শুধুমাত্র দৃশ্যায়নই একটা গল্পের শেষ কথা হতে পারে না

অনিল ঘোষ

গল্প লিখতে শুরু করলেন কেন?

অনিল ঘোষ : কেন গল্প লিখতে শুরু করলাম, এ কথার উত্তর এক কথায় দেওয়া মুশকিল।তবে এর একটা প্রেক্ষাপট আছে ।সেটা আগে বলা দরকার। আমি কখনও লেখক হব, লিখব, লিখতে পারব এটাই তো ভাবিনি।আমার মনে হয় পরিকল্পনা করে লেখক হওয়া যায় না।কেউ লেখক হয়ে জন্মায়ও না।লেখক একটা পথ, পদ্ধতি যা একটু একটু করে পার হতে হয় অথবা বলা যেতে পারে একটা ইমারতের মতো যা ধাপে ধাপে গড়ে ওঠে।

আজ যখন নিজের লেখাগুলোর দিকে ফিরে তাকাই, নিজেই অবাক হয়ে যাই।ভাবি, এগুলো কি আমার লেখা! আমি লিখেছি!বিশ্বাস করতে পারি না। এ যেন সেই কবিতাটার মতো-- যে লেখে সে কি আমি!ছেলেবেলার সেই দুরন্ত দস্যিপনার দিনগুলো মনে পড়ে। এমন কোনও দিন ছিল না যে, পাড়ার ছেলেদের সঙ্গে মারামারি করিনি বা গা হাত পা কেটেকুটে বাড়ি ফিরিনি। বাড়ির পাশে ছিল হাসপাতাল। সেখানকার লোকজনের কাছে আমি রীতিমতো জনপ্রিয় ছিলাম। তারা তো ছুরি কাঁচি বাগিয়ে ধরত আমাকে আচ্ছা করে মেরামত করবে বলে।বাড়ি ঢুকলে মায়ের হাতে লাঠি তো বাগানোই থাকত।মার খেয়ে খেয়েই বোধহয় শক্ত হয়ে গেলাম। তখন অস্তিত্ব রক্ষাই ছিল প্রধান।বেঁচে থাকারও কোনও নিশ্চয়তা ছিল না।সোনার চামচ মুখে দিয়ে তো জন্মাইনি।দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই তো ছিলই।তার সঙ্গে যুক্ত হল মাথা উঁচু করার লড়াই।দেখতাম উঁচু মাথা নিচু করার জন্য সবসময় ডাঙস বাগানো থাকত। এ যেন সেই ভিড় বাসে নিজে উঠে আর কেউ যাতে না উঠতে পারে তার জন্য রীতিমতো চিৎকার চেঁচামেচি জুড়ে দেওয়া। এ সমাজটাও যেন সেই ভিড় বাসের মতো। যারা ভালো থাকবে থাকবে, আর যেন কেউ সেখানে পা না বাড়াতে পারে তার জন্য ঠেলে ফেলে দেওয়ার ষড়যন্ত্র।তখন কোথায় লেখা, কোথায় সাহিত্য।রীতিমতো স্কুল পালানো ছেলে, পড়ায় অমনোযোগী। বইগুলো তখন কাগজের নৌকো। কালো কালো অক্ষরগুলো জলে ভেসে যেতে দেখতে বেশ ভালো লাগত।এই ছেঁড়াছেঁড়ির পরিণাম তো সুখকর ছিল না।এইভাবে কোনও রকমে ঠেলেঠুলে ওঠা।

ষাটের দশকে আমাদের ছোট্ট শহরে সূত্রপাত হল খাদ্য আন্দোলনের। চাল আর কেরোসিনের দাবিতে ছাত্র সমাবেশ। আমার বাড়ির কাছে জেলখানা, আদালত, প্রশাসনিক দপ্তর। বাড়ির পাশ দিয়ে বয়ে যাচ্ছে ইছামতী নদী। এইসব অঞ্চল সেদিন উত্তাল ছিল।আমি তখন খুব ছোটো। স্কুলের নিচু ক্লাসে পড়ি।এইসব বোঝার বয়স হয়নি। তবু তীব্র কৌতূহলে আর অ্যাডভেঞ্চারের নেশায় মিছিলের সঙ্গে পা মেলাই। ঢিল তুলে নিই হাতে। কাঁদানে গ্যাসে চোখ জ্বলে যাচ্ছে।লাঠি গুলি চলছে। আমার কান ঘেঁসে চলে গেল গুলি। চোখের সামনে একজনকে দেখলাম গুলি খেয়ে পড়ে যেতে। সেই ছেলেবেলা থেকেই খুন জখম রক্তের সঙ্গে আমার পরিচয়।এইসব দেখতে দেখতে আমি বেড়ে উঠেছি।চারপাশের জগৎটাও যেন ক্রমাগত পালটে যেতে লাগল।

