অনিল ঘোষ
ঠিক বেরুবার
মুখে বাধা পেলেন যজ্ঞেশ্বর।
প্রতিদিন বিকেল না হতেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়েন
যজ্ঞেশ্বর। এই ছোট্ট মফস্সল শহরের এক চিলতে ফুসফুস বলতে আছে একটা পার্ক। তার মাঝে
বিশাল পুকুর। রোজ বিকেলে ওই পুকুরপাড়ে আড্ডা বসে। যজ্ঞেশ্বরের মতো প্রায় বুড়ো, অবসরপ্রাপ্ত পেনশনভোগী বা সবকিছু সন্তানদের
হাতে তুলে দেওয়া নিঃস্ব বৃদ্ধ কেউ কেউ চলে আসেন। শুরু হয়ে যায় একনাগাড়ে
কথা-গল্প-আলোচনা। সারাদিন পরে এই সময়টা যেন ক্লান্তিমুক্তির বিরাম। আড্ডায় কোনও
নির্দিষ্ট বিষয় নেই। দেশের খবর, রাজনীতি-অর্থনীতি-সমাজনীতি
সবই চলে আসে। সেখান থেকে এই শহরটার হাল হকিকত, আগে
কত ভালো ছিল, এখন দিন দিন কত খারাপ হচ্ছে-- এইসব কথা, কথা
থেকে তর্ক। এভাবে সময় গড়ায়। দিনের আলো মুছে গিয়ে সন্ধে নামে, ক্রমে রাত। কারও খেয়াল থাকে না। এর মধ্যে কেউ
হয়তো বলে বসল, ইস, আটটা
বেজে গেল যে! ‘কেয়া পাতার নৌকো’ শুরু হয়ে গেল বোধহয়। ব্যস, সেদিনের মতো আড্ডার ইতি। বাকি কথা পরের দিনের
জন্য তোলা রইল।
যজ্ঞেশ্বর জামাকাপড় পরে তৈরি হয়েছেন। লাঠির
জন্য সবে হাতটা বাড়িয়েছেন,
তখনই বড়ো ছেলের
বউ চিত্রা প্রায় ছুটতে ছুটতে এসে বলল, আপনি
কি বেরুচ্ছেন?
যজ্ঞেশ্বর থমকে গেলেন। মুহূর্তের জন্য বুকের
ভিতরটা জ্বলে উঠল রাগে, বিরক্তিতে। দেখতেই তো পাচ্ছে বেরুচ্ছেন, তবে জিজ্ঞেস করা কেন! তিনি তো রোজই যান, আসেন-- কেউ
ফিরেও তাকায় না, জিজ্ঞেস করা দূরে থাক। এ বাড়িতে ওঁর
দুই উপযুক্ত ছেলে বাস করে,
তাদের বউ, তাদের ছেলেমেয়েরা-- কই, তারা
তো খোঁজ পর্যন্ত নেয় না তিনি কেমন আছেন, কী
করছেন! তিনি আদৌ আছেন-- এটাও বোধহয় খেয়াল থাকে না ওদের। মাঝে
মাঝে এমনও হয়েছে, খাবার সময় কেউ হয়তো বলে বসল, ইস, বাবাকে
তো দেওয়া হয়নি! সরস্বতী বেঁচে থাকলে না হয় কথা ছিল। তার তো কাজই ছিল যজ্ঞেশ্বর কী
করছে, কী খাচ্ছে, কোথায় যাচ্ছে-- এসব
খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জিজ্ঞেস করা। সামান্য কাশি হলেও সে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ত। ঘুরেফিরে
একবার করে জিজ্ঞেস করা চাই,
কী হয়েছে, ডাক্তার ডাকব! যজ্ঞেশ্বর বিরক্ত হতেন।
আজ টের পান সরস্বতীর অভাবটা। আজ সে ওই দেওয়ালে
একরাশ ধুলোবালি আর শুকনো মালার আড়ালে হয়তো ফিকফিক করে হাসছে। এ বাড়ির কারও ইচ্ছা
বা সময় হয় না ধুলোবালি ঝেড়ে, বাসি মালা ফেলে
দিয়ে সরস্বতীর হাসিটাকে একটু উজ্জ্বল, ঝকঝকে
করে তুলতে। যজ্ঞেশ্বর পারেন না, অত উঁচুতে হাত
যায় না বলে। দু-একবার বাড়ির লোকদের বলে দেখেছেন, ফল
শূন্য। মা বা শাশুড়ি এ বাড়িতে অপাংক্তেয়। হয়তো যজ্ঞেশ্বরও। প্রথম প্রথম অসহ্য হলেও
অবস্থাটা এখন মেনে নিয়েছেন। নিজেকে প্রায় সরিয়ে নিয়েছেন বাড়ির ভূগোল থেকে, হয়তো ইতিহাস থেকেও। বৈকালিক আড্ডা না থাকলে
হয়তো পৃথিবী থেকেই সরে যাওয়ার কথা ভাবতেন। সারাজীবন ছাত্র পড়িয়ে এখনকার এই অবস্থা
ওঁর পাওনা ছিল না, কিন্তু নিরুপায়।
রোজকার রুটিনবদ্ধ জীবনধারায় অভ্যস্ত যজ্ঞেশ্বর
চিত্রার কথায় মনে মনে অবাক হয়েছেন। রাগ বিরক্তি উপরের প্রলেপ। আসলে আশ্চর্য
হওয়াটাই সত্যি। এতটাই আশ্চর্য যে, কী করবেন কী
বলবেন ঠিক করতে পারছিলেন না। অকারণে লাঠিটার জন্য তাকালেন ঘরের এদিক ওদিক। যদিও
সেটা আছে হাতের নাগালের মধ্যে।
কথার উত্তর না পেয়ে চিত্রা আবার বলল, আপনি কি সত্যিই বেরুচ্ছেন বাবা?
২
কথার ধরনে যজ্ঞেশ্বরের রাগ হলেও সামলে নিলেন।
মাথা নেড়ে গম্ভীর গলায় বললেন, হুঁ।
চিত্রা উদ্বেগের গলায় বলল, যাবেন না আজ।
যজ্ঞেশ্বর যেন তখনই বলার মতো কথা খুঁজে পেলেন, কেন বলো তো?
আপনার ছেলে ফোন করেছিল, শহরের অবস্থা ভালো নয়। কী সব গোলমাল হচ্ছে!
পুলিশ র্যাফ নেমেছে।
গতকালকের খুন নিয়ে তো!
আপনি জানেন!
