মেহেদী উল্লাহ
------------------------------------------------------------------------------------------------------------
শুরু থেকেই গল্প লিখে পাঠকের নজর কেড়েছেন। ইতিমধ্যে জেমকম পুরস্কার পেয়েছেন একটি গল্পগ্রন্থের পাণ্ডুলিপির জন্য। বোঝা যায় তিনি লিখতেই এসেছেন। ফলে তার আলাপচারিতাও লেখার মত হয়ে ওঠে বিস্তারিত। নিজেকে সহজভাবে মেলে ধরতে স্বস্তি পান। দুই পর্বে গল্পকার মেহেদী উল্লাহ গল্পপাঠের কাছে তার ভুবন লিখেছেন। ---গল্পপাঠ
------------------------------------------------------------------------------------------------------------
১. গল্প লিখতে শুরু করলেন কেন?
এটা এক বিস্ময়! কিভাবে যেন জড়িয়ে পড়লাম! তবে ছোটবেলা থেকেই আমার গল্প শোনার ঝোঁক। আমার আম্মা কিংবা আব্বা অথবা নানী কিংবা মামারা যখন কারো সঙ্গে গল্প করতেন আমি গভীর মনোযোগ দিয়ে শুনতাম। অনেক সময় তারা আমাকে সরিয়ে দিতেন এই বলে,'বড়দের কথা শুনতে হয় না'। কিন্তু আমি নাছোড়, ছোট বয়সেই বড়দের অনেক কথা শুনে ফেলেছি। আমার আব্বা নিজের জীবনের জীবিকার তাগিদে অনেকটা 'উদভ্রান্ত উদ্বাস্তু' জীবন পার করেছেন। একবার নোয়খালী(নানাবাড়ি) তো একবার চাঁদপুর(দাদাবাড়ি) করেছেন।
বছরের ছয় মাস নোয়াখালী তো ছয় মাস চাঁদপুর। এভাবে যাওয়া আসার উপর থাকতাম। থিরতা ছিল না আব্বা-আম্মার জীবনে, তাই আমিও তাদের সঙ্গী। স্নাতক সম্মান পর্যন্ত আমার শিক্ষালয়ের সংখ্যা পনেরোর বেশি। ভেবে নিজেই অবাক হই। তবে এতে একটা সুবিধা হয়েছে,নানা রকম মানুষ দেখেছি, নানা ঘটনা দেখেছি। মানুষের জীবনের প্রতিটি মুহুর্ত আমার কাছে গল্প হয়ে ধরা দিতে চায়। সেখান থেকেই আমি সিদ্ধান্ত নিই, আসলে কোন গল্পটা লিখবো না। হাজারো গল্প বাদ দিই। আমার আব্বা বাংলার ছাত্র, শিক্ষকও। সে সূত্রে ছোটবেলা থেকেই পরিচয় সাহিত্যের সঙ্গে। চর্যাপদ, মধ্যযুগের কাব্যাদি আমি ক্লাস সভেন-এইটে থাকতে পড়েছি। রবীন্দ্রনাথ পড়েছি ছোটবেলায়। আমার আব্বার কাছে ময়মনসিংহ গীতিকার একটা কপি ছিল, এখনো আমার সংগ্রহে আছে সেটা। সম্ভত, আব্বা অনেক পছন্দ করতেন। ছোটবেলাতেই তার মুখে মহুয়া-মলুয়া পালা, কাজলরেখার গল্প শুনেছি। আব্বা মাইকেলের বর্ণাঢ্য জীবন ও সাহিত্য আমাকে সেই ছোটবেলাতেই শুনিয়েছেন। সবমিলিয়ে নিজের মধ্যে একটা সাহিত্য-পরিমণ্ডল গড়ে উঠেছিল। ছোটবেলায় কবিতা লিখতাম, আঞ্চলিক পত্রিকাগুলোতে (চাঁদপুর কন্ঠ) ছাপাও হয়েছে। ছোট ছোট ঘটনা লিখে পত্রিকায় পাঠাতাম, দুই-তিনশ শব্দের মধ্যে, গদ্যের একটা অনুশীলন ওখানে হয়ে গেছে। অবশ্য বিশ্ববিদ্যালয়ে ওঠার পর কবিতা আর লিখতে ভালো লাগতো না। পড়তেই তখন ভালো লাগতো। এখনো জয় গোস্বামী, শঙ্খঘোষ, শক্তি, বিনয়, সুকান্ত, জসীম উদদীন, শামসুর রাহমান, জীবনানন্দ দাশসহ অনেকের কবিতা পড়ি। যখন-তখন। আমরা নানাবাড়ি গেলে আমি ও আমার আম্মা দুচোখ ভরে পূর্ণদৈর্ঘ্য বাংলা ছায়াছবি দেখতাম। আমার আব্বাও দেখতেন। সিনেমার গল্পটা নিয়েই আমি সবসময় ভাবিত থাকতাম। প্রচুর ভূতের গল্প পড়েছি। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর দেখা হয়ে গেল অনেক তরুণ কবি-লেখকের সঙ্গে। আমার জন্য এটা একটা বর বলতে পারেন। মোহাম্মদ রফিক, খালেদ হোসাইন, সুমন সাজ্জাদ, তারেক রেজা, নওশাদ জামিল, পিয়াস মজিদ, নির্লিপ্ত নয়ন (আলতাফ শাহনেওয়াজ), গৌতম কৈরী, সাদিকা রুমন, শিমুল সালাহ্উদ্দীন, তৌহিদুল ইসলাম, ইমরান কামাল- এদের খুব কাছে যাওয়ার সুযোগ ঘটেছিল। এনারা সবাই কবি। আর তাত্ত্বিক তৈমুর রেজার সঙ্গও পেয়েছি। আমি কিছু লিখতে চাই-তাঁরা সেটা বুঝতে পেরেছিলেন। তাঁরা কেউই আমাকে শিখিয়ে দেননি গল্প কিভাবে লিখতে হয়। তবে তারা