জ্যোতিপ্রকাশ
দত্ত
একঃ
এক
জীবনে বারবার 'স্বাধীনতা'র স্বাদ
পাওয়া বড়ো কম কথা নয। যাঁরা
পেয়েছেন, তাঁরা জানেন।সাতচল্লিশের পূর্বে
জন্মেছি বলে আমিও ঐ মুক্তজীবনকামী স্বাপ্নিকদের দলে পড়ে যাই। শুধু
এইসবস্বপ্নপূরণ-কালের দিনরাত্রি
কি আনন্দে পালন করেছিলাম ঠিক-ঠিক মনে পড়ে না।
ঊনিশশো
সাতচল্লিশে 'স্বাধীনতা' ব্যাপারটি ঠিক বুঝিনি। আট
বছরই তো বয়স ছিলো। তাই ভারত কি পাকিস্তান কি
পূর্ব পাকিস্তান এমন কিছু আলাদা আলাদা কেও মনে থাকবার কথাও নয়।
কেবল
কিছু ঘটনার কথাই মনে পড়ে।
ছেচল্লিশের
দাঙ্গার সময়ে আমি গ্রামের বাড়ীতে। পাবনা
জেলার গভীরে একটি গ্রাম - এখন আর নেই, দীর্ঘ-কাল পূর্বেই যমুনা-গর্ভে বিলীন
হয়ে গেছে - সে-গ্রামের রাস্তায় ইউনিয়ন বৌর্ডের চেয়ারম্যান নাঈমুদ্দিনের ঘোড়া
ছুটিয়ে চলা মনে পড়ে এবং নদীর ধার দিয়ে চলে যাওয়া রাস্তায় জমায়েত গ্রামবাসীকে তাঁর
অভয়দানঃ মসজিদ থেকে বেরিয়ে হাতে লাঠিসোটা নেয়ার সঙ্গে দূর কলকাতার কোনো সম্পর্ক
নেই।কেবলই মহরমের মিছিল। তবুও
পাড়ার নারী ও শিশুদের শক্তপোক্ত নতুন কাঠের তৈরী ঘরে ভরে রাখা হয়েছিলো। এই। আর
কিছু মনে পড়ে না।
শুধু
মামাবাড়ী থাকাকালে এক বাজারির হাতে চাঁদ-তারা আঁকা চটের থলিতে 'পাকিস্তান'
শব্দটি লেখা দেখেছিলাম। শব্দটির
অর্থ কী ভেবে পাইনি। দ্বিতীয় শ্রেণীর ছাত্রই
তো।
তাই
সাতচল্লিশের 'স্বাধীনতা' মনে বিশেষ
কোনো ভাবের জন্ম দেয়নি কেনো ভাবলে দেখি কারণ আরো আছে।
সাত-আট
বছর-বয়সী সদ্য গ্রাম ছেড়ে আসা বালকের মুক্তদিনের কোনো স্বপ্ন থাকে
না। আমারও ছিলো না।সাতচল্লিশের
আগস্টে যখন শহর ছেড়ে চলে যাই বড়ো মামার পরিবারের সঙ্গে এক শেষ রাত্রির গাড়ীতে,কেনো
সে-যাওয়া জানতাম না। আমাদের শহর-যে পাকিস্তানে
পড়বে এবং পাকিস্তানে বাস কাম্য নয় ভেবেই বড়ো মামা তার পরিবার নিয়ে পাড়ি জমাচ্ছিলেন
অজানা ভিন্ন দেশে, তা-ও
জানতাম না। আমার ছোটো ভাইটির কি ঠিক
আমার বড়ো দিদিটির অবশ্য ঐ দলে পড়ার কথা ছিলো না। সবার
বড়ো দিদি সদ্য বিবাহিতা ও কলিকাতাবাসী, বড়দা তখনো গ্রামে, তাই আমাদের কোনো উপায়ও ছিলো না। মাত্র
কিছুকাল আগে পত্নীবিয়োগে অপ্রাপ্তবয়স্ক চারটি সন্তান নিয়ে পিতা দিশাহারা। বিভাগপূর্ব-কালে
