যদি পাখি না ওড়ে
জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত
এক
বালিয়াড়ির
শেষে যখন তারা নদীটির পাড়ে এসে দাঁড়ায়, তখনো সূর্যে তাপ আছে। শুকিয়ে যাওয়া মহানদীর
বালিয়াড়ি পার হওয়া বড় ক্লেশের। কেবল তারা দুজন্তই নয়, নিজ হাতে বিছানো কাঠের পাটাতনের গাড়িটিও তাদের সঙ্গে।
সেটিকেও কখনো চালিয়ে, কখনো ঠেলে আনতে হবে জলের সীমানায়।
সময়ের মহানদী এখন ক্ষীণস্রোতা। সময়ের সঙ্গেই
তার জল দূরে চলে যায়। ফেরে কখনো বর্ষায়। তখন বালিয়াড়ি থাকে না। নদীর নিচে শুয়ে
পড়ে। গাঙশালিকের ঝাঁক উড়ে বেড়ায়, কখনো কেউ বেগে নামে নদীর বুকে – জল ছুঁয়ে ওপরে উঠে যায়। কিন্তুতখন ওই না-বর্ষা না-শরৎ
না-হেমন্তের কালে, মরা কার্তিক আর ধূসর অঘ্রানের শেষে কেউ থাকে
না। আসে যদি তখন বসন্ত, কোনো ফুলবন দেখা যাবে না, এটা বনভূমি নয়, কেউ সাজবে না, খাতে
নেমে যাওয়া নদীর বালিয়াড়ির বুকে ছায়া ফেলে উড়বে তখন অজানা পাখির দল।
নদীর ওপারে স্পষ্টই দেখা যায় লালমাটির পাহাড়, তবু হেঁটে যাওয়া যাবে না সেখানে। সময়ের মতো স্থানেরও মোহ
আছে, নইলে শ্বেত বালিয়াড়ির শেষে নদীটির ওপারে রক্তিম
পাহাড় কেন? তাই নদী পারাপারের জন্যে জোড়া নৌকার খেয়াটিকে
ডাকতেই হয়। বুঝি ওপারেই মাঝির পাটকাঠির চালাটি। রাত না কাটালেও দিন কাটায় সে
সেখানেই। আকাঙ্ক্ষী আরোহীর ডাক কানে গেলে জলযানটি এপারে আনবে সে।
বালিয়াড়ির শেষে ঢালু পাড় বেয়ে খানিক নামলে
বাঁশকাঠের মাচা। জোড়া নৌকার ফেরি ওই মাচা বরাবর দাঁড়ালে মাঝি রশি দিয়ে বেঁধে ফেলে
সেটিকে খুঁটির সঙ্গে। ধীরে জোড়া নৌকার পাটাতনে তখন ওঠে আরোহীকুল – থাকে যদি সঙ্গে তিন চাকার ওপরে কাঠের আসনপাতা গাড়িটির, সেটিও। অথবা গবাদিকুল। কিন্তু ফেরিতে ওঠার জন্যে ঢালুতে
নামলে ওপারের কিছু আর দেখা যায় না। ওপারে বালিয়াড়ি নেই – খাড়া পাড়ে লালমাটির আভাস। ঘাটে যদি মাঝি তার ফেরি নিয়ে
দাঁড়িয়ে না থাকে, তাকে ডাকতে হয় ঢালুর মাথায় দাঁড়িয়ে। খেয়া
তরিটিকে যদিও দেখা যায়, দেখা যায় না তার মাঝিকে কখনো। বুঝি পাটকাঠির
চালায় নিদ্রিত সে।
বালিয়াড়ির পাড় থেকে তাই মাঝিকে ডাকে তারা। দুই
নারী-পুরুষ। পরস্পরের সঙ্গী তারা ঠিক-ই, তবু সঙ্গিনীকেই তিন চাকার গাড়ির আসনটিতে বসতে
হয়। চালায় কী টানে তার সঙ্গীই। চলায় অসমর্থ নারী সে নয়, শারীরিক অসুস্থতাও প্রবল নয়, তবু
সর্বদা বহন করার অঙ্গীকার ওই সঙ্গীই করেছিল। তাই চোরাবালিতে চাকা বসে যেতে চাইলে
সে তিন চাকার গাড়ি থেকে নামতে চায়, সঙ্গী তাকে নিষেধ করে এবং ফেলে আসা পথের যতোদূর
দেখা যায় তার শেষে কখনো সচল কখনো স্থির কৃষ্ণ-অবয়বটির দিকে তাকায়। বুঝি দূরের ওই
অস্পষ্ট চেহারার মানুষটি চালকের কথা মানা বা না-মানার হিসাব নেবে।
কেননা, অস্পষ্ট দেখা যায় ওই মানুষটিও একই কথা বলেছিল।
সেও তাকে বহন করতে চায়। তিন চাকার গাড়ি একটি তারও আছে। পেছন থেকে ঠেলে সামনে নিতে
হয় সেটিকে। তিন চাকার ওপরে বসানো কাঠের বাক্সটি এ-মুহূর্তে নানা রঙের পাত্রে ভরা
হলেও স্বচ্ছন্দে সে-বাক্সটিকে খালি করে তাতে পূর্ণবয়স্ক নারীকে ঠেলে নিয়ে যেতে
পারে সহজেই।
দুই
শুধু
বৃক্ষশীর্ষেই চোখ থাকে না লোকটির – দেখে সে-গাছের কাণ্ডটিকেও। কতখানি ওপরে গিয়ে
গাছ ছড়িয়েছে তার ডালপালা একটিই দেখে সে প্রথমে। চেরাই করবার পরে কী পরিমাণ কাঠ হতে
পারে এটি অনুমান করা চাই। তারপরে কাণ্ডর শেষে আরো কিছু তক্তা যদি হয়, সেটিকেও সে দেখে। বাকি সব ছোটবড় ডালপালা, শাখা-প্রশাখা জ্বালানির জন্যে ব্যবহার করবে সকলে, কিনে নিয়ে যাবে তার কাছ থেকে। পছন্দ হলে গৃহসে’র গাছটিকে কিনে নেয় সে। মজুরির লোক এসে সেটিকে কেটে নিলে
নানা আকারে গুঁড়ি নিয়ে যায় সে কাঠ চেরাইয়ের কারখানায়। কখনো মেলে কিছু লাভ, কখনো মেলে না। এজন্যে রোজগারের এই পথটি বড় পছন্দ ছিল না
তার। কিন্তু করবার কিছু ছিলও না। নিজ হিস্যার কয়েক কাঠা জমি রেহান দেওয়ার পরে এই
পৌষে কিছুই তার ঘরে উঠবে না জেনে গাছ খুঁজতেই গ্রামে-গ্রামে ঘুরছিল সে। আর তখনই
একদিন পৃথুলকাণ্ড গাছটির নিচে সঙ্গিনীকে বসে থাকতে দেখেছিল – তার ঘরের বাইরে। এতোকালের চেনা গ্রাম, চেনা গাছ, চেনা মানুষ মুহূর্তে প্রথম দেখা মনে হয়। ভিন্ন
গ্রামে গাছ খোঁজার কালে যাকে দেখেছিল সে আজ এই এতো কাছে, সামনে, দেখে ঘন ছায়া দেয় যে-গাছ, তার কথা খেয়াল থাকে না। স্ত্রীলোকের চোখ সজল নয়, শুধু ভেজা রোদের তাপই দেখা যায়। চেনা মুখে কোনো ভয় নেই
জানিয়ে ঠিকানায় পৌঁছে দিতে চায় সে। ফেলে আসা ঠিকানায় আর কখনো ফিরবে না জানালে সে
বলে, আমার মাঠেও পৌষ নেই, পৃথুলবৃক্ষের ছায়া কেবল ছায়াই – সূর্য নেমে গেলে সেটিও থাকবে না, বরং চলা যাক সামনে, যদি চায় তাহলে একসঙ্গেই। সঙ্গিনীকে ওই গাছের
নিচেই বসিয়ে রেখে সে নিজ হাতে কাঠের আসন্ত বিছানো ত্রিচক্রযানটিকে নিয়ে আসে। সঙ্গে
আনে নিজ ব্যবহারের নকশিকাঁথাটিকে। সেটি গাড়ির আসনে বিছিয়ে দিয়ে বলে, ‘উঠে বসো। আর কখনো তোমাকে নামতে হবে না।’
তিন
তিনদিন
ঘরে ফেরেনি লোকটি। কৃতকর্মের জন্যে কোনো বোধ ছিল না তার। যে-ঘরে বাস তার, সেটি নিজের নয়, যে-জমির ফসল তোলে সে, সেই জমিও তার নিজের নয় – তাই
সবকিছু ভেসে গেলেও, হারালেও তার নিজের কিছুই যাবে না – এই বুঝি চিন্তা। সেই কথাই বলেছিল তার সঙ্গে যে বাস করে সে।
না-হলে সারা পরিবারের সারাবছরের শ্রমে ফলানো রেহানি জমির ফসল কেউ মাঠেই হাতবদল করে? চলে যায় শহরে অতি লাভের তেজারতি ব্যবসায়? আর মৌসুমের শেষে ফিরে আসে শূন্যহাতে? শোনা যায়, শহরে তেজারতি ব্যবসায় নয়, ভাগ্যের ব্যবসায় সব খুইয়ে ফেরে সে। তখন টিনের চালা খুলতে
হয়। বাঁশঝাড়ের সবকটি বাঁশই চলে যায়, যায় সদ্য বেড়ে-ওঠা কলাগাছের চারাও। আর এসবের
কিছুই তার নিজের নয়, সর্বনাশের সব দায় তার হলেও সর্বনাশের তাপ তাকে
ছোঁবে না শুনে ঘর ছেড়ে চলে যায় সে। প্রথম দুবার তাকে খুঁজে ঘরে আনলেও এবারে তাকে
আর কেউ খোঁজে না। তিনদিন পরে নিজেই ফিরে আসে এবং অন্যের মাটিতে তোলা চালাঘরটি ভেঙে
দিয়ে চলে যায়। গৃহবাসের অংশীদার যে, তার তাই ভিন্ন গ্রামে গাছের ছায়ায় আশ্রয় নেওয়া
ছাড়া কোনো উপায় ছিল না।
চার
নদীর
উঁচু পাড়ে দাঁড়িয়ে তারা ওপারের মাঝিকে ডাকে। দিনের আলো কমলে কমতে থাকে, সূর্যের তাপও কিন্তুতাতে আরাম হয় না। যদি মাঝি না-আসে তাহলে
শূন্য নদীতটে বালিয়াড়ির শেষে অন্ধকারে জ্বলবে শ্বাপদের চোখ – এই ভয়ে আরো জোরে ডাকে তারা মাঝিকে। যদি ঘুম ভাঙে তার। কিন্তুঘুম
ভাঙে না অথবা সে তার পাটকাঠির চালা ছেড়ে চলে গেছে নিজ ঘরে।
পড়ন্ত সূর্যের আলোয় দূরের ছায়া-অবয়বটি স্পষ্ট
হয়। ঘর ভেঙে চলে যাওয়া সে তখন সামনে ঠেলা তিন চাকার ওপরে বসানো বাক্সটিকে নিয়ে
কিছু দূরে এসে দাঁড়ায়। গাড়িতে বসা সঙ্গিনী তার দিকে তাকালে উৎসাহে হাত নাড়াবে
কি-না ভেবে লোকটি বিমূঢ় হয়। সঙ্গীও জানে লোকটিকে – তবে
কাছে ডেকে নেওয়ার কথা তার নয়, তাই সে ডাকেও না।
সন্ধ্যা নামে তখন – মাঝি তবু আসে না। নদীর জল কালো হয়। উঁচু দুই পাড়ের মাঝে
নদীর খাত অস্পষ্ট হয়। মুছে যায় এ-পাড়ের বালিয়াড়ি কী ওপাড়ের রাঙামাটির পাহাড়। পাড়ে
দাঁড়িয়ে নদী বরাবর কাতালে বাঁয়ে কী ডাইনে দূরগ্রামের ছায়ায় জ্বলে ওঠে কিছু আলো।
গৃহস্ত-জীবনের আভাস পাওয়া যায়; কিন্তুসে অনেক দূরে। হয়তো নদী বরাবর পায়ে হেঁটে যাওয়া যায়
সেখানে; কিন্তু গাড়িটির কী হবে অথবা মরীচিকার মতো
গ্রামের ছায়া দূরে সরে গেলে সূর্য ডোবার পরে নদীও তার তটরেখা নিয়ে অন্ধকারে ডুবে
যাবে। পায়ে চলার কোনো পথও দেখা যাবে না তখন। পাড় কেটে খেয়ায় ওঠার পথটির মুখে গাড়ি
থামায় তারা। সঙ্গিনী বসে থাকে গাড়ির পাটাতনে। সঙ্গী তার ভ্যানগাড়ির এক কাচের আলোটি
জ্বালায়। রাত্রি গাঢ় হলে অন্ধকার তাতে কাটবে কিছু নিশ্চয়ই।
ঠেলাগাড়ি
নিয়ে লোকটি তখন সামনে এসে দাঁড়ায়। সে কি ভেবেছিল তাকে কেউ বলবে, তুমি এখানে কেন? জবাবও কি তার তৈরিই ছিল? ঘর যে সে ভাঙেনি, গেছিল নতুন ঘর বাঁধবার জন্যে এ-কথাই বলবে কি সে?
