যা কবিতায় লেখা সম্ভব নয়--তাই গল্পে লিখি

মুজিব ইরম

-------------------------------------------
মুজিব ইরম কবি। কিন্তু গল্প লিখেছেন কবিতার বাইরে আরো কিছু কথা বলার জন্য। কবি বলেই সেগুলো ঠিক গল্প নয়--গল্পের বাইরে আরো কিছু রূপের জগত। মায়াময়। 
-------------------------------------------
মুজিব ইরম-এর জন্ম মৌলভীবাজার জেলার নালিহুরী গ্রামে, ১৯৬৯ সালে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলাসাহিত্যে স্নাতক সম্মান সহ এমএ।
কাব্যগ্রন্থ : মুজিব ইরম ভনে শোনে কাব্যবান ১৯৯৬, ইরমকথা ১৯৯৯, ইরমকথার পরের কথা ২০০১, ইতা আমি লিখে রাখি ২০০৫, উত্তরবিরহচরিত ২০০৬, সাং নালিহুরী ২০০৭, শ্রী ২০০৮, আদিপুস্তক ২০১০, লালবই ২০১১, নির্ণয় ন জানি ২০১২।


শিশুসাহিত্য : এক যে ছিলো শীত ও অন্যান্য গপ ১৯৯৯।
উপন্যাস/আউটবই : বারকি ২০০৩, মায়াপির ২০০৪, বাগিচাবাজার ২০০৫।
কবিতাসংগ্রহ : ইরমসংহিতা ২০১৩, এবং বাংলা একাডেমী থেকে নির্বাচিত কবিতার বই : ভাইবে মুজিব ইরম বলে ২০০৩ ।

পুরস্কার : মুজিব ইরম ভনে শোনে কাব্যবান-এর জন্য পেয়েছেন বাংলা একাডেমী তরুণ লেখক প্রকল্প পুরস্কার ১৯৯৬। বাংলা কবিতায় সার্বিক অবদানের জন্য পেয়েছেন সংহতি সাহিত্য পদক ২০০৯।
-------------------------------------------------------------------------------------------------------
১. গল্প লিখতে শুরু করলেন কেন?

মুজিব ইরম: আমি তো কবিতার লোক৷ কবিতায় যে ভূগোল, যে মানুষ, যে ভাষা আমি তুলে আনতে চাইছিলাম, অনেক স্বাধীনতা নেবার পরও কবিতার চৌহদ্দিতে তা সম্ভব হচ্ছিলো না বলেই গল্প লিখতে শুরু করেছিলাম সেই ২০০০ সালের কোনো এক শীতভোরে, যা আজও আমি শুশ্রুষা করে চলেছি৷

২. শুরুর লেখাগুলো কেমন ছিল?

মুজিব ইরম: ২০০০ সাল থেকে লেখা গল্পগুলোই আমার লিখিতো গল্প৷ এর আগের এক যুগ আমি তো কবিতায়ই মজেছিলাম। আর কোনো গল্প লেখা না-হলেও ঠিক এই সময় সীমায় তিনটি উপন্যাস আমি রচনা করেছি৷ কেনো না কবিতা বা গল্পের ফর্মেও ঠিক আমি যুতসই প্রকাশ ঘটাতে পারছিলাম না নিজেকে৷ বারকি, মায়াপির, বাগিচাবাজার, এই তিনটিকে আমি অবশ্য আউট বই বলে থাকি৷ সেই কিশোর বেলায় পাঠ্যবইয়ের বাইরে যা ছিলো, সবই ছিলো আউট বই৷ গার্জিয়ানদের চোখ ফাঁকি দিয়ে নিষিদ্ধ গন্ধম সম এই সব আউট বই আমাকে পড়তে হয়েছিলো৷ পাঠ্যবইয়ের ভিতরে তাই ঢুকে যেতো এই সব নিষিদ্ধ বই, নিষিদ্ধ সুন্দর৷
সেই থেকে অবচেতন মনে আউট বই লেখার এক গোপন বাসনা লালন করে এসেছি বলেই হয়তো গল্পগুলো লিখতে চেয়েছি বা চাইছি।