আমাকে সুস্পষ্ট দিক নির্দেশনা দিয়েছিলেন। পড়ার ব্যাপারে চাপ সৃষ্টি করেছিলেন, চিন্তার উন্মেষ ঘটিয়েছিলেন। একবার একটা গল্প লিখলাম। আমাদের ওখানে চল ছিল, কেউ কিছু লিখলে সবাইকে পড়ে শোনাতেন। সবার মন্তব্য লেখক মনোযোগ দিয়ে শুনতেন। তো সবাই লিখতেন কবিতা, অল্পতেই পড়ে ওঠা যায়, কিন্তু একদিন আমি লিখে আনলাম একটা গল্প, নাম 'কাছারি'। পড়ে অনেকেই মন্তব্য করেছিলেন। তারা আমাকে সামনের গল্পটি লেখার জন্য উৎসাহিত করলেন, এবং কার কার গল্প পড়তে হবে বলে দিলেন(কবি নওশাদ জামিল তো দশজনার একটা লিস্টও করে দিয়েছিলেন)। এভাবেই বুঝলাম, একদল কবির ভীড়ে আমি আসলে গল্পই লিখতে চাইছি। পড়াশোনার পাশাপাশি সাংবাদিকতা করতাম, সেখানে পরিচয় হল কবি অশোক দাশগুপ্তের সঙ্গে। এই মানুষটাই আমাকে গতানুগতিক চিন্তার বাইরে নিয়ে গিয়ে বোধের অন্য একটা স্তরে উপনীত হওয়ার সুযোগ করে দিলেন। বই দিতেন। উনি নিজেই মার্কেজের অনেকগুলো উপন্যাস বাংলায় অনুবাদ করেছেন, আমাকে পড়তে দিলেন। আমি নিজেও মার্কেজের উপন্যাস সংগ্রহ করে তাঁর প্রায় সব উপন্যাস পড়ে ফেললাম। শুধু চিন্তাই নয়, তিনি আমার রিজিকের ব্যবস্থাও করেছেন এই ঢাকার শহরে। যাক, সে অন্য প্রসঙ্গ। ঢাকাতেই পরিচয় হলো কবি শামীম রেজার সঙ্গে। তিনি তখন কালের কন্ঠের সাহিত্য সম্পাদক। আমিও কালের কন্ঠে কাজ করতাম, এখনো করি। তিনি অবশ্য পরবর্তীকালে পত্রিকা ছেড়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে শিক্ষক হিসেবে জয়েন করেছেন। তো, আমার এই প্রিয় কবি ও শ্রদ্ধেয় শিক্ষক আমাকে একদিন একটা কথা বললেন,'গল্প তো লেখ, পুরো পৃথিবীতে একই দিনে আরো অনেকেই লিখছে, ধরো যদি একশটা গল্পও লেখা হয়, তবে এত গল্পের ভীড়ে তোমার গল্পটা কেন মানুষ পড়বে, তুমি কি এমন লিখছো যে, তোমার গল্পটাই টিকে থাকবে?' আমি চিন্তায় পড়ে গেলাম। আজো সেই হুমকির মুখে পড়ে আছি আমি। এভাবেই গল্প লেখার জগতে আমন্ত্রিত হয়েছিলাম।
২. শুরুর লেখাগুলো কেমন ছিল?
আমি শুরু থেকেই চাইতাম, এমন গল্প এমন ভাবে শোনাবো, যা এর আগে কেউ শোনায় নি। পারলাম না মনে হয়! কাছারি লেখার পর দু'টি নিরীক্ষাধর্মী গল্প লিখলাম। ক বর্গের ধ্বনি এবং ম তে মডেল-মরদেহ। নিরীক্ষা করলেও এখন আবার গতানুগতিক আঙ্গিকের ভেতর গল্পকে রেখেই নিরীক্ষা করার চেষ্টা করছি। আসলে, নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে দুটো কাজ হয়। এক. পাঠকের হাতে নিজেকে অন্যরকম ভাবে সমর্পণ করা। দুই. পাঠককে 'নতুন বোতলে গদ্য রস পরিবেশন করা(যদি পাঠক গ্রহণ করে)। আমি চেষ্টায় আছি, আমার মতো করে কিছু দাঁড় করাতে- ভাষায়, আঙ্গিকে- দুই নিরীক্ষার মধ্যই দিয়েই। এই দু'টি গল্পের নিরীক্ষাকে এই ভাবে বিশ্লেষণ করি- বর্তমানে দেখছি তৃতীয় পক্ষের কার্যকারিতা বা ভেল্যু কমে গেছে। আরব বিশ্বে বা পৃথিবীর কোন যুদ্ধ-ফুদ্ধের সুরাহা করতে পারেনি নিষ্পত্তিকারী হিসেবে জাতিসংঘ। কার্যত, মধ্যম পক্ষের গুরুত্ব উহ্য। এক্ষেত্র ন্যারেটর মধ্যপক্ষ। সেও বাদ গেল, তাই রইল শুধু চরিত্র, তাদের দ্বন্দ্ব-সংঘাত, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ায় একটা গল্প বা বলতে পারেন প্লট। আমি যখন নিরীক্ষা করলাম, তখন অনেকেই বলেছে, শুধু সংলাপ, তা বাবা নাটক লিখলেই তো পার! এতে আমার কিছু এসে যায় না, কারণ, জাহাঙ্গীরনগরের এক রিকশা চালক গল্পটি শুনে বলেছেন, 'ভালাইত কাইজ্জা'! আমি মূল্যায়ন পেয়েছি। আমি জানি জগতের কাইজ্জা(ঝগড়া) নিরসনে মধ্যপক্ষ(ন্যারেটর) নেই বলেই তা চলেছে-চলবে। আসলে, শুরু নিয়ে আর কি বলবো! আমি তো মনে করি, এখনো আমার শুরুর পিরিয়ডই চলছে।
৩. গল্প লেখার জন্য কি প্রস্তুতি নিয়েছেন? নিলে সেগুলো কেমন?
