের যেটা ছিল। আমরা যখন দেখেছি তখন আমিও রোগাকাঠি ইলিয়াস রোগা ফর্সা পরের যে ইলিয়াসকে আপনারা দেখেছেন সেই ইলিয়াসের তখন মুখে ব্রন বোঝাই এবং আমরা অসম্ভব ইন্ট্রোভার্ট। ইলিয়াস, আমি, সিকান্দার পুরা গ্রুপই ইন্ট্রোভার্ট। তো এইটা পরে ইউনিভার্সিটিতে এসে ইলিয়াস ক্রমশ বহির্মুখী হয়ে ওঠে। এবং ওকে একবার হাসপাতালে যেতে হয়। ওর বসন্ত-টসন্ত কী হয়েছিল সেখানকার পটভূমিকায় স্বগতমৃত্যুর পটভূমিলেখে। এবং এই গল্প লেখাতেই ও কিন্তু দৃষ্টি আকর্ষণ করল। আরেকটি গল্প বেরিয়েছিল সমকাল-এ। সমকাল তখন এমন একটি কাগজ, পত্রিকা যেখানে একটি লেখা বেরোলেই, এখন বাংলাদেশে এমন একটি পত্রিকাও নেই সেই মানের। যেহেতু আমি সেই অভিজ্ঞতার অংশীদার কাজেই আমাকে সত্যভাষণ করতে হবে। এখন একটি পত্রিকাও নেই যেখানে লেখা ছাপা হলেই আপনি লেখক হয়ে গেলেন। কিন্তু পাকিস্থান আমল বা ষাটের দশকে পঞ্চাশের দশকে আপনার ওই একটা পত্রিকা ছিল যেখানে একটা লেখা ছাপা হলে আপনি লেখক পদবাচ্য হয়ে গেলেন। আর কিছু লাগে না। আমি অষ্টম সংখ্যায় প্রবেশ করি এবং শেষ পর্যন্ত দুটো করে লেখা লিখতাম। আমাকে প্রথম দিন হাসান হাফিজুর রহমান যখন নিয়ে গেলেন তখন প্রথম সাক্ষাতেই জাফর ভাই (সিকান্দার আবু জাফর) বললেন তোমার কোনো কোনো শিক্ষকের লেখা ফেলে দিয়েছি শুনবে? নজরুল মার্কা স্বভাব। উনি কোথাও কোনো এই যে এখনকার সম্পাদকদের সঙ্গে আমার বনিবনা হয় না মানে ওই সব সম্পাদক নেই আর। যে আপনি কোথায় কী চাকরি করেন, কত কী টাকা আছে আপনার, আপনি মদ খাওয়াতে পারেন কিনা উপঢৌকন দিতে পারেন কিনা এইসব তখনকার সম্পাদকদের মধ্যে আমরা দেখিনি। আমরা যাদের হাত দিয়ে মানুষ হয়েছি সিকান্দার আবু জাফর, হাসান হাফিজুর রহমান এবং আবদুল গনি হাজারী, তারপরে শওকত ওসমান, মুনীর চৌধুরী। এঁরা সব অন্য ধাতুতে গড়া ছিল। এইসব মানুষ দেখি না আর ভাই। আছে কিন্তু তারা চিড়ে চ্যাপ্টা হয়ে গ্যাছে। আছে। তাদের ক্ষমতা নেই। ক্ষমতা যাদের দেখি তারা অন্য। যে কারণে ইলিয়াস বিকশিত হতে পেরেছে আমি বিকশিত হতে পেরেছি। অন্তত আমাদের প্রথম দিকে আমাদের চিনে নিলেন সিকান্দার আবু জাফর, হাসান হাফিজুর রহমান এঁরা। যাই হোক আমরা জগন্নাথ কলেজে একসঙ্গে কাজও করেছি তখন ছোটগল্প নামে একটি পত্রিকা বের করল কামাল বিন মাহতাব এর সঙ্গে ছিল কায়েস আহমেদ, শাকের চৌধুরী; এরা দুজনই মারা গ্যাছে। আমাদের থেকে ছোট বয়সে। যখন পত্রিকায় ছোটগল্পের বিজ্ঞাপন দেখলাম তখন আমরা খুব খুশি। ইলিয়াস, আমি আমরা বললাম যাক একটা কাগজ বেরোচ্ছে। প্রথম সংখ্যাতেই আমার লেখা ছিল, জহির রায়হানের লেখা ছিল। ইলিয়াস ওই কাগজে কিন্তু লেখেনি। ছোটগল্প পত্রিকায় ইলিয়াস কম লিখত কিন্তু আমি লিখতাম বিরামহীন। আর ইলিয়াস কম লিখত কিন্তু মূল্যবান লেখা লিখত। আরেকটা জিনিস আমি বলি প্রসঙ্গত যে সাম্প্রতিকনামে আমরা একটা কাগজ করেছিলাম এই পত্রিকার নামকরণ আমার। আসন্নবলে একটা কাগজ বের করেছিলাম আমরা এর নামকরণও আমার। এবং আসন্ন পত্রিকায় ইলিয়াস একটা গল্প লিখেছিল চিলেকোঠায়অসাধারণ গল্প! অসামান্য গল্প আমি জানি না এই গল্প আবিষ্কৃত হয়েছে কিনা? ও ইউনিভার্সিটির আরেকটি ঘটনা মনে পড়ছে যেটা আপনার বলা উচিত আমরা সবাই ছিলাম মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভক্ত। তখন তো বই পাওয়া যেত না আমরা কলেজে থাকতেই পুতুলনাচের ইতিকথাআমাদের হাতে পড়ে এবং একটা বই-ই আমরা হাতে হাতে পড়ি। তারপরেই আমরা মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভক্ত হয়ে গেলাম। এবং ইলিয়াসও স্বাভাবিকভাবে। আমরা ইউনিভার্সিটিতে উঠেই একটা উদ্যোগ নিয়েছিলাম যে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপর কিছু হোক।
তাঁর জন্মবার্ষিকী, মৃত্যুবার্ষিকী। এবং আমার এইটুকু মনে আছে আমি একেবারেই লাজুক ছিলাম, ফলে আমি যাইনি। তবে আমার সব বন্ধুরা দল বেঁধে রণেশ দাশগুপ্তের কাছে গিয়েছিলেন। রণেশ দাশগুপ্ত তখন সংবাদের সম্পাদক ছিলেন। তাঁর কাছে সবাই গিয়েছিলেন যাতে সংবাদ পত্রিকার সাহিত্যপাতায় মানিক সম্পর্কে একটা পাতা বের হয়।
শিবু কুমার শীল : ওপার বাংলার সাথে তখন আপনাদের সাহিত্যিক যোগাযোগটা কেমন ছিল?
