জাকির তালুকদার
প্যান্টের বাম পকেটের জিনিসটা
মাঝেমাঝেই গরম হয়ে এত বেশি রকমের তীব্রতায় ছ্যাঁকা দিচ্ছে যে রুহুল কুদ্দুসের মনে হচ্ছে
সেখানে সে নিজেই বোকার মতো কামারের চুল্লি থেকে একটুকরো গনগনে কয়লা ঢুকিয়ে রেখেছে।
আবার সময় যত গড়াচ্ছে ততই গরমের সঙ্গে যোগ হচ্ছে আরো নানান কিসিমের উপসর্গ। গত কয়েক ঘণ্টায় অন্তত বার তিনেক মনে হয়েছে
যে তার হৃৎপিণ্ডটা বুকের খাঁচা ছেড়ে লাফ দিয়ে বেরিয়ে পড়ার জন্য খুবই অস্থির।
সে তার
হাতুড়ে সাইকোলজি-জ্ঞান নিয়ে চেষ্টা করেছে সেটিকে সুস্থির রাখার। কাজ তেমন হয় নি। তবে
হৃৎপিণ্ডে মাঝেমাঝে অস্থিরতার যে বিরাম ঘটছে, এবং তার ফলে কিছুক্ষণের জন্য যে সুস্থিরভাবে নিঃশ্বাস নেবার
অবকাশ পাওয়া যাচ্ছে,
তা মূলত ঐ যন্ত্রটি
ক্লান্ত হয়ে পড়ার ফল। তবে যতক্ষণ বুকের খাঁচার সাথে হৃৎপিণ্ডের বাড়ি-খাওয়া বন্ধ থাকছে
ততক্ষণ যে সে পুরোপুরি সুস্থ থাকতে পারছে তা-ও নয়। সেই সময়টুকুতে আসছে অবসন্নতা। যেমন
অবসন্নতা আসে ঝড়ের রাতে মাঝনদীতে নৌকা ডুবে যাওয়ার পরে জীবন বাঁচাতে মরিয়া সাঁতার কেটে
তীরে পৌঁছানো গেছে মনে করে কালো রেখাটার কাছাকাছি আসার পরে যখন দেখা যায় যে সেটি তীর
ছিল না, আসলে ছিল দৃষ্টিবিভ্রম। সেই
রকমের হতাশ অবসন্নতায় নিস্তেজ হয়ে পড়ছে রুহুল কুদ্দুসের পুরো শরীরটাও। অনেকক্ষণ ধরেই
মনে হচ্ছে তার শরীরের কোনো অংশেই একফোঁটা শক্তিও অবশিষ্ট নেই। তার নিজেরই শরীরের যন্ত্রপাতি
তার নির্দেশ শুনবে এমন ভরসাও প্রায় পাওয়াই যাচ্ছে না। পুরো দেহযন্ত্রই অবশ-বিবশ। আর
তখনই তার মনের গলি-ঘুপচির ফাঁকে ফাঁকে বয়ে চলা অচেনা স্নায়ুনদী দিয়ে তীব্র ভীতির প্রবাহ
ছুটে চলার পাশাপাশি মনে পড়ছে তার মাঝারি মাপের সরকারি চাকুরে বাপের কথা। বিবশতা এবং
তদীয় পিতা এখন রুহুল কুদ্দুসের কাছে সমার্থক। অথচ
শৈশব-কৈশোরে তো বটেই, সে যৌবনে পদার্পণের পরেও অনেক বছর যাবতই এই মানুষটা তার সাথে কথা বললেই মনে হতো
সে কোনোদিন-না-দেখা সুন্দরবনের মাঝখানে একেবারে রয়েল বেঙ্গল টাইগারের ঝোপের পাশে বসে
রয়েছে। রিটায়ারমেন্টের সময় যত এগিয়ে আসে, বাপের বাঘ-গর্জন কমতে কমতে খেদ-এর পর্যায়ে নামতে শুরু করে, এবং এক পর্যায় তা একটিমাত্র
স্বপ্নের বাক্যানুবাদে পরিণত হতে থাকেÑ চাকরি শ্যাষ হলে কিডা থাকপে এই সোংসারে! এই দোজখের মদ্যিখানে!
