জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত
প্রথম কবে খবরের কাগজ পড়েছিলাম মনে পড়ে না। মনে পড়ার কথাও নয়। কেননা বোঝবার মতো বয়স হলেই না খবরের কাগজ কি জানা যাবে। তারপর টানা পড়বার মতো কিছু শিখলে বাড়ির কাগজটি হাতে নেয়ার চেষ্টা- অন্তত লেখাপড়া জানা পরিবারে। এই রকমই ঘটে আজকাল দেখতে পাই।
আমার বেলায় অবশ্য অমন ঘটেনি এ আমি নিশ্চিত। শহরে আসবার পরেই খবরের কাগজ দেখেছি, হয়ত পড়েওছি সামান্য- ছোটদের পাতা। পঞ্চম শ্রেণীর ছাত্র- পঞ্চাশ বছর আগের কথাই'আনন্দবাজার পত্রিকা'র ছোটদের পাতার নাম ছিল 'আনন্দমেলা'। মেলার আয়োজক ছিলেন মনে হয় 'মৌমাছি' 'যুগান্তরে'রও ছিল একপাতা- সেটি কি 'ছোটদের পাততাড়ি'? আয়োজক 'স্বপনবুড়ো'? চিঠি লিখে সভ্য হয়েছিলাম আসরের দুই কাগজেই। ছোট মামার উৎসাহে।
দেশ ভাগের পরপরই। 'আনন্দবাজার', 'যুগান্তর' কি 'স্টেটসম্যান' তখনও আসতো, কিন্তু পড়া উচিত কি উচিত না এ নিয়ে সংশয় ছিল অনেকের সম্ভবত। ঢাকার নতুন কাগজ 'আজাদ'-এ ছোটদের আসর ছিল 'মুকুলের মহফিল', আয়োজক 'বাগবান'। আমরা মুকুলের মহফিলেরই কেবল নয়, সভ্য হয়েছিলাম 'মুকুল ফৌজ'-এরও। নূরু ভাই ছিলেন আমাদের পাড়ার ফৌজ-এর দায়িত্বে। বগুড়া শহরের বনেদি পাড়া জলেশ্বরীতলা হিন্দুপ্রধান হলেও মুকুল ফৌজ-এ এসেছিল অনেকেই। বালক-বালিকা অনেকেই। মুসলিম লীগের কাগজ 'আজাদ', তারই মধ্যে আছে মুকুল ফৌজ-- একথা কেউ বলেছে সেই সময়ে শুনিনি। 'অবজার্ভার' প্রায় ঐ সময়েরই কাগজ হলেও দেখিনি তখন, ইংরেজি কাগজ বলেই হয়তো। 'সংবাদ', ইত্তেফাক তো আরও পরের।
সাতদিন নৌকা বেয়ে পাবনার বেড়া থানা থেকে বগুড়া শহরে এসেছিলাম আমরা। পিতা ও তিনপুত্র, মাঝিমাল্লাসহ। বগুড়া থেকে একদিনের পথ দূরে শেরপুরের ঘাটে পৌঁছে শুনি মহাত্মা গান্ধী আততায়ীর গুলিতে নিহত হয়েছেন। গান্ধীর কথা জানতাম খুবই। আগের বছর কলকাতা যেতে হয়েছিল আমাদের ছোট তিন ভাইবোনকে দেশত্যাগী বড় মামার সঙ্গে- সেইবার আমাদের দোতলা বাসটির ঠিক নিচে ভিড়ের মধ্যে একটি গাড়িতে নাকি গান্ধী ছিলেন। আমার মনে হয় আমি তাঁকে গাড়িতে বসা দেখেছিলাম। স্মৃতিবিভ্রম নিঃসন্দেহে- বাসের দোতলা থেকে নিচের রাস্তায় ভিড়ের মধ্যে গাড়িতে বসা গান্ধীকে দেখা কি আদৌ সম্ভব!
