স্বপ্নময় চক্রবর্তী
সুখেন্দুবাবু আজ ৭৫ পেরোচ্ছেন। এটাকে কী বলে? হীরক জয়ন্তী নাকি সুবর্ণ জয়ন্তী? একটু গোলমাল হয়ে যাচ্ছে। এই বয়সে এসে অনেক কিছুই গণ্ডগোল হয়ে যায়। সৌরভের খেলা দেখতে দেখতে কিছুদিন আগে পঙ্কজ রায়ের কথা মনে এসেছিল, কিন্তু কিছুতেই পঙ্কজ রায় নামটা মনে পড়ছিল না। কুমোরটুলির ওই ছেলেটা, ওই যে, ওপেনার, রেকর্ড করেছিল...কী অস্বস্তিতে কেটেছে কিছুক্ষণ, তার পর এক বন্ধুকে ফোন করে নামটা জানল। সেই বন্ধুটিও আবার ক’দিন আগে ফোন করেছিল—শোন সুখেন্দু, খুব মুশকিলে পড়েছি, ওই নামটা কিছুতেই মনে আসছে না, অথচ আমি ওর কত বড় অ্যাডমায়ারার, ওই যে রে, কিউবার, মুখে দাঁড়ি, একা এখনও লড়ে যাচ্ছে। বুড়ো হয়েছে..।
ফিদেল কাস্ত্রো?
ওঃ, হ্যাঁ, বাঁচালি। কিছুতেই মনে পড়ছিল না রে...।
এরকম আর কী। এখন এরকমই হয়।
আজ সকাল থেকেই ‘সুবর্ণ’ না ‘হীরক’ খুঁজছেন সুখেন্দু। কিছু খুঁজে না পেলেই অভ্যেস-বশত যেমন স্ত্রীকে ডাকেন, সেভাবেই হাঁকলেন-‘শুনছ?’ দুবার ‘শুনছ’র উত্তর না পেয়ে সুখেন্দুর মনে পড়ল-সে তো নেই। একটু আসছি বলে আধ ঘণ্টা আগে বেরিয়েছে যে। বলেই গিয়েছিল, মনে পড়েনি তখন। বোধ হয় পুজো দিতে গেছে কোনও মন্দিরে। আজ জন্মদিন। হয়তো স্পেশাল পুজো।
ক’দিন আগে ওদের বিয়ের পঞ্চাশ বছর হল। বিয়ের তারিখটা এমন, যে ভুল হবার নয়। ১ জানুয়ারি। সেটা কী ছিল? সুবর্ণজয়ন্তী না? তবে ৭৫ হীরকই হবে। ডায়মন্ড জুবিলি।
বিয়ের পঞ্চাশ বছর পূর্তি বড় নীরবে কেটে গিয়েছিল। সেদিন সকালে উঠে আশাবরী খুব লজ্জা লজ্জা মুখ করে সুখেন্দুর দিকে তাকিয়ে হেসেছিল শুধু, তখন দাঁত পরা ছিল না। যে দুই বন্ধু বরযাত্রী গিয়েছিল, ওদের এক জন পৃথিবীতে নেই, অন্য জন টেলিফোনটা ঠিক করে ধরতে পারে না। টেলিফোনটার দিকে বারবার তাকাচ্ছিল সুখেন্দু, কোনও ক্রিং নেই। যে কাকগুলো রোজ সকালবেলা জলখাবারের জন্য জানালার কার্নিশে এসে ভিড় করে, তারা যেন একটু বেশি কা-কা করছিল। আশাবরী বলেছিল-অ্যাই তোরা জানলি কী করে রে?
মেয়েরা বাইরে থাকে। ওদেরও মনে ছিল না?
একটা সারপ্রাইজ দেবার ইচ্ছে বুকে নিয়ে সকালবেলা কলেজ স্ট্রিট গিয়েছিলেন সুখেন্দু। একটা বই কিনে দেবেন। পঁচিশ বছর আগে অফিসের লাইব্রেরি থেকে নিয়ে একটা বই পড়েছিলেন সুখেন্দু, ওর পঞ্চাশ বছর বয়স তখন। ভেবেছিলেন বইটা আশাবরীকে পড়াবেন। পঁচিশ বছর ধরে হয়ে ওঠেনি। বইয়ের দোকানে গিয়ে নামটাই ভুলে গেলেন। কী একটা নদীর নামে বই। নদীটার নামও বেশ সুন্দর। লেখকের নামও মনে পড়ছে না।
আশাবরী দীক্ষা নিয়েছেন। সুখেন্দু নেননি। আশাবরী টিভি খুলে এমন সব চ্যানেল দেখেন, যেখানে গুরুরা বক্তৃতা দেয়। যে সব বই পড়ে আশাবরী, মূলত ধর্মের বই। সুখেন্দু কিছুতেই ধর্মের বই কিনবেন না। বইয়ের দোকানে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়েছিলেন। কিন্তু ওই বইটার নাম মনে পড়ল না কিছুতেই। বেশ একটা মিষ্টি প্রেমের উপন্যাস সেটা। যুবা বয়সের প্রেম। শেষ পর্যন্ত আশাপূর্ণা দেবীর ‘সুবর্ণলতা’ কিনলেন, রঙিন কাগজে মুড়লেন, তার পর খুঁজে খুঁজে কিনলেন লবঙ্গলতিকা। আশা এতটা আশা করে নি। লবঙ্গলতিকা ওর খুব প্রিয়। বহুদিন খাওয়া হয়নি। সেদিন সুখেন্দু আশার গালটা টিপে দিয়েছিলেন। আশাবরী বললেন, অ্যাই, কী হচ্ছে, ঢং। দাঁতটা বেরিয়ে যাবে যে। তারপরই হাসি। মুখে আঁচল চাপা দিয়ে। বেশ কেটেছিল দিনটা।
কিন্তু আজ সেই ফুর্তিটা নেই। সিলভার-গোল্ড-প্লাটিনাম যাই হোক না কেন। অনেক দিন পৃথিবীকে দেখছেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ দেখলেন, সাইরেন, ব্ল্যাক-আউট, স্বাধীনতা, দেশভাগ, বিধান রায়, প্রফুল্ল সেন, জ্যোতি বসু, বুদ্ধদেব ভট্টাচায্যি, মমতা—বহুত হল। এবার বিদায়ের গান গাইতে পারলে হয়। অমনি মনে এল, একবার বিদায় দে মা ঘুরে আসি। এটা বিদায়ের গান মনে হচ্ছে বটে, আসলে এটা ফিরে আসার গান। আবার ঘুরে আসার কথা বলছে। তখন চিনতে যদি না পারিস মা দেখবি গলায় ফাঁসি।
টেলিফোনটার দিকে তাকাচ্ছেন বারবার। সকাল আটটা বেজে গেল। মেয়েরা ফোন করছে না কেন? দুটি মেয়ে সুখেন্দু বিশ্বাসের। বিয়ে দেওয়া হয়ে গেছে। একজন থাকে ব্যাঙ্গালোরে, অন্যজন দিল্লিতে। মেয়েরা কি ভুলে গেল? বিয়ের তারিখের মতোই জন্মদিনটিও ভুল হবার নয়। ৯ অগস্ট। ভারত ছাড়ো আন্দোলন শুরু। বাইরে এখন কামিনী। সাদা কামিনী ফুল। বর্ষার ফুল। দুটো কামিনী গাছ আছে ওদের বরাহনগরের বাড়িটার সামনে। সাদা হয়ে আছে। সকালবেলা চা করে দিয়েই আশা বেরিয়ে গেছে। আশা গেছে দক্ষিণেশ্বর কালীমন্দিরে। জন্মদিনের জন্য পুজো দিতে। বাড়িতে কেউ নেই। টেবিলে একটা পুরোনো খবরের কাগজ পাতা। খবরের কাগজে কোন বিস্ফোরণের ছবি। ধ্বংসস্তূপের সামনে একটি কিশোরীর অসহায় মুখ। কেবল রক্তমাখা মুখ, উল্টে থাকা শব-ইরাকে, আফগানিস্তানে, জঙ্গলমহলে, নানুরে, নরওয়েতে, ছত্তিশগড়ে..কেবল অসহায় মুখ। ফোন বেজে উঠল। হাসি হাসি মুখ করে ফোনটা ধরলেন।
- গুড মর্নিং। আমি আইসিআইসিআইয়ের পক্ষ থেকে বলছি।
- বলুন।
- আপনার তো দুটো বন্ড আছে।
- হ্যাঁ।
- আমরা আপনাকে একটা ক্রেডিট কার্ড দিতে চাই। কোনও সার্ভিস চার্জ লাগবে না।
- কিন্তু আমার তো ক্রেডিট কার্ড দরকার নেই ভাই-
- কিন্তু আজকের দিনে আমরা আপনাকে এই গিফট..