আমি চল্যা যাবো মক্কাত কাবার ঘরে। আল্লার ঘরে। দিনে দুইবেলা ঝাড়– নিয়া সাফসুতরা করবো আল্লার
মোকামের মেঝে। পড়ি থাকপো সেই মেঝেতই। আর প্যাট! প্যাটের কথা কিডা ভাবে! পরভাতের আগে
খাবো দুইডে খেজুর আর একঢোক জমজমের পানি। মগরেবের টাইমে রোজা ভাঙ্গবো ফের ঐ দুইডে খেজুর
আর পানি খায়েই। শ্যাষ নিশ্বেসখান যানি ফেলবার পারি কাবার ঘরে, আল্লার কাছে এইডেই খালি চাওয়া।
অথচ সেই মানুষটা এখন দিন-মান
পড়ে থাকে নিজের ঘা-পুঁজ,
গু-মুত মাখানো চিমসে
বিছানায়। কেউ দয়া করে পাশ ফিরিয়ে দিল তো দিল, নইলে যে কাতে রাখা হয়েছে সেই কাতেই পড়ে থাকবে পরিত্যক্ত ঢেঁকির
মতো। কাউকে ডাকবে, সেই ক্ষমতাটুকুও নেই। জবানও
কেড়ে নিয়েছে প্যারালাইসিস।
মাঝারি চাকুরে অবাস্তব স্বপ্নে-পাওয়া
বাপের বর্তমান শারীরিক চরমতম দুরবস্থার কথা মনে পড়তেই রুহুল কুদ্দুসের সমস্ত অন্তরাত্মা
তারস্বরে না না করতে থাকে। অমন পরিণতির চেয়ে মৃত্যু শতগুণে শ্রেয়। এবং তখনই কিছুটা
আত্মধিক্করের সঙ্গে সঙ্গে মনে হয় সে কি তার জন্মদাতা বাপের মৃত্যুকামনা করছে? তওবা তওবা!
কিন্তু তার প্যান্টের বাম পকেটের
নিচে থাইয়ের চামড়ার জ্বলুনি যাচ্ছে না কিছুতেই। এই জিনিসটি প্যান্টের পকেটে রাখার পর
থেকেই শুরু হয়েছে এই উপসর্গ। ডান পকেটেও রেখে দেখেছে। তখন জ্বলুনি শুরু হয় ডান দিকে।
এ থেকে রেহাই পাওয়ার এক ম্ত্রা পথ হচ্ছে জিনিসটিকে খালাস করা। কিন্তু সেই পথ যেমন জানা
নেই, তেমনি প্রয়োজনীয় সাহসটুকুও
মনের মধ্যে জড়ো করা যাচ্ছে না কিছুতেই। তার সঙ্গে যোগ হয়েছে তীব্র অপরাধবোধ। ক্রমান্বয়ে
বেড়ে চলেছে। নিজেকে বোঝানোর চেষ্টা করছে সে আপ্রাণ। নিজেকে বোঝানোর জন্যেই অন্যের উদাহরণ
বার বার টেনে আনা। প্রথমেই আসে আবুলের কথা। ভার্সিটি জীবনের বন্ধু। একই হলে একই ফ্লোরে
দীর্ঘ পাঁচ বছর। ভীরু কোনো গ্রামের গরীব ঘরের ছেলে। ইস্কুলে-কলেজে নিশ্চয়ই আবুল ছিল
তাদের গ্রামের সবচেয়ে মেধাবী ছেলে বলে পরিচিত।
লেখাপড়া চালিয়ে যেতে পারলেই উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ
নিশ্চিত। কিন্তু খরচটা জোগায় কে? সহজ সমাধানÑ বিয়ে। গ্রামদেশে তখন এই প্রথা বেশ জোরেশোরেই চালু। এখনও বোধহয়
চলে আসছে। মোটামুটি অবস্থাপন্ন ঘরের অল্পবয়সী মেয়েকে বিয়ে করার বিনিময়ে উচ্চশিক্ষার
সুযোগ। প্রতি মাসের ৪ বা ৫ তারিখে দেখা যেত টাখনুর উপরে পায়জামা, আর পাঞ্জাবি-টুপি পরিহিত মাঝবয়সী
লোকটিকে। মাস খরচের টাকা,
আবুলকে লেখা তার
স্ত্রীর চিঠি, সঙ্গে মরশুমি ফলÑফলারি। এইভাবে মাসে মাসে কষ্ট
করে নিজে না এসে মানি অর্ডার করলেই তো হয়! উত্তরে স্মিত হাসির সঙ্গে বাঁধা গত্Ñ কষ্ট আর কী! মাসে মাসে এলে
দেখা করা যায়, খোঁজ-খবর নেওয়া যায়। চিঠি
তো আর চোখের দেখার সমান হয় না। ছুটি-ছাঁটাতে গ্রামে যাওয়া আবুলের জন্য প্রায় বাধ্যতামুলক।
