আমি খুব সচেতন থাকি, গল্পটি যেন বিশ্বাসযোগ্য হয় এবং সেটি যেন কমিউনিকেটিভ হয়

আহমাদ মোস্তফা কামাল


গল্পপাঠ
গল্প লিখতে শুরু করলেন কেন?

আহমাদ মোস্তফা কামাল : 
ভেবেচিন্তে শুরু করিনি তো, কীভাবে যেন শুরু হয়ে গেছে। গল্পটা আমি অনেকবার বলেছি, আবারও বলা যায় বোধ হয়। শুরুটা তেমন আহামরি গোছের কিছু নয়। ছোটবেলায় অনেকের মধ্যেই যেমন লেখার ঝোঁক থাকে, আমার মধ্যেও সেটা ছিল, যার প্রথম প্রকাশ ঘটে স্কুল ম্যাগাজিনে। তখন স্কুল থেকে ম্যাগাজিন বেরুতো, বার্ষিকী যেটাকে বলে, স্থানীয় বিভিন্ন ক্লাব থেকে ম্যাগাজিন বেরুতো -- এই ধরনের চর্চাটা ছিল। তো, স্কুলের ম্যাগাজিনের জন্য লেখা আহ্বান করা হলো। আমি লিখলাম -- গল্প-প্রবন্ধ লিখলাম, কবিতাও লিখলাম।

আমার একজন শিক্ষক ছিলেন, খুই প্রতিভাবান এবং অসম্ভব জ্ঞানী, যাঁর কথা আমি বহুবার নানা জায়গায় বলেছি এবং আমি আমার একটা বইও উৎসর্গ করেছি তাঁর নামে-- হরিপদ সূত্রধর। তিনি আমার বাংলা সাহিত্যের শিক্ষক ছিলেন এবং স্কুল ম্যাগাজিনের সম্পাদক ছিলেন। আমার গল্প-কবিতা-প্রবন্ধ সবই তিনি পড়লেন এবং গল্প ও প্রবন্ধ দুটোই রাখলেন, কবিতাটা রাখলেন না। বললেন-- কবিতার ব্যাপারটা ঠিক বলা যায় না, তবে তুই যদি গল্প নিয়ে লেগে থাকিস, তোর হবে। আর হ্যাঁ, প্রবন্ধটাও ভালো লিখেছিস। তিনি তাঁর ভাষায় বলতেন-- লেগে থাকলে হবে রে, তোর হবে। খুবই অল্প বয়সের একটা ছেলেকে তাঁর শিক্ষক ভবিষ্যদ্বাণী করছেন-- তোর হবে! ব্যাপারটা অদ্ভুত না? তিনি তো আর অশিক্ষিত মানুষ নন, সমগ্র বাংলা সাহিত্যই তাঁর পড়া ছিল, সেই পারস্পেক্টিভ থেকে দাঁড়িয়ে তিনি হওয়ার কথা বলছেন একজন কিশোর ছাত্রের প্রথম লেখা পড়ে! সেটা আমার জন্য ছিল অনেক বড় অনুপ্রেরণা।

যাহোক, তিনি যেহেতু আমার কবিতার ব্যাপারে আশাবাদী ছিলেন না, আমি তাই কবিতাটা আস্তে-আস্তে ছেড়েই দিলাম, লিখলাম না। আমার কাছে কেন যেন মনে হলো, ওটা হচ্ছেই না। এরপর থেকে পরবর্তী টানা ৪/৫ বছর আমি গল্প লিখে গেছি। প্রকাশ করার কোনো ব্যাপার নেই, শুধু খাতার পাতা ভরিয়ে তোলা। তবে কোনোটাই ছোটদের লেখা নয়, সবই বড়দের গল্প। আমি কোনোদিনই ছোটদের জন্য গল্প লিখতে পারিনি, এ আমার এক বিরাট ব্যর্থতা।