- তোমরা জানলে কী করে গো?
- কেন জানব না? আমাদের কাছে সব ডেটা আছে। আমরা আসছি। কিছু ফর্মালিটি আছে। করিয়ে নেব।
একেই বলে বিশ্বায়ন। ওদের কাছে ঠিকুজি কুষ্ঠি থাকে। ওরা সব জানে। কিন্তু ওরা যে আসবে। আইসিআইসিআই ব্যাংক। সুখেন্দু কী বলবে ওদের?
আজকের খবরের কাগজে বিধ্বস্ত মহিষপোঁতা গ্রাম। উত্তর ২৪ পরগনার। দুই পার্টির লড়াই। মস্তানেরা চারটে বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। একটা পোড়া বাঁশের খুঁটি ধরে দাঁড়িয়ে আছে এক কিশোরী। আর আছে মন্ত্রিবাণী।
রোজই খবরের কাগজে এই সব। রোজই টিভিতে এই সব। সব চ্যানেলেই ভেঙে পড়া বাড়ি, বোমের শব্দ, উড়োজাহাজ..।
ছোট জামাইটা দিল্লি আছে এখন। আগে মুম্বই ছিল। বিস্ফোরণের ঠিক চারদিন আগেই দিল্লিতে বদলি হয়েছে। ভাগ্যিস। হাত জোড় করে আকাশের দিকে তাকান সুখেন্দু। দোতলার জানালাটার সামনে দাঁড়ান।
এ বাড়ির জানালায় গ্রিল নেই, লোহার শিক। সুখেন্দু বিশ্বাসের বাবার তৈরি। বাড়িটা চার ভাগ হয়েছে। সুখেন্দুর ভাগে দোতলার দুটো ঘর। এক চিলতে বারান্দা আর একটু রান্না ঘর। আলাদা ঠাকুর ঘর নেই বলে শোবার ঘরের অনেকটাই ঠাকুর দেবতারা দখল করে নিয়েছেন। তবে পুরোনো আমলের বাড়ি বলে ঘরগুলো বড় বড়। উপরে কড়িকাঠ। ফোকরে চড়াইপাখি বাসা বাঁধে। চড়ুইদের ওড়াউড়ি দেখে অনেকটা সময় কেটে যায় সুখেন্দুর। সুখেন্দু এক মাসের উপর ঘরবন্দি। নিচে নামতে পারছেন না। একদিন ঘেমে গিয়েছিলেন হঠাৎ, বুকে খুব ব্যথা। একতলায় সুখেন্দুর ভাইপোরা থাকে। অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিল। এক সপ্তাহ ছিলেন হাসপাতালে। ওটা একটা ছোটখাটো হার্ট অ্যাটাক। সিঁড়ি দিয়ে ওটা নামা একদম বারণ।
সুখেন্দু বিশ্বাস চাকরি করতেন একটা সওদাগরি অফিসে। বাইশ বছর বয়সে ঢুকেছিলেন বত্রিশ টাকা বেতনে। অফিসে তখন সত্যিকারের সাদা চামড়ার সাহেব ছিল। রিটায়ার করার সময় আট হাজার টাকা বেতন ছিল। আলাদা বাড়িঘর করেননি। দুই মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন। পেনশন নেই, জমানো টাকার সুদে সংসার চলে। কিন্তু সুদের তো স্থিরতা নেই। কত কমে গেল। এখন একটু বেড়েছে।
ফোন এল।
কী গো, ঠিক আছ তো? আমি বুথ থেকে বলছি। পুজোর জিনিস কিনেছি। লম্বা লাইন।
টিভিতে নরওয়ের খবর। এরকম শান্ত দেশে? রক্তমাখা মানুষ। মানুষের আর্তনাদ, কান্না, মাথা চাপড়ানো এসবের ভাষা পৃথিবী জুড়ে একই রকম।
বেশ কিছুদিন কর্মচারী ইউনিয়ন করেছিলেন অফিসে। যৌবনে রবীন্দ্রনাথের আফ্রিকা, ওরা কাজ করে এই সব কবিতা আবৃত্তি করতেন। গলাটা বেশ উদাত্ত ছিল। তাই স্লোগানটাও ভালই দিতেন। প্রমোশন পেয়ে অফিসার হবার পর তেমন করে আর ইউনিয়ন করতেন না। সেই সময় কেনা বইটই কতদিন ধরে উপরের কুলুঙ্গিতে পড়ে আছে। আশা পুরোনো কাগজের সঙ্গে ওগুলোকে বিদায় করতে চেয়েছে। সুখেন্দু বলেছে থাক না, ওগুলো কি ক্ষতি করেছে কিছু? কত রাজনৈতিক বইও ওখানে রয়েছে ধুলোজমা।
আশা জানে সুখেন্দুর ঠাকুর দেবতার দিকে অত মতি নেই। আগে আগে একটু তক্কাতক্কি হত, কিন্তু এখন কিচ্ছু বলে না। আশা কত কী করে, সুখেন্দু কিছু বলে না। তাই আশাও ওসব নিয়ে পীড়াপীড়ি করে না।
পাড়ায় কী একটা চেঁচামিচি। সাত আটজন মানুষ বাড়ির তলায়। ভাইপোদের মধ্যে দুজন পার্টি নেতা। শাসক পার্টির। কী একটা নালিশের জন্যে এসেছে। বারান্দায় দাঁড়ালেন সুখেন্দু। দেখলেন ভাইপোরা রমুডা আর স্যান্ডো গেঞ্জি পরে বেরিয়ে এসেছে। সামনের সমবেত লোকজনদের নিয়ে সামনের বস্তিতে ঢুকল। তারপর বেরিয়ে এল। সুখেন্দু জিজ্ঞেস করলেন, কী হয়েছে রে বুলু? বুলু একটু উপরের দিকে তাকাল। খুব নিরাসক্তভাবে বলল, ও কিছু নয়। একটু পরেই সুখেন্দু দেখলেন বাইরের ওই লোকগুলো একটা রোগামতো পাজামা পরা খালিগায়ের মানুষকে হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে আসছে। লোকটাকে চেনেন না সুখেন্দু। টেনে নিয়ে কাছে দাঁড়ানো একটা ট্যাক্সিতে ঢুকিয়ে দিল। পিছন পিছন ছুটে আসছে বছর বারোর একটি মেয়ে। তুমুল কাঁদছে। ট্যাক্সিটা ছেড়ে দিল। মেয়েটা একটা চায়ের দোকানের বাঁশের খুঁটি ধরে আর্তনাদ করছে। আজকের খবরের কাগদে ধ্বংসস্তূপের সামনে স্তব্ধ দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটার মুখেরই কান্না শুনতে পেলেন সুখেন্দু। মেয়েটা একটু পরই ঘরে চলে যাবে। লোকটার কী হবে?
