সংসারে, সংশয়ে, সন্তাপে, আনন্দে

পূরবী বসু

নব্বইয়ের দশকে আমাদের দেশের পরিপ্রেক্ষিতে মোটামুটি একটা বড় চাকরি করার সুযোগ হয়েছিল আমার। এত বছর বিদেশে থাকার পর দেশে ফিরে এসে এমন চাকরি পাওয়া সৌভাগ্যের কথা বটে। আমি তাই বেশ পরিতৃপ্ত। কিন্তু আমার কাজের সুবাদে আর এ পোড়া দেশটাতে লেখাপড়া জানা ছেলেমেয়েদের চাকরি-সংস্থানের মারাত্মক ঘাটতির কারণে বড় বিপদে পড়ি মাঝে মধ্যে।
আগ্রহ দেখিয়ে, স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে আলাপ করতে আসে যারা, অথবা যখনই আন্তরিকভাবে নিজেদের ঘরে নেমন্তন্ন করেন কোনো অর্ধ-পরিচিতজন, প্রায় অবধারিতভাবেই দেখি, সে সঙ্গে সবিনয়ে আসে একখানি চাকরির প্রার্থনা অথবা সুপারিশ। আমেরিকান রাষ্ট্রদূতের আগ্রহে তার নিজস্ব বাসভবনে ঢাকায় বসবাসরত আমেরিকায় পড়াশোনা করা প্রাক্তন ছাত্রদের এলামনাই অ্যাসোসিয়েশন তৈরি হলো যেদিন, সেদিনই প্রথম আলাপ হলো নুর সাহেব আর তার স্ত্রীর সঙ্গে। এক সময় কলরেডোতে লাইব্রেরি বিজ্ঞানে পড়াশোনা করতেন নুর। 

সুআলাপী দম্পতি। ফেরার সময় জানতে পারি, এত রাতে স্কুটারে করে বারিধারা থেকে হাতিরপুলে বাসায় ফিরবেন তারা। শুনে জোর করে আমাদের গাড়িতে করে পেঁৗছে দিই তাদের বাসায়। এ সামান্য ব্যাপারটির জন্য এতবার তিনি ফোন করবেন, বাড়িতে নেমন্তন্ন করবেন কল্পনাও করিনি। বার বার পোড় খাওয়া, হোঁচট খাওয়া নষ্ট মন আমার। খালি মনে হয়, ছেলে-মেয়ে অথবা ভাগ্নে-ভাগি্ন কারও চাকরির দরকার নিশ্চয়। বহুবার এড়িয়ে যাওয়ার পর, একবার যেতেই হলো হাতিরপুলে তাদের বাসায়। একত্রে দ্বিপ্রাহরিক খাবার খেতে যাওয়ার আমন্ত্রণ। হাতিরপুল কাঁচাবাজারের অদূরে দোতলা সাদা বাড়িটির সামনে, নিচে, সামান্য এক চিলতে জায়গাটুকুতে পায়চারি করছিলেন নুর সাহেব আমাদেরই অপেক্ষায়। সাদা পাজামা-পাঞ্জাবি পরিহিত দীর্ঘদেহী মানুষটি আমাদের অভ্যর্থনা করে ঘরে নিয়ে যাওয়ার এই মহা দায়িত্বটা নিয়ে রীতিমতো ঘামছেন। দোতলায় তাদের ঘরে গিয়ে দেখি, আমাদের সম্মানে নুর সাহেব তার বিবাহিত ছেলেমেয়েদের ও তাদের গোটা পরিবারসহ আমন্ত্রণ জানিয়েছেন সেদিন। ঘরভর্তি আত্মীয়স্বজন। কেমন এক উৎসবের আমেজ। একসময় খাওয়াদাওয়া শেষ হয়। মিষ্টি, পানসুপারিও। অথচ এখনও কোনো গুণী, শিক্ষিত, অল্পবয়সী ছেলে বা মেয়েকে কাছে ডাকা হলো না যে পা ছুঁয়ে সালাম শেষে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে তার আর্জি পেশ করবে। একখানা ছোটখাটো চাকরি কেবল, আর কিছু নয়। ঘটা করে সালাম পর্বের এক ফাঁকে যত্ন করে হাতের ভেতর ভাঁজ করে রাখা রেজুমেটা মনে করে ধরিয়ে দেবে আমার হাতে। আমি মনে মনে একটু অস্থির হয়ে উঠেছি ততক্ষণে। 

