কেষ্টযাত্রা ও একজন জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত

কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীর

জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত গল্প সৃজনে মত্ত হন ষাট দশকের একবারে গোড়া থেকেই,-- দুর্বিনীত কাল (১৯৬৫), বহে না সুবাতাস (১৯৬৫), সীতাংশু, তোর সমস্ত কথা কাল (১৯৬৯) নামের গল্পগ্রন্থ তখনই প্রকাশও করেন। তারপর লেখাজোখা থেকে তিনি এক দশকের মতো লম্বা একটা গ্যাপ দেন। নয় দশকের গোড়া থেকে আবারও গল্প লিখতে থাকেন। তার গল্পগ্রন্থ আছে ১১টির মতো। তিনি শুধু গল্পই লিখছেন। মনিরা কায়েস বিনে আর কোনো প্রতিষ্ঠিত গল্পকার পাওয়াই মুশকিল, যিনি তার জীবন পার করেছেন শুধু গল্প লিখে। তার মানে তিনি আমাদের একজন সার্বিক-গল্পকার।


তিনি যখন গল্প লেখা শুরু করেন, তখন এই জনপদে ভাষাভিত্তিক জাতীযতাবাদের উত্থান ঘটছে। তবে এ উত্থান ছিল একান্তই রাজনৈতিক, তখন জোয়ার আসছে শ্রমজীবীদের ক্ষমতা দখলের। তবে এ গল্পকার সেই দিকে যাননি। তিনি শিল্পের স্বাধীনতা চান, সমস্ত প্রাতিষ্ঠানিকতার বিরুদ্ধেই তার নির্মোহ প্রতিবাদ লক্ষ করা যায়। তিনি শিল্পের জগৎকে ভালোবাসেন, মুক্ত-স্বাধীন চৈতন্য চান তিনি--শিল্পের জন্য শিল্পই কামনা করেন। মার্কসবাদ নামের গরীবী আধিপত্যবাদী দর্শন তাকে আপ্লুত করে বলে মনে হয় না! তাই তার সাধনার জায়গাটা বড়ো মানবিক, চৈতন্যমুখর। তিনি সামাজিক দ্বন্দ্ব দেখেন, তবে মানুষের স্বাধীনভাবে বিকাশের সেই দ্বন্দ্বের জায়গাটি মোহনীয় করে রেখেছে।

তিনি প্রথমতই গল্পে নজর দেন, একটা গল্প বলার দিকেই তার সামগ্রিক বাসনা সজাগ রাখেন। তিনি তার সৃজিত ভাষাকে আলাদা করেন, গল্পে যেন একধরনের কাব্যময়তার জাদু বিস্তার করতে থাকেন তিনি। এ হচ্ছে একধরনের শৈল্পিক সাংবাদিকতা, কথাশিল্পের কুশলতা। তার বর্ণনায় যেমন আছে নিজস্বতা, তেমনি তার বাক্যের ধরনও আলাদা, অহেতুক কথা খরচ করেন না, ডায়লগ দেয়ায় থাকেন হিসাবি। উপমাই যেন গল্প,-- বানী নয়, পাঠকের কাছে গল্প এভাবে থ্রো করেন তিনি, যেখানে পাঠক তার মেজাজে কোনো-না-কোনো ম্যাসেজ সৃজন করতে বাধ্য হন। তিনি তার প্রাপ্তির জায়গাটা ক্লিয়ার করে বলতে চান, তবে তিনি তা একেবারে ষোলআনা খোলাসা করেন না। শিল্পের ঘোর তিনি তৈরি করতে জানেন। তার গল্পে পাঠস্বাদুতা পরখ করতে যাওয়া ঠিক নয়। গল্প তিনি জ্ঞানে ধ্যানে রাখেন, তবে এর ভিতরকার জমাট জমাট ভাবটি তার আছে বলে মনে করা মুশকিলই।