আবদুল মান্নান সৈয়দ : আমরা অসম্ভব সিরিয়াস ছিলাম গল্প রচনায়। ষাটের দশকে কোলকাতায় গল্প লেখার মধ্যে একটা ধারা তৈরি হয়। শাস্ত্রবিরোধী আন্দোলন। আমাদের চিনত্মাটাও অজ্ঞাতসারেই সেই দিকে চলছিল। ওরা আমাদের খোঁজ রাখত একটু আধটু। সুব্রত সেনগুপ্ত তাঁর একটি বইই পাঠিয়ে দিয়েছিল আমাকে। আমরাও খোঁজ রাখতাম তাদের। মানে এক-আধটা বই যখন আসত তখন সেটা আমাদের হাতে হাতে ফিরত। তখন তো বই পাওয়া যেত না।
শিবু কুমার শীল : বিশ্বসাহিত্য পাঠে আপনাদের অনুপ্রবেশের প্রাথমিক প্রক্রিয়াটা কি ছিল?
আবদুল মান্নান সৈয়দ : তখন ইলিয়াস আর আমি ইউনিভার্সিটিতে, আমাদের এই গ্রিনরোডের বাড়িতে ইলিয়াসের ঢাকা কলেজের হলে মধুর ক্যান্টিনেঢাকা শহরে চক্কর দিয়ে বেড়াতাম। ব্রিটিশ কাউন্সিলে আমাদের দিনের পর দিন কেটেছে। ইলিয়াসের প্রিয় পত্রিকা ছিল এনকাউন্টারআমার প্রিয় পত্রিকা ছিল লন্ডন ম্যাগাজিনআমরা তখন জয়েস, লরেন্স, ডিলান টমাস, এদের যে পরিমাণ পাঠ করেছি সেটা ইংরেজির ছাত্ররাও পড়ে না। এবং আমারতো বইই লেখা উচিৎ ছিল লরেন্স এবং জয়েসের উপর। যে পরিমাণ আমি ওদের পাঠ করেছিলাম। এবং ডিলান টমাসের দ্বারা আমরা খুব উদ্বুদ্ধ ছিলাম। এখন ইলিয়াসের আজকের যারা বিচারক তারা এই খবর না রাখলে তার মূল্যায়ন সম্পূর্ণ হবে না। আল্লাহ যদি আমাকে সময় দেয়, ইলিয়াসের এখন রচনাবলী বেরুচ্ছে আমি তাকে নিয়ে আমার দৃষ্টিকোণ থেকে একটা আলোচনা করব। যেখানে দেখা যাবে ইলিয়াস যখন কবিতাও লিখত ওর কবিতা একটু আলাদা স্বাদের কবিতা ছিল অল্প কয়েকটা কবিতা লিখেছে পরের দিকে কবিতা লিখত কিনা জানি না কিন্তু ওই আলাদা স্বাদের কবিতার মধ্যে ইলিয়াসের একটা কবিতায় একটা লাইন আছে দেখবেন ডাক্তার হোসেন কাটছে কাহার লাশএই ডাক্তার হোসেন বলে একজন ছিলেন। ওর একটা বই আমাদের খুব প্রিয় ছিল। সেটা হচ্ছে পাগলা গারদে দু-বছরউনি পাগলা গারদের চিকিৎসক হিসেবে সেন্ট্রাল হসপিটালে ছিলেন। ওখানে নজরুল ছিলেন। নজরুলের কথা ওই বইয়ে আছে। এটা আমাকে বলল আমাদের যে কমন ফ্রেন্ড সিকান্দার দারাশিকোহ। আমাদের বন্ধুদের মধ্যে যেটা লাভ এন্ড হেট্রেডএকটা সম্পর্ক ছিল। এটাও বলতে হবে এটা বাস্তব কথা কিন্তু ইলিয়াসের সঙ্গে যে আমার অভিন্ন হৃদয়ের বন্ধুতা ছিল গল্পকে কেন্দ্র করে সেটা আমার মনে হয় না পরবর্তীকালে/উত্তরকালে মতাদর্শের বন্ধুতা যাদের সঙ্গে হয়েছিল তাদের সঙ্গে এই বন্ধুতা হয়েছে কিনা! ওটা একটা অপাপ বন্ধুত্ব ছিল।
শিবু কুমার শীল : আপনাদের লেখালেখির দার্শনিক ভিতটা কীভাবে গড়ে উঠল?
