জ্যোতিপ্রকাশ দত্তর গল্প নিয়ে আলাপ
আনোয়ার শাহাদাত
জ্যোতিপ্রকাশের গল্প। তিনি গল্প লিখেছেন। এই গল্প গল্প হিসেবে কতটা শ্রেষ্ঠ তা বলার চেয়ে বলা যায়—তিনি তার গল্পে অন্যদের চেয়ে স্বতন্ত্র। তিনি সবার মত নয়—নিজের মত করে গল্প বলেন। তার নিজের করা গল্পটিই বলেন। এই ক্ষেত্রে বাংলা সাহিত্যে তিনি অন্যকারো মত করে লেখেননি।
আনোয়ার শাহাদাত
জ্যোতিপ্রকাশের গল্প। তিনি গল্প লিখেছেন। এই গল্প গল্প হিসেবে কতটা শ্রেষ্ঠ তা বলার চেয়ে বলা যায়—তিনি তার গল্পে অন্যদের চেয়ে স্বতন্ত্র। তিনি সবার মত নয়—নিজের মত করে গল্প বলেন। তার নিজের করা গল্পটিই বলেন। এই ক্ষেত্রে বাংলা সাহিত্যে তিনি অন্যকারো মত করে লেখেননি।
সবার আগে চোখে পড়ে তাঁর লেখা গীতল। লিখেছেন গদ্য। কিন্তু ভাষাটি মোটেই গদ্যের নয়। কবিতার মত। সঙ্গীতের মত। ঝংকার আছে। ফলে তাঁর ভাষা রহসময়। ইঙ্গিতময়। সহজ
কিন্তু এর কাব্যিকতায় কখনো অসহজ হতে পারে। কথা বলার সেই
কাব্যিক গতি একটু এঁকেবেঁকে যায়। জলের মত ঘুরে ঘুরে কথা বলেন। তাকে সহজে ধরা যায় না। আয়াস করতে হয়। বলেন অস্পষ্ট করে। বলতে বলতে হয়তো
কোথাও থেমে যান। খানিক নিজে বলেন। খানিকটা পাঠক আবিষ্কার করে নেন। ছাড়া ছাড়া করে কবিতার চিত্রকল্পের মত গল্পকল্প আসে। এসে কখন যে ঘুরে যায়—সহসা বোঝা যায় না। তবে বোঝা গেলে হাহাকার জাগে। তিনি বলেন দূর থেকে। পাঠকও থেকে যান হয়তোবা দূরেই। এই দূরই হয়তো তিনি রচনা করতে
চেয়েছেন। এই দূর থেকেই ভেতরকে দেখার জন্য আলাদা একটা কলকব্জা তৈরী হতে
থাকে যৌথভাবে।
জ্যোতিপ্রকাশ বলেন-- একমাত্র সন্তান তার যেদিন গ্রাম ছেড়ে চলে যায় সেদিন কাজেমউদ্দিন বড় বিস্মিত হয়েছিল। পুত্রটিই তার সম্বল এই কারণে বিলাপ করা সঙ্গত ছিল। তার স্ত্রীও পুত্রশোকে কাতর হয়ে বাইরে উঠনে আছাড় খেয়ে পড়তে পারত কিন্তু সেও ছিল হতবুদ্ধি। (--গ্রাম ও শহর উন্নয়নের গল্প/ ১৭৮)
এই মাঠ-নদী পার হয়ে বিল-জঙ্গলের ওপার হাটুরিয়া—সাড়াশিয়ার বাইরে অনেক গ্রাম-শহর, দালান, রেলগাড়ি তাকে ডাকলে সে শুনেছিল। কাজেম তা বোঝেনি এবং এ জন্যই বিস্ময়।
(--ঐ)/১৭৮)
এই
যে জ্যোতিপ্রকাশের গল্প পড়েছি তা এজন্য নয় যে—তাঁর লেখা দেশের প্রধান পত্রিকাগুলোতে ছাপা হয়েছে ঘন ঘন। অথবা তাঁকে দেখা গেছে টিভিতে। বাংলা একাডেমিতে তিনি আমন্ত্রিত হয়েছেন এমন নজিরও খুব বেশি নেই। এটা আমার জানার কথাও নয়।
