রবীন্দ্রনাথ সম্ভবত প্রথম
সচেতন মানুষ যিনি বলেছেন বাংলার জননী হচ্ছে প্রাকৃত জননী। এক্ষেত্রে আজও, এই চলতি সময় পর্যন্ত আশ্চর্যভাবে আমাদের যে অবচেতন মন ভাষা
অবচেতনা ফার্সি ভাষাকে বহন করছে। ফার্সি ভাষাকে নতুন নতুনভাবে প্রয়োগ করছে। আমরা
ইংরেজিটা জানি কিন্তু ফার্সি ব্যাপারটা জানি না; মানে খেয়ালই করি না। যেমন, এখানকার লোকাল ট্রেনে আমরা আকছার শুনতে পাই একজন হকার তার
মালটা বিক্রি করতে করতে বলছেন 'যিনি দরকার মনে
করবেন তিনি একটু আওয়াজ দেবেন, আওয়াজ দিয়ে
জিনিসটাই চেয়ে নেবেন।' 'আওয়াজ' শব্দটা মূলগতভাবে একেবারেই ফার্সি! যাকে বলে ফার্সি-তৎসম।
আবার ধরুন: একটা মেয়ে তার বান্ধবীকে বলছে, ছেলেটা তখন থেকে কিন্তু তোকে 'আওয়াজ' দিয়ে যাচ্ছে। এখানে আওয়াজ মানে কিন্তু ব্যঙ্গ করা। ফার্সি 'আওয়াজ' দেওয়া অর্থটা
কিন্তু 'ব্যঙ্গ' করা বোঝায় না। উর্দুতে আওয়াজ দেওয়া মানে সাড়া দাও। আমার ওই
লেখাটাতেই একটা জায়গায় আছে 'বাংলাভাষার জন্য
পশ্চিম বাংলার বাঙালিরা আজ রাস্তায় নেমে আওয়াজ তুলেছে।' ভাষার জন্য আওয়াজ তোলা মানে ভাষার জন্য দাবি পেশ করা। তাহলে
আওয়াজ শব্দটাকে আমরা নানান ক্ষেত্রে কেমন করে ব্যবহার করলাম, ফার্সি যাদের মাতৃভাষা তাদের মতো করে তো নয় এবং কারো মতো
করেই নয়।
আরেকটা উদাহরণ, সেদিন আমি সোনারপুর স্টেশনে দাঁড়িয়ে আছি, ওখানে গাড়ি ধরবো, আমি অফিস যাবো এমন সময় স্টেশনের মাইকে ঘোষণা হলো ২ নং প্লাটফরম দিয়ে থ্রু গাড়ি
যাবে, অনুগ্রহপূর্বক প্লাটফরমের
ধার থেকে সরে দাঁড়াবেন। 'থ্রু' হচ্ছে ইংরেজি আর 'গাড়ি' হচ্ছে ফার্সি আমরা
ক্রমাগত এ-জাতীয় ফার্সি মেশানো মিশ্র শব্দ তৈরি করেই চলেছি। ইংরেজির আধিপত্য তো
আমরা দেখতেই পাচ্ছি; কিন্তু ফার্সি আরবি যে
কতোভাবে নিরন্তর আমাদের ওপর আধিপত্য রেখে চলেছে। অনেকের ধারণা, এরকম বলা হয় ব্যাকরণ যারা সামান্য পড়ে-টড়ে, সাধারণত যারা ব্যাকরণ লেখেন এবং ভাষা নিয়ে যারা
কলেজ-স্কুলের পাঠ্যবই প্রণয়ন করেন তারা এরকম একটা ধারণা গড়ে দিয়েছেন যে আইন-আদালত
ইত্যাদির ব্যাপারে অনেক ফার্সি শব্দ আমাদের নিতে হয়েছে এবং সেগুলোই আছে; জমি-জিরাতের হিসাবের বেলায়ও অনেক ফার্সি শব্দ আছে; কিন্তু 'থ্রু গাড়ি আসছে'
বা 'আওয়াজ' দিচ্ছে লোকটা, ভাষার জন্য কলকাতার রাস্তায় আওয়াজ তুলেছে একদল মানুষ এগুলো
