রেহাননামা: প্রান্তবর্তী এক কৃষকের মুছে যাওয়া স্বপ্ন

কামাল রাহমান


যে দৃশ্য দেখার জন্য জীবন বাজি রেখেছিল ভূমিহীন এক প্রান্তিক কৃষক তা মুছে গেলে সামান্য ঐ জীবনের ঋণ পরিশোধ করার জন্য স্বাক্ষর করা সাদা কাগজের উপর রাখতে হয় পরাজিত ঐ জীবনকে। জাগতিক হিসেবে খুব ছোট, অতি সামান্য ঐ দায় পরিশোধের বিকল্প আর কি থাকতে পারে সমাজের তথাকথিত মেরুদণ্ড ঐ কৃষক সমাজের এক অসহায় প্রতিনিধির? প্রান্তবর্তী মানুষের কাছে একটা জীবনের চেয়ে মূল্যবান, অথবা মূল্যহীন আর কোনো কিছুই হতে পারে না। এই নির্মম সত্যটা আশ্চর্য এক নির্মোহতায় উপস্থাপন করেন আমাদের বাংলা গল্পের যাদুশিল্পী জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত, তাঁর রেহাননামা গল্পে।


 আমাদের কালের এক যাদুশিল্পীই তিনি, তাঁর আশ্চর্য রুমালের ভেতর থেকে অবলীলায় বের করেন লাল গোলাপ, জ্যান্ত পায়রা, আবার কখনো কড়কড়ে কাগুজে মুদ্রা, এ রকম অনেক বিচিত্র সম্ভার! এই আশ্চর্য নির্লিপ্ত ভঙ্গি আমাদের মনে করিয়ে দেয় বিশ্বের আরেক শ্রেষ্ঠ গল্পকার আন্তন চেখভের কথা, যিনি নতুন জামাইর মতো ভালোবাসার গল্প লেখেন প্রেমপূর্ণ একটা শব্দও উচ্চারণ না করে, নতুন জামাইর ভালোবাসার তীব্র তৃষ্ণা, সারারাত নৌকো বেয়ে আবার সকাল হওয়ার আগে ফিরে আসার অক্লান্ত শ্রম, দয়িতকে একটিবার ছুঁয়ে আসার প্রচ্ছন্ন আকুতিকে উপজীব্য করে। এই ভঙ্গিটা চেখভ উল্লেখ করেন এভাবে, স্মৃতি থেকে লিখছি যা অনেকটা এরকম, যদি জ্যোৎস্না দেখাতে চাও তাহলে জানালা গলে আসা আলোটাকে একটা শিশির বিন্দুর উপর দেখিয়ে দাও। জ্যোতিপ্রকাশের বিষয়টা অনেকটা ওরকমই, ছোট্ট কোনো বিষয় নিয়ে ইনিয়ে বিনিয়ে সাতকাহন তৈরি করেন না তিনি, বরং বড় বিষয়টাকেই আশ্চর্য কুশলতায় ছোট্ট ও সুন্দর করে উপস্থাপন করেন, এবং তা দেখিয়ে দেন প্রায়োগিকভাবে, তাঁর বিভিন্ন গল্পে।

রেহাননামায় আছে এক রহস্যমৃত্যু, অথচ নেই মৃত্যুর বিভৎসতা, ভয়াবহতা কিম্বা নির্মমতা। আশ্চর্য এক মৃত্যু, চরম ঔদাসীন্যে যা ছুঁয়ে যায় এক গভীর বাস্তবতা, যেন এমন একটা পরিণতির জন্য মৃত্যু এক নিত্য ঘটনা, এটা অবশ্যম্ভাবী ও অমোঘ এক নিয়তি-নির্ভর আয়োজন। জ্যোতিপ্রকাশের এই আশ্চর্য যাদু-কৌশলটা ধরার জন্য বারবার পড়েছি রেহাননামা গল্পটা। যাদুর রহস্যটা যদি জানা না থাকে তাহলে বারবার দেখেও যেমন ওটা ধরা যায় না, যদিও যাদুকরের কাছে এটা জলের মতো সোজা একটা বিষয়, অনেকটা তেমনই হয়েছে এক্ষেত্রে। এমন স্বচ্ছন্দ ও নির্বিকার ভঙ্গিতে গল্প লেখার তুলনা বাংলায় খুব কম। যারা ভাষাটাকে দুমড়ে মুচড়ে কঠিন ও দুর্বোধ্য করে তুলে গল্পটা বানাতে চান তাদের বিপরীতে জ্যোতিপ্রকাশের অবস্থান। সহজ ভাষায়, সরল আঙ্গিকে কঠিন ও জটিল ভাবনা উসকে দেয়া গল্প লেখেন তিনি। ভাষার কলাকৌশল বা ক্যারিক্যাচার না, তাঁর গল্প বোঝার জন্য অখণ্ড মনোযোগ দিতে হয় গল্পটার উপর। বানানো, আবার কখনো বিকৃত, ভাষার ধকল পোহাতে হয় না পাঠককে তাঁর গল্প পড়তে যেয়ে।