তবে অন্য অনেকের মতো মাধ্যমিক উচ্চমাধ্যমিক বয়সে আমিও কয়েকটি গল্প লিখেছিলাম অংকের রাফখাতায়। প্রেম আর বিপ্লব নিয়ে। এক দিস্তা কর্ণফুলি কাগজ খরচ করেছিলাম একটি আউট বই লিখে। গরীব নায়কের সাথে ধনীর দুলালীর প্রেম। সে এক মারাত্মক কাহিনী! ইতিহাসও বটে! আহা, সেই ইয়থ-পার্কার, সুলেখা কালির দিন! আউট বইয়ে মজে থাকার দিন! মায়ের লতাপাতা আঁকা ট্রাঙ্কে কর্পূলের ঘ্রাণে ওরা বেশ যত্নেই ছিলো। কবে যে সেই কর্পূর গন্ধের সাথে এগুলোও হারিয়ে গেলো, আজ আর কিছুই মনে পড়ে না।

৩. গল্প লেখার জন্য কি প্রস্তুতি নিয়েছেন? নিলে সেগুলো কেমন?

মুজিব ইরম: কবিতা লিখতে লিখতে একদিন আউট বই লিখতে শুরু করেছি, আউট বই লিখতে লিখতে গল্প। ওরা তো সব যমজ ভাই, যমজ বোন। কী করে আলাদা করে দেখি! এক জীবনে আমি তো একটা লেখাই লিখতে চেয়েছি। সেখানে শিল্পের আমদানী করা এই বিভাজন কী করে মানি! আর আমার শৈশব ছিলো কিচ্ছাময়। পাঠক হিসাবেও মনে হয় গল্প-উপন্যাসেই মজে থাকি। এসবকে কি গল্প লেখার প্রস্তুতি বলা যায়? জানি না। হয়তো বলাও যেতে পারে।

৪. আপনার গল্পলেখার কৌশল বা ক্রাফট কি?

মুজিব ইরম: এই প্রশ্নের উত্তর লিখতে গেলে দশে শূন্য পাইবার সম্ভাবনা আছে। অতএব শরমিন্দা এই আমি নিজের গল্পলেখার কৌশল বা ক্রাফট নিয়ে আর কী বলবো! প্রতিটি গল্প লেখা শেষ হলে পাঠককে ভগবান ভাবিয়া বলি: এই চেষ্টা আপনাদের করকমলে নিবেদিত হইলো। সাষ্ঠাঙ্গে প্রণাম হে না-দেখা পাঠক, আপনারাই হয়তো একদিন বলতে পারবেন অদমের এই গল্পলেখার কৌশল, এই বনেদী অসুখ।

৫. আপনার নিজের গল্প বিষয়ে আপনার নিজের বিবেচনা কি কি?

মুজিব ইরম: আমার নিজের কোনো বিবেচনা নাই। গল্পগুলো এমন ভাবে আসে, আমি না লিখে পারি না। গল্পের লোকজন আমার ঘুম হরণ করে, প্ররোচনা দেয়, ইন্ধন জোগায়, তাই লিখি। লিখে শরমিন্দা হই। ফেলে রাখি। ওরা আমায় ডাকাডাকি করে। নিদ্রা ভঙ্গ হয়। আর আমি আদর-যত্নে লেগে যাই। এই করে করে বেড়ে যাচ্ছে ওদের বয়স। এক দশকে তারা কতো রূপেই না হাজির হলো! হাজির হয়েই চলছে। মনে হয় বই আকারে বের না হওয়া পর্যন্ত রেহাই নেই। মনে হয় গল্পের কামলা হয়েই কাটিয়ে দেবো কাল।

৬. কার জন্য গল্প লেখেন? আপনি কি পাঠকের কথা মাথায় রেখে লেখেন? লিখলে কেনো লেখেন? আর যদি পাঠকের কথা মনে না রেখে লেখেন তাহলে কেনো পাঠককে মনে রাখেন না লেখার সময়ে?