জানা নেইও। আর একথা খুব নির্মম সত্যি যে এই বাংলাদেশ ভূখণ্ডে কাউকে নিয়ে লেখালেখির সংস্কৃতিটা একটি বিরল রকেট সাইন্সের মত ঘটনা বটে। আর যারা এই সাইন্স চর্চায় আছেন তারা আগে বিচার করে বসেন কাউকে নিয়ে লিখতে গিয়ে যদি তাকে চাঙ্গে তুলে দেওয়া হয় তাহলে তার নিজের জন্যই একটা সমস্যা হয়ে দাঁড়াবে, তার নিজের
চাঙ্গের নিচে চাপা পড়ার আশঙ্কা বাড়তে থাকে। ফলে চাঙ্গে তুলে দিলে তাকে আর নামানো যাবে কিনা এই দুঃশ্চিন্তায় তিনি লিখতেই চান না। যদি লেখেনও কোনোভাবে তাহলে তার লেখাটা হয়ে ওঠে ধরি মাছ না ছুই পানি ধরনের। তবু তো কারো কারো বেলায় এই ধরি মাছ না ছুঁই পানির মত সামান্য হলেও কিছু কিছু হয় বা হয়েছে। কিন্তু নানাবিধ কারণে জ্যোতিপ্রকাশ দত্তকে একদম চোখের আড়াল
করবার একটা নিরন্তর অন্তহীন প্রচেষ্টা দেখতে পাওয়া যায়।
হয়তো এর অন্যতম কারণ তিনি কোনো গ্রুপ বা দলে থাকেননি—সুশীল হিসেবেও সবার দৃষ্টির মধ্যে থাকার যে কৌশল বা
দল
রয়েছে এই বাংলায় তা থেকেও তিনি নিজে সরে থেকেছেন। তবু তাকে গল্পকার হিসেবে এড়ানো কঠিন। বাংলাদেশের গল্পকে পড়তে হলে জ্যোতিপ্রকাশকে নিজ উদ্যোগেই খুঁজে নিতে হয়। খুঁজে নেওয়া ছাড়া উপায় থাকে না। খুঁজে পেলে আবার ধীরে ধীরে দীর্ঘকাল ধরেই পড়তে হয়। যেমন করে কমল কুমার মজুমদারকে আমরা খুঁজে নিয়ে পড়ি। জগদীশ গুপ্তকে পড়ে নেই। খুঁজে পড়ি সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহকে। আক্তারুজ্জামান ইলিয়াসকে। খুঁজে নিয়ে পড়তে হচ্ছে শহিদুল জহিরকে। হাসান আজিজুল হকের লেখাও এই খুঁজে নেওয়ার মধ্যেই চলে যাচ্ছে। কিন্তু তারা হারিয়ে যাচ্ছেন না। গুপ্ত অস্ত্রের মত গুপ্ত হয়ে থাকছেন নতুন করে উপ্ত হবার জন্য। এছাড়া তো আমাদের নিজেদের আর কোনো বিশেষ অস্ত্র-শস্ত্র নেই যা দিয়ে আমাদেরকে বাঁচাতে পারি। ফলে এই অস্ত্রগুলো আমাদের কাছে হীরের মত জ্বলে। মুগ্ধ করে। প্রাণবান করে।
