জ্যোতিপ্রকাশের গল্পঃ প্রান্তিকের কার্নিভাল

সঙ্ঘমিত্রা হালদার


প্রায় সর্বত্রই নিম্নবর্গীয় তথা লোকসমাজের উপর রাষ্টের বা উচ্চবিত্তের দমন- পীড়ন- অত্যাচার- শোষণ ইত্যাদি চালু রীতি। সহ্যের অতিরিক্ত হলে মানুষ নিরুপায় ক্রোধ উগরেছে। কখনো খোলা আকাশের তলায় ক্রীতদাস মানুষটি গর্জে উঠে ধ্বনি-শব্দ সমাহারে প্রতিবাদ জানিয়েছে তার আদিম দেবতার কাছে। কখনো বা উৎসবে মুখর হয়ে রঙ্গব্যঙ্গ রীতিতে। ইউরোপীয় লোকসংস্কৃতিতেও নিম্নবর্গীয় মানুষদের যুগপৎ প্রতিবাদ ও মুক্তির উপায় ছিল উৎসব- কার্নিভাল
লোকসাধারণ এই উৎসব তথা কার্নিভাল-এর মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রিক, সামাজিক ও ধর্মীয় ভীতি জয় করবার উদ্দীপনা বা বলা ভালো বেঁচে থাকবার সাহস অর্জন করত। মিখায়েল বাখতিন  দস্তয়েভস্কির উপন্যাসে প্রান্তিক ও অপাংক্তেয় মানুষের  স্বর হিসাবে এই কার্নিভাল-এর প্রয়োগ লক্ষ করেছিলেন। যা আসলে মানুষের মুক্তির প্রয়াস। আর বর্তমান প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত তাঁর ছোটগল্পের সীমিত পরিসরেই একের পর এক গল্পে এইসব অবদমিত- পীড়িত আর শোষিত মানুষের মুক্তির উপায় ঠাউরেছেন। যখন সাধারণ মানুষের সমাজ ও তার অবস্থার নিরিখে নিজের মতো করে বেঁচে থাকাটাই একটা প্রতিবাদ। কিংবা পেটের কাছে উঁচিয়ে আছে ছুরির মতো সন্ত্রস্ত তার জীবন। আর সেই পরিসরেই জ্যোতিপ্রকাশ তাঁর গল্পসংকলনটিতে নির্মাণ করেছেন কার্নিভাল-এর আবহ । সন্ধান করে ফিরেছেন জীবন প্রাচুর্যের।   


                                     জ্যোতিপ্রকাশের সাজানো ফুলের বাগান বা কেষ্ট যাত্রা-র মতো  অসংখ্য গল্পে প্রান্তিক চরিত্রদের কার্নিভাল লক্ষ করা যায়। কোনঠাসা মানুষগুলোর উপর ঘুরিয়ে ফিরিয়ে সার্চ লাইটের আলো পড়েছে। প্রাধান্য পায়নি কোন একক স্বর। মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ নেড়েচেড়ে দেখেছেন। যুগপৎ বদল ঘটিয়েছেন প্রেক্ষিত এবং অবস্থানের। ধরা যাক, সাজানো ফুলের বাগান গল্পটি। একটি চরিত্র জাহেদ। যে অনিরাময়যোগ্য ব্যধিতে শুয়ে থাকে আরও অপরিচ্ছন্ন একটি বিছানায়। সন্ধ্যে রাতে জাহেদের বাড়ির বাগানে কঠিন, জমাট, নিরেট পাথরের মতো অন্ধকার নামে। বন্ধু সুদাস জাহেদের অসুখের খোঁজ নিতে ঘরে ঢুকতে গিয়ে  বুঝতে পারে বাইরের অন্ধকার ঘরে আরও জমাট। আরও ঘন। বাইরে পা চলে। কিন্তু ঘরে পাও চলে না। আসলে যে অন্ধকার বানানো তার ভার দুর্বিসহ হবে বইকি! তাই ছোটগল্পের শিল্পরূপের সঙ্গে সঙ্গতপূর্ণ ভাষায় লেখক ধরিয়ে দেন সেই আলগা হয়ে লেগে থাকা অসংগতিটি-

                 কী করে যে এই অন্ধকার এমন কালো হলো। কী কালো!
               