প্রস্তুতি বলতে একটাই, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর থেকে শুরু করে মেহেদী উল্লাহ পর্যন্ত(হাঃ হাঃ) অনেকের গল্পই পড়েছি। পড়েছি এজন্য যে, তাঁরা যা যা লিখেছেন, তা যেন রিপিট না হয়। আর গল্পের ফর্ম বোঝা কিংবা ফর্ম ভাঙার জন্যও গল্প পড়ার বিকল্প নেই। মূলকথা হলো, রবীন্দ্রনাথ, তিন বন্দ্যোপাধ্যায়, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়, সুবোধ ঘোষ, বিমল কর, কমলকুমার, অমিয়ভূষণ, হাসান আজিজুল হক, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস এরা তো আছেনই সর্বশেষ শহীদুল জহির যেখানে শেষ করেছেন সেখান থেকেই আমাকে শুরু করা উচিত। যা তারা করেছেন-বিষয়ে, ভাষায়, আঙ্গিকে, সেসব করে ভীড় বাড়িয়ে লাভ কি। আমি যে দিন থেকে মনে করবো আর পারছি না, সেদিন থেকেই গল্প ছেড়ে দেব। উদাহরণ তো সামনে আছে। আমাদের অনেক প্রতিভাবান, আশির দশকের অনেক গল্পকার লেখা ছেড়ে দিয়েছেন। গল্প এবং গল্পকার দুটি সত্তারই হদিস নেই এখন! অনেক সময়, নতুনেরও যাতনা আছে, পাঠক রিসিভ না করলে আভাগার্ড তরুণটি হতাশার মধ্যে পড়ে। অবশ্য যদি সে পাঠকের জন্যে লিখে থাকে। আর কমলকুমারের মতো লিখলে, লিখতে থাকবে। কারণ, কমলকুমারের সারাজীবনে পাঠক ছিল মাত্র উনিশ জন! আর আমি যদিও মনে করি, এখনো আমার নিজস্ব ভাষা তৈরি হয় নি, তবুও ভাষা হচ্ছে লেখকের জার্সি নম্বর। নিজস্ব ভাষা রপ্ত করেই মাঠে নামা উচিত।
৪. আপনার গল্পলেখার কৌশল বা ক্রাফট কি?
এই বিষয়ে আমি কথা বলবো না। পাঠক যা বুঝবে তাই। তবে আমি তো বলেছি, নতুন কোন কৌশল গল্পে খাটাতে না পারলে কারোর ই আর লেখার দরকার নেই। একমাত্র অনুকরণপ্রিয় লেখকই পারেন নিজস্ব কৌশলকে এড়িয়ে যেতে। আমি আপাতত চেষ্টা করছি, নতুন নতুন বিষয়-থিমের গল্প লিখতে, যা নিয়ে আগে কেউ লেখেন নি। এটাই আমার কৌশল। আর ভাষা নিয়েও ভাবছি, সহজ-কঠিন, কঠিন-সহজ, সহজ ও কঠিন, কঠিন ও সহজ অর্থাৎ কমউনিকেটিভ করার বিষয়টি। সমাধান পাই, আবার পাই না। এজন্য দেখলাম, নোয়াখালীর আঞ্চলিক ভাষা দিয়ে কোন কাজ হয় না কিনা, তবে মনে হলো হয়েছে! আসলে, ভাষার কাজ এমন নয় যে, শুধু সরল, জটিল কিংবা যৌগিক বাক্য অথবা যতি-ছেদ চিহ্নের কারিকুরীর ব্যবহার করে অন্যের চেয়ে নিজেকে আলাদা করে ফেললাম। ভাষা এমন জিনিস যা পাঠকের চোখে মধু মাখিয়ে দেয়। শহীদুল জহির শুধু 'অথবা' কিংবা 'বর্তমান-অতীত-ভবিষ্যতের কোলাজ তৈরি করে বাক্যের মুনশিয়ানা দেখান নি, সেখানে আরো যা আছে, যা এখনো আমার নিজের কাছেই রহস্য, তাই মূলত জহিরের ভাষা, স্বতন্ত্র্য ও আলাদা।
৫. আপনার নিজের গল্প বিষয়ে আপনার নিজের বিবেচনা কি কি?
তা নিয়ে কখনো ভাবি নি। এক্ষেত্রে পাঠকই একমাত্র সত্য। পাঠক যা বিবেচনা করবে তাই। শুধু এই বেলায় আমি সদরে-বাজারে-আড়ালে আমার সমান নয়। পাঠকের বোধ ও বিবেচনার সমান।
৬. আপনার আদর্শ গল্পকার কে কে? কেনো তাঁদেরকে আদর্শ মনে করেন?
