সাক্ষাত্কারটি নিয়েছেন— শারমিনুর নাহার ও মনোজ দে
হরিপদ দত্ত, জন্ম :২ জানুয়ারি ১৯৪৭
হরিপদ দত্ত, যিনি মনে করেন, পৃথিবীতে ঈশ্বর তার জন্য কোনো ভূখণ্ড নির্বাচন করেনি। ড. আহমদ শরীফ কিংবা অমিয়ভূষণ মজুমদারের আশীর্বাদে আশির দশকে তাঁর লেখালেখির হাতেখড়ি। একসময় স্বপ্ন দেখেছেন, জন্মভূমির আর্থ-সামজিক পরিবর্তন আসবে কৃষিবিপ্লবের পথ ধরে। সেই হতাশার অমৃত-গরল, রাষ্ট্রের প্রতি ক্ষোভ আর অভিমান নিয়ে জন্মভূমি ছেড়ে আবারও প্রবাসী হয়েছেন।
হরিপদ দত্ত, যিনি মনে করেন, পৃথিবীতে ঈশ্বর তার জন্য কোনো ভূখণ্ড নির্বাচন করেনি। ড. আহমদ শরীফ কিংবা অমিয়ভূষণ মজুমদারের আশীর্বাদে আশির দশকে তাঁর লেখালেখির হাতেখড়ি। একসময় স্বপ্ন দেখেছেন, জন্মভূমির আর্থ-সামজিক পরিবর্তন আসবে কৃষিবিপ্লবের পথ ধরে। সেই হতাশার অমৃত-গরল, রাষ্ট্রের প্রতি ক্ষোভ আর অভিমান নিয়ে জন্মভূমি ছেড়ে আবারও প্রবাসী হয়েছেন।
বাংলাদেশ থেকে চলে যাবার মাস দুই আগে গত বছরের মার্চে তাঁর সঙ্গে প্রায় চার দিনব্যাপী কথা হয়। তাঁর ব্যক্তিজীবন, রাজনৈতিক জীবন, সমকালীন বাংলা সাহিত্য নিয়ে দীর্ঘ এই কথোপকথনের অংশবিশেষ এখানে প্রকাশিত হলো।
সাক্ষাত্কারটি নিয়েছেন— শারমিনুর নাহার ও মনোজ দে
শারমিন : 'জাতিস্মরের জন্মজন্মান্তর' উপন্যাসে মনে হয় আপনার জন্মের সময়ের একটা ইঙ্গিত আছে! সম্ভবত এটি আপনার আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস। আর 'জন্ম জন্মান্তর' উপন্যাসের অনেকখানি স্থান জুড়ে আপনি নিজেই উপস্থিত আছেন বলে আমার মনে হয়।
হরিপদ দত্ত : 'জন্ম জন্মান্তর' আমার প্রথম উপন্যাস। এখানে আমি নিজেই অনেকটা হাজির হয়েছি। যেটা বেশিরভাগ লেখকের ক্ষেত্রেই ঘটে থাকে, প্রথম উপন্যাসটা অনেকটা নিজেকে, নিজের সময়কে ঘিরে গড়ে ওঠে। 'জন্ম জন্মান্তর' উপন্যাসের ক্ষেত্রেও এটা ঘটেছে। তবে আমার পূর্ণাঙ্গ আত্মজীবনী লেখার ইচ্ছে আছে। 'জাতিস্মরের জন্মজন্মান্তর' উপন্যাসকে একটা অংশ বলা যেতে পারে।
শারমিন : লিখতে শুরু করলেন কখন?
হরিপদ দত্ত : লেখাটা শুরু হয় খুবই আকস্মিকভাবে। ঢাকায় আসার পর আমি রঞ্জিত দা-র সঙ্গে থাকতাম। রঞ্জিত দা মানে রঞ্জিত সেন। কোরআনের বাংলা অনুবাদক ভাই গিরীশচন্দ্র সেনের শেষ বংশধর। এটা ঢাকায় আসার প্রায় বছরখানেক পরের কথা। রঞ্জিন দা নিজেও বই লিখতেন। আমি ততদিনে শরত্চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, নীহার রঞ্জন রায়, ফাল্গুনি মুখোপাধ্যায় এঁদের উপন্যাস পড়েছি। এসব পড়তে পড়তেই আমার ইচ্ছে হলো, এমন তো আমিও লিখতে পারি। রঞ্জিত দা-কে বললাম, 'দাদা আমি একটা বই লিখব, আমার টাকা দিয়ে ছাপাব।' উনি বললেন, 'তুমি আবার কী লিখবে আর টাকাই বা পাবে কোথায়?' আমি বললাম, 'টাকা বাড়ি থেকে নিয়ে আসব।' আমি লিখে ফেললাম।
শারমিন : বইটার নাম কী ছিল?
হরিপদ দত্ত : নাম ছিল 'কত আঁখি জলে'। নাম শুনেই তো বুঝতে পারছ—একটা স্যাঁতসেঁতে প্রেমের উপন্যাস। বইটা আমার কাছে ছিল না। অনেক দিন খোঁজার পর বিজয় কৃষ্ণ মজুমদার বলে এক ব্যক্তি যিনি তার বিয়েতে বইটি উপহার পেয়েছিলেন, তার থেকে সংগ্রহ করি। সে-সময় রঞ্জিত দাদার এই কাহিনি এবং ছাপার পরে নিজের লেখা দেখে নিজের ইচ্ছেই উবে গিয়েছিল। তবে বইটা কিন্তু বেশ বিক্রি হয়েছিল।
শারমিন : এর পরে কী লিখলেন?
হরিপদ দত্ত : ওটা তো আবেগে পড়ে লিখেছিলাম। তবে পার্টির কাজে যখন ব্যর্থ হয়ে হতাশ হয়ে পড়েছিলাম, তখন ভাবছিলাম কী করব? কারণ আমি তো রাজনীতি ছাড়া কিছু শিখিনি। তখন লিখব বলে মনস্থির করলাম। তখন মনে পড়েছিল, ক্লাস এইটে পড়ার সময় কবিতা লিখেছিলাম। ওগুলো যদিও কোনো কবিতা হয়নি। পরে যুদ্ধের সময় অনেকগুলো কবিতা লিখি, মোটামুটি আশিটা কবিতা নিয়ে একটা পাণ্ডুলিপি আছে, এখনো ছাপানো হয়নি।
শারমিন :জগন্নাথ কলেজে ভর্তি হবার পরেই কি আপনার রাজনৈতিক জীবন শুরু হয়?
