কুলদা রায়
গল্পপাঠ:
চারিদিকের রোদের হাহাকারে
গল্পকার : নাহার মনিকা

বারেক খলিফা—জামাকাপড় বানায়। দূর সম্পর্কের আত্মীয় মুরাদের পরিচয়ের সুবাদের চিনিকলের অফিসারদের বেশ কিছু অর্ডার পেতে শুরু করেছে বারেক।
মুরাদের বাসা চিনিকলের কোয়ার্টারে। পশ্চিম পাকিস্তানের খানে-অফিসাররা এপ্রিল থেকে জুন মাসের মধ্যে কোয়ার্টার ছেড়ে চলে গেছে। পাকিস্তানী মিলিটারীর কনভয় চিনিকলের গেস্ট হাউসে আস্তানা গাড়লে মুরাদের পরিবারে আতংক জাগে। মুরাদ তার বউ আর মেয়ে দুটিকে নিয়ে শহরতলিতে খলিফা বারেকের বাড়িতে চলে এসেছে।
‘দিন সাতেক থাকার পরে বারেকের বাড়িটিতে নিরাপদ বোধ হয় না। বারেকের পরিবারসহ তারা বারো মাইল দূরের রহিমানপুর গ্রামের দিকে রওনা করেছে ভোররাতে। গল্পকার লিখেছেন—উঠোনে যথাসম্ভব নিচুস্বরে রেখে মালপত্র তোলা হচ্ছে। পেয়ারাগাছের ঝুঁকে আসা ছায়ায় আবছা অন্ধকারে মানুষগুলোকে আধিভৌতিক লাগে। এই পর্যন্ত পড়ে শ্বাস ঘণ হয়ে আসে আমার। মানুষের নিচুস্বর, পেয়ারাগাছের ছায়া, জ্যান্ত মানুষের আধিভৌতিক হয়ে ওঠার মধ্যে দিয়ে আটজন মাত্র মানুষ নয়—সাড়ে সাত কোটি মানুষকে দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। তারা সেকালে স্বাভাবিক নেই। কলেপড়া ইঁদুরের মত তাদের প্রাণ বিপন্ন।
বারেকের স্ত্রী সাফিয়া তাদের দুধেল গরুটিকে মতির মায়ের কাছে সঁপে যাচ্ছে। মতির মা বলছে—তারা বাঁচলে এই গরুটিও বাঁচবে। ইঞ্জিনিয়ার মুরাদ, খলিফা দোকানী বারেকের চলে যাওয়ার সুযোগ থাকলেও বাড়ি বাড়ি কাজ করে চলা মতির মা যাচ্ছে না। যাওয়ার উপায় নেই। তিনটি বিত্তের মানুষ এক ধরণের জীবন বেছে নিতে পারে না।
আগস্ট মাসের দুপুর দীর্ঘ আর পৌরুষময়। এর মধ্যে এই আটজন হেঁটে হেঁটে একটি ছোটো নদীর পাড়ে এসেছে। শ্রাবণ বলেই নদীটি একটু স্রোতস্বিনী। তবুও সবাই সাঁতরেই নদীটি পার হতে পেরেছে। শুধু শিরিন ছাড়া।
শিরিন মুরাদের বউ -- আট মাসের পোয়াতি। তাকে মুরাদ কোলে আধশোয়া করে পানিতে ভাসিয়ে নিচ্ছে। পানির মধ্যে ভেসে আসার সময়ই শিরিন বুঝতে পারে তার প্রসব সময় আসন্ন। তাকে তড়িঘড়ি করে ঘাসের উপরে একটা কাথা বিছিয়ে দেওয়া হয়েছে। শিরিনের স্খলিত পেটের চামড়া ভেদ করে শিশুর কনুই কিংবা হাঁটুর ছাপ বেশ স্পষ্ট। এ সময় ডাক্তার অথবা ধাত্রীর দরকার। সে সুযোগ নেই।
