বাংলা সাহিত্যের জমজমাট গল্প বলার জনপ্রিয়
ধারা থেকে বের হয়ে অন্য একটি ধারা তৈরি হয়েছে। অপেক্ষাকৃত কম জনপ্রিয় এই ধারাকে
বলা হচ্ছে ‘গল্পহীন গল্প’। এ জন্যে পশ্চিমে সাইকোলজি থেকে ‘চেতনাপ্রবাহ’ বা stream of consciousness শব্দবন্ধটি আহৃত হয়েছে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ
থেকে শুরু হয়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে মানুষের জীবনটা আর সেই সহজ সরল জীবন থাকলো
না। ব্যক্তি ভেঙ্গে খণ্ড খণ্ড হল।
তাকে আলাদা করে বাইরে থেকে আর সম্পূর্ণভাবে ধরা সম্ভব হল না। মানুষ কেমন করে যেন তার বাইরের জগতটাকে ভেতরে ঢেকে ফেললো। ফলে সাহিত্যের একটা নতুন ধারা তৈরি হল। প্রুস্ত, ডরোথি, জয়েস, উলফ্ ও ফকনারের হাত ধরে গল্পবলার এই নতুন ধারা ছড়িয়ে পড়লো সমগ্র বিশ্বসাহিত্যে। বাংলাদেশের সাহিত্যে এই ধারার অন্যতম প্রধান লেখক হলেন গল্পকার জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত।
তাকে আলাদা করে বাইরে থেকে আর সম্পূর্ণভাবে ধরা সম্ভব হল না। মানুষ কেমন করে যেন তার বাইরের জগতটাকে ভেতরে ঢেকে ফেললো। ফলে সাহিত্যের একটা নতুন ধারা তৈরি হল। প্রুস্ত, ডরোথি, জয়েস, উলফ্ ও ফকনারের হাত ধরে গল্পবলার এই নতুন ধারা ছড়িয়ে পড়লো সমগ্র বিশ্বসাহিত্যে। বাংলাদেশের সাহিত্যে এই ধারার অন্যতম প্রধান লেখক হলেন গল্পকার জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত।
জ্যোতিপ্রকাশ গল্প লেখায় পরিবেশ তৈরিতে
যতখানি গুরুত্ব দেন, গল্প বলাতে ততখানি
গুরুত্ব দেন না। চেতনা-প্রবাহমূলক সাহিত্যে সেটার দরকারও পড়ে না। পাঠককে একবার
পরিস্থিতির সাথে মানিয়ে নিতে পারলেই গল্পটা কখন যেন বলা হয়ে যায়। সেই মূডটা তৈরি
করাটাই এখানে আসল। বাংলা সাহিত্যে এ ধরণের গল্পের পাঠকপ্রিয়তা বরাবরই কম। সলিড
গল্পের মজা নিতে চাইলে জ্যোতিপ্রকাশ একেবারেই বেমানান লেখক। বেশিরভাগ
পাঠক-সমালোচকদের ধারণা, ছোটগল্প হতে হলে
প্রথমে গল্প হওয়া চাই তারপর অন্যকিছু। জ্যোতিপ্রকাশের অনেকগুলো গল্পে ঠিক তার
উল্টোটা ঘটে, প্রথমে অন্যকিছু
তারপর গল্প। এজন্যে তাঁর অনেক গল্পই প্রচলিত মাপকাঠিতে টেকে না।
সাহিত্যে বিষয়বস্তুর পাশাপাশি কাঠামোর
আলাদা একটা গুরুত্ব আছে। এক্ষেত্রে স্টপফোর্ড ব্রুক-এর বক্তব্যটা ধার নেওয়া চলে: ‘writing is not literature unless it
gives to the reader a pleasure which arises not only from the things said, but
from the way in which they are said’.