জানি মানে, আমি
তো দেখেছি।
কথাটা এমন হালকা সুরে বলা হল যে চিত্রা ঠাট্টা
ভেবে ফিক করে হেসে ফেলল।
যজ্ঞেশ্বর গম্ভীর হয়ে বললেন, বিশ্বাস হল না তো!
কণ্ঠস্বরের গাম্ভীর্যে চিত্রার যাবতীয়
অবিশ্বাস থমকে গেল। মুহূর্তেই চোখদুটো বড়ো হয়ে গেল। তারপর প্রায় আর্তনাদের সুরে
বলে উঠল, কী বলছেন বাবা!
যজ্ঞেশ্বর হেসে বললেন, সত্যি।
চিত্রা আমতা আমতা করে বলল, না মানে আপনি--!
হ্যাঁ দেখেছি, নিজের
চোখে ।
যজ্ঞেশ্বর ডান হাতটা রাখলেন নিজের চোখের উপর।
তাঁর কথার বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে কোনও সন্দেহ চলে না এটাই বুঝিয়ে দিলেন আচরণে। চোখ
চেয়ে দেখলেন চিত্রার চোখ ভয়ে আতঙ্কে বিস্ফারিত হয়ে উঠেছে।
যজ্ঞেশ্বরের ঠোঁটের উপর হালকা হাসির রেখা
ছুঁয়েই মিলিয়ে গেল। চিত্রার ভয়টাকে আর একটু খুঁচিয়ে দেবার লোভ সামলাতে না পেরে
বললেন, গতরাতে খেয়েদেয়ে বেরিয়েছিলাম জানো তো!
কেন?
নস্যি ফুরিয়ে গিয়েছিল। যেতে হবে সেই বাজারের
মুখের দোকানটায়। আজকাল তো আবার যেখানে সেখানে লুজ নস্যি বিক্রি হয় না।
কখন গেলেন?
বাড়ির মানুষ কখন কোথায় যায় সে খেয়াল রাখো
তোমরা! যজ্ঞেশ্বর হেসে গায়ের ঝাল ঝাড়তে দ্বিধা করলেন না। বললেন, তোমার শাশুড়ি বেঁচে থাকলে হয়তো খেয়াল রাখতেন।
অত রাতে আপনি একা বেরুলেন!
কী করব, কেউ
তো এনে দেবে না। অগত্যা--,
আসলে কী জানো
বউমা, নেশা বড়ো খারাপ জিনিস। এমনি ঠিক আছি, কোনও সমস্যা নেই। কিন্তু একবার যদি মাথায় ঢোকে
তাহলে আর উপায় নেই। তাই--।
আহ্ আসল কথাটা বলুন না! চিত্রা অধৈর্য হয়ে
উঠল। যজ্ঞেশ্বর তবু থেমে একটু সময় নিয়ে বললেন, পার্কের
পাশের রাস্তায় সবে ঢুকেছি,
তখনই--। ব্যাপারটা আরও জটিল আর রহস্যময় করার
জন্য ইচ্ছে করে থামলেন যজ্ঞেশ্বর। প্রত্যাশিত ফল পাওয়া গেল প্রায় সঙ্গে সঙ্গে।
চিত্রা উত্তেজনায় প্রায় চিৎকার করে উঠল, থামলেন
কেন, বলুন--।
যজ্ঞেশ্বর স্বাভাবিক স্বরে বললেন, দেখলাম পার্কের মধ্যে একটা ছেলেকে সাত-আটজন
মিলে কোপাচ্ছে। ওফ্, সে কী রক্ত!
আপনি দেখতে পারলেন!
৩
এ কথার উত্তর দেওয়ার প্রয়োজন মনে করলেন না
যজ্ঞেশ্বর। মুখের উপর ফুটে উঠল শান্ত আর স্থিরতার হাসি। মনটাও হালকা লাগছে। তীব্র
প্রতিশোধ গ্রহণের পর যেমন লাগে। নাহ্, এর
মধ্যে যথেষ্ট ভয় ধরিয়ে দেওয়া গেছে। আর নয়।
যজ্ঞেশ্বর লাঠিটার দিকে হাত বাড়াবেন, তখনই চিত্রা বলল, যে
খুন হয়েছে তাকে আপনি চেনেন?
যজ্ঞেশ্বর মাথা নাড়লেন, না।
যারা খুন করেছে!
দুজনকে চিনি, আমার
কাছে পড়তে আসত।
লাঠিটা যেন তক্ষুণি পাওয়া গেল। হাত বাড়িয়ে
নিয়ে আর দাঁড়ালেন না যজ্ঞেশ্বর। উদ্দেশ্য সিদ্ধ হয়েছে। অনেকদিন উপেক্ষিত হতে হতে
নিজের গুরুত্ব বোঝানোর এই সামান্য সুযোগ হাতছাড়া হয় কেন? ওরা ভয় পাবে! পাক। ঘরে বসে কূটকচালি করার থেকে
একটু-আধটু ভয়-ডর পাওয়া ভালো।
সদর দরজাটা দূরে, উঠোন পেরিয়ে যেতে হয়। যজ্ঞেশ্বর বাইরে এসে টের
পেলেন বৈশাখী সূর্য আজ রোদের বান ডাকিয়ে দিয়েছে। এই বিকেলেও ঝাঁ ঝাঁ করছে চারদিক।
দেওয়াল ঘেঁসে দাঁড়ানো কচি পেয়ারা গাছটা পর্যন্ত মিয়নো মুড়ির মতো নেতিয়ে পড়েছে।
যজ্ঞেশ্বর সবে দু-পা হেঁটেছেন, পিছন থেকে
চিত্রা বলল, বাবা--!
যজ্ঞেশ্বর না ফিরেই বললেন, আবার কী!
যাবেন না। বুঝতে পারছেন না বাইরে কী হচ্ছে!
আপনার বড়ো ছেলে বারবার ফোনে বলছে, আপনি যেন বাইরে
না যান। ও নিজেও ফিরে আসছে অফিস থেকে।
যজ্ঞেশ্বর সান্ত¡নার সুরে বললেন, আমার
আর কী হবে! তুমি ভয় পেও না।
চিত্রা কী বলতে যাচ্ছিল, তার আগেই সদর দরজাটা খুলে গেল ঘটাং করে। ছোটো
ছেলে সুরঞ্জন ঢুকছে। চোখ শুকনো, চিন্তাগ্রস্ত।
সামনে যজ্ঞেশ্বরকে দেখে রুক্ষ স্বরে জিজ্ঞেস করল, কোথায়
যাওয়া হচ্ছে?