মুজিব ইরম: নিজের জন্যই লিখি। হয়তো নিজেকেও লিখি। শৈশব কৈশোর লিখি। আমার লোকজন লিখি। তাদের বুলি ও গালি লিখি। স্বপ্ন ও বেদনা লিখি। রাগ ও ক্ষোভ লিখি। আর লিখতে লিখতে পাঠকের মুখ মনে পড়ে। কাউকে না কাউকে তো গল্প শুনাতেই হয়, যেভাবে এই অদম বালকবেলায় দূর গাঁও থেকে আসা ধানকাটা লোকদের কিচ্ছা শুনতে শুনতে নিজেই একদিন কিচ্ছাদার হবার স্বপ্ন দেখেছিলো। আহা সেই শীতকাল, আহা সেই বালকবেলা! কিচ্ছাদার হবার স্বপ্ন নিয়ে আজও আমি পাঠকের সামনে কাঁচুমাচু দাঁড়িয়ে থাকি। কবে যে আমি কিচ্ছাদার হবো!

৭. এখন কি লিখছেন? 

মুজিব ইরম: নতুন গল্প লিখছি না, তবে গল্পের পান্ডুলিপি তৈরি করছি। হয়তো মেলায় বেরুবে, অথবা বেরুবে না। গল্পগুলো লালন-পালন করে করেই তো কাটিয়ে দিলাম এক যুগেরও বেশি। মনে হয় কী যেন বাকি রয়ে গেলো। কী যেন ধরতে পারিনি! কী যে এক মায়ার ভিতর গল্পগুলো জাগল হয়ে উঠছে, আর আমি নাড়ির ভিতর টের পাচ্ছি তাদের আলগা হবার ধরন। আমার এই মায়ার গল্পগুলোকে কী নামে ডাকি! কী নামে যে ডাকি!! ডাক নামে আমি বড়ো বিভোর রয়েছি!

৮. আগামীতে কি লিখবেন?

মুজিব ইরম: যদিও আমি কবিতার লোক, আউট বই/গল্প-উপন্যাস পড়েই মনে হয় কাটিয়ে দিচ্ছি এই আলাভোলা জীবন, আর চেষ্ঠা করছি লিখে যেতে না-লেখা সেই আউট বই, যা আমি আজও এই বুকের ভিতর জিয়ল করে রাখি৷


বি.দ্র: সম্পাদক মহোদয়ের পাঠানো ১০০ মার্কের এই প্রশ্নপত্রের উত্তর লিখিতে লিখিতে হাফাইয়া উঠিয়াছি। সকল প্রশ্নের মান সমান: এই নীতি মাথায় রাখিয়াও প্রশ্নগুলোর প্রতি সুবিচার করিতে পারি নাই। তাই ডায়েরিতে পড়িয়া থাকা বছর পাঁচেক পূর্বের ২টি লিখা প্রাসঙ্গিক ভাবিয়া এইখানে হাজির করিয়া দিলাম। অপ্রাসঙ্গিক হইলে পাঠক/পাঠিকাগণ মাফ করিয়া দিবেন।
সংযোজন-১: বই পড়ার গল্প

