সোমনাথ রায়
জ্যোতিপ্রকাশ দত্তের গল্প পড়তে শুরু করি, পরমাত্মীয় গল্পটা দিয়ে। নন-ন্যারেটিভ গল্পের ধাঁচ। আর উল্লেখযোগ্যভাবে ছোটছোট সামান্য ঘটনা(incident)এর পরত দিয়ে দিয়ে কথার মতন গল্প এগোচ্ছে, যে কথা কিছু ক্ষেত্রে নিজের সঙ্গে বলা, কিছু ক্ষেত্রে শ্রীমন্তকে বলতে চেয়েও নিজের সঙ্গেই বলে চলেছে সাঈদ। ঘটনাগুলোকে এই কারণেই সামান্য বলা, যে ঘটে যাওয়ার নাটকীয়তা পাঠক এতে পাবেন না।
কিন্তু, গল্পের মধ্যে এগুলো নিরন্তর হচ্ছে, যেমনঃ – ‘এখানে বসার পরে, দৈহিক মুখরতার কালে, তুমি অকৃত্রিম আগ্রহে আমায় জিজ্ঞেস করেছিলে দু’মাসে নতুন কী লিখলে?’ কিম্বা, আরো স্পষ্টতঃ ‘এতক্ষণে খবরের কাগজের সাদা অংশে ফুল এবং পাখিরা অঙ্কিত হয়ে গেছিল।‘
জ্যোতিপ্রকাশ দত্তের গল্প পড়তে শুরু করি, পরমাত্মীয় গল্পটা দিয়ে। নন-ন্যারেটিভ গল্পের ধাঁচ। আর উল্লেখযোগ্যভাবে ছোটছোট সামান্য ঘটনা(incident)এর পরত দিয়ে দিয়ে কথার মতন গল্প এগোচ্ছে, যে কথা কিছু ক্ষেত্রে নিজের সঙ্গে বলা, কিছু ক্ষেত্রে শ্রীমন্তকে বলতে চেয়েও নিজের সঙ্গেই বলে চলেছে সাঈদ। ঘটনাগুলোকে এই কারণেই সামান্য বলা, যে ঘটে যাওয়ার নাটকীয়তা পাঠক এতে পাবেন না।
কিন্তু, গল্পের মধ্যে এগুলো নিরন্তর হচ্ছে, যেমনঃ – ‘এখানে বসার পরে, দৈহিক মুখরতার কালে, তুমি অকৃত্রিম আগ্রহে আমায় জিজ্ঞেস করেছিলে দু’মাসে নতুন কী লিখলে?’ কিম্বা, আরো স্পষ্টতঃ ‘এতক্ষণে খবরের কাগজের সাদা অংশে ফুল এবং পাখিরা অঙ্কিত হয়ে গেছিল।‘
অথচ এইসব সামান্য ঘটনাকে বাদ দিয়ে জ্যোতিপ্রকাশের কোনও গল্পই এগোয় না। ‘তার ফেরা’-তে ‘সন্ত্রাসে দ্রুতধাবমান’ সুহাস ফিরতে ফিরতে দ্যাখে সকালের স্বাভাবিক দৃশ্য- স্টেশন চত্ত্বর, ভিখিরি, সিনেমার শিশির ভেজা পোস্টার এইসব, যার মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রবল মুর্দাফরাসের কুকুরের লাশ টেনে নিয়ে যাওয়া। কিম্বা, ‘নাগর বসন্ত’-এ বসন্ত-কবিতা অনুষঙ্গে খুব ডিটেলে, মনোযোগ দাবি করে বর্ণনা করা হয় বাজারের সওদা থেকে একটা শিং মাছের পালিয়ে যাওয়া। খুব সামান্য, সাধারণতার মধ্যে মানুষকে ফিরিয়ে আনে অতিবাস্তবের অভিকর্ষ থেকে। সম্ভবতঃ দীর্ঘপ্রবাস-বাসের ছায়া জ্যোতিপ্রকাশের লেখনীকে মায়াভূত করে রাখে। যে মায়া ছড়িয়ে থাকে ফেলে যাওয়া বাস্তবের নিত্যতায়, সংস্কৃতি ও পরিবেশের প্রবল ভিন্নতার মধ্যে দাঁড়িয়ে যে মায়া পাড়ার মোড়, বাজারের গলি আর স্টেশনের