হরিপদ দত্ত : আমার ছোটকাকা নরেন্দ্র দত্ত সেই সময়ে কমিউনিস্ট পার্টি করতেন। পাকিস্তান হবার পর ভীত হয়ে সব ছেড়ে দেন। সেই সময় পার্টির নাম ছিল ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টি। পরে পার্টি ভাগ হয়ে নাম হয় পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি। পাকিস্তান আন্দোলনের সময় তিনি ভারতে চলে যান। ছোটবেলা থেকে কাকাকে দেখার কারণে একটা সুপ্ত প্রভাব নিজের ভেতরে কাজ করত। একটা কৌতূহল ছিল।
পরে জগন্নাথ কলেজে পড়ার সময় মেসে থাকতাম। তখন বাংলাবাজারে 'পানিউম' বলে ছোট্ট একটা রেস্টুরেন্ট ছিল। সেখানে কমিউনিস্টদের আড্ডা হতো। প্রিয়রঞ্জন সেন, সত্যেন সেন, রণেশ দাশগুপ্ত আরও অনেকে সেখানে আড্ডা দিতেন। এটা ৬৪ কিম্বা ৬৫ সালের কথা হবে। একদিন এক বয়স্ক মতো লোক আমাদের কাছে একটা লিফলেট নিয়ে আসে। লিফলেটের একদিকে কমিউনিস্ট পার্টির ইস্তেহার আর অন্যদিকে তাদের পার্টির কথা। পড়লাম কিন্তু কোনো আগ্রহ সৃষ্টি হলো না।
মনোজ : পরবর্তীতে কীভাবে আগ্রহ সৃষ্টি হলো?
হরিপদ দত্ত :আমি দেখতাম, শুনতাম আর সবসময় একটা কথা মনে আসত, আচ্ছা, যাদের দেখি তারা সবাই তো হিন্দু। যারা নেতা তারাও, আর যারা কর্মী তারাও। পরবর্তীকালে আমি যখন আরও বুঝতে শিখলাম তখন বুঝলাম, এটাও কমিউনিস্ট পার্টির একটা দুর্বলতা যে তারা মুসলমানদের আকৃষ্ট করতে পারত না। সাধারণ জনগণের কাছে এটার প্রয়োজন ছিল। এই সুযোগটা পাকিস্তান সরকারও নিত। তারা জনগণের মধ্যে প্রচার করত যে, তারা বিধর্মী, নাস্তিক তাদের কোনো ধর্ম নেই। পরবর্তীতে হক-তোহা এবং আরও কিছু লোক কমিউনিস্ট পার্টিতে আসে, যদিও তারা তখন জুনিয়র লেভেলে ছিল। এদের বয়স ২৩ থেকে ২৭ বছরের মধ্যে, এদের পার্টি সম্পর্কে কোনো ধারণা ছিল না কিন্তু তারা নেতা হয়ে বসে যায়। এরা আমাদের বিপ্লবের ক্ষতি করেছে। তারা একরকম বুঝতে পারছিল, সাধারণ মুসলমানদের দলে আনতে হবে।
শারমিন : এগুলো তো নিশ্চয় আপনি সেই সময় মনে করতেন। আজ যেভাবে বলতে পারছেন তখন নিশ্চয় চিন্তাটা এরকম ছিল না?
হরিপদ দত্ত : এগুলোর তো অনেক সারসংকলন হয়েছে। তবে এটা ঠিক যে আজ আমি এটা উপলব্ধি করে বলতে পারছি। সে-সময় পারিনি। কিন্তু আমি অনেক কিছু বাস্তব দেখেছি, সেটা আজ হয়তো তোমরা শুধু বই পড়ে বুঝতে চাইছ। ধরো, তোহা সাহেব কোট-টাই পরে কৃষকদের কাছে যেতেন। এখন কৃষক কি তার কথা শুনবে? বিশ্বাস করবে? আবার তার ভাষাজ্ঞান ছিল একবারে খাস-নোয়াখালী। একদিন রণেশদা-র বাসায় গেলাম। তিনি জেল থেকে সদ্য বের হয়েছেন। 'বাংলা উপন্যাসের শিল্পরূপ' অনুবাদ করেছেন তিনি। আমাদের সঙ্গে যখন পরিচয় তখন এই কাজটা করছিলেন। আমাদের পড়ে পড়ে শোনাতেন। তিনি তখন তাঁতীবাজারে একটা খুপরিতে থাকতেন। ছাত্র ইউনিয়ন করতেন। পার্টির অবস্থা খুব দুর্বল ছিল। এখানেই আমার রাশেদ খান মেননের সঙ্গে পরিচয় হয়। আরও দুটো মেয়েকে দেখতাম। সে-সময় পার্টির একটা অংশ কৌশলগত কারণে ন্যাপের সঙ্গে যুক্ত হলো।
শারমিন :আপনি যে সময়ের কথা বলছেন, অর্থাত্ ১৯৬৪-৬৫ সাল—সে-সময় একটা রাজনৈতিক পরিস্থিতি সারা উপমহাদেশ জুড়েই বিদ্যমান ছিল? কোনো তরুণের পক্ষে সেটা এড়িয়ে যাওয়া কি কঠিন ছিল?
হরিপদ দত্ত : সেটা পরে বলছি। যেমন একদিকে বিশেষ রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিদ্যমান ছিল তেমনি পরিস্থিতিকে আরও ঘোলাটে করবার সচেতন প্রয়াসও ছিল। যেমন, '৬৪-র দাঙ্গা। এ সময় চৌ এন লাই ঢাকায়। নাবিস্কো বিস্কুট ফ্যাক্টরির মালিকসহ আরও কয়েকজনকে পুড়িয়ে মারা হয়। উনার মেয়েকে পরে ভারতীয় দূতাবাস নিয়ে যায়। সেটা আমি দেখলাম। কোনো ঘটনা ঘটলে হিন্দু নেতাদের গ্রেফতার করা হতো। মুসলমানরা গ্রেফতার হলেও পরে ছেড়ে দেওয়া হতো। কিন্তু হিন্দুদের এত দ্রুত ছাড়া হতো না।
এতে আমার একটা উপকার হয়েছে, ধর্মীয় কারণে দাঙ্গাগুলো আমি প্রত্যক্ষ করেছি। এগুলো দেখায় লাভ হয়েছে যে, ধর্মের প্রতি কোনো আগ্রহ আর থাকেনি। আমার নিজের কমিউনিস্ট পার্টিতে যুক্ত হবার এটাও একটা কারণ ছিল। বিষয়টা এরকম যে, একটা জঙ্গলে যদি বাঘের ভয় থাকে তবে সেখানে কেউ যায় না। আমার ক্ষেত্রে সেটা হয়েছে। এরপর আসল '৬৫ সাল, যুদ্ধ আসলো। যুদ্ধের কারণে নিপীড়ন, অত্যাচার, দাঙ্গা বাড়ল। একসময় লক্ষ করলাম, এগুলো আমার উপন্যাসে চলে আসছে।
মনোজ : এই যে বললেন হিন্দু নেতাদের ধরে রাখত আর মুসলমানদের ছেড়ে দিতো—এই অবজারভেশন কি আপনার সে-সময় থেকেই ছিল না কি পরে হয়েছে?