জ্যোতিপ্রকাশ এই কাঠামো নিয়ে খেলতে পছন্দ
করেন। তাঁর কমিটমেন্ট যতটা না জীবনের প্রতি তার চেয়ে ঢের বেশি শিল্পের প্রতি। এদিক
দিয়ে তিনি রিয়েলিস্ট নন, স্পিরিচুয়ালিস্ট।
কিংবা আধুনিক রোমান্টিক হিসেবেও তাঁকে ধরা যায়।
তাঁর সাহিত্যে অবহেলিত, জৈবিক ও যৌন ক্ষুধায় কাতর মধ্যবিত্ত
বাঙালি উঠে আসে ঠিকই, তবে একজন সচেতন
শিল্পীর শিল্পভাষার ভেতর দিয়ে। এ জন্যে তাঁর গল্প পড়তে পড়তে কখনো কখনো মনে হয় তিনি
সাধারণ থেকে বিচ্ছিন্ন। শুধুমাত্র সাহিত্যের সমজদার বা এলিট পাঠকদের প্রবেশাধিকার
সেখানে সীমাবদ্ধ।
সাহিত্যের আসল গন্তব্যটা কোথায় সেটা একজন
লেখককেই ঠিক করে নিতে হয়। কিছুকাল আগে সাহিত্যিকরা জাতির বিবেক বলে বিবেচিত হতেন।
য়ুরোপে ডিকেন্স, দস্তয়ভস্কি এবং
তলস্তয় লিখেছিলেন উঠতি মধ্যবিত্ত শ্রেণিদের জন্যে। উনিশ শতকে গুরুত্বপূর্ণ লেখকদের
উপন্যাসগুলো জাতীয় দৈনিকগুলোর শিল্প ও সাহিত্য পাতায় প্রথম প্রকাশিত হতো কারণ মনে
করা হতো তাঁরা সমগ্র জাতির উদ্দেশ্যে কিছু বলছেন। কিন্তু বহুমুখী মিডিয়ার
বিস্তারের সাথে সাথে লেখকদের দায়বদ্ধতা গেল কমে। এখন মানুষ মূল খবরটাই জানতে চায়।
ঘরে বসে সমগ্র বিশ্ব দেখা যায়। তাই সাহিত্যিকরা আর সামাজিক মুখপাত্র থাকলেন না।
সাহিত্যের কাজ গেল বদলে। সাহিত্যের এই কাজ বদলের মুহূর্তে সাময়িকভাবে সাহিত্যের
মৃত্যু ঘোষণা করলেন কেউ কেউ। বিখ্যাত দার্শনিক-লেখক হোসে ওর্তেগা, জার্মান ভাবুক ভাল্টার বেনিয়ামিন, কথাসাহিত্যিক রোলাঁ বার্থ, গোর বিধাল, জন বার্থ এই সব গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা উপন্যাসের সম্ভাব্য মৃত্যু নিয়ে
ভাবনায় পড়ে গেলেন। কিন্তু সাহিত্য নতুন মোড় নিয়ে ঘুরে দাঁড়াল। সাহিত্য আবির্ভাব হল
সত্যকে চিনবার চেতনা হিসেবে। ফুয়েন্তেস যাকে বলছেন, ‘সর্বজনীন মানবিক বৈশিষ্ট্য’কে দাড় করানো। সাহিত্য হল সমাজ থেকে ব্যক্তিমুখী। কাফকা, মুসিল, মান, জয়েস সকলেই লিখলেন
ইন্ডিভিজুয়াল বা পার্টিকুলার নিয়ে।
য়ুরোপের বাস্তবতার সাথে আমাদের বাস্তবতার
বিস্তর ফারাক। এখানে একদিকে যেমন গ্রাম ভেঙ্গে নগর হচ্ছে, উল্টোদিকে বাড়ছে পল্লীর সংখ্যা। কাজেই
লেখকদের হাতে অপশন আছে: একদিকে পার্টিকুলার অন্যদিকে জেনারেল। বা একদিকে ব্যষ্টি
অন্যদিকে সমষ্টি। প্রসঙ্গক্রমে চলে আসছে হাসান আজিজুল হকের কথা। ষাটের দশকে একই
সঙ্গে শুরু করলেন জ্যোতিপ্রকাশ ও হাসান। একজন বেছে নিলেন ব্যক্তি তো অন্যজন সমগ্র।
একজন অনুসরণ করলেন কাফকা তো অন্যজন তলস্তয়। তবে জ্যোতিপ্রকাশ কাফকার মতো একটিভ নয়
প্যাসিভ, ভীষণ প্যাসিভ। এবং
জয়েসের মতো আত্মমগ্ন। তাঁর বেশিরভাগ গল্পই ‘অন্তর্ভাষণ’
(interior monologue) এবং ‘স্বগতোক্তি’ (soliloquy)-এর ভেতর দিয়ে শুরু
হয়। খুব দরকার না পড়লে তিনি চরিত্রের দ্বারস্থ হন না।
খ.