আবদুল মান্নান সৈয়দ : আমাদের একটা প্রতিজ্ঞা ছিল আমরা প্রেমের গল্প লিখব না। আমার আবার এক ধরনের প্রতিজ্ঞাভঙ্গের অভ্যেস আছে। আমি পরে প্রেমের গল্প প্রচুর লিখেছি। ইলিয়াস মনে হয় না একটিও প্রেমের গল্প লিখেছে। আর আমাদের লেখায় যেটা ছিল সেটা হচ্ছে মনোজগতের উদ্ভাবন। যেটা আমার লেখায় ইলিয়াসের লেখায় এসেছে। আমার বৃত্ততো সম্পন্ন হয়নি, আমার বৃত্ত আমার মৃত্যুর পরে সম্পন্ন হবে।
শিবু কুমার শীল : ইলিয়াস ভাই সম্পর্কে আরো কিছু বলেন। উনার কবিতা সম্পর্কে।
আবদুল মান্নান সৈয়দ : ইলিয়াসের দুই একটা অভ্যেস। ও হচ্ছে নতুন বই পেলে, বা কিনলে প্রথমেই সেটা শুঁকবে বইয়ের যে একটা সুগন্ধ আছে ঘ্রাণ আছেওটা ওর একটা অভ্যেস ছিল। অসম্ভব রকম কোথাও একটা ইন্দ্রিয়সজাগতা ছিল এবং ইলিয়াস অল্প কিছু কবিতা লিখলেও আমি মনে করি সেটা বিশিষ্ট। সেটা অল্প কবিতা। পরে লিখেছে কিনা জানি না কিন্তু অল্প কবিতা।
শিবু কুমার শীল : কবিতা ছাড়া গল্প বা উপন্যাসে আপনি ইলিয়াসকে কীরূপে দেখতে পান/মূল্যায়ন করবেন?
আবদুল মান্নান সৈয়দ : যেটা আমি বলতে চাই সেটা ইলিয়াসের জীবনে দুটো পর্ব আছে। পরিষ্কার দুই ভাগে ভাগ। একটা হচ্ছে আপনার ষাটের দশক এবং আরেকটা হচ্ছে আমাদের স্বাধীনতা উত্তর যে কাল। এই কালের ইলিয়াসকে আমি চিনি না। এই কালের ইলিয়াসকে, যেটা নিয়ে অন্যেরা উৎসাহী সেই কালের ইলিয়াসকে আমি চিনি না তার মানে এই নয় যে আমি পড়িনি! আমি কিছু কিছু লেখা ইলিয়াসের পড়েছি সেখানে ষাটের দশকের ইলিয়াসের গল্প হচ্ছে মুখ্য। ছোটগল্প। এবং সত্তরের দশক ও পরে কালের যে ইলিয়াস সেখানে সে উপন্যাস এবং তার গল্পে দেখবেন বিশেষ করে গল্পের যে সংহতি সেটা পরের ডিটেইলের দিকে ঝোঁক এসছে। এই দিকের গল্পে ডিটেইলের ঝোঁকটা আগে ওর ছিল না। আগে ছিল অল্পের মধ্যে পুরো ফোটানো। কারণ পরে ক্রমশ উপন্যাসে তার যে সাফল্য সেদিকে যাচ্ছিল সে।
শিবু কুমার শীল : তিনি কাদের দ্বারা মূলত প্রভাবিত ছিলেন? বা আদৌ কোনো প্রভাব ছিল কি?
আবদুল মান্নান সৈয়দ : ইলিয়াসের একটা অভ্যেস ছিল ও আরেকটা কথা আমার বলা উচিত, জেমস জয়েসের ডাবলিনার্স ওর খুব প্রিয় ছিল। জয়েসের ডাবলিনার্স হচ্ছে গল্পের বই। পুরোনো ডাবলিন শহরের ছবি নিয়ে, বিভিন্ন জনজীবন নিয়ে লেখা। ইলিয়াসের গল্পে দেখবেন পুরোনো ঢাকা। এটা যে প্রভাব তা বলব না কিন্তু একটা উৎসাহ একটা উদ্দীপনা একটা উজ্জীবন ওখান থেকে পেয়েছে। কিনলিখেছে ওর নিজের মতো। আমরা তখন ডিলান টমাসের দ্বারা উদ্বুদ্ধ। ডিলান টমাসের কম্পাউন্ড ওয়ার্ল্ডইলিয়াসের লেখায় দেখবেন। প্রথম দিকে আছে, পরেও আছে। এবং ইলিয়াসের লেখায় যতই বাইরের প্রভাব থাকুক ইলিয়াসের অনত্মর্লোকের মধ্যে কিন্তু সে ছিল অন্যরকম।
শিবু কুমার শীল : তাহলে আপনি তার সমগ্র সাহিত্যকে দুটি পর্বে মূল্যায়ন করতে চান?
আবদুল মান্নান সৈয়দ : ইলিয়াসের লেখা বা যে কোনো উৎকৃষ্ট লেখকের লেখা কোনো সরলীকরণ সম্ভব নয়। ইলিয়াসে জীবনের এই যে দুটো পর্যায়। দুটো পর্ব। এ দুটো পর্ব আবার অভিন্ন বলে আমি মনে করি। সেই জন্য যারা শুধু বাইরের ইলিয়াসকে দেখে তারা যদি ওই আবহমান ইলিয়াসকে না বিচার করে তাহলে ভুল করবেন।
শিবু কুমার শীল : সাহিত্যে মতাদর্শগত যে প্রভাবের কথা বললেন সেটা কত দূর পর্যন্ত গিয়েছিল। নাকি পরে ছিলই না?