জ্যোতিপ্রকাশকে খুঁজে পড়ার কারণটাই তার গল্প। তিনি নিজের মত করে এমন একটি গল্পধারা বেঁছে নিয়েছেন—যে ধারায় অন্য কেউই লেখেননি। অনুসরণও করেননি। এ ধারায় লেখার একটা বিপদ আছে যে এধারাটি কখনোই জনপ্রিয় হয় না। স্মৃতির মধ্যে থাকতে থাকতে বিস্মৃতির একটা চাদর ঢাকা পড়ে যায় অলক্ষ্যে। এই বিপদটা তিনি সম্পূর্ণ জেনে বুঝেই নিজের করে নিয়েছেন। এবং যেখন যখনই তিনি এই ধারায় সক্রিয় হয়ে উঠেছেন তখন তিনি নিরলসভাবে নিজের মধ্যে নিজের মত করে থাকছেন—কারো তোয়াক্কা করেননি—এই তুরীয় ভাবটিই তাকে অনন্য করে তুলেছে। অনেকের মধ্যে তিনি একা হয়ে উঠেছেন। তাকে অনেক ভীড়েও আলাদা করে চেনা যায়। বলা যায়—ওই যে জ্যোতিপ্রকাশ দাঁড়িয়ে আছেন। এই দাঁড়িয়ে থাকাটা শক্তির সামর্থ্যে পূর্ণ।
জ্যোতিপ্রকাশের এই শক্তির দিক্টি হল তার চিন্তারক্ষেত্রে কোনো ধ্বন্ধ নেই—পরিস্কার। তিনি খুব স্পষ্টভাবে ধারণ করেন আমাদের দেশ, ঐতিহ্য, ইতিহাস ভূগোল রাজনীতি সংগ্রাম আর তার ভেতরের মানুষ। এই মানুষ রক্তমাংশের। কোনো অর্থেই বানানো ফানুষ নয়। এটা স্পষ্টত মূলধারাই বটে। যে ধারাটি ১৯৪৭ সালে ছিল। ১৯৪৭ সালের পরে ১৯৫২ সালে নতুন করে আয়নার মত করে সবার সামনে এসেছে। ১৯৭১ সালে এই মানুষই যুথবদ্ধ হয়ে লড়াই করেছিল।
তার মানুষ শ্রীমন্ত এবং সাঈদ মানুষ—
‘তারা দুজন আরো ঘনিষ্ট এবং একান্ত হয়ে বসেছিল। দুজন দুজনের কথা বলছে না অথচ পরস্পরকে অনুভব করছে আর সেখানে এসেই একাত্ম হয়ে যাচ্ছে। যেন দুজনে ট্রেনের দুটো কামরা থেকে নেমে একই প্লাট ফর্মে পা রাখছে। একই মাটিতে, একই ছাউনির নিচে।‘ (--পরমাত্মীয়/ পৃষ্ঠা ৯)
সামনে রাস্তা মেরামত করা হচ্ছে। একটা পিচের পিঁপে রাস্তার প্রায় মাঝখানে পড়ে। সেখানটায় খুব জোরে ব্রেক কষল রিকশাওয়ালা। ইফতিখার এবং ননী এ-ওর গায়ে ঢলে পড়ল। (--সজানী ফুলের বাগান/ পৃষ্ঠা১৮)
কদিন রজব আলীর দেখা নেই। আমি তাকে পথে, মাঠে, নদীর ধারে সব জায়গায় খুঁজে খুঁজে বেড়ালাম। স্পষ্ট বুঝতে পারছিলাম, এই ভাবে আর অপেক্ষা করা যায় না। রজব আলীকে খুঁজে পেতেই হবে। (সারাজীবন/ পৃষ্ঠা ১০০)
ফৈজুদ্দিন
তার বাতাবী লেবুর গাছ থেকে মাসে দুটি করে লেবু নিয়ে আসবে, দীননাথের নারকেল গাছে
কয়েকটি নারকেল এখনো আছে এতএব সে নিশ্চয়ই কিছু নাড়ু তৈ্রী করে দিতে পারবে।
(--পুনরুদ্ধার/ পৃষ্ঠা ১১৪)
(--পুনরুদ্ধার/ পৃষ্ঠা ১১৪)
দিন ও
রাত্রির সীমানায় কিছু থাকে না। আলো না, অন্ধকার। জীবন, মৃত্যু কিছু না। ঐ শূন্য
সময়ে যে ডাকে সে দিব্যকান্তি কি তামসিক কেউ নয়। স্থির দৃশ্যে তাকে ধরা যায় না—শূন্যে
ভাসমান কি আমূল প্রোথিত শরীরীও নয়। তবুও সে ত্রাতা।
