পাঠকের গল্পপাঠ : কোন সাহিত্য বা শিল্প মাধ্যম যখন কোন ইজম প্রচার করে, তা আমার কাছে মন্দ

বনি আমিন

১. আপনি শুরুতে কি পড়তেন?

বনি আমিন :  শুরুতে তো আমি অ, আ, আলিফ, বা, তা, পড়েছি। তবে ভাল মতো পড়তে শিখে আমি আমার হাতের কাছে যা পেয়েছি, তাই পড়েছি। যেমন কসুসুল আম্বিয়া (নবীদের কাহিনী) আমাদের বাড়িতে থাকত সেটা পড়েছি, মীর মশাররফ হোসেনের বিষাদ সিন্ধু, হাসান-হোসেনের কারবালার পুথি, একটা বই আমার বাবা সন্ধ্যা বেলা পড়তে বসতেন আর অন্যান্যরা তার চারপাশ ঘিরে তা শুনতেন। সে বইটা ছিল আনোয়ারা নজিবর রহমান সাহিত্য রত্নের লেখা। ক্লাস সেভেনে যখন পড়ি তখন কোন এক অখ্যাত লেখকের এক চটি উপন্যাস পড়েছিলাম ট্র্যাজিডিমূলক প্রেম কাহিনী নাম সমাধির পাশে। আমার মাধ্যমে সে সময় আমার সহপাঠীরা সবাই কাহিনীটা পড়ে সে বয়সে বেশ মজা পেয়েছিল। ক্লাসের সহপাঠক্রমিকে কাজী নজরুল ইসলামের পদ্ম গোখরা গল্পটা এবং তারপর শরৎচন্দ্র চট্রোপাধ্যায়ের শ্রীকান্ত পড়তে পড়তে ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়ের অনেক চটি উপন্যাস পড়েছি - যে-গুলো আমার বাবাও পড়তেন।

২. এর মধ্যে গল্প কখন পড়া শুরু করলেন? 


বনি আমিন : গল্প বলতে যদি উপন্যাসকে(আমাদের ভাষায় বৃহৎ জীবন প্রেক্ষাপটের কাহিনীতো নেই, যা আছে তাকে গল্প বললেই চলে) অন্তর্ভুক্ত করে বাংলা কথাসাহিত্যকে বুঝান তাহলে সুবিধা হয়। সাহিত্যের ছাত্র হিসাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্য অন্তর্ভুক্ত অনেক গল্পই তো পড়তে হয়েছে। সে তালিকায় বঙ্কিম-রবীন্দ্র-শরৎ-মানিক-ওয়ালিউল্লাহ সব। সঞ্জীব চন্দ্র চট্রোপাধ্যায়ের পালামৌ ইতিহাস বইয়ে জেনেছিলাম। 

বর্তমানে অনলাইন জগতে এসে সেটি পড়ার সুযোগ পেলাম। আরো সুযোগ ঘটলো চন্ডীচরণ মুন্সীর তোতা ইতিহাস পড়ার। ক্লাস পাঠ্যের বাইরে আমি ভক্ত হয়ে পড়েছিলাম সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহ-র। তাঁর কাঁদো নদী কাদেঁা ক্লাসের জন্য নোট তৈরির আগেই আমাদের খুলনার উমেশচন্দ্র পাবলিক লাইব্রেরিতে বিকালগুলো কাটিয়ে পড়েছিলাম। তাছাড়া কমলকুমার মজুমদার এবং অমীয়ভূষণ মজুমদার পড়েছিলাম। তবে এ দু মজুমদারের মধ্যে আমার কাছে কমলই বেশি পছন্দের হয়ে উঠেছিল। 