মায়ের কাছে ৪টি বই খুব সমাদরে থাকে: কোরআন শরীফ, ওজিফা, বেহেস্তি জেওর বা নামাজ শিক্ষা ও বিষাদ সিন্ধু। একটু এদিক-ওদিক হলেই বুকে-চোখে চুমু খেয়ে বইগুলো বড়ো যত্নে তুলে রাখেন মা। প্রতিদিন বের করে পাঠ শেষে ঝেড়েমুছে আবার কাপড়ে মুড়িয়ে রেয়ালের পাশে রেখে দেন। আমরা বালকেরা অজু ছাড়া কিছুতেই ওগুলোতে হাত দিতে পারি না। মার পাশে বসে সকালসন্ধ্যা সুর করে পড়া কোরআন-ওজিফা শুনতে শুনতে ছন্দময় ঐশিক সুর আমাদের বালকমনে সমীহ আনে, মার মনে আনে প্রশান্তি। এই ধ্বনিময় অন্তমিল, এই না-বোঝা ভাষা এমন এক আবহ তৈরি করে, জায়নামাজে-বসা মায়ের মুখ এমন এক গুনগুনানি আনে, বালকমনে শুধু সমীহ আর ঘোরলাগা বাড়ে- এ কোন ওহি নিয়ে এলেন আমাদের আখেরি নবী, দ্বীনের পয়গম্বর!

এ হলো আল্লার বাণী রে পুত- পড়ো, ইকরা

বোনেরা উদান-মাদান মার পাশে বসে সুর করে বিষাদ সিন্ধু পড়ে। মায়ের চোখের জল আমাদের চোখে মিশে এ কোথায় নিয়ে যেতে চায়! কারবালা কি আমাদের ঘরেই আজ চলে এলো? কেনো এতো মাতম ওঠে দিলে? এ তুমি কী করিতেছো সীমার…হোসেনের খন্ডিত মস্তক হতে মরভূমির তপ্ত বালিতে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে টপ টপ…অর্থ, আহা রে অর্থ…অর্থই যতো অনর্থের মূল!

মার বুক কান্নায় গুমরে গুমরে ওঠে!

তীরবিদ্ধ ঘোড়া, দুলদুল, রমণী-বাহনের এমন রূপে কে তবে রক্ত ঝরায়? আমরা একবার তাকাই মেলা থেকে কিনে আনা দুলদুলের পোষ্টারে, আরেকবার বিষাদ সিন্ধুর প্রচ্ছদে। ফোরাতের জলের জন্য মার বুক শুকিয়ে হাহাকার নামে। বুবুরা পড়তে থাকে…

আমাদের চোখ কি তবে হয়ে ওঠে ফোরাতের জল?

কিন্তু ‘বেহেস্তি জেওর বা নামাজ শিক্ষা’ এ কোন বার্তা আমাদের বালকমনে অলৌকিক কষ্ট ছড়ায়? কে আর ১৮ হবার অপেক্ষা করে? দুপুরের ভাতঘুমের নীরবতায় নিষিদ্ধ পাতাগুলো পাঠ করি, আর ধীরে ধীরে লায়েক হয়ে উঠি। লুকিয়ে লুকিয়ে পড়ি, আর আমাদের দেহমনে নিষিদ্ধ সুন্দর আসে। ভিতরে ভিতরে বাড়তে থাকে অলৌকিক পাপ!

আমরা আউট বইয়ে মগ্ন হই।

হজমি বিক্রেতার কাছ থেকে কিনে রাখা ‘শেষ বিকালের মেয়ে’ আমাদের তৃষ্ণা বাড়ায়। ‘দস্যু বনহুর’ আর আমাদের ধরে রাখতে পারে না। নাওয়া-খাওয়া ভুলে আমরা ‘সুজাতা’ পড়ি, ‘দুদিনের দুনিয়া’ পড়ি। কিন্তু শহর থেকে আমাদের লজিং স্যার এ-কেমন আউট বই সাথে নিয়ে এলেন? আমরা তো রোমেনা আফাজ, আকবর হোসেন, সুবোধ-নিহার-ফাল্গুনীতেই মজে ছিলাম- তার টেবিলে কেনো পড়ে থাকে শেষের কবিতা, দেবদাস, শ্রীকান্ত, পথের পাঁচালি, পুতুল নাচের ইতিকথা, বিবর ও মা?