এবার তার সৃজিত গল্প কেষ্টযাত্রা নিয়ে কিছু কথা বলব; এবং তা করতে গিয়ে অবশেষে আমায় এমন সিদ্ধান্তেই স্থির থাকতে হলো যে, কেষ্টযাত্রা যতবারই পড়ব, ততবারই এর ভিতরকার নান্দনিকতা নতুন করে আমায় জারিত করবে! এ গল্পটি তার প্রথমদিককার গ্রন্থেই পড়েছি মনে হয়। এটি তার প্রথম গল্পগ্রন্থ বহে না সুবাতাস-এই পড়েছিলাম কি? ঠিক মনে করতে পারছি না। প্রথমইে গল্পটির শিরোনাম আমায় চমকে দেয়, মনে হয়, এ এমন এক জীবনযুদ্ধ যা ক্রমাগত একটা বিশাল ক্যানভাসের সামনে আমায় দাঁড় করিয়ে দেয়। একজন কেষ্টবাবু একটা যাত্রা শুরু করেন, মনে হতে পারে এ যাত্রাশিল্পের যাত্রা! আসলে তা নয়। একে একটা গমন বলা যায়, একদিনের গমন, বিকালের দিকে গায়ে অতি সাধারণ একটা জামা গায়ে মেজছেলে সুখেনসহ তিনি বাজারে যান। নাম তার মহিমাগঞ্জ-- গ্রাম-গ্রাম গন্ধে ঠাসা এক বাজার। তার কাজ কি ছিল তা নির্ণয় করতে গেলে, হয়ত তা জানা যায় বা যায় না। তিনি ছেলেকে মনে হয় তার জীবন দেখাতে নিয়ে গিয়েছিলেন! সে জীবন খরিদদার, পাওনাদার, হতাশাদার কর্তৃক ভরপুর নাকি তা নুয়ে-আসা-ব্যর্থতার জীবন, তা-ই দেখানোর খায়েশ। তিনি যে আসলে কী কী দেখাতে চেয়েছিলেন তা আমরা শেষতক পাই না, তিনি যেন নফরত্ব লালন করতেই বাধ্য হন। হয়ত রাজা হওয়ার বাসনা যে জীবনে যায় না, অথবা বড়ো স্বপ্ন দেখাই একটা ভুল ব্যাপার তাই আমাদের কাছে স্পষ্ট হয়।

আমার যা মনে হয় তা হচ্ছে, একজন গল্পকার কতভাবে জীবনকে চেনাতে পারেন, তারই এক ল্যান্ডস্ক্যাপ এটি। অথচ এর শুরুটা হচ্ছে সংবাদপ্রদানকারী এক শাদামাটা ডায়লগ নিয়ে,-- সেখানে তিন বারের বার কেষ্টবাবু জামাটা পুরোপুরি গায়ে দিলেন। অতি সাধারণ সংবাদ। প্রতিবেদনমুখর এক গল্প হতে পারত এটি। এর ভিতরকার শক্তিও ষাট দশকের অতি সাধারণ এক জীবনব্যবস্থামুখর। অথচ আমরা যখন ধীরে কেষ্টবাবুর সহযাত্রী হতে থাকি, তখন গল্পের পরতে পরতে বিপুল জীবন উদ্ভাসিত হয়। আমরা একে একধরনের জীবনব্যবস্থা বলতে পারি, তার ভিতরকার হাহাকার বলতে পারি, ধীরে ধীরে যা খোলাসা হয়। তিনি মেজাজে যে সৌখিন, অন্তত জীবনের নানান জিনিস প্রাপ্তির বাসনায় তা মনে হয়। যেমন, তার ফুলহাতা জামার উপরের বোতামটি ক্রিমেন্টাজ-এর; তার বাদে সব বোতামই শাদামাটা। এই বোতাম দিয়ে একটা সাঙ্কেতিকতার মুখোমুখি হই আমরা। সেই সাঙ্কেতিকময় জীবন দেখতে হলে সবটুকু গল্পই পড়ে নিতে হবে। তার জীবনের শুরুতে একটা পাওনা ছিল, আজ তা মনেও করতে পারেন না, কোথায় যেন হারিয়ে গেছে। যেন তার প্রথম বোতামটির মতোই শুরুতেই তা শেষ হয়ে গেল। যেভাবে শেষ হলো, তাতে তার ছেলেটাকে পর্যন্ত স্কুলে পড়াতে পারেন না তিনি।