যে-চাকরিটি ছিলো, তাঁর সেটিও অনিশ্চিত হওয়ার ফলে কোথায় থাকা, কোথায় যাওয়া তিনিও জানতেন না। সর্বকনিষ্ঠ
সন্তান তিনটিকে তিনি তাই পাঠিয়ে দিয়েছিলেন শ্যালকদ্বয়ের আশ্রয়ে। বড়ো
মামার ভালো হোমিওপ্যাথিক পসার ছিলো। ছোটো
মামা তাঁরই পদানুসারী। পসার হয়নি তখনও এবং তিনিই
ছিলেন আমাদের অভিভাবক।তবুও কোথায় রেখে যাবেন বুঝতে না-পেরে
বড়ো মামা তাঁর পরিবারের সঙ্গে আমাদের তিন ভাই-বোনকেও নিয়ে যান। পরে
অবশ্য আমরা দু-ভাই ফিরে এসেছিলাম ছোটো মামার কাছে। ছোড়দি
থেকে যায় বড়ো মামার কাছেই। এই রকম। সাতচল্লিশের
স্মৃতি এটুকুই। তবে মনে আছে, চন্দননগরে
(তখনও ফরাসী চন্দননগর) যে-আত্মীয়ের গৃহে আশ্রয় নিয়েছিলেন বড়ো মামা আমাদের সকলকে
নিয়ে, সে-বাসার
সামনের রাস্তায় সবুজ-সাদা-গেরুয়া রঙের পতাকা-সহ নানা মিছিল। মামা
অবশ্য বলেছিলেন, ভারত ও পাকিস্তানের কথা সামান্যই।
চন্দননগরে
বাসাটি ছিলো এক দূর সম্পর্কের মামার। পুরনো
দিনের সুড়কি-ইটের দালান তারই একটি অংশে বাস ছিলো তাঁর। একতলায়
দুটি ও দোতলায় একটি, এ-ছিলো
ঘরের সংখ্যা, রান্নাঘর-সহ। সেই
দু-ঘরের বাসায় আমরা ন'জন উঠেছিলাম। ছ'জনই
নাবালক-নাবালিকা। একটি বড়ো কাঁসার থালায়
ভাত মেখে আমাদের সকলের মাঝখানে রাখা হতো। সে-থালা
থেকে তুলে মুখে দেয়া। আহার্যের পরিমাণও ছিলো
সীমিত। ক্ষুন্নিবৃত্তি হওয়া
সম্ভব ছিলো না। হতোও না। সেখানে
কিছুকাল থেকে আমরা দু-ভাই চলে যাই কলকাতায় বড়দির নতুন সংসারে। জামাইবাবু
আইনজীবী, সৎ ও আদর্শবান ভদ্রলোক, সর্বদাই নানাপ্রকার জীবন-সংগ্রামের কথা বলতেন কিন্তু তার অষ্টমবর্ষীয় ও
ষষ্ঠবর্ষীয় শ্যালকদ্বয়-যে ঐসব গুরুত্ব শুনে নিজেদের গুরুভার মনে করতো, এ-খেয়াল ছিলো না।
ঊনিশশো সাতচল্লিশের আগস্টে গান্ধী কলকাতায়
ছিলেন বলে আমার বিশ্বাস। কেনো-না একবার দোতলা বাসে
যাওয়ার সময়ে যাত্রীদের মুখে শুনেছিলাম ওই রাস্তায় আমাদের বাসের পাশ দিয়ে তার গাড়ী
যাচ্ছে।আমার ধারণা, আমি দোতলা বাসের জানালা দিয়ে তাঁকে
গাড়ীর মধ্যে বসা দেখেছিলাম। চার-পাশে
লোক ভিড় করে আছে। ঐ-সময়ে, ঐ-মুহূর্তে গান্ধীজির সঙ্গে মিলিয়ে
ভারতের স্বাধীনতা-বিষয়ক কোনো চিন্তা আমার মনে আসেনি। বয়স
একটি ব্যাপার ছিলো নিঃসন্দেহে। ভাবি, আরও কিছু ছিলো কি?