তখনও গল্পের সঙ্গে পরিচয় হয়নি। তখনও লেখক পরিচয় থেকে আমি অনেক দূরে।।সেটা হল আমার দাদাকে দেখে। সে কবিতা লেখে। পত্রিকায় ছাপায়। লোকে বাহবা দেয়। আর আমার বুকের ভিতরে জ্বলে ঈর্ষার আগুন মনে হল আমি কেন পারব না? আমার কী কমতি আছে! পাড়ায় এল একটি সুন্দরী মেয়ে।তাকে ইমপ্রেস করার জন্য বন্ধুদের মধ্যে রীতিমতো প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গেল।কে কীভাবে তার মন জয় করতে পারে তার জন্য শুরু হয়েছে গোপন লড়াই। তখন আমার এমন কিছু নেই যা দেখিয়ে তার মন জয় করা যায়।সেইসব দিনে প্রচুর সিনেমা দেখতাম। পাড়ায় তা নিয়ে চর্চা হত।সিনেমা মানে গল্প। আর এই গল্পগুলো বলে সেই সুন্দরীকে অভিভূত করাই ছিল আমাদের লক্ষ্য।কিন্তু এটা ছিল সকলের মাঝে সকল হয়ে থাকা। আলাদা কিছু তো নয়। নিজের যদি কিছু না থাকে আমাকে আলাদা করে কেন পাত্তা দেবে সে? এইরকম অবস্থায় মনে হয়েছিল আচ্ছা ওকে যদি নিজের গল্প শোনাতে পারি, তবে তো দারুণ ব্যাপার হয়। যে ভাবা সেই কাজ।এখন লিখব তো কীভাবে লিখব! কোনও কিছুই তো জানি না।তখন তো পড়ার বইয়ের বাইরে কোনও গল্পই পড়িনি, আর ওই সিনেমার গল্পচর্চা। তবে গল্প শুনতাম খুব। শুনতে ভালো লাগত। কিন্তু লেখার ক্ষেত্রে সেগুলো কোনও কাজ দেবে না বুঝতে পেরেছিলাম।নিজের আলাদা হওয়ার নেশায় এবং সুন্দরীকে ইমপ্রেস করার চেষ্টায় এবার অন্য পথ ধরতে হল। স্কুলের ম্যাগোজিন বেরোবে, সেখানে ছাত্ররা লিখতে পারে। আমি দেখলাম এই তো সুয়োগ।এখানেই আমার প্রতিভার বিচ্ছুরণ ঘটানো যেতে পারে। তখন খুব ছোটোদের পত্রিকা পড়ি। সেখান থেকে একটা গল্প নিজের মতো করে সাজিয়ে গুছিয়ে ম্যাগাজিনে দিলাম।এবং অবাক কাণ্ড, ছাপা্ও হয়ে গেল।সেই প্রথম মুদ্রিত অক্ষরে আমার নাম ছাপা। দেখে রীতিমতো রোমাঞ্চিত, শিহরিত। কিন্তু যার কারণে আমার এই সাংঘাতিক কাণ্ড, প্রাণপাত পরিশ্রম--- সে কি না মুখ বেঁকিয়ে বলে বসল, দুর, এ তো টোকা গল্প!