সে যায় বিরক্তি নিয়ে। কিন্তু ফিরে আসে সজীব হয়ে। রুহুল কুদ্দুসদের যখন পর্ণো পত্রিকা, নীল ছবি আর অবাধ স্বপ্নকল্পনাই
সম্বল, আবুলের তখন জলজ্যান্ত টলটলে
একটা তরুণী শরীরের ওপর ষোলআনা অধিকার। সেই যৌনতৃপ্তি জনিত সতেজ ভাব কাটতে অন্তত তিন-চার
দিন। তার পরেই কেবল আবুল ক্লাস-লাইব্রেরি-পড়াশুনায় মন দিতে পারে। এবং খুব ভালোভাবে
দিতে পারে। ফলে ক্লাসে তার বেশ সুনাম হয় এবং মেয়েরা, বিশেষ করে শিপ্রা, তার সাথে ক্লাস নোট থেকে শুরু করে বিবিধ বিষয়ে, এমনকি অন্তরঙ্গ বিষয়েও, আলাপে উৎসাহী হয়ে ওঠে। তখন
রুহুল কুদ্দুসরা দেখে খাটো ঝুলের পায়জামা ও পাঞ্জাবি-টুপি পরা মাসিক রসদের যোগানদাতা
আবুলের শ্বশুরের মুখে একটা থমথমে ছায়ার প্রায় বোঝা যায়-কী- যায় নাÑ এমন একটা আবরণ। কেননা তার আদুরে কন্যার স্বামী আবুলের পড়ার খরচ
তখন মাসে মাসে বেড়ে চলেছে। এবং সেই বৃদ্ধির কোনো নিয়ম-ধারা নেই। কিছু খরচ তো বাড়তেই
পারে। কিন্তু চড় চড় করে রেড়ে চলা এবং প্রতিনিয়ত বেড়ে চলার ধাক্কা সামলানো স্বচ্ছল খাটো
পায়জামার পক্ষেও রীতিমতো দুঃসাধ্য হয়ে পড়ে। তাতে আবুলের কিছু এসে যায় না। তার পরিষ্কার
কথাÑ জামাই যখন কিনেছো, দাম দিতেই হবে। তার খরচ এখন
অনেকদিকে বেড়ে গেছে না! শিপ্রার জন্যে তো বটেই, রুহুল কুদ্দুসদের জন্যেও। কেননা রুহুল কুদ্দুসরা যাতে শিপ্রাকে
না জানায় যে আবুল ইতোমধ্যেই শরিয়তসম্মতভাবে নিজের লিঙ্গ বিক্রি করে বসে আছে। সেই আবুল
একবার শিপ্রাকে গলার সোনার চেইন পর্যন্ত উপহার দিয়েছিল। এবং সেটি নিজের বউয়ের গলা থেকে
প্রায় ছিনতাই করে এনে।
তারপরে মোস্তফার কথা। ওর বাবা
ছিল পিডিবি-র পিয়ন। তার লেখা কয়েকটা চিঠি দৈবাৎ পড়ে ফেলেছিল রুহুল কুদ্দুস। বাবা মোস্তফা, এই টাকা কয়েকটি পাঠাইলাম। অতি
কষ্টে সংগ্রহ করিয়াছি। আমাদের ভিটার পশ্চিম পাড়ের জমিটুকু বিক্রয় করিতে হইয়াছে। তোমার
প্রতি অনুরোধ, এই টাকার সর্বোত্তম ব্যবহার
করিবে। বাজে খরচ করিবে না । তুমি লেখাপড়া সমাপ্ত করিয়া সংসারের হাল ধরিলে আমি অন্তত
শান্তিতে মরিতে পারি।
কিংবা আর একটা চিঠিÑ তোমার পরীক্ষার ফরম ফিলাপের
এই টাকা কয়টি জোগার করিতে কী না করিয়াছি। শেষে হাত বাড়াইতে হইল তোমার আদরের ছোট বোন
মহিমার কানের মাকড়ির দিকে। তাহার একমাত্র অলঙ্কার। তাহার অন্তর ফাটিয়া যাইতেছিল নিশ্চয়ই।
কিন্তু বড় ভাইয়ের পরীক্ষার কথা শুনিয়া তোমার এই ছোট বোনটি নিজের কান্না সামলাইয়া হাসিমুখে
তাহার একমাত্র অলঙ্কার তুলিয়া দিয়াছে স্যাকড়ার হাতে।
ঐ টাকা খরচ করতে মোস্তফার একবেলাও
লাগত না। কেননা সে ক্যাম্পাসে নিজেকে পরিচিত করেছে মাঝারি শিল্পপতির একমাত্র পুত্র
হিসাবে, যাদের রয়েছে প্রিন্টিং, পরিবহন এবং কোল্ডস্টোরেজ ব্যবসা। ফাইনাল ইয়ারে এসে দেখা গেল ক্যাম্পাসে শিল্পপতির
ছেলের ধার-কর্জের পরিমাণ পঞ্চাশ হাজার টাকারও বেশি। কোনো পয়সাই শোধ করে নি মোস্তফা।
রুহুল কুদ্দুসের অপরাধ কি ওদের
চাইতেও বেশি?