                                        মিশেল ফুকো যেমন দেখিয়েছিলেন একটা ইতিহাস যা কিনা আমরা ধ্রুব সত্য হিসাবে- একমাত্র উপকরণ প্রতিপাদ্য সমীকরণ হিসাবে মেনে আসছিলাম, যা আদতে একটি প্রতিবেদন। কাঁটাটা বিধলেও আমরা ঢোক গিলতে বাধ্য হয়েছিলাম। মানে না গিলে উপায় ছিল না। তেমনি সিস্টেমের মধ্যে থাকা মানুষ নিরপেক্ষ বা কেবল সাদা অথবা কালো হবেই বা কী করে? ভালো চাই বা মন্দ চাই- এমন সমীকরণও তাই প্রযোজ্য নয়। আর তাই জাজমেন্ট-এর গপ্প। নিজের প্রয়োজনে সিস্টেমের কাছে বিকোতে বিকোতে (উপায় নেই) সে নিজেকে জাস্টিফাই করবার পাহাড় প্রমাণ সুবিধা আত্মসাৎ করল। করতেই হল। তাই অসুস্থ  জাহেদের পাথর প্রমাণ কালো অন্ধকার ঘরে সামান্য ক্ষীন হলুদ আলো আর কিছু ওষুধের ব্যবস্থা করে তারা নিজের মনেই নানা প্রশ্ন-উত্তরের তর্জমা ভাঁজতে থাকে। তারা জাহেদকে কতটা সাহায্য করতে পারবে- কতদিন এভাবে সাহায্য করতে পারবে- কতটা করবে ইত্যাকার। উত্তরও নিজেই এসে ধরা দেয়। জাহেদই বা তার জন্য, তাদের জন্য কতটা করেছে।তাদের প্রশ্ন ও উত্তর সম্ভব ও অসম্ভবের এইসব নানাবিধ ফাঁকফোঁকর খোঁজে। স্থির জলে ছায়া ফেলে নিজেরই প্রেত খানিক বিশ্রাম চায়। অতএব আপাতত শান্তিপর্ব। মীমাংসা।  


                                     তবু ফাটল আপনা থেকেই ধরা দেয়। মানুষ চিন্তাশীল এবং স্বততই আবেগপ্রবণ। বন্ধুতার টানে ইফতিকার, সুহাসরা পরদিনই জাহেদের জন্য ডাক্তারি পরামর্শের সিদ্ধান্ত নেয়। জানা যায় রোগ জটিল। প্রতিকারও। বেশিদিন হয়ত বাঁচবে না সে। আপাতত শান্তিকল্যান পর্বে চিড় ধরে আপনা থেকেই। জাহেদের স্থির হয়ে শুয়ে থাকার নিরুত্তাপ আঁচ টের পায় ইফতিকার, ননীরা। বুঝতে পারে আসলে তারা কেউই- তাদের কারোর অবস্থানই খুব বেশি নিরাপদ নয়। তাদের প্রত্যেকের জন্যই এক-একটা কুঠুরিতে আলাদা ব্যাধি অপেক্ষা করে আছে। থমকে আছে নিরেট কালো অন্ধকার। আর এই বুঝতে পারা- সম্যক জ্ঞানের উপলব্ধিই  সঞ্চার করে ক্রোধের। যা মানুষকে যোগায় নিজের অবস্থার ক্রীতদাস না হয়ে নিজের অবস্থানকে অতিক্রম করে যাওয়ার মানসিকতা। যা যে কোন আধিপত্য ও ঔপনিবেশিক সত্তার বিরুদ্ধেও লড়াই। তাই ইফতিকার কুড়ুল হাতে ননীর যে বাগান তছনছ করে ননীর ও যেখানে পরোক্ষে সায় থাকে। অন্তত আপত্তি থাকে না। তা রাষ্ট্রযন্ত্রের কপালের ভাঁজকেই আরও চওড়া করে। অন্তত স্বস্তিতে রাখে না এটা সুনিশ্চিত।   