আমি ওপার বাংলা থেকে প্রকাশিত দেশ পত্রিকায় প্রকাশিত গল্পগুলো পড়ার চেষ্টা করতাম। পয়সার অভাবে নতুন সংখ্যা কেনা হয়ে উঠতো না কিন্তু বহু পরনো সংখ্যা আমি কিনেছিলাম এবং গল্প সংখ্যাগুলোই সে তালিকায় বেশি ছিল। বৃহৎ আকারের একটি বিশেষ গল্প সংখ্যা আমার সংগ্রহে ছিল কিন্তু আজ আর তা নেই। আর একটি কাজ আমি করেছিলাম আমার সংগৃহীত দেশ পত্রিকার সকল গল্পগুলো পত্রিকা থেকে কেটে কেটে আলাদা করে বাধাই করেছিলাম। সে বাধাই গল্পগুলো সে সময়ের বড় ভাই মিজান ভাই বর্তমানে অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান পড়ার জন্য নিয়ে গিয়েছিলেন কিন্তু ফেরৎ দিয়েছিলেন কিনা আমার জানা নেই কারণ সে সখের গল্পগুলো আজ আর আমার কাছে নেই। সুনীলের(সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের) একটি গল্প বাংলা ছোট গল্পের শতবর্ষে দেশ পত্রিকায় প্রকাশিত আমাকে বেশ অনুপ্রাণিত করেছিল। 

হাসান-ইলিয়াস-শওকত এদেঁর মধ্যে ইলিয়াস কেন জানি আমার পড়া হয়নি। পরবর্তীকালে নাসরিন জাহান, হুমায়ূন মালিক, মশিউল আলম এদের গল্প পড়েছি। আমাদের সময়ের জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক মারা যাওয়ার পর তিনি যেন আরো একটি বিশেষণ পেয়েছেন মনে পড়ছে না। হুমায়ূন আহমদের নন্দিত নরকে আর শঙ্খনীল কারাগার ছাড়া আর কিছু পড়িনি। আমি মনে হয় ২ নম্বর প্রশ্নের যথার্থ উত্তর করছি না। কারণ প্রশ্নটা ছিল পড়ার মধ্যে গল্প পড়তে শুরু করলেন কখন ? এতো বড় উত্তর সেখানে দরকার নেই। আমি আসলে এভাবেই গল্প পড়া শুরু করি। 

৩.গল্প কেনো পড়েন? 

বনি আমিন : প্রশ্নটা সাদা-মাটা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন বিষয়ে এমন প্রশ্ন করা হয়ে থাকে। যেমন, অনলাইন ভিত্তিক একটি সাক্ষাতকারে দেশের কবিদের জিঙ্গেস করা হয়েছিল কবিতা কেন লেখেন ? এমন প্রশ্নের উত্তর রসবোদ্ধার কাছে তিনটি শব্দে শেষ হয়ে যায়। আর যে তিনটি শব্দ হলো - ভালো লাগে তাই। ব্যস। তবে উত্তর পাওয়ার সাথে সাথে যদি পাল্টা প্রশ্ন আসে- কেন ভাল লাগে ? তবে বুঝি জবাবটা অমন শর্ট বাক্যে হয় না। পরের প্রশ্নগুলোতে বুঝি সে জবাব এসে যাবে। তাই পরবর্তী প্রশ্নে যাওয়া যাক। 

৪. জীবনে প্রথম কোন গল্পটি আপনাকে বেশী স্পর্শ করেছিল কেনো করেছিল?

বনি আমিন : সে গল্পটি আজ আমার কাছে স্মৃতি শুধু। স্মৃতি এ জন্য যে, গল্পটি আজ আর আমার কাছে নেই। হারিয়ে গেছে অনেক দিন হলো। তাই তার নামটি হুবহু বলতে পারছি না। স্মৃতি শক্তি থেকে - কোন একটা নাম সেটা সুদেব বা সুনীল এমন কিছু নাম সম্বোধনে বলা হচ্ছে এসো তোমাকে নিয়ে গল্প লেখা হবে গল্পটার নাম। লেখক সুনীল গঙ্গোপাধ্যয়। পড়েছিলাম দেশ পত্রিকায় বাংলা ছোট গল্পের শতবর্ষ সংখ্যায়। 