অতি প্রত্যাশিত বিড়ম্বনার সে অবধারিত পর্যায়টুকু পার করে দিচ্ছি না কেন আমরা, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব? কিন্তু না। সে মুহূর্তটি আসে না। প্রস্থানের জন্য তৈরি হলে, দোতলা থেকে বাড়ির পুরো দল আমাদের পেছন পেছন নিচে নেমে আসে। সবাই সার বেঁধে দাঁড়ায় গেটের কাছে আমাদের বিদায় দিতে। হঠাৎ নুর সাহেব এক মিনিট দেরি করতে বলে দ্রুত ওপরে চলে যান, একটা কিছু ভুলে গেছেন তিনি। এক্ষুণি ফিরবেন। আমি সভয়ে চারদিক তাকাতে থাকি, প্রমাদ গুনি, এখানে কে আসেনি, যাকে ওপরে দেখেছি আগে, কাকে ধরে সামনে এনে দাঁড় করাবেন এখন নুর সাহেব-- কে সেই সহস্র-সহস্রের ভেতর আরও একটি চাকরিপ্রার্থী বেকার তরুণ অথবা তরুণী-- না, কেউ নয়। নুর সাহেব একাই ফিরে এলেন। হাতে কাগজ দিয়ে জড়ানো একগুচ্ছ লালগোলাপ। তিনি ওগুলো আমার স্বামীর হাতে তুলে দেন। কদিন আগে কাগজে দেখেছেন পাঠক ও ভক্তদের তরফ থেকে ঘটা করে ওর ষাট বছরের জন্মদিন পালন করার সংবাদ। ঠিক ঐ জগতের মানুষ নন বলে ইচ্ছা থাকা সত্বেও গিয়ে উপস্থিত হননি অনুষ্ঠানে, কী রকম সংকোচ হয়েছে। কিন্তু তাই বলে দেরিতে হলেও জন্মদিনের শুভেচ্ছাটা জানাতে দোষ কী? চলন্ত গাড়ি থেকে আমি বিস্ময়ে পেছনের দিকে তাকিয়ে দেখি-- নুর সাহেব ও তার স্ত্রী ছেলেমেয়ে নাতি-নাতনিসহ হাসিমুখে হাত নেড়ে বিদায় জানাচ্ছেন আমাদের।

দুই. 
কাল রাতে বড় ভয় পেয়েছিলাম। বারবার ঘুম ভেঙে যাচ্ছিল, আর মনে হচ্ছিল-- একটা বাঘ কিংবা ভাল্লুক বা ওই ধরনের বড় কোনো প্রাণী পাশের ঘরে আটকা পড়ে বিভিন্নভাবে বেরোবার চেষ্টা করে অসফল হচ্ছে। যতবার জেগে গিয়ে ঝট করে বিছানার ওপর উঠে বসে রহস্যের কুলকিনারা করার চেষ্টা করি, ততবারই স্বামী বলেন, ‘ভুলে গেলে, ও ঘরের অতিথির কথা? ওতো এ রকমই। সারাজীবনই অদ্ভুত এক শব্দ করে পড়াশোনা করে, শব্দ করে খায়, প্রচণ্ড শব্দ করে ঘুমোয়।আমার তখন মনে পড়ে যায়, আজ বিকেলেই কানাডা থেকে বেড়াতে আসা আমাদের অনেকদিনের চেনা সেই বন্ধুর কথা, যাকে পাশের ঘরে শুতে দিয়েছি। বিয়ে করেননি, অন্তরঙ্গ কোনো মেয়েবন্ধুও কখনও দেখিনি তার। কে জানে, তার সশব্দে সব কাজকর্ম করার এই যে অভ্যেস, তা তার একাকিত্ব ও নিঃসঙ্গতা কাটিয়ে ওঠারই একরকম প্রয়াস কিনা! নিজেকে বুঝিয়ে শুনিয়ে আবার ঘুমোতে গেছি, আবার সেই বিকট আওয়াজ, নতুন ধরনের, আগেরবারের চাইতে আলাদা। আবার জেগে গেছি। আমার এখন ভয় হচ্ছে শব্দটা বাড়ির দেয়াল ভেদ করে পাশের বাড়ি [আমাদের বাড়ি ও পাশের বাড়ি দুটো একসঙ্গে জোড়া দেওয়া-- মানে দুটোর মাঝখানে একটি কমন দেয়াল রয়েছে] চলে যায় কিনা! এগুলো এদেশে ডুপ্লেক্স অথবা সেমি-এটাচড বাড়ি বলে পরিচিত। আমাদের ডুপ্লেক্সের পাশের বাসিন্দা এক বুড়ি। খুব বন্ধুসুলভ নন। তার সঙ্গে সুসম্পর্ক নেই আশপাশের প্রায় কারোরই। সেটা মূলত তার খিটমিটে স্বভাবের জন্যই। এত রাতে বিজাতীয় শব্দে ঘুম ভাঙলে পুলিশ ডেকে না বসে বুড়ি।
ঘুম ভেঙে গেলে অনেকক্ষণ আর ঘুম আসে না আমার। আজ রাতেও আসছে না। সেই সঙ্গে ভয়, এই বুঝি বুড়ি দরজা ধাক্কা দিয়ে নালিশ করতে এলো। শুয়ে শুয়ে এপাশ ওপাশ করতে করতে মনে পড়ে যায় অনেকদিন আগের কথা। ১৯৬৪ সালের শীতকালের এক রাত। মাসটা সম্ভবত জানুয়ারি। শহরটা মুন্সীগঞ্জ সদর। কাশ্মীরের হজরতবাল দরগায় সংঘটিত এক স্পর্শকাতর চুরিকে কেন্দ্র করে চারদিকে তখন প্রবল সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা, খুনোখুনি। কয়েকদিন ধরে বিভিন্ন ধরনের গুঞ্জন, বিভিন্ন রকম গুজব কানে আসছে। ফলে মিলিত কণ্ঠে নারায়ে তকবির, আল্লাহু আকবরশোনার আশঙ্কায় প্রতি রাতেই আমরা ভয়ে ভয়ে কান পেতে বসে থাকি ঘরের ভেতর। যে ধ্বনি এত পূতপবিত্র, যে শব্দোচ্চারণ সৃষ্টিকর্তার মহিমা ঘোষণা করে কেবল, তার প্রতি এত আতঙ্ক কেন? কেননা, সময়টা ১৯৬৪ সাল, ভিটেটা বসুবাড়ি, আর আমাদের বসতি ভারত উপমহাদেশের একাংশে-- যা বহুকাল ধরে বিক্রমপুর বলে পরিচিত। হঠাৎ এক রাতে সত্যি সত্যি সেই প্রাণকাঁপানো, গলা শুকিয়ে দেওয়া, পরিচিত শব্দাবলি কানে ভেসে আসে। একে একে মনোযোগ দিয়ে বাড়ির প্রত্যেকেই কান পেতে শুনি আমরা, সেই মহারব। তাইতো! নিঃসন্দেহে নদীর ধার থেকেই আসছে সমস্বরে উচ্চারিত ওই পরিচিত ধ্বনি-- একযোগে। সুর করে। পুনঃ পুনঃ। নারায়ে তকবির, আল্লাহু আকবর। এবার আর রক্ষা নেই। কী করব, কোথায় যাব এখন আমরা? এত রাতে! ভাইবোনেরা একজন আরেকজনকে জড়িয়ে ধরে মশারির ভেতর বসে কাঁপতে থাকি। হঠাৎ মা আবিষ্কার করেন এবং কিছুক্ষণ পাশের ঘরে স্থির দাঁড়িয়ে থেকে নিশ্চিত হন, ঘুমন্ত ঠাকুমার ধীরলয়ের নিশ্বাস-প্রশ্বাস নির্দিষ্ট এক ছন্দে নাসিকা-গর্জনের মাধ্যমে গভীর খাদে যে গোলমালের মতো এক শব্দ সৃষ্টি করছে, তাই এ ঘরে নারায়ে তকবির আল্লাহু আকবর’-এর জন্ম দিচ্ছে। অন্তত আমাদের ভীত মনে, সন্ত্রস্ত কানে অবিকল তাই শোনাচ্ছিল সেই রাতে। মায়ের আবিষ্কারে হাঁপ ছেড়ে বাঁচি আমরা। ছোট ভাই দুলাল কেবল এতক্ষণে বলে ওঠে, ‘তাই তো বলি, দূর থেকে আসা গুঞ্জনটা এতক্ষণ ধরে এক জায়গাতেই থেমে আছে কেন? আর যেন কাছে এগুচ্ছে না!

তিন. 