রেহাননামার মৃত কৃষক নামহীন ও গোত্রহীন। স্বাভাবিকভাবেই ভূমিহীন এই কৃষক ঐতিহাসিক সময়পর্ব থেকে শোষিত ও দলিত এক সমাজের প্রতিভূ। এমনকি যে মুনীষ ঋণ পাওয়ার জন্য এনজিও ব্যাংকের পাতা ফাঁদের প্রলোভনে পড়তে যেয়েও বেঁচে যায় তারও কোনো নাম নেই, কিষাণীর নাম নেই, গল্পটার কোনো চরিত্রেরই নাম নেই, এভাবেই এক সার্বজনীনতা নির্মাণ করেন তিনি, যে কেউ হতে পারে এরা।

যে গল্প শিল্প হয়ে উঠে তার কোনো ব্যাখ্যা নেই, শিল্পের কোনো নির্দিষ্ট সংজ্ঞা নেই, আকাশের কোনো একটা মেঘের যেমন বর্ণনা হয় না, প্রতি মুহূর্তে না বদলালে ওটা তো আর মেঘ না, একটা বরফের চাঁই। একজন কালিদাস কতটুকুই আর কাব্য করতে পারতেন একটা বরফের চাঁই নিয়ে! রেহাননামা গল্পের ঐ কৃষক সামান্য এক মৃত্যুর ভেতর দিয়ে রেখে যায় এক সতর্ক বার্তা। যে লোভ, যাকে লোভ বলাও সঙ্গত না, মানুষের খুব স্বাভাবিক এক ইচ্ছা এটা, নিজের কর্তৃত্বে থাকা ছোট্ট একখণ্ড জমিতে ফলানো সবুজ ফসলের স্বপ্ন দেখায়, তা না থাকলে সে আর কৃষক হয় কীভাবে! ঐ স্বপ্ন ওকে টেনে নিয়ে যায় ঋণদাতা শোষক শ্রেণির চুক্তিজালে। সেই একই লোভ যখন সঞ্চারিত হয় মুনীষের ভেতর, তখন তাকে নিরত করার আর কোনো পথ থাকে না, গল্প লেখককে দেখাতে হয় একটা চরম পরিণতি, ঐ কৃষকের মৃত্যু, যা হত্যা না আত্মহত্যা, না জেনেই মুনীষ বুঝে নেয় যে এটা হত্যাকাণ্ড। অথচ সমাজের রক্ষক শ্রেণির কাছে তা অন্যভাবে দেখা দেয়। শ্রেণি দুটোর দৃষ্টিভঙ্গির এই পার্থক্য এত সুন্দর ও সূক্ষ্মভাবে দেখিয়ে দেয়ার অসাধারণ কুশলী শিল্পী জ্যোতিপ্রকাশ। ঘটনাটিকে দেখান তিনি অন্য এক দৃষ্টিকোন থেকে। যেমন একজন চলচ্চিত্র উপস্থাপক যখন খেলার কোনো দৃশ্য দেখান খেলাটি না দেখিয়ে দর্শকের প্রতিক্রিয়া দেখিয়ে, গোলের দৃশ্যে গোলটি না দেখিয়ে দেখান দর্শকের জয়োল্লাস, অথবা নিশ্চিত গোলটি না হওয়ায় দর্শকের নির্বাক হতাশার ছবি। রেহাননামার কেন্দ্রে রয়েছে যে মৃত্যু, তারও কোনো ব্যাখ্যা নেই, এমনকি এটা হত্যা না আত্মহত্যা, তারও কোনো ইঙ্গিত নেই, শুধু চরিত্রদের প্রতিক্রিয়া বর্ণনা করা হয়েছে। এটা সম্ভব একজন চিত্রনির্মাতার দৃষ্টিভঙ্গিতে। জ্যোতিপ্রকাশের গল্পের চিত্রকল্পগুলো ভীষণভাবে পরিদৃশ্যমান। যেমন নির্বাক যুগের চলচ্চিত্র, চোখের সামনে দিয়ে বয়ে যায়, ওখানে শব্দের প্রয়োজন হয় না, দৃশ্যগুলোই কথা বলে।