হরিপদ দত্ত : তখন থেকেই ছিল। মাওলানা ভাসানীর একটা কথা আমার এখনো মনে আছে। উনাকে অনেক শ্রদ্ধা করি, উনার পার্টির প্রতিও আমার আন্তরিকতা আছে। কিন্তু উনি সে-সময় আপত্তিকর কথা বলেছিলেন। বলেছিলেন, 'হিন্দু কমিউনিস্টগণ', যেটা নিয়ে নানা সমালোচনা হয়েছিল সে-সময়। হতে পারে যুদ্ধ, দাঙ্গা—এসব দেখে তিনি বিরক্ত হয়েও থাকতে পারেন। এটা তিনি কেন বলেছিলেন, জানি না, হয়তো আইয়ুব খানকে খুশি করবার জন্য বলে থাকতে পারেন। আমি তখনই বুঝতে পেরেছিলাম যে, তাঁর পক্ষে আর কিছু করা সম্ভব নয়। অসাধারণ সাংগঠনিক ক্ষমতাসম্পন্ন ভাসানী—এই কথার সমালোচনা এড়াতে পারেননি। কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি। আর একটা জিনিস দেখতাম, হিন্দু কমিউনিস্টরা কেন হিন্দু অধ্যুষিত এলাকায় গিয়ে আত্মগোপন করত? তাঁতীবাজার, শাঁখারীবাজার—এসব এলাকায় গিয়ে তারা কেন আত্মগোপন করত? কেন তারা মুসলমানদের কোনো এলাকায় আত্মগোপন করত না? তাহলে কি হিন্দু নেতারা মুসলমান, দরিদ্রদের বিশ্বাস করেন না? প্রায় কমিউনিস্টরাই এই কাজ করত—সে-সময়ে এমন কেউ ছিল না, যে এই কাজ করেনি।
মনোজ : পার্টিতে যুক্ত হবার পেছনে আপনার নিজের কী প্রেরণা কাজ করেছিল?
হরিপদ দত্ত : আমার নিজের কাছে মনে হয়, সবচেয়ে বেশি যেটা কাজ করেছিল তা হলো সামপ্রদায়িকতা। যখন নিজেকে হিন্দু বা মাইনরিটি ভাবি, তখন মনটা বিষাদে ভরে যায়, সংকীর্ণ হয়ে যায় মন। একটা হীনম্মন্যতা কাজ করে মনের ভেতরে। যখন কমিউনিস্ট ফিলোসফিগুলো পড়তে লাগলাম, মানুষ হিসেবে নিজের মধ্যে একটা স্বাতন্ত্র্যবোধ কাজ করত। চারপাশের সবকিছুকে অন্যরকমভাবে দেখতে শুরু করলাম। মনে হতো, সবার জন্য কিছু করে যাব। নিজে একা নই, আমারও সবার জন্য কিছু করার আছে।
যখন লাল পতাকা নিয়ে মিছিল করতাম, নিজেকে বীর মনে হতো। মনের মধ্যে একটা আলাদা সাহস, শক্তি আসত। তোমরা যেভাবে জিজ্ঞেস করছ, তেমন যুক্তি দিয়ে বিবেচনা করে এটা করব, এটা করব না—এমন নয়। কোনো যুক্তি তেমনভাবে কাজ করত কি না জানি না, তবে ভালো লাগত। তত্ত্বটা অতটা জানা ছিল না কিন্তু উত্তেজনা কাজ করত।
শারমিন : এই সময়ে এসে বিষয়গুলোকে কীভাবে মূল্যায়ন করবেন? এই ধরুন, নানা পথ ও মতের বিভাজন, স্বপ্নভঙ্গ কিংবা এখনো যারা নিজেদের ত্যাগ করে যাচ্ছে—
হরিপদ দত্ত : আমি ছিলাম উচ্চ মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান, এসব আমার করার দরকার ছিল না। কিন্তু একবারও মনে পড়ে নাই, কমিউনিজম প্রতিষ্ঠিত হলে আমার বাবা তার শত শত বিঘা সম্পত্তি হারিয়ে ফেলবে, আমার পরিবার শূন্য হয়ে যাবে। আমি নিজের দিক থেকে চিন্তা করলে বুঝতে পারি, এটা ছিল শুধুমাত্রই একটি আবেগ, যুক্তি নয়। যে কারণে শেষ পর্যন্ত নিজেকে আর পার্টির সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারিনি। একদম শেষে গিয়ে যা হলো—চীনপন্থিদের পেটের মধ্যে গিয়ে হজম হয়ে যাওয়া। চারু মজুমদারের লাইনে পূর্ব পাকিস্তানের তরুণরা স্রোতের মতো দলে দলে ঢুকে গেল। ১৯৬৯ কিম্বা '৭০ সালে যারা ঢুকে গিয়েছে তাদের বের হবার কোনো পথ ছিল না। আমারও সম্ভব ছিল না। যা করতে চেয়েছি সেটা হওয়া তো দূরের কথা, একসময় পতঙ্গের মতো সবাইকে জীবন দিতে হলো।
শারমিন : রাজনীতির বিষয় বাদ দিয়ে সাহিত্য প্রসঙ্গে আসি। রাজনৈতিক হতাশার পর সিরিয়াসলি লেখার কথা কখন ভাবলেন?—
হরিপদ দত্ত : দেখো, যা করতে চেয়েছি—তা করতে পারলাম না। যে জীবনের মধ্যে ছিলাম, সেটা থেকে নিজেকে পুরোপুরি বের করে আনতে হলো। কী করব? প্রথমবারের মতো নিজেকে প্রশ্নের সামনে দাঁড় করালাম। ভাবলাম, আমি তো একটু আধটু লিখতে পারি। এটা সিরিয়াসলি নিলে কেমন হয়? এরপর থেকেই শুরু। তবে এটুকু বলতে পারি, আমি যখন থেকে লিখতে শুরু করেছি তারপর থেকে কোথাও কোনো ফাঁকি দিইনি। পরিশ্রম করে লিখেছি। বলতে পারি নিজের শ্রম, মেধা, সবকিছু আমি উজার করে মাতৃভূমিকে দিয়েছি। নিজের যতই কষ্ট হোক লেখাকে ফাঁকি দিইনি।
শারমিন : কেন লেখেন আর কেনই বা বলছেন এখানে কোনো ফাঁকি দেন না। আপনার কি মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো লেখার পেছনে কোনো কারণ কাজ করে?