কিন্তুকেউ
তাকে কোনো প্রশ্ন করে না। কোনো শব্দ শোনা যায় না। বালিয়াড়ির নকশায় কোনো জোনাকি
ফোটে না। আকাশে কোনো মেঘ দেখা যায় না। সামান্য বাতাসে তবু আসন্ন শীতের আভাস থাকে।
এই শূন্য নদীতীরে বালুময় প্রান্তরে ‘পৌষ এলো রে’ বলে
কেউ তাকে আহ্বান করে না।
লোকটি আরো কাছে আসে তখন। কেউ তাকে কিছু
জিজ্ঞাসা করে না। নিজেই বলে সে, ভয় নাই কোনো কিছুরই। তার কাঠের বাক্সে নানা
রঙের আধারে আছে নানা ফলের আড়ক, নানা স্বাদের আচার। শরীরের তাপ যেমন বাড়াবে
তারা, কমাবেও তেমনি। ক্ষুধা মেটাবে যেমন, বাড়াবেও তেমনি। বলে নানা বর্ণের আধারের মাঝখানে রাখা
আলোটিকে জ্বালায় সে। বাতিটিকে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে সবকটি আধারের ঢাকনা খুলে দেখায়।
কোনোখানে বাজিকরের চিহ্ন নেই, বাজি খেলার কোনো সরঞ্জামও নেই। ভাগ্যের
ব্যবসায়ী নয় সে তার। আসুক সকাল। দিনের আলোয় আরো স্পষ্ট দেখা যাবে সব।
গভীর রাতে নিজ বাসনামাখা নকশিকাঁথাটি খুলে
সঙ্গিনীর গায়ে জড়িয়ে দেয় সঙ্গী। মাটিতে বসবার জন্যে ভাঁজ করে রাখা মলিন একটি চাদর
ছিল আচারওলার। সেও সেটিকে জড়িয়ে দিতে চায় ফেলে আসা ঘরের অংশীদারের গায়ে। কেউ সেটি
গ্রহণ করে না।
প্রহর পারাপারের শিবাকুল নিয়মিত কোলাহল করে, কখনো শিহরণ জাগায় শরীরে। সামান্য বাতাস, কখনো কাঠের বাক্সে রাখা আলোটিকে কাঁপায়, কাঁপায় গাড়িটির নিচে ঝোলানো এক কাচের বাতিটিকেও। সেই কাঁপতে
থাকা আলো নিদ্রিত কী নিদ্রিত নয়, সকলের মুখ আলোছায়ার রঙে বদলায়।
ক্রমে অন্ধকারের কালো পর্দা হালকা রঙে ওড়ে। শেষ
রাত্রির আকাশে মেঘ উড়ে আসে। উত্তর-দক্ষিণ নদীর পুব পারে সূর্যের সাত রং ফুটে উঠবে
ক্রমে, আলোয় ভাসবে দিগন্ত। তেমন কিছু ঘটে না, রাত্রিশেষের প্রভাত চরাচরকে স্পষ্ট করে না। নদীর বুকে
তাকালে কুয়াশার আবরণ দেখা যাবে। নদী বরাবর দূরগ্রামের ছায়া তখনো দেখা যায় না। অল্প
আলোয় শ্বেত কুয়াশায় তারা ঢাকা পড়ে আছে।
চোখ খুলে কিছু তাই দেখে না তারা। কেবল ঘোলাটে
আকাশ, শ্বেত দিগন্তে লাল আলোর ছোঁয়াটুকু কেবল। মেঘ
আরো কাটলে, আলো আরো ফুটলে খেয়াঘাটের পথ বেয়ে নদীর সীমানায়
যায়। পাড়ে উঠে ওপারের মাঝির দিকে, খেয়া নৌকাটির দিকে চেয়ে থাকে। স্বাদু ফলের আর
কি অম্লমধুর আচারে প্রাতরাশ হয় না, ভাবে নদীর ওপারে মিলবে কিছু নিশ্চয়ই।
কিন্তু মাঝি আসে না। ক্রমে মেঘ কাটে, আলো ফোটে। চরাচর স্পষ্ট হয়। সূর্যের তাপ বাড়ে। আর তখনই
প্রায় দ্বিপ্রহরের শেষে মাঝি তার জোড়া নৌকার খেয়া ওপারে ভেড়ায়। কেউ তাকে কিছু বলে
না। মাত্র তিনজন যাত্রী, একটি ভ্যানগাড়ি, তিন
চাকার ওপরে বসানো কাঠের ঠেলা দেখে বুঝি মাঝির মন ওঠে না। আরো যাত্রীর আশায় অপেক্ষা
করে সে। কিন্তু না-হেমন্ত না-শীত না-বসন্তের এই দিনে আর কেউ পাড়ি দিতে আসে না। অবশেষে
খেয়া ছাড়ে সে।
নদীর ওপারে লালমাটির ঘাট ক্রমে কাছে এলে নামে
তারা। ঢালু বেয়ে ওপরে উঠে বিস্মিত দেখে লালমাটির পাহাড় নদীর পাড় থেকে উঠে মিশে
গেছে দিগন্তে, তারই পাশে পাশে রাস্তা। দূরে গাছগাছালির রং
কিছু দেখা গেলেও স্পষ্ট বোঝা যায় না কতদূর গেলে মিলবে লোকালয়, মিলবে সেই বড় নদী যেটি পার হলে মিলবে গন্তব্য।
লালমাটির অসমান শক্ত পথে গাড়িটি ভালো চলে না।
পেছন থেকে ঠেলা যায় না তিন চাকার বাক্সটিকেও সহজে। তবু অতিকষ্টে পাহাড়ি পথে মোড়
ঘুরলেই দেখে তারা, ঝাঁকে ঝাঁকে পাখির ওড়াওড়ি। ভাবে, কাছেই আছে বুঝি কোনো জলাশয়। পাখিরা সেখানেই থাকে, যায়ও সেখানেই। কিন্তুদূরে গাছগাছালিই ওদের দেখা যায় – অস্পষ্ট কোনো জলাশয় নয়। দূরের বড় নদীতেই যদি যাবে পাখিরা
তাদের সঙ্গে তাহলে থাকা কেন?
গাড়িটিকে থামিয়ে অনেকক্ষণ অপেক্ষা করে তারা।
যদি পাখিদের ওড়াউড়ি বন্ধ হয়! তারা দলবেঁধে কখনো রাস্তার ওপরে এসে বসে থাকে, কখনো উড়ে যায়। মুনিয়ার ঝাঁক এটি নয়, এতো ছোট পাখি ওরা নয়, শালিক নয়, চড়-ইও না, অমন দলবেঁধে ওড়ে না তারা। কালো রঙের আকাশভরা
যে-পক্ষীকুলের কথা শোনা যায় ওরা বুঝি সেই সব পাখিই। বিদেশি পাখি শীতের আশ্রয়
খুঁজতে আসে দূরদেশে দলবেঁধে, এ-কথা তারা জানতো না, জানলে বলতো, তারা তো ওড়ে দূর-আকাশে, বসে বিস্তীর্ণ জলাধারে। এখানে এই রুক্ষ লালমাটির পাহাড়ি পথে
এরা ভিড় জমাবে কেন?
