আকাশপাঠ

আকাশ লীনা

পাখি জীবনেও যে অবসাদ থাকে , এখানে না এলে জানতাম না 

জীবনানন্দ দাশ আমার প্রিয় কবি । তাকে নিয়ে ৩/৪টি ঘটনা বলি । অনেকেই জানেন । তবু যারা জানেন না তাদের জন্য বলা । কারণ আছে বলার । কারণ পরে বলছি ।


ঘটনা .এক) জীবনানন্দ দাশ যেদিন মারা গেলেন সেদিন তার বাসায় বু™ব্দদেব বসু সহ সহ অনেক লেখকের ভীড়। জীবনানন্দের ওয়াইফ বুদ্ধদেব বসুকে বলেছিলেন , ‘এত লোকের ভীড় । তার সাথে এতবছর ঘর করলাম, জানতামই না তিনি এত বড়ো কবি ।

ঘটনা, দুই ) জীবনানন্দ যে বাসায় ভাড়া থাকতেন সে বাসার ভাড়া অনেক জমেছে । তিনমাস দিতে পারেননি । একদিন বাড়িওয়ালা ডেকে খুব বাজে আচরণ করলেন । কবি মন খারাপ করে একটি চায়ের দোকানে গিয়ে বসেছিলেন । সেপথে কবি দীপেন বন্দ্যোপাধ্যায় যাচ্ছিলেন । দীপেন ছিলেন একটি ড্যাশিং টাইপের । জীবনানন্দকে মন খারাপ দেখে বসে থাকতে দেখে জানতে চাইলেন কারণ । জীবনানন্দ বললেন । কবি দীপেন বললেন , ‘ আমি তোমার বাড়িওয়ালাকে খুব ধমকে দিবো । গালি দিব । তবে এজন্য ভাড়া বাবদ আমাকে ২০ টাকা দিতে হবে । রাজী আছো ?’ জীবনানন্দ রাজি হলেন ।

ঘটনা, তিন ) জীবনানন্দকে একদিন তার পরিচিত এক লোক দেখেন তিনি ঘাস বিছানো একটি নিরিবিলি পথে কান পেতে শুয়ে আছেন । রাত । সেই পরিচিত লোক কাছে গিয়ে জানতে চান কী হয়েছে ? জীবনানন্দ বলেছিলেন, ‘এপথেই তো মনে হয় , হরপ্টপ্পায় ঘোড়ার দল ছুটে গিয়েছিল । তাদের ছুটে যাওয়া শুনছি ।

এবার কারণ বলি ।

অমর দাশ আমাদের সাথে পড়ত । কবিতা লিখত । কবিখ্যাতি পায়নি । তাকে নিয়ে তিনটি ঘটনা বলি এবার ।

ঘটনা , এক ) একদিন আমায় বলল , ‘আমার কবিতা লিখা হবে না । কারণ জানতে চাইলে বলল , ‘লিখতে গেলেই মনে হয় , সবার যে কবিতার ভাষা সেটি আমারও হলে আমার আর লিখে কী হবে ? মনে হয় , কোনো না কোনো মতবাদ আমার কবিতায় ভর করে । আসলে মতবাদ জানানোর জন্য তো আমি কবি হতে চাই না ।’ এরপর কবিতা লিখা ছেড়ে দিল ।

ঘটনা ,দুই ) দার্জিলিং বেড়াতে গিয়েছি । দুপুরবেলা বিগবাজার থেকে শপিং করে হোটেলে ফিরবার আগে একটু বিয়ার খেতে সাধ জাগলো । এক বারে ঢুকলাম । দেখি ওই বারের ওয়েটার অমর । রীতিমত যেন ভুত দেখলাম । ওখানে একটি পাহাড়ি মেয়ে বিয়ে করেছে । থাকে ‘ঘুম’ রেল ইসটিশনের পাশেই । নিয়ে গেল তার বাসায় । ওই রাত তার বাসায় থাকলাম । তার ওয়াইফের নাম মুরিরি । গান শোনাল । মমো ( দার্জিলিং এর একটি বিশেষ খাবার আইটেম ) খাওয়ালো । আর ওড়িয়া নাচ দেখাল । বাসার সামনে পাহাড়ের ঢাল । ভরা জোছনা । মুরিরি নাচছে । অমর দোচোয়ানি ( ওখানকার মদ ) গিলছে । আমি দেখছি আর ভাবছি , বেশ আছে আমাদের অমর ।
পরদিন বিদায়ের সময় বললাম , ‘ বেশ আছিস অমর ।
বলল , ‘ এসবই পানসে । কবিতা ঘুরে আজো মাথায় । পারি না রে লিখতে । আসলে পড়াশনা করে ভুল করে ফেলেছি । এখন সুযোগ পেলে আর পড়তাম না ।
জানতে চাইলাম , পড়াশুনা আবার দোষ করল কোথায় ?
বলল , আমাদের পড়াশুনা কলোনিয়াল মনোজগত তৈরি করে ফেলে । এ ফাঁদ থেকে বেরুতে পারছি না ।

ঘটনা ,তিন ) ভেবেছিলাম এরপর আর অমরের সাথে দেখা হবে না । হলো । হাফলং থেকে শিলচর যাবার পথে জাটিংগা নামের একটি জায়গা আছে । ওখানে বরষাকালে পাখিরা ঝাঁকে ঝাঁকে সুইসাইড করে । কারণ অজানা । আমি এক বরষাকালে গিয়েছিলাম । ওখানে দেখি ‘ম্যাটাং ” ( কাঠের তৈরি একধরণের উঁচু পিড়ি , বসার জন্য তৈরি) ফেরি করছে অমর । যারা দেখতে যায় তাদের কাছে গিয়ে বলে , ‘বসে আরাম করে দেখেন । ম্যাটাং আছে । নিবেন ? 


অমর জানালো মুরিরির সাথে তার ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে । জাটিংগা এলাকাতেই থাকে । পাখিদের দেখে । পাখির পালক জমিয়ে রাখে । হাত বুলোয় । কতো হালকা । অখচ সুইসাইডের আগে তাদের ডানা ঝাপটানো কতো যে ভারী এটা দেখতে দেখতে পাখিদের ওপর তার মায়া পড়ে গেছে । আর কোথাও যাবে না অবসাদের পাখিদের ফেলেদ।


সেই শেষ দেখা অমরের সাথে । আবার হয়তো হবে । হয়তো না । পুরো লাইন গুলো ঠিকভাবে মনে পড়ছে না , এমন না লাইনগুলো , ‘সব পাখি ঘরে ফিরে-----------থাকে শুধু অল্পব্দকার মুখোমুখি বসিবার বনলতা সেন । ’
এই লাইনগুলো বিদায়বেলা অমর শুনিয়েছিল আর হাসতে হাসতে বলেছিল , ‘লীনা , পাখি জীবনেও যে অবসাদ থাকে , এখানে না এলে জানতাম না ।’


------------------------------------------------------------------------------------

লেখক পরিচিতি
আকাশ লীনা
কবি। গদ্যকার। 
ফ্রি ল্যান্স সাংবাদিক। ব্লগার।




-------------------------------------------------------------------------------------

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