রিজিয়া রহমান লেখার প্রধান উপজীব্য অন্ত্যজ মানুষের
জীবন, তাদের দুঃখ-বেদনা, জীবনসংগ্রাম এবং জীবনরস।
তার অনুসন্ধানী অন্তর্ভেদী দৃষ্টিতে উঠে এসেছে মানুষের জীবন, বেঁচে থাকার নিগূঢ়তম সত্য-সৌন্দর্য এবং বিচিত্রতা।
রিজিয়া রহমানের অভিজ্ঞতার ভান্ডার বিশাল, ব্যাপক ও
বৈচিত্র্যময়। শেকড়সন্ধানী তিনি। বাঙালির ইতিহাস, জাতিসত্তা,
জাতিসত্তার জাগরণ, বাঙালির জাতিসত্তা
গঠনের বিবর্তন, ইতিহাস যুদ্ধ, ভাষা,
চেতনা ইত্যাদি তার উপন্যাসে যেমন এসেছে ইতিহাসিক শুদ্ধতায় তেমনি
হƒদয়ের ভাষা হয়ে।
রিজিয়া রহমানের উপন্যাস ও লেখালেখির জগৎ বিচিত্র, বিবিধ ও
বহুমাত্রিক। নিজেকে কোনো গণ্ডির মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখেননি তিনি। বাস্তবের পোড়া মাটি
থেকে যেমন তুলে এনেছেন জীবন, যেমনি এঁকেছেন প্রেম,
প্রত্যয় আর প্রতারিত জীবনের জলছবি। তেমনি তার হাত থেকেই আবার
বেরিয়ে এসেছে শিশুর জন্য ছড়া কিশোরের জন্য উপন্যাস আর রম্য রচনা।
মাটি আর মানুষের কথা বলতে গিয়ে রিজিয়া রহমানের কলম
এঁকেছে জীবনের রক্তাক্ত ছবি। তার রক্তের অক্ষর এক অসাধারণ উপন্যাস। তার
উল্লেখযোগ্য ও আলোচিত উপন্যাসগুলো হলো: একাল, চিরকাল, বং থেকে বাংলা,
শিলায় শিলায় আগুন, অলিখিত উপ্যাখ্যান
ইত্যাদি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে এমএ এই লেখক সামান্য কিছুদিন
অধ্যাপনার পর জীবনের পুরোটাই ঢেলে দিয়েছেন সাহিত্যসেবায়। একনিষ্ঠভাবে শুধু
সাহিত্য আর জ্ঞানের চর্চা করে গেছেন। সাহিত্যকর্মের
স্বীকৃতিস্বরূপ বাংলা একাডেমী পুরস্কারসহ পেয়েছেন অসংখ্য পুরস্কার। তার
উল্লেখযোগ্য পুরস্কার হচ্ছে যশোর সাহিত্য পরিষদ পুরস্কার, হুমায়ুন কাদির স্মৃতি পুরস্কার, আসাফউদদৌলা
রেজা স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার, বাংলাদেশ লেখিকা সংঘ
সাহিত্য পুরস্কার, কমর মুস্তরী সাহিত্য পুরস্কার, অনন্যা সাহিত্য পুরস্কার, জসীমউদ্দীন সাহিত্য
পরিষদ পুরস্কার, নাসিরউদ্দিন স্বর্ণপদক ইত্যাদি।
রিজিয়া রহমান অনেকটাই প্রচারবিমুখ ও নিভৃতচারী।
ভালোবাসেন নিজের লেখার জগৎ নিয়ে থাকতেই। বাংলা সাহিত্যেও এই শক্তিমান লেখক
উত্তরার বাড়িতে এখন একাই থাকেন। তার পরও তিনি একা নন। আছে তার সৃষ্টির সুরোভিত
জগৎ আর স্রষ্টার সঙ্গে অনুভব করেন একাÍতা আর গভীর ভালোবাসার এক সম্পর্ক। সাক্ষাৎকার
নিয়েছেন কবি ও কথাশিল্পী নূর কামরুন নাহার
সাপ্তাহিক কাগজ : আপনার শৈশব নিয়ে কিছু বলুন। আপনার
বেড়ে ওঠা কেমন ছিল?
রিজিয়া রহমান : কলকাতার ভবানীপুরে আমার জন্ম। আমার
একেবারে শৈশব তাই কলকাতায় কেটেছে। তারপর বাবা বদলি হয়ে ফরিদপুরে আসেন। সেখানেই
আমার শৈশবের বেশ খানিকটা এবং কৈশোর কাটে।
বাবার বাড়ি পশ্চিমবঙ্গে হলেও আমার মায়ের বাড়ি ঢাকা
জেলার পদ্মা নদীর পারে। পদ্মা নদীর পারের মানুষ এবং জীবনের সঙ্গেও তাই আমার অন্য
রকম একটা জানাশোনা। একজন সৃষ্টিশীল মানুষের বেড়ে ওঠা তো অবশ্যই একটা গুরুত্বপূর্ণ
বিষয়। যে বিষয়টা আমার মনে হয়, আমাদের এ দেশ নদীর দেশ। এ দেশের পঞ্চাশোর্ধ্ব
প্রায় প্রতিটি মানুষেরই নদীর সঙ্গে একধরনের যোগাযোগ রয়েছে। আমার লেখালেখিতেও
পদ্মাপারের মানুষ এসেছে। তাদের জীবন নিয়ে আমি অনেক গল্প লিখেছি।
কাগজ : নদী নিরবধি নামে আপনার একটি আÍজৈবনিক লেখা
বের হয়েছে। ওখানে আপনি আপনার জীবনী তুলে ধরেছেন। তা আপনার শৈশব এবং কৈশোর আপনার
লেখালেখিতে কী রকম ভূমিকা রেখেছে?
রিজিয়া : প্রকৃত অর্থে আমার শৈশব-কৈশোর আমার
লেখালেখিতে খুব বেশি আসেনি এবং ওইভাবে খুব প্রভাবও রাখেনি। আমার ছোটগল্প উপন্যাসে
খুব বেশি আমি নেই। আÍজীবনীতেই আমি এত দিন পরে আমার কৈশোর এবং শৈশব এবং আমার জীবনী নিয়ে
লিখলাম যা সাহিত্য হিসেবেই আমি লিখেছি এবং সেভাবেই তা প্রকাশিত হয়েছে।
কাগজ : সাধারণত প্রায় লেখকই তার লেখায় থাকেন। আপনার
লেখালেখিতে আপনার উপস্থিতি কম কেন?