যজ্ঞেশ্বর অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন ছোটোছেলের
দিকে। বুঝতে পারলেন না কথাটা ওঁকে বলা হল নাকি বাইরের কোনও লোককে! সরাসরি আলাপের
থেকে ভাববাচ্যে পরিবর্তন,
এ তো রীতিমতো
হাসির ব্যাপার। আজকের আড্ডায় বিষয়টা তোলা যেতেই পারে। যজ্ঞেশ্বর মুচকি হাসলেন। মজা
করার লোভে তিনিও ভাববাচ্যে জিজ্ঞেস করলেন, কথাটা
কি আমায় বলা হল?
কথার খোঁচা ধরতে না পেরে সুরঞ্জন ঝেঁজে উঠল, হ্যাঁ আপনাকে, কোথায়
যাওয়া হচ্ছে শুনি?
এই একটু ঘুরতে।
বাইরে কী অবস্থা জানেন?
না।
গোটা শহরে বনধ্ শুরু হয়ে গেছে।
তাতে কী হয়েছে!
যা অবস্থা, যে-কোনও
মুহূর্তে গোলমাল লাগতে পারে। এর মধ্যে আপনি ঘুরতে যাচ্ছেন, আশ্চর্য!
কথাগুলো নিষেধ নয়, বাবার প্রতি শঙ্কা প্রকাশও নয়। এ যে রীতিমতো
বিদ্রুপ! মুখে বললেন, আমি বুড়ো মানুষ, আমার কী হবে!
৪
ঠিক তখনই পিছন থেকে চিত্রা আর্ত গলায় বলে উঠল, ঠাকুরপো ওঁকে আটকাও, নইলে সর্বনাশ হয়ে যাবে।
কথার সুরে-ছন্দে এমন কিছু বেরিয়ে এল, শুধু সুরঞ্জন নয়, যজ্ঞেশ্বর
পর্যন্ত চমকে উঠলেন। চোখের সামনে কাউকে মরতে দেখলেও বুঝি এমন চিৎকার করে না।
সুরঞ্জন কী বলবে, কী করবে ঠিক করতে না পেরে বিমূঢ়ের মতো
দাঁড়িয়ে পড়ল।
যজ্ঞেশ্বরের বেশ মজা লাগছে। এমনিতে দু-ভাই
বউতে মুখ দেখাদেখি নেই। খুঁটিনাটি নিয়ে চুলোচুলি লেগেই আছে। যজ্ঞেশ্বর কতবার
চেয়েছেন ওরা বরং আলাদা হয়ে যাক, দূরে থাক।
অশান্তি থেকে সে অন্তত ভালো। কিন্তু তা আর হয় না। এক হাঁড়িতে থেকে যত কূটকচাল। আজ
তাই অপ্রত্যাশিত আচরণে মজা পাওয়াই স্বাভাবিক।
চিত্রা ছুটে এসে যজ্ঞেশ্বরের হাত ধরে বলল, বাবা আপনি কোথাও যেতে পারবেন না।
আহ্, কী
ছেলেমানুষী করছ! যজ্ঞেশ্বর বিরক্ত হয়ে হাত ছাড়াতে গেলেন।
ছেলেমানুষী আপনি করছেন। সুরঞ্জন এতক্ষণে বলার
মতো কথা খুঁজে পেল। আদেশের ভঙ্গিতে বলল, চলুন, ঘরে চলুন।
যজ্ঞেশ্বর বিরক্ত হলেও বুঝলেন সুরঞ্জনের কথা
না শুনে উপায় নেই। বলা যায় না এরপর হয়তো ধাক্কা মেরে ঢোকাতে পারে। সেইটুকু কষ্টের
হাত থেকে ওদের বাঁচাতে যজ্ঞেশ্বর নিজেই চলে এলেন ঘরে।
ঘর বলতে কী, এক
চিল আস্তানা। খুপরিও বলা যায়। বাইরের বারান্দার একটা অংশ ঘিরে করা। ঘরে স্থান
সংকুলানের অভাব মেটাতে হয়েছিল এইভাবে। আত্মীয়-কুটুম্ব এলে আশেপাশের বাড়িতে
ব্যবস্থা করার চেয়ে এখানে রাত কাটানো যাবে। অথচ এখন সেখানেই ওঁর অবস্থান। রোদ আসে
না, হাওয়া খেলে না-- দিনের বেলায় আলো জ্বালতে হয়। আর মশার উপদ্রব তো
কহতব্য নয়।
যজ্ঞেশ্বরের রাগ হয়। নিজের পয়সায় তৈরি করা
বাড়িতে কেন বাইরের লোকের মতো থাকতে হবে! মন বিক্ষুব্ধ হয় টাকাগুলো বাজে খরচ হয়ে
গেল ভেবে। টাকা থাকলে আজ গায়ে ফুঁ দিয়ে ঘুরতে পারতেন। পায়ের উপর পা তুলে খবরদারি
করতে পারতেন সবকিছুর উপর। এ দুনিয়ায় টাকায় কী না হয়! স্নেহ-ভালোবাসা-মায়া-মমতা-- সব টাকার বশ! আজ টাকা নেই কিছুই নেই।
ফাঁকা ঘরে একা থাকা গেল না বেশিক্ষণ। নিজের
ভাবনায় বুঁদ যজ্ঞেশ্বর টের পেলেন ঘরে মানুষের উপস্থিতি। দুই ছেলে নিরঞ্জন আর
সুরঞ্জন, চিত্রা আর ওদের ছোটো ছোটো ছেলেমেয়েরা
ছড়িয়ে ছিটিয়ে দাঁড়িয়ে অথবা বসে। সবাই অবাক চোখে দেখছে ওঁকে।
যজ্ঞেশ্বর বুঝতে পারছেন না কে কোনজন! অনেক দিন
সেইভাবে দেখাসাক্ষাৎ নেই,
কথাবার্তা তো
নেই-ই। আজ সবাইকে একসঙ্গে দেখে যজ্ঞেশ্বরের আনন্দ হওয়ার বদলে চিন্তা হয়, এদের মতলব কী?
চিত্রা বলল, বাবা
আপনি কি তখন ঠাট্টা করছিলেন?
যজ্ঞেশ্বর গম্ভীর গলায় বললেন, আমি মিথ্যা বলি না বউমা।
সুরঞ্জন বলল, না-না
আপনি ভুল দেখেছেন আর নিজের মনে গল্প তৈরি করেছেন।
গল্প তৈরি করে আমার লাভ কী!