হরিপদ দত্ত : না, না একজন লেখক কেন লেখে, সেটা নিয়ে সারা বিশ্বের লেখকরা নিজেদের মতো করে বলে গেছেন; শুধু মানিক একা নয়। আমি মূলত লিখি ক্ষোভ থেকে। ক্ষোভটা হলো, আমি যে রাজনীতিতে ছিলাম সেখানে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছি।
শারমিন : কিন্তু ব্যক্তি মানুষ হিসেবে তো ব্যর্থ হননি!
হরিপদ দত্ত : ব্যক্তিটাই তো সমগ্রের অংশ। একসময় অনুভব করলাম, আমি সম্পূর্ণ শূন্য। কিছু হলো না। কিছু করতে পারলাম না। প্রথমে গল্প দিয়ে শুরু করলাম, চেষ্টা করতে গিয়ে নিজের মধ্যে একটা সাহস আসলো, হয়তো পারব। আমার কোনো খ্যাতির মোহ নাই, অর্থের মোহ নাই। এমন কিছু আমি বাংলা ভাষায় লিখতে চাই, যেটা অন্যের অনুকরণ নয়, এমনকি অনুসরণও নয়। এজন্য আমাকে বাংলা গদ্যের নিজস্ব একটা রীতি আবিষ্কার করতে হয়েছে। প্রচুর পড়াশোনা করতে হয়েছে। ইংরেজি সাহিত্য, রুশ সাহিত্য পড়েছি। সেখান থেকে যতটুকু বুঝেছি, নিজের মতো করে আত্মস্থ করবার চেষ্টা করেছি।
শারমিন : নিজে সচেতনভাবে কোনো ফর্ম তৈরি করেছেন, যেটা একেবারে নতুন—
হরিপদ দত্ত : একেবারে নতুন করেছি—এমন নয়। তবে আমি সচেতন ছিলাম। নিজেকে এক্সপেরিমেন্টের মধ্যে দিয়ে নিয়ে গিয়েছি। যদি আমার লিখতে গিয়ে কোথাও মনে হয়েছে, এটা অন্যের মতো হচ্ছে, সেই জায়গাগুলো বাদ দিয়েছি। তুমি খেয়াল করে দেখবে, প্রথম দিকে আমার উপন্যাসগুলো ছিল বর্ণনামূলক, কাহিনিনির্ভর। কিন্তু পরবর্তীকালে আমার 'জন্ম জন্মান্তর' উপন্যাস থেকে শিল্প-সাহিত্যের নিজস্ব ফর্ম অনুধাবন করবার চেষ্টা করেছি। কাহিনি আছে কিন্তু শিল্পও আছে। যে ইমেজ, উপমা, অলঙ্কার, উেপ্রক্ষা, চিত্রকল্প আমি তৈরি করি, সেটা বাংলা সাহিত্যে কোথাও নাই। সবাই পাশ্চাত্যের দিকে তাকিয়ে থাকে, আমি সেখানে দেখাতে চেয়েছি, আমাদের সাহিত্য আমাদের মধ্যেই আছে। তবে আমার কোনো লেখাতেই পুনরাবৃত্তি নেই। যে কটা উপন্যাস লিখেছি, সেগুলোর প্রতিটির ফর্ম আলাদা। বিষয়ও স্বতন্ত্র।
মনোজ : কতগুলো উপন্যাস লিখেছেন, গল্পের সংখ্যাই বা কত?
হরিপদ দত্ত : এত লেখার কথা ছিল না। আমি তো অবাক, এত লিখলাম কখন? এটা বুঝতে পারলাম গল্প সমগ্রটা করতে গিয়ে, এখানে ১২২টি গল্প আছে। এর বাইরেও আরও ৪০-৫০টি রয়ে গেছে, সবগুলো এটাতে দেওয়া যায়নি। আর উপন্যাস দশ-বারোটার মতো হবে।
শারমিন : আপনার গল্প বা উপন্যাসের বিশেষ কোনো বৈশিষ্ট্য, যেটা সচেতনভাবে নিজেই সৃষ্টি করেছেন, সে-সম্পর্কে যদি বলতেন—
হরিপদ দত্ত : আমার গল্পে দুটো প্রতীকের প্রাধান্য রয়েছে। সেটা হলো অন্ধকার এবং সাপ। অন্ধকারটা আনা হয় আতঙ্ক, হতাশা, ভয় এসবের ইমেজ সৃষ্টির জন্য। আর সাপটা হলো লিবিডো, যৌনতার প্রতীক। এছাড়া অন্ধকার, গুহা, জোত্স্না, জোনাক, বটগাছ এসবই ঘুরেফিরে এসেছে। মানুষের মনের ভেতরের যে দ্বন্দ্ব সেটা সচেতনভাবে তুলে আনার চেষ্টা করেছি অর্থাত্ মানুষ যে বিচিত্র জীব এবং তার মানসিক চেতনা যে বিচিত্র সেটা বলার চেষ্টা করেছি। মনস্তত্ত্বটা পুরো ধরার চেষ্টা করেছি। এবার আমার যে উপন্যাসটা বেরুলো সেটা (যুদ্ধ ও অমানিশির গণকবর, উত্স প্রকাশন, ঢাকা। একুশে গ্রন্থমেলা-২০১২) যুদ্ধের ওপর। এই উপন্যাসের প্রথম লাইনটা হলো, 'মায়ের দ্বিতীয় শরীর। অবাক বিস্ময়, অর্থহীন, কৌতূহল কিম্বা আচমকা ভয়ার্ত চোখে ভাসে অচেনা মাকে।' এখানে একজন মা তার ছেলেকে নিয়ে গ্রামের পুকুর ঘাটে স্নান করতে নেমেছে। স্নান শেষে মা কাপড় পালটাচ্ছে। তখন ছেলেটা মায়ের সম্পূর্ণ শরীরটা দেখল অবাক-বিস্ময় নিয়ে। মাকে সে একজন সম্পূর্ণ নতুন মানুষ হিসেবে দেখল। দেখে চিত্কার দিল, মা জিজ্ঞেস করল, কী রে কাঁদছিস কেন? ছেলেটি বলল, ওই একটা সাপ। এটা সম্পূর্ণ প্রতীকী অর্থে—এটাকে ব্যাখ্যা করলে চার-পাঁচ পৃষ্ঠা হয়ে যাবে। উপস্থাপনাটা জটিল কিন্তু প্রতীকী। এ সমস্ত জটিলতার কারণে আমার পাঠক সংখ্যা একটু কম। উপন্যাসটিতে এরপর থেকে ছেলেটার বিকারগ্রস্ততা শুরু হয়। সে দেখে একাত্তরে বাবা যুবতী মেয়েকে পাঞ্জাবি মেজরের কাছে সঁপে দিচ্ছে। কিন্তু বাবা জানে না, এই পাঞ্জাবিরা যে বাস্টার্ড। এশিয়ার প্রথম বাস্টার্ড হলো পাঞ্জাবিরা, তারা গ্রিকদের উত্তরসূরি। পরে এই বিকারগ্রস্ত ছেলে পিতাকে হত্যা করে মুক্তিযুদ্ধে চলে যায়। সেখানে তার মধ্যবিত্ত মনের টানাপোড়েন শুরু হয়। উপন্যাসের শেষে আমি ইঙ্গিত করেছি যে, বিপ্লবী লাইনেই দেশের পুর্নগঠন হবে।
শারমিন : আপনি শুরুতে বলেছিলেন, ক্ষোভ থেকে লেখার শুরু। কিন্তু যখন শুরু করলেন তখন কারা আপনাকে অনুপ্রাণিত করেছিল?
