কুলদা রায়
দেশ থেকে পালিয়েই এসেছিলাম। সে সময়ে মনে হয়েছিল পালিয়ে এলেই বাঁচা যাবে। জীবনে বেঁচে থাকাটাই জরুরী।
মা এসেছিল তার মাস খানেক আগে। কিছু দিন থেকে গিয়েছে আমার কাছে। আমার শার্টের একটা বোতাম লাগিয়েছে। দুএকবার মাথায় তেল ডলে দিয়েছে। পাখা দিয়ে মাঝে মধ্যে বাতাসও করেছে ঘুমের মধ্যে। আমার মেয়েদের চোখে কাজল টেনেছে। তারপর নিয়ে গেছে বাইরে—বগুড়া রোডের পাশে যে চার্চবাড়িটি রয়েছে, তার পুকুর পাড়ে হেঁটে গিয়ে তুলে এনেছে হেলেঞ্চা শাক। তিঁত পুঁটি মাছ দিয়ে রেঁধেছে। আমার বড় মেয়ে খেয়ে বলেছে—মজার। কিন্তু ছোট মেয়েটি মুখ বাঁকা করে বলেছে, তিতা লাগে।
সে সময়ে মায়ের ইচ্ছে ছিল পিপ্পল শাক রান্না করবে। পিপ্পল শাক বাজারে পাওয়া গেল না। পাওয়া যেতে পারে বাবুগঞ্জে। সেখানে যাওয়ার সময় নেই আমার। আমি দৌঁড়াচ্ছি পাতার হাটে। ঢাকাতে। চাকরী ছাড়তে। পাশপোর্ট জন্য। টিকিটের জন্য। বাড়িতে ফিরে যাওয়ার সময় মা বারবার বলতে লাগল—বাবারে পিপ্পল শাক। পিপ্পল শাক। বড় মেয়েটা আমাকে বলেছিল, ঠাকুরমা যাওয়ার সময় কাঁদছিল।
বড় মেয়েটা এই কথা বলেছিল আমাকে দেশ ছাড়ার পরে। প্লেনেও নয়। প্লেন থেকে নামার সময়ে। প্লেনের দরজা খুলেছে। আমরা আকাশ দেখতে পাচ্ছি। আকাশটা পুরনোই। অচেনা নয়। সামান্য মেঘ আছে। একটু সাদা। একটু নীল। প্লেন থেকে যখন পা ফেলতে যাচ্ছি তখনই বড় মেয়েটা বলেছিল—জানো বাবা, ঠাকুরমা কাঁদছিল। কথাটা তখন ঠিক মত কানে আসেনি। অথবা শুনতে পেলেও বুঝতে পারিনি। বোঝার মত সময়ও ছিল না। তখনো পা মাটিতে পা পড়েনি। তখনো আমরা শূন্যে। ছোট মেয়েটা দিদির কথায় মাথা নেড়ে বলল, ঠাকুরমা কাঁদছিল। সত্যি সত্যি কাঁদছিল।
তখন পা রেখেছি। দেখতে পেয়েছি—এখানে এ মাটি অচেনা। এ মাটিতে পিপ্পুল শাক জন্মে না। তখন মনে হল—দেশ থেকে পালিয়ে বাঁচতে আসিনি। মরতে এসেছি। মা কাঁদছে। আমরা মরে গেছি।
বাইরে বেরিয়ে দেখতে পাই—গাছ নেই—গাছের কঙ্কাল রাস্তার দুপারে হাত তুলে দাঁড়িয়ে আছে। বাড়িগুলো শিশুদের হাঁতে আঁকা ছবি। রাস্তার দুপাশে স্তব্ধ গাড়ি। কিছু নড়ে না চড়ে না। লোকজন নেই। মাঝে মাঝে দুএকটি গাড়ি হুশ করে বেরিয়ে যায়। তাকে ঠিক গাড়ির মত মনে হয় না। মনে হয় কাঁঠালে পোকা চলে যাচ্ছে। এর মধ্যে বৃষ্টি পড়ে।