রিজিয়া : লেখক তো কোনো না কোনোভাবে তার লেখার মধ্যে
থাকেনই। তবে আমি আমার লেখায় খুব বেশি নেই। এর একটা কারণ হচ্ছে, আমার
গল্প-উপন্যাসের অধিকাংশ মানুষেরাই সমাজের প্রান্তিক মানুষ। সমাজের এই নিু শ্রেণীর
সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা, তাদের
বেঁচে থাকার সংগ্রাম আমার লেখার অন্যতম বিষয়। শ্রেণী বিচারে আমি মধ্যবিত্ত
শ্রেণীভুক্ত। আমাকে আমি তাদের জীবনের ভেতর প্রতিস্থাপন করতে পারিনি। তাই আমার
লেখায় মনে হয়েছে আমার উপস্থিতি কম।
কাগজ : লেখালেখি শুরু করেন কিসের মাধ্যমে?
রিজিয়া : আমার লেখালেখি শুরু হয় কবিতা দিয়ে।
কাগজ : আপনার আলোচিত উপন্যাসের নাম রক্তের অক্ষর।
দেহপসারিণীদের নিয়ে আপনি এ উপন্যাসটি লিখেছেন সম্ভবত ১৯৭৭ সালে। আপনার এ
উপন্যাসটি প্রথম বিচিত্রায় প্রকাশিত হয়। ওই সময় আপনি এ রকম একটি উপন্যাস লেখার
কথা কেন চিন্তা করলেন?
রিজিয়া : আমার এ উপন্যাস নিয়ে বহু পাঠক কৌতূহলী
হয়েছে। নানাভাবে আমার কাছে জানতে চেয়েছে, বহু পাঠক টেলিফোন করেছে, পত্রিকায়ও লেখা হয়েছে। এ রকম একটি উপন্যাস লেখার প্রেরণা নিয়ে।
সাপ্তাহিক পত্রিকা বিচিত্রায় তাদের ওপর জরিপ করা হয়েছিল এবং জরিপের ভিত্তিতে
প্রচ্ছদ প্রতিবেদন ছাপা হয়েছিল। সে প্রতিবেদনে তাদের মানবেতর জীবনের যে রিপোর্ট
হয়েছিল, সেখান থেকেই আমি এটি লেখার প্রেরণা পাই। মূলত
তাদের মানবেতর জীবন আমাকে খুব আন্দোলিত করেছিল।
কাগজ : আপনি যখন উপন্যাসটি লিখেছেন তখন তাদের জীবন
যেমন ছিল, এখনো তাদের জীবন তা-ই আছে। তাদের এই জীবন ধুঁকে ধঁকে বেঁচে থাকা অথবা
ধুঁকে ধুঁকে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাওয়া-- তা থেকেও তাদের
কোনো উত্তরণ ঘটেনি।
রিজিয়া : এটা একদম সত্যি বলেছ। আমাদের অনেক কিছুরই
পরিবর্তন হয়েছে কিন্তু তাদের মানবেতর জীবন শেষ হয়নি। কোনো দিন হবে কি না, তা-ও বলা যায়
না।
কাগজ : এ ধরনের একটা বিশেষ পেশাজীবী শ্রেণী বা যদি
বলি অন্য রকম জীবিকার মানুষদের নিয়ে লিখতে গিয়ে আপনাকে নিশ্চয় তাদের জীবন, বেঁচে থাকা,
দিনযাপন-- এগুলোকে খুব ঘনিষ্ঠভাবে দেখতে
হয়েছে, জানতে হয়েছে।
রিজিয়া : তা তো অবশ্যই। তবে আমি তাদের জীবনকে ওইভাবে
দেখার সুযোগ পাইনি। তখনকার দিনে এখনকার মতো সবকিছু এত সহজ ছিল না। সমাজ আরও
রক্ষণশীল ছিল, আমার বয়সও তখন কম ছিল। তাই আমি ওদের জীবন দেখার জন্য যেতে পারিনি। তবে
আমাকে ওদের সম্পর্কে জানতে হয়েছে। জানাটা নানাভাবেই আমি করেছি। বিভিন্নভাবে
তথ্য-উপাত্ত নিয়েছি। চরিত্র তৈরি করা বা সেট তৈরি করার জন্য অনেক তথ্য যেমন
নিয়েছি, তেমনি চিন্তাও করেছি। আর লেখকদের লেখক ইনটুইশন
থাকে, সেখান থেকে লেখক কিছু গ্রহণ করে বাস্তবের সঙ্গে
লেখকের ইনটুইশন অনেক মিলে যায় । আমি বলব না সব সময় সেটা একবারে ঠিক হয় অথবা
বাস্তবের সঙ্গে মিলে যায়, তবে কখনো কখনো সেটা অনেকটাই
মিলে যায়। আমার ক্ষেত্রে সেটা হয়েছে। আমি ওদের জীবন এঁকেছি, তা মিলে গেছে।
কাগজ : তা ছাড়া একধরনের চিত্রকল্প তো লেখক তৈরি
করেই থাকেন। আর লেখক তো এই চিত্রকল্পের মাধ্যমেই সৃষ্টি করেন।
রিজিয়া : সেটা তো অবশ্যই। তবে এই চিত্রকল্প বা
ভিজ্যুয়ালাইজেশন ভিত্তিহীন নয়। এটা বাস্তব থেকেই গ্রহণ করতে হয়, যেটা আমিও
করেছিলাম। আর আমি এ জন্য তাদের অনেক ছবি নিয়েছিলাম ফটোজার্নালিস্টের কাছ থেকে।
তিনি বেশ বড় বড় করে আমাকে অনেক ছবি এনে দিয়েছিলেন। তারপর আমি তাদের সম্পর্কে
বিস্তারিত জেনেছি। তারা কীভাবে থাকে, কীভাবে গল্প করে,
কী ধরনের শব্দ ব্যবহার করে, সেখানে থেকে
চিত্র তৈরি করি।
কাগজ : আপনার রক্তের অক্ষর উপন্যাসের কেন্দ্রীয়
চরিত্র ইয়াসমিন। এ ইয়াসমিনকে কি আপনি দেখেছেন, নাকি এটিও আপনার চিত্রকল্প?