হরিপদ দত্ত : শুরু তো করলাম, এরপর আমাকে প্রথম আবিষ্কার করেন আহসান হাবীব। প্রথম সার্টিফিকেট দিয়েছিলেন ড. আহমদ শরীফ। এমন সার্টিফিকেট তিনি তাঁর জীবদ্দশায় আর কাউকে দেননি। গল্পের বইটার একটা রিভিউ বের হয় দৈনিক পত্রিকায়। পত্রিকায় রিভিউ দেখে আমাকে ডেকে পাঠালেন। ভয়ে ভয়ে গেলাম, বললেন—'তুমি মুসলমানদের মনন, বিশ্বাস, সংস্কার এত গভীরভাবে আত্মস্থ করেছ, (অন্তত এই আশির দশকে) এখন পর্যন্ত কেউ করতে পেরেছে বলে আমার চোখে পড়েনি।' আমি বললাম, 'কেন স্যার?' বললেন, 'দেখো, মুসলমানরা যে দুই হাতে ভাত খায়, মানে এক হাতে খায় আর এক হাতে কাঁটা বাছে—এটা কেউ আগে এমন গভীরভাবে দেখেছে? স্বয়ং রবীন্দ্রনাথও পারেননি। তিনি কখনো পাশের বাড়ির মুসলমানের খবর রাখেননি। কারণ, তাঁদের নিয়ে তিনি ভাবিত ছিলেন না।' আমি খুবই লজ্জিত হয়েছিলাম। পরে আমেরিকা চলে গেলে খুব আফসোস করেছিলেন। কাকে যেন বলেছিলেন, 'ওরে তোমরা শত্রু-সম্পত্তি দখলদার বলো, ওদের সামনে দাঙ্গা করো। দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক করে রেখেছ, ও যাবে না তো কে যাবে?' এছাড়া সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী অনেক সাহায্য করেছেন। তাঁর স্ত্রীও অনেক করেছেন আমাদের জন্য। এখনো করছেন। আমি তাঁর কাছে বিশেষ কৃতজ্ঞ। কলাকাতায় অমিয়ভূষণ মজুমদার, পার্থপ্রতিম বন্দ্যোপাধ্যায় উনারা আমার উপন্যাস নিয়ে লিখেছেন।
শারমিন : আপনার প্রথম লেখা কোথায় প্রকাশিত হয়?
হরিপদ দত্ত : দৈনিক বাংলায়, তখন আহসান হাবীব সাহিত্য সম্পাদক। খুব বড় মাপের মানুষ। একটা গল্প দিয়েছিলাম। উনি পড়ে কিছু জায়গা দাগিয়ে বললেন, ঠিক করে আনো। আমি বললাম, 'অন্য আর একটা দিই।' বললেন, 'না, আমি তোমার এই গল্পটাই ছাপব। তুমি ঠিক করে নিয়ে এসো।' পরপর দুটো গল্প ছেপেছিলেন। পরে অন্যরাও ছাপতে শুরু করে।
শারমিন : আমেরিকায় যাওয়া আপনার কোনো কাজে লেগেছে কি?
হরিপদ দত্ত : সত্যি বললে, আমেরিকা ভ্রমণ খুব কাজে লেগেছে। আমার গল্পের ফর্ম পাল্টে গেছে, পুরোনো ফর্মটা ভেঙে সম্পূর্ণ নতুন আঙ্গিক এসেছে। যেমন 'জন্ম জন্মান্তর' (প্রথম উপন্যাস, প্রথম প্রকাশ ২০০০ সাল) সম্পূর্ণ নতুন আঙ্গিকে লেখা। এই ফর্মটা পেয়েছি হিন্দু এবং বৌদ্ধ মিথলজি থেকে। পূনর্জন্ম লাভ এই উপন্যাসের আঙ্গিক বিবেচনার একটি উল্লেখযোগ্য দিক। আর উপন্যাসের ঢংটা নিয়েছি 'মহাভারত' থেকে। 'মহাভারতে' যেমন একটা গল্প বলতে গিয়ে আর একটা গল্পে চলে যায়, তেমন রীতি এখানেও ব্যবহার করেছি। আমরা কেন ল্যটিনের দিকে তাকিয়ে থাকি, কেন আমেরিকার, আফ্রিকার দিকে তাকিয়ে থাকি! মহাভারতের ফর্মটা ব্যবহার করা আমার একটা বিদ্রোহও বলতে পার। আমাদের নিজেদেরই তো নিজস্ব ফর্ম আছে। আমরা কেন অন্যদের দিকে তাকিয়ে থাকি? 'রামায়ণ'-এ পাচ্ছি কবিতার ঢং। পৃথিবীর প্রথম কবিতা তো রামায়ণ থেকেই শুরু। পুরো ছন্দবদ্ধ একটা কাঠামো কী রামায়ণে নেই? আর সে-সময় নিঃসঙ্গতা ছিল যাত্রা পথে। অতিরিক্ত পরিশ্রম, ঘৃণা, ক্ষোভ—এসব আছে। যেগুলোর ছাপ জন্ম জন্মান্তরে পড়েছে।
শারমিন : জন্ম জন্মান্তরের মতো এমন বিশাল উপন্যাসের পরিকল্পনা কীভাবে করলেন? এখানে ভারতবর্ষের ইতিহাসের একটি সারসংকলন আছে। যেটা দর্শনের ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ। এছাড়া ইতিহাসকে আপনি চরিত্রের মধ্য দিয়ে তুলে এনেছেন, কীভাবে?