স্বামীর সাময়িক অনুপস্থিতিতে নবজাতক মেয়েকে নিয়ে হাসপাতাল থেকে ঘরে ফেরার সময় আমার, ঘনিষ্ঠতম বন্ধু, যে আবার আমার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার স্ত্রীও বটে, তার গাড়িখানা নিয়ে নিজে আসতে পারবে না, পরিবর্তে তার প্রতিবেশীকে পাঠাবে হাসপাতালে আমাকে নিয়ে যেতে, এ সংবাদ শোনা ছিল আমার কাছে অচিন্তনীয়। মনে মনে ভাবলাম, বড়র পিরিতি বালির বাঁধ। প্রবাসে এ রকম অবস্থায় শেষ পর্যন্ত এই অভিজ্ঞতা! আজ দেশে থাকলে কিছুতেই এমন ঘটত না। প্রথম শিশু-সন্তান নিয়ে স্বজনবিহীন একলা ঘরে ফেরা! অভিমানে-অনুযোগে-অপমানে মন যখন ভারাক্রান্ত, চোখ ছলছল, বন্ধুত্বের গভীরতায় যখন সন্দেহ গাঢ়, জমাট বাঁধা, তিন দিনের এক রত্তি শিশু কোলে নিয়ে ঘরে ঢুকতে গিয়ে দেখি, সহাস্যে আমাদের বরণ করার জন্য দরজায় দাঁড়িয়ে আছে সে-- হালকা হলুদ সিল্কের শাড়ি পরনে, হাতে একগাদা রকমারি উজ্জ্বল রঙের তাজা ফুল। মুখে চোখে এক অনাবিল আনন্দ, তৃপ্তি আর প্রশান্তি। 
আমাদের অতি সাধারণ ছোট্ট বাড়িটার প্রতিটি ঘর ধুয়ে মুছে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে আনুষ্ঠানিকভাবে সজ্জিত করেছে সে একা হাতে। তারপর অপেক্ষা করছে আমার জন্য-- আমাদের নবজাত সন্তান জয়ীষার জন্য। অপেক্ষা করছে সে, প্রয়োজনীয় খুঁটিনাটির সব তদারক শেষে-- যেখানে যা থাকা দরকার, সবকিছুর সুষ্ঠু ব্যবস্থা সাঙ্গ করে। সামনের দরজায় ও ঘরের ভেতরের লম্বা দেয়ালে ঝুলছে হলুদ আর সাদা রঙের সরু রিবন। সেই সঙ্গে গাঢ় গোলাপির ওপর বড় বড় সাদা হরফে তার নিজের হাতে লেখা ব্যানার, ‘ডবষপড়সব ঐড়সবআরেকটিতে লেখা, ‘এসো এসো ঘরে এসো।তার স্মিত হাসিভরা উজ্জ্বল মুখখানার দিকে তাকাতে পারি না। আমার চোখে জল।

চার. কুরুক্ষেত্র বানানোর মতো অপরাধ এটা নয়। শমিত বোঝাতে চেষ্টা করে আমায়। সে যে ধনেপাতার গন্ধ অপছন্দ করে, সেটা এত বছর ধরে আমাকে জানতে না দেওয়ার মধ্যে কোনো ষড়যন্ত্র, চালাকি বা দুরভিসন্ধি ছিল না তার। যে জন্য এ কথা কখনও আমায় বলেনি সে, তা হলো-- সে জানে, আমি ধনেপাতাড় গন্ধ ও স্বাদ ভীষণ পছন্দ করি। সে দেখেছে আমাদের এই শহরতলির বাড়ি থেকে কতটা দূরে আমি ড্রাইভ করে যাই কেবল দেশি দুএকটা তরকারি কেনার জন্য, যার ভেতর ঝাল কাঁচামরিচ আর ধনেপাতা সবচেয়ে জরুরি আমার কাছে। কেন মিছেমিছি আমাকে আমার এমন একটা পছন্দের জিনিস থেকে বঞ্চিত করবে শমিত? তা ছাড়া, বছরের পর বছর খেতে খেতে আজকাল আর ধনেপাতার গন্ধটা আগের মতো তেমন জংলিও মনে হয় না তার কাছে। এমন কী কখনও সখনও কোনো কোনো তরকারিতে তাজা ধনেপাতার এ গন্ধটা ভালোও লাগে তার। যেমন গরম গরম মসুর ডালের সঙ্গে। মানুষ নতুন কিছুতে প্রাথমিকভাবে অপছন্দের কিছুতে আস্তে আস্তে ঃধংঃব ফবাবষড়ঢ়’-ও তো করে কখনও কখনও! করে না? যেমন আমি, শমিত বোঝায়, বিয়ের পর প্রথম প্রথম চাইনিজ খেতে একদম পছন্দ করতাম না। বিদেশে