তো আইন-আদালতের ব্যাপার নয়। আমি আরো কিছু উদাহরণ ওখানে দিয়েছি যেমন 'সেজ দিদি'। এই সেজ দিদির মধ্যে আছে 'সেহ্'। সেহ্ হচ্ছে ফার্সি। সেহ্ মানে তিন। যেমন সেতার; তিন তারবিশিষ্ট যন্ত্রকে সেতার বলা হতো। আগে তিন তারই ছিল।
তা 'সেহ্'-এর সঙ্গে 'জ' হচ্ছে সংস্কৃত-ধাতু যার মানে জন্ম। অর্থাৎ তিন নম্বরে জন্ম
যে বড় বোন বা দিদি হলো 'সেজদি', মানে তৃতীয় নম্বর জাতিকা দিদিদের মধ্যে। আর কৌতূহলের দিকটা
হলো ফার্সি 'সেহ্'-এর সঙ্গে যুক্ত হলো সংস্কৃত-ধাতু 'জ'। তাহলে শুধু এটা বলা যায় না যে, অফিস-আদালত-কাছারি-জমি-জিরাতের ব্যাপারে ফার্সি শব্দ আমাদের
দরকার হয়েছে সেগুলো আমাদের ভাষায় এসে গেছে এবং সেগুলো বিদেশি ভাষা! আমরা আপত্তি
জানাচ্ছি এখানে যে, যেখানে
ধ্বনি-প্রত্যয়-বিভক্তি পর্যন্ত ফার্সি-আরবি দ্বারা প্রভাবিত হচ্ছে সেখানে কী করে
বলি শুধু এগুলো বিদেশি ভাষা? না, এভাবে বলতে হবে না। বলতে হবে যে সংস্কৃত বাংলা যে শব্দগুলো
সরাসরি সংস্কৃত থেকে আসছে। তেমনি বলব ফার্সি বাংলা অথবা আরবি বাংলা, তেমনি ফার্সি-ইংরেজি বাংলা বা ফার্সি-সংস্কৃত বাংলা। এভাবে
বলব।
'বিদায়' শব্দটাতে রবীন্দ্রনাথ খুব অবাক হয়ে গিয়েছিলেন এই শব্দটা যে
আরবি, সেটা জেনে রবীন্দ্রনাথ
হতভম্ব হয়ে গিয়েছিলেন। তো, এ জাতীয় শব্দ
পর্যন্ত আরবি আর আমরা তো জানিই না এগুলো। যেমন বাবা শব্দটাও আরবি। এখানকার
ভাষাতাত্তি্বকরা অনেক আরবি শব্দকেও বলছেন দেশীয় শব্দ। মানে, অজ্ঞতা একেবারে চরম অবস্থায় রয়েছে। যদি আমরা ডিকশনারি খুলি
তবে তাতে দেখব যে, অনেক আরবি-ফার্সি শব্দকে
বুঝতে না পেরে সেখানে দেশীয় শব্দ লেখা রয়েছে! এমনকি এমন পর্যন্ত আছে দেশীয় সংস্কৃত?
সেটা কী ঠিক বুঝলাম না। ফলে, খুব মুশকিল! ভাষাটা নিয়ে ভাষাচর্চা এখানে নেই।
আমি আরো একটা অদ্ভুত
উদাহরণ দিচ্ছি যা শিক্ষিত বাঙালির অজানা; সেটা হচ্ছে, বই শব্দটা একেবারে গোড়ার
একটি সম্পূর্ণ কোরআনের শব্দ, মানে একেবারে
আরবি শব্দ; এবং এটা 'ঈশ্বর' চিন্তার সঙ্গে
যুক্ত শব্দ_সেটা হলো_অহি। অহি শব্দটা থেকে বহি, 'বহি' থেকে বই। 'অহি' হচ্ছে ঈশ্বরের
প্রত্যাদেশ। তাহলে, ঈশ্বরের প্রত্যাদেশ তো
সম্পূর্ণ একটা ধর্মীয় ব্যাপার। সুতরাং 'বই' শব্দটা গোড়াতেই একটা
ধর্মীয় শব্দ; সেটাকেই বাঙালি
ধর্মনিরপেক্ষ শব্দ হিসেবে ব্যবহার করে। এটা হলো, শব্দার্থের যে বিবর্তন সেটার উৎস ধর্মীয় হলেও সেটা যে 'ধর্মনিরপেক্ষ' শব্দে পরিণত হতে পারে তার সবচাইতে বড় প্রমাণ বই। এখন, এটা যদি পশ্চিমবঙ্গের একজন হিন্দু বাঙালি জেনে থাকেন বই