রিজিয়া : না, ইয়াসমিনকে আমি দেখিনি। তবে এটা আমার কোনো
কল্পনার চরিত্র নয়, যিনি আমাকে ছবি দিয়েছিলেন সে-ই
আমাকে এমন একজনের তথ্য দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ওখানে
এমন একজন মেয়েকে আমি দেখেছি যে শিক্ষিত, চিন্তাভাবনাগুলো
অন্য রকম, একেবারে আপনাদের মতো। তার ওই রকম বর্ণনার ওপর
ভিত্তি করেই আমি চরিত্রটা সৃষ্টি করেছিলাম।
কাগজ : ইয়াসমিন যা চেয়েছিল উপন্যাসে তা হয়নি।
অর্থাৎ ইয়াসমিনদের জয় হয়নি, বরং শেষ পর্যন্ত জীবন দিয়ে রক্তের অক্ষর তৈরি
করতে হয়েছে। আপনি এ রকম একটা সমাপ্তির দিকে উপন্যাসটিকে নিয়ে গেলেন কেন? সেটা কি এই যে আসলে শেষ পর্যন্ত আমরা এসব দলিত মানুষের জয় বাস্তবে
দেখি না সে জন্যই…
রিজিয়া : আমি উপন্যাসে জয়ও দেখাইনি, পরাজয়ও
দেখাইনি। আমি মানবিকতার বিষয়টি দেখাতে চেয়েছি। চেয়েছি আমাদের বোধে একটা ধাক্কা দেওয়ার।
এ উপন্যাসটি যখন আমি লিখি তখন নারীবাদ বিষয়টি বা নারীর অধিকারগুলো ওভাবে আমাদের
সাহিত্য আসেনি। আমি তাই উপন্যাসের শেষে ব্রান ফ্রি বিট…
এটার মাধ্যমে তাদের বন্দিত্বের কথা বলেছি এই যে জীবন এত করুণ এবং
এই বন্দিত্ব এটা কেন? মানুষ হিসেবে তাদের মুক্তির কথা বলতে
চেয়েছি।
কাগজ : আপনার আরও একটা আলোচিত উপন্যাস বং থেকে বাংলা, যেখানে আমরা
জাতিসত্তার বিকাশ দেখি। আমাদের এ ভূখণ্ড, ভাষা এটা নিয়ে
আপনার এ উপন্যাসে আপনি কিছু…
রিজিয়া : বং থেকে বাংলায় আমি আমাদের জাতিসত্তার কথা
বলতে চেয়েছি। জাতি তৈরিতে ভাষা বড় ভূমিকা রাখে। ভাষাই আমাদের জাতিসত্তার প্রধান
উপাদান। ভূখণ্ডের কারণে আজ আমরা আলাদা হলেও আমাদের জাতিসত্তা এক। ভূখণ্ড ভাগ হলেও
ভাষাকে ভাগ করা যায়নি।
বাংলাদেশেই বাংলা ভাষার জন্ম হয়েছে। আমরাই হচ্ছি এর
উৎসভূমি।
প্রধান নদীর যেমন কতগুলো শাখা-প্রশাখা থাকে, তেমনি
পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা, আসাম--
এরা কিন্তু আমাদের শাখা। বাংলা ভাষার জন্ম হয়েছে তৎসম, তদ্ভব, অর্ধতৎসম, ফরাসি
ও ইংরেজি ভাষা থেকে। আমরাই বাংলা ভাষা তৈরি করেছি। বং থেকে বাংলা উপন্যাসে আমি
সেটাই এনেছি। একটি জাতিসত্তা তৈরি এবং একটি জাতিগঠনের প্রক্রিয়াটা এক দিনের নয়,
বহু বছরের। আড়াই শ বছর লেগেছে আমাদের এই জাতিসত্তা গঠনে।
কাগজ : একাল চিরকাল উপন্যাসে আপনি সাঁওতালদের
জীবনচিত্র এঁকেছেন। এটিও কি আপনি তাদের সম্পর্কে তথ্য জেনে করেছেন, নাকি আপনি
সাঁওতালদের জীবনকে কাছ থেকে দেখেছেন?
রিজিয়া : সাঁওতালদের আমি কাছ থেকে দেখেছি। যদিও আমি
একবারে তাদের সঙ্গে বাস করিনি, তবে তাদের দেখার সুযোগ আমার হয়েছে। আমার
স্বামী ছিলেন মাইন জিওলজিস্ট। পেট্রোবাংলায় তিনি কাজ করতেন। বড়পুকুরিয়ার কয়লার
খনির বিষয়ে তিনি সেখানকার গবেষণা ও পরীক্ষা-নিরীক্ষার কাজ করছিলেন। তখন প্রায়ই
ওই এলাকায় যেতেন। সঙ্গে আমিও যেতাম। তাদের দেখতে দেখতেই আমার এ রকম একটি উপন্যাস
লেখার ইচ্ছে করে।
ওই সময় যখন খনি থেকে কয়লা ওঠানোর জন্য নানা রকম
পরিকল্পনা হচ্ছে। সবকিছু একবারে চূড়ান্ত পর্যায়ে, মাইন তৈরি করা হয়েছে। তখন আমার
হাজব্যান্ড খুব ব্যস্ত থাকত। রেস্টহাউজ থেকে আমি একা একাই ঘুরতে চলে যেতাম। সে রকম
এক দিনে এক সাঁওতাল মহিলা আমাকে প্রশ্ন করেছিল। তোমাদের এই খনি থেকে কী উঠবে?