কেন বেশি স্পর্শ করেছিল ? রবীন্দ্রনাথ বাংলা ছোট গল্পের যে স্টাইল সূচনা করেছিলেন তার উত্তরণ গল্পটাতে ছিল। অধিকাংশ মানুষ পরিশ্রম বিমুখ। আর ভাষার কাঠামোয় আমাদের কাছে পৌঁছায় যে সাহিত্য তা পড়া যেমন সময় সাধ্য তেমনি পরিশ্রমও কম নয়। পরিবর্তিতে সময়ে মানুষ ক্রমাগত পরিশ্রম বিমুখ হয়ে পড়ছে আর সময় ? সেতো নেই আরো। সুতরাং ছোট গল্প হয়ে যাবে আরো ছোট মাত্র দেড় পৃষ্টায়। কিন্তু তার অনুভূতি হবে প্রগাঢ়। সুনীলের ঐ গল্পটার মধ্যে সেই উপস্থাপন লক্ষ্য করা গিয়েছিল। গল্পটার বিষয়ের মধ্যে দুটো বিষয় ছিল। ১. বেকারত্ব এবং ২. মানবিকতা। কিন্তু দুটো বিষয় আবার একটি রসোপলব্ধিতে পরিণতি পেয়েছিল সেটি হলো হতাশা। গল্পটা যখন আমি পড়েছিলাম তখন আমি বেকার ছিলাম এবং চারিদিকে দেখছিলাম ধর্মের উন্নতি, কর্মের উন্নতি, তর্কের উন্নতি কিন্তু মানবিকতার বিপর্যায়। আর মনটা হয়ে থাকত সবসময় হতাশাগ্রস্ত। হয়ত ঐ মানসিক অবস্থার কারণে গল্পটা আমাকে বেশি স্পর্শ করেছিল। 

৫. গল্প পড়তেন কিভাবে? কোন কোন সময়ে? কোন কোন পরিবেশে? পরিবারের কেউ বা বন্ধু বা শিক্ষক কি কেউ গল্প পড়তে উৎসাহিত করেছেন? একটি গল্প কিভাবে পড়তে হয়--সেটা কি কেউ কখনো আপনাকে দেখিয়ে দিয়েছেন

বনি আমিন : প্রথম তিনটা জিঙ্গাসাবোধকে আমি আহ্লাদিত এ কারণে যে, এ ধরণের প্রশ্ন কেউ করে না। কিন্তু একজন লেখক যখন কিছু লিখছেন তখন তার আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটটি গুরুত্বপূর্ণ আর একজন পাঠকের কাছে যখন এ ধরণের প্রশ্ন করা হচ্ছে তখন সেটাও গুরুত্বপূর্ণ। সিলেবাসভুক্ত পড়ালেখার বাইরে আমি গল্প পড়তাম লাইব্রেরিতে বসে, বাড়িতে অলস হতাশাগ্রস্ত সময়ে শুয়ে শুয়ে আব কখনো বা বড় কোন জার্নিতে - বাসে বা লঞ্চে। লাইব্রেরির সময়গুলো ছিল বিকাল কোন কোন দিন সন্ধ্যা পেরিয়ে এশার পর্যন্ত সময়ে। বাড়ির সময়গুলোর নির্দিষ্ট কোন কাল নেই। ছোট বেলায় দেখতাম আমার বাবা সন্ধ্যার পরে কোন বই নিয়ে বসেছেন রাতের খাবারের সময় পার হয়ে যাচ্ছে মা ডাকছেন ছোট থেকে বড় স্বরে তিনি উঠছেননা গল্প ছেড়ে। এটা মনে হয় সবার ক্ষেত্রে হয়। কোন গল্প নিয়ে যখন বসা হয়, শেষ না করে আর উঠতে ইচ্ছে করে না। তেমন আমার ক্ষেত্রেও হয়েছে। 