তক্ষুনি একটা মোটর সাইকেল দাঁড়াল সামনে। একটা স্মার্ট যুবক নামল। উপরের দিকে তাকিয়ে বলল, সুখেন্দু বিশ্বাস এই বাড়িতে থাকেন?
ছেলেটা আইসিআইসিআইয়ের। বয়স বাইশ/তেইশ হবে। গলায় টাই, হাতে ফাইল।
- নমস্কার। গত বছর এই দিনে আপনি পঁচিশ হাজার টাকার বন্ড কিনেছিলেন। আজ এক বছর হল। তাই একটা গিফট দিতে চাই আমরা।
- কী গিফট?
- একটা ক্রেডিট কার্ড।
একটা খবরের কাগজ মোড়া ফাইল খুলল ছেলেটি। খবরের কাগজে আগুনের ছবি। নিজভূমিতে অসহায় মানুষরা আগুনের পাশে হাত তুলে দাঁড়িয়ে আছে। কাগজটা হেলায় সরিয়ে ফাইল খুলল ছেলেটি।
- তুমি আইসিআইসিআইতে চাকরি কর?
- না, ডাইরেক্ট চাকরি নয়। একটা এজেন্সিতে আছি।
- আমার তো ক্রেডিট কার্ড দরকার নেই। রিটায়ার্ড লোক। কোথাও যাইটাই না। কী হবে ক্রেডিট কার্ড?
- খুব দরকার। ধরুন আপনাকে নার্সিং হোমে যেতে হল। এমার্জেন্সি। হাতে ক্যাশ টাকা নেই। তখন যদি...
- না ভাই। ও সব ক্রেডিট কার্ডের ঝামেলায় যাব না।
- ঝামেলা কেন বলছেন? ক্রেডিট কার্ড থাকলে তো ঝামেলা থেকে রিলিভ্ড হবেন...
- না রে ভাই। ও সব ভাল লাগে না। চারদিকে কী হচ্ছে দেখেছ?
- হ্যাঁ। তার সঙ্গে ক্রেডিট কার্ডের কী সম্পর্ক?
- মানে কিছুই ভাল লাগছে না বুঝলে! তোমরা তো খুব বাইরে বাইরে ঘোরো। খুব পোস্টার পড়েছে, না?
- কিসের পোস্টার?
- এইসব হানাহানি মারামারির বিরুদ্ধে? এই পার্টির লোক ওই পার্টির ছেলেদের মারছে, এইসবের বিরুদ্ধে...
- কই, তেমন কিছু দেখছি না তো! এখন তো সামনে ভোট নেই। পরিবর্তন তো হয়ে গেছে...।
- তাই? দেখছ না? আমিও দেখছিনা, বুঝলে। বারান্দায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে রাস্তার দেওয়ালগুলো দেখি। কই, এ পাড়ায় কিছুই চোখে পড়ে না। সব ঠিকঠাক হয়ে গেছে?
- দেয়ালে পোস্টার মেরে কি হানাহানি আটকানো যায় স্যার?
- তিরিশ-বত্রিশ বছর আগে, ভিয়েতনামের সময় কলকাতার সারা দেয়াল। তখন তোমার জন্মই হয়নি।
- ক্রেডিট কার্ডটা...
- শোনো, তোমরা তো খুব ঘোরাঘুরি করো। লোকজন সব কী বলছে?
- যারা ক্রেডিট কার্ড করে, তারা এ ব্যাপারে কই, তেমন কিছু বলছে না তো!
- তো সব পার্টির ছেলেরা কী করছে? ওরা কী করছে? তুমি কোথায় থাকো?
--দমদম। পূর্ব সিঁথি।
--কাছেই তো। তোমাদের পাড়া তো এককালে খুব ইয়ে ছিল। তোমাদের পাড়ায় পোস্টার পড়েনি?
--হ্যাঁ। পড়েছে তো। নতুন বাংলা গড়ার পোস্টার।
--তোমার কিছু মনে হয় না ভাই?
--কী নিয়ে?
--এই মারামারি নিয়ে? জঙ্গলমহলে মিছিমিছি মানুষকে মারছে। এই সব ফালতু লড়াই। এই মস্তানি। আমরা কত ইনসিকিওরড দেখো।
--এই জন্যই তো বলছি একটা ক্রেডিট কার্ড...
--ধুৎ, ক্রেডিট কার্ড, ক্রেডিট কার্ড। বললাম তো করব না।
--আচ্ছা, থাক। তা হলে আর একটা বন্ড কিনুন। দেখছেন তো মার্কেটের অবস্থা। সুদ এ বার কমে যাবে। এখনও আমরা ৯.৫% দিচ্ছি। ওটা ৫-এ এসে ঠেকবে।
--ব্যাস? এইটুকু? আর কিছু বলবে না? তোমরা তো ইয়ং ছেলে, একেবারে নির্লিপ্ত হয়ে রইলে? কোনও লড়াই নেই?
--তা কেন হবে স্যার? লড়াই মানে তো কত কিছু। লড়াই করতে করতে দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে আমার। গরমে টাই পরে গলায় ঘা। বিজনেস না দিতে পারলে তাড়িয়ে দেবে আমায়।
পোড়াখুঁটি ধরে দাঁড়ানো আরেকটা অসহায় মুখের প্রতিচ্ছবি দেখলেন সুখেন্দু।
--কী হল? কিছু করবেন না?