তাতে কি ভাত উঠবে? এই একটা প্রশ্ন তীরের
মতো আমাকে বিদ্ধ করেছিল। সাঁওতাল যথেষ্ট সরল এবং বঞ্চিত ছিল। এই আদিবাসীদের জীবন
তাদের বঞ্চনা এবং তাদের জীবনে ভাতই যে প্রধান বিষয় ও চাহিদা, এ ধারণা থেকেই আমি উপন্যাসটি লেখার প্রেরণা পাই।
কাগজ : ওখানে তো আপনি তাদের বিবর্তনকেও এঁকেছেন। এই
যে আদিবাসী তাদের বদলে যাওয়া জীবন, শিকারি থেকে কৃষক, তারপর
আবার শ্রমজীবী মানুষ কিন্তু তার পরেও তাদের ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন আমরা দেখি না।
আর এভাবেই বোধ হয় বঞ্চিত মানুষের ইতিহাস লেখা হয় অথবা বঞ্চিত মানুষের ইতিহাস বোধ
হয় এটাই।
রিজিয়া : মানুষের তো বিবর্তন ঘটেই। সবারই বিবর্তন
হয় আমাদের কি হয়নি,
হয়েছে। সাঁওতালরা শিকারি ছিল। তারপর তাদের কৃষিকাজ করতে হয়েছে।
শেষ পর্যন্ত তারা খনির শ্রমিক হয়ে উঠল, সেটা আমি আঁকতে
চেয়েছি। ওই উপন্যাসের শেষে একটা গান আছে। গানের কথার মূলটাই হচ্ছে যে তাদের
ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন হয় না।
ওখানে আমি একটা বিহার দেখেছিলাম। তারা বলে, ওখানে সোনার
মূর্তি পাওয়া গেছে। ওটার ব্যাখ্যাও আমি বইতে দিয়ে দিয়েছি। রথে চড়ে রাজা
যাচ্ছেন এবং তার মানে হচ্ছে, সব সময় তারা কারও না কারও
মাধ্যমে শোষিত হয়েছে। রাজা রথে চড়ে যান আর প্রজারা কিন্তু নিগৃহীতই থাকে। সাধারণ
মানুষের ভাগ্য বদলায় না। পৃথিবীর ইতিহাস চিরকালই এই একদল ভোগ করে, আরেক দল বঞ্চিত থাকে।
কাগজ : এই বঞ্চনার অবসান হয়তো হয় না কিন্তু কখনো
কখনো সাধারণ মানুষ জেগে তো উঠে বিপ্লব ঘটায়, শোষণ থেকে মুক্তির স্বপ্ন দেখে সে রকম
বিষয়গুলো কীভাবে আপনার লেখায় এনেছেন?
রিজিয়া : বঞ্চনার অবসান কি সেভাবে আমরা দেখি? পরিবর্তন হয়
তবে খুব ধীরে। শিলায় শিলায় আগুনে আমি যা লিখেছিলাম, পাকিস্তানের
কিন্তু তার থেকে কোনো উত্তরণ ঘটেনি। এখনো কিন্তু তারা সেই মারামারি করেই যাচ্ছে।
আমাদের অবস্থার পরিবর্তন প্রয়োজন। বঞ্চনা থেকে
মুক্তি আবশ্যক, সে রকম একটি বিষয় আমি বাঘবন্দী উপন্যাসে আনতে চেয়েছি। উপন্যাসটি ২০০৪
সালে বের হয়েছিল। কাহিনিটা হলো, সুন্দরবনের গ্রামাঞ্চলে
একটি বাঘ এসেছে। বিভিন্নজন বিভিন্নভাবে বাঘটি দেখে এবং একেকজন একেকভাবে বাঘটির
বর্ণনা করে। উপন্যাসে ছোট একটি মেয়ে আছে। ওর বাবাকে বাঘ ধরে নিয়ে যায়। ওর
বোনকেও বাঘ ধরে নিয়ে যায়। আসলে বোনটিকে অপহরণ করা হয়। পরে সে বানিশান্তায়
গিয়ে বারবনিতা হয়ে যায়। মেয়েটা গরিব, চেয়েচিন্তে
খায়। এ সমাজ এভাবে খুঁজে খাওয়াকে মেনে নিতে পারে না। সে ছোট শিশু। তবু কেউ কেউ
তাকে বলে, যা তোর বোনের কাছে যা। ছিনাল হবি। সেভাবে ছিনাল
হলে হয়তো খাবার পাওয়া যায়। সে তার মাকে বলে, চল,
আমরা ছিনাল হয়ে যাই। এ কথা শুনে মা তাকে খুব মারে।
সে তখন রাতে বাইরে বসে কাঁদে। এমন সময় বাঘটা আসে।
চাঁদের আলোয় একটা রেখাকে তার কাছে মনে হয় বাঘ, সে ভয় পায় না। বাঘটা দেখে ওর
খুব পছন্দ হয়। সে তখন বলতে থাকে, আমি ছিনাল হতে
চেয়েছিলাম। আর মা আমাকে মেরেছে। তুই আমাকে খেয়ে ফেল। মা রাতে উঠে দেখে, তার মেয়ে বাঘের সঙ্গে খেলছে আর এসব কথা বলছে। তখন সে লোকজনকে জাগিয়ে
তোলে আর চিৎকার করে বলে, আমার ফুলরানী বাঘকে বন্দী করেছে।
কাগজ : এই বাঘপ্রতীকের মধ্য দিয়ে আপনি আসলে কী
বোঝাতে চাইলেন?
রিজিয়া : বাঘ এখানে মানুষের মনের মধ্যে যে ভয়, তার একটা
প্রতীক।
মানুষ নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে বসবাস করছে। প্রতি
পদক্ষেপে ভয় নিয়ে বসবাস করছে। যখন দেশ অরক্ষিত হয়। তখন মানুষ প্রতিনিয়ত ভয়
পায়। তার মধ্যে শঙ্কা কাজ করে। সে ভয় নানা প্রকার নিঃস্ব হওয়ার ভয়, ভাত না থাকার
ভয়। মৌলবাদীদের ভয় ইত্যানি নানা ভয়। এসব বিষয়ই মানুষ নানাভাবে দেখে আর সেটাই
বাঘ হয়ে এসে মানুষকে খেয়ে ফেলার ভয়ে ভীত করে ফেলে।
কাগজ : এটা থেকে উত্তরণটা আপনি কীভাবে দেখালেন?
