বই দেখার গল্প

মুজিব ইরম

সবেমাত্র প্রাইমারি টপকিয়েছি। এতোদিন পুরানা একব্যাগু রেডিওতে শুধু ‘হলুদিয়া পাখি সোনারই বরণ, পাখিটি ছাড়িলো কে’-তে কান অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে। পল্লীগীতির বাইরে যেন আর কোনো গানই হতে পারে না! এমন সময় ঘরে আসে ক্যাসেট প্লেয়ার, আর আমাদের বালক মনের বিভ্রম ভাঙ্গে। আমাদের চারপাশে তখন মালজোড়া গান বাজে। আমরা উঠতি বালকেরা এসব হাহাকার মর্মে গেঁথে ভাবি--আর কিছু নয়, পৃথিবীর ক্যাসেটে-ক্যাসেটে শুধু মালজোড়া গানই গীত হয়। ক্যাসেটে মালজোড়া-মুর্শিদি রেখে কে আর রেডিও শোনে? এসব বাউল গীতি, মুর্শিদি বাদে আর যা বাজে--আমরা তার খোঁজ রাখি না, অথবা এমনও হতে পারে--আমাদের গাউয়ালি কান ওসবে মজে না বা মজতে হয়তো চায়ও না। বাড়ির পাশে পড়শি রেখে কে আর অপড়শিরে খোঁজে?


কিন্তু একদা বাদ সাধল শহর।

শহরে বড়ো বোনের বিয়ে হলে বোনের সাথে কনেযাত্রি হই। গিয়ে দেখি ওদের শহরে মালজোড়া নাই, কী সব কাহিনি বাজে, আর বাজে গান ও হুল্লোড়। সমবয়সী বালক তখন কুহক জাগায়--মধুমালতী, জব্বর বই, যাবে নাকি দেখতে? বই, তা-ও মধুমালতী, ক্যাসেটে বাজে! বালক মন কিছুই আন্দাজ করতে পারে না। এতো আর রূপবান, গুনাই বিবি, বিনন্দের পালা নয় যে অভ্যস্ত মন হাহাকার ছড়াবে! এ হচ্ছে বই, তার মতে--রাধানাথ সিনেমা হলে আলো ঝলমল রূপালি পর্দায় যা নাচেগানে আনচান করায়।

সে আরো যা যা বলে--বালক মনে নিষিদ্ধ ডাক আসে, রাজি থাকি।

দুরু দুরু বুকে রাধানাথ সিনেমা হলের সামনে এসে দাঁড়াই! সঙ্গে তাকে সে। না, মধুমালতী কাল চলে গেছে, আজ থেকে চলছে বধুবিদায়। তাতে আমাদের বালক মনে আনন্দের কমতি নাই। ১৭ রিলের ছবি, শ্রেষ্টাংশে রাজ্জাক-কবরী-বুলবুল--বিরাট কাপড়ে টাঙ্গানো বইয়ের সিনারি দেখতে দেখতে তার চোখে উজ্জলতা নামে। কথা সে বলেই চলে। সবই তার মুখস্ত। কিন্তু এ অনভিজ্ঞ বালক এসব অজানা শব্দে বড়ো প্রশ্নবিদ্ধ হই।

--১৭ রিল কিতা?

--মধুমালতী আছিল ১৪ রিল, এ-বই আরো বড়ো, পরে কইমুনে, আগে লাইনে দাঁড়া। ডিসির পয়সা নাই, রিয়ালে দাঁড়াইছ ...

ডিসি, রিয়াল--মাথার ভিতর খেলতে থাকলেও আর কোনো প্রশ্ন আসে না, ঠেলেঠুলে লাইনে দাঁড়াতে হয়। মানুষের হাত-মাথার তেল-ময়লায় টিকেট ঘর হয়ে আছে টিকে-ঘর, ডিসি-রিয়াল কবেই উধাও, শুধু দেয়ালে রেখে গেছে তার অবিশিষ্ট ছায়া। বালক মনে উত্তেজনা বাড়লেও শ্রেষ্টাংশে রাজ্জাক-কবরী-বুলবুল--বিষয়টি গিলে ফেলতে হয়।

রিয়ালের টিকেট নিয়ে আলো-অন্ধকার রুমে ঢুকেই দেখি তাজ্জব কাগু! সত্যি সত্যি রূপালি পর্দায় নৃত্য করছে আগুনরঙ্গা নারী--আসিতেছে, ফারুক-কবরী জুটির আংশিক রঙিন ছবি সুখের সংসার!