--সরি ভাই।
সুখেন্দু ঘড়িতে দেখলেন সাড়ে ন’টা। বর্ষার ভিজে বাতাস। এই ভিজে বাতাসে কোথাও যেন বারুদ মিশে আছে।
কাক ডাকছে বাইরে। আম্রশাখা দুলছে। একা সুখেন্দু ওর বাড়িতে। ঘরের দেওয়ালে বহুকাল চুনকাম হয়নি। দেয়াল জুড়ে খুঁটি ধরে দাঁড়াল কিশোর। দেয়াল ক্রমশ কমে আসছে। ছবির সংখ্যা বাড়ছে। লোকনাথবাবা আগে ছিল না। একটা যিশুর ছবিও নতুন এসেছে। টিভির সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিমূলক অনুষ্ঠানের ফল বোধ হয়। দুহাত তুলে দাঁড়ানো গৌরাঙ্গ মায়াপুর থেকে নিয়ে আসা। একটা কাচের একটা তাক ভর্তি শুধু আলতার শিশি আর সিঁদুরের কৌটোয়। প্রতি বছর পয়লা বৈশাখ আর বিজয়া দশমীতে নতুন আলতার শিশি আর সিঁদুরের কৌটো কেনা হয়। নিচ থেকেও আসে। আশা এখন আলতা পরে না। বছরে ওই দু-চার দিনই বোধ হয় পরে। কিন্তু শিশিগুলো জমছে। আলতার শিশি আর সিঁদুরের কৌটো ফেলতে নেই। গত পঞ্চাশ বছর ধরেই জমছে।
সুখেন্দু কী একটা ভাবলেন। দরজার ছিটকিনিটা দিয়ে দিলেন। তারপর আলমারি খুলে একটা আলতার শিশি বার করে নিলেন। সতী আলতা। পুরোনো খবরের কাগজ নিলেন একটা। ছোট বাটিতে আলতা ঢেলে দিলেন। লাল টুকটুকে। তারের মাথায় লাগানো তুলোর পুঁটলি।
কয়েক দিনের পুরোনো খবরের কাগজ। মুম্বই বিস্ফোরণের ছবি। তুলিতে আলতা ডুবিয়ে সুখেন্দু লিখলেন, অশান্তি চাই না। কতদিন পরে পোস্টার লিখলেন একটা। তার পরের লাইনে লিখলেন, আমার প্রতিবাদ। পাড়ায় শান্তি চাই।
হাত কাঁপছে। লেখাগুলো কাঁপছে। আগে কত লিখতেন। পোস্টার লেখায় সুনাম ছিল।
এর আগেও বহুবার পোস্টার লেখার জন্য মন আনচান করেছে। লেখেননি। আজকের ৭৫ বছরের জন্মদিনে ওর পঁচিশ বছর বয়সটাকে ফিরে পেতে চাইলেন সুখেন্দু।
আশা এসেছে বোধ হয়।
বাক্যটা পুরো হল না।
তাড়তাড়ি সতী আলতার মুখ বন্ধ করে বাটিটা বাক্সের ভিতরে ঢুকিয়ে শিশিটা আলমারিতে ঢোকালেন। কাগজটা শুকোয়নি। তবু ভাঁজ করলেন। তোশকের তলায় রাখলেন। এ সব তো একা একা করা যায়। আশা দেখলে আবার ছেলেমানুষি ভাববে। দরজা খুললেন। লালপেড়ে শাড়িতে আশা এসেছে। হাতে বাঁশের চুবড়ি। চুবড়ির উপরে ন্যাতানো জবা ফুল। ফুলটা সুখেন্দুর মাথায় ছোঁয়ালেন আশাবরী। সুখেন্দু জানে এবারই হাঁ করতে হবে। হাঁ করলেন। তারপরই যা হয়। মুখে একটু প্যাড়ার গুঁড়ো। এবার মুহূর্তের জন্য চোখ বুজলেন সুখেন্দু। এটা হল এতদিনের কমপ্রোমাইজমূলক নমস্কার। নমস্কারটা করা হল না, অথচ একটু ভক্তিও দেখানো হল।
আশা বলল-ওখান থেকে গরম কচুরি এনেছি কটা। ট্যাক্সিতে এলাম। গরম আছে। দক্ষিণেশ্বর গেছিলাম কি না...।
হাতমুখ ধুয়ে কচুরি সাজানো হল থালায়।
সুখেন্দু বললেন-মা কালীর কাছে কী চাইলে?
- বলতে নেই।
- শুধু আমার জন্যেই প্রার্থনা করলে, না কি.....
- কেন, মেয়ে জামাই, নাতি নাতনি....
- আর?
- আর আবার কী?
- এই যে ধরো মানুষ মারছে...
- আমি তো বললাম, মা সবাইকে শুভবুদ্ধি দাও।
- বেশ।
- বিকেলে বেরোব। কী নেবে বলো। লুঙ্গি?
- আছে।
- গেঞ্জি?
- বড়মেয়ে ছ’টা দিয়ে গেল না?
- কী চাও বলো তো? বলো না। ইচ্ছে করছে।
- আমার সব আছে।
- কী রান্না করব বলোতো?
- বলছিলে তো লাউচিংড়ি আর পোস্তর বড়া।
- আর কী খাবে?
- আদর।
- ঢং। পায়েস করব রাত্রে।
রাত্রে পায়েস হয়েছিল। বাঁধানো দাঁত খুলে তারিয়ে তারিয়ে। তার পর আশা বলেছিল, কাল তোমাকে এমন একটা জিনিস দেব না, জানি খুশি হবে তুমি। জন্মদিনের উপহার। যদিও একদিন পরে..।
- কী দেবে?