                                   কেষ্ট যাত্রা গল্পে লোকটা অর্থাৎ কেষ্টবাবু চেয়েছিল যাত্রাদলে রাজার পার্ট। চেয়েছিল মাস্টার হতে। পরিবর্তে ডাক্তারখানায় ঘুরে ঘুরে ওষুধ বেচতে হয়। তাও পাওনা টাকা বাকি পড়ে থাকে। তিন টাকার পাওনা আদায় করতে দুটাকা গাড়িভাড়াতেই খরচ হয়। ছেলেকে পড়ানোর সামর্থ নেই বলেই সুখেনের স্কুল থেকে নাম কাটা পড়ে। অসহায়তা ঢাকতেই নিজের অক্ষমতাকে কপালের বরাত হিসাবে মেনে নেয়। কিন্তু জীবনে কোন কোন ঘটনা নিজের পলায়নবাদী সত্তাটাকে ঘাড় ধরে সামনে এনে বসায়। সরবার আর বিন্দুমাত্র জায়গা না থাকলে প্রশ্নের মুখোমুখি হয়ে হেস্তনেস্ত উত্তরপর্বটি আপনিই এসে ধরা দেয়। চোখে চোখ পেড়ে তার মাপজোখ নেওয়া চলে। এমনিএকটা ঘটনাঅপমান কেষ্টবাবুকে প্রতিরোধ গড়তে শেখায়। ভাঙনের হাঁ মুখে তলিয়ে যেতে যেতে সে স্থির সিদ্ধান্ত নেয় ছেলেকে সে-ই দেবে রাজার পার্ট। একপ্রকার নিজের এতদিনের পুষে রাখা বিশ্বাসকেই চ্যালেঞ্জ জানায় সে। জড় চঞ্চল হয়।  


                                     লেনিন তাঁর প্রতিফলন তত্ত্বে ঠিক এই কথাটাই বলেছিলেন। অর্থাৎ মানুষ কেষ্টবাবুরা হল একটি সক্রিয় কারক। যে প্রকৃতিকে নিজের সক্রিয়তা দ্বারা পরিবর্তিত করার ক্ষমতা রাখে। বদল ঘটে তার চৈতন্যের। জ্যোতিপ্রকাশ তাঁর গল্পে বস্তু ও মানুষের দ্বান্দ্বিক সমন্বয়ের ইতিহাসকে সাকার করে তুলেছেন। তাই মোটা করে দাগানো ভাষায় কোন প্রতিবাদ নেই তাঁর লেখায়। নিজের চারপাশের সমস্যাগুলোকে চারপাশের মানুষগুলোর অসহায়তা- আর নিপীড়ন আর শোষনের মুক্তির উপায় হিসাবে কার্নিভাল রচনা করেছেন তাঁর লেখায়। সমস্যা সম্পর্কে- সমাজের দ্বান্দ্বিক অবস্থান সম্পর্কে সচেতন স্বরগুলিই হল সেই কার্নিভাল     
                         

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

1 মন্তব্যসমূহ


  1. প্রান্তিক চরিত্রদের ‘কার্নিভাল’ !!! কি বোঝাতে চাইছেন

    '' জ্যোতিপ্রকাশের ‘সাজানো ফুলের বাগান’ বা ‘কেষ্ট যাত্রা’-র মতো অসংখ্য গল্পে প্রান্তিক চরিত্রদের ‘কার্নিভাল’ লক্ষ করা যায়। ''

    কার্নিভাল অভিধায় আমাদের স্বদেশী সাহিত্যে এই সনাক্তি অভিপ্রেত নয় ! আমাদের উন্নয়নশীল দেশজ বিন্যাসে যেন পুঁজিবাদী সাহিত্য সমালোচনা দৃষ্টি এখানে চোখে পড়ে, কার্নিভাল আমার কাছে অপপ্রয়োগ ! বাকুনিন প্রথম ব্যবহার করেছিলেন ...

    উত্তরমুছুন