মানুষ লোকঠকায়। তো লোকঠকানোর
জায়গা অন্তত থাকা চাই। তার জগৎ তো দুই কামড়ার এই বাড়ি, পাড়ার মুদির দোকান, কাঁচা বাজার এবং টিউশনির বাড়ি।
অন্য ভাই-বোনেরা আগে যাওবা যোগাযোগ রাখত, বাপ পুরোপুরি বোঝা হয়ে যাওয়ার পরে আর এমুখো হতে চায় না পারতপক্ষে।
তাদের কথা হচ্ছে বাপের জন্যে দু-চার টাকা খরচ চাইলে আপত্তি নেই। কিন্তু গু-মুত-পুঁজ
পরিষ্কার করাÑ অসম্ভব! বাপ যতই জন্মদাতা হোক, আর লালন-পালনকারী হোক, তার গু-মুত অন্যদের মতোই সমান
দুর্গন্ধের এবং একই রকম ঘেন্নার। কার চেয়ে পয়সা নাও, সুইপার রাখো। ভাড়াটে সুইপার কিংম্বা চাকরÑ বেশিদিন কেউই থাকে না। তাই
শেষ পর্যন্ত সবকিছু সেই রুহুল কুদ্দুসেরই ঘাড়ে। নিজের চাকরি নেই, টিউশনিই সম্বল। নিজের হাতে
রান্না করে বাপকে খাওয়ানো এবং নিজে খাওয়া। সেই খাওয়াতেও কী শান্তি আছে! খেতে বসেছে, হঠাৎ কাল্পনিক দমকা হাওয়ায়
পাশের ঘর থেকে নাকে এসে ভক্ করে লাগে গু-মুতের দুর্গন্ধ। পাতে বমি হয়ে যায় আর কী!
আগে কখনও ঠোঁট-মুখ শোঁকাশুকি
দুরের কথা, একাডেমিক আলোচনার বাইরে কোনো
কথাই সম্ভবত হয়নি অলকার সাথে। সেই অলকা হঠাৎ একদিন বলে বসল তার নাকি বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে।
রুহুল কুদ্দুসের জন্য সবচেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপার ছিল যে অলকা কথাটি বলেছিল অসম্ভব দুঃখিত
ও ভেঙে পড়া গলায়। তাকে নিরুত্তর দেখেও আরও বিষমরকম চমকে দিয়ে অলকা বলেছিল যে রুহুল
কুদ্দুস চাইলে সে বিয়েটা ভেঙে দিতে পারে।
নিজেকে নিয়ে হীনম্মন্যতা খুব
বেশি ছিল রুহুল কুদ্দুসের। তাই কোনো মেয়ে তাকে এইভাবে চাইতে পারে ভাবতে গিয়ে অসম্ভব
সুখের বেদনায় বুকটা ভেঙেচুড়ে আবেগের স্রোত বইতে শুরু করেছিল। কিন্তু তারপরেই কল্পনায়
নাকে এসে ভক্ করে লাগল প্রতিদিনের রুটিন দুর্গন্ধ। তাকে যা অর্ধেক দিন ধরে রোজ সইতে
হয়, সেই রকম জঘন্য পরিস্থিতিতে
অলকাকে সে চিন্তই করতে পারে না। তখন সে কল্পনায় দেখতে পায় অলকাকে ঠেলে নিয়ে দাঁড় করিয়ে
রেখেছে আদিঅন্তহীন বিশালতম এক ভাগাড়ের ঠিক মধ্যবিন্দুতে। আর অলকা নাকে আঁচল চেপেও বাঁচতে
পারছে না দুর্গন্ধ থেকে,
সে কাঁদছে, হড়হড়িয়ে বমি করছে আর এমন সব
অশ্র্রাব্য গালি নিক্ষেপ করছে রুহুল কুদ্দুসের উদ্দেশ্যে যা বস্তির ঝগড়াতেও উচ্চারিত হয় না। এই ভয়ংকর দৃশ্য
মনোচাক্ষুষ করতে করতে এত দীর্ঘ সময় ধরে কেঁপে কেঁপে উঠতে থাকে রুহুল কুদ্দুস যে অলকার
কথার পিঠে তার কোনো কথাই আর বলা হয়ে ওঠে না। এবং অলকা আলগোছে তার পাশ থেকে উঠে খুব
দুঃখিত ও অবমানিত ভঙ্গিতে হেঁটে, ঘাস মাড়িয়ে. কাঁটা তারের বেড়ার ঝাঁপ ঠেলে বেরিয়ে গিয়ে বাসের হ্যান্ডেল ধরে পাদানিতে
এক পা তুলে পেছন দিকে না তাকিয়েও দুই মুহূর্ত থমকে থাকে, তারপর হেলপার তাড়া দেওয়ার আগেই
দরজা পেরিয়ে বাসের মধ্যে ঢুকে যায়।