মৃত্যুর এই নির্মোহ উপস্থাপন সম্ভবত জ্যোতিপ্রকাশের পাশ্চাত্যে অবস্থানের প্রতিফলন। বাংলাদেশের সংবাদ মাধ্যমগুলোয় যেভাবে মৃতের ছবি, সংবাদ ও বিভৎসতা দেখানো হয়, পাশ্চাত্যে তা করা হয় না। মৃত্যুর নির্মমতার দিকে পাঠক অথবা দর্শকের চেতনা স্পর্শ করানোর চেষ্টা করা হয় না। পাশ্চাত্যের অনেক রহস্য গল্প অথবা থ্রিলারের শুরুতে একটা মৃতদেহ পাওয়া যায়, সূক্ষ্মভাবে ও শৈল্পিক পারঙ্গমতায় ঐ মৃত্যুর রহস্য উন্মোচন করা হয়। পাঠককে মানসিকভাবে অসুস্থ কিম্বা বিকৃতমনস্ক না করে ঐ হত্যাকাণ্ডের বিপক্ষে ধীরে ধীরে তাকে দাঁড় করানো হয়। 

মনস্তাত্বিকভাবে তাকে নিয়ে যাওয়া হয় ঐ সব ঘটনার বিশ্লেষণে যা দায়ী ঐ হত্যাকাণ্ডের জন্য। জ্যোতিপ্রকাশের গল্পেও আমরা পাই ঐ রেহান বা বন্ধকী ব্যবস্থার নির্মম ফলাফল। একটা জমির মালিক কোনো কিছু না করেই পেয়ে যায় ফসলের ভাগ, যার স্বপ্নও সে দেখে না কখনো। অথচ সবুজ এক স্বপ্ন নিয়ে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে এক কৃষক। যে স্বপ্ন শুধু প্রকৃতিই নয়, অন্যান্য আরো অনেককিছুর উপর নির্ভরশীল। এমন কোনো মৃত্যুদৃশ্য দেখা বা দেখানো উচিত না যা মানুষের অনুভূতিকে মৃত্যুর বিপক্ষে নিয়ে না যায়। মনে করা যেতে পারে অল কোয়ায়েট ইন দ্য ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট অথবা সানফ্লাওয়ারএর মতো চলচ্চিত্র ও উপন্যাসের বিষয়। মৃত্যু-দৃশ্য বর্ণনা করার বা দেখানোর মধ্যে রয়েছে এক ধরনের বিভৎসতা বা অসুস্থতার ভাবনা। কিন্তু ঐ মৃত্যুর বিপক্ষে জীবনের অবস্থানকে দাঁড় করানো হচ্ছে শিল্প, যা ঐ শিল্প-নির্মাতার একটা উদ্দেশ্য, এখানে জ্যোতিপ্রকাশ খুব সফল। ঐ মৃত্যু দ্বিতীয় ও আরো অনেক মৃত্যু ডেকে না আনার জন্য সতর্ক করে দেয় মুনীষটিকে, এবং ঐ সমাজটিকে। এ গল্পের জন্য মৃতের চেয়েও বেশি প্রয়োজনীয় ঐ মুনীষ চরিত্রটা। মৃতের স্ত্রী ছাড়া অন্যান্য চরিত্রগুলো সমাজের অবশ্যম্ভাবী ও এড়িয়ে যেতে না পারা আবর্জনা।
           