সে তার গাড়িটিকে নিয়ে সামান্য চলতে চাইলে পাখির
দল যেন পথ আটকে দাঁড়ায়। সঙ্গিনী তাকে দাঁড়াতে বলে, এই
পাখিরা চায় না আমি যাই। ওরা না-সরলে আমি কিছুতেই যাবো না।
ফিরবোই বা কোথায়, সঙ্গী
বলে। পাহাড়ি পথের বাঁকে খেয়াঘাট অনেক পেছনে পড়ে আছে। সামনের বড় নদীই হয়তো কাছে, যাই পাখপাখালির ঝাঁক মাড়িয়ে সেদিকেই।
গাড়িটিকে জোরে চালাতে চায় সে। সামনের সমতল
পাহাড়ি পথে মোড় নিলেই দেখে সব পাখি উড়াল দিয়ে চলে যায় সামনের দিকে। আবার পথ আটকে
ওড়াওড়ি করে।
গাড়ি থামিয়ে তখন বসে থাকে তারা। এই পাখির দল
না-সরলে কোথাও যাবো না বলে সঙ্গিনী তার পা ঝুলিয়ে গাড়ির কিনারায় এসে বসে। দিন
এখানেও ক্রমে শেষ হয়। কিন্তুলাল পাহাড়ের ওপারে পশ্চিম দিগন্ত বলে সূর্য ডোবার রং
মনে হয় বোঝা যাবে না। তাই সামনে তাকিয়ে থাকে সকলে।
আর তখনই সব পাখি উড়ে দূরে বসে। শেষে আরো দূরে।
আরো দূরে। এবং মনে হয় ক্রমে তারা দিগন্ত পার হয়ে চলে যাবে।
কেবল একটি পাখি ছাড়া।
একাকী পাখি কী এমন পথ আটকাবে? আটকালেও চাকার নিচে পড়বেই সে, ভেবে
নিজ আসনে উঠে বসে চালক।
সঙ্গিনী
আবার নিষেধ করে তাকে। পেছনের দিকে তাকায়, বলে, শেষ পাখিটিও উড়ুক আগে।
--------------------------------------------------------------------------------------------
রূপসাগরে ডোবে না, ঈভ
জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত
এক
রাত্রিশেষে শালুকঢাকা পদ্মবিলের কিনারা ধরে হাঁটবে সে। থামবে সেইখানে শালুকের আবরণ সরালে যেখানে স্পষ্ট হয় স্বচ্ছতোয়ার শরীর। আর জলে নেমে দু’পা গিয়ে নিচে চাইলেই সে দেখবে তার সম্পূর্ণ অবয়ব, মুখচ্ছবিসহ, যদি সেই প্রভাতের রবিকর তাকে ভাসিয়ে দিয়ে যায়।
আমি-ই তাকে পদ্মবিলের কথা বলেছিলাম। দিগন্তবিস্তৃত সেই জলাধারের রূপ সামান্য বালকের বর্ণনায় কী-ই বা ফোটে- কোনমতে বোঝানো যায় না শ্বেতরক্তিম সেই আংরাখার যে শেষ নেই! কিন্তু সে বুঝেছিল নিশ্চয়, দেখেছিল সব-ই – দৃশ্যের আড়ালে রয়ে গেলেও।
আমি-ই তাকে শুনিয়েছিলাম ছিন্নবস্ত্র অমলিন কন্যা আর তার হিংসুটে বৈমাত্রেয় ভগিনীর গল্প। অমলিন কন্যা পদ্মবিলে ডুব দিয়ে তীরে উঠে দেখে রাজকন্যার পোশাকে অলঙ্কারে সে ভূবনমোহিনী; দেখাদেখি তার হিংসাগ্রস্ত ভগিনীটিও ডুব দেয় এক-ই পদ্মবিলে। কিন্তু তীরে উঠে দেখে, অলঙ্কার নয়, জলজ কীট জড়িয়ে আছে তার শরীরে, মখমল মসলিন নয়, চীরপরিহিতা কুদর্শনা সে যেন ভিখারিণীই কেবল।
গল্প শুনে সে আমাকে আবার জড়িয়ে ধরেছিল। বলেছিল, তুই যা বলিস্, সব-ই সত্যি হয়। এটিও হবে, তাই না? আমি তার দিকে তাকিয়ে বলেছিলাম, এতো কেবল-ই গল্প। বইয়ে পড়া গল্প। ন’দশ বছর-ই বয়স তো তখন আমার। নাহলে বলতাম, গল্প কখনো সত্যি হয় না। আর সে-ও তার সহজ বিশ্বাসে বলতো, নিশ্চয়ই হয়।
দুই
কোলে তুলে নেবার মতো ছোট তখন আমি ছিলাম না তবু মাসি আমাকে দেখামাত্র কোলে তুলে নিয়েহিল। স্টেশনে নেমে মামা পাল্কিতে উঠেছিলেন অন্য কোন যান না-থাকায়। আর আমি এক পশ্চিমা মাঝির কাঁধে বসে এসেছিলাম পদ্মবিলের পার বরাবর ছড়ানো সবুজ পাতার মাঝে ফোটা হাজার শালুকের মেলা দেখতে দেখতে। চার মাইল রাস্তা। প্রভাতসূর্যে তখন তাপ-ও এসেছিল। তাই বুঝি মাসি আমাকে দেখেই কোলে তুলে নিয়েছিল। বয়স্ক মা-বাবা আর বিধবা দিদির সংসারে তখন-ও কিশোরী একলা মাসি আমাকে তার জীবনের আলো-ই ভেবেছিল বুঝি। হাত-পা ধুইয়ে, মুখ মুছিয়ে খাওয়ায় সে আমাকে আর তেমনি কোলে নিয়েই বেড়িয়ে যায় নিকট প্রতিবেশীদের দেখাতে।
মামাবাড়ির দুইপাশে পুকুর, তার পেছনে আমকাঁঠালের বাগান, ঘনণ বাঁশের ঝাড়। পুকুরের পাড়ে পুরনো দিনের দালান, কাচারিবাড়ি। অন্য দু’পাশেও বাড়ির সীমানা অনেক দূর ছড়ানো। বাঁশঝাড়, বাগিচা, জঙ্গল পেরিয়ে মাঝখানে পায়ে হাঁটা রাস্তা ধরেই কেবল যাওয়া যায় সবচেয়ে কাছের প্রতিবেশীর বাড়িতে। গ্রামের মূল লোকালয়ের শুরুও সেখানেই। গাছপালায় ঘেরা অনেক কটি বাড়ি-ই পরপর সাজানো ইউনিয়ন বোর্ডের রাস্তা বরাবর। রাস্তার পাশে দিয়ে চলে যায় বর্ষার স্রোত নিয়ে পদ্মায় নেমে যাওয়া খালটি। এপাশে আবার জঙ্গল, বাঁশঝাড়, ভিন্ন লোকালয়।
পায়ে হাঁটা রাস্তা ধরে এলে পাড়ার প্রথম বাড়িটিই তাদের – আমার গল্পে মুগ্ধ বিশ্বাসী শ্রোতার। মাসির সখি বলা যায়, যদিও মাসি তখন-ও হাঁটু পর্যন্ত নামা জামাই পরতো আর তার সখির পরনে শাড়ি। মাসির চাইতে বড় সে নিশ্চয়-ই তবুও মাসির কোল থেকে আমাকে নেয় সে, বুকে জড়িয়ে ধরে। একটু কাঁদেও বুঝি, মাসিও। মাত্র কিছুকাল আগে মাতৃহীন আমি- আত্মীয়স্বজনের কান্নায় তখন-ও অভ্যস্ত। নিজে না কাঁদলেও তাদের কান্নার কারণ বুঝি। ততোক্ষণে তার ছোট ভাইবোন কটি-ও চারপাশ ঘিরে দাঁড়ায়। বর্ষার ধারায় কোণা ধুয়ে যাওয়া বারান্দায় উঠে আসে সে। বারান্দায় কাঠের চেয়ারে বসা শীর্ণকায় প্রৌঢ় আমাকে দেখে আমার মৃতা মায়ের নাম নিয়ে বলেন তার-ই ছেলে কিনা আমি। মাসি ও সখি দু’জনেই চোখ মুছে মাথা নাড়ে। বারান্দায় বসিয়ে ঘর থেকে নাড়ু, মোয়া ডালায় করে আমার জন্যে নিয়ে আসে সে। আমি প্রায় কিছুই খাই না, মাসিও। আমার হাফপ্যান্টের পকেটে সেসব ঢুকিয়ে দেয় সে। ঘরে কি বাইরে আর কাউকে দেখি না। পরে জানি, অনেক আগে মাতৃহীনা সে ছোট কটি ভাইবোন ও রুগ্ন পিতাসহ এই সংসারের মূল।
ঐদিন বিকালেই সইয়ের বাড়িতে আসে সে। দিদিমা, বড়মাসিসহ চারজনের মাঝখানে বসি আমি। সকলের আদরের দুলাল, নয়নের মণি যেন। আমার নানা গুণের কথা মাসি বলে। এই বয়সেই বড় বড় সব গল্পের বই পড়তে পারি আমি। চাই কি শোনাতেও পারি সেইসব গল্প। এই অল্প সময়ের মধ্যে আমার ক্ষমতার কথা মাসি জানলো কী করে ঐ বয়সে অমন ভাবা স্বাভাবিক ছিল না – তাই গর্বে বুক ভরেছিল নিশ্চয়। গল্পে গল্পে সন্ধ্যা এসে গেছে প্রায় বুঝলে বড় মাসি বৈকালিক গৃহকর্মের জন্যে উঠে যেতে চায়। ছোটমাসির সই তার হাত ধরে টেনে বসিয়ে বলে, আমি-ই করে দিচ্ছি এবং দ্রুত উঠে সে বৈকালিক কর্মে হাত লাগায়। বোঝা যায়, এটি তার জন্যে নতুন কিছু নয়।
দু’একদিন পরপর-ই সে বিকালে জঙ্গল বাগিচা পার হয়ে হাঁটা পথ ধরে গল্প শুনতে আসতো। কখনো বড়মাসি বই পড়ে শোনাতো, কখনো বা আমি আমার পড়া গল্প মুখে মুখে বলতাম। ছোটমাসির লেখাপড়ায় তেমন মন ছিল না। গ্রামের প্রাইমারী স্কুল শেষ করে আর পড়েনি সে। বাড়িতেও না। তবু গল্প শোনায় তারো মন ছিল। সন্ধ্যার আলো জ্বলবার আগেই সকলকে উঠতে হতো। সখিটিকেও। ঘরে ছোট ছোট ভাইবোন, রুগ্ন পিতা ভুলতে পারে না সে কিছুতেই। কখনো দেরী হলে বেশ কদিন আর আসতো না সে। মাসি বলতো, ওর বাবাই হয়তো দায়ী এজন্যে।
ঐরকম সময়ে বাগিচা, জঙ্গল, বাঁশঝাড় পার হয়ে হাঁটা পথ ধরে মাসিকে নিয়ে, কখনো বা আমি একলাই চলে যেতাম তার বাড়িতে। কখনো ভাইবোনের আবদারে অস্থির, কখনো পিতার সেবায় ব্যস্ত, কখনো রান্নাঘরে আগুনের তাপে স্বেদময়। সে আমাদের দেখলেই হেসে দাঁড়াতো সামনে এসে। জড়িয়ে ধরতো বুকে আর আমিও তাকে ছাড়তে চাইতাম না। কখনো তাকে ঘরে না-পেলে শুনতাম গ্রামের শেষে পানের বরজে অসুস্থ পিতার বদলী খাটতে গেছে সে। কখনো বা দেখেছি ঘরের চালে উঠে পাতলা হয়ে যাওয়া আস্তরে খড় গুঁজে দিয়ে চালা বাঁধছে। আমি বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকতাম। বড়মাসি, ছোটমাসি বা অমন কাউকে ঐ-রকম কিছু করতে দেখিনি বলেই হয়তো।
তিন
আমি মামাবাড়ি যাওয়ার কিছুদিন পরেই ছোটমামা শহর থেকে এসে আমায় স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিলেন। আমার বয়সে যে ক্লাসে স্বাভাবিক তার চাইতে দু’ধাপ ওপরেই প্রায়। আসলে এক শ্রেনী ওপরেই কিন্তু তখন স্কুলের বছর প্রায় শেষ, ক’দিন পরেই বার্ষিক পরীক্ষা। পাশ করলে তো দু’ক্লাস ওপরেই চলে যাবো শিক্ষকদের এই কথায় মা.