সেদিন বাড়িতে ফিরে রুটিনমতো
বাপকে পরিচ্ছন্ন করার কাজে হাত লাগায় নি রুহুল কুদ্দুস। শুধু মানুষ কেন, সব জন্তুÑজানোয়ারেরই কন্ডিশন্ড রিফ্লেক্স
নামে একটা জিনিস আছে। ইঁদুরকে রোজ সকাল এগারোটায় কলা খেতে দিলে কয়েকদিন পরে দেখা যাবে
এগারোটা বাজতে বাজতেই তার পাকস্থলি থেকে জারকরস বেরিয়ে এসেছে। বিড়ালকে রোজ বিকেলে দুধ
খেতে দিলে দেখে যাবে ঐ সময় এসে সে মিউমিউ ডেকে নিজের উপস্থিতি জানান দিচ্ছে দুধের প্রত্যাশায়।
আর পক্ষাঘাতগ্রস্ত হলেও তার বাপতো আস্ত একজন মানুষই। ক্লাস শেষে বাড়ি ফিরে নিেেজর ঘরের
শিকল ঝনাৎ শব্দের সাথে খুলে গেলে তার বাপ নড়তে না পারুক, ঠিকই বুঝে ফেলে এবার তাকে পরিচ্ছন্ন
করা হবে। কিন্তু অনেকক্ষণ পেরিয়ে গেলেও ছেলে তার ঘরে ঢুকছে না দেখে সে আঁ আঁ শব্দ করে
ছেলের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করে। কোনো প্রত্যুত্তর আসে না। আঁ আঁ আরো বেড়ে যায়। তখন
গনগনে মুখ নিয়ে পায়ের লাথিতে দরজা হাট করে পক্ষাঘাতগ্রস্তের সামনে দাঁড়ায় রুহুল কুদ্দুসÑ চিল্লাও ক্যান? কাবা ঘরে যাবা না? মক্কা-মোকামে যায়া ধুলা ঝাড়
দিবা না? খেজুর খাবা না? কিডা কয়ছে তুমাক এই জাগাত পড়ি
থাকতে! হুঁহ্ মক্কার ধুলা পরিষ্কার করবি! নিজের গু-মুতই ছাফ করবার পারে না! এই সব কাম
এখন কিডা করবি? আমি করবার পারবোনানে আর।
এই জ্যান্ত মড়াকে কীভাবে ঘাড়
থেকে নামানো যায়, সেই চিন্তা তখন থেকে মগজে ঠাঁই
গেড়ে বসেছে রুহুল কুদ্দুসের। একবার মনে হয়েছে এভাবেই বাপকে ফেলে রেখে চলে যায় অন্য
কোনো জায়গায়। কিন্তু দুর্ধর্ষ কাজের মতো যেমন বড় কোনো ভালো কাজেও সাহসের প্রয়োজন হয়, তেমনি বড় আকারের নিষ্ঠুরতা
দেখানোর জন্যেও অনেকখানি সাহসের প্রয়োজন। বলাই বাহুল্য অতখানি সাহস রুহুল কুদ্দুসের
নেই। ফলে সেই কাজটি আর করা হয়ে ওঠে না। তবে পক্ষাঘাতগ্রস্ত বাপকে বোাঝা মনে করা এবং
এই বোঝার হাত থেকে নিস্কৃতি পাওয়ার চিন্তা তার মনের মধ্যে স্থায়ী শিকড় বিছিয়ে বসে।
শেষে অনেক ভেবে সে একটা পথ
খুঁজে বের করে। বাপকে কোনো হাসপাতালে ঢুকিয়ে দিতে হবে। একবার ভর্তি করে দিতে পারলেই
হলো। তবে নিজের ঠিকানাটা দিতে হবে ভুয়া। যাতে হাসপাতালের লোকজন অতিষ্ট হয়েও রোগীর ‘কেয়ার অফ’ হিসাবে তাকে খুঁজে বের করতে
না পারে।
কিন্তু হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে
লাভ হয় না। এমন রোগী ভর্তিযোগ্য নয় বলে তার বাপকে কিছুতেই ওয়ার্ডে ঢুকাতে দেয় না ডাক্তাররা।
উল্টো গাদা গাদা প্যাথলজি পরীক্ষার লিস্টি ধরিয়ে দেয়। লিপিড, সুগার, ইলেকট্রোলাইট, ইসিজি, ইকো, স্ক্যান, এমআরআই। সঙ্গে উপদেশ। এ ধরনের
রোগীকে হাসপাতালে নয়,
বাড়িতে প্রিয়জনদের
মধ্যে রেখেই চিকিৎসা করাতে হবে। ওষুধ, শারীরিক পরিচ্ছন্নতা, সেবা, নিউট্রিশন এবং ফিজিওথেরাপি। রোগী নিয়ে পালাতে পারলে বাঁচে রুহুল কুদ্দুস!