আমার ছোটো মেয়েটা বেশ ছোটো। সবে ছবি আঁকতে শুরু করেছে। সে এবার তার দিদিকে ডেকে বলল, জানিস দিদি, এই বৃষ্টিতে ঘরবাড়িরগুলো রং ধুয়ে যাবে। আরো জোরে বৃষ্টি পড়ে। গাছগুলোর গা বেয়ে দুএকটি কাঠবিড়ালী উঁকিঝুঁকি মারে। বড় মেয়েটা ঘর থেকে বেরিয়ে এসে কাঠবেড়ালীকে দেখে বলে ওঠে, কাঠবেড়ালী কাঠবেড়ালী পেয়ারা তুমি খাও। আমারে একটা দাও।
কাঠবিড়ালীটি ওদেরকে পুটুস পুটুস করে দেখে। তারপর বাড়িটির পিছনে দৌড়ে চলে যায়। আমার মেয়েরা মনে করেছে কাঠবেড়ালী পেয়ারা আনতে গেছে। ওরা বাইরে বসে থাকে পেয়ারার আশায়। এ বাড়ির বুড়ি জানালা দিয়ে তাদের দেখতে পেয়েছে। বাইরে তাড়াহুড়া করে বের হয়ে বেরিয়ে এলো। বলল, তোমরা এখানে কেনো। ঘরে আসো।
ওরা বুড়ির কথা কি বুঝল কে জানে। ছোটো মেয়েটা বলল, আমরা পেয়ারা খাব।
বুড়ি ঘর থেকে দুটো ফল এনে দিল মেয়ে দুটোকে। বড় মেয়েটা কিছুক্ষণ ফলটিকে ধরে রাখল। ছোটো মেয়েটা কুটুস করে একটা কামড় দিল। বলল, দিদি—সত্যি সত্যি পেয়ারা।
বড় মেয়েটা ততক্ষণে থাঙ্কু বলতে শিখেছে। নিজে কামড়ে খেতে খেতে বলল, আমাগো মামাবাড়ির পরের গ্রাম আটঘর কুড়িয়ানা। সেখানে পেয়ারা বাগান আছে। সেই বাগানের পেয়ারা তুমি পাইলা কোথায়।
বুড়ি হাসে। বলে, নট পেয়ারা-পিয়ার। পিয়ার। সেই থেকে আমার মেয়েদের কাছে বুড়িটি পিয়ার বুড়ি হয়ে গেল।
এর মধ্যে আমার মেয়েদের স্কুলে নিয়ে যাই। বড় মেয়ে একটু বড় বলেই স্কুল ধরতে পারে। ছোটোটা ক্লাশে চুপ করে চেয়ে থাকে। বাইরে মরা গাছে কুঁড়ি পাতা ধরতে শুরু করেছে। কাগজে সেই কুঁড়ি পাতাটির ছবি আঁকে। ঘাসের মধ্যে ছোটো ছোটো বুনো ফুল ফুটছে। সেই বুনো ফুলের ছবি আঁকে। পাপড়িতে একটু লাল রং লাগায়। গাছের গোড়ায় দুটো পিঁপড়ে উকি দিচ্ছে। এই পিপড়ের রঙ কালো। এদের কামড়ে বিষ নেই। পিঁপড়ের চোখে একটু নীল রঙ দেয়। পিপড়েগুলো খুব দুষ্টু। ওদের মামীর চিনি খেলে ফেলে। এর পর একপাশে একটা জানালা দিয়েছে।
জানালার দিকে থাকতে থাকতে আমার ছোটো মেয়ের চোখে জল নেমে আসে। তাঁর টিচার ছুটে আসে। বলে কি হয়েছে?