গান্ধীর মৃত্যুই আমাকে খবরের কাগজে টেনে নিয়েছিল, বিশাল অক্ষরে আততায়ীর গুলিতে নিহত হওয়ার সংবাদ-- সেই বুঝি আমার প্রথম সংবাদপত্র পাঠ। ঠিক মনে পড়ে না। মহাজনেরা ডায়রি লেখেন, তাঁদেরই কেবল সব মনে থাকে।
ঐরকম কোন সময়েই 'আনন্দবাজার' এবং 'যুগান্তর' আর দেখি না। বাড়িতে অনেকদিন কোন খবরের কাগজ আসে না। বাবা কখনো কখনো বাইরে থেকে অন্যের পড়া কাগজ ঘরে নিয়ে আসতেন মনে হয়। খবরের কাগজে ব্যয় করার মতো পয়সা তাঁর ছিল না, এখন বুঝি। তবুও ওরই মধ্যে কখনও পাড়ার মুদি দোকানের-- বড় দোকান মুরারীর ছোট দোকান খোকার- কাগজ নিয়ে এলে ফেরত দিতে যাওয়ার সময় যতোটা পড়া যায়, পড়তাম। কি কাগজ ছিল সেসব? 'আনন্দবাজার' 'যুগান্তর' বন্ধ হওয়ার পরে 'সত্যযুগ' এসেছিল অনেকদিন। দেয়ালে দেয়ালে পোস্টার দিয়ে সেই কাগজ প্রকাশিত হয়েছিল- কলকাতা থেকেই। 'সত্যযুগ', অনেক পরে শুনেছিলাম, কোন রাজনৈতিক দলের কাগজ ছিল। হিন্দ, মহাসভারই সম্ভবত। বেশ কিছুকাল চলেছিল 'সত্যযুগ' - বগুড়ায় আসতো।
'সত্যযুগ'-এর পরের কাগজ 'লোকসেবক' পড়েছি অনেকদিন, স্কুলের শেষ দিক পর্যন্ত মনে হয়। আর পড়ার চেষ্টা করতাম 'স্টেটসম্যান'। আমাদের স্কুলের এক দফতরি এই দুটি কাগজ পেঁৗছে দিতো গ্রাহকের ঘরে পাড়ায় পাড়ায়। 'স্টেটসম্যান' পড়ার সুযোগ হয়েছিল এই কাগজ বিতরণের সুবাদেই।
কলেজে ভর্তি হয়েছিলাম কোন কিছু না ভেবেই। বাবার যে আমাকে কলেজে পড়ানোর ক্ষমতা নেই এ কথাও ভাবিনি। শহরের শেষ মাথায় এক ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীর ঘরে মিলেছিল জায়গীর তার ছেলেটিকে পড়ানোর বিনিময়ে। ঐ ব্যবসায়ী, রঘুনাথ, বাজারে পান-তামাকের দোকানদার, এবং তার স্ত্রী মেনকা, অবশ্য কিছুকাল পরেই আমাকে তাদের সন্তানের গৃহশিক্ষক নয়- স্নেহে ও ভালোবাসায় পরিবারের একজন করে ঘরে তুলে নিয়েছিল। তবুও কলেজের ফিস, হাতখরচ ইত্যাদির জন্যে কিছু অর্থের প্রয়োজন তো হয়ই, তিন মাইল হেঁটে কলেজে গেলেও। স্কুলের দফতরি গফুর দিয়েছিল আমাকে সেই অর্থ উপার্জনের সুযোগ। ভোরবেলায় স্টেশন থেকে 'স্টেটসম্যান' কাগজের প্যাকেট খুলে সে আমাকে কিছু কাগজ দিতো প্রায় সারা শহরেই বিলি করার জন্যে। আমি ভ্রূক্ষেপ করিনি। সারা শহরে হেঁটে গ্রাহকদের বাড়িতে বাড়িতে কাগজ দিয়ে তারপর কলেজে গেছি। 'স্টেটসম্যান' পড়া হতো ওই হাঁটা চলার ফাঁকে ফাঁকে। এই ব্যাপারটি জানাজানি হলে কলেজের দেয়াল পত্রিকায় 'দারিদ্র্যের কাছে মাথা নত করবো না'- জাতীয় কিছু লেখা হয়েছিল আমাকে নিয়ে। ব্যাপারটি এতোদূর গড়াবে অবশ্য ভাবিনি। ভালোও লাগেনি খুব একটা। মধ্যবিত্তের সন্তানই তো- হোক না তা নিম্ন মধ্যবিত্ত।