০মা রাজী হয়ে যান। আমার নানা গুণের মধ্যে আরো একটি যোগ হয়।
গ্রামের স্কুল – সকালে শুরু হয়ে দুপুরের পরপর-ই শেষ হয়ে যেতো। একলা হেঁটে মামাবাড়িতে ফেরার পথে আমি স্কুলের পেছনে সরষের হলুদ প্রান্তরের দিকে তাকিয়ে থাকতাম, কি দেখতাম ভরা আমনের ক্ষেতে ধানের শীষে পাখির ওড়াউড়ি। কখনো দেখতাম অড়হরের ডালে ল্যাজঝোলা পাখি বসে গাছ দুলিয়ে আবার দূরে চলে যায়। স্কুলের সীমানা ছাড়িয়ে বাজার, বাজারের মুখে পোস্ট-অফিস। কখনো ডাকপিয়ন চলে না-গেলে পোস্ট অফিসের বারান্দায় তার জন্যে দাঁড়িয়ে থাকতাম। পরে পড়তি রোদে বাজারের শেষে পদ্মামুখী স্রোতের খাল পার হয়ে, বাঁশঝাড় জঙ্গলের ছায়ার গ্রামে ঢুকলে বড় মন খারাপ করতো। আর তখন দূর গ্রামে ফেলে আসা স্বজনদের চাইতেও আমার গল্পের মুগ্ধ শ্রোতাটির কথাই মনে পড়তো বেশি।
ভরা বর্ষায় রাস্তার পাশ দিয়ে চলে যাওয়া খালটি দু’কূল ছাপিয়ে ছুটতো বড় খালের সঙ্গে মিশে পদ্মায় যাবার জন্যে। বড় খাল-ও তখন যেনো তীরহীন নদী। বাঁশের সাঁকো পার হয়ে ওপারে গেলে তবেই স্কুল। খালের দুই পার থেকে কয়েকটি বাঁশ পাশাপাশি রাখায় সাঁকোর দুই মুখ প্রশস্ত হলেও মাঝখানে পাতা কেবল একটি মোটা বাঁশ। আর বেশ উঁচুতে বাঁধা আর একটি সরু বাঁশ ধরে সেটি পার হতে আমার শরীর কাঁপতো। একদিন সাঁকো পার হওয়ার সময়ে এক বাঁশের মাঝখানে এসে এতো কাঁপতে থাকি যে চোখ বন্ধ করে ফেলি। তার পরে কিছু যেন মনে পড়ে না, মনে পড়ে চোখ খুললে দেখি সাঁকোর প্রশস্ত প্রান্তে দাঁড়ানো আমি। আমার শ্রোতাকুল নিঃসন্দেহে বিশ্বাস করে যে সেটি আর কিছু নয় কোনো অশরীরি শক্তি-ই আমাকে একবাঁশের অংশ পার করিয়ে দিয়েছিল। এইরকম ঘটনা আরো দু”একটি ছিল।
গরমের সময়ে বড়ঘরের বারান্দায় মাদুর পেতে শুতাম আমি। আর কেউ নয়। মাসিরা, দিদিমা কি দাদু যার যার ঘরে – দরজা দেয়া। ঐ বয়সে --তখনো নিতান্ত বালক-ই তো, কেনো একলা শোয়ার ব্যবস্থা বুঝিনি। সেটি কি এইজন্যে যে শীতকালে লেপের মধ্যে ছোটমাসি আমাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমুলেও গরমের সময়ে পারতো না- তার শোয়া খুব খারাপ ছিল। এজন্যেইকি? অথবা বন্ধ ঘরের গরম আমার সইতো না?
অমনি এক রাতে বারান্দায় একলা শোয়া আমার হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে যায়। ঊঠে বসি। মৃদু জ্যোৎস্নার রাত্রি। সদর দরজার দিকে চেয়ে দেখি সাদা কাপড়ে মোড়া এক মূর্তি ধীরে হেঁটে আমার দিকেই এগিয়ে আসে। বিবশ আমি চোখ বন্ধ করি। কতোক্ষণ পরে জানি না চোখ খুলে দেখি সদর দরজার পাশে মূর্তিটি তেমনি দাঁড়ানো। আর মেঘ-জ্যোৎস্নার রাত্রিতে তখন মেঘ সরে যাওয়ায় সাদা জ্যোৎস্না সদর দরজার পাশে দাঁড়ানো মানকচুর পাতাটিকেই মূর্তি বানিয়েছে। আমার শ্রোতাকুল জ্যোৎস্নার কারুকাজ বিশ্বাস করে না। মাসির সখিটি তো কোনমতে নয়।
স্কুল থেকে অথবা বাজার থেকে ফেরবার সময়ে বাড়ির পেছনের দরজা দিয়ে ঢুকলে রাস্তা কম পড়তো। ঘন বাঁশঝাড়ের নীচে দিয়ে পথ। পাতাঝড়ার দিনে শুকনো বাঁশপাতা এমন পুরু জাজিম বানাতো যে এক পা তুলে আর এক পা ফেললে পা ডুবে যেতো সেই জাজিমে, আর মনে হতো কেউ যেন ঠিক পেছনেই হাঁটছে। পা ফেলার সঙ্গে সঙ্গে সে-ও ফেলে পা, শোনা যায় তার পায়ের আওয়াজ, বাতাসে ভাসে সেই শব্দ। আমি বাঁশপাতায় মোড়া সামান্য পথ দৌঁড়ে পার হয়ে আসি। এই গল্পেও তারা অশরীরির চিহ্ন খুঁজে পায়। বাঁশবাগান চিরকাল-ই অজানা শঙ্কায় ভরা, তারা বলে। আর সেই শংকা আদৌ অমূলক নয়। সেটি কাটানোর ক্ষমতা সকলের থাকে না।
চার
ভরা বর্ষার শেষে, শ্বেত শরতের কাল চলে গেলে হালকা কুয়াশার হেমন্তে বৈকালিক গল্পের আসর বসে আবার। অনেক দিন পরে সে-ও আসে। বর্ষার ধারায় সিক্ত সজীব সে নয়। শরতের জ্যোৎস্না তার মুখে ছিল না, ম্লানমুখী বিষন্ন সখীকে মাসি তার বাড়ি গিয়ে ডেকে এনেছিল। কখনো অসুস্থ, কখনো কর্মহীন পিতা তার, নিজে পিতার বদলী খেটে, বনেবাদাড়ে ঘুরে, শাকপাতা এনে, ঘরের পেছনে সবজি ফলিয়ে অর্ধাহারের ব্যবস্থা করে সে – এ-সব-ই জানা। মাসি তার সই-এর দুঃখ কমাতে চেষ্টা করে কিন্তু সখিটি সংকোচে ও লজ্জায় সর্বদা ম্রিয়মান। এইসব নানা কথাবার্তায় সেদিনের বৈকালিক আসর জমে না। বড়মাসি শেষে জিজ্ঞাসা করে, হ্যাঁরে, তোর বাবা নাকি বিয়ের চেষ্টা করছে? এমনিতেই ভেজা চোখ তার, এবারে জলে ভরে যায়। মাকে কে বিয়ে করবে দিদি? আস্তেই বলে সে। আর আমি গেলে সংসার-ই বা চলবে কী করে? সে-কথা সকলেই জানে, তবুও মাসি বলে, শুনি তোর বাবা নাকি আবার বিয়ে করবে?” ম্লান স্বর শোনা যায়, তাকেই বা মেয়ে দেবে কে?
সেদিন আর কোন গল্প হয় না। যে যার কাজে ফিরে গেলে আমি লন্ঠন জ্বালিয়ে মাদুর পেতে বারান্দায় বসি স্কুলের বইখাতা নিয়ে। মাসি এসে পাশে বসে। আমার বইপ্ত্র নিয়ে নাড়াচাড়া করে। নিজেরো কিছু বইপত্র আছে তার। হাইস্কুলে পড়বে বলে মামারা কিনে দিয়েছিল। অনেক পুরনো সে-সব বই নিয়েও কখনো সে বসে আমার মাদুরে। কিন্তু আজ নয়। আজ সে এসে মাদুরের এক পাশে শুয়েই পড়ে। অংক কষতে থাকি আমি। অনেকক্ষণ চোখ বন্ধ করে রেখে বলে সে, মেয়েদের বিয়ে না-হওয়া বড় কষ্টের, তাই না? আমি একটু চমকে তার দিকে তাকাই – বিয়ের কথা শুনেই বুঝি। খেয়াল করে দেখি, আজ সে শাড়ি পরা। মনে পড়ে, সেই প্রথম দিন তাকে দেখার কিছু কাল পর থেকেই শাড়ি পরে সে। আর বিয়ে হলেই বা কী? কষ্টতো তাতেও কমে না! বালবিধবা বড় বোনের কথা ভেবেই বুঝি বলে আবার।
আমার বয়স দশ। প্রাইমারি স্কুল শেষ প্রায়। মামাবাড়ি থেকে লেখাপড়া করি। দাদুর সঙ্গে হাটবাজারে যাই। পোস্টঅফিসে চিঠি আনতে যাই। ছুটিছাটায় ছোটমামা বাড়ি এলে ঝাড় থেকে বাঁশ কেটে সারাদিনের রোদে মামার সঙ্গে বাড়ির চারপাশে বেড়া বাঁধি। আমি কি করবো । আমার কোন-ই ক্ষমতা নেই। মাসিরা যা-ই বলুক না কেন!