আবদুল মান্নান সৈয়দ : যেমন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় কমিউনিস্ট পার্টিতে জয়েন কররেন ১৯৪৪ সালে কিনতার আগে মানিকবাবু যখন লিখছেন পদ্মা নদীর মাঝিসেখানে দেখা যাচ্ছেকত? ছত্রিশ সালে বোধহয় বেরুল। তখন লিখছেন ঈশ্বর থাকেন ওইভদ্রপল্লীতেমানে এই জেলে পাড়ায় ঈশ্বর থাকেন না। কারণ জেলেরা সারাদিন কাজ করছে তাদের ঈশ্বরের নাম নেয়ার সময় কোথায়? তখনও তিনি কমিউনিস্ট পার্টিতে জয়েন করেন তখন ছিল তার ফ্রয়েডীয় পিরিয়ড। কিনওই ধারাবাহিকতায় আবার কমিউনিস্ট হয়ে গেলেন যখন তার পরবর্তীতে আবার মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখায় সেই অন্তর্গত অন্তর্লোকের ব্যাপারটা চিরকাল ছিল।
ইলিয়াসের লেখায় একই সঙ্গেএটা দ্বিচারিতা নয়। এটা হচ্ছে জীবনকে বাইরে থেকে ধরা, ভেতর থেকে ধরা। আমি মনে করি, এটা ইলিয়াসের মধ্যে একটা বৈপরীত্য সৃষ্টি করেছে। কিন্তু এটা সমৃদ্ধ করেছে।
উপনিষদে আছে দিন এবং রাত্রি। আমরা এমনিতেও বুঝতে পারি কোনো একটা সরলীকরণ জীবনে সম্ভব নয়। এবং ইলিয়াসের মতো ভালো লেখকের রচনায়। কোনো সরলীকরণ এটা ঠিক না। খোঁয়ারি যে গল্পটি সেটা টিপসহিবলে আমরা একটা কাগজ বের করেছিলাম এক সংখ্যাই বোধহয় বেরিয়েছিল। ওই কাগজেই প্রথম ছাপা হয়। ওটাও দীর্ঘ গল্প। এগুলো সব উপন্যাসমুখী গল্প। ওর পরবর্তী যে লেখা সেগুলি দেখবেন যে ডিটেইলের দিকে ঝোঁক আমি যেটা সম্মান জানাই। ইলিয়াসকে শ্রদ্ধা জানাই আমার বন্ধু হিসেবে তার যে গুণকীর্তন করব সেটা হচ্ছে তার অসম্ভব রকম নিষ্ঠা, অধ্যয়ন। দুটো বড় উপন্যাস সে লিখেছে এবং বড় উপন্যাসের দিকে ওর ঝোঁক ছিল প্রথম থেকেই। আমার মনে আছে ও কিনেছিল নিকোস কাজানজাকিসের খুব মোটা একটা বই। তখন আমরা মহিউদ্দিন বলে নিউমার্কেটে একটা দোকান ছিল ওখান থেকে খুব সসত্মায় পেপারব্যাক কিনতাম। ইলিয়াসের তখন থেকেই মোটা বই লেখার একটা ঝোঁক ছিল। একবার ইলিয়াস আমার একগাদা বই হারিয়ে ফেলে পরে আমাকে দু একটা বই দেয়। মানে অন্যের বই। আমার বইগুলো আর ফেরত পাই না। পরে ওর নিজের তহবিল থেকে বোধহয়। তার মধ্যে একটা ছিল চাঁদের অমাবস্যাআমি সেই প্রথম ওয়ালীউলস্নাহ্‌ পড়তে গিয়ে প্রতিহত হই। ইলিয়াসের মধ্যে এই ধারাবাহিকতা একটা আছে।
শিবু কুমার শীল : এই ধারাবাহিকতায় আর কারা কারা ছিলেন?
আবদুল মান্নান সৈয়দ : মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্‌, এমনকি হুমায়ুন চৌধুরী। কোনো লেখক ধারাবাহিকতা বিচ্যুত নয়। আবার সব মিলিয়ে যে ইলিয়াস দাঁড়িয়েছে সে ইলিয়াস তার নিজস্ব। ইলিয়াস তার ঐতিহ্যের ভেতর থেকেই নিজেকে বেড়ে তোলার চেষ্টা করেছে। এবং তার মধ্যে যেটা সমন্বয় ঘটেছে, সব মিলিয়ে গল্পকার হিসেবে উপন্যাসিক হিসেবে আমি মনে করি ইলিয়াসের সাফল্য, আমার খুব সাধারণ ধারণা কারণ দ্বিতীয় পর্যায়ের ইলিয়াসকে আমি পড়িনি। আমার ধারণা প্রথম পর্যায়ের ইলিয়াসের সাফল্য হচ্ছে ছোটগল্পে পরবর্তী পর্যায়ের যে সাফল্যের চূড়া সে স্পর্শ করেছে সেটা উপন্যাসে। এবং এই দুটো ক্ষেত্রেই ও আমাদের সাহিত্যে কেন সমগ্র বাংলা সাহিত্যেই অনন্য। আমি গৌরববোধ করি আমার বাল্যবন্ধু বা সে ছেলেবেলার বন্ধু বাংলা সাহিত্যে একজন অমর লেখক-হিসেবে স্বীকৃত হয়েছে ইতিমধ্যেই।
শিবু কুমার শীল : খোঁয়ারি সম্পর্কে
আবদুল মান্নান সৈয়দ : আমাদের একজন বন্ধু ছিল রণজিৎ পাল চৌধুরী। ও ভারী সুন্দর কবিতা লিখত। আমাদের অনেক বন্ধুই যারা গ্যাছে ও বেঁচে আছে দুঃসহ একটা অবস্থার মধ্যে। (গত ৩ মে ২০১০ এ রণজিৎ কুমার পাল চৌধুরী মারা যান।) ও আমাকে বলেওছিল। একবার বিউটি বোর্ডিং-এ আমাদের দেখা হয়েছিল আমি ওর সঙ্গে সারাক্ষণ থাকলাম ও আমার সঙ্গে। তখন আমরা আপনি আপনি করতাম এখন সহজেই তুমি তুমিতে চলে এলাম।