রবীন্দ্রনাথ আদর্শ এই জন্য, সেদিকে আর ভুলেও যাওয়া যাবে না। অর্থাৎ ছোটপ্রাণ, ছোটব্যথা কিংবা শেষ হইয়াও হইল না শেষ-এসব এখন আর মানা যাবে না। জীবন এখন অনেক জটিল। মানুষের ব্যথাসমূহ অনেক বড় বড়। এছাড়া অন্যদের কথা আগে একবার বলেছি। তাঁরা বিষয়-ভাষা-বয়ান কৌশল প্রভৃতি কারণে আদর্শ।
৭. কার জন্য গল্প লেখেন? আপনি কি পাঠকের কথা মাথায় রেখে লেখেন? লিখলে কেন লেখেন? আর যদি পাঠকের কথা মনে না রেখে লেখেন তাহলে কেন পাঠককে মনে রাখেন না লেখার সময়ে?
গল্প লেখার সময় পাঠকের কথা মাথায় রাখি না। কিন্তু এমন দায়বদ্ধতা অবচেতনে থাকে, গল্পটি ছাপা হলে পাঠকই তো পড়বে। প্রকাশিত হওয়ার পর থেকে আমি তাঁদের কাছে দায়বদ্ধ। তখন আমি ও আমার গল্প-দু'জনকেই প্রকৃত পক্ষে তারা খরিদ করলো।
৮. এখন কি লিখছেন?
বাংলাদেশের ছোটগল্প নিয়ে একটা কাজ করছি। যদিও একাডেমিক কাজ। তবুও নানা অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হচ্ছি। আসলে আমাদের এখানে সত্তরের দশকের অনেক কথাসাহিত্যিক জনপ্রিয়তা পেয়েছেন পাঠকের কাছে। এখনো অনেকের বই সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয় মেলায়। কিন্তু প্রকৃত সত্য, তাদের লেখা নিয়ে তেমন রেফারেন্স জমা হয় নি, যাকে গবেষণায় কাজে লাগানো যায়। বরং লেখার চেয়ে লেখককে নিয়েই বেশি কথা হয়েছে। যেমন ধরেন, হুমায়ুন আহমেদ। ওনার লেখা নিয়ে খুব কমই কাজ হয়েছে। অথচ পত্রিকা ও টিভি খুললে আপনি দেখতে পাবেন, ব্যক্তি হুমায়ূনকে নিয়েই কথা হচ্ছে, তার লেখার সত্য আড়ালে থেকে যাচ্ছে। হুমায়ূন তমুকের অমুক হতো, হুমায়ূন বাগান করছে, পল্লী বানাইছে, প্রকাশনা শিল্পকে বাঁচাইছে, হুমায়ূন দিলখোলা মানুষ আছিল, হুমায়ূন গল্প করতে পছন্দ করতেন...এন্তার বিষয়। অথচ তার নন্দিত নরকে কিংবা শঙ্খনীল কারাগারে নিয়ে আপনি কটা লেখা পাবেন। এক্ষেত্র আমি প্রায় ই মজা করে একটা কথা বলি, তা হচ্ছে হুমায়ূনকে নিয়ে এখনো সবচেয়ে কাজের আলোচনা হয়েছে নন্দিত নরকের শুরুর অংশে। আহমদ শরীফ, আবুল ফজলসহ অনেকেই উপন্যাসটি পড়ে মন্তব্য করেছিলেন, যা শুরুর অংশে সংযুক্ত করা হয়েছিল। তারপর আর নেই। লেখার চেয়ে লেখক বড় কিংবদন্তী হয়ে গেল লেখা ক্রমেই হারিয়ে যায়। যেমন ধরেন, রামায়ণ-মহাভারত বড় না বাল্মিকী-ব্যাসদেব বড়। বাল্মিকী-ব্যাসদেবের নাম অনেকে না শুনলেও রামায়ণ-মহাভারত দ্বারা ভারতবর্ষের বৃহৎ একটা জাতি প্রভাবিত। অন্যরাও পরশ পাথরে প্রভাবিত।
রেফারেন্স না থাকায় কাজ করতে অসুবিধা হচ্ছে। সম্পর্ক বিষয়ক গল্প লিখছি। আমাদের এখানে সম্পর্কের ক্ষেত্রে ব্যাপক বিনির্মাণ লক্ষ করা যাচ্ছে। সেসব নিয়ে আর কি। ১৯৯৮ সালের বন্যা নিয়ে একটা উপন্যাস লেখা শুরু করেছি, নানা কারণে লেখা বন্ধ আছে। তবে এ বছরের শেষ দিকে তা নিয়ে আবার বসার ইচ্ছে আছে।
৯. আগামী কি লিখবেন?