এই নাদান বালক বইগুলো দেখে, আর বড়ো বেশি মুগ্ধ হয়। কাকুতি-মিনতি করি, লজিং স্যারের দিল গলে। দিন নাই, রাত নাই, শরৎ নিয়ে ডুবে থাকলে এ কোন জগত আমাদের ভাসিয়ে নিয়ে যায়? আমরা শ্রীকান্ত হতে চাই। পৃথিবীর কোনো এক রাজলক্ষ্মীর জন্য আমাদের মন পোড়ে। আমরা কি তবে তার জন্যই পাঠক হয়ে উঠি?

সংযোজন-২: বই লেখার গল্প


আমাদের বাজারের ব্যাংক ম্যানেজার খুব গম্ভীর মানুষ। এমনিতেই আমরা হাইস্কুলগামী বালকেরা ম্যানেজার রুমের রাজকীয় টেবিলের নেমপ্লেট, কলমদানী, আর রঙ্গীন তোয়ালে মোড়া চেয়ারে বসা সুদর্শন ম্যানেজারের সাইন করা দেখতে দেখতে একদিন ব্যাংক ম্যানেজার হবার স্বপ্ন বাড়াই।

কিন্তু মেঝো ভাইর টেবিল একদিন স্বপ্নের রঙ পাল্টিয়ে দেয়।

মেঝো ভাইর রুম সবসময় তালাবদ্ধ থাকে। তালাবদ্ধ রুমের দিকে আমাদের মন-কান খাড়া রেখেও কোনো কুলকিনারা করতে পারি না। ওরা বন্ধুরা এক হয়। গল্প করে। গান শোনে। আউট বই পড়ে। আমাদের তখন গরুর রচনা নিয়েই ব্যাস্ত থাকতে হয়। গরু চতু্ষ্পদ জন্তু…খড়বিছালি খায়…মাঠে মাঠে চড়িয়া বেড়ায়…তাহাদের দুইটি শিং আছে- জপতে জপতে গার্জিয়ানদেরকে ভালো ছাত্র হবার জানান দেই। সাধু ও চলিত রীতির সংমিশ্রণ দুষনীয় জানিয়া রচনা পাঠে চোখকান সজাগ রাখতে হয়।

কিন্তু মেঝো ভাইর রুম আমাদের চোখকানে বিঘ্ন ঘটায়।

একদিন তালা মারতে ভুল হলে এক অজানা পৃথিবী দেখার লোভে সে-রুমে হানা দেই। এ কী তবে পড়ে আছে টেবিলে! এতো সুন্দর মুখ বইয়ের মলাটে থাকে! আমাদের পানসে পাঠ্যবই দেখে এর আগে ভাবতেই পারি নি। ফুলপাখি, লতাপাতা, তীরবিদ্ধ দুলদুল নয়, একেবারে জলজ্যান্ত হাস্য-লাস্যময়ী তরুণীর ছবি! ওপর পৃষ্ঠায় গালে হাত দেওয়া ব্যাংক ম্যানেজারের চিন্তিত চেহারা। তাহলে আমাদের ব্যাংক ম্যানেজারই এই পুস্তক রচনা করেছেন?

উত্তেজনা আরো এক ডিগ্রী বাড়ে।

গার্জিয়ানদের চোখ ফাঁকি দিয়ে ভূগোলের ভিতর লাস্যময়ী তরুণী ঢুকে গেলে পৃথিবীর সব নদীনালা, জলবায়ু, আউট বইয়ে লীন হয়ে যায়। প্রেমকাহিনী রেখে কে আর ভূমধ্যসাগরের জলবায়ু মুখস্ত করে? আহ, কী মন পোড়ানো কাহিনী! গরীব নায়কের সাথে ধনীর দুলালীর প্রেম। কতো অত্যাচার-অনাচার, তবু কি আর প্রেমিক মন বাঁধা মানে, না মানতে পারে? কিন্তু না মানুক, তাই বলে গরীব নায়কের সাথে ধনীকন্যার কি আর মিলন হয়, না হতে পারে? না, পারে না! আর পারে না বলেই পড়তে পড়তে বারবার কাঁদতে হয়। কাঁদতে কাঁদতে আবার পড়তে হয়।

বাস্তবে না হোক, আউট বইয়েও কি ধনীগরীবের মিলন হয় না, হতে পারে না?