ব্যস, প্রেমের সমাধি হয়ে গেল।কিন্তু একটা ব্যাপার ঘটল তখনই। আমার ভিতরে জেদের বীজ পোঁতা হয়ে গেল।দাঁতে দাঁত চেপে বললাম, এবার লিখেই দেখাব। এই জেদটা বোধহয় আজও চলে আসছে আর যখন কিছু পারব না, তখন লিখতে কেন পারব না! কিন্তু লিখতে গিয়ে দেখলাম কাজটা মোটেই সহজ নয়, রীতিমতো পরিশ্রমের। মন মেধা মনন সবই প্রয়োজন। আর তার জন্য পড়তে শুরু করলাম। গোগ্রাসে পড়েছি দেশি বিদেশি সাহিত্য, আর সেইসব অগাধ সমুদ্র থেকে মুক্তো খুঁজে আনার প্রাণপণ চেষ্টা।শুরুর সেইসব দিনগুলো ছিল নড়বড়ে, পলকা। যা দেখছি, অনেকটা তারই প্রতিফলন যেন লেখায় ঘটছে। কোনও মৌলিকতা নেই। কারও না কারও থেকে ধার করা। অথচ তখন মনে হত কী মহান সাহিত্যই না সৃষ্টি করছি।আজ সেসব পড়লে হাসি পায়। তবে শুরুর সেই দিনে একটা গল্পে কথা বলতেই হবে। গ্রামের রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলাম। খালপাড় দিয়ে যেতে যেতে হঠাৎ দেখলাম একটা লোক মরা গরু টানতে টানতে নিয়ে যাচ্ছে।আর গরুটার পিছনে পিছনে যাচ্ছে দুটো ক্ষুধাত’ কুকুর। সেটা ছিল ঝড় জলের সন্ধে। লোকটা কোনওদিকে দৃকপাত না করে নিজের কাজটা মন দিয়ে করছিল। লোকটাকে দেখতে আমার মাথায় বিদ্যুৎচমকের মতো একটা ভাবনা এল, আরে এ লোকটা তো দেখছি একজন লড়াকু সৈনিক।এই বিশাল রণক্ষেত্রে ওকে লড়তে হবে অনেক বাধা প্রতিরোধের বিরুদ্ধে। যে লড়াই আমাকে ছোটোবেলা লড়তে হয়েছে। কেউ জায়গা দেয়নি। ঠেলেঠুলে করে নিতে হয়েছে। লোকটাকে দেখে আমার নিজের প্রতিবিম্বটাই মনে পড়ল। কেমন একটা ঘোরের মধ্যে বাড়ি ফিরে লিখতে বসলাম। গল্পটার নাম ছিল রণক্ষেত্র। মহাশ্বেতা দেবীর পত্রিকা ‘বর্তিকা’-য় প্রকাশিত হয়েছিল। দিদি আমায় আশীর্বাদ জানিয়ে চিঠি দিয়েছিলেন। সেদিনই মনে হয়েছিল আমি পথ পাচ্ছি। শুরুতে এইরকম চমকই বোধহয় দরকার ছিল।

২. শুরুর লেখাগুলো কেমন ছিল?

অনিল ঘোষ :  শুরুর সেইসব লেখাগুলো তখন মনে হত এককথায় মহান। কী সাংঘাতিক সাহিত্য সৃষ্টি করেছি বলে মনে মনে আত্মশ্লাঘা অনুভব করতাম।যখন তো প্রচুর পড়তাম। যখন যাঁর লেখা ভালো লাগছে, তার অনুকরণে লিখে যাচ্ছি। কীভাবে তিনি লিখছেন, কোন শব্দ প্রয়োগ করছেন, চরিত্র কীভাবে আসছে—তার একটা পাল্টা প্রয়াস ঘটছে আমার লেখায়। আশ্চর্য ব্যাপার সেগুলো ছাপাও হচ্ছে। আজ সেগুলো যখন ফিরে পড়ি নিজেই লজ্জা পাই। কী অক্ষম অনুকরণ সেগুলো !!