গল্পই লিখতে চাই। তবে সুবিধা মতো প্লট পেলে উপন্যাসের বাড়ি বানাবো।
লেখক পরিচিতি
------------------------------------------------------------------------------------------------------------
শুরু থেকেই গল্প লিখে পাঠকের নজর কেড়েছেন। ইতিমধ্যে জেমকম পুরস্কার পেয়েছেন একটি গল্পগ্রন্থের পাণ্ডুলিপির জন্য। বোঝা যায় তিনি লিখতেই এসেছেন। ফলে তার আলাপচারিতাও লেখার মত হয়ে ওঠে বিস্তারিত। নিজেকে সহজভাবে মেলে ধরতে স্বস্তি পান। দুই পর্বে গল্পকার মেহেদী উল্লাহ গল্পপাঠের কাছে তার ভুবন লিখেছেন। ---গল্পপাঠ
------------------------------------------------------------------------------------------------------------

এটা এক বিস্ময়! কিভাবে যেন জড়িয়ে পড়লাম! তবে ছোটবেলা থেকেই আমার গল্প শোনার ঝোঁক। আমার আম্মা কিংবা আব্বা অথবা নানী কিংবা মামারা যখন কারো সঙ্গে গল্প করতেন আমি গভীর মনোযোগ দিয়ে শুনতাম। অনেক সময় তারা আমাকে সরিয়ে দিতেন এই বলে,'বড়দের কথা শুনতে হয় না'। কিন্তু আমি নাছোড়, ছোট বয়সেই বড়দের অনেক কথা শুনে ফেলেছি। আমার আব্বা নিজের জীবনের জীবিকার তাগিদে অনেকটা 'উদভ্রান্ত উদ্বাস্তু' জীবন পার করেছেন। একবার নোয়খালী(নানাবাড়ি) তো একবার চাঁদপুর(দাদাবাড়ি) করেছেন।
বছরের ছয় মাস নোয়াখালী তো ছয় মাস চাঁদপুর। এভাবে যাওয়া আসার উপর থাকতাম। থিরতা ছিল না আব্বা-আম্মার জীবনে, তাই আমিও তাদের সঙ্গী। স্নাতক সম্মান পর্যন্ত আমার শিক্ষালয়ের সংখ্যা পনেরোর বেশি। ভেবে নিজেই অবাক হই। তবে এতে একটা সুবিধা হয়েছে,নানা রকম মানুষ দেখেছি, নানা ঘটনা দেখেছি। মানুষের জীবনের প্রতিটি মুহুর্ত আমার কাছে গল্প হয়ে ধরা দিতে চায়। সেখান থেকেই আমি সিদ্ধান্ত নিই, আসলে কোন গল্পটা লিখবো না। হাজারো গল্প বাদ দিই। আমার আব্বা বাংলার ছাত্র, শিক্ষকও। সে সূত্রে ছোটবেলা থেকেই পরিচয় সাহিত্যের সঙ্গে। চর্যাপদ, মধ্যযুগের কাব্যাদি আমি ক্লাস সভেন-এইটে থাকতে পড়েছি। রবীন্দ্রনাথ পড়েছি ছোটবেলায়। আমার আব্বার কাছে ময়মনসিংহ গীতিকার একটা কপি ছিল, এখনো আমার সংগ্রহে আছে সেটা। সম্ভত, আব্বা অনেক পছন্দ করতেন। ছোটবেলাতেই তার মুখে মহুয়া-মলুয়া পালা, কাজলরেখার গল্প শুনেছি। আব্বা মাইকেলের বর্ণাঢ্য জীবন ও সাহিত্য আমাকে সেই ছোটবেলাতেই শুনিয়েছেন। সবমিলিয়ে নিজের মধ্যে একটা সাহিত্য-পরিমণ্ডল গড়ে উঠেছিল। ছোটবেলায় কবিতা লিখতাম, আঞ্চলিক পত্রিকাগুলোতে (চাঁদপুর কন্ঠ) ছাপাও হয়েছে। ছোট ছোট ঘটনা লিখে পত্রিকায় পাঠাতাম, দুই-তিনশ শব্দের মধ্যে, গদ্যের একটা অনুশীলন ওখানে হয়ে গেছে। অবশ্য বিশ্ববিদ্যালয়ে ওঠার পর কবিতা আর লিখতে ভালো লাগতো না। পড়তেই তখন ভালো লাগতো। এখনো জয় গোস্বামী, শঙ্খঘোষ, শক্তি, বিনয়, সুকান্ত, জসীম উদদীন, শামসুর রাহমান, জীবনানন্দ দাশসহ অনেকের কবিতা পড়ি। যখন-তখন। আমরা নানাবাড়ি গেলে আমি ও আমার আম্মা দুচোখ ভরে পূর্ণদৈর্ঘ্য বাংলা ছায়াছবি দেখতাম। আমার আব্বাও দেখতেন। সিনেমার গল্পটা নিয়েই আমি সবসময় ভাবিত থাকতাম। প্রচুর ভূতের গল্প পড়েছি। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর দেখা হয়ে গেল অনেক তরুণ কবি-লেখকের সঙ্গে। আমার জন্য এটা একটা বর বলতে পারেন। মোহাম্মদ রফিক, খালেদ হোসাইন, সুমন সাজ্জাদ, তারেক রেজা, নওশাদ জামিল, পিয়াস মজিদ, নির্লিপ্ত নয়ন (আলতাফ শাহনেওয়াজ), গৌতম কৈরী, সাদিকা রুমন, শিমুল সালাহ্উদ্দীন, তৌহিদুল ইসলাম, ইমরান কামাল- এদের খুব কাছে যাওয়ার সুযোগ ঘটেছিল। এনারা সবাই কবি। আর তাত্ত্বিক তৈমুর রেজার সঙ্গও পেয়েছি। আমি কিছু লিখতে চাই-তাঁরা সেটা বুঝতে পেরেছিলেন। তাঁরা কেউই আমাকে শিখিয়ে দেননি গল্প কিভাবে