রিজিয়া : ঠিক উত্তরণ নয়। তবে ওর মা মনে করেছে, বাঘ বন্দী
হয়েছে। আমরা আশা করি, আমাদের ভয়টা দূর হবে। দুঃশাসন
যন্ত্রণা, নিরাপত্তাহীনতা থেকে আমরা বের হয়ে আসব। আর এসব
প্রত্যাশাই আমাদের বাঁচিয়ে রাখে।
কাগজ : নারী লেখক, পুরুষ লেখক-- এভাবে দেখাটাকে অনেকেই মানেন না। তারপরে খুব ভালো লেখক এবং প্রথম সারির
লেখকের জায়গায় নারী লেখকদের জায়গা খুব কম বা নারীরা সেখানে জায়গা করে নিতে
পারছেন না কেন?
রিজিয়া : নারী লেখক, পুরুষ লেখক-- এটি আমিও কোনো পার্থক্য করে দেখি না। ভালো লেখেন যে, সে পুরুষ হোক বা নারী হোক, তিনি ভালো লেখেন।
নারী হলেই সে ভালো লিখবে না, পুরুষ হলেই ভালো লিখবে এমন
কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। মেয়েরা ওইভাবে লেখার জগতে জায়গা করে নিতে পারেনি, তা কিছু সীমাবদ্ধতা তো আছেই। তবে মেয়েদের লেখার ক্ষমতা নেই, তা নয়।
আমার কাছে যেটা মনে হয়, মেয়েদের
লেখায় একটা আলাদা মাধুর্য থাকে। মেয়েদের লেখায় আবেগ থাকে। উচ্ছ্বাস বেশি থাকে।
এখানে বোধ হয় একটা পরিমিতি বোধ থাকা দরকার, আমি উচ্ছ্বাস
কতটুকু দেব। কতটকুু নিয়ন্ত্রণ প্রয়োজন।
কাগজ : আজকাল মেয়েদের লেখায় আরও একটি বিষয় বেশ
লক্ষণীয় হয়ে উঠেছে,
তা হচ্ছে তাদের লেখায় যৌন বিষয়গুলো আসছে। এর কারণ আপনার কাছে
কী বলে মনে হয়? এটা কি অনেকটা এই যে পুরুষের লেখায়
যেহেতু আমরা যৌনতার বিষয়গুলোর বেশ খোলামেলা প্রকাশ দেখি, আর অনেক সময় এ ধরনের বিষয়কে বেশ আধুনিক আর শক্তিমান লেখকের বৈশিষ্ট্য
বলে চিহ্নিত করা হয়। তাই নারীরা শক্তিমান প্রমাণের জন্য লেখায় যৌনতাকে আনছে।
রিজিয়া : অনেকে নিজেকে বলিষ্ঠ লেখক হিসেবে প্রকাশের
জন্য লেখে। কিন্তু প্রকৃত অর্থে এটি শক্তিমান প্রমাণের কোনো বিষয় নয়। আমি জানি
না, ঠিক এ কারণেই মেয়েদের লেখায় যৌনতা আসছে কি না। তবে মানবজীবনের সত্যকে
প্রতিষ্ঠার জন্য না লিখে অপ্রয়োজনীয়ভাবে যদি যৌনতাকে আনা হয়, তবে সেটা ঠিক হবে না।
আরও একটি বিষয় হলো, আমার কাছে মনে হয়, আমি লেখক--এটাই বড় কথা। আমার মতো আমি লিখব।
আমার কাছে কখনোই মনে হয়নি, লেখা ছেলের মতো হতে হবে। আমার
কাছে মনে হয় চরিত্র, ঘটনা পরিবেশ আমাকে নিয়ন্ত্রণ করে।
আমার চরিত্রের প্রয়োজনে আমি লিখি। নেহাত চরিত্রের প্রয়োজনে। আমি যখন একজন
বেশ্যাকে নিয়ে লিখেছি, তখন তাকে মানুষ হিসেবেই লিখেছি।
তার শরীর বর্ণনায় এমনকি তার শরীরের পেছনের অংশ বর্ণনায়ও আমি শব্দ ব্যবহারে সতর্ক
হয়েছি। কারণ, আমি তাকে মানুষ হিসেবে বর্ণনা করতে
চেয়েছি। একজন পুরুষ হয়তো তা করতে পারতেন না। তার চোখে শরীর ধরা পড়ত। সে নারীর
শরীর দেখত। এখানে দেখার কিছু পার্থক্য তো রয়েছেই।
কাগজ : সাহিত্যে বা শিল্পে যৌনতার প্রকাশটা কেমন
হওয়া উচিত?
রিজিয়া : ঠিক কেমন হওয়া উচিত, কেমন হবে,
এটা একেবারে নির্দিষ্ট করে বলা যায় না। শিল্পের একটি লাইন আছে।
শিল্পের একটা সীমা আছে। শিল্পের একটা সৌন্দর্যও আছে। সেখানে তার সীমারেখা যতটুকু,
ততটুকুই যৌনতার প্রকাশ ঘটাতে হবে । তার বেশি হলে
অকারণ যৌনতা আসলে শিল্পটা ব্যাহত হবে। এখানে লেখককে
বুঝতে হবে কোথায় শিল্প। মহৎ সাহিত্য অন্য জিনিস।
কাগজ : কিন্তু যদি কালজয়ী সাহিত্যের দিকে আমরা তাকাই
এবং বিশ্বসাহিত্যের বিখ্যাত লেখক যেমন মোরাভিয়া, মার্কেজ-- এদের সাহিত্য যদি আমরা দেখি, তাহলে সেখানেও তো
আমরা যৌনতার খোলামেলা প্রকাশ দেখি।
রিজিয়া : বিশ্বসাহিত্যের কালজয়ী লেখকেরাও শিল্পের
সেই সীমারেখাকে অতিক্রম করেননি। তারা এটার শিল্পিত প্রকাশই ঘটিয়েছেন।
কাগজ : সাহিত্যের জন্য যৌনতা কি একান্ত অপরিহার্যই?
রিজিয়া : আমার তা মনে হয় না। সব সময় যৌনতার কোনো
প্রয়োজন নেই। এটি হলো তরকারিতে পাঁচফোড়ন দেওয়ার মতো। কোনো কোনো তরকারিতে আমরা
পাঁচফোড়ন দিই। কিন্তু সব তরকারিতে প্রয়োজন হয় না।
কাগজ : আমাদের দেশে এমনি বাংলা সাহিত্যেই মেয়েদের
সার্থক রম্যরচনা দেখা যায় না। তাই তেমন নারী রম্য লেখকও নেই। এর কারণ কী বলে মনে
হয়?
