১৯৭৭ সালের কথা। তখন আমি ঘোড়াশাল সার
কারখানায় কর্মরত। এখানকার কর্মচারী ক্লাবে একটি লাইব্রেরী ছিল। সেখানে বাংলা সাহিত্যের বেশ
কিছু ভালো বইয়ের সংগ্রহ ছিল। এর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য অসীম রায়ের ‘আবহমান’,
তরুণ ভাদুড়ীর ‘সন্ধ্যা দীপের শিখা’, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’
ইত্যাদি। এইসব বইগুলির মধ্যে অপ্রত্যাশিতভাবে জ্যোতিপ্রকাশ দত্তের ‘সিতাংশু, তোর
সমস্ত কথা’ গল্পের বইটি পেয়ে গেলাম।
ওঁর ‘দুর্বিনীত কাল’, ‘বহে না সুবাতাস’ আর এই বইটির কথা শুনেছি সেই ১৯৬৯ সাল থেকে। কিন্তু কখনও পড়বার সুযোগ হয়নি কেননা স্বাধীনতার আগে এই ধরনের বই মফস্বল শহরে দুষ্প্রাপ্য ছিল। স্বাধীনতার পর এই বইগুলি তন্নতন্ন করে খুঁজেছি নিউমার্কেট আর বাংলা বাজারের বইয়ের দোকানগুলিতে। কিন্তু পাইনি কোথাও। হঠাৎ করে ‘সিতাংশু, তোর সমস্ত কথা’ বইটি এখানে পেয়ে যাব সত্যি ভাবিনি। বইটা লাইব্রেরী থেকে এনেই পড়তে শুরু করি। এখনও মনে আছে সেদিন অনেক রাত জেগে বইটা পড়ে ফেলেছিলাম। প্রথম গল্প ‘পিতৃঘ্ন’। এর প্রথম স্ট্যাঞ্জা পড়ার পর দ্বিতীয় স্ট্যাঞ্জা শুরু করতেই আমি এক অন্য জগতে চলে যাই। এর কাব্যিক উপাদান, পরিমিত বোধ, বাক্য গঠন শৈলী, গল্প উপস্থাপনার অভিনবত্ব ও উদ্ভাসিত দৃশ্যকল্প এক অনামিক অনুভূতির জন্ম দেয়। যা আমাকে আবিষ্ট করে, আচ্ছন্ন করে। শুধু কথায় সেটা বোঝানো সম্ভব নয়। যা স্পষ্ট হবে, মূর্ত হবে এই উদ্ধৃতির মধ্যে-
ওঁর ‘দুর্বিনীত কাল’, ‘বহে না সুবাতাস’ আর এই বইটির কথা শুনেছি সেই ১৯৬৯ সাল থেকে। কিন্তু কখনও পড়বার সুযোগ হয়নি কেননা স্বাধীনতার আগে এই ধরনের বই মফস্বল শহরে দুষ্প্রাপ্য ছিল। স্বাধীনতার পর এই বইগুলি তন্নতন্ন করে খুঁজেছি নিউমার্কেট আর বাংলা বাজারের বইয়ের দোকানগুলিতে। কিন্তু পাইনি কোথাও। হঠাৎ করে ‘সিতাংশু, তোর সমস্ত কথা’ বইটি এখানে পেয়ে যাব সত্যি ভাবিনি। বইটা লাইব্রেরী থেকে এনেই পড়তে শুরু করি। এখনও মনে আছে সেদিন অনেক রাত জেগে বইটা পড়ে ফেলেছিলাম। প্রথম গল্প ‘পিতৃঘ্ন’। এর প্রথম স্ট্যাঞ্জা পড়ার পর দ্বিতীয় স্ট্যাঞ্জা শুরু করতেই আমি এক অন্য জগতে চলে যাই। এর কাব্যিক উপাদান, পরিমিত বোধ, বাক্য গঠন শৈলী, গল্প উপস্থাপনার অভিনবত্ব ও উদ্ভাসিত দৃশ্যকল্প এক অনামিক অনুভূতির জন্ম দেয়। যা আমাকে আবিষ্ট করে, আচ্ছন্ন করে। শুধু কথায় সেটা বোঝানো সম্ভব নয়। যা স্পষ্ট হবে, মূর্ত হবে এই উদ্ধৃতির মধ্যে-