কলেজে পড়ার সময়েই 'ইত্তেফাক', 'অবজারভার' কি 'সংবাদ' প্রায় নিয়মিত পড়ার সুযোগ হয়, উডবার্ণ পাবলিক লাইব্রেরিতে। ছাত্র-আন্দোলনে নিবেদিত তখন। দৈনিক খবরের কাগজ না পড়লে চলবে কেন? বলা যাক সেটি বরং খুবই প্রিয় কর্তব্য ছিল। এডওয়ার্ড পার্কে ঢুকে সোজা লাইব্রেরির দিকে যাওয়া; খবরের কাগজ পড়া; তারপর বই নেয়া বা ফেরত দেয়া। দিনে দুতিনটি বইও পড়েছি কখনও সেই সময়ে।
ঢাকায় আসার পরে অবশ্য অনেককাল 'স্টেটসম্যান' পড়া হয়নি। প্রথম বাস ইসলামপুরে। যে প্রকাশকের প্রুফ দেখার বিনিময়ে থাকা-খাওয়া মিলেছিল 'আজাদ'-এর বার্তা সমপাদক জনাব আলী ছিলেন তাঁর দেশের লোক। তাই 'আজাদ'-ই পড়া হতো সেখানে নিয়মিত। সুরেন ঘোষের 'ইস্টবেঙ্গল পাবলিশার্স, প্রকাশ করেছিল 'আজাদ'-এর সাহিত্য সমপাদক আবদুর রশীদ ওয়াসেকপুরীর'বান'। আমি সেই উপন্যাসের প্রুফ দেখেছিলাম। ঐ সূত্রে ওয়াসেকপুরীর সঙ্গে যোগাযোগ এবং 'আজাদ'-এর সাহিত্য সাময়িকীতে প্রথম গল্প প্রকাশ। গল্পের নাম 'চরণপদ্ম'। সাহিত্যজগতে সেই প্রথম প্রবেশ। এর আগে গল্প ছাপা হয়েছিল কেবল কলেজ বার্ষিকীতেই।'আজাদ'-এ গল্প প্রকাশের কিছুকাল পরেই 'হিসাব' নামে একুশে ফেব্রুয়ারি নিয়ে একটি গল্প লিখে দিয়ে আসি 'মিল্লাতে'। 'মিল্লাত'-এর অফিস ছিল তখন তাঁতিবাজারে- কোর্ট ভবনের কাছাকাছি। মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান তখন 'মিল্লাত'-এর সাহিত্যপাতা দেখেন-- আমায় বলেছিল মোস্তাফা কামাল, তখনকার দিনের ছড়ালেখক, পরে বাংলাবাজারের প্রকাশক আবদুল কাদের দেওয়ান। তাঁর দেয়া তথ্য সত্যি হলে মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান আমার গল্পটি ছাপিয়েছিলেন একুশে ফেব্রুয়ারির বিশেষ সংখ্যায়।
ইসলামপুরের বাস ওঠে অল্পকাল পরেই। চলে আসি জগন্নাথ হলে। এখনকার জি. সি. দেব ভবনে। একশ দুই নম্বর ঘরে। জগন্নাথ হলের রিডিং রুমে দুইএকটি কাগজ থাকতো। 'অবজারভার', 'ইত্তেফাক' নিঃসন্দেহে। 'স্টেটসম্যান'ও। কাগজ না পড়ার দুঃখ মিটে যায় তারপর চিরকালের জন্যেই। এম.এ. পরীক্ষার খবর প্রকাশের আগেই বাংলা একাডেমীতে কর্মলাভ এবং প্রায় একই সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে জার্নালিজম ডিপ্লোমা কোর্সের প্রথম ব্যাচের ছাত্রত্বলাভ। সংবাদপত্র আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলেছে আমাকে ততোদিনে।