রিজিয়া : ওটার কী কারণ, তা বলতে পারি
না। রম্য রচনা মূলত কঠিন। আর হাসির উপন্যাসও বেশ কঠিন। বাংলাদেশে হাসির উপন্যাসও
আমরা লিখি না। আমি একটা উপন্যাস লেখার চেষ্টা করেছি প্রজাপতির নিবন্ধন।
কাগজ : মেয়েদের এই রম্য লেখা না-লেখার কারণ কি
ইমেজের কোনো সংকট?
রিজিয়া : আমি ইমেজের সংকট মনে করি না। রবীন্দ্রনাথ
তো সব ধরনের লেখাই লিখেছেন। ইমেজের কোনো সংকট তো হয়নি। আমি মনে করি, লেখকের যদি
ক্ষমতা থাকে, তবে সব ধরনের লেখাই সে লিখতে পারে। আমাকেও
অনেকে সিরিয়াস লেখক বলেন। ব্যান্ডেড হতে আমি রাজি নই। আমি মনে করি, লেখক যদি লিখে আনন্দ পান, তবে যেকোনো ধরনের
লেখাই লিখতে পারেন।
আমি শিশু-কিশোরদের জন্যও লিখেছি। উপন্যাস মতি শীলের
বাড়ি ও অন্যান্য, আজব ঘড়ির দেশে ছড়া লিখেছি ঝিলিমিলি ছড়া, নার্সারি
রাইম। রম্য রচনা লিখেছি খাওয়া-খাওয়ির বাঙালি
কাগজ : আপনার এই লেখালেখিতে আসার প্রেরণা কার কাছ
থেকে পেলেন?
রিজিয়া : লেখালেখির পেছনে আসার প্রেরণা আমিই। আমার
পরিবারে সেভাবে কেউ লেখেননি। যে লেখক হবে তার ভেতরেই প্রেরণার জন্ম হয়। তবে সবার
হয় তো তা বিকশিত হয় না। কারও কারও হয়। লেখক হওয়া খুব সহজ তা বলব না। তবে লেখক
হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাওয়া আরও কঠিন। সব দেশেই কঠিন। আর লেখক যদি প্রথমেই নাম চান।
প্রতিষ্ঠা চান তবে তিনি লেখক হিসেবে কতটুকু এগোতে পারলেন, তা বলা কঠিন।
কাগজ : কারণ, লেখা তো একটা সাধনা। তার প্রতি নিমগ্ন থাকা এবং
তার জন্য নিবেদিত হওয়া তো একটা বড় ব্যাপার, তাই না?
অবশ্যই, লেখা একটা বিরাট সাধনা। লেখা একটা নেশাও বটে।
লেখা একটা পরিশ্রমসাধ্য বিষয়ও বটে। অনেক পড়াশোনার বিষয়। ব্যাপক পাঠ দাবি রাখে।
আলবুর্জের বাজ লেখতে আমাকে প্রচুর পড়তে হয়েছে।
আজকাল যে সুইসাইড স্কোয়াড হয়। তার মূল বিষয়টি এবং উৎস নিয়ে আমি উপন্যাসটি
লিখেছি।
কাগজ : একটা সার্থক উপন্যাসের কী কী উপাদান থাকা মনে
করেন, অথবা আমরা আসলে কোন উপন্যাসকে সার্থক বলব?
রিজিয়া : এটা বলা খুব কঠিন। ব্যক্তিগতভাবে আমি যা
মনে করি, তাতে কোনো কোনো ক্ষেত্রে উপন্যাস চরিত্র প্রধান হতে পারে। আবার প্লট
প্রধান হতে পারে। আঙ্গিক কী হবে, তা বিষয়ই নির্ধারণ করে
দেয়। উপন্যাসকে আমি কোনো ছকে ফেলে লিখি না। গল্প বা বিষয়ের দাবিতেই এটি তৈরি
হয়ে যায়। কোনো নির্দিষ্ট ফর্মকেই মানতে হবে, তা আমি মনে
করি না। আসলে তা হয়ও না। সমাজ, সময় এবং পারিপার্শ্ব
বদলায়। মানুষ বদলায়, তার চিন্তাধারা বদলায়, তা থেকেই লেখাও পরিবর্তিত হয়। নানাভাবে তার ফর্ম পরিবর্তিত হয়। তবে
তা অবশ্যই শিল্প হতে হবে, সাহিত্য হতে হবে।
কাগজ : গল্পের ভাষারও তো অনেক পরিবর্তন হয়েছে। ফর্ম
নিয়েও নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা হচ্ছে।
রিজিয়া : অনেকেই ভাষা তৈরি করতে চায়। তবে ভাষা
ব্যাকরণসম্মত হতে হবে। তৈরি করতে হলেও তার ব্যাখ্যা থাকতে হবে। এত বছর ধরে যে ভাষা
তৈরি হয়েছে, তার একটা শক্তি আছে। তাকে তো ইচ্ছেমতো বদলানো যায় না। আমি যদি আমার
ভাষার মধ্যে ১০০টা আরবি শব্দ ঢুকাই, তাহলে তো হবে না।
কারণ, ভাষাকে তা নিতে হবে।
কাগজ : গল্পের আঙ্গিক নিয়ে এখন প্রচুর নিরীক্ষা
চলছে। দেখা যাচ্ছে আখ্যানহীন গল্প, আধুনিক গল্প বেশ জটিল ও দুর্বোধ্য হয়ে উঠছে।
অনেক ক্ষেত্রে অভিযোগ আসছে অস্পষ্টতার, ধারাবাহিকতাহীন
বিচ্ছিন্ন ভাবনার। এগুলো কীভাবে দেখছেন? আবার অনেকে বলছেন,
এখন ভালো গল্পের আকাল চলছে।
রিজিয়া : আধুনিক গল্প মানেই তো দুর্বোধ্য শব্দ দিয়ে
পৃষ্ঠা ভরে দেওয়া হয়। পরীক্ষার মানেই দুর্বোধ্যতা নয়। যারা এভাবে গল্প লিখছেন, তারা তাদের
দুর্বলতারই প্রকাশ ঘটাচ্ছেন। আঙ্গিক পরিবর্তন করতেই পারেন। কিন্তু আঙ্গিক
পরিবর্তনের সঙ্গে আমি যা বলতে যাচ্ছি, তা বলতে হবে।
উদ্দেশ্যহীন কিছু শব্দ দিয়ে শব্দজাল তৈরি করা কোনো আধুনিকতা নয়।
দূরে কোথাও বইটিতে আমিই প্রথম আঙ্গিক নিয়ে ভাবি।
আমাদের চিন্তাগুলো বারবার দ্বিখণ্ডিত হচ্ছে। এগুলো জোড়া দিয়েই একধরনের গল্প তৈরি
হচ্ছে । তবে আধুনিক ভাষা বিষয় ও বোধের ওপর দখল থাকতে হবে। এটি হচ্ছে একধরনের
ভারসাম্য রক্ষা করা। তবে গল্পের মোড় ঘুরেছে। তার ভেতর থেকে কিছু ঝরে যাবে, কিছু থাকবে
এবং এর মধ্য থেকেই ভালো গল্প বের হয়ে আসবে।
ভালো গল্প হচ্ছে না, এটা আমি মানি না। এখনো বেশ কিছু
গল্প খুব ভালো হচ্ছে।
কাগজ : আবার যদি সেই সার্থক গল্পের কথাই আসি, তাহলে তার
স্বরূপটা কী?