এখন তিনি কী করেন? হোমিওপ্যাথির ওষুধপত্র সাপ্লাই দেন, এসবের বইও দেন। এসব তিনি অর্ডার হিসাবে নেন। কিন্তু সময় মতো তা পৌঁছাতে পারেন না। অথবা অভাবের তাড়নায় তিনি টাকা-কড়ি মেরে দেয়ার ধান্ধায় থাকেন। নিজের মান বাঁচাতে পাওনাদারদের কাছ থেকে দূরে দূরেও থাকেন। তার নিজের পাওনা আদায় করতেও সমস্যা হয়। এ-পথ সে-পথ ঘুরে জীবন চালাতে চান তিনি-- কিন্তু তা আর পারছেন। বিকালের পুরোটায় তিনি বাজারে ঘুরে রাতের ট্রেনে বাড়ি আসতে চান। তখনই তিনি রেলস্টেশনে নিরু মাস্টার আর স্টেশন মাস্টারের খপ্পরে পড়েন। তিনি মাস্টারের  কাছ থেকে টাকা নিলেও চাহিদা মোতাবেক হোমিওপ্যাথির বই দিনে পারেন না। তাই তারা কেষ্টবাবুকেও অপমান করে। তার ছেলেটা তা দেখেও ফেলে, তাতে তার লজ্জার সীমা থাকে না। ছেলেকে তিনি নিষেধ করেন তা কাউকে যেন সে না বলে!

গল্প শেষ হয়। আমরা বলতে পারি, যেভাবে তা শেষ হয়, তা যেন বার বার শুরুই হয়। আবারও একই কথা বলতে হয়। তার এ গল্পের শুরুটা বিশাল এক উদ্ভাসন দিয়ে। যেন তিনি সংবাদমুখর ঘটনা বা ফিকশন বলছেন। বাক্য তেমন বড়ো নয়, কাটা কাটা। অনেক ফুটেজ জোড়াতালি দেয়ার মতোই। গল্পেরও যে সম্পাদকীয় থাকতে পারে, মানে, তা পুরো সম্পাদকীয় সারাৎসার হয়, এ গল্প তারই এক নজির। তিনি বাক্য নির্মাণে খুবই পটু। গল্পের খালি জায়গাসমূহ বাক দিয়ে উর্বর ক্ষেত্র করে ফেলেন।

আমরা এখানে আলোকময় কিছু আবহ দেখি, আবার অন্ধকারে পরিপূর্ণ কিছু এলাকাও দেখি। কেষ্টবাবু আলো চান, তার জীবন আলোয় বন্যা বয়ে থাকার মতো তা হতে পারত। কিন্তু তিনি বাড়ি থেকে বের হওয়ার পরই অন্ধকারের সন্ধানেই থাকেন। কারণ আলোতেই সব পাওনাদার যেন তাকে ছেকে ধরবে! কিন্তু তিনি মধ্যবিত্ত-আড়ালের জন্য রীতিমতো তৎপর থাকেন। তিনি যে রাজা হতে চেয়েছিলেন, বা রাজা হওয়ার উদ্ভাসন তার ভিতরে আছে, তা একফোঁটাও ভুলেন না। তাই তো তিনি ছেলেকে স্কুলে বর্তি করানোর কথা বলেন। যে জীবন ফেলে এসেছেন তার কথা বলেন। স্বপ্নই তার জীবন। কিন্তু সেই জীবন আর তার পাওয়া হয় না। আমরা এ গল্পের শেষ লাইনসমূহ আবার স্মরণ করতে পারি-- ‘কেষ্টবাবু ফাঁকি দিয়ে বেড়াচ্ছিলেন, সোজা-রাস্কতা ছেড়ৈ ঘুর-রাস্তায় হেঁটে। আালো ছেড়ে অন্ধকারে এসে। কেননা, ওঁর কিছু দেনা আছে দেখা গেল। তবে হ্যাঁ, কেষ্টবাবুর কিছু পাওনাও ছিল। না, অমূল্য ডাক্তারের কাছে নয়, অন্য কোথাও। কোথায় তা কেষ্টবাবু জন্মের সময় জানতেন, এখন আর জানেন না।
আর যাত্রার নফররা তা জানেও না।