“ ‘মা’ বিশেষত ‘আমার মা’ এই শব্দের নিঃশব্দ উচ্চারণ আমাকে কয়েকটি দৃশ্য দেখায়ঃ একটি বিশাল টিনের ঘরের মেঝেয় স্তিমিত আলোকে মুমূর্ষ এক রমণী এবং তাঁর প্বার্শে আমার অগ্রজা সেই দৃশ্যের অঙ্গ। তাঁর মৃত্যুর অব্যবহিত পরে সদ্য ঘুমভাঙ্গা আমার আর্ত চিৎকার সেই দৃশ্যের শব্দ, সান্ত্বনাদানরতা অগ্রজার শরীর সেই দৃশ্যের স্পর্শ, মৃতার পদযুগল তার বর্ণ।
শব্দে, স্পর্শে, বর্ণে এমনি করে আমার মা আমার স্মৃতিতে রয়ে গেছেন। আসলে, সেই মৃতা
রমণীর জন্য কোন বোধ নয়, ভালোবাসা নয়, শ্রদ্ধা নয়-আমি স্পষ্ট অনুভব করি, তাঁর জন্যে
ওই দৃশ্যটি ব্যতীত আর কোনো কিছুই অবশিষ্ট নেই।“
এরকম আশ্চর্য
বিষাদে, হাহাকারে, ক্ষোভে, অভিমানে সিক্ত এবং ঋদ্ধ গদ্যে নির্মিত ‘পিতৃঘ্ন’
গল্পটি। একজন অবহেলিত, প্রত্যাখ্যাত পুত্রের চোখ দিয়ে দেখা পিতাকে উপস্থিত করা
হয়েছে নির্মম উদাসীনতায়, অবজ্ঞায়, তাচ্ছিল্যে। পুরো গল্পের পরতে পরতে জড়িয়ে আছে
সূক্ষ অনুভূতির স্পর্শ। তারপর এই বইয়ের আরো এগারোটি গল্প একই উৎসাহে, আগ্রহে পড়ে
ফেলি। গল্পগুলি পড়ার পর মনে হয়েছে-এগুলি শেষ হয়েও যেন শেষ হল না। গল্পের এরকম
অনিষ্পন্ন পরিণতিতে এক ধরনের শূন্যতা অনুভব করেছিলাম। প্রতিটি গল্পের শরীরে লেগে
ছিল উৎকন্ঠা আর অনেক না বলা কথা। যেন ইচ্ছে করেই তা ছেড়ে দিয়েছেন পাঠকদের উপর।
এভাবেই জ্যোতিপ্রকাশ দত্তের গল্পের সাথে আমার প্রথম পরিচয় ঘটে। এবং ওঁর গল্পের
একজন মনোযোগী পাঠক হয়ে উঠি। এখানে আরেকটি কথা খুব গোপনে বলে রাখি। লাইব্রেরী থেকে
নেওয়া ‘সিতাংশু, তোর সমস্ত কথা’ গল্পের বইটি আর ফেরত দেইনি, দিতে ইচ্ছে করেনি।
কেননা বইটি তখন কোন বইয়ের দোকানে খুঁজে পাইনি। তাই অনেকটা ইচ্ছের
বিরুদ্ধেই বইটি ফেরত না দিয়ে লাইব্রেরীতে জরিমানা দিয়েছিলাম।
এছাড়া ‘সিতাংশু,
তোর সমস্ত কথা’-র গল্পগুলি পড়ার পর লেখকের সাথে দেখা করার জন্যে অনেক খোঁজ-খবর
করেছিলাম। তখন দুই বাংলার কোন লেখকের লেখা ভাল লাগলে তাঁর সঙ্গে দেখা করার চেষ্টা
করতাম। খুব ইচ্ছে হত লেখক/কবিদের কাছ থেকে তাঁদের লেখার পিছনের গল্প শুনতে। ইচ্ছে
হত আমার অনুভূতি অথবা প্রতিক্রিয়া ওঁদেরকে শোনাতে। এটা ছিল আমার এক ধরনের পাগলামি।
তবু এভাবেই অনেক লেখক/কবিদের সঙ্গে দেখা করেছি, তর্ক-বিতর্ক করেছি। এভাবে খুব ভাল
সময় কেটেছে এবং অনেক কিছু জানাও হয়েছে। আবার এমনও হয়েছে, কোন কোন লেখক আমার সাথে
দেখা করতে রাজি হননি। বলেছেন, ‘দেখা হলে যদি আমার কোন ব্যাপার বা কোন কিছু ওর ভালো
না লাগে, তাহলে আমি একজন পাঠককে হারাবো’। এসব কথা আমি অন্যের মুখে শুনেছি। কিন্তু
