এক আশ্চর্য শীত সন্ধ্যায়

ইকবাল হাসান

তেমন মনোরম ছিল না সেই আশ্চর্য শীতসন্ধ্যা।
১৯৮৩ সালের ডিসেম্বর, হার কাঁপানো শীত নিউইয়র্কে আর এই শীত কাকে বলে শরীরে উদাহরণসহ বুঝিয়ে দিচ্ছে উত্তর থেকে ধেয়ে আসা তীব্র বাতাস ও তুষার। সবে মাত্র দু
মাস হলো উজান ঠেলে দুস্তর বাধা অতিক্রম করে আমেরিকার মাটিতে পা দিয়েছি। নতুন এলে যা হয়, কাউকে তেমন চিনি না, ফলে প্রায়ই একা ও নিঃসঙ্গ। কাজ আর বাসা এই করে কাটছে দিন। রাত কাটে নির্ঘুমে, সাত-পাঁচ ভেবে। আর মাঝে মধ্যে জানালার বাইরে আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখি, নিজের অনিশ্চিত ভবিষ্যতের ছেঁড়াখোঁড়া দৃশ্যচিত্র। 

এমন এক সময়, একদিন, আমার সঙ্গে জার্মানি থেকে আসা কাবুল নামে এক বন্ধু, খুবই সহজ-সরল টাইপ, জানালেন, এই শহরে বাংলাদেশের একজন লেখক থাকেন-- জেপি দত্ত নামে। শুনেছি তিনি নাকি মস্তবড় লেখক, চেনেন? আমি তো জীবনে নামও শুনিনি। আপনার তো আবার এক-আধটু লেখালেখির ব্যারাম আছে। আছে না? আপনি হয়তো চিনলেও চিনতে পারেন। 

পুরোপুরি নিশ্চিত না হলেও বুজতে পারলাম কার কথা বলছে। ফোন নাম্বার আছে? আমাকে বিস্মিত করে বন্ধুটি বল্ল, আছে। শুনেই আমার বুকের ভেতর লাফিয়ে উঠল আনন্দ-বিস্ময়ের এক আশ্চর্য শিহরণ। 

তো সেই অ-মনোরম নির্দয় শীত সন্ধ্যায়, আমাদের ঘরে তখনও ফোন আসেনি, বাতাস ও তুষার-বৃষ্টি উপেক্ষা করে বাইরের বুথ থেকে ফোন করলাম তাকে। আর সেই প্রথম ফোনালাপে ,পঞ্চুবাবু এইমাত্র মারা গেলেন, সোজাসুজি মরা- গল্পের প্রথম বাক্যটি আমি তাকে শুনিয়ে ছিলাম, চমৎকৃত করার জন্য নয়, তার গল্পের আমি যে নিবিষ্ট একজন পাঠক, এটি প্রমাণের জন্য। পরে জেনেছি, সেই সন্ধ্যায় যথেষ্টই আশ্চর্য হয়েছিলেন তিনি।

তখন পর্যন্ত জ্যোতি দার গ্রন্থ সংখ্যা ৩। দুর্বিনীত কাল (১৯৬৭),বহে না সুবাতাস এবং সীতাংশু তোর সমস্ত কথা (১৯৬৯) -এই তিনটি মাত্র গ্রন্থের সীমিত পরিসরে ষাট দশকের খ্যাতনামা গল্পকার ড. জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত যে অসামান্য প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছিলেন তা আজও আমাদের ছোট গল্পের ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে বিবেচিত। গল্পের জন্য ভাষা নির্মাণের দুরূহ কাজটি সাম্প্রতিককালের গল্পকারদের গল্পে প্রায় অনুপস্থিত। সেক্ষেত্রে কমলকুমার মজুমদার, সৈয়দ শামসুল হক, হাসান আজিজুল হক, আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের মতোই ভাষা নির্মাণের দুরূহ কাজটি জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত সযত্নে করে চলেছেন বলেই তার প্রতিটি গল্প স্বতন্ত্র, ভাষা ও বিষয়বৈচিত্র্যের কারণে বর্ণাঢ্য এবং উজ্জ্বল। মাঝখানে তিনি লেখেননি ১৬/১৭ বছর। একটি লাইনও নয়।

২.
পরিচয়ের পর নিয়মিত তার বাসায় আড্ডা বসত আমাদের। যারা আসতেন তারা সবাই নিজ নিজ ক্ষেত্রে যথেষ্ট খ্যাতিমান। প্রায় সবাই ডক্টরেট, একমাত্র আমি ছাড়া। আর অই জ্ঞানী সভায় নিজেকে মনে হতো দীপ্তিহীন, গভীর সমুদ্রে ভাসমান নৌকোর মতো, পলকা। 