ইলিয়াসের ক্রমাগত যেটা হয়েছিল ও একটু নিঃসঙ্গ ধরনের। ও মেলামেশা করত কিন্তু কোথাও একটা সাহিত্যিক যে পরিম-ল তা থেকে নিজেকে কিন্তু একটু দূরে রাখত। পরের দিকে জড়িয়েছে। যত বয়স হয়েছে কিছুটা জড়িয়েছে। কিন্তু তারপরও কোথাও একটা দূরত্ব ছিল। রণজিৎকে নিয়ে ইলিয়াস একটা গল্প লিখেছিল। খোঁয়ারিই হচ্ছে সেটা। সব দেশেই সংখ্যালঘুর একটা সমস্যা আছে। আমি নিজেও সেই সমস্যার জাতক। ১৯৫০ সালে আমার জন্মভূমি আমি চিরকালের জন্য ছেড়ে এসেছি। কাজেই আমি এটা বুঝি এটা একটা বেদনা। সংখ্যালঘুর যে বেদনা। আমার বেদনাটা আলাদা কিন্তু যে এখনও যাতনা সহ্য করছে সে হচ্ছে রণজিৎ পাল চৌধুরী। সব সময় এক ধরনের লোক থাকে যারা সুযোগসন্ধানী। যাদের কোনো দল, মত, ধর্ম, বর্ণ নেই। তারা থাবা বসায়। এই বিষয়টাকেই খোঁয়ারিতে ইলিয়াস বিষয়বস্তু করেছে। ইলিয়াসের বহির্দৃষ্টি ওই যে বলেছি ইন্টোভার্ট থেকে সে ক্রমশ বাইরের জগতটাকে দেখতে থাকে। এবং কিছুটা কিন্তু লোকচড়্গুর অগোচরে এবং কিছুটা হয়তো এমনও হতে পারে যে ইলিয়াস অবশ্য অসম্ভব সচেতন ছিল কিনআমি জানি না এটার মূল ঘটনা জানি না। ইলিয়াস ঠিক কোনো রাজনৈতিক মতবাদের গোষ্ঠীর লেখক হতে পারে বলে আমি মনে করি না। কিন্তু যেভাবেই হোক সে চলে গিয়েছিল সেটা আলাদা কথা।
কিনএই গল্পে যেটা দেখা যায়। খোঁয়ারি গল্প তো অনেক আগে পড়েছি এখন অনেক কিছুই মনে নেই। তো যেটা দেখা যায় সেটা হচ্ছে রণজিৎ পাল চৌধুরীদের সঙ্গে ওঁর যে গভীর বন্ধুতা ছিল সেই সংখ্যালঘু মানুষের যে বেদনা, সেই বেদনার রূপায়ণ এখানে দেখা যায়। আবার একই সঙ্গে মনে রাখতে হবে ইলিয়াস নিজেই এসব খুব কাছ থেকে দেখেছে। সেই সময় তার বন্ধু ছিল বিপস্নব দাশ, মুশাররফ রসুল বুড়ো ভাই যাদের সঙ্গে তাঁর সময় কেটেছে। ফলে ওই জগৎটাকে ও খুব ভাল রকম জানতো। বিপ্লব দাশ একটা বই লেখে। ও এখন মারা গ্যাছে। অসম্ভব ভাল ছেলে ছিল, ‘কিম্পুরম্নষনামে অসাধারণ একটা উপন্যাস ছিল তার যারা হিজড়ে তাদের নিয়ে।
শিবু কুমার শীল : তখন কি যেতেন ওখানে?
আবদুল মান্নান সৈয়দ : আমরাও শাখারী পট্টিতে গিয়েছি বুড়ো ভাই আর বিপ্লবের নেতৃত্বে। এখন ইলিয়াসের এটা প্রাত্যহিক অভিজ্ঞতা ছিল এবং ওর সন্ধান ছিল এই জগৎটা সম্পর্কে।
শিবু কুমার শীল : তখনকার ঢাকা আর এখনকার ঢাকার মধ্যে পার্থক্য তো ঘটেছে বটেই। আপনি বা আপনারা সেটা কীভাবে দেখতেন?
আবদুল মান্নান সৈয়দ : ঢাকা শহর-এখন কয়েকটা ঢাকা শহর। এখন ঢাকা শহর একটা নেই। ইলিয়াস যতদিন দেখেছে ততদিন হয়তো একটা ছিল তখন পুরোনো ঢাকা একরকম। সেই আরেক রকম খাবার আরেকরকম আচরণ, রাত্রি পর্যন্ত জাগছে, এই করছে। পুরোনো ঢাকার ইয়েটা কিন্তু আলাদা। আবার যদি আপনি আমাদের যে মধ্যবিত্ত শ্রেণিকে দেখেন তাদের জগৎটা একটু অন্যরকম। গুলশান বনানী বারিধারায় যদি যান তাহলে ঢাকা আরেক রকম। এই যে একই ঢাকা শহরের মধ্যে অনেকগুলো ঢাকা তৈরি হয়েছে। ইলিয়াস তার জীবৎকালের ঢাকাকেই তুলে ধরেছে তার লেখায়।
শিবু কুমার শীল : একজন লেখক হিসেবে আপনার দেশত্যাগের বেদনাটাকে কীভাবে দেখেন?
আবদুল মান্নান সৈয়দ : শিল্পীর একটা জিনিস হচ্ছে মমত্ব। মমত্ববোধ। কিন্তু আবার মিথ্যাচার নয়। এটা কিন্তু মনে রাখতে হবে। সংখ্যালঘুর বেদনাটা আমি যেটা বুঝি কেননা সংখ্যালঘু হিসেবে আমি একটা দেশ থেকে বিতাড়িত। আমি যখন দেখি আমাদের দেশে সিনেমা হচ্ছে যেখানে বাংলাদেশ থেকে যারা ওপারে চলে গ্যাছে তাদের নিয়ে এবং তাদের নিয়ে কথা হচ্ছে। কিনবাংলাদেশে যারা ওদিক থেকে এসছেন তাদের সম্পর্কে নীরব সেটা আমি সত্যভাষিতা বলে মনে করি না। কেননা পশ্চিম বাংলা থেকে অগণন মুসলমান এখানে চলে এসেছে এই দেশ থেকে অগণন হিন্দু চলে গ্যাছে। এবং এটা কোন সময় হয়েছে? যে সময় আমি নিজে এ দেশে এসছি। আপনারা সাতচল্লিশের রায়ট, হিন্দু মুসলমান দাঙ্গার কথা জানেন কিন্তু সাতচল্লিশের পরবর্তী একটা ধাক্কা হয়েছিল সেটা হচ্ছে ১৯৫০ সনে। ওই পঞ্চাশ সনে অগণন হিন্দু এদেশ থেকে চলে যায়। আমরা তখন গোপীবাগে থাকতাম। গোপীবাগ তখন অসম্ভব সাংস্কৃতিক এলাকা। আমার বড় বোন ছিল অধ্যাপিকা সালমা হোসেন। তার সঙ্গে যে হিন্দু বন্ধুরা ছিল তারা চলে যান ১৯৫০ সালে। আমাদের পাড়ায় অগণন হিন্দু পরিবার ছিল তারাও চলে যায়। আবার ওখান থেকে আমরা চলে আসি। আব্বা আগে সরকারি চাকরি করতেন। তিনি আগেই চলে এসছেন। ফলে এইটা সারা পৃথিবীর একটা দুঃখ, দুর্দশা, দুর্ভোগ এটা একটা চিত্র। আমরা যদি চিত্রের একটা পিঠ দেখাই তাহলে কিন্তু সত্যভাষণ হলো না। এটাও আমি উল্লেখ করতে চাই আমাদের টোটাল শিল্প সাহিত্যের কথা মনে রেখে।
শিবু কুমার শীল : ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ আপনাকে কীভাবে প্রভাবিত করে?