হরিপদ দত্ত : এটা আসলে একটা অন্য ধরনের উপন্যাস হবার কথা ছিল। উপন্যাসের শুরুটা আমি ঢাকায় বসে করেছিলাম। সেটা আর পরবর্তীকালে নিইনি। আমেরিকায় পৌঁছানোর পরেই আমার মনে হয়েছে, এটা ভুল হয়ে গেছে। এবং যত বছর আমি সেখানে ছিলাম—এটা মাথা থেকে তাড়াতে পারিনি। মনে হলো, দেশটা একটা যন্ত্র। এখানে কেউ আসে? এটার পাণ্ডুলিপি আমি সঙ্গে করে নিয়ে গিয়েছিলাম। সেখানে গিয়ে আরও কিছু পরিবর্তন করি। সেগুলোর কথা অবশ্য ডায়রিতে আছে। কিন্তু লিখতে লিখতে আমি ক্লান্ত হয়ে গেলাম। কোনোভাবেই এগোতে পারি না। মনে হলো—আর বুঝি এগোতে পারব না। দেখা যেত, তিন মাস চার মাস কিছুই লিখিনি। খুব ক্লান্ত ছিলাম, সারাদিন কাজের পরে হাত-পা ক্লান্তিতে ভেঙে আসত। তখন আর লেখা হতো না। তবে খুব লোভ কাজ করত। একটা মায়াও পড়ে গিয়েছিল। শেষ প্রায় একশ পৃষ্ঠার মতো আমি কানাডার সেন্ট লরেন্স নদীর তীরে বসে লিখি।
শারমিন : এটা কি শেষের ওই সুন্দর কাহিনির অংশটা?
হরিপদ দত্ত : হ্যাঁ, মূলত এই অংশটা। হিরম্ব'র কাহিনি অনেকদিন থেকেই গোছানো। কিন্তু শেষটা আবার নানাভাবে পরিবর্তিত হয়েছে। এটার শেষ লাইনটি পঞ্চাশ-ষাট বার লিখেছি। পরে আমেরিকায় এসে আবার শেষ করি। এগুলো তারিখসহ ডায়রিতে লেখা আছে। কোন দিন কতখানি লিখলাম, কোথায়, কেন শেষ করলাম। মাঝের কিছু অংশ এবং শেষ অংশের সঙ্গে প্রায় দুই-আড়াই বছরের ব্যাবধান। শেকড়ছিন্ন মানুষের চাপ কাজ করেছে। কাজ করেছে নিজের নিঃসঙ্গতা। খুব চেষ্টা করতাম আকাশ দেখতে। বিল্ডিং-এর ফাঁকফোকর খুঁজে একটু চাঁদ দেখবার চেষ্টা করতাম। চাঁদ দেখে চিন্তা করতাম, এখন আমার জন্মভূমিতে রাত না দিন। সেখানে তাকে দেখা যাচ্ছে কি না। চাঁদটা আমার কাছে ব্যক্তি হয়ে ফুটে উঠতো। আর এমন চাঁদ দেখলেই মনে পড়ত শশী ডাক্তারের কথা। মানিকের সেই পুতুল নাচের ইতিকথার কথা। 'টিলার উপরে দাঁড়িয়ে শশী ডাক্তার আর কখনও সেই চাঁদ দেখবে না'। উজিয়ানে বসে সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহ 'চাঁদের অমাবস্যা' লিখেছিলেন। সেটা ভাববার চেষ্টা করতাম। আমি দেখতাম, এখানে কেউ সুখী নয়। একজন অসুখী মানুষ কী ভাবে? তার জীবনটা কী? এটা অনুধাবন করবার চেষ্টা করতাম। এই দুঃখগুলোই এখানে ঢেলে দিয়েছি। নিজের থেকে নিজে বিচ্ছিন্ন মানুষ কী ভাবে, সেটাই লেখবার চেষ্টা করতাম। একটা স্বপ্ন আমি বারবার দেখতাম সেটা হলো ট্রেন ফেল করা। এখনো দেখি। কোথায় ব্রিজ, ভাঙা ব্রিজ যেতে যেতে শেষ হয়ে গেছে। আর কোনো রাস্তা খুঁজে পাচ্ছি না। বুঝতে পারতাম, আমি কোথাও আটকে গেছি, কোনো পথ খুঁজে পাচ্ছি না।
শারমিন : আপনি 'জন্ম জন্মান্তর' উপন্যাসের ভূমিকায় লিখেছেন, 'যাদের কোনো দেশ নেই তাদের জন্য এই উপন্যাস লেখা'। কেন?
হরিপদ দত্ত : অনেকেরই তো দেশ নেই। ধরো, আমেরিকায় যারা বসবাস করে, তাদের অনেকেরই কোনো দেশ নেই। ইমিগ্র্যান্ট, হাজার হাজার লোক ইউরোপ, এশিয়া, অস্ট্রেলিয়া কিংবা অন্যান্য দেশ থেকে এসেছে, যাদের নিজের আর কোনো দেশ নেই। তবে একটা কথা আমি এই উপন্যাস নিয়ে বলতে চাই, একটা ম্যাসেজ দিতে চেয়েছিলাম—'কেউ যেন নিজের মাতৃভূমি ত্যাগ না করে, অন্যদেশে বেড়াতে যাবে সেটা ঠিক আছে, হয়তো কাজেও যাবে কিন্তু একেবারে নিজের শেকড় যেন ছেড়ে না যায়।'
শারমিন :সমকালীন বাংলা সাহিত্যের প্রবণতা সম্পর্কে আপনার অভিমত কী?