আচেবে বলেছেন- ‘প্রত্যেকে গল্প বোনে তার নিজের জন্যে-
নিজের বেঁচে থাকাকে উপভোগ্য করে তুলতে। গল্পগুলো সত্য হোক মিথ্যা হোক, ভাল হোক মন্দ হোক- তার চোখ দিয়ে জগতকে
চেনবার অসম্ভব এক শক্তি নিয়ে হাজির হয়।’ [‘দি ট্রুথ অব ফিকশন’ অনুবাদক:
বর্তমান আলোচক] আচেবের কথাটা সম্পূর্ণভাবেই খেটে যায় জ্যোতিপ্রকাশের বেলায়।
জ্যোতিপ্রকাশ তাঁর বেশিরভাগ গল্পে নিজের বেঁচে থাকাকে উঠিয়ে আনেন। আলাদা করে কোনো
সামাজিক দায়বদ্ধতার তোয়াক্কা তিনি করেন না। তাঁর দায়বদ্ধতা শুধু আত্ম বা ব্যক্তির
কাছে। এজন্যে তাঁর বেশিরভাগ গল্পই ব্যক্তিঘেষা। ব্যক্তি এখানে বিষণ্ন, আত্মপরিচয়ের খোঁজে ক্লান্ত। যেমন, ‘লৌহবেষ্টনী’র নামহীন প্রটাগনিস্টের পরিচয় অনেকের মাঝে লীন। আত্মপরিচয় বা অস্তিত্বের
সন্ধানে সে ‘হাঁটতে হাঁটতে
রেললাইনের কাছাকাছি চলে আসে। তারপর লাইনে উঠে স্লিপারে পা রেখে এগুতে থাকে। কিন্তু
কোথায় যাবে সে? সবজায়গা পরিচিত, সবমুখ চেনা, সব তথ্য জানা। তার জন্য আর কিছুই অবশিষ্ট নেই।’[‘লৌহবেষ্টনী’, পৃ. ২৩৮, শ্রেষ্ঠ গল্প, নালন্দা] এমনি করে চরিত্রগুলো Meursault (আউটসাইডার, আলবেয়ার কামু)-এর মতো পালাবার পথগুলোও চিনে ফেলে, জেনে যায় সবখানে সদা বর্তমান শূন্যতার কথা, হতাশা থেকে জন্ম নেই আত্মহননের আকাঙ্ক্ষা।
জ্যোতিপ্রকাশ এভাবেই উপভোগ করেন নিজের বেঁচে থাকাকে। তিনি জ্যাকের (এজ ইউ লাইক ইট, শেক্সপিয়র) মতো মেলানকলি লাভার। কিটসের
মতো স্কেপিস্ট। আবার এলিয়টের মতো রিয়েলিস্টও। তাঁর গল্পের দ্বৈত সত্ত্বাটা ‘গুড এন্ড ব্যাড’র না, ‘স্কেপিজম এন্ড রিয়েলিজম’র।
গ.
কেউ কেউ আছেন গল্পটা জেনে তারপর লিখতে
বসেন। যেমন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তিনি গল্পটা আগে থেকেই জানতেন। সেই কথায় জানিয়ে
রবীন্দ্রনাথ তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়কে লিখেছিলেন, “পোস্টমাস্টারটি আমার বজরায় এসে বসে থাকত। ফটিককে দেখেছি পদ্মার ঘাটে।
ছিদামদের দেখেছি আমাদের কাছারিতে। ওই যারা কাছে এসেছে তাদের কতকটা দেখেছি, কতকটা বানিয়ে নিয়েছি।” অন্যত্রে লিখেছিলেন, ‘আমার গল্পে বাস্তবের অভাব কখন ঘটে নি। যা
কিছু লিখেছি, নিজে দেখেছি, মর্মে অনুভব করেছি, সে আমার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা।’ ফকনার একই কথা একটু ঘুরিয়ে বলছেন- ‘গল্পটা (‘দ্য রোজ ফর এমিলি’)
কল্পনা থেকে
এসেছে। কিন্তু ঐ বাস্তবতা চারপাশে বিদ্যমান। গল্পটা নতুন কোনো বাস্তবতাকে আবিষ্কার
করেনি। তরুণীরা কাউকে ভালোবাসার স্বপ্ন দেখে, সংসার চায়, সন্তান চায়, এটা আমার আবিষ্কার না। কিন্তু ঐ মেয়েটির
(এমিলি) যে নির্দিষ্ট ট্র্যাজিক পরিণতি সেটা আমার তৈরি।’ (অনুবাদ: বর্তমান আলোচক)
আবার কেউ কেউ আছেন যারা গল্পটা জানেন না।
যেমন মুরাকামি। তিনি বলছেন--
‘আমি অতো