এর পরের পথ, বলা যাক, সোজাই ছিল। বাংলা একাডেমীর চাকরিতে থাকাকালীনই ইংরেজি সাপ্তাহিক 'হলিডে'তে কলাম লেখা শুরু- গল্পাদি লেখার পাশাপাশিই। তারপর বাংলা একাডেমী ত্যাগ, 'অবজার্ভার'-এর সমপাদকীয় বিভাগে যোগদান, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যাত্রা। মাস্টার্স, পিএইচ.ডি. ডিগ্রি লাভ, মিসৌরী ইউনিভার্সিটির তথ্য বিভাগে চাকরি, আমেরিকার বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা, ইত্যাদি। সংবাদ, সংবাদপত্র, তথ্যপ্রবাহ, গণমাধ্যম, যোগাযোগপ্রযুক্তি ক্রমে জীবনের আধেয় হয়।
২
খবরের কাগজে যা লেখে সবই ঠিক। সব সত্যি। এ বিশ্বাস দীর্ঘকাল ছিল। ঢাকায় আসার পরে অনেকদিনই। খবরের কাগজের রিপোর্টার-- তার সামনে সারা পৃথিবী খোলা ছিল। স্বাছন্দে সে ছদ্মবেশী রাজকন্যার প্রণয় লাভ করে-- 'রোমান হলিডে'তে যেমন পায় গ্রেগরি পেক, অড্রে হেপবার্নের। বাংলা পড়ার জন্যেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আসা, বাংলায় এমএ পাস করা ছিল স্বপ্ন। বাংলায় অধ্যাপনাই ছিল আদর্শ। অথচ ক্রমে বাংলা নয় জার্নালিজম, খবরের কাগজ, ম্যাগাজিন, প্রকাশনা ভিন্ন পথে নিয়ে যায়। বাংলায় এমএ পাস করলেও কোনোদিন বাংলার অধ্যাপনা করা ঘটে ওঠেনি। সে যে কেবল গ্রেগরি পেক-এর জন্যেই তা বলা যাবে না। সংবাদপত্র এবং সাংবাদিক অপরিমেয় শক্তির ও প্রতিপত্তির আধার এই বিশ্বাস দৃঢ় হয়। দেখি, সংবাদ প্রকাশে সরকারি নিষেধ। শুনি, গোয়েন্দা বিভাগের লোক খবরের কাগজের দপ্তরে গিয়ে ঠিক করে দেয় কোন্ খবর ছাপা যাবে। সেন্সরশিপ, খবর প্রকাশে নানা নিয়ম ইত্যাকার কথা শুনে সাংবাদিকের প্রতি শ্রদ্ধা আরো বাড়ে, আকর্ষণও বাড়ে সমান তালে। সংবাদপত্রই হচ্ছে জনগণের অধিকার রক্ষার অতন্দ্র প্রহরী। অন্যায়ী সরকারের মুখোমুখি দাঁড়ানোর ক্ষমতাধর। সাংবাদিকতায় উচ্চশিক্ষা লাভকালে দেখি এ ধারণা ভুলও ছিল না। সংবাদপত্রের 'অ্যাডভারসারি রোল' বা বিরোধী পক্ষের ভূমিকা কি 'ফোর্থ এস্টেট' দেশ শাসনের চতুর্থ শাখা- জাতীয় চিন্তা পণ্ডিতকুলকে চিরকালই নাড়ায়।