মেয়েটি তার কথার উত্তর দেয় না। এর পরে একজন বাংলা শিক্ষককে নিয়ে আসে স্কুলের প্রিন্সিপাল। বাংলার শিক্ষক মিস রায়হান জিজ্ঞেস করে তুমি কাঁদছ কেনো? মেয়েটি এবার ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করে। কাঁদতে কাঁদতে বলে—আমার খাতা। আমার খাতা।
আমার মেয়েটি দেশে ফাতেমা স্কুলে পড়ত। শিখেছে অ আ ই ঈ। এ বি সি ডি। ১ ২ ৩ ৪। এঁকেছে একটা কাক পাখির ছবি। কাক পাখিটা তখনো উড়তে শেখেনি। ছোটো। একটু মাথা বেঁকিয়ে আছে। তার চোখ দেওয়া হয়নি। ভেবে রেখেছে কদিন পরে দেবে। এর মধ্যে দেশ ছেড়ে চলে এসেছে। দেশ থেকে আসার সময়ে সেই খাতাটি আনা হয়নি। মেয়েটি কাঁদতে কাঁদতে বলে—সেই কাকটি এখন নিশ্চয়ই চোখের জন্য কান্নাকাটি করছে। সেই কাকপাখিটির কথা মনে করে এখন তার কান্না পাচ্ছে।
প্রিন্সিপাল তাকে একটি কাগজ এগিয়ে দিল। আর দিল এক বাক্স রঙ পেন্সিল। সঙ্গে দুটো ক্যাডবেরী। বলল, আমি তো কাক পাখি চিনি না। তুমি এঁকে দেখাও তো পাখিটা কেমন।
মেয়েটি তখন কাকটি আঁকল না। স্কুলের কাছেই একটা বড় পার্ক। সেখানে একটি বেঞ্চিতে কে একজন বসে বসে রোদ পোহাচ্ছে। মাথাটি উপরের দিকে ওঠানো—বেলা দেখতে চেষ্টা করছে। মেয়েটি আঁকল এই লোকটির ছবিই। তার মাথায় দিল একটু লম্বা চুল। মাথায় একটি সোনার মুকুট।
মিস রায়হান বলল, এইটা কি রাজা?
প্রিন্সিপাল হেসে বলল, দি কিং রুফু। মিস রায়হান বলল, এই পার্কটি রুফুস কিংএর নামে। তিনি রাজা ছিলেন না। ছিলেন বিখ্যাত আইনবিদ।
আমার মেয়েটি রুফুস কিংএর নাম শুনল কি শুনল না বোঝা গেলো না। সে মুকুট পরা রাজার পিঠে দুটো ডানা লাগিয়ে দিল। এবারে আর তাকে রাজা রাজা মনে হচ্ছে না। মনে হচ্ছে পরীরানী। রাজার চেয়ে তার পরী রানীই ভালো। তার ঠাকুমা পরীর গল্প করত।
প্রিন্সিপাল বলল, এই কি তোমার কাক পাখি? না, এটা কাকপাখি নয়। এবার পরীর মাথার উপরে ছোট্ট একটা কাকপাখি এঁকে দিল। নীল রঙ দিয়ে তার চোখ করল। ঠোঁট দুটো একটুকু ফাঁকা। নিচে লিখে দিল—কা-কা। অর্থ-- কেমন আছ।
প্রিন্সিপ্যাল পরদিন আমার ছোটো মেয়েটিকে নিয়ে ক্যাপ্টেন টিলি পার্কে গেল। পার্কটি গোলাকার। মাঝখানে একটি পরী ডানা মেলে দাঁড়িয়ে আছে। তার নিচে চারিদিকে অনেক সীগাল ঘুরে বেড়াচ্ছে। ছোটো মেয়েটি প্রথমে একটু ভয় পায়। দূরে দাঁড়িয়ে থাকে। প্রিন্সিপাল তাকে হাত ধরে পাখির মধ্যে নিয়ে আসে। কিছু বিস্কুট ছুড়ে ছুড়ে দেয়। পাখিগুলো দুলে দুলে ছুটে আসে। তাদের ঘিরে ধরে। প্রিন্সিপালের হাত থেকে বিস্কুট খেতে থাকে। আমার মেয়েটির ভয় ততক্ষণে কেটে গেছে। অবাক হয়ে পাখি দেখে। পৃথিবীর সব পাখিই সুন্দর।