স্বাধীনতার চিন্তা
কি বোধ কি ব্যক্তি-জীবনে তার উপলব্ধি ব্যক্তির দিন-যাপনের সঙ্গে সম্পর্কিত, এ-কথা
বলবার জন্যেই আমার বাল্যকালের কিছু তুচ্ছ ঘটনার উল্লেখ। আরও
আছে।
দুইঃ
সাদা
জামা, সাদা
প্যান্ট, সাদা
জুতো। কুচকাওয়াজে সামিল হওয়ার জন্য ঐ-রকম পোশাকই নির্দিষ্ট ছিলো।যাদের
ও-রকম শার্ট-প্যান্ট নেই, তাদের জন্যে সাদা কাপড় কিনার ব্যবস্থা করা
হয়েছিলো। সম্ভবতঃ খোলা-বাজারে তখন
কাপড় পাওয়া যেতো না, কি দাম
বেশি ছিলো, মনে
পড়ে না। সাতচল্লিশের দুয়েক বছর
পরেই তো।
সাদা
জামা প্যান্ট ছিলো না আমাদের, সাদা জুতো তো নয়ই। 'বাটা'র কালো 'নটি বয়' জুতো জোড়াই সম্বল। বাবাকে বলেছিলাম
প্যারেডে অংশ নেয়ার তীব্র বাসনার কথা। প্রতিদিন
বিকেলে আদালতের মাঠে মহড়ায় যেতাম নিয়মিতই, সে-তো তিনি দেখেছেনই। ভেবেছিলাম, নতুন
পোশাক আসবে ঠিক সময়েই। দু-ভাইয়ের
পোশাকের জন্য যতোটা কাপড় লাগে তার 'পারমিট'ও মিলেছিলো। এমনকি
একদিন বাবার সঙ্গে গিয়ে লংক্লথ আর সাদা জিন্সের কাপড় দেখেও এসেছিলাম। কিন্তু
ঐ পর্যন্তই। পূর্বদিন রাতেও খালি
হাতেই বাবা ঘরে ফিরে এসেছিলেন।
আমাদের
স্কুল থেকেও একটি দল মাঠে যাবে, জানতাম। সেখানে
প্যান্ট-শার্টের রং নিয়ে খুব একটা কড়াকড়িও ছিলো না। তবুও 'মুকুল ফৌজ'-এর সঙ্গে কুচকাওয়াজে
যাওয়ার বাসনা ছিলো, ঐ
ড্রাম আর সাইড-ড্রামটির জন্যেই। আমাদের
'ফৌজ'-এর অধিনায়ক নূরু ভাই ভাই কোথাও থেকে ঐ-দুটি
সংগ্রহ করেছিলেন। প্রতিদিন মহড়ার শেষে লাইন
দিয়ে দাঁড়াতাম আমরা ঐ-ড্রাম বাজানোর জন্য। ব্যবস্থা
হয়েছিলো ঐ-সামরিক বাদ্যযন্ত্রের পেছনে সাদা পোশাকে মার্চ করে যাবো আমরা।
প্রতিদিনের
জামা-প্যান্ট পরেই মাঠে গিয়েছিলাম সেদিন ভোরবেলায়। প্যারেডে
অংশ নেয়া হবে না জানতাম। তাই মাঠের পাশেই
দাঁড়িয়েছিলাম অন্য দর্শকদের সঙ্গে। 'মুকুল ফৌজ'-এর সহযোদ্ধারা 'মার্চ
ফরমেশনে' দাঁড়ানো। সামিয়ানার
নিচে বিশিষ্ট ব্যক্তিরা বসে আছেন। একবার
ঘরে ফিরে যাওয়ার কথা মনে এসেছিলো। যাবো
বলে পা-ও তুলেছিলাম মনে হয়, কিন্তু
ততোক্ষণে 'গেইম-স্যার' জহিরুল ইসলাম আমাদের দেখে ফেলেছেন। স্কুলের
দলটি মাঠের একপাশে দাঁড়িয়ে আছে, মাঝখানে
যাবে। স্পৌর্টস-মাস্টার আমাদের
দু-ভাইকে ধরে নিয়ে লাইনে দাঁড় করিয়ে দিলেন। দেখলাম
সেকশন বি-র ধেড়ে আহমদ (প্রতি ক্লাসে একবার ফেল করে উঠতো বলে ক্লাস সিক্সে এসে তাকে
ধরে ফেলেছিলাম) দড়ি দিয়ে একটি ড্রাম গলায় ঝুলিয়ে নিয়েছে। জহির
স্যার যোগাড় করেছেন, বুঝলাম। গলায়
