সাম্প্রদায়িক সহিংসতা ও নিপীড়নের বেদনার স্মৃতি বাঁচিয়ে রাখা
স্বাধীন সেন
ধর্মীয় সহিংসতা, বেদনাবিধুরতা ও ভাষা নিয়ে আলাপচারিতা করেছেন জন হপকিনস বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক বীনা দাশ আর ওয়েলেসলি কলেজের অধ্যাপক ও জার্নাল অব হিউম্যান রাইটসের সম্পাদক থমাস কুশম্যান।১ কথোপকথনের একপর্যায়ে কুশম্যান শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত নিপীড়নবিষয়ক একটি কনফারেন্সের অভিজ্ঞতার উল্লেখ করেছেন। কুশম্যানের উপলব্ধি হলো, বেদনার ভাষা সম্ভবত বেদনা ও যন্ত্রণাভোগের অভিজ্ঞতার সঙ্গে কখনো সম্মিলিত হতে পারে না। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে হিন্দুদের ওপর সংঘটিত নিপীড়ন-নির্যাতন-সহিংসতাকে ধারণ করতে পারে না বলেই কি এমন বহুধা বিস্তৃত ও গভীরে প্রোথিত নিপীড়নের বেদনা নিয়ে বাংলাদেশে গদ্য বা পদ্য লক্ষণীয় নীরবতা পালন করেছে? হয়তো কুশম্যানের উপলব্ধি আংশিক সত্য, তবে তার ব্যাখ্যা অবশ্যই বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে কিছুটা ভিন্ন।
চারটি ছোটগল্প নিয়ে পেপারব্যাক মলাটের একটি বই। শারদোৎসব। প্রশান্ত মৃধার লেখা। প্রকাশকাল ফেব্রুয়ারি ২০০৬। বইটিকে প্রকাশক শ্রাবণ প্রকাশনী রাজনৈতিক ধারার গল্প হিসেবে চিহ্নিত করেছে। ওপরের অনুচ্ছেদে আমার বক্তব্য আশা করি এ কথা স্পষ্ট করেছে যে এ বইটির 'সাহিত্যগুণ' নিয়ে প্রচলিত ধারার আলোচনা করা আমার আগ্রহের বিষয় না। সাহিত্য-সমালোচনা সমাজবিজ্ঞান বিযুক্ত নয় বলেই আমি ঠাহর করি, যদিও বাংলাদেশে এমন উপলব্ধি বেশির ভাগ বুদ্ধিজীবীই লালন করেন না।
বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িক সহিংসতা ও নিপীড়ন নিয়ে লেখালেখি তুলনামূলক অনেক কম। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের ওপর সহিংসতা ও নিপীড়ন নিয়ে লেখা গল্প, উপন্যাস বা কবিতার কথা হাতে গুণে বলে দেওয়া যাবে। প্রবন্ধের বইও অনেক কম।
রাজনৈতিক মদদের ঘটনায় সত্যতা আছে বলাই বাহুল্য। তবে সাম্প্রদায়িক সহিংসতাকে এমন দৃষ্টিভঙ্গিতে পেশ করা সমস্যাজনক। বীনা দাশ, যিনি শিখদের ওপর সংঘটিত দাঙ্গা ও গুজরাটে মুসলমানদের ওপর পরিচালিত নৃশংস নিপীড়ন ও এর যন্ত্রণা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছেন, তিনি এই প্রচলিত মতটি প্রসঙ্গে খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি কথা বলেছেন। তিনি স্পষ্ট করেই সাম্প্রদায়িক সহিংসতাকে আমরা কিভাবে অনুধাবন করি তার প্রতি আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। তিনি মনে করেন, প্রধান সমস্যা হলো সাম্প্রদায়িক সহিংসতাকে আমরা আমাদের সামাজিকত্ব বা দৈনন্দিন যাপিত জীবনের ঐতিহাসিকতা ও শর্ত থেকে বিচ্ছিন্ন বলে অনুমান করি।
বইটিতে আমার সবচেয়ে প্রিয় গল্প 'মেয়েটি বেঁচে যাবে' আর 'ঊমা-পার্বতী সংবাদ'। যেকোনো সহিংসতা-নিপীড়নের, বিশেষ করে সাম্প্রদায়িক ও জাতিগত নিপীড়নে, লিঙ্গীয় প্রসঙ্গটি খুবই কেন্দ্রীয়। সহিংসতার প্রথম ও প্রধান ভিক্টিম নারী ও তার শরীর। এ গল্প দুটিতে ব্যবহৃত অনেক উপমা-উৎপ্রেক্ষা-প্রতিতুলনা অপরিচিত লাগতে পারে। তবে ঊমা-পার্বতী সংবাদে দেবী দুর্গা, ধর্ষিতা গৌরী ও তার বোন ঊমা একাকার হয়ে যায়। নারী ও নারীর শরীর সাম্প্রদায়িক সহিংসতার প্রথম ভিক্টিম হয়ে ওঠার কারণ ও শর্তগুলো নিয়ে বিভিন্ন পর্যালোচনা হাল আমলে হচ্ছে। তা নিয়ে এখন আলোচনা না করলেও চলে।