সে পরীটির কাছে গিয়ে তাকে ঘুরে ঘুরে দেখে। সামনে থেকে দেখে। পেছন থেকে দেখে। ডানার দিকে চেয়ে থাকে। কান পেতে শোনে দুটো পাখি ডানার উপর থেকে চিড়িক চিড়িক শব্দ করে ডাকছে। এবার পরীটিকে তার চেনা মনে হয়। সে হেসে ওঠে।
রাতে শুনতে পাই—দুবোনে গল্প করছে। ছোটো মেয়েটি বলছে তার দিদিকে। কান খাড়া শুনি। বলছে, জানিস দিদি, এই দেশে কাক নাই।
দিদি বলে, কাক কি রে? বল--কাওয়া।
--হ্যা, কাউয়া—কা কা করে ডাকে। কাউয়া কাক। এদেশে কাউয়া কাক নাই।
দিদি হাই তুলে বলে, এইটা দেশ না—বিদেশ। এই বিদেশে কাক থাকতে নাই।
এরপর ছোটো মেয়েটি দিদির কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিস ফিস করে বলে, জানিস দিদি-- কাক নাই। কিন্তু চড়ুই পাখি আছে। আমি দেখছি—পরীর ডানার উপর। চিড়িক চিড়িক করে ডাকে আমাগো বাড়ির মত, সত্যি চড়ুই। চিনছি।
তখন দুবোনে চড়াই পাখির গল্প করে। মামাবাড়ির গল্প করে। মাসিবাড়ির গল্প বলে। বাবাবাড়ির কথা বলে। তাদের নদীটির কথা বলে, বলে—নদীর পাড়ের পরীটির কথা। সন্ধ্যা নামলে পরীটি দূর থেকে উড়ে আসে। চুল এলো করে একটা বটতলায় ঘুমিয়ে থাকে। তার চুলের মধ্যে এই সব চড়ুই পাখির বাসা। তখন মনে হয় পরীটি তার ঠাকুরমা। বড় মেয়েটি বলে, ওই পরীটা এখানে উড়ে এসেছে। আর চিন্তা নাই।
বলতে বলতে তাদের গলার স্বর ঘন হয়ে আসে। ঘুমিয়ে পড়ে। ঘুমের মধ্যে পরীটির মত হেসে ওঠে।
বুঝতে পারি—পরীটি এসেছে। নিশ্চয়ই হেলেঞ্চা শাকও আসবে। আসবে পিপ্পুল শাক। আবার বেঁচে উঠব। পালিয়ে মরা যায় না।
মা এসেছিল তার মাস খানেক আগে। কিছু দিন থেকে গিয়েছে আমার কাছে। আমার শার্টের একটা বোতাম লাগিয়েছে। দুএকবার মাথায় তেল ডলে দিয়েছে। পাখা দিয়ে মাঝে মধ্যে বাতাসও করেছে ঘুমের মধ্যে। আমার মেয়েদের চোখে কাজল টেনেছে। তারপর নিয়ে গেছে বাইরে—বগুড়া রোডের পাশে যে চার্চবাড়িটি রয়েছে, তার পুকুর পাড়ে হেঁটে গিয়ে তুলে এনেছে হেলেঞ্চা শাক। তিঁত পুঁটি মাছ দিয়ে রেঁধেছে। আমার বড় মেয়ে খেয়ে বলেছে—মজার। কিন্তু ছোট মেয়েটি মুখ বাঁকা করে বলেছে, তিতা লাগে।