ঝোলানোর বেল্টটি ছিঁড়ে গিয়েছিলো, আওয়াজটিও
বেজায় ঢপঢপে- মিউনিসিপ্যালিটি স্কুলের নিজস্ব কোনো সরঞ্জাম ছিলো না,ভালো
আওয়াজ পাওয়ার উপায় কি - তবুও প্রবল গর্বের সঙ্গে ঐ ড্রামের পিছনেই হেঁটেছিলাম আমরা।
বিকেলে
পার্কের মাঝখানে লাইব্রেরীর বারান্দায় বিচিত্রানুষ্ঠান হওয়ার কথা। পার্কে
ঢোকার মুকে ধেড়ে আহমদ দাঁড়ানো, লোক
জড়ো করার জন্যই বুঝি ড্রামটিকে বাজিয়ে চলেছে - গলায় দড়ি দিয়ে ঝোলানো অবস্থায়ই। অনেকক্ষণ
দাঁড়িয়ে দেখার পর 'আহমদ ভাই একটু বাজাবো' বলে এগিয়ে যেতে, সে হাতের ড্রামস্টিক সোজা বসিয়ে
দিয়েছিলো আমার বাহুতে।
প্রথম
স্বাধীন মুক্ত জীবন পালনের এই এক ছবি শুধু বারবার মনে আসে। এছাড়া
ঐ-কালে আর কোনও উল্লেখযোগ্য 'দিবস' পালনে অংশগ্রহণের কথা মনে আসে না। ঢাকা
বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়েও নয়।বিশেষ দিনে তোপখানা রৌডের
দিকে গেলে সেক্রেট্যারিয়েটের দালান ক'টিতে রঙিন আলো ঝুলতেও
দেখেছি, স্টেডিয়ামে
নাকি আতশ বাজিও ফুটতো, কিন্তু
আমি কোনোদিন দেখতে যাইনি।
তিনঃ
আটচল্লিশ
থেকে আটান্ন, এ-দশ
বছর বগুড়া শহরে কেটেছিলো নিরবচ্ছিন্ন। স্কুল
এবং স্কুলের শেষে কলেজ।স্কুলের শেষ দু-বছর এবং কলেজে শ্রমের
বিনিময়ে এক ব্যবসায়ীর কর্ম-সহায়ক হিসেবে দিন কেটেছিলো।দারিদ্র্য এবং বিমাতা, এ-উভয়
কারণে বাবার সংসারে থাকা যায়নি। আমার
ছোটো ভাইটিও পারেনি। আমার বড়ো ভাই তাকে নিয়ে
রামকৃষ্ণ মিশনের অনাথ আশ্রমে দিয়ে দেন। তাই
ব্যক্তি-জীবনে স্বাধীনতার বোধ কি চিন্তায় আমি যদি খুব পীড়িত না-হই, তাতে
আশ্চর্য হবার কিছু নেই। অথচ
ঐ-সময়েই জনকল্যাণ চিন্তা মনে স্থান পায়। নিরন্ন
মানুষ, দরিদ্রজন, বঞ্চিত কৃষক, নিপীড়িত শ্রমিক ক্রমে হৃদয়ে প্রধান হয় এবং ছাত্র-আন্দোলনের রীতি ও চরিত্র
অনুযায়ী সভা, মিছিল
ইত্যাদিতে সময় কাটলেও 'স্বাধীনতার স্বাদ' উপভোগ
করবার চিন্তাটি মনে কখনও স্থান পেয়েছে বলে মনে পড়ে না। খাদ্য, বাসস্থান, শিক্ষার বিনিময়ে কাজ, এ-জানা
ছিলো। কলেজের দু-বছরে অবশ্য
কাজের চরিত্র বদলায় এবং জনগণের কল্যাণ চিন্তায় কিছু সময় ব্যয় করা সম্ভব হয়। ঢাকায়
আসার পরেও অমনি ইসলামপুরে এক প্রকাশকের দোকানে সকাল-বিকাল প্রুফ দেখা, অন্তবর্তীকালে ক্লাস এবং তারই মধ্যে
সাহিত্যচর্চা কি তৎসম্পর্কিত কাজকর্ম, পত্রিকাদি প্রকাশ, এ-রকমই। ফাঁকে-ফাঁকে
অবশ্য যৌবন-প্ররোচিত কিছু কর্মকাণ্ডও ছিলো। এখানেও