আংশিক রঙিন মাথার ভেতর জট পাকাতে থাকে।

দেখতে দেখতে বই শুরু হয়ে যায়। চোখ আর নড়ে না। একটুখানি দেখো, একখান কথা রাখো, ভালোবাইস্যা একবার তুমি বউ বইল্যা ডাকো--কবরীর কণ্ঠ বালক মনে তোলপাড় তোলে। সে কানে কানে বলে--বুঝছস, কবরী নায়, গাইছে রুনা লায়লা, সাবিনা ইয়াসমিনও অইতে পারে, ঠোঁট মিলাইছে কবরী! কী বলে সে! যা ইচ্ছা, তাই হোক! কিন্তু কবরীকে বউ বইল্যা ডাকবে তো নায়ক? বিরতি হয়, মনে তবু শান্তি নাই-- কে আর চানাচুর-বাদামে মন ঢালে? কিন্তু এ কি, শেষপর্যন্ত মিলন হলো না, কবরীকে বউ বইল্যা ডাকলো না সে। ঘোড়ার গাড়ি করে জেলে চলে যাচ্ছে কবরী--চোখের জলে আমাদের বুক ভিজে যাচ্ছে। আমাদের বালক মনে কবরীর জন্য এক অনন্ত হাহাকার নিয়ে কান্না ভেজা চোখে রাধানাথ ত্যাগ করি। মিলন না-হওয়ার হাহাকার বুকের ভিতর ঘুমড়ে ঘুমড়ে ওঠে। মধ্যরাতে ঘুম ভেঙে যায়। কেনো মিলন হলো না, কেনো নায়ক তাকে বউ বইল্যা ডাকলো না!

আমাদের বালক বয়সের ঘুম ভিজে ওঠে কান্নায়।

দুপুরবেলা সে বলে--ধুর, এসব বানানো, কেউ একজন লেখে। তবু কি আর মন শান্তি পায়? মানুষ কী করে লেখে এসব! তাও না-হয় মানা গেলো--কিন্তু সত্যি সত্যি কি নায়ক নায়িকাকে এভাবে জড়িয়ে ধরেছিলো? না কি ক্যামেরার কারসাজি! অবশ্য এ-বিষয়ে সেও তেমন সন্দেহ মুক্ত হতে পারে না। তাই বালক মনে বই শুধু দিনমান তোলপাড় করে। রেডিও চালু করলে ভেসে আসে ভরাট কণ্ঠ--আজ থেকে সারাদেশে শুভমুক্তি জাফর ইকবাল-ববিতার ছবি, সোহেল রানার ফাইটিং অ্যাকশন ইত্যাদি ইত্যাদি। শুরু হয় কাহিনীর চমক! কিন্তু এসব তো ধরাছোঁয়ার বাইরে, চলে বড় শহরে, এ-শহরে আসতে আসতে আরো নতুন বই বেরিয়ে যাবে। কেনো যে নতুন বই রাধানাথে আসে না--এসব হাহাকারে সে অবসর ভারি করে।

তার সাথে কিছুতেই তাল মিলাতে পারি না।

সে চৌমুহনার পেপার বিপনী থেকে চুপি চুপি পূর্বানী, চিত্রালী কিনে আনে। উপুড় হয়ে দেখি। দেশ-বিদেশের নায়িকা বইয়ের ওপর মলাট হয়ে ভাসে। কিন্তু তাকেও তা লুকিয়ে রাখতে হয়, শহর হলে কী হবে, লজিং মাস্টার আর বাসায় মুরব্বি আছে না? সে খবর দেয়--পাশের শহরে ফারুক-কবরীর আংশিক রঙ্গিন সুখের সংসার এসে গেছে। চল, কাল পালাই!

কিন্তু রাত কি আর কাটে?

