চিতা

সৈয়দা আমিনা ফারহিন

তোমার মুখের আলো হারাচ্ছে  অভিমানে।  আমি একা একা ! কেটে নেয়া ফসলের মাঠে একা একা। ধানের কড়া শেকড়ে কাঁটা কাঁটা লাগছে। শক্ত মাটিতে এলেবেলে যাচ্ছি।  আমার চাঁদ মুখে অভিমানের মলিন ছায়া। কি যে মায়া ! দিগন্ত জুড়ে ভর করেছে আমাদের ভালবাসার কথা। বাতাস বলছে এসো, ফসলের মাঠ বলছে এসো। এসো না ! ঝিরিঝিরি পাহাড়ী ছড়া ডাকছে এসো।  এসো এই হিমজলে, ফসলের মাঠে, এসো দু'ঠোঁটের হাসিতে ।  এসো প্রিয়!!

দু'হাতে লাল নীল চাঁদর জড়িয়ে তাকিয়ে আছি এক পলকে। কি যে অভিমান!  এসো না উড়িয়ে দেই সব অভিমান।  তোমায় জড়িয়ে নেব দু'চোখের আকুলতায়।  এসো প্রাণভরে গাই গান, উড়ে চলি ফসলের মাঠে, পাহাড়ী নদীর মিষ্টি সুবাসে।

সাম্রাজ্যঃ "এদিকটায় এসো"

সাবজিন চুপচাপ কাছে আসে। পাশে বেগুণ ক্ষেত, সামনে পাহাড়ী ছড়া বেয়ে মিষ্টি পানির দেশ ।  গোধূলি লগ্নে চাঁদ উঠেছে।

সাবজিন মনে মনে ভাবেঃ "আমার চাঁদটার পাশে আকাশের চাঁদটা মনোযোগ কাড়ে না। চুপচাপ আমার চাঁদের পাশে হাঁটছি। ফসলের মাঠে কিছু কিছু ফসল কেঁটে নেয়া হয়েছে। আমিরুদ্দিন চাচার বাগানে সিমের বেগুণি ফুল ধরেছে সারি সারি। আমার ইচ্ছে করে বেগুণি শাড়িতে মন রাঙ্গাই। কখনো তো বললে না শাড়ি পরতে !  আমার সবচেয়ে পছন্দ রঙ্গিন তাঁতের শাড়ি। লাল টিপ, হাত ভরা কাচের চুড়ি, আলতা পায়ে রূপোর নূপুর, এলোচুল, নাকে ফুল।

ফসলের মাঠ ছেড়ে তুমি যাচ্ছ চলে। ইচ্ছে হয় তোমাকে জড়িয়ে রাখি। জড়িয়ে রাখি মমতায়। তুমি এগিয়ে গেলে চাঁদ উঠা সেগুণের বনে পাহাড়ী ঢালে। মনটা দৌড়ে তোমার কাছে।"

সাবজিনঃ "এই"

সাম্রাজ্য একটু একটু কথা বলে আবার চুপ হয়ে থাকে। একটা পাহাড়ী কাল ছাগল ওদের পথে এসে পড়ে। আমিরুদ্দিন চাচার দেয়া বেগুণের দিকে মুখ বাড়িয়ে দুষ্টু ছাগলটি। সাবজিন হাসতে হাসতে শেষ। সাম্রাজ্য এই পিচ্চি দুষ্টুর সাথে দুষ্টামীতে মেতে গেল। ছোট্ট ছাগল ছানাও পেছনের দু'পাতায় ভর করে সাম্রাজ্যের দিকে তাক করে লাফ দিল।