রিজিয়া : ভেতর থেকে যা আসবে, যা আন্দোলিত করবে।
এ মুহূর্তে আমার কিছু গল্পের কথা মনে হচ্ছে নরেন্দ্রনাথ মিত্রের রস গল্পটি কিংবা
আলাউদ্দিন আল আজাদের ছাতা, বৃষ্টি, হাসান আজিজুল হকের আত্মজা ও একটি করবী গাছ।
কাগজ : রস গল্পটির সার্থক নাট্যরূপও আমরা দেখেছি।
রিজিয়া : গল্প সার্থক হলে তা মানুষকে আন্দোলিত করবেই।
এখন যেমন অনেক ক্ষেত্রে দেখি।
প্রথমেই আঙ্গিক নিয়ে খুব ভাবা হয়। আমি মনে করি, বিষয় বেশি
গুরুত্বপূর্ণ। বিষয়ই আঙ্গিক তৈরি করে। যে বিষয় যেমন, সে
বিষয়টা সেই বিষয়, সেই আঙ্গিক তৈরি করে। কখনো কখনো
শিল্পবোধকে এত বেশি প্রাধান্য দেওয়া হয় এত বেশি আলংকারিক খাঁচায় বন্দী করা হয়
যে তা শিল্পের আতিশয্যে পরিণত হয়। আসলে আমাদের ভাব চিন্তাকে সমন্বিত করেই শিল্প।
ইংরেজিতে একটা শব্দ আছে, এসিমিলেশন তাই করতে হয় এবং
রিপ্রডিউস করা।
কাগজ : বিষয়টা কি এমন যে আমাদের ভাব অনুভূতিগুলোকে
যত বেশি ভাষায় রূপান্তর করা যাবে…
রিজিয়া : তা-ও নয়। কিছু ব্যাপার আছে যা ভাষায়ও
প্রকাশ করা যায় না।
কাগজ : আপনি একটু আগেই বলছিলেন, মোড় ঘোরা
আমরা কি বলতে পারি, আমাদের সাহিত্য নতুন মোড় নিয়েছে?
রিজিয়া : এটাকে আমি মোড় ঘোরা বলব না। কারণ, গল্পে কিছু
হয়েছে কিন্তু ষাটের দশকের পর থেকে খুব ভালো এবং উজ্জ্বল কবিতা এবং কবি আমরা
পাচ্ছি না। উপন্যাসে এক ধরনের বন্ধ্যাত্ব দেখছি। বড় ক্যানভাসের মানুষের জীবন,
তাদের বোধ বেঁচে থাকা-- এগুলো নিয়ে
জীবনঘনিষ্ঠ উপন্যাস তেমন হচ্ছে কই?
কাগজ : কলকাতার সাহিত্যের সঙ্গে বাংলাদেশের সাহিত্যের
পার্থক্য কী?
রিজিয়া : সমরেশ মজুমদার একবার বলেছিলেন, প্রবন্ধ ভালো
হয়েছে। কবিতা সমান সমান। গদ্য পিছিয়ে আছে। আমি কিন্তু তার প্রতিবাদ করেছিলাম।
আমার কাছে মনে হয়, বাংলাদেশের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের
সাহিত্যের পার্থক্য হচ্ছে বাংলাদেশের সাহিত্য বহু বিচিত্র। পশ্চিমবঙ্গের সাহিত্য
মূলত কলকাতা শহরকেন্দ্রিক। কিন্তু আমাদের বিষয়-বৈচিত্র্য অনেক বেশি।
বাংলা সাহিত্য পশ্চিমবঙ্গেরও, বাংলাদেশেরও।
সাতচল্লিশের আগ পর্যন্ত সাহিত্যটা এক রকমই ছিল এবং তা পঞ্চাশের দশক পর্যন্ত অটুট
ছিল। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের পর থেকেই রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট পরিবর্তিত হয়। ষাটের
দশক সব দিক থেকেই গুরুত্বপূর্ণ। পরিবর্তিত রাজনৈতিক সামাজিক পরিস্থিতি তখন নতুন এক
বোধ বিশ্বাসের উšে§ষ ঘটায়।
সর্বক্ষেত্রেই একটা নতুন সাড়া আনে। বাংলাদেশের সাহিত্যে বাংলাদেশের মানুষের জীবন,
আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্য, এর পরিবেশ, নদী ক্রমে ক্রমে আসতে শুরু করে এবং একটা ভিন্ন বৈশিষ্ট্য লাভ করে।
বিশেষ করে আঞ্চলিক শব্দ, আঞ্চলিক ভাষা এবং গ্রামীণ জীবন।
আর আমাদের কবিতার ভাষা বদলে গেছে। আমাদের গল্পের ভাষাটা ভিন্ন।
মোট কথা, আমাদের ভাষা আন্দোলন, ষাটের
দশক থেকে আমাদের পরিবর্তিত রাজনৈতিক, সামাজিক পরিবেশ,
মুক্তিযুদ্ধ, জীবন আমাদের সাহিত্যকে
জাতীয় সাহিত্য করে তুলেছে।
আমরা নিজস্ব সাহিত্য তৈরিতে আমাদের কবি, সাহিত্যিকেরা
সক্ষম।
কাগজ : আপনি বললেন, আমাদের নিজস্ব সাহিত্য তৈরি
হয়েছে। সে ক্ষেত্রে আমরা কি ভাষায় কোনো নতুন মাত্রা আনতে পেরেছি?