কবরীর জন্য আবারও কাঁদতে কাঁদতে রাত ভোর হয়।

আংশিক রঙিন বিষয়টি কিছুতেই বোধগম্য হয় না। সেও খোলাসা করে না। পাশের শহরে আমরা দুপুরবেলা লাপাত্তা হয়ে যাই। চিত্রালীর রঙ্গিন পর্দা আমাদেরকে নিমেশে বাকহীন করে। একি, এতক্ষণ তো সাদা-কালোই ছিলো, হঠাৎ নায়ক-নায়িকার চোখাচোখি হলো, আর নাচে গানে পর্দা একেবারে রঙ্গিন হয়ে উঠলো! সে বলে--রুনার লগে এন্ডুকিশোর গাইছে, ঠোঁট মিলাইছে ফারুক! কী জানি বাবা, যা ইচ্ছা তা হোক--বালক মনে তখন কল্পনার ডালপাখা ছড়ায়। ফারুককে হটিয়ে দিয়ে নায়িকার সাথে আমরাও পাহাড়-পর্বত নাচে-গানে একাকার করি। সহপাঠিনীর মুখ হঠাৎ কবরী হয়ে গেলো কেনো?

এবার আর বিরহ নয় মিলনের আনন্দ নিয়ে আমরা বাড়ি ফিরি।

সে বলে--কাইল প্রাণ-সজনী দেখমু, কল্পনায় আইছে। অঞ্জুর ছবি, দেখবে নে! তার গলায় রহস্য গড়িয়ে নামে। আমরা বিবাহ উৎসব তুচ্ছ করে কল্পনার খোঁজে আবারও লাপাত্তা হই।

শিশুকাল ছিলো ভালো, যৌবন কেনো আসিলো, বাগিচায় ফুল ফুটিলো কোকিল কেনো ডাকিলো--অঞ্জুর নাচে গানে পুকুরপাড়, নদীনালা, পাহাড়-পর্বত, নিচু গাছের ডাল, পুকুরের জল ভেঙে ভেঙে পড়লে আমরাও ভেঙে ভেঙে চৌচির হই। ওয়াসিমের ‘ডাক দিয়াছেন দয়াল আমারে, রইবো না আর বেশি দিন তোদের মাজারে’--বিরহী সুর আমাদের মন ভিজানোর আগে অঞ্জুর ‘যৌবন কেনো আসিলো’তেই মজে থাকি। আর ভাবি--আমাদের পড়শিনীরা কেনো যে হায় অঞ্জু হলো না!

শহর থেকে অন্য এক বালক হয়ে বাড়ি ফিরি। দেখতে না দেখতে রাজ্জাক-শাবানা, ফারুক-কবরী, অঞ্জু-আলমগীর, সোহেল রানা-ববিতা, রোজিনা-বুলবুল, জাফর ইকবাল, মাহমুদ কলি, জসীম, ওয়াসিম, জাম্বু, জাবেদ, মতি, দিলারা, বাবর, নতুন, এটি এম শামসুজ্জামান, আহমদ শরীফ আমাদের মুখস্থ হয়। শহর আমাদের ডাকতে থাকে। সহপাঠিদের সাথে কুসুমবাগে দিনের পর দিন লুকিয়ে লুকিয়ে বই দেখি আর কাহিনী বলাবলি করি। নায়িকারা নাচে গানে আমাদের বুক উচাটন বাড়ায়। সহপাঠিনী রূপে বাঞ্জারান আর চন্দন দ্বীপের রাজকন্যা আমাদের ঘুম হারাম করে, অন্ধ বধূর রোজিনার জন্য আমাদের রাতের বালিশ ভিজে ওঠে। কিন্তু ‘এই দুনিয়া এখন তো আর সেই দুনিয়া নয়’-এর হাহাকার বুকে ভিতর বাজতে থাকলেও একসময় বাঞ্জারানের ‘আমরা তো বাঞ্জারান, দেখাবো নাচ-গান’ আমাদের বুকে আবার উত্তেজনা ছড়ায়। চোখের সামনে, ঝর্ণার পাশে শাবানের ঘাগড়া খসে পড়লে, আমরা গাউয়ালি বালকেরা তার ধবল গোড়ালি দেখতে দেখতে ভাবি--কেনো যে ক্যামেরা আরেকটু উপরে উঠলো না, কেনো যে একটি দৃশ্যই বার বার দেখানো হলো না, যাচ্ছে তাই!