গল্প লেখার জন্য কি প্রস্তুতি নিয়েছেননিলে সেগুলো কেমন?
 অনিল ঘোষ : শুধু গল্প কেন, সবকিছুরই একটা প্রস্তুতি থাকে। গল্পলেখাতেও থাকবে এটাই তো স্বাভাবিক। প্রথমে একটা স্বতঃস্ফূর্ততা থাকে। যেমন দেখছি, সেটাকে হুবহু ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা। অনেকটা ফোটোগ্রাফিক কায়দায় গল্প বলার চেষ্টা। এবং সবকিছুই সত্যি ঘটনা এমন একটা হাস্যকর দাবিকে জোর করে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা। এই ভাবনার বদল ঘটে পঠন পাঠনের মধ্য দিয়ে। শুধু গল্প উপন্যাস পড়া নয়, সাহিত্যের যে-কোনও শাখায় বিচরণের মধ্য দিয়ে ক্রমাগত উপলব্ধির চেষ্টা যে, শুধুমাত্র দৃশ্যায়নই একটা গল্পের শেষ কথা হতে পারে না। তখনই পড়াটা হয়ে গেল নিবিষ্ট ছাত্রের মতো। এক-একটা গল্প পড়ছি আর একাত্ম হয়ে পড়ছি। তখন যে গল্প পড়ি তার চরিত্র যেন আমি হয়ে যাই। আমিই যেন ওইসব কাণ্ড ঘটাই। যদি অপছন্দ হয় তবে তর্ক করছি গল্পের লেখক ও চরিত্রের সঙ্গে। পালটা চরিত্র খাড়া করে লড়াই লাগিয়ে দিচ্ছি। এগুলোও তো প্রস্তুতি। তবে এই সময়ে একটা কথা মনে হত যে, নিজের কথা বলার জন্যই তো লেখা। প্রত্যেক লেখকেরই একটা নিজস্বতা আছে। এখানে একজনের সঙ্গে আর একজনের মিল খুব কম। যেমন আমার প্রিয় লেখক বাংলা সাহিত্যের তিন বাঁড়ুজ্যে (বিভূতিভূষণ, তারাশঙ্কর ও মানিক)। এঁরা সমসাময়িক, কিন্তু একজনের সঙ্গে অপরজনের মিল খুব কম।তিনজনের স্থান সাহিত্যক্ষেত্রে বটগাছের মতো। অনেক প্রশ্নের উত্তর এঁদের থেকে পাওয়া যেত।তেমনভাবেই আন্তন চেখভের কাছেও পেয়েছি অনেক প্রশ্নের জবাব। এঁরা ছাড়াও দেখেছি, খুঁটিয়ে পড়েছি আরও অনেককে।একটা জিনিস লক্ষ করেছি লেখায় যদি দশ’নবোধ না থাকে, তবে সে লেখার জানপ্রাণ অকালে শুকিয়ে বুড়িয়ে যেতে বাধ্য। রবীন্দ্রনাথের অনেক গল্পে এই ছোঁয়া পেয়েছি। টলস্টয়ের ইভান ইলিচের মৃত্যু, কিংবা চেখভের ওয়াড’ নম্বর সিক্স পড়ে তো প্রায় পাগলই হয়ে গিয়েছিলাম। এরকম আরও অনেকের গল্প আছে যা আজও আমাকে তাড়িত করে। ভুলতে পারি না দস্তয়েভক্সি, কাফকা, কার্পেন্তিয়ের, মার্কেজ, কুন্দেরা, সারামাগোর গল্প। এরকম নাম করতে বিশাল হয়ে যাবে। তার প্রয়োজনও নেই বোধহয়। মোটকথা এঁরা আমাকে প্রতিদিন প্রতিমুহূর্তে চালিত করেছে। এইসব ধার করা বিদ্যে প্রয়োগ করেছি নিজের উপর, নিজের লেখার উপর। তবে যে দশ’নবোধের কথা বললাম, সেটা পেয়েছিলাম গ্রামের তথাকথিত আনপড় এক মানুষের কাছে।তার কথা সংক্ষেপে বলছি। মানুষটার নাম মস্তান গাজি। খুব ছোটোবেলায় তাকে যখন দেখেছিলাম, সে ছিল একটা ছিঁচকে চোর। লোকের বাড়ি থালা-ঘটি-বাটি চুরি করে বেড়াত। মারধোর খেত।পুলিশ ধরত আবার ছেড়েও দিত।এই মানুষটাকে কিছুকাল পরে দেখলাম হাটে বসে মাংস কাটছে। ততদিনে আমার সঙ্গে আলাপ হয়েছে। ওর মুখে আমি হলাম কুটুম্ব।কারণ ওই গ্রামে ছিল আমার দিদির বাড়ি। সেই সুবাদে আমি সকলের কুটুম্ব। তা সেদিন মস্তান গাজি বলেছিল, বুইলে কুটুম্ব, পথ খুঁজছি।কী পথ, কেমন পথ—জিজ্ঞাসার উত্তরে হেসেছিল শুধু। বেশ কয়েক বছর পরে তাকে দেখলাম সাইকেল করে চালানি মাল নিয়ে হাটে যেতে। আমায় দেখে হেসে বলেছিল, পারাপার করছি গো কুটুম্ব, তবু কূল পেলাম না। শেষ যেবার দেখলাম, তখন সে বুড়ো। প্রায় ফকিরের মতো বেশবাস। লাঠি ঠুকঠুকিয়ে চলে যাচ্ছে মাঠ পেরিয়ে। আমায় দেখে বলেছিল, বুইলে কুটুম্ব সেই কোন কাল থেকে পথ খুঁজতিছি, পথটা কেউ বুল্যে দেয় না গো।