রিজিয়া : আমাদের লেখার ভাষাটা ভিন্ন তা বলব না। তবে
সাতচল্লিশের আগে আমাদের লেখার ভাষা ছিল কলকাতাকেন্দ্রিক একটি ভাষা। এখন বোধ হয়
সেটা আমাদের নিজস্ব। এখানে একটি কথা হচ্ছে, বাংলাদেশের সাহিত্যের ভাষা কিন্তু বদলে যায়নি,
বরং কলকাতায় ভাষা কিন্তু বদলে গেছে। তারা বাংলা ভাষার অপভ্রংশ
বা চলমান ক্ষয়িষ্ণু ভাষাকেই লেখায় নিয়ে এসেছে। তাদের কথা-ভাষার প্রচুর হিন্দি
এসেছে। এবং এগুলো আবার তারা এক প্রকার বাংলায় রূপান্তর করছে এবং সেই সঙ্গে ইংরেজি
শব্দও ব্যবহার করছে।
আমাদের লেখার ভাষায় কিন্তু এভাবে বাংলা ভাষার
অপভ্রংশ চলে আসেনি। কিছু কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে, তবে তা খুবই
ক্ষীণ। আমার মনে হয় বাংলা ভাষা রক্ষা করা আমাদের দায়িত্ব। কারণ আমাদের
রাষ্ট্রভাষা বাংলা। একটি আমাদের উত্তরাধিকার। এটি একটি দেশের ভাষা। এটিকে বিশুদ্ধ
এবং ভালো রাখা আমাদের দায়িত্ব।
কাগজ : আমাদের ভাষায় কিন্তু এখন অকারণ প্রচুর ইংরেজি
শব্দের ব্যবহার হচ্ছে। মিডিয়ায় একধরনের জগাখিচুড়ি বাংলা বলা হচ্ছে। এমনকি
বর্তমান প্রজন্ম ইংরেজি টানে বাংলা বলছে।
রিজিয়া : বাঙালি চেয়েছে বলেই বাংলাদেশ তৈরি হয়েছে।
আর বাংলাদেশ সৃষ্টির একটি অন্যতম প্রধান কারণ ভাষা। এটা আমাদের মনে রাখতে হবে, বাংলা আমাদের
দেশের ভাষা। পশ্চিমবঙ্গে এটি একটি প্রদেশের ভাষা। তাদেরকে কেন্দ্রের দিকে তাকিয়ে
থাকতে হয়। তা ছাড়া নকশাল আন্দোলনের পরে তাদের অনেক নির্যাতিতও হতে হয়েছে। ফলে
তাদের মতো করে আমাদের ভাবলে চলবে না । বাংলা ভাষাকে আমাদেরই রক্ষা করতে হবে। যারা
এ দেশে বাংলাকে বিকৃত করে, তাদেরকে জিজ্ঞেস করা উচিত,
ভাষা আন্দোলন কেন হয়েছিল এবং মুক্তিযুদ্ধ কেন হয়েছিল। ভারতীয়
উপমহাদেশে বাংলা ভাষা হচ্ছে বলিষ্ঠ এক ভাষা, যার পাশে
হিন্দি দাঁড়াতে পারে না।
আমি দিল্লিতে একটি কনফারেন্সে যোগ দিয়ে দেখেছি, দক্ষিণ
ভারতীয়দের ভাষাপ্রেম ও ভাষা রক্ষার আকুলতা। সেখান আমাকে এক মেয়ে বলল, তোমাদের শরৎ সাহিত্য সব পড়েছি। আমি যখন জিজ্ঞেস করলাম, ইংরেজিতে কি না, তখন সে বলল কেন? ইংরেজিতে কেন? আমি আমার মাতৃভাষায় পড়েছি।
আমি পিএইচডি করেছি নিজের মাতৃভাষার। তামিল, তেলেগু এরা
সবাই পিএইচডি করে নিজের মাতৃভাষার। তাই বলে তারা ইংরেজি কম জানে না।
আমাদের এখানে ট্রাশ ইংলিশের খুব ছড়াছড়ি দেখছি।
সেদিন টিভিতে দেখলাম,
রান্না শেখানোর অনুষ্ঠানে বলছে, চিকেনটা
ওয়াশ করে ব্লেন্ড করুন, মসলা মিক্স করুন, তারপর কাভার আপ করুন। কেন এ রকমের ইংরেজির মিশ্রণে বাংলা কেন? অনেকেই ইংরেজি শব্দ দিয়ে শিরোনাম দেয়। এসবই হীনম্মন্যতা থেকে করে।
আড়াই শ বছর পরাধীন থেকে পশ্চিমবঙ্গের টিভি দেখে যদি
আমরা অনুকরণ করি, তবে জাতিগতভাবে হেরে যাব।
এসব পরিবর্তনের জন্য শুধু লিখলে হবে না, আন্দোলন
দরকার।
কাগজ : আমাদের বর্তমান সময়ের সাহিত্য নিয়ে আপনার কী
মূল্যায়ন?
আমার তো মনে হয়, নব্বইয়ের পরে আমাদের সাহিত্য আরও
গতি পেয়েছে। আগে তো আমাদের ব্যক্তিস্বাধীনতা বা মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ছিল না।
যেমন আশি সালে আমিই একটি পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে একটা লেখা লিখেছিলাম। কিন্তু
সেভাবে আমি সেটাকে প্রকাশ করতে পারিনি। আমাকে অনেক কাটছাঁট করতে হয়েছে।
0 মন্তব্যসমূহ