- বলব না।
আশাবরী বেশ ভোরে ওঠেন। শীলদের বাড়ির সামনে একটু বাগান আছে। ওখান থেকে ক’টা টগর আর করবী ফুল তুলে আনেন। আজও ভোরেই উঠেছিলেন। বোধ হয় একটু বেশি ভোরে। ফুল তুলবার আগে আর একটা কাজ করলেন উষার আলো অন্ধকারে। তার পর ফুল তুলে ঘরে এসে সারা মুখে ফুল ফুটিয়ে সুখেন্দুকে বললেন-এসো, বাইরে এসো...। ওই দ্যাখো..।
চিলতে বারান্দায় দাঁড়িয়ে সকালের আলোয় সুখেন্দু দেখলেন সতী-আলতায় লেখা কাঁপা হাতের ওই পোস্টার-অশান্তি চাই না। আমার প্রতিবাদ। বিবর্ণ ভোট দিন –এর পাশে কী রকম জ্বলজ্বল করছে ওটা।
রাইকিশোরী আশা ততক্ষণে দাঁত পরে নিয়ে হি হি হি হি। ৭৫ বছরও হেসে উঠল তখন
সুখেন্দুবাবু আজ ৭৫ পেরোচ্ছেন। এটাকে কী বলে? হীরক জয়ন্তী নাকি সুবর্ণ জয়ন্তী? একটু গোলমাল হয়ে যাচ্ছে। এই বয়সে এসে অনেক কিছুই গণ্ডগোল হয়ে যায়। সৌরভের খেলা দেখতে দেখতে কিছুদিন আগে পঙ্কজ রায়ের কথা মনে এসেছিল, কিন্তু কিছুতেই পঙ্কজ রায় নামটা মনে পড়ছিল না। কুমোরটুলির ওই ছেলেটা, ওই যে, ওপেনার, রেকর্ড করেছিল...কী অস্বস্তিতে কেটেছে কিছুক্ষণ, তার পর এক বন্ধুকে ফোন করে নামটা জানল। সেই বন্ধুটিও আবার ক’দিন আগে ফোন করেছিল—শোন সুখেন্দু, খুব মুশকিলে পড়েছি, ওই নামটা কিছুতেই মনে আসছে না, অথচ আমি ওর কত বড় অ্যাডমায়ারার, ওই যে রে, কিউবার, মুখে দাঁড়ি, একা এখনও লড়ে যাচ্ছে। বুড়ো হয়েছে..।
ফিদেল কাস্ত্রো?
ওঃ, হ্যাঁ, বাঁচালি। কিছুতেই মনে পড়ছিল না রে...।
এরকম আর কী। এখন এরকমই হয়।
আজ সকাল থেকেই ‘সুবর্ণ’ না ‘হীরক’ খুঁজছেন সুখেন্দু। কিছু খুঁজে না পেলেই অভ্যেস-বশত যেমন স্ত্রীকে ডাকেন, সেভাবেই হাঁকলেন-‘শুনছ?’ দুবার ‘শুনছ’র উত্তর না পেয়ে সুখেন্দুর মনে পড়ল-সে তো নেই। একটু আসছি বলে আধ ঘণ্টা আগে বেরিয়েছে যে। বলেই গিয়েছিল, মনে পড়েনি তখন। বোধ হয় পুজো দিতে গেছে কোনও মন্দিরে। আজ জন্মদিন। হয়তো স্পেশাল পুজো।
ক’দিন আগে ওদের বিয়ের পঞ্চাশ বছর হল। বিয়ের তারিখটা এমন, যে ভুল হবার নয়। ১ জানুয়ারি। সেটা কী ছিল? সুবর্ণজয়ন্তী না? তবে ৭৫ হীরকই হবে। ডায়মন্ড জুবিলি।
বিয়ের পঞ্চাশ বছর পূর্তি বড় নীরবে কেটে গিয়েছিল। সেদিন সকালে উঠে আশাবরী খুব লজ্জা লজ্জা মুখ করে সুখেন্দুর দিকে তাকিয়ে হেসেছিল শুধু, তখন দাঁত পরা ছিল না। যে দুই বন্ধু বরযাত্রী গিয়েছিল, ওদের এক জন পৃথিবীতে নেই, অন্য জন টেলিফোনটা ঠিক করে ধরতে পারে না। টেলিফোনটার দিকে বারবার তাকাচ্ছিল সুখেন্দু, কোনও ক্রিং নেই। যে কাকগুলো রোজ সকালবেলা জলখাবারের জন্য জানালার কার্নিশে এসে ভিড় করে, তারা যেন একটু বেশি কা-কা করছিল। আশাবরী বলেছিল-অ্যাই তোরা জানলি কী করে রে?
মেয়েরা বাইরে থাকে। ওদেরও মনে ছিল না?
একটা সারপ্রাইজ দেবার ইচ্ছে বুকে নিয়ে সকালবেলা কলেজ স্ট্রিট গিয়েছিলেন সুখেন্দু। একটা বই কিনে দেবেন। পঁচিশ বছর আগে অফিসের লাইব্রেরি থেকে নিয়ে একটা বই পড়েছিলেন সুখেন্দু, ওর পঞ্চাশ বছর বয়স তখন। ভেবেছিলেন বইটা আশাবরীকে পড়াবেন। পঁচিশ বছর ধরে হয়ে ওঠেনি। বইয়ের দোকানে গিয়ে নামটাই ভুলে গেলেন। কী একটা নদীর নামে বই। নদীটার নামও বেশ সুন্দর। লেখকের নামও মনে পড়ছে না।
আশাবরী দীক্ষা নিয়েছেন। সুখেন্দু নেননি। আশাবরী টিভি খুলে এমন সব চ্যানেল দেখেন, যেখানে গুরুরা বক্তৃতা দেয়। যে সব বই পড়ে আশাবরী, মূলত ধর্মের বই। সুখেন্দু কিছুতেই ধর্মের বই কিনবেন না। বইয়ের দোকানে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়েছিলেন। কিন্তু ওই বইটার নাম মনে পড়ল না কিছুতেই। বেশ একটা মিষ্টি প্রেমের উপন্যাস সেটা। যুবা বয়সের প্রেম। শেষ পর্যন্ত আশাপূর্ণা দেবীর ‘সুবর্ণলতা’ কিনলেন, রঙিন কাগজে মুড়লেন, তার পর খুঁজে খুঁজে কিনলেন লবঙ্গলতিকা। আশা এতটা আশা করে নি। লবঙ্গলতিকা ওর খুব প্রিয়। বহুদিন খাওয়া হয়নি। সেদিন সুখেন্দু আশার গালটা টিপে দিয়েছিলেন। আশাবরী বললেন, অ্যাই, কী হচ্ছে, ঢং। দাঁতটা বেরিয়ে যাবে যে। তারপরই হাসি। মুখে আঁচল চাপা দিয়ে। বেশ কেটেছিল দিনটা।
কিন্তু আজ সেই ফুর্তিটা নেই। সিলভার-গোল্ড-প্লাটিনাম যাই হোক না কেন। অনেক দিন পৃথিবীকে দেখছেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ দেখলেন, সাইরেন, ব্ল্যাক-আউট, স্বাধীনতা, দেশভাগ, বিধান রায়, প্রফুল্ল সেন, জ্যোতি বসু, বুদ্ধদেব ভট্টাচায্যি, মমতা—বহুত হল। এবার বিদায়ের গান গাইতে পারলে হয়। অমনি মনে এল, একবার বিদায় দে মা ঘুরে আসি। এটা বিদায়ের গান মনে হচ্ছে বটে, আসলে এটা ফিরে আসার গান। আবার ঘুরে আসার কথা বলছে। তখন চিনতে যদি না পারিস মা দেখবি গলায় ফাঁসি।
টেলিফোনটার দিকে তাকাচ্ছেন বারবার। সকাল আটটা বেজে গেল। মেয়েরা ফোন করছে না কেন? দুটি মেয়ে সুখেন্দু বিশ্বাসের। বিয়ে দেওয়া হয়ে গেছে। একজন থাকে ব্যাঙ্গালোরে, অন্যজন দিল্লিতে। মেয়েরা কি ভুলে গেল? বিয়ের তারিখের মতোই জন্মদিনটিও ভুল হবার নয়। ৯ অগস্ট। ভারত ছাড়ো আন্দোলন শুরু। বাইরে এখন কামিনী। সাদা কামিনী ফুল। বর্ষার ফুল। দুটো কামিনী গাছ আছে ওদের বরাহনগরের বাড়িটার সামনে। সাদা হয়ে আছে। সকালবেলা চা করে দিয়েই আশা বেরিয়ে গেছে। আশা গেছে দক্ষিণেশ্বর কালীমন্দিরে। জন্মদিনের জন্য পুজো দিতে। বাড়িতে কেউ নেই। টেবিলে একটা পুরোনো খবরের কাগজ পাতা। খবরের কাগজে কোন বিস্ফোরণের ছবি। ধ্বংসস্তূপের সামনে একটি কিশোরীর অসহায় মুখ। কেবল রক্তমাখা মুখ, উল্টে থাকা শব-ইরাকে, আফগানিস্তানে, জঙ্গলমহলে, নানুরে, নরওয়েতে, ছত্তিশগড়ে..কেবল অসহায় মুখ। ফোন বেজে উঠল। হাসি হাসি মুখ করে ফোনটা ধরলেন।
- গুড মর্নিং। আমি আইসিআইসিআইয়ের পক্ষ থেকে বলছি।
- বলুন।
- আপনার তো দুটো বন্ড আছে।
- হ্যাঁ।
- আমরা আপনাকে একটা ক্রেডিট কার্ড দিতে চাই। কোনও সার্ভিস চার্জ লাগবে না।
- কিন্তু আমার তো ক্রেডিট কার্ড দরকার নেই ভাই-
- কিন্তু আজকের দিনে আমরা আপনাকে এই গিফট..