স্বাধীনতা ভোগ কি সে-কারণে এক বিশেষ জীবনাচরণের অনুসারী ছিলাম, বলা যাবে না। ঊনিশশো
আটান্নর সামরিক শাসন ঘোষণার দিনে আমি ঢাকা থেকে সদ্য প্রকাশিত এক দৈনিক পত্রিকার
নৈশ-কালীন প্রুফ পাঠক ছিলাম। মহা
উত্তেজিত সম্পাদক অফিসে ঢুকে যখন বলেন, 'মার্শাল ল' জারী করা হয়েছে, আমি শুনেছিলাম 'মাশাল্লাহ'
জারী করা হয়েছে। ব্যাপারটি
কী, বুঝতে একটু সময় লেগেছিলো বলা যায় এবং সে-ঘটনার দুয়েকদিনের মধ্যে যখন দেখা
গেলো সারা শহরের ব্যবসায়ীরা তাদের বাতিল করা পুরনো মালামাল গুদাম থেকে নিয়ে এসে
মার্শাল ল'র অজুহাতে সস্তা দামে বিক্রি করে দিচ্ছে, তখন আমিও জলের দামে প্যান্টের কাপড় কিনবো ভেবে অন্য সকলের সঙ্গে লাইনে
দাঁড়াই হলের মাসিক দেয় পরিশোধ না-করেই। স্বাধীনতার চিন্তা
কোথাও স্থান পায় না।
ঊনিশশো
পঁয়ষট্টির সেপ্টেম্বরের কোনো দিনে প্রায়
বিদ্যুদ্দীপ্তির মতোই স্বাধীনতাহীনতা চিন্তাকে আলোড়িত করে। কালো
রাত্রির নগরী, বেতারে
উত্তেজনা, ক্রোধ, সংকল্পের সংমিশ্রণে প্রস্তুত
অনুষ্ঠানমালায় যখন উদ্দীপ্ত ঠিক তখনই দেশের বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন বাসায়
যাতায়াত শুরু করে। রাজারবাগ, শান্তিনগরে ডেকে নিয়ে নানা
জিজ্ঞাসাবাদও চলে।
এবং
যেদিন আমার পালক পিতা দেশবরেণ্য দার্শনিক অধ্যাপককে গ্রেফতার করে জেইলে নিয়ে যাওয়া
হয়,আমি না-কেঁদে পারিনি। অবশ্য
তাঁকে জেলে থাকতে হয়নি। কিছু শুভানুধ্যায়ীর
শেষ-মুহূর্তের চেষ্টা তাকে জেইল-গেইট থেকে ফিরিয়ে নিয়ে আসে।
ঐ-সেপ্টেম্বরেই
কোনো এক দিনে প্রথম স্বাধীনতা এবং দ্বিতীয় স্বাধীনতা সম্পর্কিত 'বাংলাদেশ' শব্দদ্বয় একত্রে উচ্চারিত হতে শুনি। কিঞ্চিৎ
বিমূঢ় এবং উত্তেজিত বোধ করলেও চিন্তাটি এতো নতুন এবং অবিশ্বাস্য মনে হয়েছিলো তখন
যে, ভাবনাটি সেখানেই শেষ হয়। সাতষট্টিতে
অনেক শ্রম তদবির ঘোরাঘুরি ইত্যাদির শেষে আন্তর্জাতিক পাসপৌর্ট মিলে। কয়েক
মাসের জন্য আমেরিকা যাওয়া হয়, এমনকি
একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়াও শুরু করি। ঐ-সময়েই
কোনো এক উপলক্ষ্যে আমার বিশ্ববিদ্যালয়ে পাকিস্তানী ছাত্রদের এক অনুষ্ঠান হয়। অনুষ্ঠানস্থলে
গিয়ে দেখি পূর্ব পাকিস্তান থেকে আমরা মাত্র দু-জন। লম্বা টেবিলে
পাঞ্জাবী, সিন্ধি, বালুচ ও পাঠানেরা। শ্রেণীর
শেষে আমাদের জায়গা মেলে। দু-জনে সারা সময় ঐভাবে
বসে থেকে ঘরে ফিরি। ঐ-জনসমাজের কেউ আগ্রহের
সঙ্গে একটি কথাও বলেনি আমাদের সঙ্গে। ঘরে