তবে আমার গল্প পাঠের সময়গুলো বেশি গেছে বিকালে। আমাদের খুলনা শহর ভৈরব নদী এর পরিপার্শ্ব গল্প পড়ার পরিবেশ। পরবর্তিকালে কর্ম করতে এসে গোপালগঞ্জের দিগনগরে। বই-পত্র, পত্রিকাদি এখানে কিছুই নেই। দৈনিক পত্রিকা আনতাম দূর থেকে। তার সাহিত্য পাতাগুলো ছিল মনের খোরাক। নিজের জমাকৃত পত্রিকাগুলো দেখে অনেক সহকর্মী রহস্য করেছেন - স্যারে কি করে দ্যাখো, দেবে কেজি দরে বিক্রি করে তা না করে সুতো দিয়ে বাধেঁ। এখানকার কুমার-জুলেখা নদীর প্রকৃতি-পরিবেশ তাও অনেক স্বাচ্ছন্দের। এই হলো আমার গল্প পড়ার পরিবেশ।

 আমি দেখেছি এখানকার পরিবেশে অনেক গল্প ছড়িয়ে আছে কিন্তু নিজে লেখক নই বলে তা অক্ষরবন্দী করতে পারিনি। আমার বাবা গল্প পড়তেন উপরের জবাবগুলোতে হয়ত উল্লেখ করেছি কিন্তু ক্লাসের প্রয়োজনীয় পড়া বাদ দিয়ে তিনি গল্প পড়তে বলবেন বা উতসাহিত করবেন তেমন আশা করা সত্যিই অসম্ভব। শিক্ষক এবং বন্ধুজন কেউ কখনো গল্প পড়তে উতসাহিত করেনি। তবে ফেসবুকের লেখক বন্ধুরা ইদানীং উতসাহিত করছেন। জানিনা এ উদ্বুদ্ধ করণের পিছে কোন দূরভিসন্ধি আছে কিনা। কারণ বর্তমান জামানাটা হয়েছে বাণিজ্যের যুগ। কোন কাজ করে যদি পয়সা কিছু উপার্জন না হয়, তাহলে সে কাজে কেউ উতসাহ পায় না বা উতসাহ দেয় না। অর্থ-বাণিজ্যই হয়েছে এ যুগের সবকিছুর নিয়ামক কিনা তাই এ অবস্থা। 

৫ নম্বরের শেষ জিঙ্গাসাটা “একটি গল্প কিভাবে পড়তে হয়--সেটা কি কেউ কখনো আপনাকে দেখিয়ে দিয়েছেন” কিনা বেশ মজার প্রশ্ন। সাহিত্য তো সাহিত্যই তা কিভাবে পড়তে হয় তা বোধহয় কেউ কখনো দেখিয়ে দেয় না। যেটি হয়ত শিক্ষকের কাজ কিন্তু আমি সাহিত্যের ছাত্র হয়ে আমার শিক্ষকদের নিকট থেকে সে শিক্ষাটা পাইনি। তাদের (সাহিত্যের শিক্ষকদের) বোধ হয় একটাই কথা যে, সাহিত্য তো আর ভৌত বিজ্ঞান নয়, যে তা কিভাবে পড়তে হয় তা হাতে কলমে দেখিয়ে দিতে হবে ? শিক্ষকরা শব্দের অর্থ বুঝতে সাহায্য করতে পারেন, কোন বিশেষ বোধের অর্থ উদাহরণসহযোগে ব্যাখ্যা করতে পারেন কিন্তু কিভাবে কোন গল্প পড়তে হবে। তা তো দেখিয়ে দেন না। না আমাকে কখনো কেউ দেখিয়ে দেন নি যে, একটা গল্প কিভাবে পড়তে হয়। 