লিখতে হয়। তবে তারা আমাকে সুস্পষ্ট দিক নির্দেশনা দিয়েছিলেন। পড়ার ব্যাপারে চাপ সৃষ্টি করেছিলেন, চিন্তার উন্মেষ ঘটিয়েছিলেন। একবার একটা গল্প লিখলাম। আমাদের ওখানে চল ছিল, কেউ কিছু লিখলে সবাইকে পড়ে শোনাতেন। সবার মন্তব্য লেখক মনোযোগ দিয়ে শুনতেন। তো সবাই লিখতেন কবিতা, অল্পতেই পড়ে ওঠা যায়, কিন্তু একদিন আমি লিখে আনলাম একটা গল্প, নাম 'কাছারি'। পড়ে অনেকেই মন্তব্য করেছিলেন। তারা আমাকে সামনের গল্পটি লেখার জন্য উৎসাহিত করলেন, এবং কার কার গল্প পড়তে হবে বলে দিলেন(কবি নওশাদ জামিল তো দশজনার একটা লিস্টও করে দিয়েছিলেন)। এভাবেই বুঝলাম, একদল কবির ভীড়ে আমি আসলে গল্পই লিখতে চাইছি। পড়াশোনার পাশাপাশি সাংবাদিকতা করতাম, সেখানে পরিচয় হল কবি অশোক দাশগুপ্তের সঙ্গে। এই মানুষটাই আমাকে গতানুগতিক চিন্তার বাইরে নিয়ে গিয়ে বোধের অন্য একটা স্তরে উপনীত হওয়ার সুযোগ করে দিলেন। বই দিতেন। উনি নিজেই মার্কেজের অনেকগুলো উপন্যাস বাংলায় অনুবাদ করেছেন, আমাকে পড়তে দিলেন। আমি নিজেও মার্কেজের উপন্যাস সংগ্রহ করে তাঁর প্রায় সব উপন্যাস পড়ে ফেললাম। শুধু চিন্তাই নয়, তিনি আমার রিজিকের ব্যবস্থাও করেছেন এই ঢাকার শহরে। যাক, সে অন্য প্রসঙ্গ। ঢাকাতেই পরিচয় হলো কবি শামীম রেজার সঙ্গে। তিনি তখন কালের কন্ঠের সাহিত্য সম্পাদক। আমিও কালের কন্ঠে কাজ করতাম, এখনো করি। তিনি অবশ্য পরবর্তীকালে পত্রিকা ছেড়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে শিক্ষক হিসেবে জয়েন করেছেন। তো, আমার এই প্রিয় কবি ও শ্রদ্ধেয় শিক্ষক আমাকে একদিন একটা কথা বললেন,'গল্প তো লেখ, পুরো পৃথিবীতে একই দিনে আরো অনেকেই লিখছে, ধরো যদি একশটা গল্পও লেখা হয়, তবে এত গল্পের ভীড়ে তোমার গল্পটা কেন মানুষ পড়বে, তুমি কি এমন লিখছো যে, তোমার গল্পটাই টিকে থাকবে?' আমি চিন্তায় পড়ে গেলাম। আজো সেই হুমকির মুখে পড়ে আছি আমি। এভাবেই গল্প লেখার জগতে আমন্ত্রিত হয়েছিলাম।
২. শুরুর লেখাগুলো কেমন ছিল?
আমি শুরু থেকেই চাইতাম, এমন গল্প এমন ভাবে শোনাবো, যা এর আগে কেউ শোনায় নি। পারলাম না মনে হয়! কাছারি লেখার পর দু'টি নিরীক্ষাধর্মী গল্প লিখলাম। ক বর্গের ধ্বনি এবং ম তে মডেল-মরদেহ। নিরীক্ষা করলেও এখন আবার গতানুগতিক আঙ্গিকের ভেতর গল্পকে রেখেই নিরীক্ষা করার চেষ্টা করছি। আসলে, নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে দুটো কাজ হয়। এক. পাঠকের হাতে নিজেকে অন্যরকম ভাবে সমর্পণ করা। দুই. পাঠককে 'নতুন বোতলে গদ্য রস পরিবেশন করা(যদি পাঠক গ্রহণ করে)। আমি চেষ্টায় আছি, আমার মতো করে কিছু দাঁড় করাতে- ভাষায়, আঙ্গিকে- দুই নিরীক্ষার মধ্যই দিয়েই। এই দু'টি গল্পের নিরীক্ষাকে এই ভাবে বিশ্লেষণ করি- বর্তমানে দেখছি তৃতীয় পক্ষের কার্যকারিতা বা ভেল্যু কমে গেছে। আরব বিশ্বে বা পৃথিবীর কোন যুদ্ধ-ফুদ্ধের সুরাহা করতে পারেনি নিষ্পত্তিকারী হিসেবে জাতিসংঘ। কার্যত, মধ্যম পক্ষের গুরুত্ব উহ্য। এক্ষেত্র ন্যারেটর মধ্যপক্ষ। সেও বাদ গেল, তাই রইল শুধু চরিত্র, তাদের দ্বন্দ্ব-সংঘাত, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ায় একটা গল্প বা বলতে পারেন প্লট। আমি যখন নিরীক্ষা করলাম, তখন অনেকেই বলেছে, শুধু সংলাপ, তা বাবা নাটক লিখলেই তো পার! এতে আমার কিছু এসে যায় না, কারণ, জাহাঙ্গীরনগরের এক রিকশা চালক গল্পটি শুনে বলেছেন, 'ভালাইত কাইজ্জা'! আমি মূল্যায়ন পেয়েছি। আমি জানি জগতের কাইজ্জা(ঝগড়া) নিরসনে মধ্যপক্ষ(ন্যারেটর) নেই বলেই তা চলেছে-চলবে। আসলে, শুরু নিয়ে আর কি বলবো! আমি তো মনে করি, এখনো আমার শুরুর পিরিয়ডই চলছে।
৩. গল্প লেখার জন্য কি প্রস্তুতি নিয়েছেন? নিলে সেগুলো কেমন?