ছোটো মেয়ে দুটি একটু তফাতে বসে আছে। মুরাদ একটি শাড়ি ঘিরে দেয়। সেখানে মুহূর্তের জন্য শিরিন মূর্ছা যায়, আবার জেগে ওঠে।
এইটুকুই লিখেছেন গল্পকার। এর পরে আর কিছু নেই। বোঝার কোনো উপায় থাকে না--শিরিনের ছেলে হল কি মেয়ে হল, জীবিত হল কি মৃত হল, শিরিন বেঁচে ছিল কি মরে গেল। এটার বলার কোনো ইচ্ছে বা চেষ্টা গল্পকারের নেই। দরকারও তার বোধ হয় না। পড়ে আমি দাঁড়িয়ে পড়ি। মাথার ভেতরে রক্ত ছলকে ওঠে। বুঝতে পারি—এই মাত্র একটি বিপন্নকালের মধ্যে চলে গিয়েছিলাম। সেখানে আমার শ্বাসরোধ হয়ে গেছে। আমাকেও গভীর এক সমষ্টিগত বিপন্নতা গ্রাস করেছে।
এই গল্পটির নাম চারিদিকের রোদের হাহাকার। শুরু হয়েছিল একটি কবিতার কয়েকটি পঙক্তি দিয়ে। শেষ হয়েছে খরখরে এক কঠিন গদ্যের হাহাকার দিয়ে। এই হাহাকারে পৌঁছে দিতে গল্পকার কোনো টেনশন তৈরী করেননি—তৈরী করেননি আখ্যানের কোনো জটিল ফাঁদ। নির্মেদ সহজ সরল ভঙ্গীতে তিনি একটানা একটা পলায়ন যাত্রার বর্ণনা দিয়ে গেছেন। কোনো বাড়তি শব্দ, বাক্যি বা আবেগ গুঁজে দেননি। তার বলার স্বর এতো স্বাভাবিক ছাঁদে রেখেছেন যে কোথাও তা ঠেলে ওঠেনি—কোথাও নেমে যায়নি।
সৎ বা অসৎ কোনো উদ্দেশ্যসাধন করতেও গল্পকার এ আখ্যানটুকু বলেননি। পুরো আখ্যানটির মধ্যে কোনো অতিনাটকীয়তা নেই বলেই এই গল্পের স্থাল-কাল বা পাত্রকে সত্যি বলেই মনে হয়। কখনও মনে হয় না গল্পকার বিশেষ কোনো চরিত্রের প্রতি পক্ষপাত করছেন—কোনো ঘটনাকে পাঠকের মগজের ভেতরে জোর করে ঢুকিয়ে দিতে চাইছেন। অথচ এই গল্পের প্রতিটি চরিত্রের মধ্যেই গল্পকার আছেন চরিত্রটি হয়ে। চরিত্রটিকে লেখক করে তোলেননি।
গল্পটির মধ্যে লেখকের কোনো আবেগ নেই। তিনি শুধু তথ্য দিয়ে গেছেন। তার নিজের ভাষাভঙ্গীটিই এই তথ্যের ভেতর থেকে একটি মহৎ গল্পকে বের করে এনেছে। পড়ে অনায়াসে বুঝতে পারি গল্পকার আয়োজন করে লেখেন না। লেখাটি পড়া শেষে পাঠকের মধ্যে একটি বিশেষ আয়োজন সৃষ্টি হয়ে যায়।
এই গল্পের তুল্য গল্প বাংলাদেশে খুব বেশী নেই। এই বিরলপ্রজ গল্পকারের নাম নাহার মনিকা। মার্কেজ যে রকম করে বলেন তিনি সে রকম গল্পের ছুতোর মিস্ত্রী। কাঠ খুঁড়ে নৌকা বানাতে পারেন। সে নৌকায় সাগর পাড়ি দেওয়া যায়।
গল্পকার নাহার মনিকা, আপনাকে প্রণাম জানাই।
0 মন্তব্যসমূহ