(--হিমজীবন/ পৃষ্ঠা ১৮৫)
(--হিমজীবন/ পৃষ্ঠা ১৮৫)
রমণী
তখন প্রকৃতই বিবসনা ও বাক্যহীন। তবে শরীরে ক্রমে উষ্ণতা সঞ্চারিত হতেই পারে।
সেজন্যই অঙ্গ শিথিল। একটু দূরে রাখা খলুইয়ের দিকে তাকায় সে আর ঠিক সেই মুহূর্তে
পুরুষ তাকে বিদ্ধ করে। বারবার।
(--হিমজীবন/ পৃষ্ঠা ১৮৮)
(--হিমজীবন/ পৃষ্ঠা ১৮৮)
হিমজীবন
নামের গল্পটিতে দুটি চরিত্রের কোনো নাম নেই। একজন পুরুষ। আরেকজন রমণী। তিনি
রমণযোগ্য বলেই রমণী। প্রকৃতি আর পুরুষ। তাদের নাম দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করেননি
জ্যোতিপ্রকাশ। পুরুষটি পুরুষ বলেই কামুক। আগ্রাসী। তার আগের যে কামুক পুরুষটির
প্রসঙ্গ উত্থাপন করছেন—তিনিও আগ্রাসী এবং কামুক। রমণীর নিজের পুরুষটি কিন্তু
অসুস্থ। কেশো রোগী। এক সময় কামপ্রবণই ছিলেন বলেই তিনি জনক।
যে
পুরুষটির তার হিমজীবনে উত্তাপের সঞ্চার করছে সেই পুরুষটি পুরুষ বলেই রমণীর রক্ষক
এবং ভোগীও বটে। এই ভোগটি করে রমণীকে। তার নিজের কামনা-বাসনার কথা জানার প্রয়োজন
নেই। রমণী রমণী বলেই কম্পিতা। সে মাছ ধরতে গিয়ে মাছের বদলে সাপ ধরেছে। সিক্ত করতলে
সে ভয়ে মুখ ও শরীর উভয় ডাকার চেষ্টায় সে জ্ঞানশূণ্য, বিহ্বল। এইভাবে সে পুরুষ
কর্তৃক রক্ষিত হয় এবং প্রাপ্ত হয়। এই প্রাপ্তির মধ্যে তখন আর আগ্রাসন থাকে না। প্রণয়ে
পরিণত হয়। পাঠক বুঝতে পারে এটা অবশেষে ধর্ষণের গল্প নয়—প্রেম ও
প্রার্থনার আখ্যান। বেঁচে থাকার একটা কুহক মাত্র। এই কুহকই আমাদের যৌথ-যাপনের
ইতিহাস।
প্রেম
ও জীবনবেদের জন্য যে কোনো সাধারণ ভাষাই উপযুক্ত নয়। তার জন্য বিশেষ একটা দার্ঢ্য ভাষা
দরকার। সে ভাষায় চারিদিক পূষ্পকাল রচিত হয়। মহিমা বর্ণিত হয়। নির্বান আসে অবশেষে। ফলে জ্যোতিপ্রকাশ এই শীতের মধ্যে এক পুরুষ ও
রমণীর মাছ ধরার মধ্যে দিয়ে যে জীবনের মহিমা কীর্তন করছেন—যে বিষাদের
বয়ানটি দিচ্ছে, যে ভবিতব্যের উদ্ভাসনটি ঘটাচ্ছেন তার জন্য তিনি তিনি নির্মাণ করে
নিচ্ছেন সুষমাময় ভাষা। খরসান ভঙ্গী। আর হীরকখণ্ডের মত দ্যুতিময় শব্দরাজী। এর মধ্যে
দিয়েই তাঁর গল্প হয়ে ওঠে সুষমা, মাধুর্য্য আর দ্যূতির চলাচল।