পাঁচ
স্কুলের শেষে ফেরার পথে পোস্টঅফিসে যাই। ডাকপিয়ন তখন-ও ফেরেনি। হাটের দিনে সে বেশি দূরে যায় না। হাটেই চিঠি বিলি করে। যদি মামাদের কোন চিঠি থাকে এই ভেবে দেরী করি। শেষে বেলা প্রায় পড়ার মুখে ঘরে ফিরি – বাঁশবাগানের শুকনো পাতা মাড়িয়ে, বাড়ির পেছনের সদ্যবাঁধা বাঁশের দরজা খুলে।
রান্নাঘরের বারান্দায় দেখি সকলে বসা। মাসির সইকে নিয়ে আলাপ – কাছে এলেই বুঝি। সারা দিন অন্যের ক্ষেতে, মাঠে , ফলবাগানে, ঘোরাঘুরি তার নিত্যকর্ম জানি বলেই রোদে পোড়া ঘামে ভেজা চেহারা দেখে অবাক হই না। তবুও আমি কাছে এলে তাদের কথাবার্তা থেমে যায়। বইখাতা রাখবার জন্যে ভেতর বাড়িতে যাই। শোবার ঘরের বারান্দার চালে ঝোলানো কাঠের তাকে বইখাতা রেখে ফিরে আসি। রান্নাঘরের দিকে মোড় নেবার মুখে শুনি দিদিমার গলা, বিয়ে হবে তোর, সে তো ভালো কথা, কাঁদিস্ কেনো? কিন্তু বিয়ের পর মাসি, বিয়ের পর – কে রাখবে আমাকে – , কেঁদেই বলে সে, বলে, বুকের কাপড় সরিয়ে দেয়। আর সেই মুহূর্তে, রান্নাঘরের বারান্দার দিকে এগোনোর মুখে, আমি দেখি, তার খোলা বুক, মাসিদের কি দিদিমা কারো মতোই নয়। প্রায় আমার-ই মতো।
ছয়
বিয়েবাড়ির কোন চিহ্ন সেখানে ছিল না। তোলা বিয়ে। কনেকে নিয়ে রাখা হবে বিবাহোচ্ছুক পাত্রের গ্রামে- কোনো বাড়িতে। যথাকালে বিবাহস্থলে পৌঁছে দিলে চলবে আনুষ্ঠানিকতা। অসমর্থ পিতার কন্যার জন্যে বিবাহরীতিটি নতুন কিছু নয়। তবুও দুপুরের মুখে, ভিন্নগ্রামে কনেকে নিয়ে যাও্যার আগে, মাসির সঙ্গে তাকে দেখতে যাই আমি। রঙ্গিন তাঁতের শাড়িতে তাকে কনে বউটির মতো-ই দেখায়। মাসি কাছে গিয়ে ক্রন্দমুখী তাকে জড়িয়ে ধরে। আমাকেও হাত বাড়িয়ে ধরে সে। বলে, তুই যা বলিস সব-ই তো সত্যি হয়। তাই না? আমি জবাব দিই, হ্যাঁ।
আশেপাশের বাড়ির দু’চারজন পড়শি ছাড়া আর কাউকেই দেখি না। কেবল ভাইবোন কটি তাকে ঘিরে উঠানে দাঁড়ানো। বারান্দায় একটি ফুলপাতা আঁকা টিনের তোরঙ্গ। তার বাবা সেটি হাতে নিয়ে নেমে আসে। তিঙ চার ঘন্টার হাঁটা পথ। এখুনি বেরুতে হবে-- বলে তার বাবা ইউনিয়নবোর্ডের রাস্তার দিকে পা বাড়ায়। সে-ও চলতে শুরু করলে আমরা পেছনে পেছনে যাই। বড় রাস্তার মোড়ে গিয়ে তাকে দেখি। পেছন ফিরে ফিরে তাকায় সে বার বার।
ঘরে ফেরার মুখে আমরা কোন কথা বলি না। বাড়িতে ফিরেও নয়। অন্তত তার কথা কেউ-ই বলে না।
সাত
অনেক অনেক রাতে ঘুম ভাঙ্গে আমার। স্পষ্ট বুঝি পাশে কেউ বসে আছে। গায়ে তার হাতের স্পর্শ পাই। মুহূর্তে উঠে বসি। সেটিও জ্যোৎস্নার রাত্রি। চাঁদ অনেক নিচে নেমে যাওয়ায় তার কিছু আলো বারান্দায় আমার মাদুরে পড়েছে। সেই আলোয় দেখি, বিবাহের কন্যা আমার পাশে। আমি কথা বলতে চাইলে সে আমার মুখে হাত চাপা দেয়। কাউকে ডাকিস্ না। এই আমি চলে যাচ্ছি-- বলে ওঠে সে। ওঠার মুখে বলে, ওরা আমাকে নিলো না। সাদা জ্যোৎস্নায় তার চোখে জলের রেখা স্পষ্ট দেখা যায়। তখন প্রায় নিঃশব্দে বলে সে, না থাক আমার কিছু-- আমি-ও তো মেয়ে! তার সঙ্গে আমিও উঠে দাঁড়াই। আমাকে আবার, শেষবারের মতোই বুঝি, জড়িয়ে ধরে সে। বলে, তোর কথা সব-ই তো সত্যি হয়, তাই না? আমি কিছু না-ভেবে, কোন্ কথা না-ভেবে, সত্য কী অথবা কী মিথ্যা না-ভেবে। চোখ বন্ধ করে বলি, হ্যাঁ।
আমাকে ছাড়ে সে। বারান্দা থেকে নেমে বাইরের দরজার দিকে যায়। জ্যোৎস্নার আলো তখন আবার সেই মানকচুর পাতাটিকে কনেবৌ বানিয়ে দেয়।
আট
পরদিন সারা গাঁ খুঁজেও তাকে কেউ পাবে না। আমি যদিও জানি সে কোথায়। জানি, সে বড়রাস্তার শেষে পদ্মবিলের কিনারা দিয়ে যাওয়া পায়েহাঁটা পথ ধবে হাঁটবে। জ্যোৎস্নার শেষে না-আলো না-অন্ধকারের প্রভাত তার সামনে পথরেখা স্পষ্ট করে দিলে, সে তার সামনে পাশে পদ্মবিলের শ্বেতরক্তিম শালুক আর সোনালী পদ্মের যোজনবিস্তৃত প্রান্তর দেখবে। আকাশের কোলে লাল মেঘের নিচে তখন আলোর আধার। সেই আলোয় চিনে নেবে সে পদ্মবিলের স্বচ্ছতোয়া স্থানটিকে। লাল দিগন্তের দিকে মুখ করে জলে নামবে সে। দু’পা নেমে আরো দু’পা গিয়ে প্রথম ডুবটি দেবে, তারপর উঠে আসবে। রক্তিম দিগন্তের উৎস তখন তার সম্মুখে। জলের কিনারায় দাঁড়াবে সে, মাথা সামান্য নিচু করে দেখবে তার মুখচ্ছবি। দেখবে, জলে কাঁপে নিরাবরণ, নিরাভরণ সৃষ্টির প্রথম নারী। ঈভ।
বালিয়াড়ির শেষে যখন তারা নদীটির পাড়ে এসে দাঁড়ায়, তখনো সূর্যে তাপ আছে। শুকিয়ে যাওয়া মহানদীর বালিয়াড়ি পার হওয়া বড় ক্লেশের। কেবল তারা দুজন্তই নয়, নিজ হাতে বিছানো কাঠের পাটাতনের গাড়িটিও তাদের সঙ্গে। সেটিকেও কখনো চালিয়ে, কখনো ঠেলে আনতে হবে জলের সীমানায়।
দুই
শুধু বৃক্ষশীর্ষেই চোখ থাকে না লোকটির – দেখে সে-গাছের কাণ্ডটিকেও। কতখানি ওপরে গিয়ে গাছ ছড়িয়েছে তার ডালপালা একটিই দেখে সে প্রথমে। চেরাই করবার পরে কী পরিমাণ কাঠ হতে পারে এটি অনুমান করা চাই। তারপরে কাণ্ডর শেষে আরো কিছু তক্তা যদি হয়, সেটিকেও সে দেখে। বাকি সব ছোটবড় ডালপালা, শাখা-প্রশাখা জ্বালানির জন্যে ব্যবহার করবে সকলে, কিনে নিয়ে যাবে তার কাছ থেকে। পছন্দ হলে গৃহসে’র গাছটিকে কিনে নেয় সে। মজুরির লোক এসে সেটিকে কেটে নিলে নানা আকারে গুঁড়ি নিয়ে যায় সে কাঠ চেরাইয়ের কারখানায়। কখনো মেলে কিছু লাভ, কখনো মেলে না। এজন্যে রোজগারের এই পথটি বড় পছন্দ ছিল না তার। কিন্তু করবার কিছু ছিলও না। নিজ হিস্যার কয়েক কাঠা জমি রেহান দেওয়ার পরে এই পৌষে কিছুই তার ঘরে উঠবে না জেনে গাছ খুঁজতেই গ্রামে-গ্রামে ঘুরছিল সে। আর তখনই একদিন পৃথুলকাণ্ড গাছটির নিচে সঙ্গিনীকে বসে থাকতে দেখেছিল – তার ঘরের বাইরে। এতোকালের চেনা গ্রাম, চেনা গাছ, চেনা মানুষ মুহূর্তে প্রথম দেখা মনে হয়। ভিন্ন গ্রামে গাছ খোঁজার কালে যাকে দেখেছিল সে আজ এই এতো কাছে, সামনে, দেখে ঘন ছায়া দেয় যে-গাছ, তার কথা খেয়াল থাকে না। স্ত্রীলোকের চোখ সজল নয়, শুধু ভেজা রোদের তাপই দেখা যায়। চেনা মুখে কোনো ভয় নেই জানিয়ে ঠিকানায় পৌঁছে দিতে চায় সে। ফেলে আসা ঠিকানায় আর কখনো ফিরবে না জানালে সে বলে, আমার মাঠেও পৌষ নেই, পৃথুলবৃক্ষের ছায়া কেবল ছায়াই – সূর্য নেমে গেলে সেটিও থাকবে না, বরং চলা যাক সামনে, যদি চায় তাহলে একসঙ্গেই। সঙ্গিনীকে ওই গাছের নিচেই বসিয়ে রেখে সে নিজ হাতে কাঠের আসন্ত বিছানো ত্রিচক্রযানটিকে নিয়ে আসে। সঙ্গে আনে নিজ ব্যবহারের নকশিকাঁথাটিকে। সেটি গাড়ির আসনে বিছিয়ে দিয়ে বলে, ‘উঠে বসো। আর কখনো তোমাকে নামতে হবে না।’
তিন