এক দুপুরে জনৈক অভিঙ্গ হেডমাষ্টার প্রণীত সহজ রচনা শিক্ষা সিকায় তুলে বাজারমুখী হই। আল আমিন লাইব্রেরী থেকে এক দিস্তা কর্ণফুলি নিয়ে বলি- অংকের রাফখাতা বানাবো, টাকা দেবেন মেঝো ভাই। কালিকলম চাই। সুলেখা না ইয়থ জানতে চাইলে, ইয়থ কালিকলমই দিতে বলি। অবশ্য উইলসন আনার ইচ্ছা ছিলো, সাহস করে আর চাওয়া গেলো না। থাক, ইয়থই ভালো! বরং একটা লাল কালি তাতে যোগ করে নিই।

মেঝো ভাইর বাকির খাতায় অঙ্ক বাড়ে।

কাগজকলম তো আনা হলো। রঙ্গিন কালিও। কালো কালি দিয়ে লিখতে লিখতে ভুল হলে লাল কালি দিয়ে কাটাকুটি করা যাবে, শিরোনাম ও ডায়লগ লিখা যাবে। কিন্তু কাহিনী কোথায় পাই? ভাঁজ করা কর্ণফুলি টেবিলে বিছিয়ে বিমর্ষ হয়ে বসে থাকি। হঠাৎ কাহিনী মাথায় আসে। ম্যানেজারের মিলন না হওয়া নায়ক-নায়িাকাদের মিলন ঘটাতে হবে। ধনীর সাথে গরীবের মিলন। কিন্তু সমস্যা হলো ডায়লগ লিখি কী করে! ওরা যা বলে, তা যদি আঞ্চলিকতায় মিশেটিশে একেবারে আটপৌঢ়ে ভাষাই হয়ে গেলো, তাহলে বইয়ের ভাষার কি অপমান হবে না? আর এসব কথা লোকে শুনবেই বা কেনো, যদি বড় বড় কথা তাতে না থাকে? হোক না নায়ক গরীব, তাকে শিক্ষিত হতে তো বাঁধা নাই। আর শিক্ষিত হলে সে তো শিক্ষিত কথাই বলবে, কিন্তু শিক্ষিত ডায়লগ বানাই কেমনে?

বাঁচিয়ে দেয় লজিং স্যারের টেবিল।

স্যার সবে টিচার ট্রেনিং কোর্স পাশ করে ফিরেছেন। বড় বড় মহাজনদের বাণীর বই তার টেবিলে। বাণী চিরন্তনীও পাওয়া গেলো। প্রেম নিয়ে, ধনী-গরীব নিয়ে কতো কথা আছে- এসব কথা কি চালিয়ে দিলে হয় না?

নাওয়া নাই, খাওয়া নাই, সান্মাসিক পরীক্ষা সিকায় ওঠে। এক দিস্তা সাদাকাগজ ইউসুফ-জরিনার প্রেমকাহিনী নিয়ে পড়ার টেবিলে উত্তেজনা ছড়ায়। এতো খুচরা পাতা তবে কী করি? আবার বাজারে যাই। রিক্সার গ্যারেজ থেকে মোটা এক জোড়া নাটবল্টু কিনে আনি। কাগজগুলোর বাম কোনায় হলইদরি(হার্পুন)দিয়ে ছিদ্র করে নাটবল্টু টাইট করে আটকে দেই। গার্জিয়ানদের চোখ ফাঁকি দিয়ে মাধ্যমিক পড়ার টেবিলে এক সদ্যলেখা আউট বই স্বপ্ন হয়ে নামে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