তিনি যখন জলের কথা বলেন তখন মাঠি এসে পড়ে। যখন মাটির উল্লেখ করেন তখন স্বাভাবিকভাবে আকাশ প্রযুক্ত হয়। যখন আলোর গল্পটি করেন তখন অন্ধকার সামনে এসে দাঁড়ায়। জীবনের ব্যাখ্যা দিলে মৃত্যু প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে। আখ্যান তখন কোনো ঘেরাটোপে আবদ্ধ থাকে না। তার খোলসটি ভেঙ্গে বেরিয়ে পড়ে—ঘটনার মহত্বের দিকে যায় যাকে আমরা সত্য হিসেবে নির্ণয় করি। সত্য উপলব্দিতে পৌঁছে। উপলব্দি থেকেই জাগে জ্ঞান। জ্ঞান থেকে অভিজ্ঞান। এটা দার্শনিকতা। এই দার্শনিকতারই ভাষটি নীরবে বলে যান জ্যোতিপ্রকাশ। আমাদের কাছে সহজই-স্বাভাবিক হয়ে আসে দিব্যকান্তি, তামসিক, আমূলপ্রোথিত, ত্রাতা, চরাচর গুরুগম্ভীর শব্দগুলো। এই শব্দগুলো ছাড়া এই দর্শনজনিত ভাব প্রকাশ অপূর্ণ মনে হতে পারত।
তিনি যখন জলের কথা বলেন তখন মাঠি এসে পড়ে। যখন মাটির উল্লেখ করেন তখন স্বাভাবিকভাবে আকাশ প্রযুক্ত হয়। যখন আলোর গল্পটি করেন তখন অন্ধকার সামনে এসে দাঁড়ায়। জীবনের ব্যাখ্যা দিলে মৃত্যু প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে। আখ্যান তখন কোনো ঘেরাটোপে আবদ্ধ থাকে না। তার খোলসটি ভেঙ্গে বেরিয়ে পড়ে—ঘটনার মহত্বের দিকে যায় যাকে আমরা সত্য হিসেবে নির্ণয় করি। সত্য উপলব্দিতে পৌঁছে। উপলব্দি থেকেই জাগে জ্ঞান। জ্ঞান থেকে অভিজ্ঞান। এটা দার্শনিকতা। এই দার্শনিকতারই ভাষটি নীরবে বলে যান জ্যোতিপ্রকাশ। আমাদের কাছে সহজই-স্বাভাবিক হয়ে আসে দিব্যকান্তি, তামসিক, আমূলপ্রোথিত, ত্রাতা, চরাচর গুরুগম্ভীর শব্দগুলো। এই শব্দগুলো ছাড়া এই দর্শনজনিত ভাব প্রকাশ অপূর্ণ মনে হতে পারত।
আবার
তার পাশাপাশি তিনি চরিত্রের মুখে বসিয়ে দেন কথ্যভাষ্যও। তার চরিত্র বলে –‘বৈকালে
আইয়া লইয়া যামুনে তুমারে। পোলার বাপেরে বাইত পাঠাই দিবা। ট্যাহা লইয়া দিমুনে।
সায়েবরে খুশি রাহিস। কনু অভাব অইত না।‘
চরিত্র এই কথা বলে বলেই তিনি স্বতস্ফুর্তভাবে তাদের
জবান-ভাষ্যটির পূর্ণরূপ বজার রাখেন। তাতে কিছু আরোপ করেন না। ফলে যারা ভাষা-
সাম্প্রদায়িকতায় ভোগেন—ভাষা রক্ষণশীলতায় আতঙ্কগ্রস্থ হন—তারা দুজনেই জ্যোতিপ্রকাশের কাছে অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়ে। বোঝা যায়, তিনি গল্প বলতে বসেছেন—ষঢ়যন্ত্র করতে বসেন নি।
জ্যোতিপ্রকাশের
একটি গল্পে ( যে তোমারে ছাড়ে) আরও কয়েকটি মানুষের সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে—অনন্ত
মজুমদার, মাখন মজুমদার, অখিল তরফদার, যোগেন চৌধুরী, হৃষিকেশ ভট্টাচার্য্য, কেশব