সেদিন মস্তান গাজি আমায় এক বিরাট জিজ্ঞাসার সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল। সত্যি, আমরা সবাই তো পথ খুঁজে বেড়াই। আদৌ পথ পাই কি? শুধু খুঁজেই চলি।এই জিজ্ঞাসা নিয়ে পরবর্তীকালে একটা গল্প লিখেছিলাম—মহিষ সংক্রান্ত একটি অপ্রাচীন গল্প। সেখানে এক রাখাল বালক মহাজনের মোষ চরাতে নিয়ে পথ হারিয়ে ফেলেছিল। কিন্তু ফেরার পথ আর পাচ্ছিল না। আকুল হয়ে সবাইকে জিজ্ঞেস করছিল, আমার পথট বুল্যে দ্যাও গো—

সেই পথ তো আমিও খুঁজছি।

আপনার গল্পলেখার কৌশল বা ক্রাফট কি? 

অনিল ঘোষ :  গল্পের বিষযটাকে পরিষ্কার করে বলাই হল মূল লক্ষ্য। এজন্য গদ্যভাষায় কোনও জটিলতা আনতে চাই না। লেখালেখির ভুবনে যে দু-একজন মানুষ আমার ফ্রেন্ড-ফিলজফার অ্যান্ড গাইডের ভূমিকা নিয়েছেন, তাঁরা প্রত্যে্কেই একটা কথা বলেছেন, গদ্যভাষা হওয়া উচিত সোজা আর স্পষ্ট (স্ট্রেট অ্যান্ড ডিরেক্ট)। জীবন জটিল হতে পারে, সময়ে চেনা অচেনা আঁকিবুকি থাকতে পারে, কিন্তু তার প্রকাশ ভঙ্গিমায় কখনও ঘোলাজলে ঘূর্ণিপাক থাকা উচিত নয়। কেননা সাহিত্যের প্রথম শত’ হল আনন্দদান। মানূষ গল্প শুনতে ভালোবাসে। পড়তে ভালোবাসে। আর আমাদের দেশ তো গল্পের খনি। সেই পঞ্চতন্ত্র, কথাসরিৎসাগর, বেতাল পঞ্চবিংশতি—সবই তো গল্প।এই দেশের হাওয়ায়, প্রতিটি ধূলিকণায় ছড়িয়ে আছে গল্প। তাকে শুধু পাঠকের দরবারে পৌঁছে দেওয়া দরকার। এখন যদি পাঠক পড়তে গিয়ে ক্রমাগত ভাষার জটিলতায় হোঁচট খায়, তবে সাহিত্যের আবেদনটাই পথ হারিয়ে ফেলবে। আনন্দের মধ্য দিয়েই তো পাঠককে ভাবাতে হবে, কাঁদাতে হবে, হাসাতে হবে। এজন্য গল্প লিখতে বসে কখনও সংগীতের আশ্রয় নিতে হয়, কখনও কবিতা, কখনও কথকতা, মিথ, প্রচলিত কথা কাহিনি, কিংবদন্তী—এসব নিয়ে আসতে হয়। প্রসঙ্গক্রমে বলি, সুন্দরবনের পটভূমিকায় আমি একটি গল্পের সিরিজ লিখেছি। লৌকিক আঙ্গিকে সুন্দরবনের ইতিহাস, মূলত মানুষের কথা, তার জীবন সংগ্রাম এসবই প্রকাশ করতে চাইছি একটি চরিত্রের মাধ্যমে। তার নাম বাঘাচাঁদ। এই সিরিজ লিখতে গিয়ে আমার প্রথমেই নজরে পড়ে, সুন্দরবনের জনপদে বিভিন্ন দেবদেবীর নামে যে সব থান আছে, সেইসব থান জাগানোর জন্য গান গাওয়া হয়। গোটা অগ্রহায়ণ মাস জুড়ে গ্রামের মানুষ মূলত মহিলারা এই গান গেয়ে থাকেন। এই মহিলারা কেউই শিক্ষিত নন। কিন্তু মুখে মুখে গান বাঁধতে দক্ষ এঁরা।সেইসব গানে থাকে যেমন দেবতার মাহাত্ম্য কীত’ন, তেমনই সেই গ্রামের ইতিহাস, অবস্থার বর্ণনা, বিভিন্ন মানুষের কথা, সুখ দুঃখ ভালো মন্দ হাসি কান্না গভরতা আদি রসাত্মক চটুলতা সবই সেই গানে স্থান পেয়ে যায়। আমার বাঘাচাঁদ সিরিজ এই থান জাগানিয়া গানের আঙ্গিকেই ভেবেছি। সেখানে কথা গান কাহিনি কিংবদন্তী সব্ই আছে লৌকিক আদলে। গল্পের রীতি কৌশল হিসেবে এটা আমার খুব প্রিয়।