তিনদিন ঘরে ফেরেনি লোকটি। কৃতকর্মের জন্যে কোনো বোধ ছিল না তার। যে-ঘরে বাস তার, সেটি নিজের নয়, যে-জমির ফসল তোলে সে, সেই জমিও তার নিজের নয় – তাই সবকিছু ভেসে গেলেও, হারালেও তার নিজের কিছুই যাবে না – এই বুঝি চিন্তা। সেই কথাই বলেছিল তার সঙ্গে যে বাস করে সে। না-হলে সারা পরিবারের সারাবছরের শ্রমে ফলানো রেহানি জমির ফসল কেউ মাঠেই হাতবদল করে? চলে যায় শহরে অতি লাভের তেজারতি ব্যবসায়? আর মৌসুমের শেষে ফিরে আসে শূন্যহাতে? শোনা যায়, শহরে তেজারতি ব্যবসায় নয়, ভাগ্যের ব্যবসায় সব খুইয়ে ফেরে সে। তখন টিনের চালা খুলতে হয়। বাঁশঝাড়ের সবকটি বাঁশই চলে যায়, যায় সদ্য বেড়ে-ওঠা কলাগাছের চারাও। আর এসবের কিছুই তার নিজের নয়, সর্বনাশের সব দায় তার হলেও সর্বনাশের তাপ তাকে ছোঁবে না শুনে ঘর ছেড়ে চলে যায় সে। প্রথম দুবার তাকে খুঁজে ঘরে আনলেও এবারে তাকে আর কেউ খোঁজে না। তিনদিন পরে নিজেই ফিরে আসে এবং অন্যের মাটিতে তোলা চালাঘরটি ভেঙে দিয়ে চলে যায়। গৃহবাসের অংশীদার যে, তার তাই ভিন্ন গ্রামে গাছের ছায়ায় আশ্রয় নেওয়া ছাড়া কোনো উপায় ছিল না।
চার
নদীর উঁচু পাড়ে দাঁড়িয়ে তারা ওপারের মাঝিকে ডাকে। দিনের আলো কমলে কমতে থাকে, সূর্যের তাপও কিন্তুতাতে আরাম হয় না। যদি মাঝি না-আসে তাহলে শূন্য নদীতটে বালিয়াড়ির শেষে অন্ধকারে জ্বলবে শ্বাপদের চোখ – এই ভয়ে আরো জোরে ডাকে তারা মাঝিকে। যদি ঘুম ভাঙে তার। কিন্তুঘুম ভাঙে না অথবা সে তার পাটকাঠির চালা ছেড়ে চলে গেছে নিজ ঘরে।
ঠেলাগাড়ি নিয়ে লোকটি তখন সামনে এসে দাঁড়ায়। সে কি ভেবেছিল তাকে কেউ বলবে, তুমি এখানে কেন? জবাবও কি তার তৈরিই ছিল? ঘর যে সে ভাঙেনি, গেছিল নতুন ঘর বাঁধবার জন্যে এ-কথাই বলবে কি সে?
কিন্তুকেউ তাকে কোনো প্রশ্ন করে না। কোনো শব্দ শোনা যায় না। বালিয়াড়ির নকশায় কোনো জোনাকি ফোটে না। আকাশে কোনো মেঘ দেখা যায় না। সামান্য বাতাসে তবু আসন্ন শীতের আভাস থাকে। এই শূন্য নদীতীরে বালুময় প্রান্তরে ‘পৌষ এলো রে’ বলে কেউ তাকে আহ্বান করে না।
একাকী পাখি কী এমন পথ আটকাবে? আটকালেও চাকার নিচে পড়বেই সে, ভেবে
নিজ আসনে উঠে বসে চালক।
সঙ্গিনী আবার নিষেধ করে তাকে। পেছনের দিকে তাকায়, বলে, শেষ পাখিটিও উড়ুক আগে।
--------------------------------------------------------------------------------------------
সঙ্গিনী আবার নিষেধ করে তাকে। পেছনের দিকে তাকায়, বলে, শেষ পাখিটিও উড়ুক আগে।
--------------------------------------------------------------------------------------------
রূপসাগরে ডোবে না, ঈভ
জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত
এক
রাত্রিশেষে শালুকঢাকা পদ্মবিলের কিনারা ধরে হাঁটবে সে। থামবে সেইখানে শালুকের আবরণ সরালে যেখানে স্পষ্ট হয় স্বচ্ছতোয়ার শরীর। আর জলে নেমে দু’পা গিয়ে নিচে চাইলেই সে দেখবে তার সম্পূর্ণ অবয়ব, মুখচ্ছবিসহ, যদি সেই প্রভাতের রবিকর তাকে ভাসিয়ে দিয়ে যায়।
আমি-ই তাকে পদ্মবিলের কথা বলেছিলাম। দিগন্তবিস্তৃত সেই জলাধারের রূপ সামান্য বালকের বর্ণনায় কী-ই বা ফোটে- কোনমতে বোঝানো যায় না শ্বেতরক্তিম সেই আংরাখার যে শেষ নেই! কিন্তু সে বুঝেছিল নিশ্চয়, দেখেছিল সব-ই – দৃশ্যের আড়ালে রয়ে গেলেও।
আমি-ই তাকে শুনিয়েছিলাম ছিন্নবস্ত্র অমলিন কন্যা আর তার হিংসুটে বৈমাত্রেয় ভগিনীর গল্প। অমলিন কন্যা পদ্মবিলে ডুব দিয়ে তীরে উঠে দেখে রাজকন্যার পোশাকে অলঙ্কারে সে ভূবনমোহিনী; দেখাদেখি তার হিংসাগ্রস্ত ভগিনীটিও ডুব দেয় এক-ই পদ্মবিলে। কিন্তু তীরে উঠে দেখে, অলঙ্কার নয়, জলজ কীট জড়িয়ে আছে তার শরীরে, মখমল মসলিন নয়, চীরপরিহিতা কুদর্শনা সে যেন ভিখারিণীই কেবল।
গল্প শুনে সে আমাকে আবার জড়িয়ে ধরেছিল। বলেছিল, তুই যা বলিস্, সব-ই সত্যি হয়। এটিও হবে, তাই না? আমি তার দিকে তাকিয়ে বলেছিলাম, এতো কেবল-ই গল্প। বইয়ে পড়া গল্প। ন’দশ বছর-ই বয়স তো তখন আমার। নাহলে বলতাম, গল্প কখনো সত্যি হয় না। আর সে-ও তার সহজ বিশ্বাসে বলতো, নিশ্চয়ই হয়।
দুই
কোলে তুলে নেবার মতো ছোট তখন আমি ছিলাম না তবু মাসি আমাকে দেখামাত্র কোলে তুলে নিয়েহিল। স্টেশনে নেমে মামা পাল্কিতে উঠেছিলেন অন্য কোন যান না-থাকায়। আর আমি এক পশ্চিমা মাঝির কাঁধে বসে এসেছিলাম পদ্মবিলের পার বরাবর ছড়ানো সবুজ পাতার মাঝে ফোটা হাজার শালুকের মেলা দেখতে দেখতে। চার মাইল রাস্তা। প্রভাতসূর্যে তখন তাপ-ও এসেছিল। তাই বুঝি মাসি আমাকে দেখেই কোলে তুলে নিয়েছিল। বয়স্ক মা-বাবা আর বিধবা দিদির সংসারে তখন-ও কিশোরী একলা মাসি আমাকে তার জীবনের আলো-ই ভেবেছিল বুঝি। হাত-পা ধুইয়ে, মুখ মুছিয়ে খাওয়ায় সে আমাকে আর তেমনি কোলে নিয়েই বেড়িয়ে যায় নিকট প্রতিবেশীদের দেখাতে।
মামাবাড়ির দুইপাশে পুকুর, তার পেছনে আমকাঁঠালের বাগান, ঘনণ বাঁশের ঝাড়। পুকুরের পাড়ে পুরনো দিনের দালান, কাচারিবাড়ি। অন্য দু’পাশেও বাড়ির সীমানা অনেক দূর ছড়ানো। বাঁশঝাড়, বাগিচা, জঙ্গল পেরিয়ে মাঝখানে পায়ে হাঁটা রাস্তা ধরেই কেবল যাওয়া যায় সবচেয়ে কাছের প্রতিবেশীর বাড়িতে। গ্রামের মূল লোকালয়ের শুরুও সেখানেই। গাছপালায় ঘেরা অনেক কটি বাড়ি-ই পরপর সাজানো ইউনিয়ন বোর্ডের রাস্তা বরাবর। রাস্তার পাশে দিয়ে চলে যায় বর্ষার স্রোত নিয়ে পদ্মায় নেমে যাওয়া খালটি। এপাশে আবার জঙ্গল, বাঁশঝাড়, ভিন্ন লোকালয়।
পায়ে হাঁটা রাস্তা ধরে এলে পাড়ার প্রথম বাড়িটিই তাদের – আমার গল্পে মুগ্ধ বিশ্বাসী শ্রোতার। মাসির সখি বলা যায়, যদিও মাসি তখন-ও হাঁটু পর্যন্ত নামা জামাই পরতো আর তার সখির পরনে শাড়ি। মাসির চাইতে বড় সে নিশ্চয়-ই তবুও মাসির কোল থেকে আমাকে নেয় সে, বুকে জড়িয়ে ধরে। একটু কাঁদেও বুঝি, মাসিও। মাত্র কিছুকাল আগে মাতৃহীন আমি- আত্মীয়স্বজনের কান্নায় তখন-ও অভ্যস্ত। নিজে না কাঁদলেও তাদের কান্নার কারণ বুঝি। ততোক্ষণে তার ছোট ভাইবোন কটি-ও চারপাশ ঘিরে দাঁড়ায়। বর্ষার ধারায় কোণা ধুয়ে যাওয়া বারান্দায় উঠে আসে সে। বারান্দায় কাঠের চেয়ারে বসা শীর্ণকায় প্রৌঢ় আমাকে দেখে আমার মৃতা মায়ের নাম নিয়ে বলেন তার-ই ছেলে কিনা আমি। মাসি ও সখি দু’জনেই চোখ মুছে মাথা নাড়ে। বারান্দায় বসিয়ে ঘর থেকে নাড়ু, মোয়া ডালায় করে আমার জন্যে নিয়ে আসে সে। আমি প্রায় কিছুই খাই না, মাসিও। আমার হাফপ্যান্টের পকেটে সেসব ঢুকিয়ে দেয় সে। ঘরে কি বাইরে আর কাউকে দেখি না। পরে জানি, অনেক আগে মাতৃহীনা সে ছোট কটি ভাইবোন ও রুগ্ন পিতাসহ এই সংসারের মূল।