৬. পড়ে কোনো গল্প ভালো লাগলে কি রকম অনুভূতি হয়? আপনার কি কখনো মনে হয়েছে গল্পের কোনো চরিত্র আপনার নিজের মত। বা চরিত্রটি আপনার মধ্যে চলে এসেছে। কিছুদিন তার মত করে চলাফেরা করতে শুরু করেছেন?
বনি আমিন : পড়ে কোন গল্প আমার মধ্যে যে অনুভূতি হয় তা বিচিত্র। কেননা সব গল্পের রসানুভূতি তো এক রকম নয়। রবীন্দ্রনাথের পোস্ট মাস্টার গল্পের রসানুভূতির সাথে মানিক বন্দোপাধ্যয়ের প্রাগৈতিহাসিক গল্পের অনুভূতি মেলানো যাবে না। আবার সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ-র নয়নচারা গল্পের সাথে মশিউল আলমের মাংসের কারবার-এর ক্ষেত্রেও সেই একই কথা প্রযোজ্য। তবে শুধু গল্প কেন সব সাহিত্যের ক্ষেত্রেই যে রসবোধের বিজারণ হয় তা মানুষকে এমন একটি স্থানে নিয়ে যায় সেখানে সে পরিশুদ্ধ হওয়ার সুযোগ পায়। 

আমি আমার শিক্ষার্থীদেরকে একটা কথা বলে থাকি, দ্যাখো, আমাদের সমাজটা দিনে দিনে যে পঙ্কিলতায় ডুবে যাচ্ছে। যে-গুলোকে আমরা অপকর্ম বলি তা বেড়ে যাওয়ার কারণ হলো সাহিত্যের পাঠ বিমুখতা। সাহিত্য পাঠে মন মননের যে চর্চা হয় তা অন্যকিছুতে হয় না। সাহিত্য হচ্ছে মানুষের মনের হাসপাতাল। এমন একটা কিছু যা মানুষের মনকে পরিচ্ছন্ন করতে পারে সে হলো সাহিত্য। এই লেখাটা যখন লিখছি তখন পাশেই বিশাল ওয়াজ মাহফিল চলছে। সেখানকার মুরুব্বী মাওলানা সাহেব যিকিরের তালিম দিচ্ছেন - অর্থাত যাতে মানুষের কলব পরিষ্কার হয়। আর কলবের উপরে কালিমা পড়ে গেছে বলেই তো এতো এতো অরাজকতা। যিকিরের মাধ্যমে কলব পরিষ্কার হলেই তো সব পরিষ্কার। ওনি ওনার পথে মন বিশুদ্ধ করার চেষ্টায় লিপ্ত। কিন্তু আমি মনে করি সাহিত্য পাঠের মাধ্যমেই মনের সেই বিশুদ্ধতা বেশি আসতে পারে। 

গল্পের কোনো চরিত্র নিজের সাথে তো মিলতে হয়। না মিললে সে ভাল লাগা দাবী করবে কিভাবে ? এটি আমার অনেক গল্প পড়ার ক্ষেত্রেই হয়েছে ; তবে গল্পের চরিত্র আমার মধ্যে চলে এসেছে এমনটা এখন আদৌ হয়না। কিশোর বেলায় অমন হয়েছিল। শরতচন্দ্রের শ্রীকান্ত, কিশোর শ্রীকান্ত শুধু আমার মধ্যে না আমাদের সমবয়সী আরো কয়েক জনের মধ্যে চলে এসেছিল। আমাদের সে কিশোর বয়সে আমরা তেমন সব দুর্দান্তপনা শুরু করেছিলাম। 

৭. একটি গল্পের কি কি বিষয় আপনাকে টানে? অর্থাৎ একটি ভালো গল্প হয়ে উঠতে হলে গল্পের মধ্যে কি কি বিষয় থাকা দরকার বলে মনে করেন? 