আপনার নিজের গল্প বিষয়ে আপনার নিজের বিবেচনা কি কি

 অনিল ঘোষ : আমার গল্প, বুঝতে পারি এখনও সেভাবে দানা বেঁধে ওঠেনি। যা বলতে চেয়েছি, যেভাবে বলতে চেয়েছি, সেটা বোধহয় এখনও আয়ত্তে আসেনি। তবে চেষ্টা করি যেটুক লিখব, সেটা যেন সততার সঙ্গে পাঠকের দরজায় পৌঁছে যায়।

আপনার আদর্শ গল্পকার কে কেকেনো তাঁদেরকে আদর্শ মনে করেন?

অনিল ঘোষ : প্রথমেই উল্লেখ করেছিলাম বাংলা সাহিত্যের তিন বাঁড়ুজ্জের (বিভূতিভূষণ, তারাশঙ্কর, মানিক)কথা। এঁরা জগৎ ও জীবনকে যেভাবে দেখেছেন, তার সঙ্গে আমি যেন একাত্ম হতে পারি। তবে যে দুজন গল্পকার আমাকে সবচেয়ে বেশি আলোড়িত করেছেন, তাঁরা হলেন হাসান আজিজুল হক এবং অমর মিত্র। আমার গল্প-জীবনের প্রথম পর্বে হাসান আজিজুল হকের আত্মজা ও করবী গাছ এবং অমর মিত্রের মাঠ ভাঙে কালপুরুষ না পড়লে বোধহয় আমি গল্প লিখতেই পারতাম না। এঁরা আমাকে ক্রমাগত শিখিয়েছেন কীভাবে গল্প লিখতে হয়, কীভাবে বিষয়কে গদ্যভাষার মাধ্যমে প্রকাশ করতে হয়। অনেকটা একলব্যের নিষ্ঠার মতো এঁদের আঙ্গিক শৈলী ভাষা বিন্যাস আমি অনুধাবন করে গেছি।সেই অর্থে এঁরা আমার আদশ’।

কার জন্য গল্প লেখেনআপনি কি পাঠকের কথা মাথায় রেখে লেখেনলিখলে কেনো লেখেন?আর যদি পাঠকের কথা মনে না রেখে লেখেন তাহলে কেনো পাঠককে মনে রাখেন না লেখার সময়ে? 

অনিল ঘোষ : অবশ্যই পাঠকের কথা ভেবেই লিখি। এ ব্যাপারে আমার অন্তত কোনও দ্বিমত নেই। কেন না আমি মনে করি নিজস্ব দুঃখ কষ্টের কোনও ভাগ হয় না, কিন্তু আনন্দ সকলের সঙ্গে ভাগ করে নেওয়া উচিত। অন্য কোনওভাবে সেই আনন্দ যখন দিতে পারছি না, একটু-আধটু কলম যখন ধরতে পারছি, আমি নিজে যা উপলব্ধি করতে পারছি, তাকে কেন পাঠকের সভায় পৌঁছে দেব না !!

এখন কি লিখছেন? 

অনিল ঘোষ : 
একটু আগে যে বাঘাচাঁদ সিরিজের কথা উল্লেখ করলাম, সেটি আর তিনটি গল্প লিখলে শেষ হবে মনে হয়। সেটাই এখন লেখার চেষ্টা করছি।আর লিখছি উপন্যাস। সুন্দরবনের গ্রামীণ জনপদে দেশীয় ঘোড়াদৌড় খুবই জনপ্রিয় খেলা। এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে জমিভূমির ইতিহাস। শহর সংস্কৃতির সঙ্গে সংঘাতে ক্রমশ পালটে যাওয়া গ্রাম, গ্রামীণ মানসিকতার চিত্রাবলি।এই বিষয়টাকে নিয়ে লেখা শুরু করেছি। 

আগামী কি লিখবেন? 

অনিল ঘোষ : এখনও বর্তমানেই আছি।যে লেখাগুলোর কথা উপরে উল্লেখ করলাম, সেগুলোই শেষ করাই হবে আমার কাজ। পরবর্তী ভাবনা পরবর্তীকালে ভাবা যাবে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