অবশেষে একটা পথ অবশ্য পাওয়া
যায়। ক্লিনিকে ভর্তি করানো যাবে। কিন্তু প্রতিদিনের বেড ভাড়া-খাবার-পথ্য-ওষুধ-সেবিকা-সুইপার
মিলে লাগবে অনেক টাকা। এবং ভর্তির সময়ে কমপক্ষে দশ দিনের টাকা অ্যাডভান্স জমা দিতে
হবে। সব মিলিয়ে একথোকে কমপক্ষে পঞ্চাশ হাজার টাকার ধাক্কা। তা হোক, সুষ্ঠুভাবে নিজের মুক্তির একটা
ব্যবস্থা তো হবে! সে নিজের নাম ঠিকানা লিখবে ভুয়া। আর বাপের তো সাধ্য নেই কথা বলার
কিংবা খুঁজে বের করার।
সেই টাকা জোগাড়ের পদক্ষেপ নিতে
গিয়েই আজ এই দশা রুহুল কুদ্দুসের।
নিজের নাম নিয়ে দারুণ বিব্রত
তার ও-লেভেলের ছাত্রী তৃষা। এইটা কী এই যুগের উপযোগী নাম হলো! তৃষা তার সেই নামের স্মার্টনেসের
ঘাটতি পুষিয়ে নেয় চলা-ফেরায়, কথা-বার্তায়, পোষাকে-ফ্যাশনে। শুধু মোবাইলেই
মাসে মাসে টাকা উড়ায় কয়েক হাজার। যখন পড়তে বসে, এমনভাবে সেজে-গুজে আসে যেন ফ্যাশন শো-তে যাচ্ছে। এসব নিয়ে কটু
কথা বলার ইচ্ছা জাগলেও বলতে পারে না রুহুল কুদ্দুস। তার মাসিক উপার্জনের একটা বড় অংশ
আসে তৃষাকে পড়ানো থেকে। এমন সোনার ডিম পাড়া হাঁসকে চটানো যায় না। তাই ন্যাকামিপনা আর
একজিবিশনিজমের দর্শক হিসাবে চূড়ান্ত বিড়ম্বনার
শিকার হতে হয় তাকে রোজ। কান থেকে দুল খুলে রুহুল কুদ্দুসের মুখের সামনে নাড়ায়
তৃষাÑ দেখুন স্যার এইটা বাবা এই মাসে
দুবাই থেকে আনছে। খুব সুন্দর না! গলায় তার কত রকমের চেইনÑ এইটা বাবা সিঙ্গাপুর থেকে আনছে।
এইটা আনছে জার্মানি থেকে। এমনকি কোনো-কোনোদিন জুতো-স্যান্ডেলও দেখতে হয়েছে রুহুল কুদ্দুসকেÑ এই যে দ্যাখেন স্যার, জুতা যে কী কিউট হইতে পারে, না দেখলে বুঝতেই পারবেন না।
এই রকম জিনিস বানানো খালি জাপানি এক্সপার্টদের পক্ষেই সম্ভব। বাবা ওসাকা থেকে কিনছে।
সে-ও নাকি সব দোকানে পাওয়া যায় না। আমাদের এখানে যেমন জামদানিপল্লী আছে, সেই রকম ওসাকাতেও নাকি আছে
স্পেশাল জুতাপল্লী। খুঁজে খুঁজে সেই জায়গায় পৌঁছাতেই নাকি বাবার ট্যাক্সি ভাড়া গুনতে
হইছে পঞ্চাশ ডলার।
মুখে বলবে দামের বিশালতা, গুণগান গাইবে জিনিসটার, রুহুল কুদ্দুসের নাকের সামনে
দোলাবে কিছুক্ষণ, তারপর অবহেলায় রেখে দেবে টেবিলে
বা বিছানায় বা মেঝেতেই। যেন রুহুল কুদ্দুসকে দেখানো পর্যন্তই তার জিনিসটি মুল্যবান, তার পরেই সেই জিনিসে আর কোনো
আগ্রহ নেই তৃষার। গতকাল সিঙ্গাপুর না জাপান না দুবাই থেকে আনা তৃষার এক জোড়া দুল পকেটে
ঢুকিয়ে ফেলেছে রুহুল কুদ্দুস। বাপ নামক বোঝা ঘাড় থেকে নামানোর খরচ। কিন্তু তখন থেকেই
তার শরীরে ও মনে দেখা দিয়েছে এইসব উপসর্গ। উপসর্গগুলোর প্রকোপ যত বাড়ছে, উপসর্গগুলোর স্থায়ীত্ব যত বাড়ছে, কষ্ট যত বাড়ছে, ভেতরে ভেতরে তার ক্রোধও বাড়ছে
সেই অনুপাতে।
ভারী দুর্গন্ধ ঝুলে থাকে বাপের
ঘরের বদ্ধ গুমোট বাতাসে। এত দিনেও এই পরিস্থিতির সাথে অভ্যস্ত হয়ে উঠতে পারে নি রুহুল
কুদ্দুস। দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলেই এখনও গন্ধ ধাক্কা মারে তাকে। অথচ আজ আর সেই অনুভুতি
হয় না কেন যেন।
বাবার চোখ-কান বোধহয় এখনও কাজ
করে। দরজা খোলার শব্দেই হোক আর ঘরে আলো ঢোকার কারণেই হোক তার বোঁজা চোখ খুলে যায়।
চোখের মণি ঘুরিয়ে বাবা ভাবলেশহীন তাকিয়ে থাকে কনিষ্ঠ পুত্রের দিকে। তার নাকের সামনে
হীরে বসানো সোনার দুলজোড়া দোলায় রুহুল কুদ্দুসÑ এই যে দ্যাখো কী দামি জিনিস! কুথায় পালাম? চুরি করিছি। বুঝতে পারিছাও? চুরি করিছি। তুমার জন্যি ।
তুমার হাতেত থিনি বাঁচার জন্যি।
বাপের চোখ সাপের চোখের মতো