ডিপ্লোমা শেষ করার কিছুকালের মধ্যেই বাংলা একাডেমীর চাকরি ছেড়ে দিয়ে 'অবজারভার-এ চলে যাই। হলিডের কলাম এবং 'অবজারভারে' একটি দুটি লেখা দেখে আবদুল গনি হাজারী আমাকে'অবজারভারে' সুযোগ করে দেন। পরম আনন্দে স্বপ্ন সফল হলো ভেবে চলে আসি আজীবনের এই পেশায়। অবশ্য এ সময়েই, অবজারভারে আসার বছর দেড়েক আগেই মনে সন্দেহ জাগে সাংবাদিকের জগতে হয়তো সবই রোমাঞ্চ নয়।
ঊনিশশ চৌষট্টির সেই সামপ্রদায়িক দাঙ্গার কথা আজও ভোলা যায় না। কাশ্মীরের হযরতবাল মসজিদ থেকে মহানবীর পবিত্র কেশ চুরি যাওয়ার বিভ্রান্তিকর সংবাদ ওই দাঙ্গা ছড়ায়। তৎকালীন রাজনৈতিক অবস্থা জেনেও 'মর্নিং নিউজ' এবং 'অবজারভার'সহ বিভিন্ন কাগজ ঐ ভ্রান্ত খবর ব্যানার হেডলাইনে প্রকাশ করে। উদ্দেশ্যমূলকভাবেই। দাঙ্গা ছড়ায় ঢাকাতেও। আমি নিজে প্রায় চারদিন ঘরে বন্ধ ছিলাম। আর তখনই সন্দেহ হয় সংবাদপত্র সর্বদাই জনগণের জীবনানুকূল এটি সত্য নয়। এ বিশ্বাস নিঃসন্দেহে দৃঢ়বদ্ধ হতো যদি-না 'ইত্তেফাক' দাঙ্গার বিরুদ্ধে 'বাঙালি রুখিয়া দাঁড়াও' এ শীর্ষ শিরোনাম বা ব্যানারে প্রকাশিত না হতো।
সাংবাদিকতার জগত স্বর্গোপম নয় একথা জানা হলেও আকর্ষণ কিছু কমে না তাতে। বাংলায় অনার্স পড়ার সময়ে একবার শান্তিনিকেতনে পড়তে যাওয়ার প্রবল বাসনা হয়। ছেষট্টির পরে তেমন বাসনা জাগে সাংবাদিকতায় লেখাপড়া করার জন্যে বিদেশ যাওয়ার। ঐ সময়েই আমি ব্রিটিশ কাউন্সিলে দরখাস্ত করেছিলাম বিলেতে সাংবাদিকতা শিখতে যাওয়ার জন্যে। ইন্টারভিউ নিয়েছিলেন ইংরেজি বিভাগের অধ্যক্ষ সৈয়দ সাজ্জাদ হোসেন। আমাকে বৃত্তি না দেয়ার কারণের মধ্যে তিনি বলেছিলেন, বিলেতে কেন, সাংবাদিকতা পড়তে আমেরিকায় যাও। আমাকে বঞ্চিত করলেও অন্তত একটি ঠিক কথা বলেছিলেন তিনি। ঐ ঘটনার দুই বছর পরে আমি যুক্তরাষ্ট্রের ফিলাডেলফিয়ায় টেমপল ইউনিভার্সিটিতে চলে যাই-- সাংবাদিকতায় উচচশিক্ষা লাভের জন্যে।

৩
বাংলায় অধ্যাপনা করার কথা যার সে সংবাদভুবনে চলে যায় কোন্ আকর্ষণে। এম.এ-এর রেজাল্ট খারাপ ছিল না। গল্প-কবিতা ইত্যাকার লেখালিখি কিংবা ছোট কাগজের সমপাদনা ইংগিত করে তো অধ্যাপনার দিকেই। তাহলে? আর সেই সময়ে সরকারি রেডিও ছাড়া সাময়িক পত্র কি খবরের কাগজই ছিল গণমাধ্যম। সাদা-কালোয় ছাপা। নিউজপ্রিন্টও এমন কিছু ভালো নয়, এরকম আটপৃষ্ঠার গুটিকত কাগজই তো। কি ছিল তার আকর্ষণ?