এই সময় সুরঞ্জনের বউ দিতি ঘরে ঢুকল। বুদ্ধিমতী
মেয়ে। পরিস্থিতি বুঝে শ্বশুরের পাশে বসে আদুরে গলায় বলল, আপনি কেন শুধু শুধু ভয় দেখাচ্ছেন বাবা? এইসব কথা বাইরে প্রকাশ হলে কী হবে জানেন!
কী হবে?
৫
ঝামেলা হবে। যে খুন হয়েছে আর যারা খুন করেছে
তাদের দলবল আমাদের উপর হামলা করতে পারে।
তাই বলে চোখে দেখা ঘটনাকে মিথ্যে বলে উড়িয়ে
দেব!
হ্যাঁ দেবেন। নিরঞ্জন প্রায় ধমকে উঠল, এখন যা যুগ পড়েছে তাতে এটাই ঠিক।
যুগ কারা তৈরি করে বড়োখোকা?
নিরঞ্জন বিরক্ত হয়ে বলল, আহ্ এটা তত্ত্বকথার সময় নয় বাবা। আপনি কেন
খামোকা বাইরের ঝামেলা ঘরে টেনে আনবেন!
যজ্ঞেশ্বর অবাক হয়ে বললেন, আমি তো আনিনি, আনার
কথাও বলিনি।
কিন্তু আপনি চেপে রাখতেও পারবেন না।
চেপে রাখব কেন! একটা ছেলে প্রকাশ্য রাস্তায়
খুন হল, আমারই চোখের সামনে--!
চিত্রা বলল, কে
খুন হয়েছে জানেন না তো?
না।
তখন আপনাকে বলিনি। ছেলেটির নাম সুবীর দত্ত।
কোন সুবীর দত্ত?
গেল মাসে যে ছেলেটা ওই পার্কে ইভটিজিং-এর
প্রতিবাদ করে চারটে ছেলেকে পুলিশের হাতে তুলে দিয়েছিল, সেই ছেলেটা।
ইস, তাহলে
তো খুব অন্যায় হয়ে গেছে। যজ্ঞেশ্বর কপাল চাপড়ালেন।
সুরঞ্জন বলল, কীসের
অন্যায়?
যজ্ঞেশ্বর কথা বললেন না। মুখ দিয়ে শুধু ইস-ইস
শব্দ করে চললেন।
দিতি বলল, ব্যাপারটা
এখন খুব বাজে জায়গায় চলে গেছে। এখন যদি জানতে পারে আপনি ওই খুনের প্রত্যক্ষদর্শী, তাহলে কী হবে ভাবতে পারছেন! এই তো কিছুদিন আগে
গোবরডাঙায় কী হল কাগজে পড়লেন তো! ওই যে তপন সরকার, খুব
পপুলার স্কুল টিচার, কত লোকজনের উপকার করত-- সে বছর দুয়েক আগে গণধর্ষণের অপরাধীদের বিরুদ্ধে
আন্দোলন করে এলাকাছাড়া করে,
পুলিশের হাতে
ধরিয়ে দেয়। অথচ সেদিন প্রকাশ্যে স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে তাকে গুলি করে মারা হল।
নিরঞ্জন বলল, ছেলেপুলে
নিয়ে বাস করি, কত সাবধানে থাকতে হয়। আপনার পাগলামির
কারণে কি আমরা মারা পড়ব!
যজ্ঞেশ্বর মাথা নিচু করে বসে আছেন, ওদের কথা যেন শুনতেই পেলেন না। মুখে অস্ফুট
ইস-ইস ধ্বনি।
নিরঞ্জনরা ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়ার সময় বলল, বাবা, আমাদের
কথাগুলো একটু ভেবে দেখবেন।
বাইরে থেকে দিতির গলা শোনা গেল, ওঁর আর কী, খাচ্ছে-দাচ্ছে
আর উড়ে উড়ে বেড়াচ্ছে। নিজেকে তো করে খেতে হয় না।
একচিলতে ঘরে কথাগুলো যেন সুচের মতো এসে বিদ্ধ
করল। ইচ্ছে হল ছুটে গিয়ে ঠাস ঠাস করে দিতির গালে দুটো চড় কষিয়ে দিয়ে আসেন। রাগটা
কিছুক্ষণের জন্য শরীর গরম করে উড়ে গেল। কথাগুলো সত্যি, বড়ো রূঢ় সত্যি। যজ্ঞেশ্বর কেন্নোর মতো গুটিয়ে
গেলেন। রাগ করবেন! কার উপর রাগ করবেন! এরা সব খোলসের বাসিন্দা। বাইরের চাপ থেকে
বাঁচার জন্য ন্যায়-নীতি-সততা-বিবেক-বুদ্ধি-চারিত্রিক দৃঢ়তা সব বিসর্জন দিয়ে বসে
আছে। এক-একটা জড়ভরত মার্কা জীব। নিজের স্বার্থ ছাড়া কিছুই বোঝে না। আত্মকেন্দ্রিক
নপুংসকের দল। সবসময় ভয়ে ঘরের মধ্যে গুটিয়ে আছে। চোখের সামনে
৬
একটা ছেলে খুন
হয়ে গেল। ওঁরই চোখের সামনে। তিনি দেখেও সেটা বলতে পারবেন না! খুনের কোনও কিনারা
হবে না! কোনও বিচার হবে না!
একটু পরে চিত্রা ফিরে এল হাতে চায়ের কাপ নিয়ে।
দেখে বিরক্ত হলেন যজ্ঞেশ্বর। এ বাড়িতে এত তাড়াতাড়ি চা হয় না। আজ কেন? নাকি চিত্রা ওঁকে মুখ বন্ধ রাখার জন্য ঘুষ
দিতে চাইছে!
যজ্ঞেশ্বর মাথা নিচু করলেন। বুকের ভিতর থেকে উঠে আসছে অনবরত একটা ইস-ইস ধ্বনি।
চিত্রা চায়ের কাপ টেবিলে রেখে বলল, বাবা, ওই
ছেলেটা খুন হওয়াতে দেখছি আপনি তখন থেকে খুব দুঃখ করছেন!
যজ্ঞেশ্বর মাথা তুললেন। গম্ভীর হয়ে বললেন, বউমা, যে
কাজটা কালই আমার করা উচিত ছিল, সেটা না করতে
পেরে বড়ো আফশোস হচ্ছে। ইস--।
ছেলেটিকে কি চিনতেন?
না, তবে
ঘটনাটা জানতাম।
কীভাবে?