ধারণা করি, কমা-সেমিকোলনহীন অই নিরন্তর আড্ডাই তাকে আবার লেখালেখির জগতে ফিরিয়ে নিয়ে আসে।
নতুন করে লেখালেখি শুরু করেন ১৯৮৮ সালে। আমাদের দেশের বিদগ্ধ পাঠক-পাঠিকারা যেন নতুন করে আবিষ্কার করতে সক্ষম হলেন এই অসাধারণ কথাশিল্পীকে। ১৯৯৩ থেকে ২০০০ সালের মধ্যে লেখকের পুনরুদ্ধার, উড়িয়ে নিয়ে যা কালমেঘ, ফিরে যাও জ্যোৎস্নায় ও প্লাবনভূমি প্রকাশিত হয়। জ্যোতিপ্রকাশ দত্তের গল্পসমগ্র প্রকাশিত হয় ২০০১ সালে। এরপর প্রকাশিত হয় যথাক্রমে-জলপরী তো নাচবেই (২০০২), গল্পকল্প ও বাঁচা মরার জীবন (২০০৫), না আলো না আঁধার (২০০৫), শ্রেষ্ঠ গল্প (২০০৮), নির্বাচিত গল্প (২০০৮), সময় ভোলে না কিছু (২০০৯)। 

জ্যোতিদার সঙ্গে বেশ কয়েকবার বোস্টন গেছি, উদ্দেশ্য কবি শহীদ কাদরীর সঙ্গে স্রেফ আড্ডা দেওয়া। সঙ্গে স্ত্রী পূরবী বসু (গল্প-প্রবন্ধ আর পুষ্টিবিজ্ঞান নিয়ে লিখে যিনি ইতিমধ্যেই যথেষ্ট বিখ্যাত) এবং মাঝে মধ্যে সাংবাদিক বন্ধু বদিউজ্জামান খসরু। বোস্টনের মলডেন শহরে এমনি এক আড্ডার রাতে, আমরা আসছি জেনেই বোধকরি শহীদ কাদরী আগেভাগে তার যাবতীয় বাংলা বইপত্র একটি কালো প্লাস্টিকের ব্যাগে পুরে বাথরুমের ক্লোসেটে লুকিয়ে রেখেছিলেন, সেবারই আমি, খুব আশ্চর্যজনকভাবে ১৬ বছর আগে গোপীবাগের বাসা থেকে হারিয়ে যাওয়া (আমার নাম-তারিখসহ) বুদ্ধদেব বসু অনূদিত বোদলেয়ারের কবিতার বইটি লুকোনো বইয়ের ব্যাগ থেকে উদ্ধার করি। 

৩.
একবার কবি ফরহাদ মজহার ও আমি গ্রান্ড সেন্ট্রাল থেকে শিল্পী কাদেরী কিবরিয়াকে নিয়ে গিয়েছিলাম জ্যোতি দার কিউ গার্ডেন হিলসের বাড়িতে। গানের আড্ডা হলো, বলতে গেলে প্রায় সারারাত, কাদেরী কিবরিয়া রবীন্দ্রসঙ্গীত শোনালেন। অপূর্ব ছিল সেই রাত। খ্যাতনামা কবি ফরহাদ মজহারও যে গানের প্রতিভা নিয়ে জন্মেছেন তা প্রমাণিত হলো যখন তিনি নিজের লেখা ও সুর দেওয়া কয়েকখানা গান বেশ আনন্দের সঙ্গে আমাদের শুনিয়ে দিলেন। কথাগুলো বুঝলাম বটে, তবে সুরের আগামাথা কিছুই বুঝলাম না। পরে অবশ্য শুনেছি, গান ফরহাদ মজহার নতুন গাইছেন না, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চত্বরে তার সাগরেদদের এসব গান ও সুর তিনি শুনিয়েছিলেন বহু আগেই।