শাবানা, কবরী, অঞ্জু, রোজিনা, ববিতার ভিউকার্ড আমাদের নোটবইয়ের ভিতর নৃত্য করে। কিন্তু দিলারা, নতুনের জন্য আমাদের মন কেনো কেমন কেমন করে না? ওরা তো আর নায়িকা নয়--বন্ধুরা বলে। ওরা শুধু নাচে, আর বাবর, আহমদ শরীফ, জসীম, এটিএম শামসুজ্জামানের হাতে ইজ্জত হারায়। বাঁচাও বাঁচাও বললেও কেউ আসে না, শুধু বাংলার নবাব আনোয়ার হোসেন বড় ভাই হয়ে বুক চাপড়ায়। তা দেখে শিশু নায়ক বড় হয়ে ওঠে। তার জেদ বাড়ে। ভিলেনের হাতে একদিন নায়িকা ইজ্জত হারাতে বসলে, নায়িকার বাঁচাও বাঁচাও চিৎকারে সে হাজির হয়। ‘তোমাকে আর কেউ আজ বাঁচাতে পারবে না সুন্দরী’--ভিলেনের অট্টহাসি চাপিয়ে ডিশুম ডিশুম শব্দে হল কেঁপে কেঁপে ওঠে। ভিলেনের পতন হয়। হলের ভিতর তালি বাজে। নায়ক-নায়িকার নাচগান পুনরায় ফিরে আসে। পর্দায় ভাসে সমাপ্ত।

আমরা মিলনের আনন্দে বারবার বাড়ি ফিরি।

পৃথিবীতে সবকিছু তুচ্ছ করে শহরের প্রেক্ষাগৃহ আমাদেরকে ডাকতে থাকে। স্বজনের মৃত্যুর দাফনা দিয়ে কুসুমবাগের আলো-অন্ধকারে আমরা প্রেম আর নারী দেখি, চন্দন দ্বীপের রাজকন্যার যৌবন দেখি--অঞ্জুর দেহে পৃথিবীর জরা-মৃত্যু যেন নাই হয়ে যায়। নাচেগানে ভরপুর এতোসব জীবন রেখে কে আর মৃত্যুকে ডরায়?

কিন্তু নবাগত প্রিন্সেস টিনা খানের নদীবক্ষে মৃত্যু হলে আমাদের বালক হৃদয়ের এক টুকরো যেন সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুবরণ করে। কিন্তু তা কি আর স্থায়ী হয়? সমবয়সী বালক শহর থেকে চিঠি পাঠায়--বিডিআরে ইংলিশে ছবি চলছে, চলে আয়।
পেছনে পড়ে থাকে মালজোড়া গানের আসর, রূপবান, গুনাই বিবি, বিনন্দের পালা। বই দেখতে দেখতে আমরা একদা লায়েক হয়ে ওঠি, যেরূপ শিশু অঞ্জু নদীজলে ডুব দিয়ে ভেসে উঠতেই যৌবন কেনো আসিলো হয়ে যায়, যেভাবে শিশু শাবানা সখীসনে ফুল গাছের আড়াল থেকে বেরিয়ে আসলেই হঠাৎ যৌবন এসে নাচে-গানে পৃথিবী কাঁপায়।




------------------------------------------------------------------------------------------------
লেখক পরিচিতি
মুজিব ইরম

জন্ম মৌলভীবাজার জেলার নালিহুরী গ্রামে, ১৯৬৯ সালে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলাসাহিত্যে স্নাতক সম্মান সহ এমএ।
কাব্যগ্রন্থ : মুজিব ইরম ভনে শোনে কাব্যবান ১৯৯৬, ইরমকথা ১৯৯৯, ইরমকথার পরের কথা ২০০১, ইতা আমি লিখে রাখি ২০০৫, উত্তরবিরহচরিত ২০০৬, সাং নালিহুরী ২০০৭, শ্রী ২০০৮, আদিপুস্তক ২০১০, লালবই ২০১১, নির্ণয় ন জানি ২০১২।
শিশুসাহিত্য : এক যে ছিলো শীত ও অন্যান্য গপ ১৯৯৯।
উপন্যাস/আউটবই : বারকি ২০০৩, মায়াপির ২০০৪, বাগিচাবাজার ২০০৫।
কবিতাসংগ্রহ : ইরমসংহিতা ২০১৩, এবং বাংলা একাডেমী থেকে নির্বাচিত কবিতার বই : ভাইবে মুজিব ইরম বলে ২০০৩ ।

পুরস্কার : মুজিব ইরম ভনে শোনে কাব্যবান-এর জন্য পেয়েছেন বাংলা একাডেমী তরুণ লেখক প্রকল্প পুরস্কার ১৯৯৬। বাংলা কবিতায় সার্বিক অবদানের জন্য পেয়েছেন সংহতি সাহিত্য পদক ২০০৯।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

1 মন্তব্যসমূহ