ব্যস্ততার ডাক দিয়ে যায় নির্জন আমেরিকায়। পৃথিবীর অন্য পৃষ্ঠে যার মধ্যে নাটকীয় কিছুই নেই, সূর্যাস্তের অপরপীঠে তা-ই স্বপ্নের মত ফিরে ফিরে আসে। এই ফিরে আসা জ্যোতিপ্রকাশের গল্পের প্রায় প্রতি পাতায় দেখতে পাচ্ছিলাম আমি। অ্যালিয়েনেশনের গৌরব ও ভীতি একই সঙ্গে মৃত্যু ও জীবনের দ্যোতনায় এবং দোটানাতে প্রকাশ পাচ্ছে। অ্যালিয়েনেশনের একটা মহৎ গুণ হলো, কিছুটা বাইরে থেকে দেখতে শেখায়। ডকুমেন্টারির মতন পথ চলে ‘কেষ্ট যাত্রা’র মতন গল্পগুলির।
জ্যোতিপ্রকাশের ভাষা তাই সংলাপধর্মী নয়, বর্ণনাত্মক। কারণ, জ্যোতিপ্রকাশ তাঁর লেখার মধ্যে দিয়ে কোনো চিত্তাকর্ষক স্টোরি বলছেন না, কিন্তু বর্ণনা দিয়ে যাচ্ছেন ঘটে যাওয়াগুলির। বর্ণনা একজন অবজার্ভারের জায়গা থেকে, যে কাউকে উচ্ছ্বসিত হয়ে গল্প করে বলেনা, নিরাসক্তভাবে লিপিবদ্ধ করে রেখে দ্যায় ঘটনাক্রম। যখন সাহিত্য হিসেবে পড়তে যাই, এই ভাষা অচেনা লাগে আমার। ‘তাদের নেতা অবশেষে পর্বত, সমুদ্র এবং বায়ুকে পরাজিত করবেন। উইঢিপি, গোষ্পদে নীর এবং তালবৃন্ত সঞ্চালিত হওয়া কি পরিমাণেই না তুচ্ছ প্রতীয়মান হয় এমনক্ষেত্রে’ (একজন পুরুষ চাই)। লক্ষ্যণীয় কমা আর ‘এবং’ এর ব্যবহার। অ্যাকাডেমিক প্রবন্ধের ‘respectively’র মতন করে বসানো প্রথম বাক্যের বিশেষ্য ও পরের বাক্যের ক্রিয়াপদগুলি। ভিন্নধর্মী গদ্যভাষার অভিজ্ঞতা আমরা যাঁদের কাছে পেয়েছি তাঁদের মধ্যে কমলকুমার সর্বাগ্রগণ্য, কিন্তু কমলকুমারের বর্ণনা ও যুক্তিজালের থেকে জ্যোতিপ্রকাশের ধরণটা আমাদের বেশি চেনা। কিন্তু, অন্য অনুষঙ্গে, অ্যাকাডেমিক প্রবন্ধে ও মূলতঃ ইংরেজি ভাষায় এই গদ্য পড়ার অভ্যেস আমরা করেছি। আজকে যখন বাংলায় এক অর্থে ভাষার সংকট এসেছে, ভবিষ্যত প্রজন্ম মান্য বাংলায় আদৌ কথা বলবে কিনা সেই নিয়ে প্রতিদিন সন্দিহানতর হয়ে উঠছি। আর লেখালিখির জগতে আন্দোলন চলছে একদম মুখের ভাষায়, যাকে ‘গ্রাম্যতা দোষ’ বলে ডিকশনারিতে দাগিয়ে দেওয়া হত, সেই বাংলায় গদ্য ও পদ্য লেখার, সেখানে জ্যোতিপ্রকাশের লেখা ঠিক উলটোরকম লাগে। মুখের ভাষাকে বানিয়ে নেওয়া হচ্ছে প্রবন্ধের ভাষার আদলে ‘ইফতিকারটা, সত্যি বলছি, জাহেদ নেহাত স্থূল। পা টিপে চলতে তো আর সবাই জানেনা। আস্তে বলল জাহেদ, যাকগে, যেতে দাও।’ (সাজানো ফুলের বাগান)মনে হচ্ছে একদম ইংরেজি বাক্যাংশের বাংলা করে বসানো এমনকী ‘যেতে দাও’-টাও ‘let it go’ হয়ে কানে বাজে। কিম্বা ‘সরল সংসার’ গল্প থেকে জার্নাল পেপারের মতন যুক্তিনির্মিত ন্যারেশন- ‘খুশি হলে তিনি উর্দু বাত বলেন, তাই মনে মনে বললেন, কে ফাঁকি দেবে, এই তো হাম হ্যায়’। রংরাজ ফেরেনা, জলজ কুসুম, রেহাননামা- গল্পগুলিতে কিন্তু এই ভাষিক ইংরেজিত্ব নেই। বরং কিছুক্ষেত্রে কবিতার মতন চলমান ভাষা, বর্ণনাতেও চরিত্রর সঙ্গে লেখকের দূরত্ব কম। ‘তাহলে কি আরও কিছু ছিল অন্যের অগোচরে? একাকী কূলহীন পাথারে রাত্রিবাস। দিনশেষের আলো মুছে গেলে রাত্রিবাস তো একাকীই। স্বপ্নও দেখা যায় না তখন।’ যুক্তির নির্মাণ এখানেও আছে কিন্তু জার্নালধর্মিতা নেই। আর, লক্ষ্য করলে দ্যাখা যায় যে এই গল্পগুলি গ্রামজীবনের। অর্থাৎ আর্বান অ্যালিয়েনেশনের গল্প জ্যোতিপ্রকাশ লিখেছেন ইংরেজির বাংলা করে। কারণ সেই ভাষাতেই আর্বানপুরুষের আত্মকথন, তার অভিব্যক্তির আগে আসছে যুক্তিগত সঠিকতা। কিন্তু, গ্রাম-গল্পের ভাষা স্বাভাবিক। সেখানে রাত্রিবাসে একাকিত্ব আসে। একা থাকবো বলে রাত্রিকে ডেকে আনা হয় না (তার ফেরা)।
এইভাবে হয়তো ফর্ম দিয়ে কন্টেন্টের নির্মাণ খুঁজতে খুঁজতে আমরা জ্যোতিপ্রকাশের লেখার একটি স্বত্ত্বাকে ছুঁতে পারি যেখানে আর্বানিটি ও গ্রাম্যতার সংজ্ঞাগুলি পুনরুদ্ধার করা হচ্ছে। এই পুনরুদ্ধার-ক্রিয়ায় একটা বড় ভূমিকা নিচ্ছে তাঁর র্যাশনাল কথন। রেহান নামায় মৃতদেহ দেখেই খুন বলে চিৎকারের পরে যে র্যাশনালিটি থেকে মনে হয় ‘খুনের চিন্তা তার মাথায় কেন এলো কে জানে। মৃতের শরীরে কি শরীরের পাশে কোনো রক্তচিহ্ন ছিলোনা’। কিন্তু, চিন্তাটির আগে গ্রাম্য ভূমিহীন কৃষক ‘এই দ্যাহো খুন, খুন করছে’ বলে সবাইকে জানিয়ে দ্যান। আর, গোলাপনামায় দেখা যায় অবজার্ভেশন ও চিন্তার প্রিল্যুডের পর বাকি কথা তৈরি করার শহুরে পদ্ধতিঃ ‘তাদের প্রত্যেকের চোখে অবিশ্বাসীর দৃষ্টি। ঘৃণাও বুঝি আছে। কিন্তু আমি সে সব লক্ষ করিনা, যেহেতু জানা আছে, ওরা কত সংবেদনশীল, অতএব আমি বুঝিয়ে বলতে থাকি। অসন্তোষ নীরব হয়, ক্রোধ বিদূরিত।’ শুধু লক্ষণ দেখিয়ে থেমে যাচ্ছেননা জ্যোতিপ্রকাশ, এরপর-এ ‘কেবল যোজনব্যাপী হতাশায় তারা আচ্ছন্ন হয়। কী উপায়’। নাগরিকতার কৌশলের মতই সংজ্ঞায়িত হয় তার সীমাবদ্ধতা। কিন্তু গ্রাম্য ‘জলজ কুসুমে’ সীমাবদ্ধতা কমঃ ‘জলে প্রাণ আছে। শান্ত বাতাসে কাঁপতে থাকা ঢেউয়ের ডগায় নয়; কিংবা ঝড়ো হাওয়ায় তীরে আছড়ে পড়া তরঙ্গশীর্ষেও নয়। আছে হয়তো তারই নিচে বা আরও গভীরে।... ভয়ও আছে’। লক্ষ্যণীয় দুটি সম্পূর্ণ ভিন্ন আঙ্গিকের গল্পেই সমান র্যাশনাল বর্ণনা জ্যোতিপ্রকাশের, যা প্রায় বিজ্ঞানের মতন শর্ত মেনে বিশ্লেষণ ও প্রেডিকশনের পথে এগোয়।