অপলক। কোনো ভাষা ফোটে না। তা দেখে আরো ক্ষেপে ওঠে রুহুল কুদ্দুসÑ তুমি তো এখন আপুছা মরদ। কিডা
পুছে তুমাক। তুমার ঘরে কি খালি আমার একলার জম্মো? তাহলি তুমার বাকি ছোল-মিয়্যা একবারের জন্যিও তুমার খোঁজ নেয়
না ক্যান? আল্লাও তুমাক পুছে না। আজরাইলও
না।
তীব্র ঝগড়ায় মেতে উঠতে পারলে
যেন ভেতরের সব ঝাল এবং গরলগুলো বের করে দিতে পারত রুহুল কুদ্দুস। কিন্তু ঝগড়া তো একপাক্ষিক
হয় না। তদুপরি এটাও সে নিশ্চিত নয় বাপ তার কথা শুনতে পাচ্ছে কী পাচ্ছে না। ফলে রুহুল
কুদ্দুসের ক্রোধ ক্রমান্বয়ে বাড়তে বাড়তে বারুদে
পরিণত হতে থাকে। সে নেচে নেচে মুদ্রা দেখিয়ে ভ্যাংচাতে থাকে বাপকেÑ কাবা শরীফ যাবা না? মেঝে ঝাড়– দিবা না? চলো উঠো তুমার পিলেনের টিকিট
কাটতে যাই। এইডে বেচলেই পিলেনে উঠবার পারবানে। অনেক দাম এইডের। হিরে বসান আছে। হিরে।
নাম তো শুনিছাও। কাঁচকাটা হিরে। কুনোদিন কি চোখে দেখিছাও? দ্যাখো! জীবন সার্থক কর্যা
দ্যাখো!
দুলজোড়া দোলাতে দোলাতে একবার
বাপের মাথার কাছে আসে রুহুল কুদ্দুস, একবার পায়ের কাছে যায়, একবার দরজার আলোতে ধরে, একবার দিনে-দুপুরে সুইচ টিপে আলো জ্বালিয়ে সেই প্রখর আলোতে দুলজোড়া
বাপকে দেখানোর জন্য ক্ষেপে ওঠে। আর অবিরাম বলে চলেÑ দ্যাখো দ্যাখো, হিরে দ্যাখো, নয়ন-মন সার্থক করো।
তারপরে হঠাৎ সে থমকে দাঁড়ায়।
যেন কাল্পনিক এক প্রতিপক্ষ তাকে একটা প্রশ্ন করেছে আর সে উত্তর দিচ্ছে এই ভঙ্গিতে বলতে
থাকেÑ চুরি। হ্যাঁ চুরিই তো। কিন্তু
তার জন্য আমার কোনো অনুতাপ নেই। চোরের ঘরে চুরি করলে কোনো দোষ নেই। তৃষার বাপ তো চোর।
চোরের বড় চোর। জানেন না বাংলাদেশে এখন কুড়ি হাজার কোটিপতি। কেউই নিজের সৎ উপার্জনে
বড়লোক হয়নি। তৃষার বাবাও তাই। গার্মেন্টের একটা নারীশ্রমিককে কত মজুরি দেয় জানেন? মাসে নয়শো ষাট টাকা। সরকারি
দলকে চাঁদা দেয় বছরে এক কোটি টাকা। বিরোধী দলকে দেয় পঞ্চাশ লক্ষ টাকা।
চুরি করেছি আমি। হ্যাঁ চুরি
করেছি। চুরি কে না করে?
দেখেন না টিআইবি-র
রিপোর্ট। পর পর পাঁচ বছর বাংলাদেশ দুর্নীতিতে পৃথিবীর মধ্যে শীর্ষস্থান পেয়েছে? চুরি না করলে এদেশে কেউ বড়লোক
হতে পারে না। আমিও চুরি করব। বড়লোক হবো। তারপরে না হয় মসজিদ বানিয়ে দেব একটা।
তারপর হঠাৎ-ই প্রচণ্ড জোড়ে
ধমকে ওঠে রুহুল কুদ্দুসÑ
চোপ্! জ্ঞান দিতে
আসবেন না। যাত্রাদলের বিবেক সাজতে আপনাকে কে বলেছে? আপনার সৎ পরামর্শের মুখে পেচ্ছাব করে দেই আমি। এই দুল নিয়ে আমি
এখন বায়তুল মোকাররমে যাব। নগদ টাকা নিয়ে বাপকে ভর্তি করাব বড় একটা ক্লিনিকে। জমা দেব
দশ দিনের পুরো টাকা। পুরো পঞ্চাশ হাজার টাকা। তাহলেই আমার ছুটি। বাপ তখন হয়ে থাকবে
ঐ ক্লিনিকের গলার কাঁটা। তা হোক। হলে ক্ষতি কী? ক্লিনিকঅলারাও তো খুব হারামি। অসহায় রোগীদের গলা কাটে। আদ্দেক
অপারেশন করে পুরো টাকা চায়। না দিলে অপারেশন বন্ধ করে দেয়। পেট সিলাই না করে রোগীকে
পচিয়ে মারার ভয় দেখায়। ... চোর নয় কে? কে চোর নয় অ্যাঁ? মন্ত্রী-এমপি-আমলা-মিলিটারি-পুলিশ-ব্যবসায়ী-বুদ্ধিজীবী-দোকানদারÑ কে চোর নয়? সেখানে আমি সাধু হয়ে থাকতে
যাব কোন দুঃখে? তাছাড়া আমি তো বড় কোনো চুরি
করছি না। যেদিন সামর্থ্য হবে, তৃষাকে নতুন দুল বানিয়ে দেব। অথবা তার বাপকে দিয়ে দেব ওটার দাম। কিংবা খুব বেশি
দেরি হলে তৃষার বিয়ের সময় গিফ্ট করে আসব এই রকম একজোড়া দুল। ... আরে রাখেন রাখেন! নৈতিকতার
কথা বাদ দ্যান। নীতির কথা বাদ দ্যান। ধর্মের কথা বাদ দ্যান। সবাইকে চিনি আমি। সব শালা
চোর!