এসেও এখানকার কোনো খাবারই আমার মুখে মোটেই স্বাদ লাগত না। আর এখন? এখন তো প্রতিমাসে একবার অন্তত বাইরের খাবার [বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ধরনের] না খেলে চলেই না। কিন্তু এসব যুক্তির কথা আমি মানতে রাজি নই। আমার সোজাসাপ্টা কথা, এটা এতদিন, এত বছর কেন আমার কাছে গোপন করে রাখল শমিত? কেমন করে তা পারল সে? কেন আমাকে বোকার মতো তৃতীয় ব্যক্তির মুখ থেকে তা জানতে হলো আজ? তাহলে কি শমিত তার জীবনের এমন আরও অনেক কথা, অনেক কিছুই গোপন করে আছে আমার কাছে? তার নিজস্ব এবং ভিন্ন একটা জগত কি রয়েছে যেখানে আমার প্রবেশ নিষেধ? শমিতের ওপর বিশ্বাস হারাতে বসেছি আমি। ধনেপাতা এমন মহা কিছু খাদ্যদ্রব্য নয় যে আমাকে তা খেতেই হতো। শমিতের তা অপছন্দ হলে আমিও না হয় খেতাম না তা। 
পৃথিবীতে রকমারি খাবার-দাবারের অভাব আছে? পুরো এক সপ্তাহ কেটে যাওয়ার পরেও যখন আমি শান্ত হই না, মাথার মধ্যে অনবরত ঘুরপাক খায় প্রান্তের চতুর্দিকে ঝিরঝির করে কাটা গোলচে ধরনের সেই সবুজ পাতা-- অর্থাৎ ধনেপাতা, ইতোমধ্যে নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা প্রায় বন্ধ, সামান্য এ বস্তুটিকে কেন্দ্র করে, শমিত কিছুটা রাগান্বিত হয়ে পড়ে। সেদিন সকালে অফিসে যাওয়ার মুখে একটা কঠিন প্রশ্ন রেখে যায় সে আমার জন্য। শমিতের চরিত্রে বা শমিতের ভালো লাগার জিনিসের মধ্যে এমন কিছুই কী নেই যা আমি মোটেও পছন্দ করি না; কিন্তু মুখ বুজে সহ্য করে যাচ্ছি কেবল এই জন্য যে, হয় তা শমিতের বিশেষ পছন্দের, না হয় যার ওপর ভরসা করা বা বিশেষ আকর্ষণের ব্যাপারে শমিতের নিয়ন্ত্রণ নেই তেমন-- যা ধীরে ধীরে স্বভাবে বা পছন্দে প্রোথিত, কিংবা যা প্রাকৃতিক বা জেনেটিকভাবে পূর্বনির্ধারিত? ভাবনার জন্য বেশিদূর এগোবার আগেই আমি আবিষ্কার করি-- বাংলা ছায়াছবিতে শমিতের বিশেষ পছন্দের নায়িকা সুচিত্রা সেনের পুরনো ছবিগুলো, বিশেষ করে উত্তম-সুচিত্রা জুটির সেই রমরমা ছবি কয়েকটি যেমন অগি্নপরীক্ষা, সাগরিকা, শাপমোচন, হারানো সুর, পথে হলো দেরী। 
আমেরিকান ক্লাসিক্যাল ছবি দেখার ফাঁকে ফাঁকে পুনঃ পুনঃ রাত জেগে জেগে এ সব বাংলা ছবি দেখে শমিত এবং সে চায় আমিও তার পাশে বসে তারই মতো করে তা উপভোগ করি। সেসব ছবি দেখতে দেখতে মনে মনে আমি সেই আকর্ষণীয় মুখমণ্ডল ও দেহবল্লবির অধিকারী নায়িকা সুচিত্রা সেনের অতি-অভিনয় এবং ন্যাকামির জন্য যতই বিরক্ত হই না কেন, মুখে হাসি অক্ষুণ্ন রেখে আপাত আগ্রহের সঙ্গে ওর পাশে বসে সম্পূর্ণ ছবিটি ঠিকই দেখে যাই। আর সেটা করে এই ধারণা কি দিয়ে যাচ্ছি না শমিতকে যে সুচিত্রা-উত্তম জুটির হিট ছবিগুলো শমিতের মতোই আমারও খুব পছন্দের? তাহলে?


লেখক পরিচিতি........................।
পূরবী বসু
গল্পকার। প্রবন্ধকার। গবেষক।
গল্পকার জ্যোতিপ্রকাশ দত্তের স্ত্রী। 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