‘সিতাংশু, তোর সমস্ত কথা’-র লেখকের সঙ্গে তখন দেখা করা হল না। কেননা জানতে পারলাম
যে তিনি আমেরিকা চলে গেছেন এবং সেখানেই স্থায়ীভাবে বসবাস করেন। তারপর ওঁর
‘দুর্বিনীত কাল’ এবং ‘বহে না সুবাতাস’ বই দুটিও পড়ে ফেলি। যদিও তখন হাসান আজিজুল
হকের ‘আত্মজা ও একটি করবী গাছ’-এর মতো অসাধারণ গল্পটি পড়েছি। মুগ্ধ হয়েছি, আবেগে আপ্লুত হয়েছি।
ভালো লেগেছে মাহমুদুল হক অথবা কায়েশ আহমদের গল্পগুলিও তখন। কিন্তু জ্যোতিপ্রকাশ
দত্তের গল্পের উপস্থাপনা এবং ওঁর গদ্যের প্রতি একটা আলাদা আকর্ষণ অনুভব করেছি। ওঁর
গল্পের প্রতি এক ধরনের ভালোবাসা জন্মে যায়। ওঁর গল্পের অধরা উপাদান আমাকে
বিশেষভাবে টেনেছিল। এই গল্পগুলি পড়তে পড়তে অন্য আরেক ভুবনে চলে গেছি। বাংলা গদ্য
সাহিত্যে এরকম লেখা সচর-আচর আমার চোখে পড়েনি তখন। চার বছরের মধ্যে পর পর তিনখানি
গল্পের বই প্রকাশের মধ্যে দিয়ে তৎকালীন পুর্বপাকিস্তানে শিক্ষিত পাঠক এবং
সমালোচকদের বিশেষভাবে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন। এবং সাহিত্য জীবনের শুরুতেই উজ্জ্বল
সম্ভাবনার বীজ বপন করেছিলেন।
কিন্তু এই
গল্পকার হঠাৎ করেই কাউকে কিছু না বলে একদিন হাওয়া হয়ে গেলেন সাহিত্য জগৎ থেকে। এই
গল্পকারের আর কোন লেখা পাওয়া গেলনা। কেউ তেমন কিছু বলতেও পারতো না এই গল্পকার
সম্পর্কে। মাঝে মাঝে ভাবতাম মানুষটি কেন এভাবে হারিয়ে গেলেন! সমর সেনের মতো মৌলিক
কবিও একদিন কবিতা লেখা ছেড়ে দিয়েছিলেন। তবে কী তিনিও ইচ্ছে করেই একদিন গল্প লেখা
ছেড়ে দিলেন? তবে কেন দিলেন? এরকম অবান্তর ভাবনা আমাকে আচ্ছন্ন করেছিল তখন। তারপর
একদিন প্রাকৃতিক নিয়মেই গল্পকার জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত নীরবে সবার কাছ থেকে হারিয়ে
গেলেন অথবা সরে গেলেন। শুধু একটি সুখকর স্মৃতি হয়ে বেঁচে রইলেন কিছু সাহিত্য
প্রেমিক মানুষ অথবা কিছু সাহিত্যিকদের মধ্যে। কখনো সখনো কোন সাহিত্যের আড্ডায় ওঁর
গল্প প্রসঙ্গে কথা হয়। শুধু এইটুকুই। এরকম একজন সৃজনশীল গল্পকারের সাহিত্য চর্চা
থেকে স্বেচ্ছা নির্বাসনে যাওয়ার ঘটনা তেমন একটা চোখে পড়েনা। কিন্তু এভাবেই কেটে
যায় ওঁর অনেকগুলি নিষ্ফলা বছর।
তারপর অনেক বছর
কেটে যায়। ১৯৮৮ সালে আমি আমেরিকা আসি। এতগুলি বছর পরও ‘সিতাংশু, তোর সমস্ত কথা’-র
স্মৃতি আমি ভুলিনি। তাই পরিচিত মহলে স্বেচ্ছা নির্বাসিত গল্পকারের কথা জিজ্ঞেস করি। এবং আমার খোঁজা-খুঁজি চলতে থাকে।
অবশেষে ১৯৯১ সালে আমার তখনকার লেখক বন্ধু আলম খোরশেদ-এর মাধ্যমে এই হারানো