সমাজের ছবিটা ফুটিয়ে তোলার জন্য ব্যক্তিকে অবলম্বন করে মানবমনের জটিল অভ্যন্তরে প্রবেশ করেন জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত। পাশ্চাত্যের নাগরিক জীবনে বাস করে লিখেন ঐ সব মানুষদের নিয়ে যাদের নেই কোনো নাগরিক চেতনা। একটা রাষ্ট্রীয় কাঠামোর ভেতরে বাস করলেও এই সমাজ বা রাষ্ট্র তার নাগরিক অধিকার বা ন্যূনতম দাবীটুকুও মেটাতে অক্ষম। রাষ্ট্রের নাগরিকত্ব যেমন একজন মানুষের জন্মগত অধিকার তেমনি একজন কৃষকের জন্য জমিও তার জন্মগত অধিকার হওয়া উচিত। রাষ্ট্রকে নিশ্চিত করতে হবে একজন কৃষকের ন্যূনতম জমির চাহিদা। জমির পরিমান অপর্যাপ্ত হলে অবশ্যই রাষ্ট্রকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে কৃষকের পুনঃকৃষক উৎপাদনের প্রচেষ্টা। এক সময় রাজারা নিষ্কর ভূমি দান করতো সমাজের একটা পরগাছা শ্রেণির কাছে। অথচ উৎপাদক কৃষকের রক্ত মুখে তুলে পরিশোধ করতে হতো গুচ্ছের খাজনা। এরপর চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ভূমির মালিকানা হতে পুরোপুরি উৎখাত করেছে কৃষককে। তাদের অধিকার অস্বীকার করে অনুৎপাদক, পরাশ্রয়ী শোষক শ্রেণির কাছে রাষ্ট্র বা দেশের সব সম্পদ বিলিয়ে দেয়া হয়েছে। কৃষকেরা ঐ সব জমি চাষবাস করে কোনো রকমে জীবন ধারণ করে নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখে। আজকের তথাকথিত আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় তার কতটুকু পরিবর্তন হয়েছে! এখনো কৃষি জমির প্রায় সবটুকু জোতদার মহাজনের করায়ত্বে। কৃষকেরা এখনো অন্যের জমি চাষ করে, ও বিভোর থাকে একটা রেহান পাওয়ার স্বপ্নে, আবার ঐ রেহানের অর্থ সংগ্রহ করার জন্য একটা ঋণ পাওয়ার স্বপ্নে। এনজিও নামের শোষক গোষ্ঠি ব্যাংক ও অন্যান্য নাম নিয়ে কৃষকের রক্ত শোষণ করে নিজেদের গলায় ঝোলায় বিশ্ব-খেতাব, আর কৃষকেরা প্রতিনিয়ত জড়াতে থাকে সমাজের জটিল ও বিবিধ জালে!

আমাদের এ গল্প লেখা কার জন্য, এ কথাগুলো কার জন্য! ঐ মুনীষের কাছে কি এই গল্পের সন্ধান আছে? মধ্যবিত্ত কলমের এই সীমাব্ধতা কাটানোর কোনো পথ খুঁজে পাওয়া যায় না। প্রান্তিক জনগোষ্ঠি নিয়ে এক সময় প্রচুর লিখেছিলেন তারাশঙ্কর। ওসবও থেকে গেছে মধ্যবিত্তের পঠন-পাঠনেই, আরেকটু নিষ্ঠুরভাবে বললে মধ্যবিত্ত বা নিুবিত্তের মনোরঞ্জনে, গল্প পাঠের আনন্দ উপভোগে, বা উদযাপনে। এমনকি তাঁর পথের পাঁচালি উপন্যাস নিয়ে নির্মিত চলচ্চিত্র সারা বিশ্বে আলোড়ণ তুলেছে, কিন্তু মনে হয় না এতটুকুও ছুঁয়েছে ঐ শ্রেণিকে, যাদের নিয়ে রচিত এই মহাকাব্যিক উপাখ্যান! মধ্যবিত্তের এই ধারাবাহিকতার বাইরে এসে কেউ দাঁড়াতে পারছে না। মনিকা আলীর ব্রিক লেন বইটা পোশাক-শিল্প শ্রমিকদের একজনও পড়েছে কিনা সন্দেহ করা যায়। কারণ ওটার টার্গেট পাঠক ওরা না। ঐ শ্রমিক শ্রেণিটা যেমন কর্পোরেট ব্যবসার একটা উপাদান, তেমনি ওদের ভিত্তি করে লেখা ঐ বইটাও কর্পোরেট বাণিজ্যের চাহিদাই মেটায়। পোশাক-শিল্প শ্রমিকদের পাঠোপযোগী লেখা যে-পর্যন্ত না আমাদের কলম থেকে বেরিয়ে আসবে সে পর্যন্ত সব লেখালেখি, সংকীর্ণ অর্থে বললে, আমাদের পাঠ-তৃষ্ণা মেটানোর জন্যই রয়ে যাবে। 