সেন, ললিত সান্যাল, সনাতন, নরেন পোদ্দার। এরা র্যাডক্লিফ সাহেবের সীমানা
নির্ধারণের পরে দেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছেন। এদের পাশাপাশি আরো পাওয়া যাচ্ছে আরও কয়েকটি
মানুষকে—আশরাফ,
আলতাফ, আমিনুর, রইসুদ্দিন, বেলায়েত সাহেবকে। অনন্তরা চলে যাচ্ছে ভিটেমাটি ছেড়ে। আর
আশরাফরা সেই ভিটেমাটিতে উঠে যাচ্ছে। এই ছেড়ে যাওয়া ও দখলে নেওয়ার মধ্যে কিন্তু
কোনো হুমকি নেই। কেউ কাউকে হুমকি দিয়ে তাড়িয়ে দিচ্ছে না। ছাড়িয়ে দিচ্ছে না। একটা
সময়, সময়ের ভেতরের ভবিতব্য তাদের নিঃস্ব করে দিচ্ছে।
আরেকদলকে
দুহাত ভরে দিচ্ছে। কিন্তু এই এই হারানো-প্রাপ্তির মধ্যে কোনো হিংসা-দ্বেষ কাজ করছে
না।এটা যেন নদীর বাক বদলের মতই কোনো ঘটনা।
তবে যারা চলে যাচ্ছেন তারা কিন্তু মনে-প্রাণে যেতে চাননা। কোনো না কোনো ভাবে তাদের থাকার ইচ্ছেটা প্রবল। তারা ফিরে ফিরে দেখছেন তাদের শিউলী গাছটি, পুকুর পাড়টি। জানালার পাল্লাটি। শান্ত নদীটি। আর তাকিয়ে দেখেন তাদের পাতার ধার দিয়ে চূর্ণ চূর্ণ জ্যোৎস্না ঝরে। এই জ্যোৎস্নার চূর্ণ ছেড়ে কোথাও যেতে নেই—যাওয়া যায় না। কিন্তু যাওয়াটিই ভবিতব্যের পাখি। ডানামেলা ছাড়া উপায় নেই। পাখা মেলে গেছে।
তবে যারা চলে যাচ্ছেন তারা কিন্তু মনে-প্রাণে যেতে চাননা। কোনো না কোনো ভাবে তাদের থাকার ইচ্ছেটা প্রবল। তারা ফিরে ফিরে দেখছেন তাদের শিউলী গাছটি, পুকুর পাড়টি। জানালার পাল্লাটি। শান্ত নদীটি। আর তাকিয়ে দেখেন তাদের পাতার ধার দিয়ে চূর্ণ চূর্ণ জ্যোৎস্না ঝরে। এই জ্যোৎস্নার চূর্ণ ছেড়ে কোথাও যেতে নেই—যাওয়া যায় না। কিন্তু যাওয়াটিই ভবিতব্যের পাখি। ডানামেলা ছাড়া উপায় নেই। পাখা মেলে গেছে।
এদের
মধ্যে যোগেনবাবু হলেন গল্পের সে-মানুষটি। তার বাক্স-পেট্রা বাঁধা হয়েছে। ‘প্রায়ান্ধকার
করবী গাছ ফুলে ঢাকা এখন এ কথা কেউ বলবে না’।
তাদের অন্তর্বাসের মধ্যেও কিছু গচ্ছিত সোনা অথবা টাকা সেলাই করে রাখা হয়েছে। ‘কিন্তু
সে জানে ঐ লাল-হলুদ করবীর রাশি মাড়িয়ে ছোট মাঠটুকু পেরুতে দেখবে ঘাসের ডগায় হালকা
হিমের ছায়া’।
তাদের মাথাটা টলমল করছে। ‘ যদি নরম করবীর স্পর্শ সে হাতে
না লাগবে তাহলে রাস্তায় নেমে বাঁয়ে ঘুরলেই দেখবে শরতের প্রথম শিউলী ঐ অন্ধকারেও
জ্যোৎস্নার চূর্ণ ছড়িয়ে রেখেছে। তার হাত থেকে ঘাম বেয়ে নামছে’।