- তোমরা জানলে কী করে গো?
- কেন জানব না? আমাদের কাছে সব ডেটা আছে। আমরা আসছি। কিছু ফর্মালিটি আছে। করিয়ে নেব।
একেই বলে বিশ্বায়ন। ওদের কাছে ঠিকুজি কুষ্ঠি থাকে। ওরা সব জানে। কিন্তু ওরা যে আসবে। আইসিআইসিআই ব্যাংক। সুখেন্দু কী বলবে ওদের?
আজকের খবরের কাগজে বিধ্বস্ত মহিষপোঁতা গ্রাম। উত্তর ২৪ পরগনার। দুই পার্টির লড়াই। মস্তানেরা চারটে বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। একটা পোড়া বাঁশের খুঁটি ধরে দাঁড়িয়ে আছে এক কিশোরী। আর আছে মন্ত্রিবাণী।
রোজই খবরের কাগজে এই সব। রোজই টিভিতে এই সব। সব চ্যানেলেই ভেঙে পড়া বাড়ি, বোমের শব্দ, উড়োজাহাজ..।
ছোট জামাইটা দিল্লি আছে এখন। আগে মুম্বই ছিল। বিস্ফোরণের ঠিক চারদিন আগেই দিল্লিতে বদলি হয়েছে। ভাগ্যিস। হাত জোড় করে আকাশের দিকে তাকান সুখেন্দু। দোতলার জানালাটার সামনে দাঁড়ান।
এ বাড়ির জানালায় গ্রিল নেই, লোহার শিক। সুখেন্দু বিশ্বাসের বাবার তৈরি। বাড়িটা চার ভাগ হয়েছে। সুখেন্দুর ভাগে দোতলার দুটো ঘর। এক চিলতে বারান্দা আর একটু রান্না ঘর। আলাদা ঠাকুর ঘর নেই বলে শোবার ঘরের অনেকটাই ঠাকুর দেবতারা দখল করে নিয়েছেন। তবে পুরোনো আমলের বাড়ি বলে ঘরগুলো বড় বড়। উপরে কড়িকাঠ। ফোকরে চড়াইপাখি বাসা বাঁধে। চড়ুইদের ওড়াউড়ি দেখে অনেকটা সময় কেটে যায় সুখেন্দুর। সুখেন্দু এক মাসের উপর ঘরবন্দি। নিচে নামতে পারছেন না। একদিন ঘেমে গিয়েছিলেন হঠাৎ, বুকে খুব ব্যথা। একতলায় সুখেন্দুর ভাইপোরা থাকে। অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিল। এক সপ্তাহ ছিলেন হাসপাতালে। ওটা একটা ছোটখাটো হার্ট অ্যাটাক। সিঁড়ি দিয়ে ওটা নামা একদম বারণ।
সুখেন্দু বিশ্বাস চাকরি করতেন একটা সওদাগরি অফিসে। বাইশ বছর বয়সে ঢুকেছিলেন বত্রিশ টাকা বেতনে। অফিসে তখন সত্যিকারের সাদা চামড়ার সাহেব ছিল। রিটায়ার করার সময় আট হাজার টাকা বেতন ছিল। আলাদা বাড়িঘর করেননি। দুই মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন। পেনশন নেই, জমানো টাকার সুদে সংসার চলে। কিন্তু সুদের তো স্থিরতা নেই। কত কমে গেল। এখন একটু বেড়েছে।
ফোন এল।
কী গো, ঠিক আছ তো? আমি বুথ থেকে বলছি। পুজোর জিনিস কিনেছি। লম্বা লাইন।
টিভিতে নরওয়ের খবর। এরকম শান্ত দেশে? রক্তমাখা মানুষ। মানুষের আর্তনাদ, কান্না, মাথা চাপড়ানো এসবের ভাষা পৃথিবী জুড়ে একই রকম।
বেশ কিছুদিন কর্মচারী ইউনিয়ন করেছিলেন অফিসে। যৌবনে রবীন্দ্রনাথের আফ্রিকা, ওরা কাজ করে এই সব কবিতা আবৃত্তি করতেন। গলাটা বেশ উদাত্ত ছিল। তাই স্লোগানটাও ভালই দিতেন। প্রমোশন পেয়ে অফিসার হবার পর তেমন করে আর ইউনিয়ন করতেন না। সেই সময় কেনা বইটই কতদিন ধরে উপরের কুলুঙ্গিতে পড়ে আছে। আশা পুরোনো কাগজের সঙ্গে ওগুলোকে বিদায় করতে চেয়েছে। সুখেন্দু বলেছে থাক না, ওগুলো কি ক্ষতি করেছে কিছু? কত রাজনৈতিক বইও ওখানে রয়েছে ধুলোজমা।
আশা জানে সুখেন্দুর ঠাকুর দেবতার দিকে অত মতি নেই। আগে আগে একটু তক্কাতক্কি হত, কিন্তু এখন কিচ্ছু বলে না। আশা কত কী করে, সুখেন্দু কিছু বলে না। তাই আশাও ওসব নিয়ে পীড়াপীড়ি করে না।
পাড়ায় কী একটা চেঁচামিচি। সাত আটজন মানুষ বাড়ির তলায়। ভাইপোদের মধ্যে দুজন পার্টি নেতা। শাসক পার্টির। কী একটা নালিশের জন্যে এসেছে। বারান্দায় দাঁড়ালেন সুখেন্দু। দেখলেন ভাইপোরা রমুডা আর স্যান্ডো গেঞ্জি পরে বেরিয়ে এসেছে। সামনের সমবেত লোকজনদের নিয়ে সামনের বস্তিতে ঢুকল। তারপর বেরিয়ে এল। সুখেন্দু জিজ্ঞেস করলেন, কী হয়েছে রে বুলু? বুলু একটু উপরের দিকে তাকাল। খুব নিরাসক্তভাবে বলল, ও কিছু নয়। একটু পরেই সুখেন্দু দেখলেন বাইরের ওই লোকগুলো একটা রোগামতো পাজামা পরা খালিগায়ের মানুষকে হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে আসছে। লোকটাকে চেনেন না সুখেন্দু। টেনে নিয়ে কাছে দাঁড়ানো একটা ট্যাক্সিতে ঢুকিয়ে দিল। পিছন পিছন ছুটে আসছে বছর বারোর একটি মেয়ে। তুমুল কাঁদছে। ট্যাক্সিটা ছেড়ে দিল। মেয়েটা একটা চায়ের দোকানের বাঁশের খুঁটি ধরে আর্তনাদ করছে। আজকের খবরের কাগদে ধ্বংসস্তূপের সামনে স্তব্ধ দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটার মুখেরই কান্না শুনতে পেলেন সুখেন্দু। মেয়েটা একটু পরই ঘরে চলে যাবে। লোকটার কী হবে?