গল্পকারের খবর পাই। আলম খোরশেদ ওঁকে আমাদের বাসায় নিয়ে আসে। অবশেষে আমাদের দেখা
হয়। দীর্ঘ প্রতিক্ষার অবসান হয়। সেদিনই জ্যোতিদা আমাকে ওঁর ‘সিতাংশু, তোর সমস্ত
কথা’ বইটি উপহার দেন। এবং তিনি লিখেছিলেন-
‘জয়ন্ত নাগ
প্রিয়বরেষু-
পঁচিশ বছর আগের লেখা
বিশ বছর ধরে মনে রাখার জন্যে’
এরপর জ্যোতিদা ওঁর প্রায় সবগুলি বই আমাকে উপহার দিয়েছেন। এমন কী একটা বই আমাকে উৎসর্গও করেছেন। কিন্তু ‘সিতাংশু, তোর সমস্ত কথা’ বইটি উপহার পাওয়ার পর যেমন লেগেছিল সে রকম আর কখনো লাগেনি। এক বিশেষ স্মৃতি হিসেবে তা বেঁচে আছে এবং থাকবে। এভাবেই একজন পাঠকের সঙ্গে একজন লেখকের সম্পর্ক তৈরি হয়, একজন পাঠক একজন লেখকের খুব কাছে চলে আসে, একজন পাঠক একজন লেখকের বন্ধু হয়ে ওঠে। এভাবেই পাঠক-লেখকের সম্পর্কের রসায়ন অন্য এক মাত্রা পায়। এসব ঘটনার কোন বৈষয়িক মূল্য নেই। তবে জীবনের কিছু ভালোলাগা মুহূর্তের তালিকায় এই ঘটনাটি একটি স্থায়ী আসন পেয়ে যায়।
‘জয়ন্ত নাগ
প্রিয়বরেষু-
পঁচিশ বছর আগের লেখা
বিশ বছর ধরে মনে রাখার জন্যে’
এরপর জ্যোতিদা ওঁর প্রায় সবগুলি বই আমাকে উপহার দিয়েছেন। এমন কী একটা বই আমাকে উৎসর্গও করেছেন। কিন্তু ‘সিতাংশু, তোর সমস্ত কথা’ বইটি উপহার পাওয়ার পর যেমন লেগেছিল সে রকম আর কখনো লাগেনি। এক বিশেষ স্মৃতি হিসেবে তা বেঁচে আছে এবং থাকবে। এভাবেই একজন পাঠকের সঙ্গে একজন লেখকের সম্পর্ক তৈরি হয়, একজন পাঠক একজন লেখকের খুব কাছে চলে আসে, একজন পাঠক একজন লেখকের বন্ধু হয়ে ওঠে। এভাবেই পাঠক-লেখকের সম্পর্কের রসায়ন অন্য এক মাত্রা পায়। এসব ঘটনার কোন বৈষয়িক মূল্য নেই। তবে জীবনের কিছু ভালোলাগা মুহূর্তের তালিকায় এই ঘটনাটি একটি স্থায়ী আসন পেয়ে যায়।
পুনশ্চঃ
দীর্ঘ বিশ বছর পর
এই প্রতিভাধর গল্পকারের চতুর্থ গল্পগ্রন্থ ‘পুনরুদ্ধার’ প্রকাশিত হয় ১৯৮৯ সালে। তিনি আবার সক্রিয়ভাবে
লেখালেখি শুরু করেন এবং সেই ধারা এখনও বহমান। তবুও আমার মনে একটি প্রশ্ন উঁকি দেয় মাঝে মাঝে। যদি
ওঁর লেখালেখিতে বিশ বছরের বিরতি না হত, এরকম দীর্ঘ ছেদ না পড়তো এবং যদি তিনি
ধারাবাহিক ভাবে লিখে যেতেন, তাহলে কী তিনি অন্য রকম কোন গল্পকার হয়ে উঠতেন?
লেখক পরিচিত
জয়ন্ত নাগ
কবি। প্রবন্ধকার। গল্পকার। গীতিকার।
কর্মসূত্রে পরিবেশ বিজ্ঞানী।
কানেকটিকাট, যুক্তরাষ্ট্রে প্রবাসী।
লেখক পরিচিত
জয়ন্ত নাগ
কবি। প্রবন্ধকার। গল্পকার। গীতিকার।
কর্মসূত্রে পরিবেশ বিজ্ঞানী।
কানেকটিকাট, যুক্তরাষ্ট্রে প্রবাসী।
0 মন্তব্যসমূহ