একটা সময় ছিল যখন  বাংলার পুঁথি কিম্বা গল্প-গাঁথা গ্রামের সাধারণ মানুষজনের জন্য কবিতা বা গল্পের একটা রূপ বা বিকল্প হিসেবে ব্যবহৃত হতো, সমাজের প্রান্তবর্তী মানুষেরাও ঐ পুঁথিপাঠ অথবা গল্পকথা শুনে আনন্দ উপভোগ করতে পারতো। প্রাচীন রূপকথা ও গল্প-গাঁথার রস প্রতিটা শিশুকিশোরই সমানভাগে ভাগ করে নিতে পারতো। একুশ শতকে এসে পুঁথি আর রূপকথার বিষয় ভাবা যায় না, কিন্তু আপামর জনসাধারণের জন্য একটা কিছু তো ভাবতে হবে! আমাদের শিল্প সাহিত্যের চরিত্রটা প্রায় পুরোপুরি মধ্যবিত্তের। সমাজের ঐ প্রান্তের মানুষেরা আমাদের লেখার একটা বিষয়, লেখাটা তাদের উদ্দেশ্যে নয়। এটা অভিযোগ নয়, বাস্তবতা। এটা শুধু বাংলাদেশের সমস্যা না, বাংলা সাহিত্যেই কেবল এমন ঘটছে, তা না, পুরো পৃথিবী জুড়ে এখন একই চিত্র। বলা চলে, এর বাইরে কেউ নেই। 

আমাদের শুরুর দিকটা অবশ্য ছিল প্রান্তবর্তী মানুষদের নিয়ে। ওদের জন্য, এবং ওদের দিয়ে। চর্যাপদ, দোহাকোষ, এসবের রচয়িতা ও ভোক্তা, উভয়েই প্রান্তিক মানুষজন। সমাজটা হয়তো তখন এতটা উচ্ছন্নে যায়নি, বা কলুষিত হয়নি। সমাজে তখনও নির্মম শোষণ ছিল, উচ্চকোটির অত্যাচার ছিল, প্রকট বিভাজন ছিল, পাইক পেয়াদা সামন্ত বরকন্দাজ সবই ছিল, ভয়ঙ্কর অসামঞ্জস্য ছিল, প্রবলভাবেই ছিল। কিন্তু প্রান্তিক মানুষজনের নিজেদের ভেতর অন্তত একটা বোঝাপড়া ছিল। ভাইয়ে ভাইয়ে কৃপাণ ও তলোয়ার নিয়ে মুখোমুখি দাঁড়ায়নি তখনো, অথবা তাদেরকে দাঁড় করানো হয়নি। এসব সংস্কার ও ঐতিহ্য বহিরাগত। এসব হয়তো এখানে প্রাসঙ্গিক নয়। রেহাননামা গল্পটা যে শ্রেণিকে প্রতিনিধিত্ব করে, যে শ্রেণির মানুষদের নিয়ে, ঐ শ্রেণিটা এসে যাওয়ায় বিষয়টার অবতারণা। প্রান্তিক এই সমাজটা বারবার ভেঙ্গে গেছে, সৃষ্টির পর একবারও গড়ে উঠেনি আর, অন্তত এরকমই মনে হয়। ভাঙনের পর ভাঙন, আবার ভাঙন। আর এই ভাঙনের উৎসবে সবশেষ সংযোজন এই সব গ্রামীন এনজিও ও ব্যাংকগুলো। রেহাননামা গল্পে প্রচ্ছন্নভাবে, ও এক নিপুণ শিল্পকুশলতায় এদেরকেই উপস্থাপন করেছেন আমাদের ছোট গল্পের যাদুশিল্পী জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত।