এই বিষাদ জড়ানো মায়াই এইসব মানুষদের মাথা ছুয়ে যায়। এ কারণেই জ্যোতিপ্রকাশের
মানুষদের সচরাচর হাসতে দেখা যায় না।
যোগেনবাবু
বাড়ির সবাইকে নিয়ে অনন্ত মজুমদারদের মত ট্রেন স্টেশনে এসেছেন। আমিনুর এসেছে তাদের
সঙ্গে। উঠিয়ে দিতে। মনীষা বারবার বলছিল,’এমন শরীরে যেও না। আর কিইবা
লাভ’’।
স্ত্রী শুধু স্তব্ধ হয়ে বসে ছিলেন। ‘বেশি কিছু নেওয়া যাবে না শুনেও
গুরুদেবের ছবি, ঠাকুরের সিংহাসনের সঙ্গে, মীনা করা লাডলো কোম্পানীর বাজনার বাক্স
মনীষার বড় শখের, কিছুতেই ফেলে যাওয়া যায় না। তিনি সেই সব দেখে সারারাত জেগে বসে
থাকা স্ত্রী ও কন্যা দুটির দিকেও তাকিয়েছিলেন, মিনতির শুন্য সিঁথি, খালি হাতের
দিকে চোখ মেলেছিলেন একবার, বুকের সামান্য
ব্যথাটি ঐ কষ্টের জন্যই ভেবে দরজার বাইরে পা দিয়েছিলেন। এই শেষবার।
যোগেনবাবুদের গল্পতো এখানে শেষ হয়ে যাচ্ছে। নতুন আরেকটি গল্পের শুরু হচ্ছে। তার আগে কয়েকটি প্রশ্ন জেগে উঠছে—মিনতির সিঁথি শূন্য কেনো? হাত খালি কেনো? কেনো শেষবার অন্তর্বাসের সেলাইটাও দেখে নিচ্ছেন?
যোগেনবাবুদের গল্পতো এখানে শেষ হয়ে যাচ্ছে। নতুন আরেকটি গল্পের শুরু হচ্ছে। তার আগে কয়েকটি প্রশ্ন জেগে উঠছে—মিনতির সিঁথি শূন্য কেনো? হাত খালি কেনো? কেনো শেষবার অন্তর্বাসের সেলাইটাও দেখে নিচ্ছেন?
কেনো
আমিনুর মাথা নিচু করে থাকে? কেনো মনীষা চলে গেলে তার ভালো লাগে না? বেলায়েত সাহেব
রিকশা দেখে হাত নাড়ছেন? মাদলার জমিদারি সেরেস্তায় দারোয়ানের কাশিটি শোনা যায়?
বারোয়ারী মণ্ডপের সব কটি দরজাই খোলা থাকে? কেনো সেখানে ভক্তের বদলে দু’একটি
গরু বা বা আশ্রয়হীন কুকুর শুয়ে থাকে? এবং এই কুকুরগুলোর আশ্রয়দাতা কে কে ছিল এবং
কেনো এখন আশ্রয়হীন হয়ে গেলো? এই সব প্রশ্নের ভেতর দিয়ে বহু গল্প বলেন জ্যোতিপ্রকাশ।
এইভাবে বহু গল্প বলতে চান বলেই তিনি
নির্দিষ্ট কোনো গল্প বলতে চান না। শুধু গল্পের ইশারা দিয়ে যান। এই গল্পের ভেতর
দিয়ে তিনি শুধু কিছু বিষাদ্গ্রস্থ মানুষের বিন্দুপাত ঘটান।
এরই
ভেতর দিয়ে যোগেনবাবুর ছেড়ে যেতে পা সরছে না। ট্রেন আসছে। তিনি ঢলে পড়েছেন আবার
ফিরে যাচ্ছেন তার বাড়িতে। বাড়ি যেন অপেক্ষা করে আছে। এ বাড়ির না-ফেরার মানুষটি
আবার ফিরে আসছে দেখে কেউ একজন দরজায় এসে দাঁড়াবে। বলবে-এসেছ?