ফিরে মনে হলো পঁয়ষট্টির কোনো এক দিনে যে শব্দদ্বয়ের একত্র উচ্চারণ শুনেছিলাম, সেটি
একেবারে অবিশ্বাসযোগ্য নয়।
দ্বিতীয়
'স্বাধীনতার'র সব কথাই মনে আছে। থাকবেই
বা না কেনো! সত্তর-একাত্তরে দেশের বাইরে হলেও বাংলাদেশের স্বাধীনতা তখন কেবল ধারণা
নয়, তার
জন্য সর্বস্ব যাক, এ-চিন্তা সর্বব্যাপী। বাংলাদেশ
তখন চিন্তায় ও কর্মে বিস্তৃত। তবুও স্বাধীনতা ব্যক্তি-জীবনে
কি ব্যক্তির দৈনন্দিন জীবনে কী কাজ করে বুঝিনি।বিদেশে ছিলাম বলেই নিশ্চয। একাত্তরের
নয়-দশ মাস কি তার পরেও অনেকদিন বাংলাদেশের জন্য আন্দোলন কি সংগ্রাম, দেশের পত্র-পত্রিকা, নানা লোকজনের আসা-যাওয়া ইত্যাদিতে
নৈকট্য ও গর্ববোধ ছিলো। বাংলাদেশের নাগরিক পরিচয়
দেওয়ায় সর্বদা আগ্রহ ছিলো, তবুও
স্বাধীনতার পরিপূর্ণ বোধ জন্মেছিলো বলা যাবে না। সেটি
সম্ভবতঃ ঘটেছিলো প্রায় সাত বছর পরে দেশে ফিরার কালে।
লণ্ডনে
বাংলাদেশ বিমানে ওঠার মুখে বাংলায় অভ্যর্থনা, সিল্কের শাড়ি-পরা বাঙালী বিমান-বালার
স্বচ্ছন্দে বাংলায় কথা বলা, বিমানের
বিনোদন ব্যবস্থায় বাংলা গান কি বাংলায় ঘোষণা, বিমান-চালকের বাংলায় কথা বলা
ইত্যাদিতে 'এলেম নতুন দেশে' জাতীয়
চিন্তায় বুক ভরে গিয়েছিলো নিশ্চয়ই।
বিমান-বন্দরে
নামার পরেও তেমনি। দোকানের সামনে বাংলায় নাম
লেখা, দোকানের
নামেও বাংলা শব্দের ব্যবহার। বেতার-টেলিভিশনে
চিরায়ত বাঙালী সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, সরকারী কর্মচারী কি দোকান কর্মচারী
সবাই বাঙালী। ছেড়ে যাওয়া বন্ধু-বান্ধব, পরিজন সকলের সঙ্গে পুনর্সাক্ষাত। দেখি, সবাই জীবন আবার গুছিয়ে নিয়েছে। নতুন
উদ্যমের হাসিমুখের জীবন। স্বাধীনতার এ-রকম
অর্থই বুঝেছিলাম সেদিন নিশ্চয়।নিজ ভাষা ও সংস্কৃতির
অধিকার। স্বচ্ছন্দ জীবন
যাপনের অধিকার।
দীর্ঘকাল
এ-চিন্তায়ই বুক ভরে ছিলো। তাই প্রায় ন'টি মাস
ঘোরের মধ্যে কাটানো, যেনো
অচৈতন্যই।অনিকেত। স্বপ্নের মধ্যে
বাঁচা কেবল - মনে থাকবে না কেনো? তবুও
বাহাত্তরের মার্চ কি ডিসেম্বর কীভাবে পালন করেছি যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগোতে কি
কলাম্বিয়া-মিসৌরিতে, মনে পড়ে না। তার
পরের দীর্ঘ-কালেও নয়।ছিয়াত্তরের আগে তো দেশেই আসিনি। প্রবাসী
মুক্তিযোদ্ধা বলে বিশেষ কোনো সম্মান না-পেলেও স্বাধীনতার সংগ্রামে অংশ নিয়েছি
এ-বোধ ছিলো। গর্বও ছিলো। তবুও
একাত্তরে আমার আশ্রয় ও পিতৃস্নেহে বুকে টেনে নেয়া আশ্রয়দাতার চিহ্ন মুছে গেলে
অনেককাল দেশে আসা হয়নি। দেখিনি স্বপ্ন হাতে ধরা
