কুলদা রায়
১.
আমার সবচেয়ে প্রিয় গল্পটির নাম
আত্মজা ও একটি করবী গাছ। প্রিয় গল্পকার হাসান আজিজুল হক। এই রকম গল্প একদিনে লেখা
যায় না। একা লেখা যায় না। বংশপরম্পরায় লিখতে হয়। একটি জনপদের সবাই মিলেই
লেখেন।
এই গল্পটি যখন আমার মুদিদোকানী
বাবা কাজের ফাঁকে ফাঁকে পড়তেন--স্পষ্টভাবে দেখতে পেতাম, বাবার শ্বাস
ঘন হয়ে পড়ছে। নাকের ডগা লাল হয়ে উঠেছে। পড়া শেষ হলে দপদপিয়ে মুদিখানা থেকে
বেরিয়ে পড়েছেন। কোন কথা বলতে পারছেন না। পারলে রাস্তাটিকে ধরে আকাশের ওপারে
ছুড়ে মারতেন।
সে সময় আমাদের পাড়ায় কয়েকটা
করবী ফুলের গাছ ছিল। ফুলগুলো লাল হত না—হলুদ হয়ে ফুটত।
ফুলটির নাম যে করবী এটা কেউ জানত না। সবাই বলত কলকি ফুল। এই কলকি ফুল তুলতে নেই।
একদিন আমার মেজোদিদি একটি কলকি
ফুলের গাছ এনে আমাদের মন্দিরের সামনে লাগিয়েছিল। গাছটি তুলে ফেলেছিল আমার মা।
রেগেমেগে বলেছিল, সংসারে কি অ্যালফ্যাল আনতি চাও নাকিরে মাইয়া?
এরপর গাছটি বহুদিন পড়েছিল
নিমতলার পাশে। সেখান থেকে বেলতলার নিচে। শুকিয়ে ঠ্যানঠ্যানে হয়ে পড়েছিল। তারপর
পুকুরপাড়ে ছুড়ে ফেলেছিল।
এই পুকুরপাড়ে আমাদের পাড়ার
জেঠীকাকীরা প্রতিদিন সকালে থালাবাসন মাজতেন। মাজতে মাজতে তাদের মাজা ধরে আসত। জল
দিয়ে চোখ থেকে জল মুছে দিতেন। মুখে জল নিয়ে কুলকুচা করে উঠে পড়তেন। মাঝে মাঝে
সেই কুলকুচা এসে পড়ত পাড়ের দিকে। আর সেই থেকেই আমাদের কলকি গাছটি নড়ে চড়ে
উঠেছিল। আমাদের অবাক করে দিয়ে তার শুকনো ডালে পাতা এসেছিল। শেকড় জেগেছিল।
আমার সেজো বোনটি সেই মরতে মরতে
বেঁচে যাওয়া কলকি গাছটি মন্দিরের পাশটিতে আবার লাগিয়ে দিয়েছিল। মা যখন গাছটিকে
তুলে ফেলবে বলে ডাল ধরেছে, সেই সময়ে উঠোনে ঢুকছেন কুসুমদিয়ার ফকির। তিনি
ডেকে বলছেন, গাছটির নাম করবীগাছ। সেই থেকে আমাদের কলকি
ফুল করবী হয়ে আমাদের উঠোনে ফুটেছিল।
২.
সে সময়কালে হাসান আজিজুল হকের
বুড়োটির মত বেশ কয়েকজন বুড়ো খুব ভোরে হাঁটতে বের হতেন রাস্তা দিয়ে। এর মধ্যে
একজন ছিলেন কাশেম রেজা। চোখের ডাক্তার। তিনিই আমাদের জলের তলা থেকে ভেসে ওঠা খুদে
শহরের কবিকাকা। তিনি পূজোর সময়ে দুর্গামণ্ডপে কবিতা পড়তেন। শহীদ মিনারে একুশে
ফেব্রুয়ারির দিনে কাগজে কবিতা লিখে বিলি করতেন। তাঁর মুখ ছিল প্রাচীন ঋষিদের মত
সৌম্য। আর শিশিরের মত মায়াময়। তিনি একদিন ভোরবেলা সবাইকে ডেকে তুললেন। বললেন, এই করবী গাছটি
নিয়ে আমি একটি কবিতা লিখব। তোমাদের শুনিয়ে যাব।
তিনি কবিতা শোনাবেন এই আশায় আমরা
তাঁর ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতাম। পাশে কুণ্ডেশ্বরী ঔষধালয়। ছবি তুলে কেউ
বেরিয়েছে ছবিঘর থেকে। তার চুলে তখনো টেরিকাটা। মকলু ভাই হৈ হৈ করে যাত্রাদলের কথা
বলছেন। পথচারিরা আমাদের পাশ হেঁটে যেত। কেউ কেউ গান গাইত, অনেক সাধের
ময়না আমার। ময়নাটি বাঁধন কেটে যেত। তারা কল্পনা সিনেমা হলে রাজ্জাক কবরীর
ময়নামতি সিনেমাটি দেখে যাবে।
কবির ঘরটি ছিল কালিবাড়ির পুকুরের
উপরে। মাচা থেকে মাছ ধরা যেত। আমাদের বন্ধু পল্টু পুকুর থেকে জল তুলে ঠিক পুকুরের
উপরে দাঁড়িয়ে গোসল সারত। বলত, জানিস, পৃথিবীতে কেউ
জলের উপরে হাঁটতে পারে না। আমরা পারি। কবি কাশেম রেজা আর তার ছেলে কবি রেজা পল্টু
প্রতিরোজ জলের উপরে হেঁটে বেড়াত। আমরা দেখতে পেতাম—কবি তার টেবিলে ঝুঁকে কবিতা লিখছেন। চোখের উপর থেকে চশমাটি নাকের
উপরে ঝুকে এসেছে। কাঁচাপাকা চুল। আর বাদশাহী দাড়ি। আমরা অপেক্ষা করতাম এই কবি
বুড়ো হওয়ার আগে করবী গাছটি নিয়ে কবিতাটি লেখা শেষ করবেন। আমরা শুনতে পাব। পল্টু
তখন বলেছিল, কষ্ট কবিতা থেকে জন্ম নেয়। কী কষ্ট জানিনা। তাহলে কি করবী কোনো কষ্টের
নাম?