ভেবেচিন্তে লিখি না। আমি গল্পটার জন্যে অপেক্ষা করি। আমি জানতে চাই তাই লিখি।’ (তর্জমা: ঐ, প্যারিস রিভিউ) ফুয়েন্তেস বলছেন, ‘আমি কেবল কাঠামোর কঙ্কালটার কথা ভাবতে পারি। কীভাবে এগুবো জানি না।’ [প্যারিস রিভিউ, অনুবাদ: আন্দালিব রাশদী]
জ্যোতিপ্রকাশ দ্বিতীয় দলে। তিনি গল্পটা
আবিষ্কার করেন না, নির্মাণ করেন।
বাস্তবতা সেখানেও থাকে তবে রবীন্দ্রনাথের মতো করে নয়। তিনি তাঁর অভিজ্ঞতাগুলোকে
নতুন করে কতগুলো বায়বীয় চরিত্রের মাঝে ঢেলে সাজান, দেখতে চান নতুন কোনো সম্ভাবনা তৈরি হয় কিনা। তাঁর ছোটগল্পের অন্যতম
প্রধান লক্ষই হল সম্ভাবনা তৈরি। এজন্যে আমরা তাঁর গল্পে রবীন্দ্রনাথের গল্পের মতো
সমাপ্তিটা ধরে নিয়ে এগুতে পারি না। হাসান কিংবা আখতারুজ্জামানের গল্পের মতো
সমাপ্তির জন্য মুখিয়েও থাকি না। সম্ভাবনাকে খুঁজে বের করার জন্যই রবার্ট ফ্রস্টের
মতো জ্যোতিকেও হাঁটতে হয়েছে সেই পথে যে পথে মানুষ কম হেঁটেছে। ('Two Roads Diverged in the Wood and
I’ I took one less Traveled by. And that has made all the Difference'.)
ঘ.
কাফকা কিংবা
হেমিংওয়ের মতো জ্যোতিও চরিত্রের বিশদ বয়ানে যান না। বেশিরভাগ সময় তাঁর প্রজেকশন
থাকে চরিত্রের ইনার সেলফ্রে দিকে। সেই চরিত্রের গায়ের রং সাদাও হতে পারে, কালোও হতে পারে, চরিত্র বেটেও হতে পারে লম্বাও হতে পারে।
কোনো কোনো ক্ষেত্রে জ্যোতিপ্রকাশ চরিত্রের নামটাও বলে দিতে চান না। ভেতরের
অস্তিত্বের টানাপড়েনটাই তাঁর গল্পে মুখ্য, জাগতিক পরিচয় নয়। এমনকি বাহ্যিক পরিপার্শ্বের বর্ণনাটাও হয় সেই মাফিক।
রবার্ট লিডেল এ সম্পর্কে বলেন, ‘পটভূমি
বর্ণনায় নিছক প্রকৃতিবাদী প্রবণতা শিল্পের পক্ষে সহায়ক নয়। কাহিনী ও চরিত্রের
মধ্যে সংযোগ স্থাপনের প্রয়োজনে যতটুকু কেবল ততটুকুই পটভূমি হিসেবে গ্রাহ্য হওয়া
উচিত।’ [সাহিত্যের রূপ-রীতি, কুন্তল চট্টোপাধ্যায়] লিডেলের ভক্ত শ্রোতা
যেন জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত। তিনি তাঁর গল্পে বলছেন-
‘তুমি ধূসরতার পথ অতিক্রম করে আমার কাছে এসে বসেছ, আমরা কথা বলছিলাম। তুমি উত্তাপের কথা
বলছিলে এবং রৌদ্রের! আমি মেঘের কথা বলছিলাম এবং বৃষ্টির। দুজনে মিলে উত্তাপ এবং
মেঘের কথা বলছিলাম আর আমার মধ্যে সেই অনুভূতি জন্ম নিচ্ছিল। ...আকাশের পূর্ব দিকে
মেঘ ছিল। ঘন, কালো, নিশিছিদ্র গভীর মেঘ। আর পশ্চিমে পড়ন্ত
বেলার রোদ। আমি বললাম, এই মেঘ উঠবে, আস্তে আস্তে সবটা আকাশ পেতে বসবে। রোদকে
নিষ্পিষ্ট করবে এবং বৃষ্টি নামবে।’ [পৃ.১০, পরমাত্মীয়, ঐ]
কি চমৎকারভাবে তিনি প্রকৃতিকে ব্যবহার করে
মনের উদ্দেশ্য হাসিল করলেন! প্রকৃতি এভাবেই উঠে আসে তাঁর গল্পে। তার মানে জ্যোতির
গল্পে বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে বললে বাইরে যে বৃষ্টি হতেই হবে, নট নেসেসারি। মনটা খারাপ কিংবা ভাল, এটা তিনি সরাসরি না বলে এলিগরি বা রূপকের
আশ্রয় নেন। পূর্বেই বলেছি ভাষার দক্ষ খেলোয়াড় জ্যোতি। ভাষা নিয়ে খেলতে পছন্দ করেন
কারণ এই খেলাটা তিনি বোঝেন।
ঙ.