এত তীব্র গতিতে তার মুখ থেকে
কথাগুলো ছিটকে ছিটকে বেরিয়ে আসতে থাকে যে কথার ফাঁকে ফাঁকে মানুষ নিঃশ্বাস বয়ে যাওয়ার
জন্য যে সময়টুকু খরচ করে,
সেই বাতাস চলাচলের
অবকাশটুকুও নিজের ফুসফুসকে দেওয়ার কথা ভুলে যায় রুহুল কুদ্দুস। ফলে কিছুক্ষণ পরেই হাঁপানির মতো শ্বাসকষ্ট হতে থাকে তার, মুখের কথার সাথে ছিটকে বেরুতে
থাকে থুথুর ছোট-বড় বেলুনদানা। তবু সে কথা বলতে থাকে। হাত-পা নেড়ে মুখ দিয়ে, চোখ দিয়ে, সমস্ত শরীর দিয়ে, কথা বলতে থাকে। সে বুঝতে পারে
না যে সে আসলে আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্যই এতটা মরিয়া। কোনো আদালতের এজলাসে না দাঁড়িয়েও, কোনো মানুষের প্রত্যক্ষ প্রশ্নের
মুখোমুখি না হয়েও যে কখনো কখনো কাউকে এভাবে আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য দাঁড়াতে হয়, এটা তার জানা ছিল না। বেশিরভাগ
মানুষেরই জানা থাকে না। তাই রুহুল কুদ্দুস যে মরিয়া থেকে আরও-মরিয়া হয়ে উঠছে নিজেকে
নির্দোষ প্রতিপন্ন করার জন্যই, এটা সে নিজে কিছুতেই বুঝে উঠতে পারে না। ফলে সে এক কাল্পনিক ছায়ার সাথে বাহাসে
মেতে থাকে দুপুরভর, বিকালভর, এবং সন্ধ্যাভর। বাহাসের সাথে
সাথে যেন ক্রমান্বয়ে লুপ্ত হতে থাকে তার বাহ্যজ্ঞান।
তারপর হঠাৎ-ই সে থেমে যায়।
এই অকস্মাৎ থেমে পড়ায় যে নৈঃশব্দ নেমে আসে তা যেন তার নিজেরই বুকে প্রবল এক ঘুষির মতো
আঘাত করে। সে বুক চেপে ধরে দুই হাতে। বুকে বিছানো আঙুলের ফাঁক গলে বেরিয়ে মেঝেতে পড়ে
যায় জোড়াদুলের একটি। সে সেই মেঝেতে ময়লার পুরু আস্তরনের ওপরে পড়ে থাকা হীরে-জ্বলজ্বল
দুলটির দিকে তাকায়। তাকায় হাতের সাথে তখনও লেগে থাকা জোড়ার অন্য দুলটির দিকে। তারপরে
নিঃসাড় পড়ে থাকা বাপের দিকে। কী মনে হয়, সে নোংরা মেঝেতে হাঁটু গেড়ে বসে বাপের বিছানার পাশে। তার চোখ
এবং বাপের চোখ এখন একই সমতলে। সে বিড় বিড় করে বলতে থাকেÑ কিডা এখন তুমাক পুছে আব্বা!
আজরাইলও এখন তুমাক পুছে না। কেউ তুমাক পুছে না গো আব্বা!
হাউ হাউ করে কেঁদে উঠে সে পুঁজ-কফ-গু-মুত
মাখানো হাড়সর্বস্ব কঙ্কালকাঠামোটিকে জড়িয়ে ধরে দুই হাতে সর্বশক্তিতে।
০২.
নাহ্ তৃষা, তোমার এত ভুলোমন! এত অগোছালো
তুমি! ঐ দ্যাখো সোফার পায়ের কাছে তোমার দুলজোড়া পড়ে আছে। যাও যাও, তুলে রেখে এসো তোমার আম্মার
কাছে। এত দামি জিনিস এইভাবে ফেলে রাখে মানুষ!
0 মন্তব্যসমূহ