প্রস্তুতি বলতে একটাই, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর থেকে শুরু করে মেহেদী উল্লাহ পর্যন্ত(হাঃ হাঃ) অনেকের গল্পই পড়েছি। পড়েছি এজন্য যে, তাঁরা যা যা লিখেছেন, তা যেন রিপিট না হয়। আর গল্পের ফর্ম বোঝা কিংবা ফর্ম ভাঙার জন্যও গল্প পড়ার বিকল্প নেই। মূলকথা হলো, রবীন্দ্রনাথ, তিন বন্দ্যোপাধ্যায়, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়, সুবোধ ঘোষ, বিমল কর, কমলকুমার, অমিয়ভূষণ, হাসান আজিজুল হক, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস এরা তো আছেনই সর্বশেষ শহীদুল জহির যেখানে শেষ করেছেন সেখান থেকেই আমাকে শুরু করা উচিত। যা তারা করেছেন-বিষয়ে, ভাষায়, আঙ্গিকে, সেসব করে ভীড় বাড়িয়ে লাভ কি। আমি যে দিন থেকে মনে করবো আর পারছি না, সেদিন থেকেই গল্প ছেড়ে দেব। উদাহরণ তো সামনে আছে। আমাদের অনেক প্রতিভাবান, আশির দশকের অনেক গল্পকার লেখা ছেড়ে দিয়েছেন। গল্প এবং গল্পকার দুটি সত্তারই হদিস নেই এখন! অনেক সময়, নতুনেরও যাতনা আছে, পাঠক রিসিভ না করলে আভাগার্ড তরুণটি হতাশার মধ্যে পড়ে। অবশ্য যদি সে পাঠকের জন্যে লিখে থাকে। আর কমলকুমারের মতো লিখলে, লিখতে থাকবে। কারণ, কমলকুমারের সারাজীবনে পাঠক ছিল মাত্র উনিশ জন! আর আমি যদিও মনে করি, এখনো আমার নিজস্ব ভাষা তৈরি হয় নি, তবুও ভাষা হচ্ছে লেখকের জার্সি নম্বর। নিজস্ব ভাষা রপ্ত করেই মাঠে নামা উচিত।
৪. আপনার গল্পলেখার কৌশল বা ক্রাফট কি?
এই বিষয়ে আমি কথা বলবো না। পাঠক যা বুঝবে তাই। তবে আমি তো বলেছি, নতুন কোন কৌশল গল্পে খাটাতে না পারলে কারোর ই আর লেখার দরকার নেই। একমাত্র অনুকরণপ্রিয় লেখকই পারেন নিজস্ব কৌশলকে এড়িয়ে যেতে। আমি আপাতত চেষ্টা করছি, নতুন নতুন বিষয়-থিমের গল্প লিখতে, যা নিয়ে আগে কেউ লেখেন নি। এটাই আমার কৌশল। আর ভাষা নিয়েও ভাবছি, সহজ-কঠিন, কঠিন-সহজ, সহজ ও কঠিন, কঠিন ও সহজ অর্থাৎ কমউনিকেটিভ করার বিষয়টি। সমাধান পাই, আবার পাই না। এজন্য দেখলাম, নোয়াখালীর আঞ্চলিক ভাষা দিয়ে কোন কাজ হয় না কিনা, তবে মনে হলো হয়েছে! আসলে, ভাষার কাজ এমন নয় যে, শুধু সরল, জটিল কিংবা যৌগিক বাক্য অথবা যতি-ছেদ চিহ্নের কারিকুরীর ব্যবহার করে অন্যের চেয়ে নিজেকে আলাদা করে ফেললাম। ভাষা এমন জিনিস যা পাঠকের চোখে মধু মাখিয়ে দেয়। শহীদুল জহির শুধু 'অথবা' কিংবা 'বর্তমান-অতীত-ভবিষ্যতের কোলাজ তৈরি করে বাক্যের মুনশিয়ানা দেখান নি, সেখানে আরো যা আছে, যা এখনো আমার নিজের কাছেই রহস্য, তাই মূলত জহিরের ভাষা, স্বতন্ত্র্য ও আলাদা।
৫. আপনার নিজের গল্প বিষয়ে আপনার নিজের বিবেচনা কি কি?
তা নিয়ে কখনো ভাবি নি। এক্ষেত্রে পাঠকই একমাত্র সত্য। পাঠক যা বিবেচনা করবে তাই। শুধু এই বেলায় আমি সদরে-বাজারে-আড়ালে আমার সমান নয়। পাঠকের বোধ ও বিবেচনার সমান।
৬. আপনার আদর্শ গল্পকার কে কে? কেনো তাঁদেরকে আদর্শ মনে করেন?