৩.
পান্নু স্যারের বাসার সামনেই
বাজার বসে। শুক্রবারে আর মঙ্গলবারে দূরের হাটুরেরা এসে কবির হোটেলে ভাত খেয়ে
যায়। খেতে খেতে লাউগাছের গল্প করে। রায়েন্দাধানের পুড়ে যাওয়ার জন্য হাহাকার
শোনায়। মাঝিগাতির বিলে শালুকধরার খবরাদি জানিয়ে যায়। রাধুনে মহিলাটি এসে বলে—বাবা,
আপনেও চাইট্টা খাইয়া লন। এ সময়ই পান্নু স্যার তার দ্বিতীয়
বিবির জন্য ম্যাকবেথ পড়ছেন। আর বাজার ধীরে ধীরে ভেঙে যেতে থাকে।
কবি আমাদের উঠোনে ভোর ফোটার আগেই
ঘুরে যেতেন। তখন তার ঘরে মোজো মেয়েটির ছেলেমেয়েরা এসে পড়েছে। কেউ কেউ
বারান্দায় ঘুমোয়। কেউ কেউ রোগীদেখার ঘরে। কোকো আপা মন খারাপ করে ইস্কুলে পড়াতে
যান। সেকো আপার সঙ্গে দেখা হয় না। রেখা আপা একদিন বিপ্লব হবে বলে ছুটে বেড়ান
এপাড়া থেকে ওপাড়ায়। আর শোনা যায় কচি আপা কবিতা লিখছেন। ঢাকায় কবিতা ছাপা
হচ্ছে। করবী ফুলকে নিয়ে কেউ কবিতা লেখেনি। আমরা জানি আমাদের শহরের সত্যিকারের কবি
কাশেম রেজাই লিখবেন কবিতাটি। আমরা শুনব। শুনলে আমাদের মন ভালো হয়ে যাবে। এইহেতু
আমাদের উঠোনে একটি গাছেই কখনো রক্তের মতো লাল ফুল ফুটত। কখনো শ্বেত পাথরের মত সাদা
ফুল। কখনো আমার মায়ের মতো কালো কালো ফুল। আবার বাটা হলুদের মত হলুদ হলুদ। কবিতা
এই লাল, সাদা, কালো আর হলুদের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসবে।
চারিদিকে ফেটে পড়বে।
৪.
এইভাবে আমাদের কবি একদিন বুড়ো
হতে হতে তার লেখার টেবিল হারিয়ে ফেললেন। সেখানে বসেছে ক্যারামবোর্ড। আর কবিতার
খাতার বদলে মাসুদ রানা। অমিতাভ বচ্চন—আখেরি রাস্তা।
ইয়াহ-ঢিসুম ঢুসুম।
কবি আমাদের বটতলায় আসেন। হাতে
ময়ূরমুখী লাঠি। মাথায় সাদা টুপি। তার চোখের মধ্যে অনেকগুলো কাক কা কা করে ওড়ে।
পাখা ঝটপটায়। মা দুটো মুড়ি খেতে দেয়। একখণ্ড নলেন গুড়। কাসার গ্লাসে জল। কবির
হাতে জলের গ্লাস। তিনি বলেন, কবিতা লেখা হয়েছে।
তিনি ঢকঢক করে জল খেলেন। তারপর
পড়লেন 'একটি বাবা, তার মেয়ে আর একটি একটি করবী গাছের'
কবিতা। বাবা বারান্দার ঘরে বসে থাকে। তার ঘরে গ্রামের ছেলেরা
আসে। দুটো একটা টাকা দেয়। ভেতর ঘরে তার মেয়েটির শাড়ির খসখসানি কানে আসে। বুড়ো
খুক খুক করে কাশে। আর বাইরে সেই করবী গাছ বেড়ে ওঠে। বুড়ো শোনায় করবী ফলের মধ্যে
মারাত্মক বিষ থাকে।
আমরা কবির কণ্ঠে শুনি সেই বিষের
গল্পটি। আর কিছু নয়। এই বিষময় করবী গাছটি আমাদের মন্দিরে বেড়ে ওঠে। বাতাসে তারা
চিকন চাকন পাতাগুলো দোলে। মা রান্না ঘর থেকে গরম ভাতের ফ্যান গাছটির গায়ে ফেলতে
ফেলতে থেমে যায়। এ সময়ই কবি জলের গ্লাসটি আবার ঠোঁটে চেপে ধরেন। তার আবার জল
পিপাসা জেগেছে। কিন্তু গ্লাসটি শূণ্য। আমাদের উঠোনে করবী ফুল ফেটে পড়েছে।
.নিউ ইয়র্ক. ২০ নভেম্বর. ২০১১.
0 মন্তব্যসমূহ