আমি নিজেও ভেবে দেখেছি। বাংলা একাডেমীতে আমার প্রথম প্রকাশনা বিভাগে চাকরি হলেও মাত্র তিন মাসই ছিলাম সেই বিভাগে। তারপরে যাই সংকলন বিভাগে। আঞ্চলিক ভাষার অভিধান ও ব্যবহারিক বাংলা ভাষার অভিধান প্রস্তুত প্রকল্পের জন্যে শব্দ বাছাই, ব্যুৎপত্তি নির্ণয়, কুলজি স্থির ইত্যাদি বিন্দুমাত্র আকর্ষণ করেনি আমায়। পরিপূর্ণ একঘেয়ে, বিরক্তিকর কাজ এই চিন্তা এমন সর্বব্যাপী ছিল যে 'অবজার্ভারে' চাকরি স্থির হওয়ার আগেই একাডেমীর চাকরি ছেড়ে দিয়েছিলাম। সরকারি কলেজে চাকরি নিলে ঢাকার বাইরে যেতে হয় এ ভাবনাও সাংবাদিকতার দিকে টেনেছিল নিশ্চয়ই। কিন্তু বড় ছিল সংবাদ মাধ্যমের সর্বদা পরিবর্তনশীল স্বছন্দপ্রবাহী চরিত্রই। আমার হাতে কলম, এতো শক্তি আর কার-- এইসব চিন্তাও ছিল হয়তো। তাছাড়া সাংবাদিক যে এতো নিগ্রহ কি নির্যাতনের শিকার হবেন কখনো কি স্বার্থবুদ্ধি তাকে এতো দূরে নিয়ে যাবে যে ন্যায়-অন্যায়ের পার্থক্য তার কাছে থাকবে না, এসব চিন্তায় ছিল না। সাংবাদিক যদি কারাবরণ করেন তাও অন্যের স্বার্থ রক্ষায়ই-- এই ছিল ধ্রুব চিন্তা।
তাছাড়া বাংলার ছাত্র বিদেশে পড়তে গেলে পড়তে হবে শব্দতত্ত্ব, ভাষাতত্ত্ব এসবই। খুব আকর্ষণীয় ছিল না। আরও একটি কারণ ছিল। সেটি যুক্তরাষ্ট্রের গণমাধ্যমকে জানা।
টেমপল-এ আমার একটি গ্র্যাজুয়েট এ্যাসিস্ট্যান্টশিপ ছিল। প্রথম বছরে বিভাগীয় পাঠকক্ষের তদারক করা। ঐ লাইব্রেরিতেই আমি পরিচিত হই আমেরিকার বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আসা একাধিক সংবাদপত্রের সঙ্গে। নিউইয়র্ক টাইমস, ওয়াশিংটন পোস্ট, লস এঞ্জেলস্ টাইমস্, ফিলাডেলফিয়া ইনকোয়্যারার, ইভনিং বুলেটিন, বাল্টিমোর সান, মায়ামি হেরাল্ড, সেন্টলুইস পোস্ট-ডিসপ্যাচ, শিকাগো ট্রিবিউন, শিকাগো সান টাইমস, ডেইলি নিউজ, ডেনভার পোস্ট, লুইভিল কুরিয়্যার জার্নাল, ক্রিশ্চিয়ান সায়েন্স মনিটর নিউজডে-সহ শতাধিক কাগজ নিয়মিত গুছিয়ে রাখতাম। চোখে পড়তো তাদের লেখা। পড়ে মনে হতো কাগজ যেন প্রকাশিত হচেছ পাঠকের জন্যেই। পাঠক যা জানতে চাইবে, যা তার প্রয়োজন তাই তাকে দাও। সরকার, হোক সে স্থানীয় কি জাতীয়, কি চায় সেটা বড় কথা নয়। মনেপ্রাণে নিজ অঞ্চলের প্রতি অনুগত সেইসব কাগজ। যার ফলে আমেরিকায় তখন কোন জাতীয় সংবাদপত্র ছিল না বলা যায়। নিউইয়র্ক টাইমস হয়তো ছিল কিছু পরিমাণে, আর এখন আছে ইউএসএ টুডে।