আবদুল মান্নান সৈয়দ : আজকে আপনারা বাংলাদেশ থেকে ইলিয়াসের উপর ডকুমেন্টারি বানাচ্ছেন এইটা যদি স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ না হতো তাহলে আপনারা এখানে আমার কাছে আসতেন না। আমারও সুযোগ হতো না।
আমরা যে ভূখ- পেয়েছি এর যে মাহাত্ম্য সেটা আমরা কিন্তু বুঝতে পারছি না। যেহেতু এটা আমাদের সবচেয়ে সুসময়। অনেক সময় সুসময়ের মধ্যে থাকলে বোঝা যায় না। চলে গেলে বোঝা যায় আমি কী হারালাম।
আমি খবরের কাগজ পড়ি না; পড়লে আমার প্রেসার চড়ে যায়। আমাদের দেশ কোথায়! পঁয়ত্রিশ ছত্রিশ বছরে আমরা কোথায় এসছি? আমরা যদি গণতান্ত্রিকতাকে না রক্ষা করতে পারি। আমরা যদি আমাদের সংখ্যালঘু যারা আছেন তাদের জানমালের নিরাপত্তা না দিতে পারি তাহলে সেটা আমাদের অক্ষমতা। আবার যারা ওখান থেকে এসছে তাদের হৃদয় দিয়ে গ্রহণ করা, তাদেরও দুঃখের অনুভূতি বুঝতে হবে। আমার মেঝ ভাই বড় চাকরি করত মুন্নু সিরামিকে। মেঝ ভাই তার এক লেখায় বলেছে আমার শ্রমিকরাও জানে মৃত্যুর পরে তাদের দেশের বাড়িতে তাদের লাশ যাবে এবং সেখানে তারা সমাহিত হবে। কিন্তু আমি? আমি তো আর আমার দেশে ফিরতে পারব না। এই বেদনাটাও বুঝতে হবে আমাদের দেশের একটা চোখ ট্যারা আছে আমাদের কথাসাহিত্যে বলুন, কথাসাহিত্যে তো এটা আসে, আমাদের এই বেদনাগুলো কিন্তু চিহ্নিত করা হয়নি। আমাদের সাহিত্যের একটা প্রধান অসুবিধা হচ্ছে, আমরা সাহিত্যিকেরা নিম্নবিত্ত থেকে তো আসে না, আসে নিম্ন মধ্যবিত্ত, উচ্চ মধ্যবিত্ত এই বঙ্গে আমাদের দেশে সাহিত্যিকদের উৎস। দুএকজন উচ্চ ঘরানার দুএকজন নিম্ন ঘরানারও আসে। সাধারণভাবে দেখতে গেলে বিষয়টা এই। আমাদের দেশের কথাসাহিত্যের দীনতার কথা বলবো আমি সেটা হচ্ছে আমাদের কথাসাহিত্যিকেরা লিখতে ভালোবাসেন যে জীবন তারা যাপন করেন সেটা না। নিচু তলার জীবন অথবা উঁচু তলার জীবন। এর মধ্যে কোথাও একটা ছলনা আছে। আমি যে জীবনযাপন করি সেখানে আমাকে বাজার করতে হয় এটা আমি লিখছি না আমি লিখছি বাজারে গিয়ে কোনো গরীব মানুষ কিনতে পারছে না তার কথা। আবার বড়লোকেরাও গুলশানে বাজার করছে এসব দেখে এসে কেউ লিখছে। আমাদের কথাসাহিত্যের বিরাট দুর্বলতা হচ্ছে আমরা বাস্তবতার মুখোমুখি হতে ভয় পাই। বাস্তবতার মুখোমুখি হলে আমার নিজের ছবিটা তুলে ধরতে হয়।
শিবু কুমার শীল : সেই তুলনায় কোলকাতার সাহিত্য কি আমাদের চেয়ে এগিয়ে?