"এরে বাবা ! এর যে দেখি ভর ডর কিছু নেই" সাবজিন বলে উঠল।

সাম্রাজ্যঃ হুম, পাহাড়ী ছাগল খুব দুষ্টু হয়

সাবজিনঃ আমাদের বাড়িতে একটা ছোট্ট ছাগল লাগবে

সাম্রাজ্যঃ কাঠের ছোট্ট বাড়ি

সাবজিনঃ পাহাড়ে চাঁদ উঠবে

সাম্রাজ্যঃ আর পাহাড়ের পাশে ছোট্ট নদী

সাবজিনঃ বাড়ির পাশে ক্ষেত

সাম্রাজ্যঃ টমেটো, মরিচ, লেবু লাগাবো

সাবজিনঃ হাসনাহেনা, বেলী, তুলসী

সাম্রাজ্যঃ ওয়াইন রেড গোলাপ

সাবজিনঃ আর আমি জুম চাষ করব

সাম্রাজ্য হাসতে থাকে। আজ পাহাড়ে চাঁদ উঠেছে বিশাল। হিমেল হাওয়া বাড়তে থাকে। রাস্তার পাশে শুকনো পাতায় ছোট্ট বাঙ্গালী ছেলে আগুন জ্বালিয়ে তাপ পোহাচ্ছে। সেগুণের বনে চাঁদটা মায়াবী আভা ছড়ায় ঝিরিঝিরি পাহাড়ী ছড়ার উপর। সন্ধ্যে গড়িয়ে গড়িয়ে শীতের চাঁদর পরিয়ে দেয়। রাস্তায় পাশে নিচু জমি থেকে একটি ছেলে, একটি মেয়ে হাসতে হাসতে আসতে থাকে।

মেয়েঃ রাত নেমে আসছে

ছেলেঃ তাড়াতাড়ি নিচে যান


পাহাড়ী এলাকায় উপরে যাওয়া বলতে পর্বতে আরোহন, আর নিচে যাওয়া মানে পাহাড় থেকে নামা বোঝায়।


ওদের কথা সাবজিন বুঝতে না পেরে জিজ্ঞেস করেঃ কেন?

মেয়েঃ এখানে বিপদ আছে

সাবজিনঃ কি?

ছেলেঃ চিতা নামবে এখন

সাবজিন অবাক হয়ঃ এখানে চিতা?

মেয়েঃ একটু নিচেই মারমা চিতা। তাড়াতাড়ি রাত হবার আগেই নেমে পড়েন।

সাবজিনঃ মারমা চিতা?

সাম্রাজ্যঃ চিতা থাকতেও পারে। শুষ্ক পাহাড়। দু'পাশে ঘন জঙ্গল। সামনে জলাশয়ে চিতা নামতে পারে।

সাবজিনঃ কিন্তু এখানে আসবে কিভাবে? আচ্ছা, চিতা নামলে আমরা কি করব?

সাম্রাজ্যঃ তুমি দৌড় দিয়ে যেও। আমার কথা চিন্তা করো না।


সাবজিন মুখ উলটে হাঁটছে। কি বলে ছেলেটা !

সাম্রাজ্য বলতে থাকেঃ ট্র্যাকিং করে অভ্যস্ত আমি। কি করতে হয় জানি।

চাঁদটা আরো গাঁঢ় হলুদ হয়ে হাঁটছে ওদের সাথে। সাবজিন ভাবতে থাকে এমন সময় কালো ফোঁটা ফোঁটা চিতাবাঘ নামলে কেমন হবে। শিহরিত হচ্ছে। জঙ্গলের ফাঁকে ফাঁকে চাঁদটা আরো মোহনীয় লাগছে এসময়। একটা ছোট্ট কুড়ে ঘরে প্রদীপ জ্বলছে। কেউ হাটু গেরে মঙ্গল প্রার্থনায় অগ্নি উপাসনা করছে।  রহস্যময় পাহাড় দিয়ে ওরা হেঁটে গেল অনেকক্ষণ। একটু পরেই একটি মারমা গ্রাম।

মারমা বাচ্চারা হেসে হেসে রাস্তায় এসে পড়েছে। চাঁদটা মাথার উপর উঠে এসেছে। সাবজিন ওদের কাছে নিয়ে আদর করে দেয়।  চারপাশে মাচা করে মারমা ঘর। আগুণ জ্বালিয়ে শিশু, বয়োবৃদ্ধ তাপ পোহাচ্ছে। বড় বড় রাম দা, ছুরিতে আগুনের প্রতিফলন হচ্ছে। পাহাড়ী ঝরণার পানি জমে বড় জলাশয়ে দ্বীপ জালিয়ে পূজো দেয়া হয়েছে কিছুক্ষণ। একটা মারমা পুরূষের হাতে ফিলিপসের অনেক পুরোনো ব্যান্ডের রেডিওতে জোড়ে জোড়ে বাংলা গান চলছে। এমন পুরোনো ব্র্যান্ডের রেডিও আগে দেখেছে বলে মনে পড়ছে না। লোকটা ওদের পাশে দাঁড়িয়ে আছে। মারমা শিশুরা সাবজিনের চারপাশে গোল করে দাঁড়িয়ে হাসছে। ও গাল টিপে দেয় শিশুদের।  শিশুরা দল বেঁধে হাসছে, খেলছে। আধাঁর ঘনিয়ে আসছে।  মারমা শিশুদের বিদায় জানিয়ে  ওরা নেমে পড়ে আরো নিচে। পথে মারমা মাচা ঘরে মাটির মট, হাড়ি দেখে চিতার কথা মনে পড়ল। সামনের উঁচুনিচু পাহাড়ী পথে কোন বাড়িঘর নেই। একপাশে উঁচু পাহাড়, অন্যদিকে পাহাড়ী ঝরণার পানি জমে বড় জলাশয়। উঁচু পাহাড় থেকে অন্ধকারে বন্য প্রাণী নেমে আসে কি? সাবজিন সাম্রাজ্যের হাত চেপে ধরে। পেছন থেকে গান ভেসে আসছে। পুরোনো ব্র্যান্ডের ফিলিপস রেডিও থেকে। পাহাড়ের ফাকে কখনো চাঁদটা আড়াল করে দাড়িয়েছে।