আরে ওই পার্কে তো রোজ আমরাও বসি। বসে বসে
রাজা-উজির মারি। আমাদেরই আশেপাশে কিছু ছেলে কী উচ্ছৃঙ্খল আচরণ করে বলে বোঝানো যাবে
না। মদ-গাঁজা তো প্রকাশ্যে খায়, মেয়েদের দেখে
টোন-টিটকিরি আছেই, তারপর কোনও কোনও দিন দেখি হাত ধরে
টানাটানি পর্যন্ত চলছে। কী সব ভাষা ওদের মুখে! শুনলে পিলে চমকে যায়। মদ খাওয়াকে
বলে টান্টু মারা! হায়রে বিদ্যাসাগর, আপনি
কাদের জন্য বর্ণপরিচয় লিখেছিলেন! আফশোস কোথায় জানো, আমরা
সব দেখেশুনে চুপ করে থাকি। ওই ছেলেটা তবু প্রতিবাদ করেছিল, আর আমি কিনা ভেবেছিলাম, যতসব বাঁদর ছেলে নিজেদের মধ্যে খুনোখুনি করছে
করুক, মরুক। পৃথিবীর ভার তবু কমবে। আজ
তোমাদের কাছে ছেলেটির পরিচয় শুনে খুব দুঃখ
পাচ্ছি, লজ্জাও হচ্ছে। ছিÑছি--।
অনেকক্ষণ একটানা কথা বলে থামলেন যজ্ঞেশ্বর।
দুঃখ আর লজ্জাটা ঠিক কত সেটা বোঝানোর জন্য দুটো হাত দু-দিকে ছড়িয়ে দিলেন। মুখে সেই
ইস-ইস ধ্বনি। চিত্রা বলল,
বাবা দুঃখ করবেন
না, প্লিজ।
যজ্ঞেশ্বর উত্তেজিত হয়ে বললেন, কেন করব না! আমরা যদি আমাদের দায়িত্ব ঠিকমতো
পালন করতাম, তাহলে ওই ছেলেটাকে এভাবে প্রাণ দিতে হত
না। কিন্তু আমরা কী করলাম! ওদের খিস্তি খেউড়গুলো বেমালুম হজম করে নিরাপদ দূরত্বে
বসে রইলাম। ওই ছেলেটিও পারত নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখতে, তাতে অন্তত ওর প্রাণ যেত না। বউমা, কাল যদি বুঝতে পারতাম ও সেই প্রতিবাদী ছেলেটা--! যজ্ঞেশ্বর থামলেন। হাত বাড়িয়ে চায়ের কাপ টেনে
নিয়ে চুমুক দিলেন।
চিত্রা বলল, তাহলে
কী করতেন?
অন্তত বাধা দিতে পারতাম। ছেলেটার জায়গায় না হয়
আমিই--!
বাবা! চিত্রা প্রায় আর্তনাদ করে উঠল, এ আপনি কী বলছেন?
বউমা, আমার
জীবন তো প্রায় শেষ হয়ে এসেছে, আর ক-দিনই বা
বাঁচব! একবার ভাবো তো ওই ছেলেটার কথা! যে জীবন শুরুই করল না, এর মধ্যেই তাকে চলে যেতে হল! কার জন্য তাকে জীবন
দিতে হল? হয়তো আমাদের কোনও ঘরের মেয়ের সম্মান
রক্ষার জন্য--। আমি বুঝতে পারছি না বউমা, অন্যায়ের প্রতিবাদ করলেই কি মরতে হবে! আমরা কি
এতটাই অক্ষম হয়ে পড়েছি!
এভাবে বলবেন না বাবা।
৭
কেন বলব না! আজ
তোমরা আমায় ঘরে বন্দি করে রাখছ, কিন্তু একবার
ভাবো তো, যদি তোমার মেয়ে পড়তে গিয়ে ওইরকম কিছু
বদছেলের পাল্লায় পড়ে তখন কী করবে! পারবে ঘরের মধ্যে এভাবে আটকে থাকতে?
যজ্ঞেশ্বর জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালেন চিত্রার
দিকে। চিত্রা চুপ। কথা বলছে না। যজ্ঞেশ্বর হেসে বললেন, বউমা ইতিহাসের দিকে তাকাও। ঠিক এভাবেই প্রায়
বিনা প্রতিবাদেই আমাদের দেশটা বারেবারে বিদেশি শক্তির কাছে পদানত হংেছে।
একদিন বাবর মাত্র বারোশো সৈন্য নিয়ে ভারত
দেশট কীভাবো দখল করে নিল। বখতিয়ার খিলজি ক-টা সৈন্য নিয়ে এসেছিল বাংলা দখল করার
জন্য! কিংবা পলাশির প্রান্তরে রবার্ট ক্লাইভের সৈন্যসংখা কত ছিল? পারল কী করে! ভাবো বউমা, ভাবো। আসলে সমস্যা কোথায় জানো,
আমরা চাই আমাদের
দেশে বিবেকানন্দ, নেতাজী যত খুশি জন্মাক, কিন্তু সেটা যেন আমাদের ঘরে না হয়।
বিপ্লব-বিদ্রোহ-সংগ্রাম যা খুশি হোক সব ঘরের বাইরে, তার
আঁচ যেন আমাদের গায়ে না পড়ে। এভাবেই তো অন্যেরা সুযোগ নেয়। আর আমরা অন্যের দাস হয়ে
যাই, টেরও পাই না।
চিত্রা অসহিষ্ণু হয়ে বলল, আপনার ওইসব বড়ো বড়ো কথা আমি বুঝি না, বুঝতেও চাই না। ছাপোষা মানুষ আমরা, ঝুটঝামেলায় থাকার কোনও ইচ্ছা নেই আমাদের। আপনি আর ঘাড়ে বয়ে এসব আনবেন না, আপনার কাছে হাতজোড় করে অনুরোধ করছি।
বলে চিত্রা আর দাঁড়াল না। দ্রুত চলে গেল ঘর
ছেড়ে। যজ্ঞেশ্বর দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। চিত্রা কিছুতেই বুঝতে চাইল না। এতক্ষণ যেন
ভস্মে ঘি ঢালা হল। এরাই আমাদের দেশের নাগরিক! হায় রে! অতি দুঃখেও হাসি পেল
যজ্ঞেশ্বরের।
গোটা বাড়ি নিঝুম হয়ে গেল। অন্যদিন তবু হইচই
হয়। তুচ্ছ কারণে খিটিমিটি তো লেগেই আছে। আজ সেসব যেন মন্ত্রবলে উধাও। শ্মশানের
স্তব্ধতা নেমে এসেছে গোটা বাড়িতে। মানুষ আছে কিনা, কোনও
প্রাণ আছে কিনা-- বোঝার উপায় নেই।
ঘরে থাকতে থাকতে বিরক্ত হয়ে উঠলেন যজ্ঞেশ্বর।