জ্যোতিপ্রকাশের গল্পে উইট বা হাস্যরসের
মাত্রাটা খুব চাপা। এদিক দিয়ে অগ্রগণ্য ছিলেন তাঁর সমসাময়িক গল্পকার আবদুশ শাকুর।
শাকুরের মতো ওতো কথার মারপ্যাঁচ জ্যোতিপ্রকাশের গল্পে নেই। তাঁর গল্পে কোথাও কোথাও
ভাষা ব্যবহারের কারণে কিঞ্চিত হাসি পায়। এদিক দিয়ে তাঁর উল্লেখযোগ্য গল্প ‘রংবাজ ফেরে না’। গল্পটির শুরুতেই একচোট হেসে নিতে হয়-
গো-মাতা হলেন দেবতা! সে দামড়া হোক আর বকনা হোক।
শালা চামার না হলে হাটে নিব্যার কয়?/ চামারের হাতের জল স্পর্শ যায় কি-না এ-প্রশ্ন তুলবার আগেই শ্রীদাম মোহান্ত
রঘুনাথ দেবনাথের কড়া তামাক জ্বালানো কল্কি হাতে তুলে নিয়ে ব্যবহার করতে শুরু করে
দিয়েছিল। অবশ্য এ প্রশ্ন তোলা হল একটু পরেই কিন্তু ত্রৈলোক্য শাস্ত্রে পারঙ্গম, অতএব এ কথা স্বীকৃত হলো যে ধুম্রে দোষ
নাস্তি! [পৃষ্ঠা, ৬৭, রংবাজ ফেরে না, ঐ]
এই গল্পে এমন হাসির খোরাক আরো কিছু আছে। জ্যোতিপ্রকাশ
সচেতনভাবেই হাসাতে চেয়েছেন সেটা তাঁর শব্দ চয়নে বোঝা যায়। যেমন তিনি বলছেনে, ‘চণ্ডীমণ্ডপের পেছন দিয়ে আসতে রঘুনাথ আবারও
ত্রৈলোক্য দাসের ভারডিক্ট শুনলো, শালা
চামার।’ [ঐ] এমন হালকা
জায়গায় ‘ভারডিক্ট’র মতো শক্ত শব্দ বসিয়ে তিনি মজা করলেন।
পাঠকও মজাটা বুঝে আনন্দ পেল। এছাড়াও গল্পে গরুর নাম রংবাজ রাখা, ছেলেকে শ্যালা বলে সম্বোধন করা হাসির
উদ্রেক ঘটায় বৈকি।
যৌনতা প্রকাশের ক্ষেত্রেও জ্যোতিপ্রকাশ
একই পন্থা অবলম্বন করেন। তাঁর আরেক সমসাময়িক গল্পকার সৈয়দ হক কিংবা খানিক পরের
ইলিয়াসের মতো তিনি হুটহাট করে সবকিছু বলে ফেলেন না। তিনি সেটা করলে বড় বেমানান
দেখাতো কেননা তাঁর গল্পের বাস্তবতা সেটা দাবীও করে না। তিনি শুধু এইটুকু বলতে
পারেন, ‘বৌয়ের চেনা শরীরে
আরেকটা মেয়েলোকের মুখ বসিয়ে ভাবতে বেশ উল্লাসই আসে!’ [পৃষ্ঠা, ৬৯, ঐ]
চ.