সাবজিনঃ দেখো, মারমা গ্রামের সেই লোকটা

সাম্রাজ্যঃ তাতে কি হয়েছে?

সাবজিনঃ লোকটা খুব তাড়াতাড়ি আসছে এদিকে

সাম্রাজ্যঃ হুম

সাবজিনঃ মারমা চিতা মানে কি?

সাম্রাজ্যঃ ভয় পাচ্ছ?

সাবজিনঃ মারমা চিতা কি কোন বন্য প্রাণী?

পাহাড়ের বাকে রেডিওর আওয়াজটা ক্ষীণ হতে থাকে। পাহাড়ী নিচু বাঁক থেকে উপরের দিকে উঠলে নিচের দিকের আওয়াজ ক্ষীণ হয়ে যায়। ওরা দ্রুত পায়ে হাঁটছে। একটু পর রেডিওর আওয়াজ আবার বাড়তে থাকে। পাশের উচু পাহাড়ের ছায়ায় চাঁদ দেখা যাচ্ছে না। একটা জনমানবহীন কাঠের নির্মানাধীন গীর্জা ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। পেছনে রেডিও আওয়াজটা দ্রুত আসছে। সাবজিন তাকিয়ে আছে ওদিকটায়। হঠাৎ একটা বিশাল আলোর ছটা !

একটা ট্রাক এগিয়ে এল। পাহাড়ের নিচের বাঁকে থাকায় ওর আওয়াজ কানে আসেনি। ট্রাকটি সাম্রাজ্য সাবজিনকে পাশ কাটিয়ে চলে গেল। পেছন থেকে রেডিওর আওয়াজটা একদম কাছেই চলে আসছে। সাবজিনের ভয় লাগছে। এই লোকটিই  কি মারমা চিতা? সাবজিনের হাত অবশ হয়ে আসছে। সাম্রাজ্য অনেক বিপদেও মাথা ঠান্ডা রাখতে পারে। সাবজিনকে সামনে এগিয়ে যেতে বলল সে।

"বরই নিবেন?" সামনে ঝুড়ি মাথায় একটা ছোট ছেলে বলে উঠল।

সাবজিন সম্বিত ফিরে পেল। ওরা লোকালয়ে চলে এসেছে।  সাবজিন বললঃ না বাবু। আজকে না অন্যদিন।


পেছন থেকে ফিলিপসের পুরোনো ব্র্যান্ডের রেডিওর আওয়াজটা অন্ধকারে থেমে গিয়েছে। 


-----------------------------------------------------------------------------------------------------------

লেখক পরিচিতি

সৈয়দা আমিনা ফারহিন

বেড়ে ওঠা চট্টগ্রামে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইনে এল এল. বি. (স্নাতক) এবং এল এল. এম. ।
অন্তর্জালে লেখেন। ছবি তোলেন। 

বর্তমান নিবাসঃ বান্দরবান।
বিচার বিভাগে কর্মরত।

-----------------------------------------------------------------------------------------------------------

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

7 মন্তব্যসমূহ

  1. অনেক সুন্দর আর ব্যতিক্রমী লেখা। ভাল লাগলো অনেক।

    উত্তরমুছুন
  2. মৃত্যু ছাড়া কোনো পরিচিত হারিয়ে যেতে পারে না। তাই না?

    উত্তরমুছুন
  3. ভালো থাকুন, ফারহিন। ভালো থাকুন, প্রকৃতি।

    উত্তরমুছুন
  4. আমারও শুভ কামনার জন্যে আপনাকে অসংখ্য কৃতজ্ঞতা। আশা করি একদিন খুলে যাবে লৌহযবনিকা।

    উত্তরমুছুন