২০০১ সালে নির্বাচন-উত্তর নিপীড়নে অসংখ্য হিন্দু নারী গণধর্ষণের শিকার হয়েছিল। শারদোৎসবের এ দুটি গল্প ধর্ষিতা হিন্দু নারীর ভিক্টিমহুডের অসামান্য আখ্যানই কেবল হয়ে ওঠেনি, সঙ্গে সঙ্গে আখ্যান দুটি এই নিপীড়নের সামষ্টিক ও ব্যক্তিক যন্ত্রণা আর বেদনার স্মৃতি বয়ে বেড়াবার ভার প্রসঙ্গেও আমাদের ভাবতে বাধ্য করে। এই স্মৃতি ও এর আখ্যান আমাদের কাছে অজানা থেকে যায়। তবে আমি কিছুটা অনুভব করতে পারি, আমার সংখ্যালঘু আত্ম-অবয়ব থেকে যে এই স্মৃতির বেদনা কতটা ভয়ংকর হতে পারে। এই স্মৃতিকে যখন সমকালীন ইতিহাস বিকৃত করতে বা মুছে দিতে চায়, তখন তা হয়ে ওঠে নিরন্তর নৈমিত্তিক যাপিত যন্ত্রণার উৎস। ওই সাম্প্রদায়িক নিপীড়নের দায়ভার প্রধানত বিএনপি-জামায়াতের হলেও, আওয়ামী মানুষজনও এর ভাগীদার ছিল।
ঐতিহাসিক দলিল হিসেবে নয় (সাহিত্যকে ঐতিহাসিক দলিলের মর্যাদা দেওয়া, না দেওয়া নিয়ে তর্ককে আমলে না নিয়ে বলছি), বরং মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী স্বাধীন বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নিপীড়নের বেদনা ও যন্ত্রণার স্মৃতিকে সতত বাঁচিয়ে রাখার জন্য, সেই স্মৃতি দিয়ে আমাদের উদারতা ও সম্প্রীতির ইতিহাসকে আক্রান্ত করার জন্য শারদোৎসব বইটি অসম্ভব গুরুত্বপূর্ণ বলে আমি মনে করি। আমাদের বেদনার স্মৃতিগুলো বাঁচিয়ে রাখতে ভূমিকা রাখার জন্য প্রশান্ত মৃধাকে মোবারকবাদ। শারদোৎসব বইটিকে সালাম-নমস্কার।
ধর্মীয় সহিংসতা, বেদনাবিধুরতা ও ভাষা নিয়ে আলাপচারিতা করেছেন জন হপকিনস বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক বীনা দাশ আর ওয়েলেসলি কলেজের অধ্যাপক ও জার্নাল অব হিউম্যান রাইটসের সম্পাদক থমাস কুশম্যান।১ কথোপকথনের একপর্যায়ে কুশম্যান শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত নিপীড়নবিষয়ক একটি কনফারেন্সের অভিজ্ঞতার উল্লেখ করেছেন। কুশম্যানের উপলব্ধি হলো, বেদনার ভাষা সম্ভবত বেদনা ও যন্ত্রণাভোগের অভিজ্ঞতার সঙ্গে কখনো সম্মিলিত হতে পারে না। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে হিন্দুদের ওপর সংঘটিত নিপীড়ন-নির্যাতন-সহিংসতাকে ধারণ করতে পারে না বলেই কি এমন বহুধা বিস্তৃত ও গভীরে প্রোথিত নিপীড়নের বেদনা নিয়ে বাংলাদেশে গদ্য বা পদ্য লক্ষণীয় নীরবতা পালন করেছে? হয়তো কুশম্যানের উপলব্ধি আংশিক সত্য, তবে তার ব্যাখ্যা অবশ্যই বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে কিছুটা ভিন্ন।
চারটি ছোটগল্প নিয়ে পেপারব্যাক মলাটের একটি বই। শারদোৎসব। প্রশান্ত মৃধার লেখা। প্রকাশকাল ফেব্রুয়ারি ২০০৬। বইটিকে প্রকাশক শ্রাবণ প্রকাশনী রাজনৈতিক ধারার গল্প হিসেবে চিহ্নিত করেছে। ওপরের অনুচ্ছেদে আমার বক্তব্য আশা করি এ কথা স্পষ্ট করেছে যে এ বইটির 'সাহিত্যগুণ' নিয়ে প্রচলিত ধারার আলোচনা করা আমার আগ্রহের বিষয় না। সাহিত্য-সমালোচনা সমাজবিজ্ঞান বিযুক্ত নয় বলেই আমি ঠাহর করি, যদিও বাংলাদেশে এমন উপলব্ধি বেশির ভাগ বুদ্ধিজীবীই লালন করেন না।
বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িক সহিংসতা ও নিপীড়ন নিয়ে লেখালেখি তুলনামূলক অনেক কম। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের ওপর সহিংসতা ও নিপীড়ন নিয়ে লেখা গল্প, উপন্যাস বা কবিতার কথা হাতে গুণে বলে দেওয়া যাবে। প্রবন্ধের বইও অনেক কম।
রাজনৈতিক মদদের ঘটনায় সত্যতা আছে বলাই বাহুল্য। তবে সাম্প্রদায়িক সহিংসতাকে এমন দৃষ্টিভঙ্গিতে পেশ করা সমস্যাজনক। বীনা দাশ, যিনি শিখদের ওপর সংঘটিত দাঙ্গা ও গুজরাটে মুসলমানদের ওপর পরিচালিত নৃশংস নিপীড়ন ও এর যন্ত্রণা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছেন, তিনি এই প্রচলিত মতটি প্রসঙ্গে খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি কথা বলেছেন। তিনি স্পষ্ট করেই সাম্প্রদায়িক সহিংসতাকে আমরা কিভাবে অনুধাবন করি তার প্রতি আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। তিনি মনে করেন, প্রধান সমস্যা হলো সাম্প্রদায়িক সহিংসতাকে আমরা আমাদের সামাজিকত্ব বা দৈনন্দিন যাপিত জীবনের ঐতিহাসিকতা ও শর্ত থেকে বিচ্ছিন্ন বলে অনুমান করি।
বইটিতে আমার সবচেয়ে প্রিয় গল্প 'মেয়েটি বেঁচে যাবে' আর 'ঊমা-পার্বতী সংবাদ'। যেকোনো সহিংসতা-নিপীড়নের, বিশেষ করে সাম্প্রদায়িক ও জাতিগত নিপীড়নে, লিঙ্গীয় প্রসঙ্গটি খুবই কেন্দ্রীয়। সহিংসতার প্রথম ও প্রধান ভিক্টিম নারী ও তার শরীর। এ গল্প দুটিতে ব্যবহৃত অনেক উপমা-উৎপ্রেক্ষা-প্রতিতুলনা অপরিচিত লাগতে পারে। তবে ঊমা-পার্বতী সংবাদে দেবী দুর্গা, ধর্ষিতা গৌরী ও তার বোন ঊমা একাকার হয়ে যায়। নারী ও নারীর শরীর সাম্প্রদায়িক সহিংসতার প্রথম ভিক্টিম হয়ে ওঠার কারণ ও শর্তগুলো নিয়ে বিভিন্ন পর্যালোচনা হাল আমলে হচ্ছে। তা নিয়ে এখন আলোচনা না করলেও চলে।
২০০১ সালে নির্বাচন-উত্তর নিপীড়নে অসংখ্য হিন্দু নারী গণধর্ষণের শিকার হয়েছিল। শারদোৎসবের এ দুটি গল্প ধর্ষিতা হিন্দু নারীর ভিক্টিমহুডের অসামান্য আখ্যানই কেবল হয়ে ওঠেনি, সঙ্গে সঙ্গে আখ্যান দুটি এই নিপীড়নের সামষ্টিক ও ব্যক্তিক যন্ত্রণা আর বেদনার স্মৃতি বয়ে বেড়াবার ভার প্রসঙ্গেও আমাদের ভাবতে বাধ্য করে। এই স্মৃতি ও এর আখ্যান আমাদের কাছে অজানা থেকে যায়। তবে আমি কিছুটা অনুভব করতে পারি, আমার সংখ্যালঘু আত্ম-অবয়ব থেকে যে এই স্মৃতির বেদনা কতটা ভয়ংকর হতে পারে। এই স্মৃতিকে যখন সমকালীন ইতিহাস বিকৃত করতে বা মুছে দিতে চায়, তখন তা হয়ে ওঠে নিরন্তর নৈমিত্তিক যাপিত যন্ত্রণার উৎস। ওই সাম্প্রদায়িক নিপীড়নের দায়ভার প্রধানত বিএনপি-জামায়াতের হলেও, আওয়ামী মানুষজনও এর ভাগীদার ছিল।
ঐতিহাসিক দলিল হিসেবে নয় (সাহিত্যকে ঐতিহাসিক দলিলের মর্যাদা দেওয়া, না দেওয়া নিয়ে তর্ককে আমলে না নিয়ে বলছি), বরং মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী স্বাধীন বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নিপীড়নের বেদনা ও যন্ত্রণার স্মৃতিকে সতত বাঁচিয়ে রাখার জন্য, সেই স্মৃতি দিয়ে আমাদের উদারতা ও সম্প্রীতির ইতিহাসকে আক্রান্ত করার জন্য শারদোৎসব বইটি অসম্ভব গুরুত্বপূর্ণ বলে আমি মনে করি। আমাদের বেদনার স্মৃতিগুলো বাঁচিয়ে রাখতে ভূমিকা রাখার জন্য প্রশান্ত মৃধাকে মোবারকবাদ। শারদোৎসব বইটিকে সালাম-নমস্কার।
0 মন্তব্যসমূহ