এটা
দেশভাগের সময়কার গল্প। কিন্তু জ্যোতিপ্রকাশ কোথাও বলেননি যে এটা দেশভাগের গল্প।
শুধু একটা সুত্র দিয়েছেন-- র্যাডক্লিফের সীমানা। এই র্যাডক্লিফের সীমানা—নামের
দুটি শব্দেই বলে দিয়েছেন তিনি সেই সাতচল্লিশের সময়কাল নিয়ে লিখছেন। আর বিস্তার
ঘটাননি। তিনি বিস্তার ঘটাচ্ছেন তার গল্পবিন্দু দিয়ে। ইতিহাস দিয়ে নয়। মানুষের
ঘামবিন্দু দিয়ে। আবেগ দিয়ে নয়। মৃত্যু
দিয়ে--জীবন দিয়ে নয়। সে মৃত্যু এখন হতে পারে। তখন হতে পারে। পরেও হতে পারে। ফলে
দেশভাগের মানুষজনদের নিয়ে আর কোনো গল্প
থাকে না। তার গল্পের শুরুটাও গল্পহীন—শেষটাও গল্পহীন। এই গল্পহীন
গল্পই জ্যোতিপ্রকাশ লিখেছেন। লিখেছেন বলেই এ গল্পে কোনো মোচড় নেই। দ্বন্দ্ব আমাদের
টেনে নিয়ে যায় না এরপরের অংশে। এর যে কোনো অংশেই তিনি থেমে যেতে পারতেন। অথবা পাঠক
থেমে যেতে পারেন। তাতে গল্পপাঠের কোনো ক্ষতিবৃদ্ধি হয়না। আমাদের উপনিবেশোত্তর জীবন
যাপনটাই তো অশেষ—ক্লান্তিকর। পুনরাবৃত্তিময়। একঘেয়ে। অপূর্ণ। না-মানুষ।
প্রাণীবৎ। জ্যোতিপ্রকাশের গল্পগুলোর মানুষ শুধু জলের রেখার মত বলে যায়—‘’রাস্তায়
নেমে বায়ে ঘুরলেই দেখবে শরতের প্রথম শিউলী ঐ অন্ধকারেও জ্যোৎস্নার চূর্ণ ছড়িয়ে
রেখেছে।‘’
জ্যোতিপ্রকাশ
দত্তও কিন্তু এই অনন্ত মজুমদার, যোগেন বাবুদের লোক। দেশভাগ তাকেও খণ্ড করেছে।
ক্ষত-বিক্ষত করেছে। উন্মূল করেছে। তারও ক্ষোভ থাকাটা খুব স্বাভাবিক। কিন্তু তিনি
যখন গল্পটি লিখছেন—তিনি কোনোভাবেই এই ক্ষোভের কথাটি বলছেন না। কোনো গুপ্ত
হিংসা ছড়িয়ে দেননি। কোনো নির্দিষ্ট চরিত্রের হয়ে দেখা দেননি কোনো হুহুংকার উগরে
দিয়ে। তিনি বলছেন একজন বর্ণনাকারীর মত। যে বর্ণনাকারী আগেই শপথ নিয়েছেন—তিনি
যেকোনো পরিস্থিতিতেই নিরাবেগ, পক্ষপাতহীন, নির্মোহ থাকবেন। তিনি কোনো পূর্বনুমিত
সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেবেন না। জীবন কখনো ব্যাখ্যা দেয় না। জীবন প্রতিমুহূর্তে হয়ে
ওঠে। যাত্রা করে। পেছনে ফেরে না। মহাভারত বর্ণানাকালে এই শপথ মহাভারতের সঞ্জয়
নিয়েছিলেন। সঞ্জয় শপথ নিয়েছিলেন জন্মান্ধ রাজা ধৃতরাষ্ট্রকে তিনি যুদ্ধ শোনাবেন—যুদ্ধ
দেখাবেন। তার বর্ণনায় মহাভারত মহাকাব্য
হয়ে উঠে উঠেছিল। হয়ে উঠেছিল চিরকালের।
জয়তিপ্রকাশ আমাদের একজন সঞ্জয়। তিনি উবাচ। আমাদেরকে হাজির করেন কুরুক্ষেত্রে। যুদ্ধক্ষেত্রে। সমবেতা। যুযুৎসবঃ।
জয়তিপ্রকাশ আমাদের একজন সঞ্জয়। তিনি উবাচ। আমাদেরকে হাজির করেন কুরুক্ষেত্রে। যুদ্ধক্ষেত্রে। সমবেতা। যুযুৎসবঃ।
0 মন্তব্যসমূহ