গেলে সেটির কী-রকম চেহারা হয়। ছিয়াত্তর
থেকে ছিয়ানব্বই এ-কুড়ি বছরে আরও কয়েকবার দেশে এলেও ডিসেম্বরে কি মার্চে আসা হয়নি
কখনও। অনেক-কাল জানতাম না
কি-করে স্বপ্ন-পূরণের দিন পালন করা হয়। প্রবাসী
বাঙালী কেবল একটি আলোচনা সভা কি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করতে পারে। সে-অনুষ্ঠানে
সীমিত-সংখ্যক দর্শক কি বক্তার একজনও ছিলাম কখনও কখনও।
এবং
এ-কুড়ি বছরের প্রতি মার্চে কি ডিসেম্বরে দেশে থাকা যায় যাতে, তেমন
চেষ্টাও করেছি কয়েকবারই।মুছে যাওয়া আশ্রয়, ছড়িয়ে পড়া জীবন গোছানোর জন্যে কিছু
অবলম্বন তো চাই। কিছু পাই না। স্বচ্ছন্দজীবন-যাপনের
অধিকার সকলের ক্ষেত্রে সমান নয়-তবুও আশা ছিলো। বিদেশে
থাকলেও এরশাদ-পতনের আন্দোলনে অংশ ছিলো। তাই
দেশে গণতন্ত্র ফিরলে আবার এসেছিলাম। পূর্ব-বিশ্বাস
দৃঢ় করার জন্যে।একবছর পরে ফিরে যেতে হলেও প্রায় জেদের বশেই ফিরে আসি
আবার। সাতানব্বইয়ে। আর
যাবো না ভেবে বাসা নেই, জীবন
গুছাই ছাব্বিশ বছর-বয়সী স্বাধীন দেশে। দেখি, বুঝি।
এই
গেলো দশ বছরে বাংলাদেশে অনেক কিছু ঘটে। নববর্ষের
অনুষ্ঠানে বোমা ফাটে। সারাদেশ কাঁপতে থাকে আরও
অনেক বোমার বিস্ফোরণের শব্দে। দেখি
গণতন্ত্রের নানা পালা-বদল। জরুরী
অবস্থা। মন্ত্রীসভা বাতিল। সংসদ
বাতিল। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি। সাবধানে
পথ চলতে হয়। সন্ত্রাসীর বোমা-গুলিতে
মৃত্যুর খবর আর ছবিতে সংবাদপত্র সয়লাব। দুর্ঘটনাই
হোক, দুর্বৃত্তই
হোক, যে-কোনো মুহূর্তে জীবন সংশয়াকুল করে দিতে পারে। ছিয়াত্তরে
দেশে ফিরলে দেখেছিলাম মধ্যরাত থেকে কারফিউ। ঢাকা
থেকে নারায়ণগঞ্জ যেতে ভয় ছিলো রাত্রিকালে। সেদিন, এই এতোকাল পরেও আবার অমনি হয়। ঘরের
বাইরেই বেরনো যায় না।
তবুও
স্বাধীনতার অন্য কোনো অর্থ খুঁজে পাই না। ভাবি, সব স্বাধীন দেশই এমন সময়ের মধ্য দিয়ে
যায়।ভাবি, সব স্বাধীন দেশেই এমন ঘটতে পারে। রাজনীতির
ওঠা-নামা তো আছেই। বেশি কিছু না-পাল্টালেই
হলো।
ভাবি, স্বাধীনতা
তো নিজ ভাষা ও সংস্কৃতির অধিকার, নিজ
ইচ্ছানুযায়ী সামাজিক রাষ্ট্রিক সীমার মধ্যে জীবন পরিচালনার অধিকার, স্বচ্ছন্দ
জীবন যাপনের অধিকার। এই আমাদের চাওয়া। এর
বেশি কিছু নয়।
তাহলে
কেনো মনে হয় যে, আজ
না-হয় ঘর থেকে না-ই বেরুলাম। ঘরে
থাকলে মনে হয়, এই
বুঝি কেউ ঘর থেকে ডেকে নিয়ে যাবে। ঘর
থেকে বেরুলে মনে হয় ফিরবো তো।
প্রকাশিত গ্রন্থ 'পতিত মানবজমিন'-এর অংশ
0 মন্তব্যসমূহ