যুক্তরাষ্ট্রে সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতার ভিত্তি প্রোথিত তাদের সংবিধানের প্রথম সংশোধনীতেই। 'সরকার সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতা খর্ব করার জন্যে কোন আইন প্রণয়ন করবে না।' সাফ কথা। বিভিন্ন ব্যাখ্যা আছে সংবিধানের এ সংশোধনীর। আইনি ব্যাখ্যাও অনেক। আজও তবু ওই মূল ধারাই চালু আছে। কোন সরকার তা অগ্রাহ্য করতে পারে না। সংবিধান কেবল দেশ শাসনের নয়, জনগণের জীবন পরিচালনার নির্দেশও তো। আমেরিকার গণমাধ্যম, সংবাদ মাধ্যম একথা মানে। মানে তাদের সরকারও।
চৌষট্টির সেই সন্দেহের ঘুণপোকা এখন বেশ পুষ্ট হয়েছে দেখি দেশে ফেরার পরে। অথচ নানা রঙে ছাপা নয়নমনোহর, চিত্তহারী শোভার ঝলমলে কাগজ গুনে এখন এক হাতে শেষ করা যায় না যায় না বাংলাদেশে। আমেরিকার মতো নয়, জনসংখ্যার তুলনায় হয়তো কিছুই নয় এখনও, তবুও মনে হয় অনেকই। মনে হয় প্রয়োজনের তুলনায় বেশিই। অথচ তেমন হওয়ার কথা নয়। জাতিসংঘ প্রস্তাবিত গণমাধ্যমের নিুতম সংখ্যায়ও আমরা পৌঁছিনি এখনও। তাহলে? পণ্ডিতেরা কারণ বিশ্লেষণ করেন অনেক-- সংবাদ মাধ্যমের ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দ, রাজনৈতিক বিশ্বাস, স্বার্থচিন্তা, পাঠককে ভাসিয়ে নিয়ে যায়। পাঠক কোনোমতে নিজ জায়গায় দাঁড়াতে পারে না। আর সরকারও তেমনি-- সরকারের সব শাখাসহ। গায়ে টোকা মারা সয়না। গ্রেপ্তারি পরোয়ানা আসে।
আর সাংবাদিক তখন করে কি? বাঁচার জন্যে যা করা দরকার করে। ক্রমে এটিই অভ্যাসে পরিণত হয়। যেমন করলে দিন পার করা যায়। তেমনি করে সে। সরকারি সমর্থক হলে সরকারের ইচছানুযায়ী কলম চলে। বিরোধী হলে দাঁতফুটে বেরুনো মিথ্যা কথা লেখা। ওই। এরকমই চলে। এরই মধ্যে গা ঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা হয় কখনও কখনও। চেষ্টা করে কেউ কেউ। নির্যাতিত হয় তখন প্রকৃত খবর দেয়ার জন্যে। চাই কি পঙ্গু হতে হয়, জীবননাশও। কি করবে সে? পঞ্চাশ বছর পরে এমনি দেখি।
1 মন্তব্যসমূহ
আপনার লেখা পড়ে আমারও ছেলেবেলার কাহিনী মনে পড়ে গেল। ধন্যবাদ !
উত্তরমুছুন