আবদুল মান্নান সৈয়দ : আমি ভারতপ্রেমী লোক না। ওদের সাহিত্যের অগ্রসরতা যেটা আছে সেটা আমাদের স্বীকার করতে হবে তারা মোকাবিলা করতে পারে। তারা তাদের সাহিত্যের সমসাময়িক বিষয়কে অকুণ্ঠভাবে তাদের সাহিত্যে তুলে ধরতে পারে। অগণন লেখক আছে ওদের। আমাদের লেখকও কম। তারা অগণন সাহিত্যিকেরা মিলে সেটা রূপায়িত করছে। আমরা মধ্যবিত্ত জীবন থেকে এসছি কিন্তু একটু আগে আযান হলো আমাদের সাহিত্যে আযানের কোনো ইয়ে নেই। আমাদের এই বাড়িতেই ঊলুধ্বনি হয় সন্ধ্যার একটু পরে। আযানের কিছুক্ষণ পড়েই ঊলুধ্বনি আমরা শুনতে পাই। ঊলুধ্বনি দেয়া হবে সেটা আমাদের সাহিত্যে দেখতে পাবেন না। এখন আমি ব্যক্তিগত জীবনে ধর্মাচরণ করি কি না করি আমাদের যে বাস্তবতা সেটা কিন্তু  আমাদের সাহিত্যে আসতে হবে। এইটা আমি মনে করি আমাদের কথাসাহিত্যের একটা মৌলিক দুর্বলতা। এই দূর্বলতা কাটাতে হলে আমাদের আরো সত্যভাষী হতে হবে। আরো জীবন থেকে পাঠযেটা গোর্কি বলছেন, গোর্কি যে জীবন থেকে এসছে সেই জীবনের ছবি তো গোর্কি ছাড়া আর কারো পড়্গে সম্ভব ছিল না। গোর্কি নিজেও এই সংগ্রাম করে করে এসছে। ফলে তার যে লেখা আর টলস্টয়কে আরো সম্মান করি, দসত্ময়েভস্কিকে সম্মান করি, দসত্ময়েভস্কি আমাদের ইলিয়াসেরও পূর্বসূরী। ইলিয়াসের একটা জিনিস, শিল্পীর যে নিবেদন সেটা ওর আছে। এখন তার যে খ্যাতি দেখছি ইলিয়াস তার জীবৎকালে কিন্তু তা দেখে যায়নি। তার কণামাত্র দেখেছে যেহেতু অকালমৃত্যু হয়েছে। এবং এইটা একধরনের হুজুগ। এই ইয়েতে অনেকেই অনেক আবেগের কথা বলেছে বা সুযোগ এসেছে। কিন্তু সাহিত্যের একটা নিরাবেগ দৃষ্টিকোণ থাকে। সেখানে থেকে দেখলেও আমি মনে করি ইলিয়াস আমাদের দেশের একজন ভালো লেখক।
শিবু কুমার শীল : প্রথমদিককার সাহিত্যিকদের যে প্রভাব ইলিয়াসে ছিল সে পরে কি আর বিসত্মার লাভ করেছিল?
আবদুল মান্নান সৈয়দ : ওয়ালীউল্লাহ্‌র ধারাবাহিকতা ওর মধ্যে আছে খুব পরিষ্কার ভাবে আছে কিন্তু এটার কোনো উল্লেখ দেখি না। যেমন হুমায়ুন চৌধুরীর আছে, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের আছে। ওর যে পরবর্তী ঘরানা আবার এদিকে আমরা ছিলাম বুদ্ধদেব বসু এদের ভক্ত। ফলে ওর লেখায় প্রথম থেকেই যেটা লক্ষ করেছি বুদ্ধদেব বসুর ভক্ত হলেও ওর লেখায় কিন্তু একটা আলাদা ব্যাপার ছিল। আমরা পরীক্ষামূলক বানান লিখতাম পরীক্ষামূলক সেনটেন্স। ওর লেখায় কিন্তু প্রথম থেকে আলাদা যদিও সেটা আমাদের সবার লেখায়ও কমবেশি দেখা গিয়েছিল।
শিবু কুমার শীল : আপনাদের ষাটের দশক পরবর্তী সাহিত্যের কথা বলুন।
আবদুল মান্নান সৈয়দ : ষাটের দশকে আমরা যেখানে ছিলাম সেখানে তো কেউই নেই। ইলিয়াস ৯৭ সালে মরে গ্যাছে যদি ২০০৮ সালে বেঁচে থাকত-ইলিয়াসের যে সন্ধানআমি মনে করি একজন লেখকের সন্ধানই তাকে লেখক করে। ফলে ইলিয়াস একটা জায়গায় থাকত ইলিয়াস খ্যাতি বা প্রচারধর্মী ছিল না। ও নিঃশব্দ ছিল। নিঃশব্দে নিজের কাজ করে গ্যাছে। এটাকে সালাম জানাই। ইলিয়াস যে নিঃশব্দে বিশাল। এইসব উপন্যাস এই হৈচৈ এর মধ্যে করতে পেরেছে। বারবার পুনর্লেখন করেছে। একেবারে ছক করে ইতিহাস তৈরি করে তারপরে সে লিখেছে। এইগুলো আমার বিস্মিত করে যে, নিজে এতটা আড়ালে থেকে কি করে এটা সম্ভব।
শিবু কুমার শীল : এটা নিয়ে ইলিয়াস ভাইয়ের প্রতিক্রিয়া কী ছিল?