শব্দটাই আরবি এবং সেটা একদম ধর্ম সম্পৃক্ত শব্দ, তাহলে আর আরবি-ফার্সি নিয়ে মাথা ঘামাবেন না তিনি। এই
বর্তমান 'সময়' যেই-যেই শব্দগুলোকে গ্রাহ্য করছে আমি সেই-সেই শব্দগুলো নেবো
কি-না; এবং তার জন্য তার গায়ে
লাগা উচিত না। এবং থাকলে প্রথমেই তো 'বই' শব্দ গায়ে লাগানো উচিত।
এর বিকল্প হিসেবে কি 'কিতাব' ব্যবহার করবে? সেটাও তো তথাকথিত তৎসম শব্দ নয়। কলম, দোয়াত, কিছুই সংস্কৃতজাত শব্দ
নয়। কাগজ এমনকি জামা-ও।
তাহলে দেখা যাচ্ছে,
জামা-কাপড় খাওয়া-দাওয়া যা কিছুতেই আরবি-ফার্সি
সম্পৃক্ত হয়ে মেখে রয়ে গেছে। তাহলে বাংলাভাষাকে আমরা কী ভাষা বলব? এবং এই প্রাকৃত লোকেরা যেভাবে আরবি-ফার্সিকে উচ্চারণ করেছে,
সেভাবেই কিন্তু এই ভাষাটা তার আদল গড়ে নিয়েছে। 'অহি' এই 'অহি' শব্দটা উচ্চারণই
করে না বাঙালি; কারণ হচ্ছে 'ওয়াহ্' শব্দটা বাঙালির
উচ্চারণের মধ্যে থাকে না। বাঙালির কাছে দুটো যে ব _ একটা বর্গীয় এবং অপরটা অন্তস্থ। এই বর্গীয় 'ব'-ই শুধু উচ্চারণ
করে, এবং অন্তস্থ 'ব' বাঙালি উচ্চারণ
করে না বলে 'অহি'টা বহি থেকে বই হয়ে গেলো। যেহেতু বর্গীয় ব-ই উচ্চারণ করে
বাঙালি এবং অন্তস্থ 'ব' উচ্চারণ করে না... এভাবে আরবি-ফার্সি খুব সূক্ষ্মভাবে
আমাদের প্রাকৃত জিহ্বায় জড়িয়ে গেছে সেটা ধাতস্থ হয়ে গেছে। কী সংস্কৃত, কী আরবি ফার্সি বা তুর্কি যেভাবে বাঙালির জিভ নিতে পেরেছে
সেভাবেই শব্দগুলো এসেছে। বাবা শব্দটা তুর্কি-আরবি। আলিবাবা, কাশিমবাবা। যার ফলে খুব হাস্যকর লাগে আমার এখানে, পশ্চিমবাংলায় হিন্দু-বাঙালি তার পিতাকে বাবা বলেই ডাকে। আর
এখানে মুসলিম-বাঙালি বাবাকে বাবা না বলে আব্বা বলে ডাকে। এসবের তো কোনো মানে হয়
না।
কিন্তু সাধারণ মানুষের
ভেতরে এই ধারণা বদ্ধমূল যে, বাবা শব্দটা হিন্দু
শব্দ সংস্কৃত থেকে উঠে আসা, আবার পানি
শব্দটাকে মনে করে নিপাট আরবি শব্দ! পানি শব্দটা একেবারেই হিন্দি, মানে প্রাকৃত-হিন্দি যাকে বলে। পানীয় শব্দটা সংস্কৃত;
কিন্তু হিন্দি বলয়ে হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে
জলকে পানি বলছে; অথচ পশ্চিমবাংলার
হিন্দুরা জল ও মুসলিমরা পানি বলছে! 'পানি' যেমন আরবি-ফার্সি থেকে
উঠে আসা শব্দ নয়, 'বাবা'ও সংস্কৃতজাত শব্দ নয় এমনকি 'কাকা' শব্দও। এসব
একেবারে চরম অজ্ঞতা থেকে; এবং এর থেকে
দুঃখজনক ব্যাপার আর কী হতে পারে? এর থেকে বোঝা যায়
বাঙালিরা ভাষা-সংস্কৃত সচেতন নয়।
এই যে দুটো সমপ্রদায় কিছু
কিছু শব্দ নিজস্ব ধর্মগত শব্দ হিসেবে সযত্নে আলাদাভাবে ব্যবহার ও লালন করছে এই যে