ঐদিন বিকালেই সইয়ের বাড়িতে আসে সে। দিদিমা, বড়মাসিসহ চারজনের মাঝখানে বসি আমি। সকলের আদরের দুলাল, নয়নের মণি যেন। আমার নানা গুণের কথা মাসি বলে। এই বয়সেই বড় বড় সব গল্পের বই পড়তে পারি আমি। চাই কি শোনাতেও পারি সেইসব গল্প। এই অল্প সময়ের মধ্যে আমার ক্ষমতার কথা মাসি জানলো কী করে ঐ বয়সে অমন ভাবা স্বাভাবিক ছিল না – তাই গর্বে বুক ভরেছিল নিশ্চয়। গল্পে গল্পে সন্ধ্যা এসে গেছে প্রায় বুঝলে বড় মাসি বৈকালিক গৃহকর্মের জন্যে উঠে যেতে চায়। ছোটমাসির সই তার হাত ধরে টেনে বসিয়ে বলে, আমি-ই করে দিচ্ছি এবং দ্রুত উঠে সে বৈকালিক কর্মে হাত লাগায়। বোঝা যায়, এটি তার জন্যে নতুন কিছু নয়।
দু’একদিন পরপর-ই সে বিকালে জঙ্গল বাগিচা পার হয়ে হাঁটা পথ ধরে গল্প শুনতে আসতো। কখনো বড়মাসি বই পড়ে শোনাতো, কখনো বা আমি আমার পড়া গল্প মুখে মুখে বলতাম। ছোটমাসির লেখাপড়ায় তেমন মন ছিল না। গ্রামের প্রাইমারী স্কুল শেষ করে আর পড়েনি সে। বাড়িতেও না। তবু গল্প শোনায় তারো মন ছিল। সন্ধ্যার আলো জ্বলবার আগেই সকলকে উঠতে হতো। সখিটিকেও। ঘরে ছোট ছোট ভাইবোন, রুগ্ন পিতা ভুলতে পারে না সে কিছুতেই। কখনো দেরী হলে বেশ কদিন আর আসতো না সে। মাসি বলতো, ওর বাবাই হয়তো দায়ী এজন্যে।
ঐরকম সময়ে বাগিচা, জঙ্গল, বাঁশঝাড় পার হয়ে হাঁটা পথ ধরে মাসিকে নিয়ে, কখনো বা আমি একলাই চলে যেতাম তার বাড়িতে। কখনো ভাইবোনের আবদারে অস্থির, কখনো পিতার সেবায় ব্যস্ত, কখনো রান্নাঘরে আগুনের তাপে স্বেদময়। সে আমাদের দেখলেই হেসে দাঁড়াতো সামনে এসে। জড়িয়ে ধরতো বুকে আর আমিও তাকে ছাড়তে চাইতাম না। কখনো তাকে ঘরে না-পেলে শুনতাম গ্রামের শেষে পানের বরজে অসুস্থ পিতার বদলী খাটতে গেছে সে। কখনো বা দেখেছি ঘরের চালে উঠে পাতলা হয়ে যাওয়া আস্তরে খড় গুঁজে দিয়ে চালা বাঁধছে। আমি বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকতাম। বড়মাসি, ছোটমাসি বা অমন কাউকে ঐ-রকম কিছু করতে দেখিনি বলেই হয়তো।
তিন
আমি মামাবাড়ি যাওয়ার কিছুদিন পরেই ছোটমামা শহর থেকে এসে আমায় স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিলেন। আমার বয়সে যে ক্লাসে স্বাভাবিক তার চাইতে দু’ধাপ ওপরেই প্রায়। আসলে এক শ্রেনী ওপরেই কিন্তু তখন স্কুলের বছর প্রায় শেষ, ক’দিন পরেই বার্ষিক পরীক্ষা। পাশ করলে তো দু’ক্লাস ওপরেই চলে যাবো শিক্ষকদের এই কথায় মা.
০মা রাজী হয়ে যান। আমার নানা গুণের মধ্যে আরো একটি যোগ হয়।
গ্রামের স্কুল – সকালে শুরু হয়ে দুপুরের পরপর-ই শেষ হয়ে যেতো। একলা হেঁটে মামাবাড়িতে ফেরার পথে আমি স্কুলের পেছনে সরষের হলুদ প্রান্তরের দিকে তাকিয়ে থাকতাম, কি দেখতাম ভরা আমনের ক্ষেতে ধানের শীষে পাখির ওড়াউড়ি। কখনো দেখতাম অড়হরের ডালে ল্যাজঝোলা পাখি বসে গাছ দুলিয়ে আবার দূরে চলে যায়। স্কুলের সীমানা ছাড়িয়ে বাজার, বাজারের মুখে পোস্ট-অফিস। কখনো ডাকপিয়ন চলে না-গেলে পোস্ট অফিসের বারান্দায় তার জন্যে দাঁড়িয়ে থাকতাম। পরে পড়তি রোদে বাজারের শেষে পদ্মামুখী স্রোতের খাল পার হয়ে, বাঁশঝাড় জঙ্গলের ছায়ার গ্রামে ঢুকলে বড় মন খারাপ করতো। আর তখন দূর গ্রামে ফেলে আসা স্বজনদের চাইতেও আমার গল্পের মুগ্ধ শ্রোতাটির কথাই মনে পড়তো বেশি।
ভরা বর্ষায় রাস্তার পাশ দিয়ে চলে যাওয়া খালটি দু’কূল ছাপিয়ে ছুটতো বড় খালের সঙ্গে মিশে পদ্মায় যাবার জন্যে। বড় খাল-ও তখন যেনো তীরহীন নদী। বাঁশের সাঁকো পার হয়ে ওপারে গেলে তবেই স্কুল। খালের দুই পার থেকে কয়েকটি বাঁশ পাশাপাশি রাখায় সাঁকোর দুই মুখ প্রশস্ত হলেও মাঝখানে পাতা কেবল একটি মোটা বাঁশ। আর বেশ উঁচুতে বাঁধা আর একটি সরু বাঁশ ধরে সেটি পার হতে আমার শরীর কাঁপতো। একদিন সাঁকো পার হওয়ার সময়ে এক বাঁশের মাঝখানে এসে এতো কাঁপতে থাকি যে চোখ বন্ধ করে ফেলি। তার পরে কিছু যেন মনে পড়ে না, মনে পড়ে চোখ খুললে দেখি সাঁকোর প্রশস্ত প্রান্তে দাঁড়ানো আমি। আমার শ্রোতাকুল নিঃসন্দেহে বিশ্বাস করে যে সেটি আর কিছু নয় কোনো অশরীরি শক্তি-ই আমাকে একবাঁশের অংশ পার করিয়ে দিয়েছিল। এইরকম ঘটনা আরো দু”একটি ছিল।
গরমের সময়ে বড়ঘরের বারান্দায় মাদুর পেতে শুতাম আমি। আর কেউ নয়। মাসিরা, দিদিমা কি দাদু যার যার ঘরে – দরজা দেয়া। ঐ বয়সে --তখনো নিতান্ত বালক-ই তো, কেনো একলা শোয়ার ব্যবস্থা বুঝিনি। সেটি কি এইজন্যে যে শীতকালে লেপের মধ্যে ছোটমাসি আমাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমুলেও গরমের সময়ে পারতো না- তার শোয়া খুব খারাপ ছিল। এজন্যেইকি? অথবা বন্ধ ঘরের গরম আমার সইতো না?
অমনি এক রাতে বারান্দায় একলা শোয়া আমার হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে যায়। ঊঠে বসি। মৃদু জ্যোৎস্নার রাত্রি। সদর দরজার দিকে চেয়ে দেখি সাদা কাপড়ে মোড়া এক মূর্তি ধীরে হেঁটে আমার দিকেই এগিয়ে আসে। বিবশ আমি চোখ বন্ধ করি। কতোক্ষণ পরে জানি না চোখ খুলে দেখি সদর দরজার পাশে মূর্তিটি তেমনি দাঁড়ানো। আর মেঘ-জ্যোৎস্নার রাত্রিতে তখন মেঘ সরে যাওয়ায় সাদা জ্যোৎস্না সদর দরজার পাশে দাঁড়ানো মানকচুর পাতাটিকেই মূর্তি বানিয়েছে। আমার শ্রোতাকুল জ্যোৎস্নার কারুকাজ বিশ্বাস করে না। মাসির সখিটি তো কোনমতে নয়।
স্কুল থেকে অথবা বাজার থেকে ফেরবার সময়ে বাড়ির পেছনের দরজা দিয়ে ঢুকলে রাস্তা কম পড়তো। ঘন বাঁশঝাড়ের নীচে দিয়ে পথ। পাতাঝড়ার দিনে শুকনো বাঁশপাতা এমন পুরু জাজিম বানাতো যে এক পা তুলে আর এক পা ফেললে পা ডুবে যেতো সেই জাজিমে, আর মনে হতো কেউ যেন ঠিক পেছনেই হাঁটছে। পা ফেলার সঙ্গে সঙ্গে সে-ও ফেলে পা, শোনা যায় তার পায়ের আওয়াজ, বাতাসে ভাসে সেই শব্দ। আমি বাঁশপাতায় মোড়া সামান্য পথ দৌঁড়ে পার হয়ে আসি। এই গল্পেও তারা অশরীরির চিহ্ন খুঁজে পায়। বাঁশবাগান চিরকাল-ই অজানা শঙ্কায় ভরা, তারা বলে। আর সেই শংকা আদৌ অমূলক নয়। সেটি কাটানোর ক্ষমতা সকলের থাকে না।
চার
ভরা বর্ষার শেষে, শ্বেত শরতের কাল চলে গেলে হালকা কুয়াশার হেমন্তে বৈকালিক গল্পের আসর বসে আবার। অনেক দিন পরে সে-ও আসে। বর্ষার ধারায় সিক্ত সজীব সে নয়। শরতের জ্যোৎস্না তার মুখে ছিল না, ম্লানমুখী বিষন্ন সখীকে মাসি তার বাড়ি গিয়ে ডেকে এনেছিল। কখনো অসুস্থ, কখনো কর্মহীন পিতা তার, নিজে পিতার বদলী খেটে, বনেবাদাড়ে ঘুরে, শাকপাতা এনে, ঘরের পেছনে সবজি ফলিয়ে অর্ধাহারের ব্যবস্থা করে সে – এ-সব-ই জানা। মাসি তার সই-এর দুঃখ কমাতে চেষ্টা করে কিন্তু সখিটি সংকোচে ও লজ্জায় সর্বদা ম্রিয়মান। এইসব নানা কথাবার্তায় সেদিনের বৈকালিক আসর জমে না। বড়মাসি শেষে জিজ্ঞাসা করে, হ্যাঁরে, তোর বাবা নাকি বিয়ের চেষ্টা করছে? এমনিতেই ভেজা চোখ তার, এবারে জলে ভরে যায়। মাকে কে বিয়ে করবে দিদি? আস্তেই বলে সে। আর আমি গেলে সংসার-ই বা চলবে কী করে? সে-কথা সকলেই জানে, তবুও মাসি বলে, শুনি তোর বাবা নাকি আবার বিয়ে করবে?” ম্লান স্বর শোনা যায়, তাকেই বা মেয়ে দেবে কে?