আবদুল মান্নান সৈয়দ : ইলিয়াসের খ্যাতি তো একেবারে শেষদিকে সূচনা হয়েছে। ইলিয়াস তা দেখে যায়নি। ইলিয়াসের যা স্বভাব ও নিজেই এই খ্যাতিকে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ করত। জীবন সম্পর্কে ইলিয়াসের গভীর এক কৌতূহল ছিল। একজন জীবনবাদী লেখক। সে বাস্তববাদী।
আমাদের প্রথম জীবনের যে নাস্তিক্য ছিল জীবন সম্পর্কে যে নেতিবাচকতা ইলিয়াসের ছিল আমার ছিল, সেটা আমি মনে করি ইলিয়াসের মধ্যে চিরকাল রয়ে গ্যাছে ভেতরে ভেতরে। ইলিয়াস ব্যঙ্গ বিদ্রূপ করছে সবাইকে নিয়ে। ব্যঙ্গ বিদ্রূপ করে কে? সে নিজেকে নিয়েও ব্যঙ্গ বিদ্রূপ করত। যে কারো সঙ্গে দেখা হলে ও ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ করছে ওকে নিয়ে একেবারে মুখের সামনে। কোনো আড়ালে না। আড়ালেও করছে মুখের সামনেও করছে। আবার নিজেকেও ছেড়ে কথা বলছে না। ওর আরেকটা স্বভাব ছিল নাম দেয়া। যেমন আমাদের সমসাময়িক একজনের নাম দিল পিপিমানে পাগলা। এখন অনেকে তো জানেই না পিমানে কি? ‘পিঅমুক বলেই তিনি বিখ্যাত। দেখা গেল তার স্ত্রীও তাকে পি বলে ডাকে। স্ত্রী জানে না পিমানে কি? তো এই যে ওর একটা মজা করার স্বভাব সেটা ওর সাহিত্যেও আছে। সেই সাথে সিরিয়াসনেসও। যেটা আমাদের আজকের সাহিত্যে অনুস্থিত  । সেই ক্ষেত্রে ইলিয়াস একটি প্রতিবাদ।
যেখানে আমাদের কথাসাহিত্য সস্তা জনপ্রিয়তা নির্ভর-সেখানে ইলিয়াসের এই সিরিয়াসনেসকে সালাম জানাতে হবে।
ও কখনও টেলিভিশনে আসত না। ওর একটা বলয় ছিল বন্ধুবৃত্ত ছিল সেই বন্ধুবৃত্তের মধ্যেই ও আবদ্ধ থাকত। আমাদের সঙ্গে দেখা হলে হাসি, ঠাট্টা, মসকরা করত। ব্যাস এই।
শিবু কুমার শীল : ইলিয়াসের সঙ্গে আপনার যে বন্ধুতা তা তো শেষ পর্যন্ত একই রকম থাকেনি।
আবদুল মান্নান সৈয়দ : আমার সাথে ইলিয়াসের সম্পর্কের যে ঘনিষ্ঠতা ছিল সেটা ষাটের দশক পর্যন্ত এবং সেটা নিবিড় সম্পর্ক। ওই সময়ে ইলিয়াসের মতো আমার কোনো বন্ধু ছিল না এবং আমার বিশ্বাস ইলিয়াসেরও ছিল না।
আমরা একই সঙ্গে যাত্রা শুরু করেছিলাম। ইলিয়াসের লেখায় একই সঙ্গে অস্তিবাচকতা এবং নেতিবাচকতা কোথাও একটা জায়গায় আছে। এটা আমার মনে হয় খুঁজে দেখতে হবে। আল্লাহ যদি আমাকে সময় দেয় তবে ইলিয়াসের লেখাগুলো পুরো পড়ে তারপর আলোচনা করব।
শিবু কুমার শীল : আমরা অনেকেই মনে করি ইলিয়াসের পরম্পরা শহীদুল জহিরের মধ্যেও প্রবহমান ছিল। আপনি কি মনে করেন?
আবদুল মান্নান সৈয়দ : ইলিয়াসের প্রথম দিককার লেখার সাথে আমি পরিচিত। পরবর্তী লেখার সঙ্গে আমি খুব পরিচিত না। শহীদুল জহিরের মৃত্যুর পর আমি লিখেছিলাম। আমি যেটা লক্ষ করেছি সেটা হচ্ছে আমি কয়েকটা পুরস্কার অনুষ্ঠানে বিচারক হিসেবে কাজ করেছি। একাধিক পত্রিকায়। তখন আমকে তরুণদের লেখা পড়তে হয়। এবং আমি শহীদুল জহিরের লেখা পড়ে বিস্মিত হই। এবং তাকে পুরস্কারের জন্য মনোনয়ন করেছিলাম। আমি ও হায়াৎ দুজনেই। যাই হোক সে পুরস্কার পায়নি। কিন্তু এটা ঠিক যে শহীদুল জহিরের লেখা অসম্ভব রকম ক্ষমতাশালী। যদিও সে অকাল প্রয়াত। এদের ধারার উৎস কিন্তু সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্‌। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্‌র ধারাবাহিকতা আংশিক সৈয়দ শামসুল হকে, পরবর্তী আখতারুজ্জামান ইলিয়াসে, তার পরবর্তীতে শহীদুল জহির ও আরো অনেক তরুণ লেখকের আছে। কিন্তু শক্তিশালী লেখক যারা যেমন ইলিয়াস বা শহীদুল জহির এরা নিজ নিজ অবস্থান আবার তৈরি করেছে। শহীদুল জহিরের একটা ইয়ে ছিল যে তার বিভিন্ন জায়গার যে অভিজ্ঞতা তার লেখায় দেখি যেমন চট্টগ্রাম, বা ঢাকা পুরোনো ঢাকা যেটা ইলিয়াসের ক্ষেত্রেও ছিল। তবে শহীদুল জহিরের বিষয়টা একটু আলাদা ও আরো বেশি অন্তর্মুখী তুলনামূলক আলোচনা যদি করতে হয়- ইলিয়াসের চেয়ে আরো বেশি অন্তর্মুখী ছিল সে। ওর লেখায় আমার মনে হয়েছে ওয়ালীউল্লাহ্‌র মতো কোথাও একটা নিয়তির ব্যাপার আছে। যদিও ইলিয়াসের লেখায় নিয়তি সেরকমভাবে নেই তারপরও ইলিয়াস নিয়তির শিকার। আমরা সকলেই নিয়তির শিকার। আমিও নিয়তির শিকার আপনিও তাই। নিয়তির বাইরে কেউ নয়। তো মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের উত্তরসূরী কিন্তু সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্‌, জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী, রমেশচন্দ্র সেন। একটা ধারাবাহিকতা কোথাও থাকে এবং এটার সূত্রপাত আমরা দেখি বঙ্কিমে। যে মনোজগত বঙ্কিমচন্দ্রের বিষবৃক্ষ, কৃষ্ণকান্তের উইল এইসব উপন্যাসে আছে। সেটা রবীন্দ্রনাথের চোখের বালিতে বিকশিত হলো।

কিন্তু তথাকথিত ছোটলোকযারা তারা সাহিত্যে ঢুকল তিরিশের দশকের লেখকদের লেখার মধ্য দিয়ে। শৈলজানন্দ, মনীশ ঘটক, নজরুল ইসলাম। নজরুল ইসলামের গল্প ও উপন্যাসে এবং আরো অনেক লেখকের লেখার মধ্য দিয়ে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