বড় মেয়েটা এই কথা বলেছিল আমাকে দেশ ছাড়ার পরে। প্লেনেও নয়। প্লেন থেকে নামার সময়ে। প্লেনের দরজা খুলেছে। আমরা আকাশ দেখতে পাচ্ছি। আকাশটা পুরনোই। অচেনা নয়। সামান্য মেঘ আছে। একটু সাদা। একটু নীল। প্লেন থেকে যখন পা ফেলতে যাচ্ছি তখনই বড় মেয়েটা বলেছিল—জানো বাবা, ঠাকুরমা কাঁদছিল। কথাটা তখন ঠিক মত কানে আসেনি। অথবা শুনতে পেলেও বুঝতে পারিনি। বোঝার মত সময়ও ছিল না। তখনো পা মাটিতে পা পড়েনি। তখনো আমরা শূন্যে। ছোট মেয়েটা দিদির কথায় মাথা নেড়ে বলল, ঠাকুরমা কাঁদছিল। সত্যি সত্যি কাঁদছিল।
তখন পা রেখেছি। দেখতে পেয়েছি—এখানে এ মাটি অচেনা। এ মাটিতে পিপ্পুল শাক জন্মে না। তখন মনে হল—দেশ থেকে পালিয়ে বাঁচতে আসিনি। মরতে এসেছি। মা কাঁদছে। আমরা মরে গেছি।
বাইরে বেরিয়ে দেখতে পাই—গাছ নেই—গাছের কঙ্কাল রাস্তার দুপারে হাত তুলে দাঁড়িয়ে আছে। বাড়িগুলো শিশুদের হাঁতে আঁকা ছবি। রাস্তার দুপাশে স্তব্ধ গাড়ি। কিছু নড়ে না চড়ে না। লোকজন নেই। মাঝে মাঝে দুএকটি গাড়ি হুশ করে বেরিয়ে যায়। তাকে ঠিক গাড়ির মত মনে হয় না। মনে হয় কাঁঠালে পোকা চলে যাচ্ছে। এর মধ্যে বৃষ্টি পড়ে।
আমার ছোটো মেয়েটা বেশ ছোটো। সবে ছবি আঁকতে শুরু করেছে। সে এবার তার দিদিকে ডেকে বলল, জানিস দিদি, এই বৃষ্টিতে ঘরবাড়িরগুলো রং ধুয়ে যাবে। আরো জোরে বৃষ্টি পড়ে। গাছগুলোর গা বেয়ে দুএকটি কাঠবিড়ালী উঁকিঝুঁকি মারে। বড় মেয়েটা ঘর থেকে বেরিয়ে এসে কাঠবেড়ালীকে দেখে বলে ওঠে, কাঠবেড়ালী কাঠবেড়ালী পেয়ারা তুমি খাও। আমারে একটা দাও।
কাঠবিড়ালীটি ওদেরকে পুটুস পুটুস করে দেখে। তারপর বাড়িটির পিছনে দৌড়ে চলে যায়। আমার মেয়েরা মনে করেছে কাঠবেড়ালী পেয়ারা আনতে গেছে। ওরা বাইরে বসে থাকে পেয়ারার আশায়। এ বাড়ির বুড়ি জানালা দিয়ে তাদের দেখতে পেয়েছে। বাইরে তাড়াহুড়া করে বের হয়ে বেরিয়ে এলো। বলল, তোমরা এখানে কেনো। ঘরে আসো।
ওরা বুড়ির কথা কি বুঝল কে জানে। ছোটো মেয়েটা বলল, আমরা পেয়ারা খাব।
বুড়ি ঘর থেকে দুটো ফল এনে দিল মেয়ে দুটোকে। বড় মেয়েটা কিছুক্ষণ ফলটিকে ধরে রাখল। ছোটো মেয়েটা কুটুস করে একটা কামড় দিল। বলল, দিদি—সত্যি সত্যি পেয়ারা।
বড় মেয়েটা ততক্ষণে থাঙ্কু বলতে শিখেছে। নিজে কামড়ে খেতে খেতে বলল, আমাগো মামাবাড়ির পরের গ্রাম আটঘর কুড়িয়ানা। সেখানে পেয়ারা বাগান আছে। সেই বাগানের পেয়ারা তুমি পাইলা কোথায়।
বুড়ি হাসে। বলে, নট পেয়ারা-পিয়ার। পিয়ার। সেই থেকে আমার মেয়েদের কাছে বুড়িটি পিয়ার বুড়ি হয়ে গেল।

জানালার দিকে থাকতে থাকতে আমার ছোটো মেয়ের চোখে জল নেমে আসে। তাঁর টিচার ছুটে আসে। বলে কি হয়েছে?