সেদিন আর কোন গল্প হয় না। যে যার কাজে ফিরে গেলে আমি লন্ঠন জ্বালিয়ে মাদুর পেতে বারান্দায় বসি স্কুলের বইখাতা নিয়ে। মাসি এসে পাশে বসে। আমার বইপ্ত্র নিয়ে নাড়াচাড়া করে। নিজেরো কিছু বইপত্র আছে তার। হাইস্কুলে পড়বে বলে মামারা কিনে দিয়েছিল। অনেক পুরনো সে-সব বই নিয়েও কখনো সে বসে আমার মাদুরে। কিন্তু আজ নয়। আজ সে এসে মাদুরের এক পাশে শুয়েই পড়ে। অংক কষতে থাকি আমি। অনেকক্ষণ চোখ বন্ধ করে রেখে বলে সে, মেয়েদের বিয়ে না-হওয়া বড় কষ্টের, তাই না? আমি একটু চমকে তার দিকে তাকাই – বিয়ের কথা শুনেই বুঝি। খেয়াল করে দেখি, আজ সে শাড়ি পরা। মনে পড়ে, সেই প্রথম দিন তাকে দেখার কিছু কাল পর থেকেই শাড়ি পরে সে। আর বিয়ে হলেই বা কী? কষ্টতো তাতেও কমে না! বালবিধবা বড় বোনের কথা ভেবেই বুঝি বলে আবার।
আমার বয়স দশ। প্রাইমারি স্কুল শেষ প্রায়। মামাবাড়ি থেকে লেখাপড়া করি। দাদুর সঙ্গে হাটবাজারে যাই। পোস্টঅফিসে চিঠি আনতে যাই। ছুটিছাটায় ছোটমামা বাড়ি এলে ঝাড় থেকে বাঁশ কেটে সারাদিনের রোদে মামার সঙ্গে বাড়ির চারপাশে বেড়া বাঁধি। আমি কি করবো । আমার কোন-ই ক্ষমতা নেই। মাসিরা যা-ই বলুক না কেন!
পাঁচ
স্কুলের শেষে ফেরার পথে পোস্টঅফিসে যাই। ডাকপিয়ন তখন-ও ফেরেনি। হাটের দিনে সে বেশি দূরে যায় না। হাটেই চিঠি বিলি করে। যদি মামাদের কোন চিঠি থাকে এই ভেবে দেরী করি। শেষে বেলা প্রায় পড়ার মুখে ঘরে ফিরি – বাঁশবাগানের শুকনো পাতা মাড়িয়ে, বাড়ির পেছনের সদ্যবাঁধা বাঁশের দরজা খুলে।
রান্নাঘরের বারান্দায় দেখি সকলে বসা। মাসির সইকে নিয়ে আলাপ – কাছে এলেই বুঝি। সারা দিন অন্যের ক্ষেতে, মাঠে , ফলবাগানে, ঘোরাঘুরি তার নিত্যকর্ম জানি বলেই রোদে পোড়া ঘামে ভেজা চেহারা দেখে অবাক হই না। তবুও আমি কাছে এলে তাদের কথাবার্তা থেমে যায়। বইখাতা রাখবার জন্যে ভেতর বাড়িতে যাই। শোবার ঘরের বারান্দার চালে ঝোলানো কাঠের তাকে বইখাতা রেখে ফিরে আসি। রান্নাঘরের দিকে মোড় নেবার মুখে শুনি দিদিমার গলা, বিয়ে হবে তোর, সে তো ভালো কথা, কাঁদিস্ কেনো? কিন্তু বিয়ের পর মাসি, বিয়ের পর – কে রাখবে আমাকে – , কেঁদেই বলে সে, বলে, বুকের কাপড় সরিয়ে দেয়। আর সেই মুহূর্তে, রান্নাঘরের বারান্দার দিকে এগোনোর মুখে, আমি দেখি, তার খোলা বুক, মাসিদের কি দিদিমা কারো মতোই নয়। প্রায় আমার-ই মতো।
ছয়
বিয়েবাড়ির কোন চিহ্ন সেখানে ছিল না। তোলা বিয়ে। কনেকে নিয়ে রাখা হবে বিবাহোচ্ছুক পাত্রের গ্রামে- কোনো বাড়িতে। যথাকালে বিবাহস্থলে পৌঁছে দিলে চলবে আনুষ্ঠানিকতা। অসমর্থ পিতার কন্যার জন্যে বিবাহরীতিটি নতুন কিছু নয়। তবুও দুপুরের মুখে, ভিন্নগ্রামে কনেকে নিয়ে যাও্যার আগে, মাসির সঙ্গে তাকে দেখতে যাই আমি। রঙ্গিন তাঁতের শাড়িতে তাকে কনে বউটির মতো-ই দেখায়। মাসি কাছে গিয়ে ক্রন্দমুখী তাকে জড়িয়ে ধরে। আমাকেও হাত বাড়িয়ে ধরে সে। বলে, তুই যা বলিস সব-ই তো সত্যি হয়। তাই না? আমি জবাব দিই, হ্যাঁ।
আশেপাশের বাড়ির দু’চারজন পড়শি ছাড়া আর কাউকেই দেখি না। কেবল ভাইবোন কটি তাকে ঘিরে উঠানে দাঁড়ানো। বারান্দায় একটি ফুলপাতা আঁকা টিনের তোরঙ্গ। তার বাবা সেটি হাতে নিয়ে নেমে আসে। তিঙ চার ঘন্টার হাঁটা পথ। এখুনি বেরুতে হবে-- বলে তার বাবা ইউনিয়নবোর্ডের রাস্তার দিকে পা বাড়ায়। সে-ও চলতে শুরু করলে আমরা পেছনে পেছনে যাই। বড় রাস্তার মোড়ে গিয়ে তাকে দেখি। পেছন ফিরে ফিরে তাকায় সে বার বার।
ঘরে ফেরার মুখে আমরা কোন কথা বলি না। বাড়িতে ফিরেও নয়। অন্তত তার কথা কেউ-ই বলে না।
সাত
অনেক অনেক রাতে ঘুম ভাঙ্গে আমার। স্পষ্ট বুঝি পাশে কেউ বসে আছে। গায়ে তার হাতের স্পর্শ পাই। মুহূর্তে উঠে বসি। সেটিও জ্যোৎস্নার রাত্রি। চাঁদ অনেক নিচে নেমে যাওয়ায় তার কিছু আলো বারান্দায় আমার মাদুরে পড়েছে। সেই আলোয় দেখি, বিবাহের কন্যা আমার পাশে। আমি কথা বলতে চাইলে সে আমার মুখে হাত চাপা দেয়। কাউকে ডাকিস্ না। এই আমি চলে যাচ্ছি-- বলে ওঠে সে। ওঠার মুখে বলে, ওরা আমাকে নিলো না। সাদা জ্যোৎস্নায় তার চোখে জলের রেখা স্পষ্ট দেখা যায়। তখন প্রায় নিঃশব্দে বলে সে, না থাক আমার কিছু-- আমি-ও তো মেয়ে! তার সঙ্গে আমিও উঠে দাঁড়াই। আমাকে আবার, শেষবারের মতোই বুঝি, জড়িয়ে ধরে সে। বলে, তোর কথা সব-ই তো সত্যি হয়, তাই না? আমি কিছু না-ভেবে, কোন্ কথা না-ভেবে, সত্য কী অথবা কী মিথ্যা না-ভেবে। চোখ বন্ধ করে বলি, হ্যাঁ।
আমাকে ছাড়ে সে। বারান্দা থেকে নেমে বাইরের দরজার দিকে যায়। জ্যোৎস্নার আলো তখন আবার সেই মানকচুর পাতাটিকে কনেবৌ বানিয়ে দেয়।
আট
পরদিন সারা গাঁ খুঁজেও তাকে কেউ পাবে না। আমি যদিও জানি সে কোথায়। জানি, সে বড়রাস্তার শেষে পদ্মবিলের কিনারা দিয়ে যাওয়া পায়েহাঁটা পথ ধবে হাঁটবে। জ্যোৎস্নার শেষে না-আলো না-অন্ধকারের প্রভাত তার সামনে পথরেখা স্পষ্ট করে দিলে, সে তার সামনে পাশে পদ্মবিলের শ্বেতরক্তিম শালুক আর সোনালী পদ্মের যোজনবিস্তৃত প্রান্তর দেখবে। আকাশের কোলে লাল মেঘের নিচে তখন আলোর আধার। সেই আলোয় চিনে নেবে সে পদ্মবিলের স্বচ্ছতোয়া স্থানটিকে। লাল দিগন্তের দিকে মুখ করে জলে নামবে সে। দু’পা নেমে আরো দু’পা গিয়ে প্রথম ডুবটি দেবে, তারপর উঠে আসবে। রক্তিম দিগন্তের উৎস তখন তার সম্মুখে। জলের কিনারায় দাঁড়াবে সে, মাথা সামান্য নিচু করে দেখবে তার মুখচ্ছবি। দেখবে, জলে কাঁপে নিরাবরণ, নিরাভরণ সৃষ্টির প্রথম নারী। ঈভ।
2 মন্তব্যসমূহ
বলার ভাষা খুঁজে পাচ্ছি না
উত্তরমুছুনঅদ্ভুত এক মুগ্ধতা বোধ আচ্ছন্ন করে রেখেছে
বলার ভাষা খুঁজে পাচ্ছি না
উত্তরমুছুনঅদ্ভুত এক মুগ্ধতা বোধ আচ্ছন্ন করে রেখেছে