এইভাবে হয়তো ফর্ম দিয়ে কন্টেন্টের নির্মাণ খুঁজতে খুঁজতে আমরা জ্যোতিপ্রকাশের লেখার একটি স্বত্ত্বাকে ছুঁতে পারি যেখানে আর্বানিটি ও গ্রাম্যতার সংজ্ঞাগুলি পুনরুদ্ধার করা হচ্ছে। এই পুনরুদ্ধার-ক্রিয়ায় একটা বড় ভূমিকা নিচ্ছে তাঁর র্যাশনাল কথন। রেহান নামায় মৃতদেহ দেখেই খুন বলে চিৎকারের পরে যে র্যাশনালিটি থেকে মনে হয় ‘খুনের চিন্তা তার মাথায় কেন এলো কে জানে। মৃতের শরীরে কি শরীরের পাশে কোনো রক্তচিহ্ন ছিলোনা’। কিন্তু, চিন্তাটির আগে গ্রাম্য ভূমিহীন কৃষক ‘এই দ্যাহো খুন, খুন করছে’ বলে সবাইকে জানিয়ে দ্যান। আর, গোলাপনামায় দেখা যায় অবজার্ভেশন ও চিন্তার প্রিল্যুডের পর বাকি কথা তৈরি করার শহুরে পদ্ধতিঃ ‘তাদের প্রত্যেকের চোখে অবিশ্বাসীর দৃষ্টি। ঘৃণাও বুঝি আছে। কিন্তু আমি সে সব লক্ষ করিনা, যেহেতু জানা আছে, ওরা কত সংবেদনশীল, অতএব আমি বুঝিয়ে বলতে থাকি। অসন্তোষ নীরব হয়, ক্রোধ বিদূরিত।’ শুধু লক্ষণ দেখিয়ে থেমে যাচ্ছেননা জ্যোতিপ্রকাশ, এরপর-এ ‘কেবল যোজনব্যাপী হতাশায় তারা আচ্ছন্ন হয়। কী উপায়’। নাগরিকতার কৌশলের মতই সংজ্ঞায়িত হয় তার সীমাবদ্ধতা। কিন্তু গ্রাম্য ‘জলজ কুসুমে’ সীমাবদ্ধতা কমঃ ‘জলে প্রাণ আছে। শান্ত বাতাসে কাঁপতে থাকা ঢেউয়ের ডগায় নয়; কিংবা ঝড়ো হাওয়ায় তীরে আছড়ে পড়া তরঙ্গশীর্ষেও নয়। আছে হয়তো তারই নিচে বা আরও গভীরে।... ভয়ও আছে’। লক্ষ্যণীয় দুটি সম্পূর্ণ ভিন্ন আঙ্গিকের গল্পেই সমান র্যাশনাল বর্ণনা জ্যোতিপ্রকাশের, যা প্রায় বিজ্ঞানের মতন শর্ত মেনে বিশ্লেষণ ও প্রেডিকশনের পথে এগোয়।
জ্যোতিপ্রকাশের এই উচ্চারণ খুব অন্যরকম। বাংলা ছোটগল্পের ক্ষেত্রে যেখানে অনিশ্চয়তাই কাহিনির সম্পদ, সেইখানে ঘটে চলা নিসছিতের বিশ্লেষণে অনিশ্চিতকে প্রেডিক্ট করার অঙ্ক আঙ্গিক হিসেবে বেশ অভিনব। আবার স্বাভাবিকও, কারণ জ্যোতিপ্রকাশের গল্পের শিরোনামেই পাচ্ছি ‘স্বপ্নে সত্যি আছে’।

লেখক পরিচিতি
ড: সোমনাথ রায়
কবি। গল্পকার। প্রবন্ধকার।
এসিস্ট্যান্ট প্রফেসর আইআইটি, পাটনা।

লেখক পরিচিতি
ড: সোমনাথ রায়
কবি। গল্পকার। প্রবন্ধকার।
এসিস্ট্যান্ট প্রফেসর আইআইটি, পাটনা।
1 মন্তব্যসমূহ
সমৃদ্ধ গবেষণাধর্মী একটি লেখা।ভাল লাগলো পড়ে।
উত্তরমুছুন