বনি আমিন : একটি গল্পের রসাবেদনটাই মূখ্য। গল্পটা পড়ে যদি আমার মধ্যে কোন অনুভূতির অনুরণন -যেমন কোন কেবলের মধ্যে হয় তেমন অনুভূতির অনুরণন যদি হয়, তাহলেই কেবল সে গল্পটি আমাকে টানে। বিষয়ের উপস্থাপন সেখানে জরুরী নয়, সে গল্প আমাকে কোন অনুভূতির রাজ্যে নিয়ে গেল কি না সেটাই হলো আমার সেই গল্পের প্রতি আগ্রহ বাড়ার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। অনেক সময় বিষয়টা পুরনো কিন্তু উপস্থাপন রীতির ভিন্নতার কারণে সে গল্প অন্যতর আস্বাদের হয়। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ-র নয়নচারা এবং অতি সম্প্রতি পড়া কুলদা রায়ের সুবল সখার বিয়ে বৃত্তান্ত-র বিষয় এক -দুর্ভিক্ষ। কিন্তু উপস্থাপন রীতির কারণে দুটোই আমার ভালা লাগা গল্পগুলোর মধ্যে অন্যতম।
মুক্তিযুদ্ধ একটি বিষয় বহু গল্প সে বিষয়কে নিয়ে লেখা হয়েছে। কিন্তু অনলাইন গল্পপাঠ সাইটে আহমদ মিনহাজ প্রোলোগ গল্পটি উপস্থাপন রীতির কারণে পেয়েছে নতুন মাত্রা। একটি গল্প ভালো হয়ে উঠতে হলে তার কার্যকারণ সূত্রটি জীবন সত্যের প্রেক্ষাপটে নির্মিত কিনা সেটাই আমার কাছে ভাল লাগার বিষয় হয়। ভাষার ক্ষেত্রে প্রাঞ্জলতা জরুরী, বাক্যের নির্মিতিতে কুশলতা অবশ্যই কাম্য। একঘেয়েমী বাক্যের গড়ন গল্পের মানকে নিম্ন স্তরে নিয়ে যায়। অনেকে গল্পের মধ্যে গীতিময়তা আনার চেষ্টা করেন। কিন্তু আমার কাছে সেটা বিসদৃশ বোধ হয়। গল্পের মধ্যে কাব্যিক ব্যঞ্জনা আমার ভালা লাগার বস্তু। 

৮. সে রকম গল্প কোন কোন গল্পকারের মধ্যে পেয়েছেন? কিছু গল্পের নাম বলুন। 

বনি আমিন : আমার ভাল লাগা গল্পের যে রুপরেখা দিয়েছি তা সম্পূর্ণ আমার নিজস্ব। অন্য কারো সেটা পছন্দ হবে বা সেটি কোন আদর্শ ফরমেট হবে সেটা আমি বলছি না। আমার ভাল লাগা গল্পকারের মধ্যে আমি উপরে এ জবাবে যে-সব গল্পকারের নাম উল্লেখ করেছি তারা সবাই। তবে বিশেষভাবে স্মরণীয় মানিক বন্দো্পাধ্যয় ( তাঁর প্রাগৈতিহাসিক ), হাসান আজিজুল হক ( তাঁর শকুন, জীবন ঘষে আগুন), কমলকুমার মজুমদার (তাঁর নীম অন্নপূর্ণা), আবু বকর সিদ্দিক (তাঁর মরে বাঁচার স্বাধীনতা), দেশ পত্রিকার অনেক গল্প নাম মনে করতে পারছি না, মশিউল আলম ( তাঁর মাংসের কারবার) কুলদা রায় (তাঁর পরী রাণীর সন্ধ্যা, সুবল সখার বিয়ে বৃত্তান্ত) সহ স্মৃতিতে আসেনা এমন আরো অনেক গল্প।

 ৯. কি কি কারণে কোনো গল্প মন্দ হয়ে ওঠে? এ রকম কি ঘটনা ঘটেছে যে এক সময় মনে হয়েছিল গল্পটি ভালো--পরে তা মন্দ লেগেছে?

বনি আমিন :  শুধু গল্প কেন যে-কোন সাহিত্য বা শিল্প মাধ্যম যখন কোন ইজম প্রচার করে, তখন তা আমার কাছে আপনি যা বলছেন ‘মন্দ’ তা হয়ে যায়। গল্পের ক্ষেত্রে মানুষের জীবনের যে রিয়ালিটি, সেটি বাদ দিয়ে যখন ইনিয়ে-বিনিয়ে গল্প বানানোর চেষ্টা করা হয়, তখন তা আমার ভাল লাগার বস্তু হয় না। বড় বড় ঘটনাগুলোকে গল্পের আঙ্গিকে ঠিক মানান সই হয় না। জীবনের ক্ষুদ্র পরিসরের ঘটনাগুলো যে-গুলো যত তুচ্ছই হোক সময়ের বাস্তবতাকে তুলে ধরে তাহলে সে গল্প মন্দ হতে পারে না। তবে শিল্প কাঠামোর একটা নিজস্ব আঙ্গিকগত সৌন্দর্য্য আছে গল্পের সেটি হলো তার ভাষা সেটি অবশ্যই সৌন্দর্য্যমন্ডিত হতে হবে, না হলে সে মন্দ হয়ে পড়বে। 