তক্ষুনি একটা মোটর সাইকেল দাঁড়াল সামনে। একটা স্মার্ট যুবক নামল। উপরের দিকে তাকিয়ে বলল, সুখেন্দু বিশ্বাস এই বাড়িতে থাকেন?
ছেলেটা আইসিআইসিআইয়ের। বয়স বাইশ/তেইশ হবে। গলায় টাই, হাতে ফাইল।
- নমস্কার। গত বছর এই দিনে আপনি পঁচিশ হাজার টাকার বন্ড কিনেছিলেন। আজ এক বছর হল। তাই একটা গিফট দিতে চাই আমরা।
- কী গিফট?
- একটা ক্রেডিট কার্ড।
একটা খবরের কাগজ মোড়া ফাইল খুলল ছেলেটি। খবরের কাগজে আগুনের ছবি। নিজভূমিতে অসহায় মানুষরা আগুনের পাশে হাত তুলে দাঁড়িয়ে আছে। কাগজটা হেলায় সরিয়ে ফাইল খুলল ছেলেটি।
- তুমি আইসিআইসিআইতে চাকরি কর?
- না, ডাইরেক্ট চাকরি নয়। একটা এজেন্সিতে আছি।
- আমার তো ক্রেডিট কার্ড দরকার নেই। রিটায়ার্ড লোক। কোথাও যাইটাই না। কী হবে ক্রেডিট কার্ড?
- খুব দরকার। ধরুন আপনাকে নার্সিং হোমে যেতে হল। এমার্জেন্সি। হাতে ক্যাশ টাকা নেই। তখন যদি...
- না ভাই। ও সব ক্রেডিট কার্ডের ঝামেলায় যাব না।
- ঝামেলা কেন বলছেন? ক্রেডিট কার্ড থাকলে তো ঝামেলা থেকে রিলিভ্ড হবেন...
- না রে ভাই। ও সব ভাল লাগে না। চারদিকে কী হচ্ছে দেখেছ?
- হ্যাঁ। তার সঙ্গে ক্রেডিট কার্ডের কী সম্পর্ক?
- মানে কিছুই ভাল লাগছে না বুঝলে! তোমরা তো খুব বাইরে বাইরে ঘোরো। খুব পোস্টার পড়েছে, না?
- কিসের পোস্টার?
- এইসব হানাহানি মারামারির বিরুদ্ধে? এই পার্টির লোক ওই পার্টির ছেলেদের মারছে, এইসবের বিরুদ্ধে...
- কই, তেমন কিছু দেখছি না তো! এখন তো সামনে ভোট নেই। পরিবর্তন তো হয়ে গেছে...।
- তাই? দেখছ না? আমিও দেখছিনা, বুঝলে। বারান্দায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে রাস্তার দেওয়ালগুলো দেখি। কই, এ পাড়ায় কিছুই চোখে পড়ে না। সব ঠিকঠাক হয়ে গেছে?
- দেয়ালে পোস্টার মেরে কি হানাহানি আটকানো যায় স্যার?
- তিরিশ-বত্রিশ বছর আগে, ভিয়েতনামের সময় কলকাতার সারা দেয়াল। তখন তোমার জন্মই হয়নি।
- ক্রেডিট কার্ডটা...
- শোনো, তোমরা তো খুব ঘোরাঘুরি করো। লোকজন সব কী বলছে?
- যারা ক্রেডিট কার্ড করে, তারা এ ব্যাপারে কই, তেমন কিছু বলছে না তো!
- তো সব পার্টির ছেলেরা কী করছে? ওরা কী করছে? তুমি কোথায় থাকো?
--দমদম। পূর্ব সিঁথি।
--কাছেই তো। তোমাদের পাড়া তো এককালে খুব ইয়ে ছিল। তোমাদের পাড়ায় পোস্টার পড়েনি?
--হ্যাঁ। পড়েছে তো। নতুন বাংলা গড়ার পোস্টার।
--তোমার কিছু মনে হয় না ভাই?
--কী নিয়ে?
--এই মারামারি নিয়ে? জঙ্গলমহলে মিছিমিছি মানুষকে মারছে। এই সব ফালতু লড়াই। এই মস্তানি। আমরা কত ইনসিকিওরড দেখো।
--এই জন্যই তো বলছি একটা ক্রেডিট কার্ড...
--ধুৎ, ক্রেডিট কার্ড, ক্রেডিট কার্ড। বললাম তো করব না।
--আচ্ছা, থাক। তা হলে আর একটা বন্ড কিনুন। দেখছেন তো মার্কেটের অবস্থা। সুদ এ বার কমে যাবে। এখনও আমরা ৯.৫% দিচ্ছি। ওটা ৫-এ এসে ঠেকবে।
--ব্যাস? এইটুকু? আর কিছু বলবে না? তোমরা তো ইয়ং ছেলে, একেবারে নির্লিপ্ত হয়ে রইলে? কোনও লড়াই নেই?
--তা কেন হবে স্যার? লড়াই মানে তো কত কিছু। লড়াই করতে করতে দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে আমার। গরমে টাই পরে গলায় ঘা। বিজনেস না দিতে পারলে তাড়িয়ে দেবে আমায়।
পোড়াখুঁটি ধরে দাঁড়ানো আরেকটা অসহায় মুখের প্রতিচ্ছবি দেখলেন সুখেন্দু।
--কী হল? কিছু করবেন না?