এ যেন বন্দি জীবন। সময় কাটে না কিছুতেই। সকাল থেকে দুপুর, দুপুর গড়িয়ে বিকেল-- এক-একটা মুূহূর্ত মনে হয় অনন্তকাল। দীর্ঘ
অভ্যেসে ঘর এখন একরকম পর হয়ে গেছে। মন টিকতে চায় না কিছুতেই। তবুও থাকতে পারতেন, কিন্তু বাড়ির লোকেরা যেভাবে নজর রাখছে ওঁর
প্রতিটি পদক্ষেপের দিকে, তাতেই মন বিদ্রোহী হয়ে ওঠে। কেন ওরা
এমন করবে? যজ্ঞেশ্বর চোর না ডাকাত! নাকি
চিড়িয়াখানার বন্দি জন্তু! যজ্ঞেশ্বর নিশ্চয়ই সকলের কাছে উপযাচক হয়ে বলতে যাচ্ছেন
না। এতটা সাহসী, আদর্শবাদী নন তিনি। চিত্রাকে যা বলেছেন, সেটা রাগের কথা। আসলে মনটা এরকমই হতে চায়।
কিন্তু বাস্তবের আয়নায় দেখলে তিনি তো খোলসেরই বাসিন্দা। শান্ত-নির্বিরোধ ভঙ্গিতে কাটিয়ে
দিচ্ছেন দিন আর সময়। আজ সেটা ভেঙে ফেলার কোনও কোনও কারণ দেখছেন না। বাড়ির লোকেরা
সেটাই বুঝতে চাইছে না কেন?
সন্ধের দিকে আর পারলেন না যজ্ঞেশ্বর। বৈশাখের
গুমোট গরম আর হাড় জ্বালানো মশার উৎপাতে ঘরে থাকা মানে আত্মহত্যার শামিল। মাথাটাও
কেমন বোধবুদ্ধিহীন হয়ে গেছে। একটু ঠান্ডা হাওয়ায় ঘোরা দরকার।
যজ্ঞেশ্বর উঠে পড়লেন। যা হয় হোক, তিনি বাইরে যাবেনই।
প্রস্তুত হয়ে বেরোতে যাবেন, দেখলেন দরজার কাছে নিরঞ্জন দাঁড়িয়ে। অমায়িক
ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করল, বেরুচ্ছেন নাকি!
যজ্ঞেশ্বর অসহিষ্ণু হয়ে বললেন, দেখতেই পাচ্ছ।
এই অবস্থায়!
৮
কী অবস্থা! একটা খুন হয়েছে বলে সবাইকে ঘরে
ঘোমটা টেনে বসে থাকতে হবে নাকি!
সুরঞ্জন ছুটে এসে বলল, আপনি যাচ্ছেন কেন?
যজ্ঞেশ্বর অসহায়ের মতো বলল, আমি একটু খোলা হাওয়ায় ঘুরতে চাই, তাতেও তোমাদের আপত্তি!
নিরঞ্জন বলল, না
মানে, বুঝতেই তো পারছেন--।
কী বুঝব?
আপনার কিছু বলা মানে--!
থাক, সেকথা
তোমায় বলতে হবে না। ভালো-মন্দ জ্ঞান আমার এখনও লোপ পায়নি।
নিজের ঘর থেকে দিতি ইয়ার্কির ঢঙে বলল, ওঁকে আটকিও না, নিজের
চোখেই দেখে আসুন অবস্থাটা।
চিত্রা বলল, ঠাকুরপো
বাবাকে যেতে দাও। উনি কিছু বলবেন না। আমায় কথা দিয়েছেন।
সুরঞ্জন বিরক্তির সঙ্গে টিপ্পনী কাটল, নিজের ভালো পাগলেও বোঝে।
যজ্ঞেশ্বরের আর সহ্য হচ্ছিল না, একরকম ছুটেই পেরিয়ে গেলেন সদর দরজা।
রাস্তায় যখন পা দিলেন, তখন রীতিমতো ফুঁসছেন। এরা ভেবেছে কী! তিনি মরে
গেছেন! উপযুক্ত জবাব দেওয়ার নেশায় হন হন করে হাঁটতে লাগলেন যজ্ঞেশ্বর।
রাস্তা অন্য দিনের তুলনায় যথেষ্ট নির্জন।
দোকানপাট বন্ধ, বাস-লরি চলছে না। সন্ধের মুখেই
মরুভূমির চেহারা নিয়েছে শহরটা। লোকজন চলছে কম। দু-চারটে সাইকেল পেরিয়ে যাচ্ছে
হুশহাশ করে। সকলের চোখে মুখে ভয় আর আতঙ্কের ছাপ। এর মানে বনধ্ সফল। কোনও দল যদি
বনধ্ ডেকে থাকে, তবে নিশ্চয়ই তারা দেঁতো হেসে সাফল্য
দাবি করবে।
যজ্ঞেশ্বর হাঁটছেন। গতিবেগ আগের তুলনায় কম।
বুক কেঁপে উঠছে অজানা আশঙ্কায়। এক পা দু-পা করে পার্কের কাছে পৌঁছে গেলেন। ওই তো সেই জায়গাটা।
সন্ধে নেমে গেছে। পার্ক জুড়ে চাপ চাপ অন্ধকার।
মিটমিট করে আলো জ্বলছে। কিন্তু তার ঔজ্জ্বল্য যেন হারিয়ে গেছে। দূর থেকে তাই
বোঝেননি যজ্ঞেশ্বর, কাছে এসে দেখলেন-- খুনের জায়গাটা কালো আর সাদা কাপড়ে ঘেরা। ভিতরে
ইট সাজিয়ে করা হয়েছে অস্থায়ী শহিদ বেদী। ফুল মালা ছড়িয়ে আছে ইতস্তত। ধূপ জ্বলছে।
ওইখানেই পড়েছিল লাশটা। কিছুদূরে দুজন পুলিশ কনস্টেবল পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে।
যজ্ঞেশ্বর ধীর পায়ে পেরিয়ে গেলেন জায়গাটা। এই
দিকটা আরও নির্জন। আরও অন্ধকার। পথ চলতি দু-একজন ছাড়া সবকিছু নীরব নিথর। কী হল, ভয় পেল নাকি! কার ভয়, কীসের ভয়! যজ্ঞেশ্বর একবার ভাবলেন ফিরে যাবেন।
মুখটা ব্যাজার হয়ে গেল সঙ্গে সঙ্গে। ফিরের যাওয়া মানে সেই তো অন্ধকার ঘুপচি ঘর, গরম আর মশার দাপট। তার উপর ওদের টীকাণ্ডটিপ্পনী।
অসহ্য রাগ ছড়িয়ে যাচ্ছে রোমে রোমে। অথচ কী করবেন ভেবে পাচ্ছেন না যজ্ঞেশ্বর। রাগ-দুঃখ-যন্ত্রণা আর অসহায়তা মিলেমিশে একাকার
হয়ে গেছে। কিছু একটা করতেই হবে। আদর্শের জন্য নয়, নিজের
জন্য। অসহ্য অবস্থা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য। নিথর জলের মতো এই জীবনে একটু
ওলোটপালোট না হলেই নয়।
যজ্ঞেশ্বর ভাবলেন, স্মরজিৎ চৌধুরীর সঙ্গে পরামর্শ করলে কেমন হয়!