যাহোক, ক্রমাগত লিখলেও পত্রপত্রিকায় পাঠানোর সাহস তখন ছিল না। দু-একটা লেখা পত্রপত্রিকায় পাঠানোর চেষ্টা করেছি, তেমন বিখ্যাত পত্রিকা নয়, একটু কম পরিচিত পত্রিকায়। এই যে বছর পাঁচেক ধরে ক্রমাগত লিখে যাওয়া -- সেটাই ছিল আমার প্রস্তুতিপর্ব, যদিও সেগুলো কখনো প্রকাশ করিনি এবং লেখার খাতাগুলোও নিতান্তই অবহেলায় হারিয়ে ফেলেছি। ইউনিভার্সিটিতে ফার্স্ট ইয়ারে পড়ার সময় আমার মনে হলো -- আমি আসলে লেখকই হতে চাই। সত্যি কথা বলতে কি, আমি জীবনে কিছুই হতে চাইনি, কোনো পরিকল্পনাও করিনি নিজের জীবন নিয়ে, শুধু একটা ব্যাপার পরিষ্কার করে বুঝতাম -- আমি লিখতে চাই, না লিখে আমি থাকতে পারবো না। তো, ওই সময় থেকে সাহস করে নামি পত্রিকায় -- যেমন বিচিত্রা, ইত্তেফাক, দৈনিক বাংলা কিংবা সংবাদ ইত্যাদি -- লেখা পাঠাতে শুরু করলাম। আমি এক অর্থে খুবই সৌভাগ্যবান যে, প্রথম থেকেই পত্রপত্রিকার কাছ থেকে সহযোগিতা পেয়েছি। ১৯৯২ কি ১৯৯৩ সালে, আমি তখন ইউনিভার্সিটিতে পড়ি, বিচিত্রা ঈদসংখ্যায় আমার গল্প ছাপা হলো। বিচিত্রার সম্পাদক ছিলেন শাহাদত চৌধুরী, আর সাহিত্য বিভাগ দেখতেন মঈনুল আহসান সাবের। তাঁর হাত দিয়েই আমার ঈদ সংখ্যায় লেখালেখি শুরু। ওই একই সময়ে ইত্তেফাকে ধারাবাহিকভাবে দীর্ঘ প্রবন্ধ লিখেছি অ্যাবসার্ড নাটকের ওপর। তো, এসব গল্প বলতে গেলে তো থামা যাবে না। তারচেয়ে বরং এটুকু বলে এই প্রসঙ্গের ইতি টানি -- ওই যে আমার শিক্ষক আমাকে লেগে থাকতে বলেছিলেন, আমি এখনো লেগে আছি। কিছু হচ্ছে কী না কে জানে!


গল্পপাঠ
শুরুর লেখাগুলো কেমন ছিল?

আহমাদ মোস্তফা কামাল : 
অত তো মনে নেই। পারিবারিক আখ্যান-নির্ভর কিছু গল্প, মা-বাবা-ভাই-বোনের কাছ থেকে শোনা মুক্তিযুদ্ধের কিছু গল্প, আবার তরুণ বয়সের ভয়াবহ আবেগ নিয়ে লেখা কিছু প্রেমের গল্প লিখেছিলাম বলে মনে পড়ে। বললাম না, লেখার খাতাটি হারিয়ে ফেলেছি! মাঝে মাঝে ওটার জন্য খারাপই লাগে। বেড়ে ওঠার চিহ্ন মুছে গেছে। যখন প্রকাশের জন্য লিখতে শুরু করলাম, তখন ওসব বিষয় কখনো কখনো ফিরে এসেছে, সঙ্গে অনিবার্যভাবে এসেছে রাজনীতি। তবে আমার প্রথম গল্পগ্রন্থের অধিকাংশ গল্প যতটা নয় আখ্যানপ্রধান, তারচেয়ে বেশি মনস্তাত্বিক গল্প।


গল্পপাঠ
গল্প লেখার জন্য কি প্রস্তুতি নিয়েছেন? নিলে সেগুলো কেমন? 

আহমাদ মোস্তফা কামাল : 
সচেতন প্রস্তুতি ঠিক নেয়া হয়নি। তবে আমার আগে লেখকরা কী ধরনের গল্প লিখেছেন, বা সমকালীন লেখকরা কী লিখছেন সেসব পড়েছি। রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে আমার সমকালের প্রায় সব লেখকের দু-চারটা গল্প আমার পড়া হয়েছে। কারো কারো সমগ্র পড়েছি। বিশ্বসাহিত্যের নানা ভাষার গল্প পড়েছি। বাংলায় অনূদিত হয়ে থাকলে বাংলায়, নইলে ইংরেজিতে। এই পড়াগুলো আমার কাজে লেগেছে নিঃসন্দেহে। আর ও ঐ-যে একটানা লিখে যাওয়ার কথা বললাম, সেটাও প্রস্তুতি হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।


গল্পপাঠ
আপনার গল্পলেখার কৌশল বা ক্রাফট কি? 

আহমাদ মোস্তফা কামাল : 
এটাও পরিষ্কারভাবে বলতে পারবো না। বিষয়ই আসলে কৌশল নির্ধারণ করে দেয়। লিখতে বসে যখন যে কৌশলে লেখার প্রয়োজন বোধ করি, সেই কৌশলেই লিখি। তবে আমার ভালো লাগে কথক ভঙ্গিটি। যেন পাঠকের মনে হয়, গল্পটা পড়ছি না, শুনছি। এবং আরেকটি বিষয়ে আমি খুব সচেতন থাকি, গল্পটি যেন বিশ্বাসযোগ্য হয় এবং সেটি যেন কমিউনিকেটিভ হয়। আমি মনে করি কথাসাহিত্যের ক্ষেত্রে এই দুটো বিষয়ই সবচেয়ে জরুরী। আমি বোধ হয় সেটা করতে সক্ষম হয়েছি। আমার অধিকাংশ পাঠকই মনে করেন, আমার সব গল্পই আত্মজৈবনিক। তার মানে তাদের কাছে গল্পটি পৌঁছেছে এবং বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়েছে।

গল্পপাঠ
আপনার নিজের গল্প বিষয়ে আপনার নিজের বিবেচনা কি কি? 