রবীন্দ্রনাথ আদর্শ এই জন্য, সেদিকে আর ভুলেও যাওয়া যাবে না। অর্থাৎ ছোটপ্রাণ, ছোটব্যথা কিংবা শেষ হইয়াও হইল না শেষ-এসব এখন আর মানা যাবে না। জীবন এখন অনেক জটিল। মানুষের ব্যথাসমূহ অনেক বড় বড়। এছাড়া অন্যদের কথা আগে একবার বলেছি। তাঁরা বিষয়-ভাষা-বয়ান কৌশল প্রভৃতি কারণে আদর্শ।
৭. কার জন্য গল্প লেখেন? আপনি কি পাঠকের কথা মাথায় রেখে লেখেন? লিখলে কেন লেখেন? আর যদি পাঠকের কথা মনে না রেখে লেখেন তাহলে কেন পাঠককে মনে রাখেন না লেখার সময়ে?
গল্প লেখার সময় পাঠকের কথা মাথায় রাখি না। কিন্তু এমন দায়বদ্ধতা অবচেতনে থাকে, গল্পটি ছাপা হলে পাঠকই তো পড়বে। প্রকাশিত হওয়ার পর থেকে আমি তাঁদের কাছে দায়বদ্ধ। তখন আমি ও আমার গল্প-দু'জনকেই প্রকৃত পক্ষে তারা খরিদ করলো।
৮. এখন কি লিখছেন?
বাংলাদেশের ছোটগল্প নিয়ে একটা কাজ করছি। যদিও একাডেমিক কাজ। তবুও নানা অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হচ্ছি। আসলে আমাদের এখানে সত্তরের দশকের অনেক কথাসাহিত্যিক জনপ্রিয়তা পেয়েছেন পাঠকের কাছে। এখনো অনেকের বই সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয় মেলায়। কিন্তু প্রকৃত সত্য, তাদের লেখা নিয়ে তেমন রেফারেন্স জমা হয় নি, যাকে গবেষণায় কাজে লাগানো যায়। বরং লেখার চেয়ে লেখককে নিয়েই বেশি কথা হয়েছে। যেমন ধরেন, হুমায়ুন আহমেদ। ওনার লেখা নিয়ে খুব কমই কাজ হয়েছে। অথচ পত্রিকা ও টিভি খুললে আপনি দেখতে পাবেন, ব্যক্তি হুমায়ূনকে নিয়েই কথা হচ্ছে, তার লেখার সত্য আড়ালে থেকে যাচ্ছে। হুমায়ূন তমুকের অমুক হতো, হুমায়ূন বাগান করছে, পল্লী বানাইছে, প্রকাশনা শিল্পকে বাঁচাইছে, হুমায়ূন দিলখোলা মানুষ আছিল, হুমায়ূন গল্প করতে পছন্দ করতেন...এন্তার বিষয়। অথচ তার নন্দিত নরকে কিংবা শঙ্খনীল কারাগারে নিয়ে আপনি কটা লেখা পাবেন। এক্ষেত্র আমি প্রায় ই মজা করে একটা কথা বলি, তা হচ্ছে হুমায়ূনকে নিয়ে এখনো সবচেয়ে কাজের আলোচনা হয়েছে নন্দিত নরকের শুরুর অংশে। আহমদ শরীফ, আবুল ফজলসহ অনেকেই উপন্যাসটি পড়ে মন্তব্য করেছিলেন, যা শুরুর অংশে সংযুক্ত করা হয়েছিল। তারপর আর নেই। লেখার চেয়ে লেখক বড় কিংবদন্তী হয়ে গেল লেখা ক্রমেই হারিয়ে যায়। যেমন ধরেন, রামায়ণ-মহাভারত বড় না বাল্মিকী-ব্যাসদেব বড়। বাল্মিকী-ব্যাসদেবের নাম অনেকে না শুনলেও রামায়ণ-মহাভারত দ্বারা ভারতবর্ষের বৃহৎ একটা জাতি প্রভাবিত। অন্যরাও পরশ পাথরে প্রভাবিত।
রেফারেন্স না থাকায় কাজ করতে অসুবিধা হচ্ছে। সম্পর্ক বিষয়ক গল্প লিখছি। আমাদের এখানে সম্পর্কের ক্ষেত্রে ব্যাপক বিনির্মাণ লক্ষ করা যাচ্ছে। সেসব নিয়ে আর কি। ১৯৯৮ সালের বন্যা নিয়ে একটা উপন্যাস লেখা শুরু করেছি, নানা কারণে লেখা বন্ধ আছে। তবে এ বছরের শেষ দিকে তা নিয়ে আবার বসার ইচ্ছে আছে।
গল্পই লিখতে চাই। তবে সুবিধা মতো প্লট পেলে উপন্যাসের বাড়ি বানাবো।
লেখক পরিচিতি
মেহেদী উল্লাহ
তরুণ গল্পকার।
‘পোস্টমাস্টার ও অন্যান্য গল্পে’র পাণ্ডুলিপির জন্যে পেয়েছেন জেমকন তরুণ কথাসাহিত্য-২০১৩ পুরস্কার।
তরুণ গল্পকার।
‘পোস্টমাস্টার ও অন্যান্য গল্পে’র পাণ্ডুলিপির জন্যে পেয়েছেন জেমকন তরুণ কথাসাহিত্য-২০১৩ পুরস্কার।
3 মন্তব্যসমূহ
mehedi ullah dirghojibi hon, aapnake bohudur zete hobe.......apnar lekhate ze moja pai ta r kothao paina......
উত্তরমুছুনবন্ধু, আপনার মন্তব্যে অনুপ্রাণিত হলাম।
মুছুনঅনেক লেখকই আছেন যারা গল্পলেখার কৌশল বা ক্রাফট কি? এই বিষয়ে কিছু বলতে চান না? পাঠক হিসেবে অধুরাই রয়ে যাই
উত্তরমুছুন