জ্যোতিপ্রকাশের গল্পের প্লট বেশ শিথিল। এর
কারণ তিনি পূর্বপরিকল্পিত কাঠামোর দ্বারা নিয়ন্ত্রিত থাকেন না। প্লট শিথিল হওয়ার
কারণেই তাঁর চরিত্ররা অতিমাত্রায় স্বাধীন। তাদের চিন্তাভাবনাগুলো এলোমেলোভাবে আসে।
লজিক্যাল কোন বন্ড সেখানে থাকে না। এজন্য তাঁর গল্পের কাহিনীকে কোনভাবে ধরে নিয়ে
এগুনো যায় না। ঘটনার পরস্পর সম্পর্ক বিচ্ছেদের কারণে খেই হারিয়ে ফেলেন পাঠক।
আধুনিক মনস্তত্ত্বমূলক ও অস্তিত্ববাদী সাহিত্যে এসে প্লটের গুরুত্ব অনেক কমে গেছে।
যেমন, কামু-উলফ-কাফকা-জয়েস
তাঁদের উপন্যাসে প্লটের সুতা কেটে দিয়ে চরিত্রগুলোকে আখ্যানের মাঝে ছেড়ে দেন।
জ্যোতিপ্রকাশের গল্পেও তার চরিত্ররা যৌক্তিক ‘শৃঙ্খল-বিযুক্ত’
রীতিতে
গল্পকে ধরবার বদলে তাদের বিশেষ মানসপ্রবৃত্তি অনুসারে গল্পের পরিণামকে চালিত করে।
পটভূমি বা সেটিংয়ের ক্ষেত্রেও
চেতনাপ্রবাহমূলক (স্ট্রীম অব কনসাসনেস) সাহিত্যের ধারা অবলম্বন করে স্থান ও কালের
প্রচলিত নিয়ম ভেঙ্গে বিচিত্র ও বহুমুখী পটভূমি নির্মাণ করেন জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত।
এজন্যে তাঁর গল্পে প্রায়শই কাল ও স্থান (টাইম এন্ড স্পেস) ধরা যায় না। গল্পের
বিভিন্ন দৃশ্যকে তিনি চলচ্চিত্রের মতো আলাদা করে ধারণ করে montage-এর রীতি অনুসরণ করে জুড়ে দেন। কাজেই
চেতনার মতো অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যৎ এলোমেলোভাবে মিশে যায়।
চেতনা-প্রবাহমূলক গল্পে গল্পবলার মজলিসী
ঢঙ লুপ্ত হয়। এ কারণে জ্যোতিপ্রকাশের অনেক গল্প সুখপাঠ্য হয়ে ওঠে না। ছোটগল্পে
গল্পটা ঠিকঠাক বলা চায়, আমি পূর্বেই বলেছি
জ্যোতিপ্রকাশ এ নীতির ধার ধারেন না। কোথাও কোথাও অতি ভণিতার কারণে তাঁর গল্প পড়েও
যায়। প্রকাশভঙ্গী সরল রেখেও গল্পকে ঈঙ্গিতপূর্ণ করে তোলা যায়, হেমিংওয়ে তার জ্বলন্ত উদাহরণ। এ জায়গায়
এসে কিছুটা ব্যর্থ হয়েছেন জ্যোতিপ্রকাশ। তবে তিনি যেহেতু স্বতন্ত্রধারার লেখক, কাজেই তাঁকে বুঝতে হলে তাঁর ভেতরেই যেতে
হবে। অন্যদের সাথে তুলনা করে তাঁকে বোঝা বা বোঝানো মুশকিল। জ্যোতিপ্রকাশকে
মোটামুটি পাঠ থেকে এই আমার উপলব্ধি।
লেখক পরিচিতি
মোজাফফর হোসেন
জন্ম : ১৯৮৬ জন্মস্থান : মেহেরপুর, বাংলাদেশ।
পড়াশুনা : ইংরেজী বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।
কবি ও গল্পকার, প্রবন্ধকার, অনুবাদক।
সম্পাদক : শাশ্বতিকী।
যোগাযোগ : 01717513023,
যোগাযোগ : 01717513023,
mjafor@gmail.com
0 মন্তব্যসমূহ