যে-সব চরিত্র ও ঘটনা গল্প-লেখকের মাথায় থাকে সেগুলো পাঠকের কাছে পৌঁছে দেয়ার জন্য শব্দ দিয়ে লেখক নির্মাণ করে এক ধরণের যান বা বাহন, যা পাঠকের কাছে নিয়ে যায় তার মস্তিষ্ক-প্রসূত চিন্তাধারা। ঐ বাহনের নির্মাণ-কৌশল, এর রূপ, অঙ্গ-সজ্জা প্রভৃতি আকর্ষণ করে পাঠককে, যদি তা আকর্ষণীয় হয়। লেখকের আনকোরা অভিজ্ঞতা যখন পাঠকের কাছে পৌঁছে, সেও বিশ্বাস করতে চায় ঐ সব চরিত্র ও ঘটনাগুলোকে। এখানে দুটো বিষয় কাজ করে, বাহনের সৌন্দর্য চরিত্র ও ঘটনার অবস্থান। দুটোর এক সঙ্গে জ্বলে উঠার মধ্যে লেখকের সফলতা নির্ভর করে। ভাঙাচোরা, অনাকর্ষণীয় কোনো বাহনে একজন পাঠক ভালো কোনো অবস্থানেও যেতে চাইবে না, আবার চমৎকার একটা বাহনে চড়ে অসুন্দর কোনো জায়গায়ও যেতে চাইবে না। অনেক বেশি সচেতন থাকার সুযোগ রয়েছে আজকের পাঠকের। পরিচিত প্লট, কাকতাল, কার্টুন জাতীয় চরিত্র, উদ্ধৃতিমূলক অথবা একঘেয়ে বর্ণনা, এসব দেখলেই ঐ লেখা এড়িয়ে যাওয়ার  ইচ্ছা দেখা দিতে পারে। এত বেশি বিকল্প এখন, পণ্যের মতো লেখা উৎপাদন, বিপণনের প্রলোভন, বিজ্ঞাপনের কৌশল, সিন্ডিকেটের ঘেরাটোপ, এসবের ভেতর থেকে প্রকৃত লেখককে ভাবতে হয় একেবারে নতুন কিছু, অন্য রকম কিছু, অননুকরণযোগ্য কিছু! অবাক হতে হয়, পাঁচ দশক আগেই সব ধরনের প্রলোভন এড়িয়ে জ্যোতিপ্রকাশ নির্মাণ করা শুরু করেছিলেন এমন এক আশ্চর্য বাহন, যা আজো পাঠককে নিয়ে যায় অনেক দূরে, চমৎকার সব গন্তব্যে!




লেখক পরিচিতি
কামাল রাহমান

আট দশকের গোড়া থেকেই সাহিত্যচর্চা করছেন। তার ক্ষেত্র মূলত কথাশিল্প। কবিতা অনুবাদও করছেন। ছোটকাগজ সম্পাদনার সাথেও সম্পৃক্ত ছিলেন। তিনি বাস্তবকে একেবারে কাছে গিয়ে ছুঁয়ে দেখতে চান। তার লেখায় রাজ্যনীতিরাজনীতিসমকালীন বাস্তবতা উঠে আসে। তার দুটি গল্পগ্রন্থ আর তিনটি উপন্যাস প্রকাশিত হয়েছে।
উপন্যাস :
১. তাজতন্দুরি,   বইমেলা ২০১১,   মাওলা ব্রাদার্সঢাকা;
২. ঝুমপাহাড়,    বইমেলা ২০১২,   রোদেলা প্রকাশনীঢাকা
৩. অন্য আলো,  বইমেলা ২০১৩,   প্রকৃতি প্রকাশনীঢাকা
গল্পগ্রন্থ :  
১. শীতের আপেল ও কমলা,  বইমেলা ২০১২,  ধ্রবপদ প্রকাশনীঢাকা
২. স্টোনহেঞ্জ,  বইমেলা ২০১৩,  ধ্রবপদ প্রকাশনীঢাকা
সম্পাদক : ১৪০০

সম্পাদক (২টি সংখ্যার) : কালধারা

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