--সরি ভাই।
সুখেন্দু ঘড়িতে দেখলেন সাড়ে ন’টা। বর্ষার ভিজে বাতাস। এই ভিজে বাতাসে কোথাও যেন বারুদ মিশে আছে।
কাক ডাকছে বাইরে। আম্রশাখা দুলছে। একা সুখেন্দু ওর বাড়িতে। ঘরের দেওয়ালে বহুকাল চুনকাম হয়নি। দেয়াল জুড়ে খুঁটি ধরে দাঁড়াল কিশোর। দেয়াল ক্রমশ কমে আসছে। ছবির সংখ্যা বাড়ছে। লোকনাথবাবা আগে ছিল না। একটা যিশুর ছবিও নতুন এসেছে। টিভির সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিমূলক অনুষ্ঠানের ফল বোধ হয়। দুহাত তুলে দাঁড়ানো গৌরাঙ্গ মায়াপুর থেকে নিয়ে আসা। একটা কাচের একটা তাক ভর্তি শুধু আলতার শিশি আর সিঁদুরের কৌটোয়। প্রতি বছর পয়লা বৈশাখ আর বিজয়া দশমীতে নতুন আলতার শিশি আর সিঁদুরের কৌটো কেনা হয়। নিচ থেকেও আসে। আশা এখন আলতা পরে না। বছরে ওই দু-চার দিনই বোধ হয় পরে। কিন্তু শিশিগুলো জমছে। আলতার শিশি আর সিঁদুরের কৌটো ফেলতে নেই। গত পঞ্চাশ বছর ধরেই জমছে।
সুখেন্দু কী একটা ভাবলেন। দরজার ছিটকিনিটা দিয়ে দিলেন। তারপর আলমারি খুলে একটা আলতার শিশি বার করে নিলেন। সতী আলতা। পুরোনো খবরের কাগজ নিলেন একটা। ছোট বাটিতে আলতা ঢেলে দিলেন। লাল টুকটুকে। তারের মাথায় লাগানো তুলোর পুঁটলি।
কয়েক দিনের পুরোনো খবরের কাগজ। মুম্বই বিস্ফোরণের ছবি। তুলিতে আলতা ডুবিয়ে সুখেন্দু লিখলেন, অশান্তি চাই না। কতদিন পরে পোস্টার লিখলেন একটা। তার পরের লাইনে লিখলেন, আমার প্রতিবাদ। পাড়ায় শান্তি চাই।
হাত কাঁপছে। লেখাগুলো কাঁপছে। আগে কত লিখতেন। পোস্টার লেখায় সুনাম ছিল।
এর আগেও বহুবার পোস্টার লেখার জন্য মন আনচান করেছে। লেখেননি। আজকের ৭৫ বছরের জন্মদিনে ওর পঁচিশ বছর বয়সটাকে ফিরে পেতে চাইলেন সুখেন্দু।
আশা এসেছে বোধ হয়।
বাক্যটা পুরো হল না।
তাড়তাড়ি সতী আলতার মুখ বন্ধ করে বাটিটা বাক্সের ভিতরে ঢুকিয়ে শিশিটা আলমারিতে ঢোকালেন। কাগজটা শুকোয়নি। তবু ভাঁজ করলেন। তোশকের তলায় রাখলেন। এ সব তো একা একা করা যায়। আশা দেখলে আবার ছেলেমানুষি ভাববে। দরজা খুললেন। লালপেড়ে শাড়িতে আশা এসেছে। হাতে বাঁশের চুবড়ি। চুবড়ির উপরে ন্যাতানো জবা ফুল। ফুলটা সুখেন্দুর মাথায় ছোঁয়ালেন আশাবরী। সুখেন্দু জানে এবারই হাঁ করতে হবে। হাঁ করলেন। তারপরই যা হয়। মুখে একটু প্যাড়ার গুঁড়ো। এবার মুহূর্তের জন্য চোখ বুজলেন সুখেন্দু। এটা হল এতদিনের কমপ্রোমাইজমূলক নমস্কার। নমস্কারটা করা হল না, অথচ একটু ভক্তিও দেখানো হল।
আশা বলল-ওখান থেকে গরম কচুরি এনেছি কটা। ট্যাক্সিতে এলাম। গরম আছে। দক্ষিণেশ্বর গেছিলাম কি না...।
হাতমুখ ধুয়ে কচুরি সাজানো হল থালায়।
সুখেন্দু বললেন-মা কালীর কাছে কী চাইলে?
- বলতে নেই।
- শুধু আমার জন্যেই প্রার্থনা করলে, না কি.....
- কেন, মেয়ে জামাই, নাতি নাতনি....
- আর?
- আর আবার কী?
- এই যে ধরো মানুষ মারছে...
- আমি তো বললাম, মা সবাইকে শুভবুদ্ধি দাও।
- বেশ।
- বিকেলে বেরোব। কী নেবে বলো। লুঙ্গি?
- আছে।
- গেঞ্জি?
- বড়মেয়ে ছ’টা দিয়ে গেল না?
- কী চাও বলো তো? বলো না। ইচ্ছে করছে।
- আমার সব আছে।
- কী রান্না করব বলোতো?
- বলছিলে তো লাউচিংড়ি আর পোস্তর বড়া।
- আর কী খাবে?
- আদর।
- ঢং। পায়েস করব রাত্রে।
রাত্রে পায়েস হয়েছিল। বাঁধানো দাঁত খুলে তারিয়ে তারিয়ে। তার পর আশা বলেছিল, কাল তোমাকে এমন একটা জিনিস দেব না, জানি খুশি হবে তুমি। জন্মদিনের উপহার। যদিও একদিন পরে..।
- কী দেবে?
- বলব না।
আশাবরী বেশ ভোরে ওঠেন। শীলদের বাড়ির সামনে একটু বাগান আছে। ওখান থেকে ক’টা টগর আর করবী ফুল তুলে আনেন। আজও ভোরেই উঠেছিলেন। বোধ হয় একটু বেশি ভোরে। ফুল তুলবার আগে আর একটা কাজ করলেন উষার আলো অন্ধকারে। তার পর ফুল তুলে ঘরে এসে সারা মুখে ফুল ফুটিয়ে সুখেন্দুকে বললেন-এসো, বাইরে এসো...। ওই দ্যাখো..।
চিলতে বারান্দায় দাঁড়িয়ে সকালের আলোয় সুখেন্দু দেখলেন সতী-আলতায় লেখা কাঁপা হাতের ওই পোস্টার-অশান্তি চাই না। আমার প্রতিবাদ। বিবর্ণ ভোট দিন –এর পাশে কী রকম জ্বলজ্বল করছে ওটা।
রাইকিশোরী আশা ততক্ষণে দাঁত পরে নিয়ে হি হি হি হি। ৭৫ বছরও হেসে উঠল তখন
1 মন্তব্যসমূহ
beautiful story
উত্তরমুছুন