আহমাদ মোস্তফা কামাল : 
আমার নিজের কোনো বিবেচনা নেই। নানা-বিষয়ে নানা-আঙ্গিকে লিখে যেতে চেয়েছি, জীবনের চেনা-অচেনা নানা কোণে আলো ফেলে দেখবার চেষ্টা করেছি। এটুকুই। বাকিটা পাঠকরা জানেন।


গল্পপাঠ
আপনার আদর্শ গল্পকার কে কে? কেন তাঁদেরকে আদর্শ মনে করেন? 

আহমাদ মোস্তফা কামাল : 
অনেকেই। ছোট্ট একটা গল্পে যারা একটা জীবনের পূর্ণাঙ্গ ছবি উপহার দিতে পারেন, তাদেরকে মান্য করতেই হয়। রবীন্দ্রনাথ এবং মানিক তো আছেনই, বাংলাদেশে ওয়ালীউল্লাহ, আবু ইসহাক, সৈয়দ হক, হাসান আজিজুল হক, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, মাহমুদুল হক, মঈনুল আহসান সাবের, শহীদুল জহির, শাহাদুজ্জামান, খোকন কায়সার -- এঁদের গল্প পড়ে আমি গভীর আনন্দ পাই। এর বাইরেও অনেক লেখকে আছেন যাদের একটি-দুটো গল্পকে মনে হয়েছে পূর্ণাঙ্গ। দেশের বাইরে, কাফকা আমার অসম্ভব প্রিয় গল্পকার। আর বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে যখন আরো সহজ হয়ে উঠবার সাধ জাগছে, তখন ক্রমশ বোর্হেস প্রিয় থেকে প্রিয়তর হয়ে উঠছেন!


গল্পপাঠ
কার জন্য গল্প লেখেন?

আহমাদ মোস্তফা কামাল : 
জানি না কার জন্য লিখি। কখনো মনে হয় -- নিজের জন্য লিখি। মনে হয়, জীবনের দুর্বহ জটিলতাকে ভুলে থাকার একটা উপায় হিসেবে আমি লেখালেখিকে বেছে নিয়েছি। আবার কখনো মনে হয়, দেশের নানা সামাজিক-সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক ঘটনাসমূহে আমার প্রতিক্রিয়া জানানোর জন্য লিখি, কখনো বা মনে হয় -- আমি লিখি সেই অচেনা পাঠকটির জন্য যে আমার গল্প পড়ে নিভৃতে চোখের কোণ ভিজিয়ে তোলে। গল্প লেখার সময় আসলে কারো কথাই মনে থাকে না, পাঠকের কথা তো নয়ই, এমনকি নিজের কথাও নয়। একটা ঘোরের ভেতরে গল্পগুলো লেখা হয়ে যায়, যাকে আমি ব্যাখ্যা করতে পারি না। তবে লেখাটি প্রকাশের জন্য যখন দ্বিতীয়বার হাত বুলাই, মানে সম্পাদনা করি, তখন হয়তো পাঠকের কথা ভাবি। শব্দ ও বাক্যের পরিবর্তন করি, ক্রিয়াপদের ধরন ও অবস্থান নিয়ে ভাবি, হয়তো মনে হয় -- এই বাক্যটি এভাবে না লিখে অন্যভাবে লিখলে আরো বেশি আকর্ষণীয় ও কমিউনিকেটিভ হয়ে উঠবে -- এইসব। তবে এই চরিত্রটি লেখকের নয়, সম্পাদকের। একজন লেখকের ভেতরে এই দুই চরিত্রের বসবাস থাকে, তবে ভিন্ন ভিন্ন সময়ে তারা ক্রিয়াশীল হয়ে ওঠে।


গল্পপাঠ
এখন কি লিখছেন ? 

আহমাদ মোস্তফা কামাল : 
আমি তো সবসময়ই একাধিক লেখা নিয়ে থাকি, সুনির্দিষ্টভাবে এখন কী লিখছি বলা কঠিন। না লিখলেও নিদেনপক্ষে লেখার চিন্তার ভেতরে থাকি। যদিও ইদানিং বেশ ক্লান্ত এবং অবসন্ন লাগে। বিরতি এবং বিশ্রাম নিতে ইচ্ছে করে! কতকাল ধরে যে আমার জীবনে কোনো ছুটির দিন নেই!


গল্পপাঠ
আগামী কি লিখবেন ?

আহমাদ মোস্তফা কামাল : 
বেশকিছু গল্পের খসড়া করে রেখেছি, একটা উপন্যাস শুরু করেছি, কিছু গদ্য লিখবো বলে নোট নিয়ে রেখেছি -- লেখা হচ্ছে না। হয়তো যে-কোনো দিন আবার শুরু করে দেবো।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