এই তো পার্কের পাশেই ওঁর বাড়ি। পার্কে নিয়মিত আড্ডাধারীদের মধ্যে চৌধুরী একজন।
দুজনে শিক্ষকতা করতেন। মনের মিলও আছে। সমস্যায় পড়লে নিজেদের মধ্যে শলা-পরামর্শ
একরকম অবধারিত।
৯
পায়ে পায়ে এগোলেন যজ্ঞেশ্বর। গেট পেরিয়ে দুটো
বাড়ি পরেই চৌধুরীর বাড়ি। সামনেটা অন্ধকার। গোটা বাড়িতে কোথাও আলো জ্বলছে না। অথচ
লোডশেডিং না। কী ব্যাপার! যজ্ঞেশ্বর বাড়ির গেটে দাঁড়িয়ে হাঁক পাড়লেন, চৌধুরী, চৌধুরী
আছ নাকি--!
কোনও সাড়াশব্দ নেই। বারদুয়েক হাঁকাহাঁকির পর
ভিতর থেকে এক মহিলার কর্কশ কণ্ঠ ভেসে এল, কে? চৌধুরী অসুস্থ, যেতে
পারবে না।
প্রশ্ন এবং উত্তর একসঙ্গে এসে গেল। এরপর আর
কথা চলে না। যজ্ঞেশ্বর ফেরার জন্য ঘুরলেন, তখনই
শুনতে পেলেন ভিতরে সেই মহিলার কর্কশ গলা, ওহ্, রস কত! এই খুনোখুনির দিনেও আড্ডা মারতে না
পারলে বুঝি রস মাঠো হচ্ছে না!
চৌধুরীর চাপা গলা শোনা গেল, আহ্, শুনতে
পাবে!
শুনুক।
যজ্ঞেশ্বর আর দাঁড়ালেন না। কান-মাথা গরম হয়ে
যাচ্ছে। ঘর-বাড়ি পেরিয়ে যাচ্ছেন দ্রুত। যেন তাড়া খাওয়া কুকুরের মতো ছুটছেন
যজ্ঞেশ্বর। ভীতুর ডিম সব। ভাবছে ঘরে মুখ লুকিয়ে থাকলেই বুঝি আগুনের তাপ থেকে
বাঁচতে পারবে! এভাবে বাঁচা যায় নাকি! আর
একে বাঁচাও বলে না। যজ্ঞেশ্বর দাঁড়িয়ে পড়লেন। কোথায় যাবেন! কোথায় যাওয়া যেতে পারে!
চৌধুরীর যা অবস্থা দেখলেন,
তাতে আর কারও
কাছে যাওয়ার কোনও মানে
হয় না। আড্ডায়
সব এক-একটা বাঘ-ভালুক। হালুম-হুলুম করে রাজা-উজির মেরেই যাচ্ছে। অথচ যখন একটা
অন্যায়ের বিরুদ্ধে সত্যিকারের প্রতিবাদ উঠেছে, তখন
কোথায় সবাই বেরিয়ে আসবে, তা না, খোলসের
মধ্যে গিয়ে নিশ্চিন্তে বসে আছে। নাহ্, এই
ভীতুর ডিমেদের সঙ্গে মিশে লাভ নেই। কিন্তু কিছু একটা করতেই হবে। না হলে তিনি যে
আলাদা কিছু, সেটা প্রমাণ হবে কী করে! যজ্ঞেশ্বর
ভাবলেন, তিনি যদি পুলিশের কাছে গিয়ে বলেন, তাহলে কী হতে পারে! শহরসুদ্ধ লোক কি ওঁর উপর
ঝাঁপিয়ে পড়বে! কিংবা যারা ওই খুনের দলে ছিল, তাদের
দলবল কি বোমা মারবে বাড়িতে! না, এতটা ভীষণ
ব্যাপার তিনি কল্পনাতেও আনেন না।
রাস্তায় উদ্দেশ্যহীনভাবে হাঁটছেন যজ্ঞেশ্বর।
কোথায় কতদূরে চলে এসেছেন খেয়াল নেই। এভাবে হাঁটতে ভালো লাগে। কষ্ট হয় না।
খেলতেন বয়েসকালে। সেন্টার ফরোয়ার্ড। বল পায়ে
বিপক্ষের ডিফেন্সে ছিলেন আতঙ্ক। না পেরে একদিন বিপক্ষের এক স্টপার সজোরে লাথি মেরে
ফেলে দিয়েছিল বক্সের মধ্যে। পা ভেঙে চলে যেতে হয়েছিল মাঠের বাইরে। আর ফেরেননি। অথচ
খেলার ঝোঁকটা রয়ে গেছে এখনও। সেটা একা এই উদ্দেশ্যহীন ভ্রমণে প্রকাশ পায়। শরীর
স্বাস্থ্য অনেকখানি ভেঙে গেছে, মনের জোর কমেনি
একটুও।
হাঁটতে হাঁটতে খেয়াল ছিল না কতদূরে চলে এসেছেন! হঠাৎ থমকে দাঁড়িয়ে পড়লেন।
সামনে থানার তিনতলা বাড়ি। যেতে আসতে কতবার এই বাড়িটাকে এড়িয়ে চলেছেন যজ্ঞেশ্বর। আজ
নিজেই অবাক হয়ে ভাবলেন, এ কি নিজের ইচ্ছায় আসা নাকি অবচেতনে
এখানেই আসতে চেয়েছেন! ফিরে যাবেন, নাকি ভিতরে
ঢুকবেন! ভাবনার সঙ্গে রোমাঞ্চ হল শরীরে। গা ঝাড়া দিয়ে উঠলেন।
পুলিশ ব্যাপারটার সঙ্গে চিরকালই ওঁর কেমন একটা
গা গোলানো সম্পর্ক। আজ মনে হল দেখাই যাক না কী হয়! তাঁকে তো কিছু তৈরি করতে হবে
না। যা দেখেছেন তাই বলবেন। কিছু করতে হলে পুলিশের কাছেই যাওয়াই উচিত। তবু তো
প্রমাণ হবে তিনি ভীরু নন,
কাপুরুষ নন।
অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে জানেন।
কেমন একটা অ্যাডভেঞ্চারের নেশা পেয়ে বসল
যজ্ঞেশ্বরকে। দ্বিধা সংকোচ ঝেড়ে ফেলে তিনি এগোলেন।
১০
হাঁটতে হাঁটতে মনে হল তিনি ছুটছেন। মনে হচ্ছে
বয়সকালের ফর্ম ফিরে এসেছে। দ্বিধা- জড়তা-সংকোচ-ভয়-- সবকিছু
ডজ করে এগিয়ে চলেছেন।
এভাবেই পৌঁছে গেলেন বড়ো ঘরটাতে। বাইরে একজন
কনস্টেবল দাঁড়িয়ে। ভুরু কুঁচকে তাকাল। বলল না কিছু।
যজ্ঞেশ্বর যখন ঘরে ঢুকলেন, তখন রীতিমতো হাঁফাচ্ছেন। সামনে বিশাল টেবিলের
ওপাশে বসে আছে খাকি পোশাকপরা পুলিশ অফিসার। পাশে আর একজন বসে সাধারণ পোশোকে।
যজ্ঞেশ্বরকে দেখে অফিসারের ভুরু কুঁচকে উঠল। গম্ভীর গলায় জিজ্ঞেস করল, কী চাই?
যজ্ঞেশ্বর উত্তেজনায় কাঁপছেন। জড়িয়ে জড়িয়ে
বললেন, জানেন আমি দেখেছি ওদের--।
কাদের?
ওই যারা কাল পার্কের মধ্যে একটা সৎ ছেলেকে খুন
করেছে--।
তাই নাকি! অফিসার হঠাৎ হো হো করে হেসে উঠলেন, নিশ্চয়ই তাদের নাম নেপলা ঘোতন বাচ্চু সরোজ!
হঠাৎ হাসিতে দমে গেছেন যজ্ঞেশ্বর। আমতা আমতা
করে বললেন, সবাইকে তো চিনি না, তবে দেখলে--।
ধুর মশাই, অফিসার
বাজখাঁই গলায় ধমকে উঠলেন,
আপনাকে নিয়ে
চারজন একই কথা বলে গেল। সবাই নাকি দেখেছে! আরে মশাই, যাদের
নাম করছেন তারা তো কেউ কাল ছিলই না এখানে। ওদের পার্টির প্রোগ্রামে সবাই কলকাতায়
ছিল-- আর আপনারা সব দেখে ফেললেন, কী করে দেখলেন মশাই! গাঁজা-টাজা খান নাকি!
যজ্ঞেশ্বর সব তালগোল হারিয়ে অন্ধকার দেখলেন
চোখে। মাথা টলে উঠল। থর থর করে কাঁপছে শরীর। কথা বলতে গিয়েও পারলেন না। গলার কাছে
ঘড় ঘড় শব্দ হল শুধু।
অফিসার উপদেশের ভঙ্গিতে বলল, বাড়ি যান মশাই, বাড়ি
যান, বনধের বাজারে অকারণ ঘোরাঘুরি করবেন না।
যজ্ঞেশ্বরের ইচ্ছে হল ছুটে গিয়ে সপাটে চড় মেরে
আসেন ওই অফিসারের গালে। হাতদুটো খানিক উঠেও ভাঙা ডালের মতো খসে পড়ল দু-দিকে। মনে
হল আজও সেই ডিফেন্ডার ওঁকে নিখুঁত ল্যাং মেরে ফেলে দিল বক্সের মধ্যে।
টলে পড়ে যাচ্ছিলেন যজ্ঞেশ্বর। হঠাৎ মনে হল, কী আশ্চর্য, তিনি
তো একা নন! ওঁর মতো আরও তিনজন এখানে এসেছিল ওই একই উদ্দেশ্য নিয়ে! সেই অজানা অচেনা
তিন মানুষের সঙ্গে সহমর্মিতা অনুভব করতে গিয়ে যজ্ঞেশ্বর টের পেলেন ওঁর পতনোন্মুখ
শরীরটা হঠাৎ খাড়া আর ঋজু হয়ে উঠল।
লেখক পরিচিতি
অনিল ঘোষ
জন্ম উত্তর ২৪ পরগনা জেলার বসিরহাট শহরে, নদীর তীরে। সেখানেই বসবাস, পড়াশোনা। তারপর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় এমএ। বাঁধাধরা চাকরির পথ ছেড়ে প্রায় বাউণ্ডুলে জীবনযাপন। কখনও টিউশানি, কখনও সাংবাদিকতা। বর্তমানে কলকাতার প্রকাশনা জগতের সঙ্গে যুক্ত।
পরিচয় পত্রিকার দপ্তর সম্পাদক। সম্পাদিত পত্রিকা ইছামতী বিদ্যাধরী।
লেখালেখির সূত্রপাত স্কুল থেকে। এ পর্যন্ত গল্প-উপন্যাস-নাটক ও অন্যান্য রচনা মিলিয়ে তেরোটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। উল্লেখযোগ্য গ্রন্থÑÑ রণক্ষেত্র, চারাগাছ ও অন্যান্য গল্প, নিউ জার্সির ফোন,মহাযুদ্ধের পটভূমি (গল্প সংকলন), প্রান্তরের গান (উপন্যাস), নির্বচিত নাটক (নাটক), অকিঞ্চন কথামালা (কবিতা), শ্রেষ্ঠ শিখা, বিষয় বসিরহাট (সম্পাদনা) প্রভৃতি।
২০০৭ সালে ছোটোগল্পের জন্য বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ প্রদত্ত ইলা চন্দ স্মৃতি পুরস্কার প্রাপক।
0 মন্তব্যসমূহ