স্বাতন্ত্রিক ভাষা-সাংস্কৃতিক জাত্যাভিমান এবং গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন যেটা উঠতে পারে
এসব আচরণের পেছনে কি কোনো সূক্ষ্ম সামপ্রদায়িক মনোভাব কাজ করে? আমি তা মনে করি না। সামপ্রদায়িকতার একটা সচেতন দিক আছে,
আর একটা অসচেতন দিক আছে। এসব হলো, না জেনে সামপ্রদায়িক মনোভাব লালন করা। জানেই না এরা যে,
ব্যাপারটা সামপ্রদায়িক হয়ে উঠছে। যেমন বাবা
হিন্দুরা বলে, জল হিন্দুরা বলে; সুতরাং আমি মুসলিম হলে বাবা এবং জল বলব না। আবার হিন্দুরা
ভাবছে, বাবা শব্দটা তাদের নিজস্ব
ধর্মগত শব্দ এবং পানি শব্দটা মুসলিমদের একচেটিয়া যা সম্পূর্ণ চরম অজ্ঞতাপ্রসূত।
যেমন আমি বলি এও এক হাস্যকর ব্যাপার অতি শিক্ষিত লোক, এতো শিক্ষিত, যাদের লেখা হরদম আমরা শ্রদ্ধার সঙ্গে পড়ছি এরকম একজন বিদ্বান সাংবাদিক আমার
আগের সহকর্মী হঠাৎ আমায় বলছেন 'বাশার, আপনাকে বাশারবাবু বলব নাকি বাশারসাহেব বলব? আমি বললাম দেখুন, 'বাবু'টাও ফার্সি 'সাহেব'টাও ফার্সি। কী
করবেন এবার ভেবে দেখুন।' বাবু শব্দের
ব্যুৎপত্তিগত অর্থ হলো'বু' মানে গন্ধ এবং 'বা' মানে সহিত; অর্থাৎ গন্ধের সহিত অর্থাৎ যে গন্ধ মাখে, সে-ই হচ্ছে 'বাবু'। সেজন্য কলকাতার
বাবু মানে হলো সুগন্ধিত হয়ে যে রাস্তায় বেরোয় তার থেকে বাবু, বাবু-সমপ্রদায়। বাবু সমপ্রদায় কলকাতায় জন্মেছিল তারা ছিল
জমিদার। জমিদারদের ভেতর থেকেই তথাকথিত অভিজাত হিন্দু জমিদারদের বাবু বলা হতো।
এভাবেই শিক্ষিত লোকেরা
তাদের অজ্ঞতা থেকে ভাষাটাকে যেমন মনে করছে_ ভাষাটা তা-ই হয়ে উঠছে। আর বাংলাভাষার সঙ্গে তো বটেই,
'বাংলা' শব্দের ভেতরেও ফার্সি আছে। আসলে বাংলার 'প্রাকৃত' রূপটা যখন গড়ে
উঠছে, তখনই আরবি-ফার্সি
শব্দসমূহ ঢুকে পড়েছে_ ঐতিহাসিক কারণেই ঢুকে
পড়েছে। ঢুকে পড়ে বাংলার মজ্জার মধ্যে আরবি-ফার্সি-তুর্কি শব্দ তাদের জায়গাটা দখল
করে নিয়েই বাংলার 'প্রাকৃত' অবয়বটা গঠন করেছে। অতএব, ইচ্ছেকৃতভাবে আরবি-ফার্সি একটা ভালো শব্দ কোনো লেখক ব্যবহার
করেন এবং তার মধ্যে যদি কেউ সামপ্রদায়িকতার গন্ধ খুঁজতে চেষ্টা করেন_ সেটা বড় ভুল হবে।
(কালের কণ্ঠের শুভযাত্রা
সংখ্যায় প্রকাশিত)
1 মন্তব্যসমূহ
সামাজিক ভাবে শব্দ ব্যবহারে ধর্মীয় কুসংস্কার দূরীকরনে এটি একটি মূল্যবান রচনা। লেখাটি পুনঃপ্রচার হলে ভালো হয়। বাশারদাকে অনুরোধ করছি সমাজের সাথে আরো বেশি সংপৃক্ত করে এই ধরনের বিষয় নিয়ে লেখার জন্য।
উত্তরমুছুন