হরিপদ দত্ত :আমি বাংলাদেশের সাহিত্য নিয়ে মোটেও আশাবাদী নই। সাহিত্য নির্মাণের জন্য যে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক পরিবেশ দরকার সেটা এখনো গড়ে ওঠেনি। আমাদের মূল সাহিত্যের যে উদ্ভব, বিকাশ, সেটা উপমহাদেশে। এর কাঠামো ছিল ঔপনিবেশিক আমলের। ইংরেজি সাহিত্যে যখন রেঁনেসা আসলো সেই সময়ে ভালো ভালো সাহিত্য সৃষ্টি হয়েছে। পূর্ববাংলার যে সাহিত্য গড়ে উঠেছে ওয়ালিউল্লাহ্, সত্যেন সেন কিংবা ইলিয়াসের মতো সাহিত্যিকদের হাত ধরে—মূলত আমাদের গৌরবোজ্জ্বল বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন তার ভিত্তি। কিন্তু একাত্তরে তো সবকিছু মীমাংসা হয়ে গেল। বাকি ছিল সমাজতন্ত্র, সেখান থেকে রাষ্ট্র বেরিয়ে এসে তাকে পরিত্যাগ করল।
শারমিন :কে পরিত্যাগ করল? রাষ্ট্র তো সমাজতন্ত্রের স্লোগান ব্যবহার করেনি—
হরিপদ দত্ত :করল না, তারা মুখে মুখে স্লোগান দিল, ধর্ম নিরপেক্ষতার কথা বলল আর সমাজতন্ত্র। সমাজতন্ত্র থাকলে ধর্ম নিরপেক্ষতার প্রশ্ন ওঠে না। গণতন্ত্র বললেই সব হয়। তারা নকশালদের হত্যা করেছে। '৭২-এ যে মাধ্যমিক, উচ্চ-মাধ্যমিক পরীক্ষা হলো সেটা হলো বই দেখে। স্বাধীনতা-উত্তর একটা জাতির শিক্ষা কাঠামোতে প্রথমেই দুর্নীতি ঢুকানো হলো। এর পেছনে সরকারের যুক্তি ছিল, এরা পড়াশোনা করতে পারেনি। এই যে রাষ্ট্র, সেটার শিল্প কীভাবে হবে সেটা নিয়ে কারও কোনো সচেতন পরিকল্পনা আছে? এই যে বাহাত্তর সাল পর্যন্ত যে কবিতাগুলো লেখা হলো, রফিক আজাদ কিংবা নির্মলেন্দু গুণ, তাঁরা যে কবিতাগুলো লিখলেন, এর পরে আর এমন কবিতা লিখতে পারেননি। কারণ, স্বাধীনতার স্বপ্নটাই তো আর নেই। স্বাধীনতার স্বপ্নটা কী ছিল আমাদের—গণ মানুষের মুক্তি, সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা, যদি এই দুটো না থাকে, আমি গল্পে কী দেখাব আর কবিতাতেই বা কী বলব? উপন্যাসই নির্মিত হবে কীভাবে? আমার তো কোনো স্বপ্ন নেই। আমার স্বপ্ন কেমনে বিদেশ যাব, আরও একটু টাকা করব, কোন বিষয়ে পড়লে ভালো চাকুরি পাব। সাহিত্য পড়েই বা কতজন লেখক হবার স্বপ্ন দেখে? কী করে আশা করো এখানে ভালো কিছু লেখা হবে। ভালো উপন্যাস হবে। যেমন আমি 'জন্ম জন্মান্তর' উপন্যাস লিখেছিলাম প্রচণ্ড চাপের ভেতরে। আমি কীভাবে মুক্তি পাব। কখন আমি দেশে যেতে পারব। এখন যদি বলো দাদা, এমন আরেকটা উপন্যাস লেখেন, আমি পারব না। ওই জিনিস আর আমার ভেতরে নাই। হাওয়া হয়ে গেছে। এই জন্যই বাংলাদেশের সাহিত্যের অবস্থা ভালো না। বিশ্বমানের উপন্যাস বলো, গল্প বলো সেটা আপাতত এখানে লেখা হবে না। যদি কখনো রাষ্ট্রের মধ্যে পরিবর্তন আসে, আমরা এমন রাষ্ট্র গড়ব সেটার যদি একটা স্বপ্ন থাকে—যেখানে কৃষক, শ্রমিকদের জন্য কী থাকবে ইত্যাদি বিষয় নিয়ে যদি রাষ্ট্র এগুতে থাকে, তাহলে মানুষের মধ্যে একটা স্বপ্ন আসবে। সেটার সঙ্গে সঙ্গে সাহিত্য এগিয়ে যাবে। কৃষির সঙ্গে সঙ্গে যেমন শিল্প হয় তেমনি রাষ্ট্রের, রাজনৈতিক স্বপ্নের সঙ্গে সঙ্গে শিল্প এগোয়। যদিও আমি নিজের হতাশা ব্যক্ত করলাম কিন্তু এটাই সত্য।
শারমিন :তার মানে কি, সামগ্রিক স্বপ্ন না থাকলে সাহিত্য এগোয় না?
হরিপদ দত্ত : স্বপ্নকে ঘিরে লেখকের মধ্যে তাড়না তৈরি হয়। প্রতিটি কবি, লেখকের মধ্যে এটা কাজ করে। হেলাল হাফিজ কি আর কোনো দিন লিখতে পারবে—'এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়'? তাদের তো কবিসত্ত্বা আছে সেটা তো আর বসে থাকবে না। তারা কাজ চায়। আমি এখন আর লিখতে পারছি না। আর লিখতেই যদি না পারি তবে মাটি আঁকড়ে পড়ে থাকার মানে হয় না। আমি আমার ঘর সংসার, বউ, ছেলে-মেয়ের কাছে চলে যাই। একটা দিন যদি লিখতে না পারি তবে মনে হয় সময়টা ব্যর্থ হলো। আমার মধ্যে তাড়না নেই।
শারমিন : বিদেশে গেলেন কেন? আপনি যে সময়ের কথা বলছেন, তখন তো লেখক হিসেবে সম্ভবত প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছেন।
হরিপদ দত্ত : হ্যাঁ, তখন আমি প্রতিষ্ঠিত। শোন, তোমাদের কাছে একেবারে ফ্র্যাঙ্কলি স্পিকিং, আমি বুঝে গিয়েছি, এই দেশে আমি লেখক হিসেবে গৃহীত হব না, সাম্প্রদায়িকতার কারণে। আমার তো নাগরিকত্ব নেই, দ্বিতীয় শ্রেণী করে রাখা হয়েছে আমাকে। আর একটা কারণ ধরো—বড় বড় যে-সব শিল্পী-সাহিত্যিক আছে, তারা কেউ আমার নাম বলে না, নিজেদের লেখাতেও কেউ ব্যবহার করে না। তারা কেউ চায় না একজন হিন্দু লেখককে জায়গা দিতে, ওপরে তুলতে।
শারমিন : কেন এটা বলছেন, এখানে কি কোনো হিন্দু লেখক নেই?