মেয়েটি তার কথার উত্তর দেয় না। এর পরে একজন বাংলা শিক্ষককে নিয়ে আসে স্কুলের প্রিন্সিপাল। বাংলার শিক্ষক মিস রায়হান জিজ্ঞেস করে তুমি কাঁদছ কেনো? মেয়েটি এবার ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করে। কাঁদতে কাঁদতে বলে—আমার খাতা। আমার খাতা।
আমার মেয়েটি দেশে ফাতেমা স্কুলে পড়ত। শিখেছে অ আ ই ঈ। এ বি সি ডি। ১ ২ ৩ ৪। এঁকেছে একটা কাক পাখির ছবি। কাক পাখিটা তখনো উড়তে শেখেনি। ছোটো। একটু মাথা বেঁকিয়ে আছে। তার চোখ দেওয়া হয়নি। ভেবে রেখেছে কদিন পরে দেবে। এর মধ্যে দেশ ছেড়ে চলে এসেছে। দেশ থেকে আসার সময়ে সেই খাতাটি আনা হয়নি। মেয়েটি কাঁদতে কাঁদতে বলে—সেই কাকটি এখন নিশ্চয়ই চোখের জন্য কান্নাকাটি করছে। সেই কাকপাখিটির কথা মনে করে এখন তার কান্না পাচ্ছে।
প্রিন্সিপাল তাকে একটি কাগজ এগিয়ে দিল। আর দিল এক বাক্স রঙ পেন্সিল। সঙ্গে দুটো ক্যাডবেরী। বলল, আমি তো কাক পাখি চিনি না। তুমি এঁকে দেখাও তো পাখিটা কেমন।
মেয়েটি তখন কাকটি আঁকল না। স্কুলের কাছেই একটা বড় পার্ক। সেখানে একটি বেঞ্চিতে কে একজন বসে বসে রোদ পোহাচ্ছে। মাথাটি উপরের দিকে ওঠানো—বেলা দেখতে চেষ্টা করছে। মেয়েটি আঁকল এই লোকটির ছবিই। তার মাথায় দিল একটু লম্বা চুল। মাথায় একটি সোনার মুকুট।
মিস রায়হান বলল, এইটা কি রাজা?
প্রিন্সিপাল হেসে বলল, দি কিং রুফু। মিস রায়হান বলল, এই পার্কটি রুফুস কিংএর নামে। তিনি রাজা ছিলেন না। ছিলেন বিখ্যাত আইনবিদ।
আমার মেয়েটি রুফুস কিংএর নাম শুনল কি শুনল না বোঝা গেলো না। সে মুকুট পরা রাজার পিঠে দুটো ডানা লাগিয়ে দিল। এবারে আর তাকে রাজা রাজা মনে হচ্ছে না। মনে হচ্ছে পরীরানী। রাজার চেয়ে তার পরী রানীই ভালো। তার ঠাকুমা পরীর গল্প করত।
প্রিন্সিপাল বলল, এই কি তোমার কাক পাখি? না, এটা কাকপাখি নয়। এবার পরীর মাথার উপরে ছোট্ট একটা কাকপাখি এঁকে দিল। নীল রঙ দিয়ে তার চোখ করল। ঠোঁট দুটো একটুকু ফাঁকা। নিচে লিখে দিল—কা-কা। অর্থ-- কেমন আছ।

সে পরীটির কাছে গিয়ে তাকে ঘুরে ঘুরে দেখে। সামনে থেকে দেখে। পেছন থেকে দেখে। ডানার দিকে চেয়ে থাকে। কান পেতে শোনে দুটো পাখি ডানার উপর থেকে চিড়িক চিড়িক শব্দ করে ডাকছে। এবার পরীটিকে তার চেনা মনে হয়। সে হেসে ওঠে।

দিদি বলে, কাক কি রে? বল--কাওয়া।
--হ্যা, কাউয়া—কা কা করে ডাকে। কাউয়া কাক। এদেশে কাউয়া কাক নাই।