আর একবার, আমি ততদিনে কানাডায়, নিউইয়র্কে কবিতা সম্মেলনে যোগ দিতে এসেছি। বন্ধু তারেক মাহবুব উদয় হলেন মধ্যরাতে, বললেন, চলেন জ্যোতিদার বাড়িতে হানা দিই। সঙ্গে সঙ্গে আমরা দুজন রাজি হলাম-- কবিবন্ধু সুরাইয়া খানম আর আমি। অই মধ্যরাতে জ্যোতিদার বাড়িতে হানা দিলাম আমরা তিনজন। দীর্ঘদিন পর সুরাইয়া খানমকে দেখে খুবই উৎফুল্ল হলেন জ্যোতিদা ও পূরবী। আড্ডার এক পর্যায়ে কথা উঠল লেখালেখি নিয়ে, প্রকাশনা নিয়ে। সুরাইয়া বললেন, কে বলছে আমি লিখি না। লিখে যাচ্ছি নিয়মিত। কিন্তু প্রকাশ করতে চাই না। লেখাটাই মুখ্য, প্রকাশ করা খুব জরুরি নয়। একথার সঙ্গে মোটেই একমত হলেন না জ্যোতিদা, বললেন, প্রকাশ যদি নাইবা করব তবে লিখব কেন? লিখিত নিজের উপলব্ধি, অনুভূতি অন্যকে জানানোর জন্য। আমি আমার শেষ লেখাটিও ছাপার হরফে দেখে যেতে চাই।

জীবনের সুর-ছন্দ-কথা ও কবিতার বৃত্ত ছেড়ে তারা দুজনেই আজ নির্বাসিত দূর কোনো নক্ষত্রালোকে।

একটি ভালো লেখা, কি গল্প কি কবিতা, লিখে ফেলার পর লেখক কবিদের চোখ-মুখে ফুটে ওঠে যে আলো, যে আশ্চর্য জ্যোতি-- হয়তো লিখছেন না বলেই অই সময় তেমন আলো আর জ্যোতির কাঙ্ক্ষিত প্রকাশ তার চোখে-মুখে কখনও দেখিনি; বরং তাকে দেখি, প্রায় ম্রিয়মাণ। তুষার ঝরা রাতের মতো সাবডিউড। ঘন অরণ্যের মতো ইনট্রোভার্ট।
তো একদিন হঠাৎ দেখি,তার চোখ-মুখে আলোর উদ্ভাস, জ্যোতির্ময় হয়ে উঠেছেন তিনি। এত আলো এলো কোত্থেকে-- এ মত ভাবছি যখন, জ্যোতি দা বললেন, ইকবাল, সুখবর একটা আছে।
আমি তার দিকে তাকিয়ে চোখ নাচিয়ে জানতে চাইলাম, কী জ্যোতিদা, খবরটা কী?
বলছি, বলছি। আগে বাসায় চলুন।
বললেন বটে, তবে এক সময় দেখলাম, বাসার বদলে আমরা যাচ্ছি ভিন্ন পথে, জ্যাকসন হাইটসের দিকে।
ভেতরে ভেতরে তর পাচ্ছি আমি সুখবরটি শোনার জন্য, আর জ্যোতি দা খুশিতে জ্যোতির্ময় হয়ে আছেন।
শাড়ির দোকানে ঢুকলাম আমরা, জ্যোতি দা খুব একটা দেখাদেখি না করেই একখানা শাড়ি কিনে ফেললেন। আমি অবাক! শাড়ি আবার কার জন্য?
আবার সাবওয়ে, এবার সত্যি সত্যি বাড়ির দিকে।

ভাবছি, জ্যোতি দা নিশ্চয়ই নতুন একটি গল্প লিখেছেন বহু বছর পর। বাড়িতে গিয়ে শোনা যাবে। যদি আমার অনুমান সত্যি হয়, তাহলে তো সেটা হবে, আশ্চর্য এক সুখবর।

জ্যোতিদা কিন্তু গল্পের ধার-কাছ দিয়েও গেলেন না, সহসা বললেন, পূরবী ফোনে কথাটা আজই জানাল। আমাদের ঘরে নতুন অতিথি (দীপন, জন্ম : নভেম্বর, ১৯৮৪) আসছে।

শাড়ির রহস্য এতক্ষণে আবিষ্কৃত হলো বটে। আর জ্যোতিদার আনন্দ-আলোতে একটু যেন উদ্ভাসিত হলাম আমিও।
জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত মন ও মননে অত্যাধুনিক, স্মার্ট, সজ্জন একজন আলোকিত মানুষ, যার জ্যোতির কাছে তুচ্ছ যেন বয়স, সময়। আজ সত্তরতম জন্মদিনে আপনার দীর্ঘায়ু কামনা করি আমরা, তসলি ও আমি।




লেখক পরিচিতি
ইকবাল হাসান
কবি। গল্পকার। উপন্যাসিক।
কানাডা প্রবাসী

কবিতাগ্রন্থ : অসামান্য ব্যবধান, মানুষের খাদ্য তালিকায়।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