তিনি গল্পে স্বভাবত ডায়লগ তেমন ব্যবহার করেন না। তবে এ গল্পে ডায়লগ ব্যবহারের পরিমিতিবোধের সাথে আছে মুনশিয়ানা। যেন কথার এক জগৎ বসেছে এখানে। কেষ্টবাবু ছেলে নিয়ে ঘুরছেন, দেখছেন, নিজের জগৎ নিয়ে হাহাকারে আছেন, কিন্তু কথা তার থামে না। বর্ণনায়ও কথা আছে। না-কথাতেও কথা আছে-- যেন তা এক কথাসরিৎসাগর!

এখানেই ছোটগল্পের দাপট প্রকাশ পায়। তিনি ছোট প্রাণ, ছোট ব্যথা দ্বারা তার গল্প ভরাট করেননি। তিনি তার উপমায়, উৎপ্রেক্ষায়, সাঙ্কেতিকতায় তা আমাদের বার-বার জানাচ্ছেন। আমরা এ গল্পে জ্যোতিপ্রকাশের কাছে কৃতজ্ঞ থাকতে বাধ্য হবো। কারণ তাতে জীবনের যে ঘ্রাণ, যে প্রাণ, যে দীর্ঘশ্বাস লেগে আছে, তা ছোটগল্পেই থাকে। আমরা যখন জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত পাঠ করি, তখনই এমন এক গল্পকারের সন্ধান করতে পারি যেখানে বোঝা যায়, গল্প হচ্ছে নিত্যসাধনার এক ব্যাপার। এর প্রকৃত কম্পোজিশন এমনি-এমনি তৈরি হয় না। এর জন্য সাধনা যেমন দরকার তেমনি থাকতে হয় গল্পভাবনার মেধা। এতে কাহিনীর সৃজনশীলতাই শুধু তৈরি হয় না, বরং এতে জীবনের অনেক বড়ো ব্যাপারই প্রকাশ পেতে থাকে। গল্প তো ছোট প্রাণ ছোট ব্যথার কোনো রূপ নয়, বরং এতে জীবনের বিশাল প্রত্যয়ই প্রকাশ পায়। পাঠকের ধারণারও অনেক পরিবর্তনের দায়িত্বও তিনি নেন। কখনও কখনও তিনি আলাদা ভাষাভঙ্গিমা নির্মাণ করতে পারেন। জীবনের এই সত্য প্রকাশে তাঁর দ্বিধা আছে বলেও মনে হয় না। একটা গল্প তিনি বলে যান ধারণা করলেও এখানে অনেক গল্পই তিনি বলতে থাকেন। আর সেই বলা গল্প এক গল্পের ভিতরই মিশে থাকে। এক রঙে অনেক রং আমরা পাই। আমরা শেষ পর্যন্ত এই কথা বলতে পারি, তার সর্বাঙ্গে এক গল্পকারের নেশা মিশে আছে। আমরা সেই নেশায় অবগাহন করতে পারি। জীবন চলে গেলেও জীবনের ফাঁকে ফাঁকে যেমন জীবন লেগে থাকে, তেমনি গল্পের পরেও গল্পের ভিতর আরও আরও গল্প জিইয়ে রাখা যায়। আমরা কেষ্টযাত্রাকে সেই ধরনের গল্পই বলতে চাই। গল্পজনিত এতবার এত এত হতাশার কথা থাকলেও আমরা গল্পের জায়গা-জমিন থেকে আমাদের সত্তাকে আলাদা করতে পারি না।




লেখক পরিচিতি
কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীর
গল্পকার। উপন্যাসিক। প্রবন্ধকার। সম্পাদক
তাঁর প্রকাশিত গল্পগ্রন্থ : মৃতের কিংবা রক্তের জগতে আপনাকে স্বাগতম  (জাগৃতি প্রকাশনী),স্বপ্নবাজি ((ইত্যাদি গ্রন্থ প্রকাশ) কতিপয় নিম্নবর্গীয় গল্প (শুদ্ধস্বর)
উপন্যাস--পদ্মাপাড়ের দ্রৌপদী (মাওলা ব্রাদার্স)।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