দিদি হাই তুলে বলে, এইটা দেশ না—বিদেশ। এই বিদেশে কাক থাকতে নাই।
এরপর ছোটো মেয়েটি দিদির কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিস ফিস করে বলে, জানিস দিদি-- কাক নাই। কিন্তু চড়ুই পাখি আছে। আমি দেখছি—পরীর ডানার উপর। চিড়িক চিড়িক করে ডাকে আমাগো বাড়ির মত, সত্যি চড়ুই। চিনছি।
তখন দুবোনে চড়াই পাখির গল্প করে। মামাবাড়ির গল্প করে। মাসিবাড়ির গল্প বলে। বাবাবাড়ির কথা বলে। তাদের নদীটির কথা বলে, বলে—নদীর পাড়ের পরীটির কথা। সন্ধ্যা নামলে পরীটি দূর থেকে উড়ে আসে। চুল এলো করে একটা বটতলায় ঘুমিয়ে থাকে। তার চুলের মধ্যে এই সব চড়ুই পাখির বাসা। তখন মনে হয় পরীটি তার ঠাকুরমা। বড় মেয়েটি বলে, ওই পরীটা এখানে উড়ে এসেছে। আর চিন্তা নাই।
বলতে বলতে তাদের গলার স্বর ঘন হয়ে আসে। ঘুমিয়ে পড়ে। ঘুমের মধ্যে পরীটির মত হেসে ওঠে।
বুঝতে পারি—পরীটি এসেছে। নিশ্চয়ই হেলেঞ্চা শাকও আসবে। আসবে পিপ্পুল শাক। আবার বেঁচে উঠব। পালিয়ে মরা যায় না।
এই লেখাটি কোলকাতা হতে প্রকাশিত দৈনিক বর্তমান পত্রিকার প্রবাসে মহালয়া সংখ্যায় প্রকাশিত হয় অক্টোবর ৪, ২০১৩। লিংক
জন্ম : ১৯৬৫
বাংলাদেশের গোপালগঞ্জে। বরিশাল ও ময়মনসিংহের আধিবাসী।
লেখা পড়া ও পেশা : কৃষি।
গবেষণা : ধানের আমিষ বৃদ্ধি।
ব্লগার।
প্রকাশিত বই : কাঠপাতার ঘর
বাংলাদেশের গোপালগঞ্জে। বরিশাল ও ময়মনসিংহের আধিবাসী।
লেখা পড়া ও পেশা : কৃষি।
গবেষণা : ধানের আমিষ বৃদ্ধি।
ব্লগার।
প্রকাশিত বই : কাঠপাতার ঘর
দীর্ঘদিন নিউ ইয়র্কে প্রবাসী।
1 মন্তব্যসমূহ
Amader cele meyeder desh mane nana bari dada bari. Ki odbhut Tara helencha shak pippul shak chinbena, nana bari gelei ami rubi apar sate shak tulte jetam. Rubi apader jouto songsar, dupur bela 5kg mangsho ranna hole somoymoto kete na bosle vagge sudui jhul ! Tai se cheri shak er bebostha rakto.....amar husband tader sobji bicrai porsinir chagol dhukiye kete dito alu bakorer pata, kochi lauyyer chara.....ki durvaggo amader cele meyeder sei suvaggo hobena kunodin. Tai desh e jabar pordin e tader kali paye cere dei utane, Tara huchot Kai, hat pa Kate , pet beta hoy, rude e pure tamate hoy kintu kade na, r amra tader sorirer dag gulu souvagger chinho hisabe dhore fhire asi por desh e , sontander desh e
উত্তরমুছুন