হরিপদ দত্ত : আছে, ধরো আমিই প্রথম সামপ্রদায়িক অবস্থাটা ভাঙি। সেনা-শাসনের সময়ে আমাকে বাংলা একাডেমী পুরস্কার দেওয়া হয়। কোনো দল এই উদারতার পরিচয় দিতে পারবে না। সেনা শাসককে দিয়ে সেটা করানো হলো। খালেদা জিয়া, এরশাদ, জিয়াউর রহমান কিংবা শেখ হাসিনা তাঁদের কি কারও আমার কথা মনে ছিল না। অবশ্যই পুরস্কার বড় কথা নয়, কিন্তু বড় বিষয় হলো স্বীকৃতি। যেটা ওই মইন ইউ আহমেদ করতে পেরেছে। আর্মি ইন্টেলিজেন্স এসেছিল আমার এখানে, 'বলেছে কেন আপনি প্রত্যাখান করতে চান? তারা কিছু ভালো কাজ করতে চায়। নিজেদের কোথাও কোথাও ভালো তাদের দেখাতে হয়।' যা-ই হোক, সেনা শাসন আমার জন্য সাপে বর হয়ে গেল। তবে তুমি জানো, ২০০৬ সালে বাংলা একাডেমীর পুরস্কার ঘোষণা করা হয়েছে, ওয়েব সাইটে দেখো, সেখানে আমার নাম নেই। প্রতিবছর আমার কাছে পুরস্কারের জন্য লেখক সিলেক্ট করার ফর্ম আসে আমার কাছে এবারই আসেনি। বাংলা একাডেমী কি কারও বাপের সম্পত্তি যে, যাকে ইচ্ছা রাখবে, যাকে ইচ্ছা ছুড়ে ফেলে দেবে। এজন্য মনে হয়, এই রাষ্ট্রটাই আমার বিরুদ্ধে। বললে বিশ্বাস করবা না—মেসের ছেলে, এমনকি পত্রিকার হকার তাদের কাছ থেকে আমি টাকা ধার করি। অন্যরা তো অনেক সুবিধা ভোগ করল। সাহিত্য যতক্ষণ না এই দুর্বৃত্তদের হাত থেকে মুক্তি না-পাবে ততক্ষণ এই সাহিত্য দাঁড়াবে না।
মনোজ :এই ক্ষোভ, ঘৃণা কেন আপনার মধ্যে আসলো?
হরিপদ দত্ত : কথাটা আমি নিজেও অনেক সময়ে ভেবেছি, এই ঘৃণাবোধ কেন আসলো? এটা এক ধরনের রাজনৈতিক হতাশা। আমি কি ভাবতে পেরেছিলাম, ১৯৭১ সালে যে দেশ সবাই যুদ্ধ করে স্বাধীন করেছিল সেই দেশে বাবরি মসজিদ ভাঙার সময়ে দাঙ্গা হবে? পাহাড়ে আদিবাসী মেয়েরা ধর্ষিত হবে। ২০০১ সালেও পূর্নিমা নামের মেয়েটা ধর্ষিত হয়েছিল—এসব কি হবে ভাবতে পেরেছিলাম? আর আমিই বা কেন আমেরিকা চলে গিয়েছিলাম। ২০০১ সালে জনএফ কেনেডি বিমান বন্দরে নেমেই বুঝতে পেরেছিলাম, আমি তো ভুল করে ফেলেছি। কিন্তু আমার তো উপায় ছিল না। সন্তানদের কী খাওয়াবো, যে সাম্রাজ্যবাদীদের ঘৃণা করি, তার কাছে আশ্রয় চাওয়া, এর চেয়ে লজ্জার আর কী আছে? কৃতদাস হয়ে সাদাদের সেবা করা। কত ধরনের কাজ যে করেছি, কুকুরের বিষ্ঠা পর্যন্ত ক্লিন করেছি।
শারমিন :আপনার লেখা সম্পর্কে কোনো সমালোচনা নেই? এই যে আপনার পাঠক কম। কিংবা আপনি যা বলতে চাচ্ছেন, তা অন্যরা বুঝতে পারছে কি না। এটা কখনো ভেবে দেখেছেন?
হরিপদ দত্ত : দেখো, আমার লেখা উপস্থাপনাটা জটিল, এজন্য পাঠক নিতে পারে না।
শারমিন : পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন থাকলেন কেন?
হরিপদ দত্ত : বিচ্ছিন্ন থাকতে বাধ্য হয়েছি। আমি এখানে শিয়াল-কুকুরের মতো জীবন যাপন করি। আর কত! ছেলেমেয়ে আছে তাদের কাছে চলে যাব। তবে আমি আমার কাজ সঠিকভাবে করার চেষ্টা করেছি। কোথাও কোনো ফাঁকি দিইনি।
শারমিন : আপনি হয়তো নিজে নিজেই এটা ভাবছেন যে, আপনি নিজের কাজ করে গেছেন, পরিশ্রম করে গেছেন। কেউ আপনার মূল্যায়ন করছে না। এটা নিয়ে কি এভাবে ভাবার কিছু আছে? আপনি আপনার কাজ করে গেছেন।
হরিপদ দত্ত : শোন, তোমাকে একটা সত্যি কথা বলি, আমি এখান থেকে মানে 'নতুন দিগন্ত' থেকে তিন হাজার টাকা পাই। এখানের অনেকে পায় আট হাজার, দশ হাজার কিন্তু আমি অত পাই না। আমার কোনো ছুটি-ছাটা নাই। আর এক জায়গায় টিউশনি করি—পাই পাঁচ হাজার। এই আট হাজার হলো আমার মাসের ইনকাম। আর এই লেখালেখি থেকে যা পাই। আমি এক লক্ষ টাকা ঋণগ্রস্ত। প্রকাশদের কাছ থেকে কোনো টাকা পাই না। কেন থাকব বলো?
শারমিন : আপনি না গিয়ে ওদের চলে আসতে বলেন।
হরিপদ দত্ত : না। আয় নাই রোজগার নাই কী করব বলো। আমার ছেলেটা ও লেভেল পড়ে। বড় হচ্ছে, মেয়েটা তো এখন সুস্থ। ক্যানসার হয়েছিল। পুরো একটা বছর নষ্ট হলো।
মনোজ : কলকাতায় গিয়ে কী করবেন?
হরিপদ দত্ত : কিচ্ছু করব না। আমার যা প্রতিভা ছিল তা আমি মাতৃভূমিকে দিয়ে গেলাম।
0 মন্তব্যসমূহ