কোন ভাল প্রতিষ্ঠিত লেখকের সব লেখা যে সুন্দর হবে এমন কোন কথা নেই। মানিক বন্দ্যোপাধ্যয় তাঁর প্রথম দিককার লেখায় যে শিল্পকুশলতার পরিচয় দিয়েছেন, শেষ দিককার লেখায় সেটা দিতে পারেননি - সে হয়ে পড়েছে ইজম প্রচার মাত্র। আমি নন্দিত কথা সাহিত্যিক হুমায়ূন আহমদের নাম বুঝি উপরে উল্লেখ করেছি। তার শঙ্খনীল কারাগার বা নন্দিত নরকে যে শিল্প সুষমার দাবীদার তাঁর তাবত অন্য রচনাগুলোতে সে রকম ভাল লাগার কিছু দেখিনা। আমাদের একটা সমস্যা হলো - কেউ একজন দু’ একটি রচনা দিয়ে খ্যাতিমান হয়ে গেলে, সেই দিয়ে তিনি বাণিজ্যিক হয়ে যান। তখন আর কেউ তার রচনার শিল্প সুষমা নিয়ে তেমন বিচার বিশ্লেষণ করে না। সবার মধ্যে গল্প আছে। সে গল্পগুলো হয়ত অল্পতরে একটি দুটি গ্রন্থে বা গল্পে প্রকাশ পেয়েছে সেগুলোই হয়ত ভাল গল্প, খ্যাতিমান বা নন্দিতদের অজস্র গল্পের তুলনায় ভাল। 

১০. এ সময়ের কোন কোন গল্পকারের গল্প আপনি পড়েছেন বা পড়েন? সেগুলো কেমন লাগে? ভালো লাগলে কেনো ভালো লাগে? মন্দ লাগলে কেনো মন্দ লাগে? 

বনি আমিন :  আমার অবস্থানের কারণে জানাশোনা কম। হয়ত অনেকেই গল্প লিখছেন কিন্তু আমার তাদের গল্প পড়া হয়নি। অনলাইনের সৌজন্যে জানা-শোনা হচ্ছে। যেমন হলো কুলদা রায়ের গল্পের সঙ্গে পরিচয়। এবং তাঁর এ গল্পতেই কেমন যেন আমি তাঁর ফ্যান হয়ে গেলাম। জাকির তালুকদারের কদমচিলান পড়লাম কিন্তু সে আমার ততো ভাল লাগেনি। মনে হয়েছে ইনিয়ে-বিনিয়ে বানানো গল্প। সে তুলনায় কুলদা রায়ের সুবল সখার বিয়ে বৃত্তান্ত এবং জুতাপাখির সুতাকথা অনেক আনন্দ দিয়েছে।এ সময়ের অনলাইন ভিত্তিক সব গল্পকারের গল্প পড়ার প্রত্যাশায় আছি এবং পেলেই মনে ধরলে সব কাজ ফেলে সেটা পড়ে নেওয়ার চেষ্টা করি।

ধন্যবাদ অনেক গল্পপাঠ কর্তৃপক্ষকে।



পরিচিতি
বনি আমিন

জন্মস্থান: সাতক্ষীরা (সুন্দরবনের পাশ ঘেষে শেষ জনপদে) লেখাপড়া এবং বেড়ে ওঠা ওখানেই(মাধ্যমিক পর্যন্ত) এরপর খুলনা এবং রাজশাহী। 
কর্মস্থল: গোপালগঞ্জ--দিগনগর গ্রামে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